উড়োজাহাজের সবচেয়ে নোংরা জায়গা কোনটা? জেনে বিস্মিত হতে পারেন

CBC marketplace ১৮টি ফ্লাইটের ১০০টিরও বেশি নমুনা পরীক্ষা করে তাতে নানা ধরণের ব্যাকটরিয়া ও রোগজীবাণু দেখতে পেয়েছে

জানুয়ারী ৭, ২০১৯

প্রবাসী কণ্ঠ ডেস্ক : ব্যবহৃত ব্যান্ডেজের তুলা, খোলা কনডম, স্মার্টফোন, নোংরা ডায়াপার। এই জিনিসগুলোর মধ্যে মিল কিসে?

ফ্লাইট অ্যাটেন্ডেন্টরা cbc marketplace-কে জানিয়েছেন যে, ওগুলোর সবই উড়োজাহাজের সিট পকেটে পাওয়া গেছে।

marketplace এর সর্বশেষ অনুসন্ধানে উঠে এসেছে যে, আপনি উড়োজাহাজের যেসব জায়গা প্রায়শ স্পর্শ করেন সে জায়গাগুলো আপনি যতটা ধারণা করছেন ততটা পরিষ্কার নয়। বরং এসব জায়গার অনেকগুলোই বিভিন্ন ধরণের ব্যাকটেরিয়া ও অন্যান্য রোগজীবাণুতে পরিপূর্ণ।

marketplace কর্মীরা অটোয়া ও মন্ট্রিলের মধ্যে চলাচলকারী কানাডার তিনটি বড় এয়ারলাইনÑ এয়ার কানাডা, ওয়েস্টজেট এবং পোর্টার-এর মোট ১৮টি স্বল্পবিরতির ফ্লাইট পরীক্ষা করেছেন।

বিমানে ফোল্ডিং ট্রে-তে পরিবেশিত খাবার। এখানে রোগজীবানু থাকতে পারে। ছবি : অনলাইন

প্রতিটি ফ্লাইটেই যেসব জায়গা নতুন করে ঝাড়ামোছা করা হয় সেগুলি হলো: সিটবেল্ট, ট্র-টেবিল, হেডরেস্ট, সিট পকেট এবং ওয়াশরুমের হাতল। যেসব ফ্লাইট পরীক্ষা করা হয়েছে সেগুলো থেকে marketplace ১০০টির বেশি নমুনা সংগ্রহ করে।

এসব নমুনা পরে গুয়েলফ ইউনিভার্সিটির একটি ল্যাবে পরীক্ষা করেন মাইক্রোবায়োলজিস্ট কিথ ওয়ারিনার। তিনি নমুনাগুলিতে ঈস্ট, মোল্ড, ই-কোলি এবং অন্যান্য রোগজীবাণু আছে কি না তা পরীক্ষা করে দেখেন।

ওয়ারিনার বলেন, “আমরা সেইসব নমুনা থেকে যা পেয়েছি তাতে আমি হতভম্ব হয়েছি। ওগুলো একটার চেয়ে অন্যটা বেশি ভয়ংকর।”

ওয়ারিনার বলেন, বিমানের যেসব জায়গা ঝাড়ামোছা করা হয় তার প্রায় অর্ধেক জায়গাতেই এমন মাত্রায় ব্যাকটেরিয়া দেখা গেছে যা মানুষকে সংক্রমণের ঝুঁকিতে ফেলতে পারে।

পরীক্ষা করা ১৮টি ফ্লাইটের বেশিরভাগেই ঈস্ট ও মোল্ডের মতো জার্ম পাওয়া গেছে। এ থেকে ওয়ারিনার ধারণা করছেন যে, জায়গাগুলো হয় ভালো করে পরিষ্কার করা হয় না অথবা নিয়মিতভাবে করা হয় না।

উড়োজাহাজের সবচেয়ে দূষিত জায়গাটা হলো হেডরেস্ট।

বিমানের সিটে এই হেডমেটগুলোতে রোগজীবানু থাকতে পারে। ছবি : অনলাইন

ওয়ারিনারের কাছে সবচেয়ে উদ্বেগজনক আবিষ্কার হলো, ই-কোলাই ব্যাকটেরিয়ার অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া। এই জীবাণুটি সিট পকেট এবং হেডরেস্ট উভয় জায়গাতেই পাওয়া গেছে।

ই-কোলাই-র মতো রোগজীবাণুর উপস্থিতির কারণে যে কেউ অভ্যন্তরীণ সংক্রমণের শিকার হতে পারেন এবং সেক্ষেত্রে ডায়রিয়া, বমি এবং পেট ব্যথার মতো উপসর্গ দেখা দিতে পারে।

ওয়ারিনার বলেন, “সিট পকেটের ভেতরে কেমন করে ই-কোলাই ব্যাকটেরিয়া ঢুকলো সেটা জানার এবং ধারণা করার চেষ্টা আমরা করেছি।”

‘কাজটা করা হয় মূলত সৌন্দর্য রক্ষার খাতিরে’

সিট পকেটে কিভাবে গাদ লেগে থাকতে পারে সে সম্পর্কে খুব ভাল ধারণা আছে কনর রেমাস-এর। পোর্টারের সাবেক এই কর্মচারী বলেন, তিনি সিট পকেটে ব্যবহৃত ডায়াপার এবং অন্যান্য বর্জ্যদ্রব্য পেয়েছেন।

তিনি বলেন, “সবকিছুই সিট পকেটে পাওয়া যায়, কাগজের মতো পাতলা বমির ব্যাগ থেকে শুরু করে ব্যবহৃত র‌্যাপার পর্যন্ত সব কিছুই।”

marketplace বিভিন্ন বিমান সংস্থার এক ডজনেরও বেশি সাবেক ফ্লাইট অ্যাটেন্ডেন্ট এবং কাস্টমার সার্ভিসের প্রতিনিধির সঙ্গে কথা বলেছে তাদের উড়োজাহাজে দায়িত্ব পালনের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে। তাদের বেশিরভাগই বলেছেন যে, বিমানের একটি ফ্লাইটের পর আরেকটি ফ্লাইট যাত্রার আগে সেটি পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করার দায়িত্ব তাদেরই। তবে দুটি ফ্লাইটের মাঝখানে পুরো বিমানটি যথাযথভাবে জীবাণুমুক্ত করার মতো যথেষ্ট সময় পাওয়া যায় না।

ওয়েস্টজেট-এর সাবেক কর্মচারী স্টিফেন পোইরিয়ের বলেন, প্রকৃত বাস্তবতা হলো, নতুন ফ্লাইট শুরুর আগে কর্মীরা মাত্র ১৫ মিনিট সময় পায় সেটিকে প্রস্তুত করতে। “টেবিলগুলো ধুয়ে ফেলা বা সবকিছু যথাযথভাবে পরিষ্কার করার মতো সময় আমরা পাই না।”

তিনি বলেন, দুটি ফ্লাইটের মাঝে কর্মীরা ক্লিনজার বা অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল স্প্রে ব্যবহার করার সময় পান না। অনেক পরিষ্কারক দ্রব্য বিমানে ব্যবহারের ওপরও অনেক ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ আছে।

পোইরিয়ের বলেন, “আমরা বিমানে স্প্রে নিতে পারি না, ন্যাকড়াও নেওয়া যায় না। অনেক পরিষ্কারক দ্রব্যই ভয়ংকর। সুতরাং হয় আমাদেরকে পানি দিয়ে ধুতে হবে বা রুমাল দিয়ে মুছতে হবে।”

রেমাস বলেন, পরিষ্কার যদি করা হয়ও সেটা করা হয় উপরে উপরে। “পরিষ্কারের বিষয়টি কখনই সর্বোচ্চ গুরুত্বপূর্ণ হিসাবে বিবেচনা করা হয় না। এটা অগ্রাধিকার পায় বাহ্যিক সৌন্দর্য রক্ষার দিকটি মাথায় রেখে।”

শরীরের স্পর্শ লাগার জায়গায়ও ব্যাকটেরিয়া পাওয়া গেছে

মাইক্রোবায়োলজিস্ট ও স্বঘোষিত “জার্ম মানব” জেসন টেট্রোর মতে, marketplace ট্রে-টেবিলে যে মাত্রার রোগজীবাণু পেয়েছে তাতে এটা স্পষ্ট যে, ওগুলো বেশ কিছু সময়ের জন্য ধোয়া হয়নি।

তিনি বলেন, ট্রে-টেবিলের বাস্তবতার বিষয়ে যাত্রীদের সুনির্দিষ্টভাবে মনোযোগ দিতে হবে। কারণ এতে এমন ধরণের জার্ম থাকতে পারে যা ত্বকে ও নরম কোষ-কলায় সংক্রমণ ঘটাতে পারে।

টেট্রো বলেন, “স্ট্যাফাইলোককাস অরেউস-এর মতো জীবাণুর সংস্পর্শে এলে আপনি নিশ্চিতভাবেই খারাপ কিছু ঘটার উচ্চ ঝুঁকির মধ্যে থাকবেন।”

যাত্রীদের জন্য টেট্রোর পরামর্শ, ট্রে-টেবিলের ওপর মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়বেন না এবং খাবার মুখে দিবার আগে সেটা কখনই টেবিলের ওপর নামিয়ে রাখবেন না। কারণ টেবিলের জার্ম মুখে বা পেটে গেলে তা খুবই ক্ষতিকর হতে পারে।

এমনকি ‘জার্ম মানব’ও বিতৃষ্ণ!

সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে কাজ করেছেন টেট্রো, তারপরও বিমানের হেডরেস্টের যে অবস্থা জেনেছেন তাতে তিনিও বিস্মিত।

তিনি বলেন, “আমি মর্মাহত। সত্যিকার অর্থে, আমাকে বিমানে প্রায়ই দেখা যায়, আমি প্রচুর ভ্রমণ করেছি বিমানে। আমি সেইসব জায়গা সম্পর্কে সচেতন যেগুলোতে জার্ম থাকতে পারে। তারপরও হেডসেটের কী অবস্থা সেটা আপনারা আমাকে দেখিয়েছেন। আর এমনকি আমি, এই জার্ম মানবও বিতৃষ্ণ বোধ করছি।

প্রধানত গলায় জ্বলুনির সৃষ্টিকারী হেমোলাইটিক ব্যাকটেরিয়া নিয়ে টেট্রো বিশেষভাবে উদ্বিগ্ন। পূঁজ তৈরি করে এমন ব্যাকটেরিয়া (staph) সম্পর্কেও উদ্বেগ জানান তিনি। হেডরেস্টে এধরণের ব্যাকটেরিয়া পাওয়া গেছে।

টেট্রো বলেন, “কোনও হেডরেস্টে যদি ওইসব জার্ম থাকে আর আপনি সেটার ওপর মাথা রাখেন তাহলে সেগুলো আপনার মুখের মাধ্যমে ও নিঃশ্বাসের সঙ্গে শরীরের ভেতরে ঢোকার মতো নৈকট্য তৈরি হতে পারে। ওগুলো মুখের মধ্য দিয়ে বা নিঃশ্বাসের সঙ্গেই শরীরে প্রবেশ করে।

টেট্রো আরও বলেন, ওইসব রোগজীবাণু শরীরে ক্ষতের মাধ্যমেও সংক্রমিত হতে পারে। “আপনার যদি মুখে ব্রণ থাকে আর আপনি যদি সারাক্ষণ মুখমন্ডল স্পর্শ করেন তাহলে জীবাণু আপনার শরীরে সহজেই ঢুকতে পারে এবং আপনার ত্বকে দাদ জাতীয় চর্মরোগও হতে পারে।” তিনি বলেন, জানা থাকা দরকার যে, আমরা যেসব জীবাণু পেয়েছি সেগুলোর পাশাপাশি অন্য আরও অনেক ধরণের জীবাণু বিমানের ওইসব খোলা জায়গায় থাকতে পারে। জায়গাগুলো যথেষ্ট পরিষ্কার করা হয় না। আর ব্যাকটেরিয়ার চেয়ে ঈস্ট ও মোল্ড জাতীয় জীবাণু পরিষ্কার করা অপেক্ষাকৃত কঠিন।

marketplace দুটি বিমান সংস্থা থেকে যাত্রীদের যে কম্বল দেওয়া হয় সেগুলোও পরীক্ষা করেছে। এগুলো হলো এয়ার কানাডা ও ওয়েস্টজেট। (পোর্টার কম্বল দেয় না) ওয়েস্টজেটের কম্বলে ঈস্ট, মোল্ড এবং বিপুল পরিমাণ ব্যাকটেরিয়া দেখে তিনি বিস্মিত হন।

তিনি বলেন, “উদ্বেগের কারণ হলো এই যে, ওগুলো ছিলো সেলফোনের মোড়কে। এগুলো ব্যবহার করা ঠিক হয়নি।”

অনুসন্ধানে পাওয়া ফলাফল নিয়ে ওয়েস্টজেটের সঙ্গে কথা বলতে গেলে সংস্থাটি marketplace-কে বলেছে যে, এই ফলাফল দেখে তারাও উদ্বিগ্ন। ই-মেলে দেওয়া জবাবে সংস্থাটি বলেছে, “আমরা বিষয়টি আরও খতিয়ে দেখছি। কারণ, আমাদের ফ্লাইটে যেসব কম্বল ব্যবহার করা হয় সেগুলো সবই নতুন (আগে ব্যবহার করা হয়নি) এবং সেগুলো সিল করা অবস্থায় সরাসরি পরিবেশকের কাছ থেকে আসে।

বিমান সংস্থাগুলোর সাড়া

বিমান সংস্থার সাবেক কর্মীরা বলছেন, একটি উড়োজাহাজ যথাযথভাবে পরিষ্কার করার সময় হলো যখন এটা সার্ভিসে থাকে না।

তিনটি বিমান সংস্থার প্রতিটিই এ বিষয়ে সাক্ষাৎকার দিতে অস্বীকৃতি জানালেও ই-মেলের জবাব দিয়েছে। তিনটি সংস্থাই বলেছে যে তারা বিমানের অভ্যন্তরীণ সজ্জার বিষয়ে কানাডা ও আন্তর্জাতিক বিধি অনুসরণ করে।

এয়ার কানাডা তার জবাবে একটি সমীক্ষার ফলাফল তুলে ধরেছে। সমীক্ষায় বলা হয়েছে যে, বিমানের ভেতরে নোংরা থাকে এটা সত্য, তবে তা অন্য খোলা জায়গার (public space) চেয়ে নোংরা নয়। ওই সমীক্ষাটি চালাতে যে ব্যয় হয় তার কিছু অংশ দিয়েছিলো বিশ্বের বৃহত্তম উড়োজাহাজ নির্মাণ প্রতিষ্ঠান বোয়িং।

ওয়েস্টজেট বলেছে, অনুসন্ধানের ফল দেখে তারা উদ্বিগ্ন তবে তাদের কর্মীরা সর্বোত্তম কাজ করে থাকে। সংস্থাটি বিমানের অভ্যন্তরভাগকে public space হিসাবে উল্লেখ করে। তাদের প্রতিটি উড়োজাহাজ প্রতিদিন পরিষ্কার করা হয় এবং প্রতিটি ফ্লাইটের পর ভেতরে ঝাড়ামোছা করা হয়। জবাবে বলা হয়, তাদের বিমানগুলো প্রতি ২৪ ঘণ্টায় একবার পুরোপুরি ঝাড়ামোছা করা হয়, মাসে একবার ভেতরের অংশ পুরোপুরি ঝাড়ামোছা এবং বছরে একবার খুব ভালো করে পরিষ্কার করা হয়।

পোর্টার বলেছে, যাত্রী ও কর্মীদের নিরাপদ রাখার তাদের প্রয়াসের ব্যাপারে তারা আস্থাশীল। তাদের উড়োজাহাজ দিনের ফ্লাইট পরিচালনা শেষ করলে একদল কর্মী সেটির ভেতরের অংশ নাক থেকে লেজ পর্যন্ত পুরোটাই পরিষ্কার করে। এর পাশাপাশি প্রতি তিন সপ্তাহে একবার প্রতিটি উড়োজাহাজ খুব ভালো করে ধোয়ামোছা করা হয়।

টেট্রো পরামর্শ দিয়েছেন যে, পরিচ্ছন্নতার বিষয়টি যাত্রীদের নিজের দায়িত্বে নেওয়া উচিৎ। যাত্রীরা যেসব জায়গা স্পর্শ করবেন সেগুলো নিজেই মুছে নেওয়া এবং জার্ম মারার জন্য যথেষ্ট পরিমাণ অ্যালকোহল সঙ্গে রাখার পরামর্শ দেন তিনি। টেট্রো বলেন, “নিজের হাত পরিষ্কার করুন ১৫ সেকেন্ডে, ৩০ সেকেন্ডে বসার জায়গাটা এবং তাহলেই আপনার যাত্রা হবে সুন্দর।” – সিবিসি