মডেল জাস্টিন ট্রুডো
এপ্রিল ৮, ২০১৮
প্রবাসী কণ্ঠ : প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর যশ ও সুখ্যাতি শুধু দেশে নয়, দেশের বাইরেও বিদ্যমান। আন্তর্র্জাতিক অঙ্গনে তিনি একজন দীপ্যমান ঝলমলে রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। এই সব গুণাবলী তাকে সেলিব্রিটির মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করেছে। তিনি যেখানেই যান সেখানেই রকস্টারদের মত সমাদর ও অভ্যর্থনা পান। জাস্টিন ট্রুডো এখন অনেকের কাছে মডেলও। আর তাই তো দেখা গেছে এই মডেল সেলিব্রিটিকে নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্ক ভিত্তিক প্রকাশনা সংস্থা ‘ইউনিভার্সিটি পাবলিশিং’ একটি সুদৃশ্য ক্যালেন্ডারও (My Canadian Boyfriend 2018 calendar) প্রকাশ করেছে যা গত বছর হট কেকের মত বিক্রি হয়েছে এবং গত ডিসেম্বরের মধ্যেই সব ক্যালেন্ডার বিক্রি হয়ে গেছে। প্রকাশনা সংস্থা ইউনিভার্সিটি পাবলিশিং হাউস কর্তৃপক্ষ ভাবতে পারেনি জাস্টিন ট্রুডোকে নিয়ে ছাপা হওয়া ক্যালেন্ডার এতটা জনপ্রিয় হবে এবং সব কপি বিক্রি হয়ে যাবে। ইউনিভার্সিটি পাবলিশিং এর এসোসিয়েট পাবলিশার রব পার্লম্যান টরস্টার নিউজ সার্ভিসকে বলেন, আমরা প্রচলিত ধারার বাইরে গিয়ে একটু রাজনীতির ছোঁয়া লাগাতে চেয়েছিলাম ক্যালেন্ডারে। বিষয়টি জনগণের কাছে এতটা গ্রহনযোগ্য হবে ভাবিনি। জাস্টিন ট্রুডো আসলেই এই ক্যালেন্ডারের জন্য ‘ন্যাচারাল ফিট’ ছিলেন।
ক্যালেন্ডারের বিভিন্ন পাতায় জাস্টিনকে দেখা গেছে বিভিন্ন আঙ্গিকে। এগুলোর মধ্যে আছে কুকুর সহ জাস্টিন, কাউবয় জাস্টিন, বডি বিল্ডার জাস্টিন, রানিং জাস্টিন ইত্যাদি। প্রতি মাসের পাতায় জাস্টিনকে উপস্থাপন করা হয়েছে আলাদা ভাবে। যেমন জুন মাসের পাতায় লেখা আছে “Justin has intelligence, compassion and just the right amount of swagger.” জুলাই মাসের পাতায় একটি ওজন মাপার যন্ত্রে শার্ট ছাড়া জাস্টিনকে দেখা যাচ্ছে যার ক্যাপশনে লেখা আছে, , “Justin’s views on ‘gun’ control align with my own.”
জাস্টিন ট্রুডোকে নিয়ে করা চলতি বছরের ক্যালেন্ডারের সাফল্য দেখে প্রকাশনা সংস্থাটি বেশ উৎসাহিত হয়ে উঠেছে। তারা ইতিমধ্যে অনলাইনে প্রি-অর্ডার গ্রহণ করছে ২০১৯ সালের ক্যালেন্ডারের জন্য। রব পার্লম্যান টরস্টারকে বলেন খুচরা বিক্রেতাদের কাছ থেকে যে অর্ডার আমরা পাচ্ছি তাতে মনে হয় আমাদের তৈরী ২০১৯ সালের ক্যালেন্ডারও হট কেক হিসাবে বিক্রি হবে। চলতি বছরের মত আগামী বছরের ক্যালেন্ডারও কানাডা ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বিভিন্ন স্টোরে বিক্রি হবে। পাশাপাশি অনলাইনেও।
আমাজন.কমের রিভিউ সেকশনে চলতি সালের ক্যালেন্ডার সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে একজন ক্রেতা জাস্টিন ট্রুডো সম্পর্কে বলেন, “He’s the ray of sunshine peeking through the storm clouds. He’s the hero the world so desperately needs.”
টরস্টার নিউজ সার্ভিস আরো জানায়, প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর কার্যালয় থেকে এই ক্যালেন্ডার সম্পর্কে কোন মন্তব্য করতে অনিহা প্রকাশ করা হয়। তবে ইতিপূর্বে একজন কর্মকর্তা জানিয়েছিলেন, এই ক্যালেন্ডার তৈরীর সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের কোন সম্পৃক্ততা নেই।
অবশ্য নিউফাউন্ডল্যান্ড এর মেমোরিয়াল ইউনির্ভাসিটির হিউম্যানিটিস এ্যান্ড সোসিয়াল সাইন্স বিভাগের অধ্যাপক এলেক্স মারল্যান্ড টরস্টারকে বলেন, জাস্টিন ট্রুডোর জন্য এই ক্যালেন্ডার অবশ্যই একটি সাফল্য। আমার জানা মতে কানাডার আগের কোন প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে এরকম কাজ কেউ করেনি। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ঐ মাত্রার খ্যাতি বা ঐ রকম যশস্বী ব্যক্তি হিসাবে স্বীকৃতি পাওয়া সত্যি খুব বিরল।
জরীপে দেখা গেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ঐ দেশের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এর চেয়ে কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর জনপ্রিয়তা বেশী। কিছুদিন আগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের Lincoln Park Strategies একটি জরীপ চালিয়ে দেখতে পায় সেদেশে জাস্টিন ট্রুডোর জনপ্রিয়তা ১২। অন্যদিকে ডোনাল্ড ট্রাম্প এর জনপ্রিয়তা মাইনাস ১৭। জাস্টিন ট্রুডো এগিয়ে আছেন যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী তেরেসা মে (২) এবং জার্মান চ্যান্সেলর এঞ্জেলা মার্কেল (৭) এর চেয়েও।
জাস্টিন ট্রুডোর জনপ্রিয়তা কানাডায়ও বেশী অন্যান্য রাজনৈতিক দলের নেতাদের চেয়ে বেশী। ইয়াহু কানাডা নিউজ এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়, সম্প্রতি নৈতিকতা সম্পর্কিত বিতর্কের খবর প্রকাশের পর প্রধানমন্ত্রী দৃশ্যত বড় ধাক্কা সামলে নিতে পেরেছেন। ৩ জানুয়ারি প্রকাশিত ন্যানো রিসার্চ-এর এক সাম্প্রতিক সমীক্ষায় দেখা গেছে জাস্টিন ট্রুডো এখনও প্রধানমন্ত্রী হিসাবে কানাডীয়দের পছন্দের তালিকার শীর্ষে রয়েছেন (৪৬.৯ শতাংশ), তার পর যথাক্রমে রয়েছেন রক্ষণশীল দলের নেতা এন্ড্রু শিয়ার (২১.৫ শতাংশ), এনডিপি নেতা জাগমিত সিং (৯.১ শতাংশ) এবং গ্রিন পার্টির এলিজাবেথ মে (৩.৯ শতাংশ)। সমীক্ষায় বলা হয়, ১৮ শতাংশ মানুষ বলেছেন, তারা কাকে সমর্থন করবেন সে বিষয়ে নিশ্চিত নন।
গত বছর ২০ ডিসেম্বর প্রকাশিত নৈতিকতা সম্পর্কিত পর্যবেক্ষণ প্রতিষ্ঠানের রায়ের পর লিবারেল দলের নেতা ট্রুডোর পক্ষে এই জনসমর্থন বিস্ময়কর। কমিশনার ম্যারি ডাউসন ওই রায়ে বলেছেন ২০১৬ সালে পরিবারের সঙ্গে বাহামায় ছুটি কাটানোর সময় আগা খানের কাছ থেকে উপহার গ্রহণ করায় ট্রুডো স্বার্থের দ্বন্দ্ব সম্পর্কিত আইন লংঘন করেছেন।
প্রধানমন্ত্রী অবশ্য দাবি করেছেন যে, আগা খান তার পারিবারিক বন্ধু। কিন্তু নৈতিকতা বিষয়ক কমিশনার সে দাবি নাকচ করে দিয়েছেন। ডাউসন বলে দিয়েছেন যে, কানাডার আগা খান ফাউন্ডেশন নিবন্ধিত হয়েছে কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে দেন-দরবার করার প্রতিষ্ঠান হিসাবে। ২০ ডিসেম্বর প্রকাশিত বিবৃতিতে মিজ. ডাউসন লিখেছেন, “সুতরাং, মি. ট্রুডো বা তার পরিবার যে উপহার গ্রহণ করেছেন সেটি প্রধানমন্ত্রী হিসাবে তাকে প্রভাবিত করার জন্যই দেওয়া হয়েছে।”
নৈতিকতা বিষয়ক কমিশনারের রায়ের পর ট্রুডো ক্ষমা প্রার্থনা করেছেন এবং এ বিষয়ে পুরো দায়িত্ব গ্রহণ করে বলেছেন, ভবিষ্যতে যে কোনও পারিবারিক ছুটি কাটানোর সময় তিনি সবধরণের সতর্কতা অবলম্বন করবেন।
নৈতিকতা বিষয়ক কমিশনের রায় প্রকাশের পর টরন্টো স্টার পত্রিকার ন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্স বিষয়ক লেখক টিম হারপার মন্তব্য করেছিলেন এই বলে যে, “যদ্দূর মনে হয়, এই সরকারকে কোনওকিছুই ঘায়েল করতে পারবে না।” তিনি অভিমত দেন যে, “বুদ্বুদের মত মিলিয়ে যাওয়ার পরিবর্তে এই ঘটনায় বড় ধরণের বিস্ফোরণ ঘটা উচিৎ ছিলো।”
এসব জরিপের ফলাফল যদি কোন ইঙ্গিত বহন করে তাহলে সেটা হলো, নৈতিকতা লংঘনের এই ঘটনায় ট্রুডোর সুনামের কোনও ক্ষতি হয়নি।
কিন্তু গত ফেব্র“য়ারীতে ভারতে এক সপ্তাহের সরকারী সফরে গিয়ে বেশ বেকায়দায় পড়তে হয়েছিল জাস্টিন ট্রুডোকে। ২০১৫ সালের ৪ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেবার পর থেকে তিনি ইতিমধ্যে কয়েকটি দেশ সফর করেছেন। যোগ দিয়েছেন একাধিক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে। এবং সব জায়গায়ই তিনি রকস্টারদের মত সমাদর পেয়েছেন। তাঁকে নিয়ে আনন্দ-উৎসবে মেতে উঠেছে সবাই। কিন্তু এই প্রথম কানাডার বাইরে গিয়ে জাস্টিন ট্রুডোকে অন্যরকম পরিস্থিতির শিকার হতে হয়েছে। তাঁকে নিয়ে ভারতের সরকারী মহলে কোন হইচই ছিল না। এমন কি তাঁর প্রতি ভারত ‘অবজ্ঞা’ প্রদর্শন করেছে বলেও অভিযোগ করেছেন কেউ কেউ। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি কানাডার প্রধনমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন সফরের শেষ পর্যায়ে এসে।
কিন্তু তাঁর ভারত সফর নিয়ে হইচই যে হয়নি তা নয়। হইচই ঠিকই হয়েছে তবে সেই হইচই ছিল নেতিবাচক। এমনকি কানাডার মিডিয়াতেও জাস্টিন ট্রুডোর ভারত সফর নিয়ে বেশ হইচই হয়েছে। তীব্র সমালোচনায় মুখর হয়ে উঠতে দেখা গেছে
মিডিয়া বিশেষ করে রক্ষণশীল মিডিয়াগুলোকে। প্রধানমন্ত্রীকে রক্ষণশীল মিডিয়াগুলো তুলা ধুনা করে ছেড়েছে।
রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, জাস্টিন ট্রুডোর ভারত সফর নিয়ে যুগপদ অবজ্ঞা ও হইচই হয়েছে প্রধানত খালিস্তান ইস্যু নিয়ে। সফরের সময় কানাডার নাগরিক শিখ বংশোদ্ভূত জসপল অটওয়াল এর উপস্থিতিও বিতর্কের আরেক কারণ বলে মনে করছেন অনেকে। বিবিসি’র খবর থেকে জানা গেছে, জসপল অটওয়াল নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন শিখ ইয়ুথ ফেডারেশনের সক্রিয় সদস্য। এমনকি ১৯৮৬ সালে কানাডার ভ্যাঙ্কুভারে ভারতের সাবেক মন্ত্রী মলকিয়াত সিংহ সিধুকে খুনের চেষ্টার অভিযোগও রয়েছে জসপলের বিরুদ্ধে। এজন্য তার সাজাও হয়েছে। এই জসপল নয়াদিল্লিতে কানাডার হাইকমিশনে এক নৈশভোজেও আমন্ত্রিত ছিলেন ট্রুডোর সফরকালে। অবশ্য জানাজানি হওয়ার পর সেই আমন্ত্রণ বাতিল করা হয়েছে এবং যারা তাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবার কথাও জানিয়েছেন জাস্টিন ট্রুডো। পরে অবশ্য কানাডার এমপি রনদীপ সরাই সমস্ত দায় নিজের কাঁধে নিয়ে ক্ষমা চেয়েছেন।
বিবিসি’র খবরে আরো বলা হয়, জাস্টিন ট্রুডোর ক্যাবিনেটে যে চারজন শিখ মন্ত্রী আছেন, তার মধ্যে অন্তত দুজন – হরজিৎ সজ্জন ও অমরজিৎ সোধি – প্রকাশ্যেই কানাডাতে খালিস্তান আন্দোলনকে সমর্থন করে নানা বিবৃতি দিয়েছেন ইতিপূর্বে। উল্ল্লেখ্য যে, কানাডার জনসংখ্যার একটা বড় অংশ শিখ সম্প্রদায়ের মানুষ। কানাডায় ফেডারেল ও প্রভিন্সিয়াল পর্যায়ে বেশ কয়েকজন মন্ত্রী ও এমপি, এমপিপি রয়েছেন এই সম্প্রদায় থেকে। স্বাভাবিক ভাবেই ট্রুডোকে শিখদের মন জুগিয়ে চলতে হয়।
কিন্তু এই মন জুগাতে গিয়ে দেখা গেলো জাস্টিন ট্রুডো যখন স্ত্রী সোফি ও তার তিন সন্তানকে নিয়ে ভারতে এসে নামেন, তখন সেই দেশের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী তাঁকে বিমানবন্দরে স্বাগত জানাতে যাননি। বিবিসি’র খবরে বলা হয়, মোদির আমলে বিশ্বের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সরকারপ্রধান বা রাষ্ট্রপ্রধানরা যখন ভারতে আসেন, তখন প্রোটোকল ভেঙে তাদের স্বাগত জানাতে যাওয়াটা প্রায় রুটিনে পরিণত করে ফেলেছেন তিনি। কিন্তু কানাডার মত এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ দেশের এমন একজন রকস্টার পর্যায়ের নেতা জাস্টিন ট্রুডোর বেলায় ঘটলো অন্য ঘটনা। আরও আশ্চর্যের ব্যাপার ছিল, কানাডার প্রধানমন্ত্রীকে স্বাগত জানাতে পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজও যাননি। এমনকি তার দুই প্রতিমন্ত্রী – ভি কে সিং বা এম জে আকবর পর্যন্ত উপস্থিত ছিলেন না। কানাডার ‘রকস্টার’ প্রধানমন্ত্রীর জন্য এই উপেক্ষা ছিল একেবারেই বেমানান! জাস্টিন ট্রুডোকে ভারতে স্বাগত জানাতে বিমানবন্দরে গিয়েছিলেন কৃষি মন্ত্রণালয়ের একজন জুনিয়র মন্ত্রী গজেন্দ্র সিং, যিনি মাত্র মাসচারেক আগে প্রথমবারের মতো মন্ত্রী হয়েছেন।
তবে জাস্টিন ট্রুডোর সঙ্গে পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী ক্যাপ্টেন অমরিন্দর সিংহের বৈঠকে প্রত্যাশিত ভাবেই উঠেছিল খালিস্তান ইস্যু। ঐ সময় কানাডার জাতীয় প্রতিরক্ষা মন্ত্রী শিখ বংশোদ্ভূত হারজিত সিং সাজনও উপস্থিত ছিলেন। বিবিসি জানায়, বৈঠকে কানাডার প্রধানমন্ত্রীর হাতে সক্রিয় ৯ জনের একটি তালিকা দেন অমরিন্দর। তালিকাভুক্ত এই ব্যক্তিরা পাঞ্জাবে টার্গেট করে খুন করা থেকে শুরু করে নানা ধরনের ঘৃণা-বিদ্বেষমূলক অপরাধের সঙ্গে জড়িত। এরা সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ চালাতে অস্ত্রশস্ত্র সরবরাহ করার পাশাপাশি অর্থ ঢালছে। এদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিতে তিনি জাস্টিন ট্রুডোকে অনুরোধ করেন। অনুরোধের জবাবে ট্রুডো আশ্বাস দেন, কানাডা ভারত বা অন্যত্র কোথাও সন্ত্রাসবাদী আন্দোলন সমর্থন করে না। বৈঠকের পর পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী নিজেই টুইট করে বলেছেন, কানাডার প্রধানমন্ত্রীর সুস্পষ্ট আশ্বাস পেয়ে আশ্বস্ত হলাম।
ভারতে জাস্টিন ট্রুডোর রকস্টার ইমেজের এই ছন্দপতন কিছুটা প্রভাব ফেলেছে বৈকি কানাডার মাটিতে। জরীপ সংগঠন Abacus Data পরিচালিত এক জরীপে দেখা যাচ্ছে ভারত থেকে ফিরে আসার পর ভোটারদের মধ্যে জাস্টিন ট্রুডোর সমর্থন ৩% হ্রাস পেয়েছে। গত ৭ মার্চ এই রিপোর্ট প্রকাশিত হয়।
অন্যদিকে গত ২০ মার্চ প্রকাশিত The Nanos tracking এর জরীপ রিপোর্টেও বলা হয় লিবারেল ও কনজার্ভেটিভ পার্টির মধ্যে জনপ্রিয়তার ব্যবধান কমে আসছে। বর্তমানে লিবারেল সমর্থকের হার ৩৫.৯% এবং কনজার্ভেটিভ পার্টির সমর্থকের হার ৩৪.৯%। লিবারেল এর জনপ্রিয়তা হ্রাসের কারণ হিসাবে এই জরীপেও ভারত সফরকালে জাস্টিনের ইমেজ বা ভাবমূর্তি মলিন হওয়াকে দায়ী করা হচ্ছে।
তবে জাস্টিন ট্রুডোর ব্যক্তি ইমেজ কানাডায় এখনো অন্যান্য জাতীয় নেতাদের চেয়ে বেশী। জরীপে অংশ নেয়া শতকরা ৫৫ জন বলেন, তারা বিশ্বাস করেন একজন ভাল রাজনৈতিক নেতা হওয়ার গুণাবলী জাস্টিন ট্রুডোর মধ্যে রয়েছে। অন্যদিকে শতকরা ৪০ জন মনে করেন প্রধান বিরোধী দলীয় নেতা এন্ড্রু শিয়ারের মধ্যে একজন ভাল রাজনৈতিক নেতা হওয়ার গুণাবলী রয়েছে।
জাস্টিন ট্রুডোর এমন কি গুণাবলী আছে যার জন্য এখনো তিনি কানাডার অন্যান্য নেতৃবৃন্দের তুলনায় বেশী জনপ্রিয়? এমন কি আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও! তাকে নিয়ে ক্যালেন্ডার কেন তৈরী হয় এবং তা হট কেকের মত কেন বিক্রি হয়?
ট্রুডো সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য যাচাই বাছাই করলে আমরা দেখতে পাব তিনি একজন মানব দরদী। তিনি কানাডায় রিফিউজিদেরকে স্বাগত জানানোর উদ্যোগ নিয়েছেন ক্ষমতায় এসে। ২০১৬ সালে কানাডা প্রায় অর্ধ লক্ষ রিফিউজিকে স্বাগত জানায়। এটি ছিল বিগত চার দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ সংখ্যক রিফিউজি গ্রহণ (কোন একক বছরে)। এই রিফিউজিদের মধ্যে বেশিরভাগই সিরিয়ান নাগরিক।
ট্রুডো ঘন ঘন ক্লাইমেট চেঞ্জ এর বিষয়টি মোকাবেলা করার কথা উত্থাপন করছেন। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্লাইমেন্ট চেঞ্জ সংক্রান্ত প্যারিস এগ্রিমেন্ট থেকে সরে আসায় তার সামালোচনা করেছেন।
তিনি esbian, gay, bisexual, and transgender (LGBT) দের অধিকার রক্ষায় একজন জোরাল সমর্থক এবং তিনিই কানাডার প্রথম প্রধানমন্ত্রী যিনি ভ্যাঙ্কুভার ও টরন্টোতে খএইঞ’দের প্রাইড প্যারেডে অংশ নেন। এই সময় তার পরিবারের সদস্যরাও তার সঙ্গে ছিলেন। ক্ষমতা গ্রহণের পর তিনিই প্রথম প্রধানমন্ত্রী যিনি মন্ত্রীসভায় অর্ধেক সদস্য নেন মহিলাদের মধ্য থেকে। তিনি নিজেকে নারীবাদী বলে আখ্যায়িত করে থাকেন।
জাস্টিন ট্রুডো একজন ফ্যামিলি ম্যান। বিয়ে করেছেন প্রেম করে। পরিবারের সদস্যদের প্রতি খুবই যতœশীল তিনি। বিভিন্ন রাষ্ট্রিয় সফরে তিনি পরিবারের সদস্যদেরকে সাথে নেয়ার চেষ্টা করেন।
বাংলায় একটি প্রবাদ আছে এই বলে যে, আগে দর্শনদারী পরে গুণ বিচারি। জাস্টিন ট্রুডো দেখতে সুন্দর। সুঠাম দেহের অধিকারী। দশজন নেতা পাশাপাশি দাড়ালে তাকেই বেশী দীপ্যমান দেখায়। ফলে সবার নজরটাও তার উপরই বেশী পড়ে।
তিনি ভারতীয়দের অনুষ্ঠানে গিয়ে ভাংড়া নাচ নাচতে পারেন, মুসলমানদের মসজিদে গিয়ে মুসল্লিদের সঙ্গে হাত তুলে দোয়া করতে পারেন, শিখ মন্দিরে গিয়ে পাগড়ি পড়তে পারেন, রাষ্ট্রিয় সফরে কোন দেশে গেলে সেখানকার ঐতিহ্যবাহী পোষাক পরে সবাইকে চমক লাগিয়ে দিতে পারেন। এরকম আরো অনেক কিছুই তিনি বিনা দ্বিধায় করতে পারেন। ফলে মানুষজন তাকে নিজেদেরই লোক বলে ভাবতে থাকেন।
জাস্টিন ট্রুডো মিডিয়াবান্ধব। আগের প্রধানমন্ত্রী স্টিফেন হারপার মিডিয়াকে এড়িয়ে চলতেন। কিন্তু ট্রুডো ঠিক তার উল্টো। তিনি নিজে একজন খেলোয়াড়। বক্সিং খেলা তার খুবই প্রিয়। ফলে তার মধ্যে খেলোয়াড়সুলভ একটি মনোভাল লক্ষ্য করা যায়। তার হৃদয়টাও খুব কোমল। সিরিয়ান রিফিউজিদের কষ্টের কথা শুনে তিনি চোখের জল ধরে রাখতে পারেন না। রক সঙ্গীত শিল্পী গর্ড ডাউনির মৃত্যুর পর শোক প্রকাশ করতে গিয়ে তিনি স্টেজে চোখের জল ফেলেছেন।
উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত জাস্টিন ট্রুডো। বাবা ছিলেন কানাডার প্রধানন্ত্রী। কিন্তু সেই পরিচয় ছাপিয়ে তিনি নিজ গুণেই রাজনীতিতে হয়ে উঠেন জাজ্বল্যমান ও অপ্রতিদ্বন্দ্বি। দলীয় প্রধান হিসাবে জাতীয় নির্বাচনে নেমে প্রথমবারেই দলকে তৃতীয় অবস্থান থেকে একেবারে প্রথম অবস্থানে নিয়ে আসেন। কানাডার রাজনীতিতে চমক সৃষ্টির পাশাপাশি অধিকতর সক্রিয় ও সহসী এবং সপ্রতিভ ফেডারেল সরকার উপহার দেওয়ার জন্য জাস্টিন ট্রুডো ইতিমধ্যেই প্রশংশিত হয়েছেন কানাডার সাধারণ মানুষের কাছে। ২০১৬ সালের মাঝামাঝি সময়ে এ কথা বলেছেন কানাডার একটি জরীপ প্রতিষ্ঠানের (EKOS Research Associates) প্রেসিডেন্ট ফ্রেঙ্ক গ্র্যাভিস। ইকোস এর প্রেসিডেন্ট বলেন সরকারের উপর জনগনের আস্থা বর্তমানে যে পর্যায়ে পৌঁছেছে তা গত ২৫ বছরে দেখা যায়নি।
কানাডার জনগন চান রাজনীতিতে স্বচ্ছতা ও অবারিত দ্বার। ট্রুডো কানাডার রাজনীতিতে সেই বিষয়গুলোই আনার চেষ্টা করছেন। কিন্তু তার পূর্ববর্তী প্রধানমন্ত্রী স্টিফেন হারপার করেছেন ঠিক তার উল্টোটি। জনগন এমনকি পার্টির লোকদের কাছেও তিনি স্বচ্ছ ছিলেন না। গোপন দ্বার বৈঠকে তিনি সিদ্ধান্ত নিতে ও চাপিয়ে দিতে ভালবাসতেন।
একই সময়ে আরেক জরীপ প্রতিষ্ঠান এবাকাস ডাটা’র প্রধান নির্বাহী ডেভিড কলেটো বলেন, গত নির্বাচনে জাস্টিন ট্রুডো তার সমালোচকদের বোকা বানিয়েছেন এবং ক্ষমতা গ্রহনের পর রাজনীতিকদের প্রতি জনগনের প্রত্যাশাকে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করেছেন।
এরকম একজন ক্যারিশমাটিক রাজনৈতিক নেতা অনেক ক্ষেত্রেই মডেল হিসাবে বিবেচিত হতে পারেন। মডেল হিসাবে নির্বাচিত হতে পারেন ক্যালেন্ডারের পাতায়ও। জাস্টিন ট্রুডোর বেলায় এটিই স্বাভাবিক।