‘অভিবাসীরা এগুচ্ছে না, পিছিয়ে পড়ছে’ : নতুন রিপোর্টে উদ্বেগজনক তথ্য

জুন ৬, ২০১৯

মার্গারেট ইটন

চলতি সপ্তাহের আরও আগের দিকে গ্রেটার টরন্টো অঞ্চলের ইউনাইটেড ওয়ে একটি উদ্বেগজনক রিপোর্ট প্রকাশ করে যাতে এমন বক্তব্য উঠে এসেছে যে, “আপনি কতদিন ধরে কানাডায় আছেন সেটা গুরুত্বপূর্ণ নয়- বাস্তবতা এই যে, এখানে আপনার জন্ম না হয়ে থাকলে তার অর্থ হলো আপনি কম উপার্জন করবেন।”

রিপোর্টে পিল, টরন্টো এবং ইয়র্ক অঞ্চলে ১৯৮০-২০১৫ সালের মধ্যে তরুণ, অভিবাসী এবং জাতিগত পরিচয়ে চিহ্ণিত গ্রুপের লোকেদের আয়ের প্রবণতা তুলে ধরা হয়েছে। এটি ছিলো প্রধান সামাজিক-জনসংখ্যাগত বৈশিষ্ট্যের জনগোষ্ঠীর মধ্যে গত ৩৫ বছর ধরে আয়ের বৈষম্য কতটা বিদ্যমান রয়েছে এমনকি বেড়ে গেছে তারই একটি বাস্তব পরীক্ষা। দেশের মোট জনসংখ্যার এক-পঞ্চমাংশ যে কানাডীয় অভিবাসীরা তাদের ক্ষেত্রে যে পরিসংখ্যান দেওয়া হয়েছে তা দেখে আমি সবচেয়ে বেশি উদ্বিগ্ন।

রিপোর্টে দেখা গেছে, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অভিবাসীরা আসলে আরও দরিদ্র হয়েছে এবং যারা ২০ বছরে বেশি সময় ধরে কানাডায় আছে তেমন “দীর্ঘদিনের অভিবাসীদের গড় আয় গত ৩৫ বছরেও বাড়েনি।”

দেশের সর্বোচ্চ সংখ্যক অভিবাসী আসে অন্টারিও প্রদেশে। বৃহত্তর টরন্টো অঞ্চলের অর্ধেকটা অভিবাসীদের দিয়ে পরিপূর্ণ। আর এদের অনেকেই যখন অর্থনীতিতে এবং শ্রমশক্তিতে তাৎপর্যপূর্ণ অবদান রাখছে তবুও এটা স্পষ্ট যে, তাদের মধ্যে এমন অনেক সম্ভাবনা আছে যা এখনও অনুদ্ঘাটিত রয়ে গেছে। আমরা জানি, বেশিরভাগ নবাগত আসেন অর্থনৈতিক অভিবাসী হিসাবে, তারা সুদক্ষ এবং কাজ করতে আগ্রহী। কিন্তু অনেক সময় তারা তাদের শিক্ষা, যোগ্যতা ও পোশাগত অভিজ্ঞতার সঙ্গে খাপ খায় এমন কাজ খুঁজে পান না। ফলে তারা বাধ্য হয়ে কেবল অস্তিত্ব রক্ষার মতো কাজে যোগ দিতে বাধ্য হন। এর ফলে আমাদের সবাইকে মূল্য দিতে হয়, বিশেষ করে বিশ্বব্যাপী মেধা অন্বেষণের এই প্রতিযোগিতার সময়ে যখন কানাডার চাকরিদাতারা অব্যাহতভাবে দক্ষ জনবলের অভাবের মোকাবিলা করছেন। কানাডায় ১০ বছর বা তার চেয়ে বেশি সময় ধরে আছেন এমন একজন অভিবাসী একই স্থায়ী চাকরিতে একই কাজ করে কানাডায় জন্মানো একজন নাগরিকের আয় করা প্রতি ডলারের বিপরীতে মাত্র ৬৭ সেন্ট আয় করবেন এটা হতে পারে না।

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অভিবাসীরা আসলে আরও দরিদ্র হয়েছে। ছবি : ন্যাশনাল অবজারভার

রিপোর্টে অভিবাসী নারীদের ক্ষেত্রে আরও বেশি মারাত্মক পরিস্থিতির চিত্র উঠে এসেছে। অভিবাসী ও কানাডায় জন্মানো নারীদের উভয়েরই আয়ের ক্ষেত্রে সার্বিক অর্জন থাকলেও তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য লৈঙ্গিক বৈষম্য রয়েছে। রিপোর্টে বলা হয়েছে, “অভিবাসী নারী হচ্ছে তার গ্রুপের সবচেয়ে কম গড় আয়ের কর্মচারী তবে অভিবাসী পুরুষরাও খুব বেশি এগিয়ে নয় কারণ তাদের গড় আয় কমে যাচ্ছে, বিশেষ করে যারা মানসম্মত চাকরিতে নিয়োজিত নয় তাদের।”

টরন্টো রিজিয়ন ইমিগ্রান্ট এমপ্লয়মেন্ট কাউন্সিলের (TRIEC) “স্টেট অব ইমিগ্রান্ট ইনক্লুশন” শিরোনামের সাম্প্রতিক রিপোর্টে এই তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরা হয়েছে। এই রিপোর্টে গত ১৫ বছরে বৃহত্তর টরন্টো অঞ্চলে অভিবাসন ও কর্মস্থলের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলি খতিয়ে দেখা হয়েছে। এতে দেখা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রিধারী বা তার চেয়েও বেশি যোগ্যতাসম্পন্ন একজন অভিবাসী নারী তার কানাডায় জন্মগ্রহণকারী প্রতিপক্ষের তুলনায় নিতান্ত অর্ধেক অর্থ উপার্জন করেন- এই বাস্তবতা গত ১৫ বছরেও পাল্টায়নি। এছাড়াও, ব্যাচেলার ডিগ্রি বা তার চেয়েও উচ্চতর ডিগ্রিধারীদের মধ্যে মাত্র ৩৭ শতাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাগত যোগ্যতার প্রয়োজন আছে এমন চাকরি পেয়েছে, একই যোগ্যতাসম্পন্ন অভিবাসী পুরুষদের মধ্যে এধরণের চাকরি পেয়েছে মাত্র ৫৪ শতাংশ।

বৃহত্তর বিভাজনের এই প্রবণতা আমরা কীভাবে রোধ করতে পারি এবং এমন একটি শ্রমবাজার তৈরি করতে পারি যেটি মানুষের বয়স, অভিবাসীর মর্যাদা, জেন্ডার এবং জাতিগত পরিচয় নির্বিশেষে সবার জন্য সমানভাবে কাজ করবে? প্রথমত এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, চাকরিদাতাকে অভিবাসীদের মেধা, তাদের আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা এবং আন্তর্জাতিক শিক্ষার মূল্য স্বীকার করতে হবে। TRIEC-এ আমরা অভিবাসীদের জন্য প্রস্তুত এবং অভিবাসীদের জন্য উপযোগী অন্তর্ভুক্তিমূলক কর্মপরিবেশ তৈরির বিষয়ে চাকরিদাতাদের সঙ্গে কাজ করি। আমরা তাদেরকে পক্ষপাতহীন

নিয়োগদান পদ্ধতি গ্রহণ করতে এবং অভিবাসীদের সত্যিকারের সমর্থন দেওয়ার মতো করে সেই পক্ষপাতহীন নিয়োগপদ্ধতি অনুসরণে উৎসাহিত করি। আমরা চাই তাদের কর্মীবাহিনী এমন একটি আন্তঃসাংস্কৃতিক সমন্বয় গড়ে তুলুক যাতে করে নবাগতদের সঙ্গে কাজ করা টিমের সদস্যরা বৈচিত্রের ভেতর থেকে কীভাবে পরিপূর্ণ সুফল তোলা যায় এবং সত্যিকারের অন্তর্ভুক্তিমূলক কর্মস্থল গড়ে তোলা যায় সেটা বুঝতে পারে।

আমরা যখন আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক হয়ে ওঠার জন্য নিয়োগদাতাদের সঙ্গে কাজ করছি তখন বেতনের বৈষম্য কমিয়ে আনার জন্য অভিবাসীরা কী করতে পারে? বিষয়টি পদ্ধতিগত, তবে এখানে কিছু ধারণা তুলে ধরা হলো:

১. পরামর্শ দিতে পারে এমন কাউকে রাখুন- আপনি যদি নিজে কর্মক্ষেত্রে কোন কাজ খুঁজে না পান তাহলে পরামর্শ দেয় এমন কোনও কর্মসূচিতে যোগ দিন। অভিবাসীদের প্রয়োজনীয় সবকিছুই আছে, নেই কেবল পেশাগত নেটওয়ার্ক। আপনার পেশাদারি ক্ষেত্রে একজন মেন্টর বা পরামর্শদাতা খুঁজে বের করুন এবং তার মাধ্যমে পেশাগত কর্মক্ষেত্রের লোকজনের সঙ্গে সংযোগ গড়ে তুলুন। কানাডাজুড়ে এধরণের যতো কর্মসূচি আছে তাদের মাধ্যমে ৭০ শতাংশ মানুষ নিজ পেশায় কাজ খুঁজে পেয়েছে।

২. স্পন্সর যোগাড় করুনÑ চাকরি পাবার পর আপনার কোম্পানিতে এমন একজনকে খুঁজে নিন যিনি আপনাকে এবং আপনার কাজের রক্ষক হতে পারেন। অনেক সময় এধরণের স্পন্সর আপনাকে পরবর্তী চাকরি খুঁজে পেতে বা পদোন্নতি পেতে বা কোম্পানির বাইরে ভূমিকা রাখার সুযোগ করে দিতে পারেন। একজন স্পন্সর হলেন কর্মজীবনে আপনার নিজস্ব দূত।

৩. বেতন বাড়ানোর কথা বলুনÑ বিশেষ করে নারীদের ক্ষেত্রে বেতন বাড়ানোর কথা আগে থেকে বলা ভালো। বেতনের ধাপ এবং পরিসর সম্পর্কে এবং আপনি কোন ধাপের উপযুক্ত সে সম্পর্কে সচেতন হোন। আপনার কোম্পানিতে সামনে এগুনোর সুযোগগুলো কী? আপনার বেতন বাড়িয়ে নেওয়ার জন্য আপনার আর কি করা উচিৎ?

৪.            নিজের নেটওয়ার্ক গড়ে তুলুনÑ প্রথম চাকরি পাওয়া বা পরের চাকরিতে যাওয়ার ব্যাপারটা অনেক সময় সম্পন্ন হয় আপনার নিজস্ব পেশাগত নেটওয়ার্কের মাধ্যমে। তাই আপনি চাকরি পাওয়ার পরও নিজের পেশাদারি নেটওয়ার্কের লোকজনের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করুন। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে ভালো জায়গা হলো পেশাদার সমিতিগুলো। বড় করপোরেশনগুলোর প্রায়শ এমন গ্রুপের সঙ্গে সম্পর্ক থাকে যেখান থেকে তারা কর্মচারী পেতে পারে। এগুলো অনেক সময় নবাগত, নারী এবং জাতিগত পরিচয়ের লোকেদের প্রাধান্য দেয়। এই গ্রুপগুলো অন্যদের সঙ্গে যোগাযোগের ভালো মাধ্যম হতে পারে বিশেষ করে কোম্পানির ভেতরের অধিকতর উচ্চতর স্তরের ব্যক্তিদের সঙ্গে। মানুষের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য লিঙ্কডইন সামাজিক মাধ্যমও একটি বড় উপায় বিশেষ করে যখন আপনি কারও সঙ্গে পরিচিত হওয়ার পর তার সঙ্গে সম্পর্ক ধরে রাখতে চান।

৫.            ভোট দিনÑ অভিবাসন ও বন্দোবস্তুকারী সেবাদাতাদের দলগত অবস্থান নিয়ে গবেষণা করুন এবং রাজনৈতিক কর্মকা-ে জড়িত হোন। নিয়োগদান পদ্ধতি কীভাবে বাস্তবায়ন হচ্ছে সে বিষয়ে সরকারের সব স্তরেরই ভূমিকা রাখার সুযোগ আছে। সরকার কীভাবে নিয়োগদানের ক্ষেত্রে প্রভাব রাখতে পারে সেটা খুঁজে বের করুন এবং ব্যবস্থা নিতে বলুন।

৬.           হাল ছেড়ে দেবেন না!Ñ কানাডায় অভিবাসী হয়ে আসা লোকেদের জন্য জীবন কঠিন হতে পারে। আপনি যতটা আশা করেছিলেন এটা হয়তো সেরকম নয় বরং যেটা কল্পনাও করেননি জীবন অতোটাই কঠিন হতে পারে এবং আপনি যেমনটা ধারণা করেছিলেন তার চেয়েও অনেক বেশি সময় লেগে যেতে পারে। তবে জীবনে সুসময় আসবেই। দুয়ার খুলবেই।

কানাডা এখনও অর্থনৈতিক অসাম্য নিয়ে জর্জরিত। আর ইউনাইটেড ওয়ের এই উদ্বেগজনক পরিসংখ্যান থেকে দেখা যাচ্ছে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি না বরং পিছিয়ে পড়ছি। আমরা এই রিপোর্টটিকে কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ার আহবান হিসাবে গ্রহণ করার জন্য সরকার, চাকরিদাতা এবং নাগরিকদের প্রতি আহবান জানাই। আমাদের সবাইকে একসঙ্গে মিলে একটি দীর্ঘমেয়াদী, টেকসই পরিবর্তন আনার জন্য কাজ করতে হবে যাতে আমাদের দেশের সমৃদ্ধির সুফল সবাই সমানভাবে পেতে পারে।

-সৌজন্যে : নিউকানাডিয়ানমিডিয়া.সিএ