বিদেশি শিক্ষার্থীরা কানাডার স্কুল ও অভিবাসন চিত্র বদলে দিচ্ছে
ডিসেম্বর ৫, ২০১৮
প্রবাসী কণ্ঠ ডেস্ক :
সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের ট্রাম্প প্রশাসন স্টুডেন্ট ভিসা দেওয়ার ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট সময়সীমা আরোপ করেছে। এর ফলে বিদেশি শিক্ষার্থীদের কাছে কানাডা আরও বেশি আকর্ষণীয় গন্তব্যে পরিণত হচ্ছে।
সূর্য শিবকুমার যখন ভারতের বাইরে প্রকৌশল বিষয়ে গ্রাজুয়েশন ডিগ্রি অর্জনের সিদ্ধান্ত নেন তখন কানাডাই ছিলো তার প্রথম পছন্দ। এমনকি নতুন বিধিনিষেধ আরোপের আগেও যুক্তরাষ্ট্র বিদেশি শিক্ষার্থীদের কাছে অপেক্ষাকৃত কম আকর্ষণীয় গন্তব্য ছিলো। একই অবস্থা ব্রিটেনের। আর সংবাদভিত্তিক রিপোর্ট থেকে সূর্য অস্ট্রেলিয়ায় বর্ণবাদী অসহিষ্ণুতার বিষয়ে পড়েছে।
সূর্য বলেছে, “কানাডায় বর্ণবাদ কোনও বিষয়ই নয়।” আর ভারতের চেয়ে এখানে ভালো বেতনে কাজ পাওয়ার সুযোগ রয়েছে। অটোয়া ইউনিভার্সিটিতে দুমাস কাটানোর পর সূর্যের মনে কানাডায় আসার সিদ্ধান্ত নিয়ে মুহূর্তের জন্যও কোনওরকম আফসোস নেই।
মি. সূর্য শিবকুমার হলেন কানাডার শিক্ষা ও অভিবাসন খাতে চলমান ব্যাপকতর পরিবর্তনের অংশ। চলতি বছর কানাডায় প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় স্তর পর্যন্ত পাঁচ লাখেরও বেশি আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী পড়াশোনা করবে বলে আশা করা হচ্ছে যা ২০০০ সালের চেয়ে চার গুণ বেশি। এষড়নব ্ গধরষ এর এক প্রতিবেদনে এ তথ্য তুলে ধারা হয়।
কানাডার আন্তর্জাতিক শিক্ষা ব্যুরোর অন্তর্বর্তীকালীন প্রধান ল্যারিসা বেজো বলেন, “শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেড়ে যাওয়া কানাডার আন্তর্জাতিক শিক্ষা কার্যক্রমের এক অনন্য সাফল্য।”
পত্রিকাটি আরো জানায়, রক্ষণশীল ও লিবারেল উভয় সরকার যেসব পরিবর্তিত বিধিবিধান চালু করেছে তার ফলে কেন্দ্রীয় সরকারের গ্রহণ করা অর্থনৈতিক খাতের সর্বশ্রেণির অভিবাসীর মধ্যে ৪০ শতাংশই এখন আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী যারা এখানে গ্রাজুয়েশন করেছে এবং কানাডাতেই থাকতে চায়।
মিজ. বেজোর পর্যবেক্ষণ, “আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীরা কানাডার সমাজের সঙ্গে একাত্ম হওয়ার ক্ষেত্রে খুব ভালো অবস্থানে রয়েছে। তারা এরই মধ্যে কানাডার সঙ্গে পরিচিত, তারা দুটি সরকারি ভাষার উভয়টি বা একটি বলতে পারে এবং কানাডা ও বিদেশে তাদের নেটওয়ার্ক আছে।”
সেইসঙ্গে তারা তরুণ- সরকারি পরিষেবা গ্রহণকারী না হয়ে তারা বরং করদাতা।
আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের কাছে কানাডার এমন একটি কাঙ্খিত গন্তব্যে পরিণত হওয়ার পেছনে অনেক কারণ আছে। এর মধ্যে একটা হলো, বিশেষ করে বর্তমান প্রতিযোগিতার সময়ে এখানে টিউশন ফি যুক্তিসঙ্গত যার পেছনে অন্যতম ভূমিকা রেখেছে কানাডীয় ডলারের দাম অপেক্ষাকৃত কম হওয়া।
এটা আরও সহায়ক হয়েছে যে, প্রতিযোগিতাটা তীব্রতা হারাচ্ছে। একটি রিপোর্টে দেখা গেছে, ২০১৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তির সংখ্যা সাত শতাংশ কমেছে। ট্রাম্প প্রশাসনের কঠোরতর বিধিনিষেধ আরোপকে ধন্যবাদ। স্টুডেন্ট ভিসার সময়সীমা বেঁধে দেওয়ার কারণে সেদেশে বিদেশি শিক্ষার্থী আসা আরও কমতে পারে বলেই মনে হয়।
এদিকে ব্রিটেনে গ্রাজুয়েশন করার পর শিক্ষার্থীদের কাজ করার অধিকার সীমিত করে বিধিনিষেধ জারির পর সেখানে বিদেশি শিক্ষার্থী আসার হার আর বাড়ছে না। আর ব্রেক্সিট নিয়ে বিদ্যমান সংশয়ের কারণে ব্রিটেনে শিক্ষা গ্রহণের বিষয়টি এক ধরণের অনিশ্চয়তার জায়গায় চলে গেছে।
নতুন শিক্ষার্থী ভর্তি করানোর ক্ষেত্রে কানাডার চেয়েও বেশি আগ্রাসী হলো অস্ট্রেলিয়া। পাঁচ বছর আগে যেখানে অস্ট্রেলিয়ায় নতুন শিক্ষার্থী ভর্তির সংখ্যা ছিলো তিন লাখের সামান্য বেশি সেখানে চলতি বছর পাঁচ লাখ ৪০ হাজারের বেশি শিক্ষার্থী ভর্তি হয়েছে। যদিও অস্ট্রেলিয়ায় জাতিগত অসহিষ্ণুতার খবরে অনেক শিক্ষার্থীই উদ্বিগ্ন। একের পর এক বর্ণবাদী হামলার পর ভারত সরকার ২০০৯ সালে অস্ট্রেলিয়ার কাছে প্রতিবাদ জানায়।
কানাডার আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী কর্মসূচি জোরালো উৎসাহমূলক সুবিধা দেয়। কানাডার নিয়ম অনুযায়ী শিক্ষার্থীরা শিক্ষাকালীন সময়েও খন্ডকালীন কাজ করতে পারে; গ্রাজুয়েশন করার পর তারা স্বয়ংক্রিয়ভাবেই তিন বছর মেয়াদি ওয়ার্ক পারমিট পাওয়ার যোগ্যতা অর্জন করে; আর তারা যদি পারমানেন্ট রেসিডেন্ট হওয়ার আবেদন করে তাহলে তাদেরকে অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত হিসাবে মর্যাদা দেওয়া হয়।
কানাডার কনফারেন্স বোর্ডের জ্যেষ্ঠ গবেষক করিম আল-আসাল বলেন, বিদেশি শিক্ষার্থীরা “কানাডার দিকে নজর দেয় একটি বহুসংস্কৃতির দেশ হিসাবে আমাদের সুখ্যাতির কারণে এবং একই সঙ্গে অভিবাসীদের গ্রহণ করার ক্ষেত্রে একটি মুক্ত ও স্বাগত জানানোর মতো দেশ হওয়ায়।”
কানাডায় বিদেশি শিক্ষার্থীর
সবচেয়ে বড় উৎস হলো চীন। প্রতি ১০ জন আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীর মধ্যে ৩ জনই চীনের। এর পরেই রয়েছে ভারতের অবস্থান, প্রতি চারজনে একজন।
কিছু সমালোচক উদ্বেগ প্রকাশ করেন যে, আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীরা স্থানীয় ভর্তিচ্ছুদের কোণঠাসা কর ফেলছে। তবে ২০১৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রের একটি রিপোর্টে জানা যায়, আসলে বিপরীতটাই সত্য।
পাবলিক ইকোনোমিক্স জার্নালে কেভিন শিহ লিখেন, “সার্বিকভাবে, বিদেশি শিক্ষার্থীদের কারণে স্থানীয়দের ভর্তির সুযোগ বেড়েছে।” রিপোর্টে দেখা যায়, বিদেশি শিক্ষার্থীরা যে উচ্চ হারে টিউশন ফি দেয় সেটা ভর্তুকি হিসাবে স্থানীয় শিক্ষার্থীদের ভর্তির সুযোগ বাড়ায়।
কানাডায় জন্মহার স্বল্প হওয়ায় দেশটির প্রতিষ্ঠানগুলোর বিভিন্ন কর্মসূচি কাটছাট করা বা একেবারেই বন্ধ করে দেওয়া থেকে বাঁচার জন্য বিদেশি শিক্ষার্থীর প্রয়োজন রয়েছে। উদাহরণ হিসাবে বলা যায়, অন্টারিওতে ১৯৯৮ থেকে ২০০৬ সালের মধ্যে সরকারি শিক্ষা কার্যক্রম থেকে এক লাখ শিক্ষার্থী ভর্তির আসন বিলুপ্ত করা হয়েছে।
বিদেশি শিক্ষার্থীরা ক্রমবর্ধমান হারে অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ অংশে পরিণত হচ্ছে। তারা ২০১৭ সালে কানাডার জিডিপিতে ১৫.৫ বিলিয়ন ডলারের আর্থিক এবং এক লাখ ৭০ হাজার চাকরির শূন্যস্থান পূরণ করেছে। আর এসব অবদান এসেছে তাদের টিউশন ফি, আবাসন এবং অন্যান্য ব্যয় থেকে।
মি. আল-আসাল বলেন, “এটার একটা দারুণ ইতিবাচক অর্থনৈতিক প্রভাব রয়েছে।”
উন্নয়নশীল বিশ্বের অনেক অংশ ক্রমশ স্বচ্ছল ও সুশিক্ষিত হয়ে ওঠায় সে সব দেশ থেকে বিদেশে শিক্ষা অর্জনের জায়গা খোঁজার মতো আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীর সংখ্যা আগামী এক দশকে দ্বিগুণ বেড়ে এক কোটি ছাড়িয়ে যাবে বলে আশা করা হচ্ছে।
কানাডা যদি তার অংশ ধরে রাখতে পারে তাহলে সেদেশের স্কুলগুলোতে বিদেশি শিক্ষার্থীর সংখ্যা হবে ১০ লাখ। অভিবাসন মন্ত্রী আহমেদ হুসেনের মুখপাত্র ম্যাথিউ জিনেট বলেন, অটোয়া ওই ধরণের শিক্ষার্থীদেরকে পারমানেন্ট রেসিডেন্ট হিসাবে আবেদন করা এবং তাদেরকে নাগরিকত্ব নেবার পথে এগিয়ে দিতে আরও বেশি উৎসাহজনক সুবিধা দেওয়ার পরিকল্পনা করছে।
আগের যে কোনও সময়ের চেয়ে বড় এবং সুশিক্ষিত ও কানাডীয় সমাজে সুষ্ঠুভাবে অঙ্গীভূত নতুন কানাডীয়দের একটি দল তাদের ভূমিকা পালনের জন্য প্রস্তুত হয়ে যাবে।