আপনার সংস্কৃতি যাই হোক শিশুকে শাস্তি দিলে রেহাই পাবেন না

জানুয়ারী ১০ ২০২০

শিশু লালন-পালনে বিভিন্ন সংস্কৃতিতে ভিন্ন ভিন্ন রীতিনীতি আছে। সেজন্যে নবাগতদের এদেশে থিতু হতে সহায়তাকারী সংস্থাগুলোর দায়িত্ব হলো তাদেরকে শিশুদের শাস্তিদান সম্পর্কিত কানাডার আইন বোঝার মত তথ্য সরবরাহ করা।
গ্রেটার মঙ্কটন অঞ্চলের মাল্টিকালচারাল অ্যাসোসিয়েশনের (MAGMA) জনসংযোগ বিষয়ক সমন্বয়কারী জাস্টিন রাইয়ান এ বিষয়ে চরম উদাহরণ হিসাবে ব্রাজিলের একটি উপজাতীয় গোষ্ঠীর বালকদের ক্ষেত্রে আচরিত একটি রীতির উল্লেখ করেন। সেই গোষ্ঠীতে বালকদের হাতে একটি ঘাসের তৈরি গ্লাভস বা দস্তানা পরিয়ে দেওয়া হয়। তারপর তার হাতে বুলেট পিঁপড়া দিয়ে কামড় দেওয়ানো হয়। এটি এমন এক পিঁপড়া যার কামড় গুলির আঘাতের মতই তীব্র। কিন্তু এর কামড় খেয়েও বালকটি কাঁদতে পারবে না।
রাইয়ান বলেন, “এখানে এটি হবে শিশু নির্যাতনের সবচেয়ে বড় অপরাধ। কিন্তু ওখানে এটি হলো একটি বালকের প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার প্রক্রিয়া। আমি যদি আমার সন্তানের সঙ্গে এই আচরণ করি তাহলে তারা (সরকার) তাকে আমার কাছ থেকে নিয়ে যাবে।”
কানাডায় নবাগত অভিবাসীদের রীতি হয়তো শিশুদের শারীরিক শাস্তিদান সম্পর্কিত আইনের ৪৩ অনুচ্ছেদের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হতে পারে। সরকার ট্রুথ অ্যান্ড রিকনসিলিয়েশন কমিশনের সুপারিশের ভিত্তিতে গত বছর ওই অনুচ্ছেদ রদ করতে সম্মত হয়েছিলো। তবে রাইয়ান উল্লেখ করেন যে, ওই অনুচ্ছেদের সঙ্গে নবাগতদের রীতি সাংঘর্ষিক হবার কারণ মূলত এই যে তারা সম্পূর্ণ ভিন্ন সাংস্কৃতিক পটভূমি থেকে এখানে আসেন। অনেকে আসেন সম্পূর্ণ পিতৃতান্ত্রিক সমাজ থেকে যেখানে তেমন কোনও সামাজিক অবকাঠামো নেই এবং পারিবারিক সহিংসতার ঘটনা খুব সাধারণ বিষয়।
যেমন অনেক সংস্কৃতিতে মুখের ওপর কথা বলা, কাজ গুছিয়ে না করা অথবা যথেষ্ট বাধ্য না হওয়ার কারণে একজন বাবা তার সন্তানকে চপেটাঘাত করতে পারেন এবং সেখানে এটা গ্রহণযোগ্য।
রাইয়ান বলেন, অভিবাসীদের কাছ থেকে এ বিষয়ে সবচেয়ে বেশি যে প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায় সেটি হলো তাদের বিস্ময়। তারা বিস্মিত হয় যে, শিশুকে শারীরিক শাস্তি দেয়ার বিরুদ্ধেও এখানে আইন আছে এবং সরকার সে আইন কার্যকরে সক্রিয়।
তিনি ব্যাখ্যা করে বলেন, কোনও উন্নয়নশীল দেশে এধরণের সামাজিক অবকাঠামো খুব কমই থাকে। সেখানে হয়তো এমন আইন থাকতে পারে যে অভিভাবকরা শিশুকে মারধর করতে পারবে না, কিন্তু তা কার্যকর করার ব্যবস্থা খুব কমই থাকে।

শিশু শাসনের জন্য কানাডায় রয়েছে আইন। অভিবাসীদের উচিৎ তা অনুসরণ করা। ছবি: study.com

কানাডার আইন বোঝা খুবই জরুরী

শিশুদের সঙ্গে বাবা-মার আচরণগত ব্যবস্থাপনা নিয়ে ৩৩ বছরের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন সমাজকর্মী গ্যারি ডিরেনফেল্ড বলেন, অনেক অভিবাসী এমন সব দেশ থেকে আসেন যেখানে শ্রদ্ধা প্রদর্শন, বিশেষ করে বয়স্কদের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনকে খুবই গুরুত্ব দেওয়া হয়।
তিনি ব্যাখ্যা করে বলেন, “এধরণের শ্রদ্ধা আসে প্রশ্নাতীত অবস্থান থেকে, যেখানে আমরা আশা করি যে, বয়স্করা যা বলেন শিশু সেটাই ভাববে এবং অনুসরণ করবে, তাহলেই সবকিছু ঠিক। এর বিপরীতে কানাডার সংস্কৃতিতে ব্যক্তি-স্বাতন্ত্র্য ও স্বাধীনতার বিষয়টি অধিকতর মূল্যায়ন করা হয় এবং প্রায়শ শিশুরা এই মূল্যবোধেই প্রভাবিত হয়। অবশ্য তাদের বাবা-মায়েরা হয়তো এমন কোনও দেশ থেকে এসেছেন যেখানে শারীরিক শাস্তি দেয়ার অনুমোদন আছে এবং যৌক্তিক বলে মনে করা হয়।
অন্টারিওর ডুনডাস-এ কর্মরত ডিরেনফিল্ড ব্যাখ্যা করেন যে, “কানাডার পরিপ্রেক্ষিতে শিশুরা তাদের অধিকার ও স্বাধীনতা সম্পর্কে শিক্ষা লাভের পর তারা হয়তো শারীরিক শাস্তির বিষয়ে অভিযোগ করতে পারে এবং তখনই বাবা-মাকে শিশুর সুরক্ষা বিষয়ক পরিষেবা সম্পর্কে সচেতন করা হয়।”
তিনি বলেন, “আপনি যদি কোনও যুদ্ধ-বিধ্বস্ত দেশ থেকে এসে থাকেন যেখানে মানুষ রাজনৈতিক কাঠামো ও প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে ভীতির মধ্যে থাকে, তাহলে শিশুর সহায়তাকারীদের আপনার ঘরে আসছে এই চিন্তাটাও ভীতির চেয়ে বেশি কিছু হয়ে ওঠে।”
ডিরেনফিল্ড বলেন, “শিশুর ওপর নির্যাতন করা হচ্ছে এমন আশঙ্কা থেকে চিলড্রেন্স এইড সোসাইটির কর্মীদের বাসায় আগমন ওই পরিবারগুলোর জন্য যতই বিব্রতকর হোক না কেন সেটাও বহুগুণ বেড়ে যাবে যদি তারা বাবা-মার ওপর আস্থা ও বিশ্বাস নেই বলে ঘোষণা করে।”
তিনি বলেন, শারীরিক শাস্তি সম্পর্কিত বিষয়টি স্থানীয় কানাডীয়রা যতটুকু উপলব্ধি করে তার চেয়েও গভীর এবং ব্যাপকতর। নতুন অভিবাসীদেরকে কানাডার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেয়ার জন্য সেটেলমেন্ট বিষয়ক সংগঠনগুলোর উচিৎ তাদেরকে আমাদের শিশু প্রতিপালন সম্পর্কিত উদ্যোগ উপলব্ধি করতে সহায়তা করা।
রাইয়ান বলেন, “সন্তান লালন-পালনের বিষয়ে আন্তঃসংস্কৃতি পরিপ্রেক্ষিত যদি দেখেন তাহলে এটি অনেক বেশি অস্পষ্ট, অনেক বেশি গতিবেসম্পন্ন মনে হবে যার অর্থ হলো, আমাদেরকে সংশ্লিষ্ট লোকেদের সঙ্গে যোগাযোগ করা ও তাদেরকে কানাডার আইন কতটা জটিল সে সম্পর্কে বোঝানোর জন্য আরও ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করতে হবে।”

অনুবাদে বিভ্রাট

রাইয়ান উল্লেখ করেন যে, অভিবাসীদের ক্ষেত্রে যেমনটা ঘটে, সামাজিক পরিষেবা সম্পর্কে তাদের সঙ্গে যোগাযোগের ক্ষেত্রে ভাষাও একটি বাধা হয়ে দাঁড়ায়। এই বাধা সূক্ষè অথচ গুরুত্বপূর্ণ প্রভেদগুলো বুঝে ওঠা অসম্ভব করে তুলতে পারে।
তিনি বলেন, এই বাধার একটি ভালো উদাহরণ হলো, যখন তাদের জিজ্ঞাসা করা হয় যে, “সন্তানকে শৃক্সক্ষলার মধ্যে নিয়ে আসার জন্য কী করেন” তখন তারা হয়তো জবাব দেন, “তাদেরকে প্রহার করি”, এর মাধ্যমে তারা বোঝাতে চান যে, “আমি তাদের চড়-চাপড় দিই।”
“তারা আসলে কিভাবে সন্তানকে শাসন করেন, যথাযোগ্য শব্দে সেই বিবৃতি দেবার মত ভাষাজ্ঞান তাদের নেই।”
সব বাবা-মা যাতে শিশুর যত্নে কানাডার মানটা বুঝতে পারে সেই লক্ষ্যে কাজ করছে ম্যাগমা (MAGMA)। সাম্প্রতিক শরণার্থী জোয়ারের কারণে এই ব্যাপারটা সুনির্দিষ্ট করে শরণার্থীদের ক্ষেত্রেই ঘটে সবচেয়ে বেশি। এই ইস্যুর কার্যকর সমাধানের জন্য শিশু সুরক্ষা পরিষেবার পক্ষ থেকে অভিবাসীদের জন্য গ্রুপভিত্তিক জমায়েতের আয়োজন করা হয়। এতে শিশুদের শাসন করার জন্য কানাডায় গ্রহণযোগ্য ব্যবস্থা সম্পর্কে ব্যাখ্যা করে বোঝানো হয়। রাইয়ান বলেন, “আমাদের প্রাথমিক লক্ষ্য হলো উদ্দীষ্ট লোকেরা এদেশে আসামাত্র তাদেরকে কানাডার যথাযথ মূল্যবোধ সম্পর্কে নির্দেশনা দেওয়া। বিশেষ করে এখানকার যেসব আইনের কারণে তাদেরকে অসুবিধায় পড়তে হতে পারে সে সম্পর্কে নির্দেশনা দেওয়া।”
৪৩ অনুচ্ছেদ বাতিলের প্রভাব হবে এমন যে, সন্তানকে শারীরিক শাস্তি দেওয়ার মত ঘটনাও কার্যত ফৌজদারি অপরাধ হিসাবে গণ্য হবে। সেক্ষেত্রে ম্যাগমার মত সংগঠনগুলোকে তাদের মক্কেলদের বোঝানোর কাজে আরও বেশি সক্রিয় হতে হবে।
রাইয়ান ব্যাখ্যা করে বলেন, “ওই উপলব্ধির একটি অংশ হলো এই যে, কানাডার সরকার অন্য বেশিরভাগ দেশের চেয়ে পারিবারিক গতিশীলতার ব্যবস্থাপনায় অধিকতর জোরালোভাবে সংশ্লিষ্ট। সাধারণভাবে অন্য দেশগুলোতে সরকারগুলো এধরণের ব্যক্তিগত বিষয়ে খুব বেশি ভূমিকা রাখে না। সেজন্যে অভিবাসী পরিবারগুলোর জীবনে কানাডার সরকারের সরাসরি জড়িত হওয়ার প্রশ্নটি আসলে উভয় পক্ষের বোঝাপড়ার বিষয়।”
-সৌজন্যে : নিউকানাডিয়ানমিডিয়া.সিএ