মিসিসাগাায় মুসলিম দম্পতির উপর বিদ্বেষপ্রসূত হামলা
‘ঘৃণা এখনও টিকে আছে এখানে’: হামলার পর বললেন প্রহৃত ব্যক্তির স্ত্রী
আগস্ট ৪, ২০১৮
১৮ জুলাই ২০১৮ : এটা হতে পারতো বন্ধুদের সঙ্গে বাইরে বেড়ানোর একটি শান্তিপূর্ণ গ্রীষ্মের সন্ধ্যা। কিন্তু হঠাৎ করেই মিসিসগার একজন বাসিন্দাকে মারাত্মকভাবে পেটানোর ঘটনায় পুরো ব্যাপারটি হয়ে ওঠে ভীতিকর এক অভিজ্ঞতা। যাকে পেটানো হলো তিনি দুই সন্তানের বাবা। হামলার শিকার হয়েছেন ঐ ব্যক্তির স্ত্রীও। পিল অঞ্চলের পুলিশ বিভাগ বলছে, বিদ্বেষপ্রসূত এই হামলার ঘটনাটি তারা তদন্ত করে দেখছে। খবর সিবিসি নিউজের।
মোহাম্মদ আবু মারজুক (৩৯) নামের প্রহৃত ব্যক্তির স্ত্রী দিয়ানা আত্তার সিবিসি নিউজকে দেওয়া বিশেষ সাক্ষাৎকারে বলেন, রবিবার সন্ধ্যায় মিসিসগার ভ্যালি কমিউনিটি সেন্টারে পরিবারের সঙ্গে পিকনিক করার পর তারা বাড়ি ফিরছিলেন। তখন তার গাড়ির পেছন দিয়ে দুজন লোক হেঁটে যেতে যেতে চিৎকার করছিলো, “f–king এরাবিয়ান! সন্ত্রাসী!”
দুই ব্যক্তি আবু মারজুকের গাড়িতে লাথি মারে এবং বলতে থাকে, “তুমি আমাদের দেখতে পাওনি!” এদিকে পুলিশ বলছে, সহিংসতা শুরুর আগে মারজুকের গাড়ি কাউকে ধাক্কা দিয়েছে এমন কোনও প্রমাণ তারা পাননি।
আবু মারজুক লোক দুটির সঙ্গে কথা বলার জন্য গাড়ি থেকে নেমে আসেন। আত্তার বলেন, গাড়ি থেকে নামতেই একজন লোক মারজুকের মুখে ঘুষি মারে। ওই রাতে পিকনিকে অংশ নেওয়া মারজুক দম্পতির একজন বন্ধু লোক দুটিকে থামানোর জন্য এগিয়ে যান। তাকেও প্রহার করে লোক দুটি। তিনি সামান্য আহত হন।
আত্তার সেই সময়ের স্মৃতিচারণ করে জানান, তিনি লোকদুটির কাছে বারবার নিবেদন করছিলেন, “প্লিজ আমার স্বামীকে মারবেন না। আমার দুটি ছোট মেয়ে আছে, আমার স্বামীকে মারবেন না।
তিনি কাছেই একটি পুলিশের গাড়ি দেখে সাহায্যের জন্য ছুটে যান। তিনি যখন ফিরে আসেন ততক্ষণে তার স্বামীকে পিটিয়ে মাটিতে ফেলে দিয়েছে হামলাকারীরা। তার কান দিয়ে রক্ত বেরুচ্ছে এবং মাথার পাশটা রক্তে ভেসে যাচ্ছে। কিছু সময়ের মধ্যে মারজুক জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন এবং আত্তার তার স্বামীর জীবনের জন্য প্রার্থনা করতে থাকেন।
তিনি বলেন, তিনি যখন তার স্বামীকে ধরার জন্য নিচু হয়েছেন তখন লোক দুটি তাকেও লাথি মারে।
মারজুককে এরপর দ্রুত হাসপাতালে নেওয়া হয়। তার মুখের আশেপাশে বেশ কয়েকটি হাড় ভেঙ্গে যায় এবং মস্তিস্কে রক্তক্ষরণও হয়। তাকে সঙ্গে সঙ্গে অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যাওয়া হয় এবং আত্তার জানান, ডাক্তাররা মারজুকের মস্তিস্কে রক্তক্ষরণ বন্ধ করার জন্য তার “মাথার খুলির একটি অংশ খুলে ফেলেন।” তাকে কৃত্রিম শ্বাসযন্ত্র লাগিয়ে দেওয়া হয়।
আত্তার বলেন, পুরো সময় ধরেই তার চার ও ছয় বছরের মেয়ে দুটি তাকে বারবার জিজ্ঞাসা করছিলো, তাদের বাবা কী মরে গেছে? তারা কী আর তাকে দেখতে পাবে?
পুলিশ এখন এটিকে ঘৃণাবশত হামলার ঘটনা হিসাবে বিবেচনা করছে
ওই ঘটনার জন্য ব্রাম্পটনের ১৯ ও ২৭ বছর বয়সী দুই ভাইকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে প্রথম মাত্রার উস্কানিমূলক আঘাত হানা এবং দ্বিতীয় মাত্রার আঘাত করার অভিযোগ আনা হয়েছে। সোমবার সকালে দুই ভাই আদালতে হাজির ছিলো।
প্রাথমিকভাবে পিল-এর আঞ্চলিক পুলিশ এটিকে নিছক একটি রাস্তার ঝগড়া হিসাবে গণ্য করছিলো। তবে মঙ্গলবার রাতে পুলিশি তথ্যের ভিত্তিতে সেটি পরিবর্তন করে এখন এটিকে একটি ঘৃণাবশত হামলার ঘটনা হিসাবে তদন্ত করা হচ্ছে।
পুলিশের মুখপাত্র অখিল মুকেন বলেন, “আমরা এমন তথ্য পেয়েছি যে প্রাথমিকভাবে ঘটনাটি শুরু হয় রাস্তার ঝগড়ার মধ্য দিয়ে, পার্কিং লটে একটি ব্যাপারে বিরোধকে কেন্দ্র করে সেটি ঘটে। এর পর পরই প্রত্যক্ষ্যদর্শীরা এগিয়ে আসেন। তারা তদন্তকারীদের সঙ্গে কথা বলেন এবং তাদের কাছে ঘটনা সম্পর্কে বিবৃতি দেন। এতে গ্রেফতারকৃত ও অভিযুক্ত দুজনের হামলা সম্পর্কে তথ্য ছিলো।”
ঘটনার সময় সেখানে হস্তক্ষেপ করা মারজুকের বন্ধু ফুয়াত ইউসেল বলেন, তিনি রবিবার রাতে যে ঘটনা দেখেছেন এমন কোনও কিছু আগে কখনও দেখেননি। তিনি বলেন, “আমি ৩৯ বছর ধরে এই দেশে রয়েছি, কিন্তু আমি কখনই এধরণের ঘটনার মুখোমুখি হইনি… এ ব্যাপারে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। এটি একটি বিদ্বেষপ্রসূত হামলা। এটা ‘ইসলামোফোবিয়া’। এটা এখনও টিকে আছে।”
মারজুকের পরিবার যেখানে নামাজ আদায় করে সেই দার আল তাওহীদ মসজিদের ইমাম হলেন ইব্রাহিম হিন্দি। তিনি বলেন, “আমার বাচ্চারা তার বাচ্চাদের সঙ্গে খেলাধুলা করে।” তাই তিনি মারজুকের হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার কথা শুনেই সেখানে ছুটে যান তাকে দেখতে। ইমাম হিন্দি বলেন, “তাকে কী ভয়ানকভাবে পেটানো হয়েছে সেটার মাত্রা আমি বুঝতে পারি না।”
পুলিশ ঘটনাটিকে ঘৃণাবশত হামলার ঘটনা হিসাবে তদন্ত করছে এই খবরকে স্বাগত জানিয়ে তিনি উল্লেখ করেন যে, গত বছর পিল অঞ্চলে মুসলমানদের বিরুদ্ধে ঘৃণাবশত হামলার ঘটনা ৯১ শতাংশ বেড়েছে।
ইমাম হিন্দি বলেন, “তারা এদেরকে বলছিলো আরব সন্ত্রাসী বলে, সুতরাং এটা স্পষ্ট যে, এই হামলার পেছনে তাদের ধর্ম, তাদের জাতিগত পরিচয়ের ভূমিকা রয়েছে। যে কোনও সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে এধরণের ঘৃণার ব্যাপারে আমাদের উদ্বিগ্ন হওয়ার কারণ রয়েছে, তবে যা ঘটছে সেটা একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।”
তিনি আরও বলেন, “একটি সমাজ হিসাবে আমাদেরকে স্বীকার করে নিতে হবে যে, এখানে ঘৃণাবোধের অস্তিত্ব রয়েছে। এই হামলার ঘটনায় ঘৃণা থেকে উদ্বুদ্ধ হওয়ার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উপাদান রয়েছে এবং এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য এটির অস্তিত্ব স্বীকার করার প্রয়োজন রয়েছে।
মারজুকের স্ত্রী আত্তারের অবস্থা এখনও নাজুক। স্বামীকে লাথি মারার দৃশ্য বার বার তার মানসপটে ভেসে ওঠে আর তার মাথার চারপাশে জমে ওঠা রক্তের ঘ্রাণ এখনও তার মনে পড়ে।
কি কারণে এই হামলা হলো সেটা নিয়ে আত্তার এখনও বিস্ময়ের মধ্যে রয়েছেন। তিনি যখন জানালা দিয়ে বাইরে তাকার তখন তার হিজাব দেখে কি লোকগুলো ক্ষিপ্ত হয়েছিলো?
আত্তারের ভাষায়, “যদি পুলিশ এগিয়ে না আসতো তাহলে আমি হয়তো তাকে হারাতাম, হয়তো তাকে হারাতাম… কোনও কারণ ছাড়াই।”