কানাডায় আসার পর অভিবাসী শিশুদের স্বাস্থ্যের দ্রুত অবনতি ঘটে
সেপ্টেম্বর ১২, ২০১৯
দারিদ্র্যমুক্ত, স্বাস্থ্যোজ্জ্বল, সুখি ভবিষ্যৎ: এটাই হলো কানাডা এবং যুক্তরাষ্ট্রে আসা অনেক অভিবাসী ও উদ্বাস্তুর আকাক্সক্ষা। বিরূপ জীবন এবং খাবারের অভাব পেছনে ফেলে রেখে তারা নিরাপত্তা ও অপেক্ষাকৃত স্বচ্ছলতাকে বরণ করেন যেটা উত্তর আমেরিকা তাদের দিতে পারে।
খুব কম লোকই কল্পনা করেন যে, অভিবাসন তাদের পারিবারিক জীবনের কল্যাণ ক্ষতিগ্রস্ত করবে এবং দ্রুত স্বাস্থ্যহানির দিকে ঠেলে দেবে।
এর পরও গত ১৫ বছরের গবেষণা সমীক্ষায় দেখা গেছে যে, অভিবাসীরা সাধারণত কানাডীয়দের চেয়ে ভালো স্বাস্থ্য নিয়ে এদেশে আসেন, তাদের মধ্যে হৃদরোগ, ক্যান্সার বা ডায়াবেটিসের মতো তেমন কোনও পুরনো রোগ থাকে না। তারপরও কানাডায় তাদের অবস্থানের মেয়াদ যতো দীর্ঘ হয় ততই তাদের স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটে।
স্বাস্থ্যের এই অবনতি শিশুদের ক্ষেত্রেও ঘটে। সাসকাটচাওন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব পাবলিক হেলথ অ্যান্ড ফার্মাসি ও নিউট্রিশন কলেজের অধ্যাপক ও পোস্ট ডক্টরাল ফেলো হিসাবে আমরা সম্প্রতি এদেশে আসার পর অভিবাসী ও উদ্বাস্তু শিশুদের স্বাস্থ্যের অবস্থা সম্পর্কে প্রথম সমন্বিত গবেষণা প্রকল্প হাতে নিই।
অ্যাপ্লায়েড ফিজিওলজি, নিউট্রিশন অ্যান্ড ম্যাটাবলিজম সাময়িকীতে প্রকাশিত এই সমীক্ষায় ওইসব শিশুদের স্বাস্থ্য ও পুষ্টিগত ঘাটতি বিষয়ে বেশ কিছু উদ্বেগজনক চিত্র উঠে এসেছে।
অপেক্ষাকৃত উচ্চ রক্তচাপ এবং অস্বাস্থ্যকর কোলেস্টেরল
সাসকাটচাওনের সাসকাটুন ও রেজিনায় ৩০০ অভিবাসী ও উদ্বাস্তু শিশুর মধ্যে পরিচালিত আমাদের সমীক্ষায় দেখা যায় যে, এইসব শিশুরা প্রায়শ পাশ্চাত্যের খাদ্যসামগ্রী এবং আয়েসী জীবনধারায় অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। অনেক বাবা-মাই অতিরিক্ত খাওয়া এবং পাশ্চাত্যের খাবারের অতিরিক্ত ক্যালরির বিপদ সম্পর্কে অসচেতন।
সব মিলিয়ে নবাগত শিশুদের মধ্যে কানাডীয় শিশুদের চেয়ে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বেশি রক্তচাপ দেখা গেছে।
আমাদের গবেষণায় অংশ নেওয়া শিশুদের ৩৬ শতাংশের খাবারে জিঙ্ক গ্রহণের স্বল্পতা লক্ষ্য করা গেছে যা শারীরিক বৃদ্ধি ও উন্নয়নের জন্য জরুরী।
৫২ শতাংশের শরীরে অস্বাস্থ্যকর মাত্রায় কোলেস্টেরল-এর উপস্থিতি পাওয়া গেছে, যেখানে কানাডীয় শিশুদের মধ্যে এমন প্রবণতা দেখা যায় ৩৫ শতাংশের ক্ষেত্রে।
বলা যেতে পারে যে, অতিরিক্ত চাপ কোলেস্টেরল উচ্চমাত্রায় পৌঁছার জন্য অনেকাংশে দায়ী।
অন্যান্য গবেষণায় দেখা গেছে, কিছু জাতিগত অভিবাসীর ক্ষেত্রে, যেমন দক্ষিণ এশীয়দের, নির্দিষ্ট করে নারীদের ক্ষেত্রে কানাডায় বসবাসের মেয়াদ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে উচ্চ রক্তচাপ সৃষ্টি হবার ঝুঁকি বাড়তে থাকে।
ইউরোপের বাইরে থেকে আসা অভিবাসীদেরও স্বাস্থ্যগত অবনতি ঘটে এবং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে উচ্চতা ও ওজনের প্রেক্ষিতে শরীরে মেদের পরিমাণ বেড়ে যায়।
দারিদ্র্য এবং উন্নতিবিহীন চাকরি
স্বাস্থ্যের এই অবনতি কেন? কানাডায় খাবারের অপেক্ষাকৃত প্রাচুর্য রয়েছে, প্রাপ্য স্বাস্থ্য-সুবিধা এবং জীবনযাত্রার মানের একটি মানসম্মত অবস্থা বিদ্যমান যা বিশ্বের সবচেয়ে ভালো, সেজন্যে সমীক্ষার ফলাফলকে বলা যায় সজ্ঞার পাল্টা প্রভাব (counter-intuitive)।
এর জবাব লুকিয়ে আছে অভিবাসী ও উদ্বাস্তুদের ফেলে আসা পরিবেশ এবং এখানে আসার পর তারা যে পরিবেশ পায় এই উভয়ের মধ্যেই।
কিছু অভিবাসী এমন অবস্থায় পড়েন যে তাদেরকে তাদের অভিবাসনপূর্ব স্বপ্ন নিয়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়তে হয়। তারা অপেক্ষাকৃত দারিদ্র্যের মধ্যে বসবাস করতো, এমন কাজ করতো যেখানে তাদের অভিজ্ঞতা ও সম্ভাবনা পুরোপুরি কাজে লাগানোর সুযোগ ছিলো না। তাদের অনেকে কানাডায় আসেন অত্যন্ত দক্ষ কর্মী হিসাবে, নতুন দেশে তাদের সম্ভাবনার উজ্জ্বল আশাবাদ নিয়ে, কিন্তু তারা একটি অর্থবহ এবং সুফলদায়ক কর্মসংস্থান জোটাতে ব্যর্থ হন। অনেকে মধ্যবিত্ত জীবনের স্বপ্ন দেখলেও ভাষাগত ও শিক্ষাগত বাধার কারণে অর্থনৈতিকভাবে সর্বনি¤œস্তরে থেকে যেতে বাধ্য হন।
শস্তা ও প্রস্তুতকৃত অবস্থায় পাওয়া জাঙ্কফুড খাওয়া সুস্বাস্থ্য রক্ষায় সহায়ক হতে পারে না।
অনেক অভিবাসী পরিবারের স্বাস্থ্যগত অবনতির কারণ হলো কানাডায় খাপ খাইয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে শারীরিক ও মানসিক চাপ। অভিবাসনের কারণে অনেকের সামাজিক সহায়ক নেটওয়ার্ক নষ্ট হয়। আবার সাংস্কৃতিকভাবে অনুকূল স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার সুযোগ পাওয়াটাও অনেকের জন্য খুব চ্যালেঞ্জিং হয়ে পড়ে।
শুধু অস্তিত্ব রক্ষার মতো বেঁচে থাকা
নবাগতদের স্বাস্থ্য, খাদ্যতালিকা এবং জীবনযাপন প্রণালী বিষয়ে আমরা অসংখ্য অভিবাসী এবং স্বাস্থ্যসেবা দানকারীর সঙ্গে কথা বলেছি। অনেক নবাগত কানাডায় মানসম্মত জীবনযাত্রার আশাবাদের কথা এবং তা অর্জন করতে গিয়ে তাদের সংগ্রামের কথা বলেছেন।
তারা যে স্বপ্ন নিয়ে এবং যে জীবনযাত্রা পাবেন বলে আশা করে এসেছিলেন তা অর্জন
করার কঠিন প্রক্রিয়ার কারণে অনেকেরই মোহভঙ্গ হয়।
পরিবার চালানোর জন্য একটি ভালো চাকরির সন্ধানে কঠিন পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে গিয়ে একজন উদ্বাস্তু এতটাই হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েন যে, তিনি পরিবারকে দেশে ফেরত পাঠানোর চিন্তা করছিলেন।
খাদ্য নিরাপত্তাহীন অভিবাসীদের প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে একজন সেবাদানকারী বলেন, “উদ্বাস্তু ও অভিবাসীরা নিছক অস্তিত্ব রক্ষার মতো অবস্থায় টিকে আছে, কারণ, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার ও পেশাজীবীরা সচ্ছল জীবন যাপন করছেন।”
গবেষণায় দেখা গেছে, জাতিগত গ্রুপগুলোর সদস্যরা যখন তাদের কাক্সিক্ষত আর্থ-সামাজিক পর্যায়ে পৌঁছতে সক্ষম হন তখন তাদের ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যগত অসাম্য কমে আসে। তার মানে হলো দীর্ঘ সময় ধরে স্বল্প আয়ে বেঁচে থাকা তাদের জন্য শারীরিক মানসিক সমস্যার কারণ হতে পারে এবং তারা অস্বাস্থ্যকর সুলভ খাবারের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়তে পারে।
স্বল্প আয়ের মানুষের কাছে একটি হ্যামবার্গার কিংবা ভাজাপোড়া খাবার সালাদের চেয়ে দামে কম এবং তা ক্ষুধার্ত পেট ভরানোর জন্য উপযোগী।
খাবারের প্রাচুর্য
উদ্বাস্তু শিশু যারা ক্ষুধার সঙ্গে পরিচিত তাদের পক্ষে খাবার ইচ্ছা চেপে রাখা কঠিন হতে পারে। রেজিনার একজন স্বাস্থ্যসেবাদানকারী বলেন, “অনেক মানুষ তাদের খাদ্যাভ্যাস পাল্টে ফেলে। যেকারণে তারা এত বেশি মোটা হয়ে যায়। এখানে তারা প্রচুর খাবার পায়।”
অভিবাসন সম্পর্কিত একজন সেবাদানকারী বলেন, “অনেক সময় উদ্বাস্তু শিবির থেকে আসা শিশুরা খুব বেশি খাবার খেতে থাকে। কারণ উদ্বাস্তু শিবিরে খাবারের অভাব থাকে।” এক্ষেত্রে অরেকটি উপাদান হলো এই যে, কোন কোন সংস্কৃতিতে মোটাসোটা শিশুদেরকে স্বাস্থ্যবান ভাবা হয়। একটি পরিবার আমাদেরকে বলেছে, গোশত খাওয়া যেখানে একসময় ছিলো বিলাসিতা, মাসে মাত্র একবার বা দুবার গোশত খাবার সুযোগ হতো সেখানে এখন গোশত খাওয়াটা যেমন প্রত্যাশিত তেমনই প্রয়োজনও।
তিন থেকে ১৯ বছর বয়সী কানাডীয় শিশুদের ১৩ শতাংশ স্থ’ূলোকায়। অথচ পাঁচ বছর বা তার চেয়ে কম সময় ধরে কানাডায় বসবাস করছে এমন নবাগত শিশুদের ১০ শতাংশই স্থূলোকায়।
এইসব নবাগতর স্থূলোকায় হওয়া এবং স্বাস্থ্যগত অবনতির কারণ সম্পর্কে বুঝতে পারাটা আমাদের জন্য খুবই জরুরী যদি আমরা এদের প্রাপ্ত বয়সকালে টাইপ-২ ডায়াবেটিস এবং উচ্চ রক্তচাপজনিত জটিল রোগ প্রতিরোধ করতে চাই।
কার্যকর ও সাংস্কৃতিক বিষয়সচেতন স্বাস্থ্য কর্মসূচি গ্রহণের সময় স্বাস্থ্য ও সামাজিক সেবা কর্মীদেরকে এসব ঝুঁকির বিষয়ে সচেতন থাকতে হবে।