কানাডায় ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় বাঙ্গালীদের হৃদরোগ পরিস্থিতি
গবেষণায় দেখা গেছে দক্ষিণ এশীয়ার বয়স্ক ইমিগ্রেন্টদের একটি উল্ল্লেখযোগ্য অংশের হৃদযন্ত্রের অবস্থা ভাল নয় : মৃত্যুর হারও শ্বেতাঙ্গ জনগোষ্ঠির চেয়ে বেশী
ডিসেম্বর ৫, ২০১৮
খুরশিদ আলম : নাম তার আশরাফ চৌধুরী। বয়স ষাট এর কাছাকাছি। তার শারীরিক তেমন কোন সমস্যা ছিল না। কিন্তু বুকের ব্যথা নিয়ে তাকে কয়েকবার হাসপাতালের জরুরী বিভাগে যেতে হয়েছিল। ডাক্তারগণ নানান পরীক্ষা-নীরিক্ষা করেও তার হৃদযন্ত্রে কোন সমস্যা খুঁজে পাননি। বুকের ব্যথাটি সম্ভবত গ্যাস থেকে হচ্ছে- এরকম একটা ধারণা তাকে দেয়া হয়েছিল।
কিন্তু সে ধারণা যে কত বড় ভুল ছিল তা যখন আবিষ্কার করা গেল তখন আশরাফ চৌধুরী সকলের ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যান। ঘটনাটি ঘটে গত বছর ৮ অক্টোর। তার আগের দিন রাত এগারটার দিকে টরন্টোর ডাউনটাউনে কর্মরত অবস্থায় তিনি হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন। ঐ সময় তিনি নিজেই ৯১১ এ কল করে এম্বুলেন্স ডাকেন। কয়েক মিনিটের মধ্যে এম্বুলেন্স এসে পৌঁছায় এবং তাকে দ্রুত টরন্টো জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। হাসপাতালের চিকিৎসকগণ তার শারীরিক অবস্থা পরীক্ষা-নীরিক্ষা করে দ্রুত অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যান। সেখানে প্রায় তিন ঘন্টা আপ্রাণ চেষ্টা করেও চিকিৎসকগণ তাকে বাচাতে পারেননি। অপারেশন চলাকালেও তার হার্ট এ্যাটাক হয় একবার। অপারেশনের পর তার হৃদযন্ত্রের আর্টারীতে তিনটি ব্লক এর উপস্থিতি লক্ষ্য করা গিয়েছিল।
আশরাফ চৌধুরীর এই অকাল ও আকস্মিক মৃত্যুতে পরিবারের সদস্যসহ আত্মীয়-পরিজন সকলেই শোকে মুহ্যমান হওয়ার পাশাপাশি একেবারেই হতবাক হয়ে গিয়েছিলেন। সকলেরই প্রশ্ন ছিল, এটা কি করে সম্ভব? মৃত্যুর এক মাস আগেও ডাক্তার তার স্ট্রেস টেস্ট করিয়েছিলেন। তখনও ডাক্তার বুঝতে পারলো না যে তার হৃদযন্ত্রের অবস্থা এরকম ভয়াবহ পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল?
কানাডার মত এরকম একটি উন্নত চিকিৎসা ব্যবস্থার মধ্যে থেকেও এবং বার কয়েক হাসপাতালের জরুরী বিভাগে গিয়েও যদি হৃদযন্ত্রের আসল সমস্যা কোথায় তা ধরা না যায় তবে তার ব্যাখ্যা কি হতে পারে?
এই প্রতিবেদক এক কানাডিয়ান কার্ডিওলজিস্ট এর কাছে বিষয়টি জানতে চেয়েছিলেন। তিনি জানান, রোগীর বাহ্যিক লক্ষণসমূহ দেখে হৃদযন্ত্রের অবস্থা কতটা খারাপ এটা বলা মুসকিল। স্ট্রেস টেস্ট করানো হলেও না। এনজিওগ্রাম করানো হলে বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া যায়।
কিন্তু আশরাফ চৌধুরীর বেলায় এনজিওগ্রাম কেন করানো হয়নি তা জানা যায়নি।
কানাডায় শতকরা কত ভাগ বাংলাদেশী হৃদযন্ত্রের সমস্যা নিয়ে বাস করছেন তার সঠিক তথ্য বলা মুশকিল। তবে এখানে পরিচালিত বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে দক্ষিণ এশীয়ার বয়স্ক ইমিগ্রেন্টদের একটি উল্ল্লেখযোগ্য অংশের হৃদযন্ত্রের অবস্থা ভাল নয়। বাংলাদেশীরা এই দক্ষিণ এশিয় ইমিগ্রেন্টদের মধ্যেই পড়েন। এবং এরা গুরুতর ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায়ই আছেন। আর শুধু হৃদরোগই নয়, ডায়াবেটিস এবং স্থুলতার সমস্যায়ও ভুগছেন তারা। এবং এই ডায়াবেটেস ও স্থূল রোগ থেকে হৃদরোগের উৎপত্তি ঘটতে পারে।
টরন্টোর নিকটবর্তী হ্যামিলটনের ম্যাকমাস্টার ইউনিভার্সিটির এক গবেষণায় দেখা গেছে কানাডায় দক্ষিণ এশীয় ইমিগ্রেন্টদের মধ্যে হৃদরোগীর সংখ্যা কানাডার শ্বেতাঙ্গ জনগোষ্ঠির চেয়ে অনেক বেশী। ডায়াবেটিস এবং স্থুলতার সমস্যাও শ্বেতাঙ্গ জনগোষ্ঠির চেয়ে দক্ষিণ এশীয় ইমিগ্রেন্টদের মধ্যে বেশী।
সিবিসি নিউজে প্রকাশিত এই প্রতিবেদন থেকে আরো জানা যায়, ঐ গবেষণায় ১৯৭৯ সাল থেকে ২০০৭ সালের মধ্যে প্রায় ৫.৮ মিলিয়ন লোকের ডাটা পরীক্ষা-নীরিক্ষা করে দেখা হয়েছে। তাতে দেখা গেছে কানাডায় দক্ষিণ এশীয় ইমিগ্রেন্টদের (ভারত, বাংলাদেশ, শ্রীলংকা এবং পাকিস্তান) মধ্যে উচ্চমাত্রায় হৃদরোগ বিদ্যমান। এর মধ্যে আছে angina, এবং stroke. এনজিনা হলো – হৃদযন্ত্রে রক্তসরবরাহের অপ্রতুলতাহেতু অল্প পরিশ্রমেই বুকে যে ব্যথা হয় সেটি। স্ট্রোক হলো মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ। হৃদযন্ত্রের সমস্যা বেশী হলে অনেকেরই বাইপাস সার্জারী করাতে হয়। একটি বা দুটি আর্টারিতে ব্লক এর মাত্রা ৮০% এর মত হলে আর্টারীতে রিং পড়ানো হয়। এর জন্য বুকে কাটাছেড়া করতে হয় না। তবে এসবই নির্ভর করে রোগীর প্রকৃত অবস্থার উপর এবং কার্ডিওলজিস্ট এর সিদ্ধান্তের উপর।
ঐ গবেষণায় আরো দেখা গেছে হৃদরোগের কারণে দক্ষিণ এশীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে মৃত্যুর হারও শ্বেতাঙ্গ জনগোষ্ঠির চেয়ে বেশী। এই রোগে শ্বেতাঙ্গ পুরুষদের মৃত্যুর হার ২৯% আর দক্ষিণ এশীয় পুরুষদের ৪২%। আর শ্বেতাঙ্গ মহিলাদের ক্ষেত্রে মৃত্যুর হার ১৯% এবং দক্ষিণ এশীয় মহিলাদের ক্ষেত্রে মৃত্যুর হার ২৯%। দক্ষিণ এশীয় বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপ এ ভোগা রোগীর সংখ্যাও শ্বেতাঙ্গ জনগোষ্ঠির চেয়ে বেশী।
গবেষকগণ তাদের প্রাপ্ত তথ্য তুলনা করে দেখতে পান একই মাপের দৈহিক উচ্চতা ও ওজনের একজন শ্বেতাঙ্গ মানুষের তুলনায় একজন এশীয় মানুষের শরীরে অধিকমাত্রার বডি ফ্যাট রয়েছে। এশীয়দের পেটেও রয়েছে অধিকমাত্রার ফ্যাট। তাছাড়া এশীয় মহিলাদের কোমড় এবং নিতম্বে রয়েছে উচ্চমাত্রার ফ্যাট। আর এই সমস্যাগুলো হৃদরোগকে লালগালিচার সংবর্ধনা দিয়ে শরীরে ডেকে আনে। কেউ কেউ কৌতুক করে বলেন, শুধু ডেকে আনা-ই নয়, হৃদরোগকে পিআর কার্ডও দেয়া হয়। অর্থাৎ কানাডার ইমিগ্রেশনের ভাষায় যাকে পার্মান্টে রেসিডেন্সী বলা হয়।
কিন্তু কানাডায় দক্ষিণ এশীয় জনগোষ্ঠির মধ্যে হৃদরোগী সংখ্যা এত বেশী কেন? এবং একই সাথে ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যাও?
এর কারণ খুঁজে পাওয়া সহজ নয় বলে জানিয়েছেন ম্যাক্মাস্টার ইউনিভার্সিটির মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপিকা সোনিয়া আনান্দ। সিবিসি নিউজের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে তিনি জানান, বিষয়টি নিয়ে এখনো গবেষণা করা হচ্ছে। দক্ষিণ এশীয়দের জেনেটিক দিকটাও পরীক্ষা-নীরিক্ষা করে দেখা হচ্ছে। এটি আসলে জটিল একটি বিষয়। শুধু জেনেটিক বিষয়টি দায়ী তাও বলা যাচ্ছে না।
তাহলে এই মুহুর্তে দক্ষিণ এশীয় জনগোষ্ঠি কি করতে পারে হৃদরোগ আর ডায়াবেটিসকে মোকাবেলা করার জন্য? সোনিয়া বলেন, লাইফস্টাইল বদলাতে হবে। যেমন নিয়মিত ব্যায়াম করা, স্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়া -বিশেষ করে কম মাত্রায় কার্বোহাইড্রেটযুক্ত খাবার খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। দক্ষিণ এশীয় জনগোষ্ঠির সব বয়সের লোকদেরকেই এ ব্যাপারে সতর্ক হতে হবে।
কানাডিয়ান জার্নাল অব ডায়াবেটিস এর তথ্যমতেও দেখা যায় এই দেশটিতে আসা দক্ষিণ এশীয় জনগোষ্ঠির মধ্যে ডায়াবেটিস আর হৃদরোগের প্রাদুর্ভাব শ্বেতাঙ্গ জনগোষ্ঠির চেয়ে অনেক বেশী। আদম শুমারীর (২০০৬) হিসাবে দেখা যায় কানাডায় দৃশ্যমান সংখ্যালঘুদের সংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই বৃদ্ধির হার ২৭%। এই বৃদ্ধির হার অন্যান্য সম্প্রদায়ের তুলনায় ৫ গুণ বেশী। এই হার অব্যাহত থাকলে ২০৩১ সালের মধ্যে প্রতি ৩ জন কানাডিয়ান এর মধ্যে একজন হবেন দৃশ্যমান সংখ্যা লঘু সম্প্রদায়ের সদস্য। ২০০৬ সালের আদম শুমারীতে ১.৩ মিলিয়ন লোক নিজেদেরকে দৃশ্যমান সংখ্যালঘুর সদস্য বলে জানিয়েছেন। এদের মধ্য আছেন ভারত, বাংলাদেশ, শ্রীলংকা, পাকিস্তান ও নেপালের লোকজন। আর এই দ্রুত বর্ধমান
জনগোষ্ঠির মধ্যে হৃদরোগ আর ডায়াবেটিস রোগের এরকম ব্যপকতা নিশ্চই দুশ্চিন্তার একটি বড় কারণ হয়ে দাড়িয়েছে আজ। প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, কানাডার বাইরেও দক্ষিণ এশীয়দের মধ্যে উচ্চ হারে ডায়াবেটিস বিদ্যমান। এবং সবচেয়ে উচ্চ হারের অকাল
কার্ডিও ভাসকুলার রোগ রয়েছে এমন লোকদের বসবাস এই দক্ষিণ এশিয়াতেই।
কানাডায় যারা বাংলাদেশী আছেন এবং বিশেষ করে যাদের বয়স পঞ্চাশোর্ধ তাদের প্রায় অধিকাংশেরই রয়েছে ডায়াবেটিস এবং হৃদরোগের সমস্যা। কোন পার্টিতে পঞ্চাশোর্ধ দশজন বাঙ্গালীর সমাগম হলে দেখা যায় এদের মধ্যে অর্ধেকের বেশী ডায়াবেটিস রোগী। আর হৃদরোগের বিষয়টি একটু ভিন্ন রকম। অনেকে হয়তো জানেনই যে তিনি হার্টে ব্লক নিয়ে চলাফেরা করছেন। বাহ্যিক কোন লক্ষণ নেই। তাই ঠিক বুঝতে পারেনা। হৃদরোগ থাকলে সবার বেলায় লক্ষণ প্রকাশ নাও পেতে পারে। বিশেষ করে যাদের ডায়াবেটিস আছে তাদের অনেকের ক্ষেত্রেই লক্ষণ প্রকাশ পায় না। একদিন হয়তো দেখা যায় হঠাৎ করেই একটা বড় ধরণের দুর্ঘটনা ঘটে যায়। এ কারণেই ডাক্তারগণ বলে থাকেন, যাদের বয়স হয়েছে এবং যারা ডায়াবেটিস এর রোগী তাদের উচিৎ কার্ডিওলজিস্ট এর পরামর্শ নেয়া।
গবেষকরা বলছেন, স্থূলতা এবং ডায়াবেটিস হৃদরোগের একটি অন্যতম বড় কারণ এবং মৃত্যুর হার বৃদ্ধিতেও এটি বিশেষ ভূমিকা রাখে। স্টাডি অব হেলথ এসেসমেন্ট এ্যান্ড রিস্ক ইন এথনিক গ্র“পস (SHARE) এর তথ্য অনুযায়ী দেখা যায়, বাংলাদেশের বড় শহরগুলো সহ দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন শহরাঞ্চল থেকে যারা ইমিগ্রেন্ট হয়ে কানাডায় আসেন তাদের মধ্যে ইউরোপ থেকে আসা ইমিগ্রেন্টদের তুলনায় উচ্চমাত্রায় হৃদরোগের ঝুঁকি বিদ্যমান। এমনকি চাইনিজ ইমিগ্রেন্টদের তুলনায়ও বেশী। একই চিত্র দেখা গেছে যুক্তরাজ্য সহ অন্যান্য শিল্পোন্নত দেশেও।
কানাডিয়ান জার্নাল অব ডায়াবেটিস এর তথ্য থেকে আরো জানা যায়, যে সকল দক্ষিণ এশীয় মানুষ গ্রাম থেকে শহরে আসেন এবং যারা অনুন্নত দেশ থেকে উন্নত দেশে আসেন (যেমন কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য) তাদের মধ্যে স্থূলতা, ইনসুলিন রেজিস্টেন্স, টাইপ ২ ডায়াবেটিস এবং হৃদরোগ এর প্রাদুর্ভাব বেশী।
যুক্তরাজ্যের ডাটা অনুযায়ী দেখা যায়, ঐ দেশটিতে দক্ষিণ এশীয় শিশুদের মধ্যে স্থূলতার হার অনেক বেশী। শ্বেতাঙ্গ শিশুদের তুলনায় এদের স্থূলতার হার ৪৫% বেশী। আর বাড়তি ওজনের হার ২৭% এর বেশী।
তাছাড়া শ্বেতাঙ্গদের তুলনায় দক্ষিণ এশীয়দের মধ্যে ডায়াবেটিস ধরা পরে অন্তত দশ বছর আগে। অন্যদিকে প্রবাসে দ্বিতীয় এবং তৃতীয় প্রজন্মের এশীয়দের মধ্যেও ডায়াবেটিস ও হৃদরোগ নিয়ে দেখা দিচ্ছে একই সমস্যা।
একটা সম্পূর্ণ নতুন দেশে আসার পর প্রথম প্রজন্মের অধিকাংশ ইমিগ্রেন্টদেরকে নানারকম আর্থ-সামাজিক প্রতিকুলতার সম্মুখীন হতে হয় এবং এর সাথে যোগ হয় মানসিক চাপ, হতাশা ও অস্থিরতা। এগুলোর একটা উল্ল্লেখযোগ্য ভূমিকা থাকতে পারে উচ্চ মাত্রার ডায়াবেটিস এবং হৃদরোগ হওয়ার পিছনে। আরো আছে শারীরিক সক্রিয়তার অভাব। এটির অভাব যেমন রয়েছে প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে, তেমনি রয়েছে শিশু কিশোরদের মধ্যেও। এশীয়দের মধ্যে উচ্চমাত্রার ডায়াবেটিস ও হৃদরোগ হওয়ার পিছনে এই শারীরিক সক্রিয়তার অভাব সম্ভবত একটি বড় ধরণের কারণ।
কারণ আরো আছে। সেটি হলো খাদ্যপ্রীতি। বাঙ্গালীসহ দক্ষিণ এশীয়দের মধ্যে ভোজনরসিকের অভাব নেই। ভোজন রসনার তৃপ্তি ঘটাতে খাদ্যের মধ্যে তারা ব্যবহার করেন অতিমাত্রায় নানান জাতের মশলা আর তেল-ঘি। প্রায় প্রতি সপ্তাহেই নিজ বাড়িতে বা আত্মীয়-বন্ধুদের বাড়িতে পার্টি থাকে তাদের। সেখানে উচ্চমাত্রার চর্বিযুক্ত নানান পদের মজাদার সব খাবার পরিবেশন করা হয়। সেই সাথে আছে উচ্চ মাত্রার চিনিযুক্ত নানান রকমের মিষ্টান্ন। আরো আছে অতিমাত্রায় চিনি ও চর্বিযুক্ত কোমল পানীয়। আর এই সব পার্টিতে খেতে বসে পরিমাণের বিষয়ে কারো কোন নিয়ন্ত্রণ থাকে না।
কোন কোন বিজ্ঞানী অবশ্য বলছেন যে হৃদরোগের প্রধান কারণ মানসিক। মার্কিন হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ ডা: ক্রিচটন দীর্ঘ গবেষণার পর এ কথা বলেন। তার এ কথার সঙ্গে কানাডা ও অন্যান্য উন্নত দেশে ইমিগ্রেন্ট হিসাবে আগত দক্ষিণ এশীয় ইমিগ্রেন্টদের বর্তমান স্বাস্থ্যগত অবস্থার যথেষ্ট মিল লক্ষ্য করা যায়। বিশেষত হৃদরোগের ক্ষেত্রে। আমরা দেখেছি ইমিগ্রেন্টদের অনেকেই নতুন একটি দেশে আসার পর নানারকম টেনশন আর স্ট্রেস এর মুখমুখি হন। এর মধ্যে আছে নিজ নিজ পেশায় চাকরী না পাওয়া, যোগ্যতার তুলনায় অনেক নিচ স্তরের চাকরী করা, এক চাকরীতে সংসার চলেনা বলে দুই চাকরী করা, তারপরও স্বল্প আয়, আর সেই আয় দিয়ে সংসার চালাতে গিয়ে হিমসিম খাওয়া, আর্থিক অনটনের কারণে পারিবারিক কলহ ও অশান্তি, ঋণগ্রস্ত হওয়া, উচ্চহারে সেই ঋণের সুদ দেওয়া, কখনো কখনো ছেলে-মেয়ের বিপথগামী হওয়া অথবা বিপথগামী হতে পারে সেই দুশ্চিন্তা। আরো আছে নতুন দেশের নতুন ভাষা ও সংস্কৃতির সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর চাপ, দেশে ফেলে আসা বাবা-মায়ের জন্য দুশ্চিন্তা এবং তাদের জন্য কিছু করতে না পারার অপরাধবোধে দংশিত হওয়া। এক পর্যায়ে হতাশা আর বিষন্নতায় আক্রান্ত হওয়া। এসব কিছু মিলে ইমিগ্রেন্টদের মধ্যে একটা চরম মানসিক সংকট তৈরী হয়। আর সম্ভবত সে কারণেই আমরা লক্ষ্য করছি ইমিগ্রেন্টদের মধ্যে উচ্চমাত্রার ডায়াবেটিস আর হৃদরোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দিচ্ছে।
বাংলাদেশী চিকিৎসক মনিরুজ্জামান লিখেন, মানসিক কারণসহ বিজ্ঞানীরা আরো যে সব কারণকে হৃদরোগের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ বলে মনে করে থাকেন তারমধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হলো-
১. বয়স: বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বাড়তে থাকে।
২. লিঙ্গ: মহিলাদের চেয়ে পুরুষেরা হৃদরোগে বেশি আক্রান্ত হয়। তবে মেনোপজের পরে মহিলাদের হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি অনেক বেড়ে যায়।
৩. বংশগত: বাবা-মায়ের হৃদরোগ থাকলে তাদের সন্তানদের হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি অধিক থাকে। এর মূল কারণ পরিবারের একই খাদ্যাভ্যাস ও ধূমপানের অভ্যাস।
৪. ধূমপান: হৃদরোগ হওয়ার পেছনে ধূমপানের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যে ব্যক্তি নিয়মিত ধূমপান করে থাকেন তার হঠাৎ হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করার ঝুঁকি থাকে।
৫. উচ্চ রক্তচাপ: উচ্চ রক্তচাপ করোনারি হৃদরোগের একটি মারাত্মক রিস্ক ফ্যাক্টর। অনিয়ন্ত্রিত উচ্চ রক্তচাপ হৃদপিন্ডের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর।
৬. রক্তের কোলেস্টেরলের মাত্রার আধিক্য: রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রার আধিক্য হৃদরোগের একটি গুরুত্বপূর্ণ রিস্ক ফ্যাক্টর।
৭. ডায়াবেটিস: হৃদরোগ হওয়ার পেছনে ডায়াবেটিসের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দীর্ঘদিনের ডায়াবেটিস হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ায়।
৮. অতিরিক্ত ওজন এবং মেদস্থূলতা: অধিক ওজন হলে শরীরে রক্ত সরবরাহ করতে হৃদপিণ্ডের অধিক কাজ করতে হয়। যার ফলে হৃদরোগের ঝুঁকি বেড়ে যায়।
৯. শারীরিক পরিশ্রমের অভাব: শারীরিকভবে নিস্ক্রিয় লোকদের হৃদরোগ হওয়ার প্রবণতা দেখা যায়। অলস জীবন-যাপন করোনারি হৃদরোগের জন্য আরেকটি রিস্ক ফ্যাক্টর।
উপরে উল্ল্লেখিত কারণগুলোর প্রায় সবকটিই প্রবাসী বাঙ্গালীদের মধ্যে বিদ্যমান। আর সেই সাথে মানসিক চাপ। বিজ্ঞানীরা উপরোক্ত সবগুলো কারণের মধ্যে একক গুরুত্বপূর্ণ কারণ হিসেবে স্ট্রেসকে চিহ্নিত করছেন। গবেষণায় দেখা গেছে, কোনও ব্যক্তির রক্তের উচ্চ কোলেস্টেরল লেভেল, উচ্চ রক্তচাপ বা ধূমপানের অভ্যস থাকা সত্ত্বেও স্ট্রেস- ফ্রি থাকার কারণে তিনি হৃদরোগ থেকে মুক্ত রয়েছেন। আবার উপরোক্ত কারণগুলো না থাকা সত্ত্বেও শুধু স্ট্রেসের কারণে কোনও ব্যক্তি হৃদরোগে আক্রান্ত হয়েছেন।
হৃদরোগ থেকে মুক্ত থাকার কিছু উপায় :
প্রবাসে অধিকাংশ ইমিগ্রেন্টকে নানান প্রতিকুলতার মধ্য দিয়ে জীবন অতিবাহিত করতে হয়। বাংলাদেশীদের মধ্যে যারা অনেক দিন ধরে এদেশে আছেন তারা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই উচ্চ রক্তচাপ, কোলেস্টরেল এবং ডায়াবেটিসে ভোগেন। আর এদের মধ্যে পুরুষের সংখ্যা বেশি। ব্যস্ত জীবনের ফলে অনেকে ডাক্তারের কাছে যাওয়ার ফুসরত পান না। যদি মনে করেন যে মোটামুটি ভাল আছেন তাহলে আর ডাক্তারের কাছে যাওয়ার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন না। ডাক্তারগণ বলেন,এটি আসলে ঠিক নয়। প্রবাসীরা সময়মত সার্ভিসিং এর জন্য গাড়ি নিয়ে যান ডিলার বা ম্যাকানিক শপে। কিন্তু নিজ শরীরেরও যে নিয়মিত ‘সার্ভিসিং’ এর প্রয়োজন আছে সেটি ভাবেন না। বিশেষত যারা বয়স্ক তাদের নিয়ম করে ডাক্তারের কাছে যাওয়া উচিৎ ডায়াবেটিস ও হৃদরোগ আছে কি না তা পরীক্ষা করানোর জন্য। আর যাদের আছে তাদেরও নিয়মিত ডাক্তারের কাছে যাওয়া উচিৎ রোগ পরিস্থিতি কোন পর্যায়ে আছে তা জানার জন্য এবং নতুন কোন চিকিৎসার প্রয়োজন আছে কি না তা পরামর্শ করার জন্য।
হৃদরোগ থেকে কিভাবে মুক্ত থাকা যায় সে বিষয়ে ডাঃ আবুল হাসান মুহম্মদ বাশার এর পরামর্শ হলো : হার্টকে ব্লক মুক্ত রাখতে উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস এবং রক্তে কোলেস্টেরলের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ ও ধূমপান পরিহার করা অত্যন্ত জরুরি। কাজটি খুব সহজ নয়। এজন্য চাই দৃঢ় মনোবল এবং জীবনাচরণে পরিবর্তন। পুরো ব্যাপারটা কঠিন মনে হলেও জীবনাচরণ সংক্রান্ত কিছু কাজ কিন্তু সহজেই সম্ভব। যেমন :
শারীরিক পরিশ্রম বাড়ানো : মানুষ যত নগরকেন্দ্রিক হচ্ছেন, ততই তারা বুদ্ধিবৃত্তিক পেশায় আত্মনিয়োগ করছেন। তারা যতটা মাথা খাটাচ্ছেন, শরীর ততটা না। ফলে শরীর হয়ে পড়ছে নিষ্ক্রিয়। অথচ, নিয়মিত শারীরিক পরিশ্রম উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস ও উচ্চ কোলেস্টেরলের ঝুঁকি কমায়।
লিফট কম ব্যবহার করুন : প্রতিদিন অন্তত ৩০ মিনিট দ্রুত হাঁটা কিংবা জগিংয়ের অভ্যাস করুন। যারা হাঁটার সময় বের করতে পারেন না, তারা কাছের দূরত্বগুলো যানবাহন ব্যবহার না করে পায়ে হেঁটে যান। যতটা সম্ভব লিফটে না চড়ে সিঁড়ি ব্যবহার করুন।
ক্যালরির হিসাব রাখুন : খাবারের মাধ্যমে প্রতিদিন যে পরিমাণ ক্যালরি আপনি গ্রহণ করছেন, সেই পরিমাণ ক্যালরি যদি খরচ না হয়, তাহলে বাড়তি ক্যালরি রক্তে কোলেস্টেরলের পরিমাণ বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে শরীরের ওজন বাড়িয়ে আপনাকে ডায়াবেটিস ও ইশ্কেমিক (ischaemic) হার্ট ডিজিজের দিকে ঠেলে দেবে। এজন্য প্রতিদিন খাবারের মাধ্যমে গৃহিত ক্যালরি ও এর ব্যয় সম্পর্কে একটা মোটামুটি ধারণা মাথায় রাখা ভালো।
স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস : ইশ্কেমিক হার্ট ডিজিজের ঝুঁকি কমাতে নিচের খাবারগুলো আপনার দৈনন্দিন খাদ্য তালিকায় রাখতে পারেন।
১.টাটকা শাকসব্জি, ২.ফলমূল, ৩.মাছ- বিশেষ করে সামুদ্রিক মাছ, ৪.বিভিন্ন ধরনের বাদাম, শিম, মটরশুঁটি, ৫. -সয়াজাত খাবার যেমন-টফু, ৬. রসুন, ৭. ননিমুক্ত দুধ, পনির।
কিছু খাবার পরিহার করাও স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাসের অংশ। এ ধরনের কিছু খাবার হল;
১. অতিরিক্ত লবণ, ২. লাল মাংস ও অতিরিক্ত চর্বিযুক্ত মাংস যেমন- গরু, খাসি, হাঁস ইত্যাদি, ৩. মাংসের ওপরের চামড়া, ৪. মাখন, ৫. অধিকাংশ কোমল পানীয়, ৬. অতিরিক্ত তেলে ভাজা খাবার।
সাধারণত কোন দাওয়াতে বা অনুষ্ঠানে গেলে খাদ্যগ্রহণের পরিমাণের ওপর আমাদের কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকে না। এটা ক্ষতির কারণ হতে পারে। মনে রাখতে হবে, কী খাচ্ছেন প্রশ্নটা যেমন জরুরি, কতটুকু খাচ্ছেন প্রশ্নটাও সমান জরুরি।
মানসিকভাবে চাপমুক্ত থাকার অভ্যাস করুন
দীর্ঘমেয়াদি মানসিক চাপ আপনার রক্তচাপ ও হৃদস্পন্দন বাড়িয়ে ইশ্কেমিক হার্ট ডিজিজের ঝুঁকি বৃদ্ধি করে। সুতরাং যতটা সম্ভব মানসিকভাবে চাপমুক্ত থাকার চেষ্টা করুন। বুক ভরে শ্বাস নিন এবং সুযোগ পেলেই হাসুন, প্রাণখুলে। মানসিক প্রশান্তির জন্য নামাজ, প্রার্থনা, মেডিটেশন এসবের সাহায্যও নিতে পারেন।
নিয়মিত চেক-আপ
হার্টের ব্লক সাধারণত বয়স্কদের রোগ হলেও ইদানীং অল্প বয়সেও এ রোগ দেখা যাচ্ছে। তাই ব্লক জনিত হৃদরোগ বা ইশ্কেমিক হার্ট ডিজিজ প্রতিরোধে ৪০ বছর বয়সের পর নিয়মিত চেক-আপ করানো ভালো।