কানাডায় নিছক বেঁচে থাকার মতে চাকরির চোরাবালিতে হারিয়ে যাওয়া
মার্চ ১৩, ২০১৮
ন্যানি এলবুয়েরো টরন্টো থেকে : মরিয়ম সাঈদ মবিনুল্ল্লাহ যখন অসংখ্য শক্তিশালী যন্ত্রপাতির ভেতর দিয়ে অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে নিজের কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন তখন তার আশেপাশে চলছে এমব্রয়ডারি মেশিনের একটানা ছন্দ্যোবদ্ধ আওয়াজ। তিনি বোতাম ও হুকের বাক্সের কাছে যাচ্ছিলেন এবং সেগুলোকে একের পর এক একেকটি কাপড়ের সঙ্গে জুড়ে দিচ্ছিলেন। তিনি অবিরাম ছুটে ছুটে কাজ করছিলেন যা শরীরের জন্য খুবই শ্রমসাধ্য, কিন্তু তিনি দড়ির তৈরি ব্যাগগুলোতে নানা উপকরণ সেলাই করার কাজে মোটেও সময় নষ্ট করছিলেন না। কারণ নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কাজ সম্পন্ন করার ব্যাপার আছে।
যাহোক, আট ঘণ্টার আরেকটি পালা শুরুর আগে মরিয়মের সঙ্গে কথা বলতে গেলে তিনি এই চাকরির প্রতি তার অসন্তুষ্টির বিষয়টি তুলে ধরলেন। আট ঘণ্টা ধরে কাজ করে তিনি কেবল সর্বনি¤œ মজুরি পান এবং কোনওরকম বেনিফিট পান না। তিনি স্বীকার করেন যে, তিনি নিজের জন্য যে নতুন দেশ বেছে নিয়েছেন সেখানে জীবন এমন হবে তা তিনি কখনও ভাবেননি। টরন্টোর একটি টেইলারিং কারখানার হাতের সেলাইয়ের কর্মী হিসাবে মরিয়মের দিন কাটে নানা রকম গাউন, কোট, শার্ট, প্যান্ট ও স্কার্ফ তৈরি করে যা কাবুলে থাকতে তার একজন স্কুল শিক্ষিকার জীবন থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন।
যুদ্ধ-বিধ্বস্ত স্বদেশ আফগানিস্তান থেকে পালিয়ে বাঁচার জন্য মবিনুল্ল্লাহ তার পরিবারের সঙ্গে পাঁচ বছর আগে কানাডায় আসেন। “আমার সন্তানদের সুন্দর ভবিষ্যতের যে স্বপ্ন দেখেছিলাম” বর্তমান সংগ্রামের পেছনে সেটাই ছিলো মূল কারণ।
একজন নবাগত কানাডীয় হিসাবে কঠিন অবস্থায় পড়েছেন এমন মানুষ মবিনুল্ল্লাহ একা নন। একজন অভিবাসী হিসাবে নিজের ‘কানাডীয় স্বপ্ন’ বাস্তবায়নের পথে রয়েছে তার যোগ্যতা এবং চাকরিদাতারা সেই যোগ্যতার স্বীকৃতি দেবে কিনা ইত্যাদি নানা প্রতিবন্ধকতা। নিজ দেশে বিশ^বিদ্যালয়ের উচ্চতর ডিগ্রি অর্জনকারী অতি দক্ষ পেশাজীবীরাও প্রায়ই ন্যূনতম মজুরিতে নিছক বেঁচে থাকার মতো চাকরিতে নিয়োজিত হতে বাধ্য হন যেখানে চাকরির কোনও নিশ্চয়তাও দৃশ্যমান নয়। একজন চিকিৎসক ট্যাক্সিক্যাব চালাচ্ছেন কিংবা একজন প্রকৌশলী কাজ করছেন নিরাপত্তা প্রহরী বা পিজা সরবরাহকারী হিসাবে এমন অনেক কাহিনী শোনা যায়। আর এইসব স্বল্প আয়ের লোকদের জন্যই “শ্রমজীবী দরিদ্র” কথাটার উদ্ভব হয়েছে।
এই হেঁয়ালিপূর্ণ পরিভাষা সম্পর্কে ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে টরন্টোর ওয়ার্কার্স অ্যাকশন সেন্টারের সমন্বয়কারী দীনা ল্যাড বলেন, “এটি বিস্ময়ের কিছু নয়। এমন অনেক মানুষ এদেশে আসছে যাদের যোগ্যতা এদেশে স্বীকৃত নয়। গবেষণামূলক সমীক্ষায় দেখা গেছে, এমন অনেক মানুষ এসেছে যাদের যোগ্যতার স্বীকৃতি দেওয়া অথবা সমকক্ষতার স্বীকৃতি আদায় করা কোনওভাবেই সম্ভব নয়।”
ল্যাড আরও বলেন, নবাগতদের মধ্যে যারা নতুন করে এদেশে শিক্ষা অর্জন করতে চায় তাদের জন্যও এটা কঠিন হয়ে পড়ে। কারণ, “আপনাকে যদি দৈনন্দিন জীবনযাত্রার ব্যয় বহন করতে হয় তাহলে আপনি কীভাবে বিদ্যালয়ে ভর্তি হবেন?”
কানাডার অভিজ্ঞতা নেই
১৯৯৭ সালে ভারত থেকে কানাডায় আসার পর ময়ুরিকা ত্রিবেদী ঠিক এই উভয়সঙ্কটের মধ্যে পড়েছিলেন। তিনি গর্ব করে বলতেন, “আমি কানাডায় নবাগত নই। আমি আমার দুই ছেলের সঙ্গে এদেশে এসেছি।” কিন্তু অ্যাকাউন্টিং ও বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন বিষয়ে তার ভারতীয় ডিগ্রি দিয়ে তিনি এখানে কোনও চাকরির ব্যবস্থা করতে পারেননি এবং শেষ পর্যন্ত একটি কারখানায় মেশিন অপারেটরের চাকরিতে যোগ দেন।
তাকে সেই ভীতিকর মন্ত্রের শিকার হতে হয় যে, তার কোনও ‘কানাডীয় অভিজ্ঞতা’ নেই। নবাগত হিসাবে যথেষ্ট পরিমাণ তথ্য না জানা এবং প্রশিক্ষণের সুযোগের অভাবে হতাশাগ্রস্ত হয়ে শেষে তিনি একটি মোটর কারখানায় রাতের পালায় কাজ নিতে বাধ্য হন। পরে তাকে দিনের পালায় বদলী করা হয়।
২০১০ সালে স্বামী অসুস্থ হয়ে পড়লে ময়ুরিকাকে চাকরি ছাড়তে বাধ্য করা হয়। কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে পড়েও তিনি হাল ছেড়ে দেননি বরং তার কর্মজীবনে সহায়ক হবে ভেবে নিজের শিক্ষার মানোন্নয়নের জন্য আবারও স্কুলে ভর্তি হওয়ার পরিকল্পনা করেন। একদিন অর্থনৈতিকভাবে জীবনে স্বাধীন হতে পারবেন এবং তার স্বপ্ন পূরণ হবে এ ব্যাপারে তিনি বরাবরই আশাবাদী ছিলেন।
এটা একটা মর্মন্তুদ বিষয় যে কানাডায় ১৫ লাখ নারীকে স্বল্প আয়ের ওপর নির্ভর করে জীবন চালাতে হয়। এটাই হলো জীবনের বাস্তবতা যে, গ্রুপ-৭-এর অন্তর্ভুক্ত একটি দেশেও মরিয়ম সাঈদ মবিনুল্ল্লাহ এবং ময়ুরি ত্রিবেদীকে এমন জীবন যাপন করতে হচ্ছে।
অবশ্য কিছু অভিবাসী তাদের ‘কানাডীয় স্বপ্ন’ পরিত্যাগ করে নিজের দেশে ফিরেও গেছেন। কিন্তু অনেকের জন্যই সে পথ বেছে নেওয়ার সুযোগ নেই। যেখানে যথেষ্ট স্বাধীনতা এবং নিরাপত্তা নেই সেখান থেকে দূরে চলে যাওয়ার পর সেখানে ফিরে আসার মূল্য শেষ পর্যন্ত অত্যন্ত চড়া হতে পারে।
এটা দুঃখজনক যে, দৃশ্যমান সংখ্যালঘু নারীদের ২৮ শতাংশই দারিদ্র্যের মধ্যে বসবাস করে। কানাডীয় নারী ফাউন্ডেশনের হিসাব অনুযায়ী, খন্ডকালীন চাকরিতে নিয়োজিতদের প্রায় ৭০ শতাংশই নারী। আর ন্যূনতম মজুরিতে কাজ করেন এমন লোকেদের মধ্যে ৬০ শতাংশ হলেন নারী।
টরন্টো বিশ^বিদ্যালয়ের ড. ইজুমি সাকামোতো সেইসব চাকরিদাতাদের কথা উল্ল্লেখ করেন যারা চাকরিপ্রার্থীর বিদেশে অর্জিত যোগ্যতার সনদপত্রের চেয়ে ‘কানাডীয় অভিজ্ঞতা’কে অগ্রাধিকার দিতে যেয়ে জেনেশুনে অথবা না জেনে অভিবাসীদের প্রতি বৈষম্য করছেন।
সিবিসি রেডিওর মেট্রো মর্নিং অনুষ্ঠানে এক সাক্ষাৎকারে ড. সাকামোতো বলেন, “চাকরির জন্য সাক্ষাৎকার দিতে গেলে তাদের বলা হয়, আপনার কানাডীয় অভিজ্ঞতা নেই, তাই চাকরি দেওয়া যাচ্ছে না। যে কোনওভাবেই হোক তাদের অভিজ্ঞতা একজন কানাডীয়র অভিজ্ঞতার চেয়ে কমই হবে।”
অন্টারিওর মানবাধিকার কমিশন ২০১৩ সালে “কানাডীয় অভিজ্ঞতার” বিষয়টিকে অন্টারিওর মানবাধিকার সনদের লংঘন বলে ঘোষণা করে। তবে নতুন কানাডীয় হিসাবে অব্যাহতভাবে এই বাধার মুখোমুখি হওয়ার কারণে এটা স্পষ্ট যে, একটি অধিকতর বাস্তবসম্মত সমাধান অবশ্যই বলবৎ করতে হবে। কানাডা যেহেতু আরও দক্ষ অভিবাসীর জন্য দরোজা খুলে দিতে যাচ্ছে সেজন্য সাকামোতো আরও বেশি সচেতনতার আহবান জানান। এটা মানবাধিকার সনদের লংঘন বলে ঘোষণা দেওয়াটা নিশ্চয়ই ভালো খবর, কিন্তু অন্টারিওতে নিছক বেঁচে থাকার মতো এবং অনিশ্চিত চাকরি করতে বাধ্য হচ্ছেন এমন হাজার হাজার মানুষের জন্য এই ঘোষণা এখনও সামান্যই স্বস্তিদায়ক।
– নিউ কানাডিয়ান মিডিয়া