নতুন অভিবাসীদের জন্য ইতিবাচক মনোভাব জরুরী
মার্চ ১৩, ২০১৮
দিলনওয়াজ কামার : স্যাম গিল (ছদ্মনাম), তার স্বামী জন ও তাদের দুই সন্তান কানাডায় আসার ২৯তম দিনে আমার সঙ্গে দেখা করেন। নতুন দেশে নিজেদের খাপ খাইয়ে নেওয়া এবং কর্মসংস্থানের অভাবে তারা খুই চাপের মধ্যে ছিলেন। নগরীতে তারা নিঃসঙ্গ বোধ করছিলেন এবং তাদের অভিযোগ ছিলো সামাজিক সহায়তার অভাব নিয়েও। সন্তানদের স্কুলে ভর্তি করা নিয়েও তারা ছিলেন উদ্বিগ্ন। আমাদের প্রথম সাক্ষাতের অনেকটা সময় কেটেছে মূলত তাদের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার কথা শুনে। জন একারণে হতাশাগ্রস্ত ছিলেন যে, তারা কানাডার কেন্দ্রীয় সরকারের দক্ষ শ্রমিক শ্রেণিতে অভিবাসনের জন্য আবেদন করেছিলেন এবং নিজেদের কাজের ক্ষেত্রে তারা রীতিমত বিশেষজ্ঞ, অথচ এখন বলা হচ্ছে তাদের শিক্ষাগত নথিপত্র এখানে স্বীকৃত নয়। নিজের দেশে জন ছিলেন একজন স্থপতি এবং গিল ছিলেন চিকিৎসক। পরিস্থিতি এতটাই প্রতিকূল ছিলো যে কখনও কখনও তারা নিজেদের দেশে ফিরে যাওয়ার কথা খুব জোর দিয়েই ভাবতেন।
একজন অভিবাসী হিসাবে আপনি যখন এই নিবন্ধটি পড়ছেন তখন নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন তারা কী অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছিলেন, কারণ এমন ঘটনা কানাডায় প্রচুর। প্রথম সাক্ষাতে আমি জানতে পারি যে তারা তাদের অভিজ্ঞতার কথা তখন পর্যন্ত কারও সঙ্গে শেয়ার করেননি, সেজন্য তাদেরকে যে পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে হচ্ছিলো সে সম্পর্কে আমার সঙ্গে কথা বলাটা ছিলো জরুরী। আর আমি যখন অভিবাসী হিসাবে আমার নিজের অভিজ্ঞতার কথা তাদের বললাম তখন তারা বুঝতে পারলেন যে, তারাই কেবল এই পরিস্থিতিতে পড়েননি। কিন্তু তাদেরকে খারাপ দৃষ্টান্ত দেখিয়ে বোঝানোর পরিবর্তে আমি চাইছিলাম দৃশ্যত তাদের নেতিবাচক পরিস্থিতিকে কার্যত ইতিবাচক শিক্ষণীয় অভিজ্ঞতায় পরিণত করতে।
নতুন অভিবাসীরা যাতে ইতিবাচক মনোভাব গড়ে তুলতে পারেন এমন কিছু উপায় এখানে তুলে ধরছি যা নতুন দেশে সাফল্যের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
আপনি একা নন
অভিবাসন এমন এক অভিজ্ঞতা যাতে সত্যিই বিরাট চাপ সহ্য করতে হয়, তাই এতে নৈরাশ্যের বিভিন্ন পর্যায় পেরুতেই হবে, কিন্তু সাহস হারাবেন না। আপনিই একমাত্র ব্যক্তি নন যাকে এই অবস্থার মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে। আপনার অভিজ্ঞতা অন্যদের সঙ্গে শেয়ার করুন। এর ফলে আপনি জানতে পারবেন যে, প্রত্যেক অভিবাসীকেই একটি নতুন দেশে নতুন জীবন শুরু করতে গিয়ে কঠিন সময় পেরুতে হয়েছে। এই মানসিক অবস্থা একসময় কেটে যায় এবং হীনম্মন্যতার অনুভূতি স্থায়ী হতে পারে না। তা না হলে বেশিরভাগ অভিবাসী তাদের নিজের দেশে ফিরে যেতো। এটা হলো নিছক কিছু সময়, সঠিক লোকদের সঙ্গে যোগাযোগ ঘটা এবং সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার ব্যাপার।
এটি হলো আচরণগত একটি বিষয়
আমি প্রায়ই আমার মক্কেলদের বলে থাকি যে, আপনি যদি কালো চশমা পরেন তাহলে চার পাশের সবকিছুই কালো এবং ঘোলাটে দেখাবে, কিন্তু আপনি যদি সেটা পাল্টে স্বচ্ছ কাচের চশমা ব্যবহার করেন তাহলে সবকিছুই উজ্জ্বল দেখাবে। এই উপলব্ধি অনেক মানুষের জীবনের বাঁক পাল্টানোর সূচনা করেছে। আমরা যখন ভিন্ন প্রেক্ষাপট থেকে কোন অবস্থাকে দেখার চেষ্টা করি তখন আমরা আশাবাদী এবং উদ্বুদ্ধ হতে চাই। মনোভঙ্গির পরিবর্তন আমাদের জীবন পাল্টে দেয়। একটি গ্লাসকে অর্ধেক পূর্ণ বা অর্ধেক খালি দেখাটা একান্তভাবে আপনার ওপরই নির্ভর করে।
ঘ্যানঘ্যান করা বন্ধ করুন
বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন কথাটা বলেছেন এভাবে : “আমাদের যা কিছু অর্জন তার জন্য সবচেয়ে নিকৃষ্ট ধরণের বিনিময় হলো অবিরাম অভিযোগ করা।” আমি জানি, নবাগত অভিবাসীর জন্য জীবনটা সহজ নয় এবং কখনও ব্যাপারটা মনে হয় অন্যায্য হয়ে ওঠে, কিন্তু অসন্তুষ্টি আমাদের কোথাও পৌঁছে দেয় না। আমরা প্রায়শ অভিযোগ করি কারণ কোনটা সঠিক এবং ভালো সেটা খুঁজে বের করার চেয়ে অভিযোগ করাটা সহজ।
কানাডায় আসার এক মাস পর আমার স্বামী বলেছিলেন যে, তিনি এমন বোধ করছেন যেন জীবনটা স্থবির হয়ে পড়েছে এবং কোনও কিছুই কাজ করছে না। আমি তাকে আমাদের কানাডায় আসার দিনগুলোকে ফিরে দেখার পরামর্শ দিলাম। সে সময় আমরা কিছুই চিনতাম না এবং অন্যদের ওপর নির্ভরশীল ছিলাম। একমাস পর আমরা অন্তত জেনেছি যে কীভাবে কারও ওপর নির্ভর না করেই আমরা মুদির দোকানে, গীর্জায় অথবা লাইব্রেরিতে যেতে পারছি। এই ক্ষুদ্র অর্জনটুকুই আমাদের উদযাপন করা উচিৎ। আর প্রতি মাসেই আমরা আরও বেশি বেশি শিখবো।
সুখ হলো নিজের কাছে
সুখের উৎস হলো হৃদয়। একজন রাজার কাহিনী আছে এমন যে, সেই রাজা সব সময়ই ছিলেন অসুখি এবং বিমর্ষ। দীর্ঘদিনের বিমর্ষতায় বিরক্ত হয়ে শেষমেষ তিনি বিজ্ঞ ব্যক্তিদের ডেকে তাদের পরামর্শ চাইলেন। বিজ্ঞ লোকেরা তাকে একজন
সুখি মানুষের জামা গায়ে দেওয়ার পরামর্শ দিয়ে বললেন, সুখি মানুষের জামা গায়ে দিলেই তিনি সুখি হতে পারবেন। রাজা তৎক্ষণাৎ তার লোকদেরকে পাঠালেন একজন সুখি মানুষ খুঁজে আনার জন্য। এক বছর ধরে খোঁজাখুজি করে তারা একজন সুখি লোকের সন্ধান পেলো এবং রাজা তখনই সেই সুখি লোকটির জামা এনে দেওয়ার নির্দেশ দিলেন। কিন্তু তখনই রাজা জানতে পারলেন যে, ওই লোকটির কোনও জামাই নেই। সুতরাং আমাদের সুখ আসলে বস্তুগত বিষয় যেমন আমাদের কী আছে, কারা আমাদের চারপাশে রয়েছে অথবা আমাদের পরিবেশ ইত্যাদি কোনও কিছুর ওপরই নির্ভলশীল নয়। সত্যিকারের সুখ আসলে আমাদের নিজেদের মধ্যেই রয়েছে।
কৃতজ্ঞতা বোধের মনোভাব গড়ে তুলুন
আমার আরেকজন রোগী আছেন যিনি একসময় কঠিন পরিস্থিতি পেরিয়ে এসেছেন। তিনি একজন নিঃসঙ্গ মা। তার দুটি শিশু সন্তান রয়েছে যাদের বিশেষ ধরণের সেবাযতেœর প্রয়োজন রয়েছে। এই নারী পরিস্থিতির চাপ আর সহ্য করতে না পেরে রাতের বেলা খোদার কাছে প্রার্থনা করে সঠিক পথের সন্ধান চাইতেন। আমি তাকে একটি ‘কৃতজ্ঞতার রোজনামচা’ সংরক্ষণের পরামর্শ দিই। তাকে বলি, রাতে প্রার্থনা শেষে রোজনামচায় ওই দিনের এমন তিনটি ঘটনা লিখে রাখুন যার জন্য আপনি কৃতজ্ঞ বোধ করতে পারেন। কাজটা শুরু করার কিছুদিন পর তিনি জানান যে আগের চেয়ে তার জীবনকে ইতিবাচক বলে মনে হচ্ছে এবং জীবনের বোঝা তার কাছে অধিকতর বহনযোগ্য বলে মনে হচ্ছে। আর তিনি এমনটাও উপলব্ধি করছেন যে, এমন অনেক মানুষ আছেন যারা তার চেয়েও অনেক বড় সমস্যার মধ্যে রয়েছেন।
একটি নতুন দেশে আসার পর প্রথম দিকে কয়েকটি মাস খুবই চাপের মধ্যে পড়তে হয়, তবে আপনি যদি নিজের মধ্যে ধন্যবাদ জ্ঞাপন এবং কৃতজ্ঞতা বোধের মনোভাব গড়ে তুলতে পারেন তাহলে আপনি নিজের জন্য কল্যাণকর কী কী বিষয় পাচ্ছেন যেমন, একটি নতুন দেশ, সুযোগ-সুবিধায় পূর্ণ একটি ভূখ- এবং ক্রমশ অগ্রসরমানতার মতো বিষয়গুলোর ওপর আরও বেশি মনোযোগ দিতে পারবেন।
উইলিয়াম সেকার নামে একজন ধর্মযাজক ও ধর্মীয় লেখক লিখেছেন, “কৃতজ্ঞ চিত্ত একইসঙ্গে মহৎ ও সুখি।”
পাকিস্তানী বংশোদ্ভূত দিলনওয়াজ কামার ব্রাম্পটন বহুমুখি সাংস্কৃতিক কমিউনিটি সেন্টারের মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক উপদেষ্টা।