এক-চতুর্থাংশ কানাডীয়র ভাষ্য, মুসলিমদের বিরুদ্ধে পক্ষপাতদুষ্ট হওয়া অধিকতর গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠেছে
গ্লোবাল নিউজের জন্য পরিচালিত এক বিশেষ জরিপে দেখা গেছে, কানাডায় বর্ণবাদ বা জাতিবিদ্বেষকে এখন তেমন একটা বড়ো সমস্যা হিসাবে দেখাহচ্ছে না যদিও কানাডায় ঘৃণাপ্রসূত অপরাধ বা হেট ক্রাইম বেড়েই চলেছে।
সেপ্টেম্বর ১২, ২০১৯
প্রবাসী কণ্ঠ ডেস্ক : এক-চতুর্থাংশেরও বেশি কানাডীয় মনে করেন, গত পাঁচ বছরে মুসলিমদের বিরুদ্ধে পক্ষপাতদুষ্ট হওয়ার বিষয়টি “অধিকতর গ্রহণযোগ্য” হয়ে উঠেছে। গ্লোবাল নিউজের জন্য পরিচালিত ইপসস-এর এক বিশেষ জরিপে এই তথ্য উঠে এসেছে।
জরিপের ফলাফলে এদেশে বসবাসকারী মুসলিমদের বিরুদ্ধে ঘৃণাপ্রসূত হামলার ঘটনা বৃদ্ধির যোগসূত্র রয়েছে মনে হয়। খবর গ্লোবাল নিউজ এর।
স্ট্যাটিস্টিকস কানাডার তথ্য অনুযায়ী, ২০১৭ সালে কানাডায় মুসলিমদের বিরুদ্ধে হেট ক্রাইমের সংখ্যা ১৫১ শতাংশ বেড়ে যায়। সবচেয়ে বেশি হেট ক্রাইম ঘটেছিলো অন্টারিও ও কুইবেকে। অন্টারিওতে পুলিশের কাছে রিপোর্ট করা হয়েছে এমন হেট ক্রাইমের সংখ্যা বাড়ে ২০৭ শতাংশ আর কুইবেকে ১৮৫ শতাংশ। মুসলিমদের বিরুদ্ধে জাতিগত বৈষম্যের এই বিস্ফোরণের কারণ কী?
অন্টারিও ইউনিভার্সিটির টেকনোলজি ইন্সটিটিউটের হেট ক্রাইম বিশেষজ্ঞ বারবারা পেরি বলেন, কানাডায় ইসলামভীতি সব সময়ই ছিলো কিন্তু গত কয়েক বছরে তা বহুগুণ বেড়ে গেছে। তিনি আরও বলেন, এর পেছনে অনেক উপাদান সক্রিয় তবে সেগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো “ট্রাম্পের প্রভাব।”
ট্রাম্পের প্রভাব
অনেক বিশেষজ্ঞ মুসলিমদের বিরুদ্ধে ঘৃণাপ্রসূত অপরাধ বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নির্বাচনী প্রচারণার সময় ২০১৬ সালে এবং ২০১৭ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর মুসলিমবিরোধী বক্তৃতাবাজীর সম্পর্ক আছে বলে মনে করেন।
যুক্তরাষ্ট্রে মুসলিমদের নিষিদ্ধ করার যে অঙ্গীকার ট্রাম্প ঘোষণা করেন তা কানাডার অনেক চরম দক্ষিণপন্থী মহল সমর্থন করেন।
উদাহরণস্বরূপ, ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে কুইবেকের একটি মসজিদে নামাজরত মুসল্লিদের ওপর গুলি চালায় আলেক্সান্ডার বিসোনেত্তি নামের এক চরমপন্থী, যাতে ছয়জন মুসলিম নিহত হন। এই হামলার আগে বিসোনেত্তি যুক্তরাষ্ট্রে মুসলিমদের ভ্রমণের ওপর নিষেধাজ্ঞা সম্পর্কিত ট্রাম্পের একটি টুইটার বার্তা পড়ে মুসলিমদের প্রতি বিদ্বিষ্ট হয়ে ওঠে।
ইপসস-এর ভাইস-প্রেসিডেন্ট সিন সিম্পসন বলেন, ট্রাম্পের মুসলিমবিদ্বেষী দৃষ্টিভঙ্গি কানাডায় সংক্রমিত হয়েছে এবং জরিপে তারই প্রতিফলন দেখা গেছে।
সিম্পসন বলেন, “আমি নিশ্চিতভাবেই মনে করি, যখন যা মনে আসে ঝোঁকের বশে তাই বলে ফেলেন ট্রাম্পের মত এমন একজন প্রেসিডেন্টের বক্তব্য মানুষকে একই রকম কাজ করার লাইসেন্স দেয়।”
তিনি বলেন, “যুক্তরাষ্ট্রে এমনই কিছু আন্দোলন জোরালো হয়ে উঠছে যে, আমরা আগে যেসব কথা বলতে হয়তো উদ্বেগ বোধ করেছি এখন সেগুলো বলাটা ঠিকই আছে… এই আন্দোলনেরই কিছু প্রভাব কানাডায় চুইয়ে আসছে।”
তিনি বলেন, রাজনৈতিক যথার্থতার (political correctness) অভাব কানাডার বর্তমান পরিবেশেও লক্ষ্যণীয়। যেমন ধরুন, ম্যাক্সিম বার্নিয়ের-এর অভিবাসনবিরোধী বক্তৃতাবাজী একদম ট্রাম্পের বক্তব্যেরই প্রতিধ্বনি।”
কানাডার পিপলস পার্টির নেতা বার্নিয়ের তার একটি বক্তব্যের জন্য গত বছর ব্যাপকভাবে সমালোচিত হন। তিন বলেছিলেন, “অধিকতর বৈচিত্র আমাদের শক্তি নয় বরং এটি আমাদের দেশকে যা মহৎ করেছে তাকে ধ্বংস করবে।”
সিম্পসন বলেন, “বার্নিয়ের এবং ট্রাম্পের মত রাজনীতিকরা এমন সব কথা গলা ফাটিয়ে বলছেন যেগুলো লোকেরা এমনকি মনে মনে চিন্তা করলেও এতদিন পর্যন্ত প্রকাশ্যে উচ্চস্বরে বলতে উৎসাহী ছিলো না।” এটি জনগণকে সংখ্যালঘুদের প্রতি বিদ্বেষপরায়ণ করে তুলছে।
পেরি বলেন, কানাডায় মুসলিমদের বিরুদ্ধে অবিরাম বক্তব্য বিবৃতি দিয়ে যাচ্ছেন এমন রাজনীতিক বার্নিয়ের একাই নন।
২০১৫ সালে স্টিফেন হারপারের পুননির্বাচনের বছর তিনি মুসরিম নারীদের নেকাবের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। তিনি কানাডার নাগরিত্বের শপথ নেওয়া কারও জন্যে নেকাব পরাকে অপরাধ বলে বর্ণনা করেন।
আর ২০১১ সালে কানাডার তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী হারপার বলেছিলেন, “ইসলাম” কানাডার জাতীয় নিরাপত্তার জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি হয়ে দেখা
দিচ্ছে।
পেরি বলেন, কানাডায় যদিও মুসলিমবিরোধী বক্তৃতাবাজী সব সময়ই ছিলো কিন্তু ২০১৭ সালে সেটা হেট ক্রাইমের আকারে বেড়ে গেছে এবং দেশজুড়ে কিছু সংগঠিত শ্বেতাঙ্গ জাতীয়তাবাদী গ্রুপ সেটা লুফে নিয়েছে।
২০১৫ সালে সারাদেশে পুলিশের রেকর্ড করা মুসলিমদের ওপর হামলার ঘটনা ছিলো ১৫৯টি যা ২০১২ সালের চেয়ে ৪৫টি বেশি। এর অর্থ হলো হেট ক্রাইমের পরিমাণ ২৫৩ গুণ বেড়ে যায়।
পেরি বলেন, ২০১৫ সালে কানাডায় বিদ্বেষপ্রবণ গ্রুপের সংখ্যা ছিলো ১০০টির মতো, কিন্তু এখন এধরণের গ্রুপের সংখ্যা ২০০ থেকে ৩০০ হবে।
মিজ. পেরি বলেন, চরম-ডানপন্থী রাজনীতিক ও গ্রুপগুলোর মধ্যে ইসলাম এবং অভিবাসনের বিরুদ্ধে আঘাত হানার ব্যাপারে এক মোহাচ্ছন্নতার সৃষ্টি হয়েছে।
পেরি উদ্বগ্নি যে, মুসলমি-বিরোধী বাগাড়ম্বর ২০১৯ সালের কেন্দ্রীয় নির্বাচনেও অলক্ষ্যে ঢুকে পড়তে পারে কারণ বহু মুসলমি-বিদ্বষেী গ্রুপ বিষয়টাকে স্বাভাবিক করে ফেলার প্রয়াস চালাচ্ছে।
তিনি বলেন, “চরম দক্ষিণপন্থীরা একধরণের বক্রোক্তির মাধ্যমে বিষয়টিকে সামনে নিয়ে আসছে এবং তাদের ইচ্ছার প্রতি নমনীয় হওয়ার জন্য দক্ষিণপন্থার প্রতি ঝোঁক রয়েছে এমন দলগুলোর ওপর চাপ সৃষ্টি করছে। তিনি আরও বলেন, ট্রাম্পের মুসলিম-বিরোধী বাগাড়ম্বর অনলাইনে ঘৃণা বাড়িয়ে দেওয়ার সঙ্গে সম্পর্কিত হলেও এটিই পুরো বাস্তবতা নয়। তিনি বলেন, “এক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের বহু উপাদান সক্রিয়”, কুইবেকের “ধর্মীয় নিরপেক্ষতার আইন” বলে কথিত বিতর্কিত ২১ নম্বর বিল ওই প্রদেশে মুসলিমদের বিরুদ্ধে বৈষম্যকে উস্কে দিয়েছে।
প্রস্তাবিত এই আইন অনুযায়ী দায়িত্ব পালনরত অবস্থায় কর্তৃত্বশীল পদে নিয়োজিত সরকারি কর্মকর্তারা, যাদের মধ্যে শিক্ষক, পুলিশ এবং বিচারকও অন্তর্ভুক্ত, ধর্মীয় প্রতীক পরতে পারবেন না।
২০১৭ সালের অক্টোবরে এই প্রদেশে বিল ৬২ নামে আরেকটি আইন পাশ করা হয়। এই আইন অনুযায়ী সরকারি পদে যোগ দিতে হলে সবাইকে মুখ খোলা ছবি দিতে হয়। আইনটি আদালতে চ্যালেঞ্জ করা হয় এই যুক্তিতে যে, এতে নেকাব বা বোরকা পরা মুসলিম নারীদের প্রতি বৈষম্য করা হয়েছে।
রাজনৈতিক দল ও অধিকারের প্রবক্তারা এটিকে মুসলিম নারীদের প্রতি সরাসরি বৈষম্যমূলক আইন বলে এর সমালোচনা করেন। অবশ্য কুইবেকের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী ফিলিপে কাউলার্ড আইনের পক্ষ নিয়ে বলেন, যোগাযোগ, পরিচিতি এবং নিরাপত্তাজনিত কারণে এই আইন প্রয়োজন।
পেরি ও সিম্পসন উভয়েই স্বীকার করেন যে, বৈষম্য সত্ত্বেও অনেক কানাডিয়ান আছেন যারা মুসলিমদের পক্ষে কথা বলেন। বৈষম্য গ্রহণযোগ্যতা পাচ্ছে একথা যারা বলেন তারা এখনও মুষ্ঠিমেয় সংখ্যালঘু।
সিম্পসন বলেন, “বহু মানুষ মনে করেন যে মুসলিমদের প্রতি পক্ষপাত খুব কমই গ্রহণযোগ্য, তাই এক-চতুর্থাংশ মানুষও যদি এই মতের অনুসারী হন যারা মনে করেন যে, মুসলিম ও আরবদের প্রতি পক্ষপাত গ্রহণযোগ্য তাহলেও তারা সংখ্যাগরিষ্ঠের কাছে পিছিয়ে থাকবে।”