কানাডীয় মুসলিমদের কেউ কেউ যুক্তরাষ্ট্রে ঢুকতে পারছেন না

অক্টোরবর ৯, ২০১৯

সম্প্রতি কানাডার বেশ ক’জন মুসলিম কানাডা-যুক্তরাষ্ট্র সীমান্ত থেকে ফিরে এসেছেন। তাদেরকে যুক্তরাষ্ট্রে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। অভিবাসন বিষয়ক আইনজীবীরা একথা জানান।

যাদেরকে যুক্তরাষ্ট্রে ঢুকতে দেওয়া হয়নি তাদের মধ্যে গায়ানায় জন্মগ্রহণকারী টরন্টোর একজন বিশিষ্ট ইমামও আছেন যিনি পিল আঞ্চলিক পুলিশের চ্যাপলিন (ইমাম) হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়াও আছেন ইরাকের তুর্কি সম্প্রদায়ের একজন নেতা যার পরিবারের সদস্য ইরাকে আইএস-এর বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন। খবর সিবিসি নিউজের।

ওই দু’জন একসঙ্গে ভ্রমণ করছিলেন না, তাদেরকে ভিন্ন ভিন্ন সীমান্ত পথে বাধা দেওয়া হয়েছে। গত দুই সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্রে ঢুকতে না দেওয়া অন্তত ৬জন কানাডীয় মুসলিমের মধ্যে এরা দুজন অন্যতম।

যেসব ব্যক্তি ও তাদের পরিবারকে যুক্তরাষ্ট্রে ঢুকতে দেওয়া হয়নি তারা কেন যুক্তরাষ্ট্রে ঢুকতে পারবেন না সে বিষয়ে কোনও ব্যাখ্যাও দেননি যুক্তরাষ্ট্রের সীমান্ত কর্মকর্তারা।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাহী আদেশবলে যেসব দেশের মুসলিমদের যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ নিষিদ্ধ করেছেন তার মধ্যে গায়ানা বা ইরাক কোনওটিই নেই। ট্রাম্পের ওই আদেশের মাধ্যমে নিষিদ্ধ দেশগুলোর শরণার্থী ও সাধারণ নাগরিকদের যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশাধিকার রুদ্ধ করা হয়েছে।

উভয় ব্যক্তিকে যুক্তরাষ্ট্রে ঢোকার জন্য আবারও সীমান্তে আসার আগে টরন্টোর মার্কিন কনস্যুলেটে ভিসার জন্য আবেদন করতে বলা হয়েছে। কিন্তু যারা কানাডার পাসপোর্টধারী তাদের যুক্তরাষ্ট্রে ঢোকার জন্য সেদেশের ভিসা নেওয়ার প্রয়োজন পড়ে না।

সম্প্রতি কানাডার বেশ ক’জন মুসলিম কানাডা-যুক্তরাষ্ট্র সীমান্ত থেকে ফিরে এসেছেন। ছবি : সিটিভি নিউজ

যুক্তরাষ্ট্রের সীমান্ত থেকে ফিরে আসা ৬ জনই টরন্টো এলাকার ইমিগ্রেশন ফার্ম (সিআইএলএফ) -ক্যারুসো গুবারম্যান অ্যাপলবাই-এর মাধ্যমে যাওয়া। সেই ফার্মের আইনজীবীরা জানান, তাদের প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে যাওয়া লোকেরা যদি এধরণের সমস্যায় পড়েন তাহলে আরও অনেক কানাডীয় নাগরিক নিশ্চয়ই সীমান্তে একইধরণের সমস্যায় পড়ছেন।

দাউদ আলী নামে সিআইএলএফ-এর একজন আইনজীবী সিবিসি নিউজকে বলেন, “গত কয়েক সপ্তাহে আমরা এধরনের অনেক ঘটনা দেখেছি, কিন্তু আমরা জানি না এর পেছনে কী কারণ রয়েছে। আমরা জানি ওখানে, যুক্তরাষ্ট্রে পরিস্থিতি পাল্টেছে, এখন পরিবেশ কিছুটা ভিন্ন, কিন্তু তার পরও কিছু প্রক্রিয়া ও নিয়ম-বিধি আছে, কোনও ঘটনাকে চ্যালেঞ্জ করার সুযোগ মানুষকে দিতে হবে।”

“কিন্তু আপনাকে কেন ঢুকতে দিতে অস্বীকৃতি জানানো হচ্ছে সেটা যখন আপনাকে জানানো হচ্ছে না তখন কিসের বিরুদ্ধে লড়ছেন সেটা জানা খুব কঠিন। এটা সত্য যে তারা সবাই মুসলিম, সেজন্যেই কিছু উদ্বেগের সৃষ্টি হতে পারে যে, এদেরকে কি টার্গেট করা হয়েছে নাকি এটা নতুন কোনও ধরনের নিষেধাজ্ঞা…।”

প্রতিষ্ঠানটির অংশীদার জোয়েল গুবারম্যান বলেন, “৪০ বছরের বেশি সময় ধরে অভিবাসন আইনজীবী হিসাবে কাজ করতে গিয়ে এই ঘটনার চেয়ে বেশি আর কোনও কিছুই আমাকে বিস্মিত করেনি, আমি কখনই এমন নিপীড়নমূলক দৃশ্য দেখিনি।”

কানাডার মুসলিম পর্যটকদের বিষয়ে সাম্প্রতিক সময়ে তারা কোনও নতুন নির্দেশনা পেয়েছেন কিনা জানতে চাওয়া হলে যুক্তরাষ্ট্রের কাস্টমস ও সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর (সিবিপি) মুখপাত্র বলেন, তাদের সংস্থায় “নতুন করে কোনও নীতিগত পরিবর্তন আসেনি।”

গোপনীয়তা আইনের কারণে সুনির্দিষ্ট ঘটনার বিষয়ে মন্তব্য করতে অপারগ হলেও সিবিপি মুখপাত্র বলেন, “যুক্তরাষ্ট্রে যাবার জন্য যারা আবেদন করেন তারা যে সেদেশে ঢোকার জন্য স্পষ্টতই যোগ্য তা প্রমাণের দায়িত্ব তাদেরই। তারা প্রবেশাধিকার পাবার যোগ্য এটা দেখানোর জন্য তাদেরকে অযোগ্যতার সবগুলো কারণ উৎরে আসতে হবে।”

কর্তব্যরত মার্কিন কাস্টমস কর্মকর্তার একক সিদ্ধান্তেই কেউ যুক্তরাষ্ট্রে ঢুকতে পারেন, এর বাইরে কানাডার কোনও নাগরিকেরই যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার অধিকার নেই। আর বিদেশি নাগরিকদের সেদেশে ঢুকতে দেওয়া সিদ্ধান্ত নেবার জন্য মার্কিন কাস্টমস কর্মকর্তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করার বিপুল এখতিয়ার রয়েছে।

যেসব কারণে কোনও ব্যক্তি যুক্তরাষ্ট্রে ঢোকার অযোগ্য হবেন এমন ৬০টিরও বেশি কারণ আছে সিবিপির তালিকায়। চারটি বিশেষ ক্যাটাগরিতে বিন্যস্ত ওইসব কারণ হলো স্বাস্থ্য-সম্পর্কিত, অপরাধমূলক, নিরাপত্তাজনিত, আইনগত এবং অভিবাসন নীতি লংঘন ও প্রয়োজনীয় নথিপত্র সম্পর্কিত।

যে  ছয়জনকে যুক্তরাষ্ট্রে ঢুকতে দেওয়া হয়নি তাদের মধ্যে দুজন তাদের অভিজ্ঞতা সিবিসিকে জানাতে সম্মত হন। কানাডার অন্যান্য মুসলিমরা যুক্তরাষ্ট্রে যাবার চেষ্টা করলে কি কি জটিলতার মুখোমুখি হতে পারেন সে বিষয়ে তাদেরকে সতর্ক করার জন্যই ওই দুজন তাদের অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে রাজি হন।

টরন্টো ও আঞ্চলিক ইসলামিক ধর্মসমবায়ের (ঞঅজওঈ) মসজিদে গত ২০ বছরের বেশি সময় ধরে আবাসিক ইমাম হিসাবে দায়িত্ব পালনকারী এবং পিল আঞ্চলিক পুলিশের ইমাম ইমরান আলী নিউইয়র্কের কুইন্স বরোতে তার ঘনিষ্ঠ বন্ধুর মেয়ের বিয়েতে যোগ দেওয়ার জন্য স্ত্রী ও তিন সন্তানকে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে যাচ্ছিলেন। কথা ছিলো তিনিই বিয়েতে কাজীর দায়িত্ব পালন করবেন।

আলী ও তার হুইল চেয়ারে বসা প্রতিবন্ধী ছেলেকে অন্টারিওর ফোর্ট ইরির কাছে পিস ব্রিজ সীমান্ত পথে পাঁচ ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে আটকে রাখা হয়। তাদেরকে সাদা পোশাকের কাস্টমস কর্মকর্তাদের তিন দফা জিজ্ঞাসাবাদের মুখোমুখি করা হয়। কিছু প্রশ্ন ছিলো তার সিরীয় উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসন সম্পর্কিত দাতব্য কর্মকাÐের সঙ্গে সম্পর্কিত।

দক্ষিণ আফ্রিকার দেশ গায়ানা থেকে আসা আলীকে ধর্মীয় নেতা হিসাবে তার কর্মকাÐ নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়, ছবি তোলা হয়, আঙুলের ছাপ নেওয়া হয় এবং সব শেষে যুক্তরাষ্ট্রে যেতে দিতে অস্বীকৃতি জানানো হয় এজন্যে যে “একজন বদলোকের নামের সঙ্গে তার নামের মিল রয়েছে।”

এরপর তাকে পুলিশের গাড়িতে করে কানাডার সীমান্তে নিয়ে আসা হয়। বিয়ের অনুষ্ঠানে যাওয়ার দীর্ঘদিনের পরিকল্পনা বাতিল করতে হয়।

আলী বলেন, “আমি জানতাম প্রথমবারের মতো যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়াটা লাল গালিচা দিয়ে স্বাগত জানানোর মত হবে না, জানতাম আমাকে হয়তো অনেক প্রশ্নের জবাব দিতে হবে, হয়তো অনেক দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করানো হবে। এই সব কিছুর জন্যই আমরা প্রস্তুত ছিলাম, কিন্তু কখনও দুঃস্বপ্নেও চিন্তা করিনি যে, আমাকে অযোগ্য করা হবে নিছক আমার নামের জন্য।”

“যেভাবে তারা এই কাজটি করলো তাতে শেষ পর্যন্ত সত্যিই মনে হচ্ছিলো যেন আমি একজন অপরাধী।”

এদিকে টরন্টোর ইরাকী তুর্কী কমিউনিটির ভাইস প্রেসিডেন্ট নেজমেতিন ভ্যালিকেও গত আগস্ট মাসের শুরুর দিকে উইন্ডসর-ডেট্রয়েট সীমান্ত পথে যুক্তরাষ্ট্রে যেতে দেওয়া হয়নি। তিনি ও তার পরিবার মুসলমানদের অন্যতম বৃহৎ ধর্মীয় উৎসব ঈদুল আজহার ছুটিতে যুক্তরাষ্ট্র যাচ্ছিলেন।

ভ্যালি ডেট্রয়েটে যাচ্ছিলেন তার স্ত্রী ও সন্তানদের নিয়ে সীমান্তবর্তী এলাকায় কিছু কেনাকাটা করতে। এসময় দ্বিতীয় দফা জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আমেরিকান অফিসাররা তাকে পরিবার থেকে সরিয়ে নেয় এবং তা চার ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে চলে।

ভ্যালি বলেন, অফিসাররা তাকে রীতিমত অত্যাচার করেছে বলেই তিনি অনুভব করেন। তারা কেবল তার নিজের সেলফোনই আটক করেনি, তার স্ত্রী ও কানাডায় জন্মগ্রহণকারী সন্তানদের ফোনও আটক করেছে। এমনকি জিজ্ঞাসাবাদের সময় তাকে তার অটিস্টিক মেয়ের জন্য খাবার ও ওষুধও সংগ্রহ করতে দেয়নি।

ভ্যালি বলেন, “আমাকে একজন সন্ত্রাসী বা তেমন কিছুর মতই দেখেছে তারা। আমার অতীতে কোনও অপরাদের ইতিহাস নেই, কখনও জেল খাটিনি, কিচ্ছু না। গত ২০ বছর ধরে আমি একজন কানাডীয় এবং কখনও কোনও সমস্যা হয়নি। সেজন্যেই আমি বোঝার চেষ্টা করছিলাম, কী ঘটছে। আমি এর বিরুদ্ধে লড়াই করতে চাইÑ আমার মনে হচ্ছে যে, আমার সুনাম খুণœ হবে কারণ তারা আমাকে ঢুকতে দেয়নি।

“এটা খুবই দুঃখজনক। আমরা সবাই আনন্দিত ছিলাম যুক্তরাষ্ট্রে যাবো বলে। এটা ছিলো মাত্রই দু’ঘণ্টার কেনাকাটার ব্যাপার। সেটা হলো না।”

ভ্যালি জানান, সীমান্ত রক্ষীরা তাকে যুক্তরাষ্ট্রে ঢুকতে না দেওয়ার কারণ জানায়নি তবে তিনি বলেন, মার্কিন অফিসাররা তার জন্মভূমি ইরাকে তার অনিয়মিত সফরের বিষয়টি নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিলো।

ভ্যালি জানান, তাকে মাঝে মাঝে তার মাতৃভূমিতে যেতে হয় তার তিন নাতি-নাতনির দেখাশোনার জন্যÑ কারণ তার ছেলে ইরাকী পুলিশ বাহিনীর কর্মকর্তা আইএসআইএস বাহিনীর হাতে নিহত হয়েছেন।