মি টু আন্দোলন : কানাডার রাজনৈতিক অঙ্গনে কারো কারো ঘুম হারাম
ইতিমধ্যেই দলের শীর্ষ পদ হারিয়েছেন কয়েকজন : কেউ হারিয়েছেন মন্ত্রীত্ব
মার্চ ১৮, ২০১৮
খুরশিদ আলম: সম্প্রতি ‘মি টু’ আন্দোলন জোরদার হওয়ার পর কানাডার রাজনৈতিক অঙ্গণে কতিপয় রাজনৈতিক নেতা আতংকের মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন। অতীতে তারা কখন কার উপর যৌন নির্যাতন চালিয়েছেন অথবা কাকে যৌন হয়রানি করেছেন সেগুলো স্মৃতির পর্দায় বার বার ভেসে উঠছে। আতংকে আছেন এ কথা ভেবেও যে, নিজের অজান্তে বা অসাবধানতাবশত কারো সঙ্গে কি কোন অশালীন বা অশোভন ব্যবহার করেছেন? আতংকের পাশাপাশি কল্পনায় ভেসে উঠছে কিছু যৌন কেলেংকারীর নিউজ হেডলাইন যেখানে নায়ক তিনি নিজেই। তার ছবি সহ দেশের বিভিন্ন মিডিয়াতে গুরুত্বসহকারে ছাপা হচ্ছে তার অতীত কেলেংকারীর খবর যা এতদিন কেউ জানতে পারেনি। তার স্ত্রী, পুত্র, কন্যা এবং পরিবারের অন্যান্য সদস্য সবাই মিডিয়ার বদৌলতে জেনে গেছেন ‘তার চরিত্র ফুলের মত পবিত্র’ নয়! জেনে গেছে গোটা জাতি। সবাই ছি ছি করছেন!
কয়েক সপ্তাহ আগে প্যাট্রিক ব্রাউন নামের একজন কানাডীয় রাজনীতিক এর বিরুদ্ধে দুই মহিলা যৌন নির্যাতের অভিযোগ আনেন। এরপরই শুরু হয় আতংকিত হওয়ার পালা। শুরু হয় হৈ-চৈ। তপ্ত হয়ে উঠে কানাডার রাজনৈতিক অঙ্গণ, আতংকিত হয়ে উঠেন কেউ কেউ। সজাগ হয়ে উঠে মিডিয়া।
প্যাট্রিক ব্রাউন ছিলেন অন্টারিও প্রভিন্সের প্রগ্রেসিভ কনজারভেটিভ পার্টির প্রধান। প্রধান বিরোধী দলীয় নেতা। ইতিপূর্বে তিনি ফেডারেল পার্লামেন্টেরও এমপি ছিলেন। ঐ সময়টাতেই নাকি তিনি যৌন নির্যাতন এর ঘটনা ঘটিয়েছিলেন। দুই নারী এই অভিযোগ তুলেন। সিটিভি নিউজের এক খবরে এই তথ্য প্রকাশিত হয়।
অন্টারওি প্রভিন্সের আসন্ন নর্বিাচনে তার দলের জয়ী হওয়ার সম্ভানা ছিল বেশী। আগামী ৭ জুন নির্বাচন অনুষ্ঠতি হওয়ার কথা। নানান জরীপে তিনি ও তার দল এগিয়ে ছিল। অর্থাৎ তিনিই সম্ভবত হতে যাচ্ছিলেন অন্টারিওর পরবর্তী প্রিমিয়ার।
কিন্তু রাতারাতি সে সম্ভাবনার চিত্র পাল্টে গেল। দুই নারী তার বিরুদ্ধে যৌন নির্যাতনের অভিযোগ আনেন। প্রথমে তিনি সংবাদ সম্মেলন করে এই অভিযোগ অস্বীকার করেন। ঐ সময় প্রায় কান্নায় ভেঙ্গে পড়ার মত অবস্থা হয়েছিল তার। তিনি অভিযোগ অস্বীকার করেই সম্মেলনস্থল ত্যাগ করেন সাংবাদিকদের কোন প্রশ্নের জাবব না দিয়েই। কিন্তু এর ঘন্টাখানেক পরই তিনি দলীয় প্রধানের পদ থেকে পদত্যাগ করেন। তবে তিনি তার এমপিপি (মেম্বার অব প্রভিন্সিয়াল পার্লামেন্ট) পদ থেকে সড়ে দাড়াচ্ছেন না বলে জানিয়েছেন। তিনি বলেন এই মিথ্যা যৌন নির্যাতনের অভিযোগ থেকে তিনি তার নাম মুছে ফেলার জন্য লড়বেন। তিনি দাবী করেন এই অভিযোগ সুষ্পষ্টভাবে মিথ্যা।
প্যাট্রিক অবশ্য সিটিভি নিউজের বিরুদ্ধে মামলা ঠুকে দিয়েছেন ইতিমধ্যে। তবে যৌন হয়রানী বা নির্যাতন যেটাই হয়ে থাকুক বা না হয়ে থাকুক সেটা প্রমাণিত হতে সময় লাগবে। কিন্তু প্যাট্রিক ব্রাউনের সর্বনাশ যা হবার তা হয়ে গেছে।
উল্লেখ্য যে, প্যাট্রিক ব্রাউন অভিযোগের প্রথম ধাক্কা কাটিয়ে উঠে আবারো পার্টি প্রধান হওয়ার জন্য মাঠে নেমেছিলেন। যৌন হয়রানির অভিযোগ থাকা সত্বেও দলের পক্ষ থেকেও তার এই প্রার্থীতাকে মেনে নেয়া হয়েছিল। কিন্তু কয়েকদিন যেতে না যেতেই প্যাট্রিক সরে দাড়ান প্রতিযোগিতা থেকে। তিনি হয়তো আশংকা করছেন যে, যৌন হয়রানি বা নির্যাতন এর অভিযোগ মাথায় নিয়ে সামনে এগুনো যাবে না।
শুধু প্যাট্রিক ব্রাউন নয়, একই সময় যৌন নির্যাতনের অভিযোগ উঠে এই একই দলের সভাপতি রিক ডাইকস্ট্রার বিরুদ্ধেও। ২০১৪ সালে তার হাতে নাকি যৌন নির্যাতনের শিকার হন এক তরুনী। ঐ সময় রিক ডাইকস্ট্রা প্রগ্রেসিভ কনজারভেটিভ পার্টির ফেডারেল এমপি ছিলেন।
টরন্টো থেকে প্রকাশিত ম্যাগাজিন ম্যাকলিন’স এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ঐ সময় রিক ডাইকস্ট্রার হাতে নির্যাতিত হওয়ার পর সেই তরুনী পুলিশের কাছে রিপোর্ট করেন। তবে রিক এর বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগ আদালতে প্রমাণিত হয়নি এখনো। কিন্তু ম্যাকলিন’স এ সংক্রান্ত প্রতিবেদনটি ছাপানোর পর ২৮ জানুয়ারী রিক ডাইকস্ট্রোকেও পদত্যাগ করতে হয় দলীয় সভাপতির পদ থেকে। প্যাট্রিক ব্রাউন পদত্যাগ করেছিলেন ২৫ জানুয়ারী। তিন দিনের মাথায় একই দলের প্রেসিডেন্টও পদত্যাগ করতে বাধ্য হন একই অভিযোগ মাথায় নিয়ে।
রিক ডাইকস্ট্রা অন্টারিও প্রগ্রেসিভ কনজার্ভেটিভ পার্টির প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন ২০১৬ সাল থেকে। তিনি সেইন্ট ক্যাথেরিন থেকে নির্বাচিত এমপি ছিলেন ২০০৬ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত।
এদিকে গত জানুয়ারী মাসের ২৪ তারিখে নোভাষ্কাশিয়ার প্রগ্রেসিভ কনজার্ভেটিভ নেতা জেমী বেইলি-ও পদত্যাগ করতে বাধ্য হন তার বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ উঠায়। অর্থাৎ ২৪, ২৫ এবং ২৮ জানুয়ারী -এই তিন দিনে তিন হাই-প্রোফাইল রাজনীতিবিদ (একই দলের) দল পরিচালনার দায়িত্ব থেকে সরে দাড়ান যৌন হয়রানি বা যৌন নির্যাতনের অভিযোগ উঠায়!
সিবিসি নিউজের খবরে বলা হয় জেমী’র বিরুদ্ধে পার্লমেন্টের এক মহিলা কর্মী যৌন হয়রানির অভিযোগ আনেন। কিন্তু স্থানীয় পুলিশ কর্তৃপক্ষ এ ব্যাপারে কোন অভিযোগ পায়নি বলে জানিয়েছে।
শুধু প্রগ্রেসিভ কনজার্ভেটিভ পার্টির এই তিন নেতাই যে যৌন হয়রানির অভিযোগ উঠায় নিজ দলের নেতৃত্ব হারিয়েছেন তা নয়। লিবারেল দলের কয়েকজন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তির বিরুদ্ধেও উঠেছে একই অভিযোগ।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মি টু আন্দোলন জোরালো হয়ে উঠার পর ‘ক্যালগারী সেন্টার’ রাইডিং থেকে নির্বাচিত ফেডারেল এপি কেন্ট হ্যার এর বিরুদ্ধেও যৌন হয়রানী বা নির্যাতনের অভিযোগ উঠে। তিনি ২০১৫ সালের ফেডারেল নির্বাচনে লিবারেল দলের হয়ে এমপি নির্বাচিত হন। তিনি জাস্টিন ট্রুডোর মন্ত্রী সভায়ও স্থান পান। তাকে মিনিস্ট্রি অব ভেটেরান এ্যাফেয়ার্স এর দায়িত্ব দেয়া হয় ২০১৫ সালের ৪ নভেম্বর। পরে ২০১৭ সালের আগস্টে তাকে মিনিস্ট্রি অব স্পোর্ট এ্যান্ড পারসনস উইথ ডিজএবিলিটি’র দায়িত্ব দেয়া হয়। কিন্তু তার বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ উঠলে চলতি বছর ২৫ জানুয়ারী তিনি মন্ত্রীর পদ থেকে সরে দাড়ান। তবে এমপির পদ থেকে তিনি পদত্যাগ করেননি যেমনটা করেননি প্যাট্রিক ব্রাউন।
মন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে কেন্ট হ্যার বলেন, আমি আমার কর্মজীবনে সবসময় চেষ্টা করেছি অপরের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকতে। আমি জানতে পারি যে আমার বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ উঠেছে এবং সেটি এখন তদন্তাধীন। আমি এই প্রক্রিয়াকে স্বাগত জানাই।
কেন্ট হ্যার পদত্যাগের সময় প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো সুইজারল্যান্ডে অবস্থান করছিলেন। সেখান থেকেই তিনি এক বর্তায় জানান কেন্ট এর পদত্যাগ অনুমোদন করা হয়েছে।
সোস্যাল মিডিয়াতে ইতিপূর্বে প্রচার করা হয় এই বলে যে কেন্ট এর উপস্থিতিতে আলবার্টার পার্লামেন্টে মহিলারা নিরাপদ বোধ করেন না।
ক্রিস্টিন রওয়ার্থ নামের এক মহিলা তার টুইটারে লিখেন, কেন্ট হ্যার একবার এলিভেটরে তাকে উদ্দেশ্য করে বলেন “you’re yummy ”।
ক্যালগারীতে কেন্ট হ্যার ছাড়া আরো একজন লিবারেল এমপির বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ উঠে। তিনি হলেন পাঞ্জাবী বংশোদ্ভূত দর্শন কং। ২ মার্চ (২০১৮) সিবিসি নিউজের এক খবরে বলা হয় তার বিরুদ্ধে আনিত যৌন হয়রানির আভিযোগ তদন্তের পর প্রমাণিত হয়েছে।
এমপি দর্শন এর অধিনে কাজ করতেন রেহা বাছি নামের এক মহিলা। তিনি অভিযোগ করেন দর্শন নিয়মিত তাকে জড়িয়ে ধরতেন এবং শরীরের বিভিন্ন স্থানে চাপড় মারতেন। অফিসের পর দর্শনের ফোন কল রিসিভ না করলে তাকে চাকরীচ্যূত করার হুমকী দিতেন। বার বার তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাকে চুমু খেতেন। দর্শনের এই আচরণ সম্পর্কে অভিযোগ করার হুমকী দিলে তার মুখ বন্ধ করার জন্য অর্থ দেয়ার প্রস্তাব করেছিলেন তিনি।
যৌন হয়রানির অভিযোগ উঠার পর দর্শন গত বছর আগস্ট লিবারেল ককাস থেকে পদত্যাগ করেন।
কানাডার বিভিন্ন প্রভিন্সের কয়েজন রাজনীতিবিদের এই পরিণতি কানাডার রাজনৈতিক অংঙ্গণে এক প্রচন্ড ঝাঁকুনি দিয়ে গেছে। আর এই ঝাঁকুনিতে ঘুম ভেঙ্গে গেছে আরো কিছু রাজনীতিক এর। তারা এখন উদ্বেগ, আতঙ্ক এবং দুঃস্বপ্নের মধ্য দিয়ে তাদের নিশি-দিন যাপন করছেন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন যৌন নির্যাতন বা যৌন হয়রানির শিকার মহিলাগণ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সোচ্চার হওয়ায় অনেক পুরুষই এখন তাদের অতীত নিয়ে আতংকের মধ্যে আছেন। সেলিব্রিটি ছাড়া সাধারণ পুরুষদের মধ্যেও বিরাজ করছে এই আতংক। দেখা দিয়েছে বিশ্বাসের ঘাটতি। তারা ভাবছেন অতীতে কোন মহিলার সঙ্গে তাদের আচরণ বা ক্রিয়াকলাপ কি সঠিক ছিল নাকি কিছুটা বাড়াবাড়ি পর্যায়ের ছিল? যদি সেই আচরণ বা ক্রিয়াকলাপের কারণে এখন কেউ যৌন হয়রানির অভিযোগ তুলে বসেন তখন কি হবে?
ক্রিস্টিন হার্ট নামের এক জেন্ডার ইন্টেলিজেন্স এক্সপার্ট বলেন, আমি কিছু যুবক বয়সী পুরুষের সঙ্গে কথা বলেছি বিষয়টি নিয়ে। তারা প্রায় সবাই এখন মহিলাদের এড়িয়ে চলার চেষ্টা করছেন। তাদের ভয়, তাদের কোন আচরণে যদি আবার যৌন হয়রানির অভিযোগ উঠে? ক্রিস্টিন আরো বলেন, যুবকদের কেউ কেউ এমনও বলেছেন যে, তারা এখন মহিলাদের সঙ্গে যোগাযোগ কমিয়ে দিয়েছেন এমনকি কর্মস্থলে বা অন্য কোথাও চোখাচোখিও প্রায় বন্ধ করে দিয়েছেন।
অয়ন মুখার্জী টরন্টোর একজন মনোবিজ্ঞানী। তিনি পুরুষদের মানসিক সমস্যা নিয়ে কাজ করেন। অয়ন বলেন, পুরুষদের মধ্যে এখন বেশ শঙ্কা বা ভীতি কাজ করে মহিলাদের সঙ্গে সামাজিক যোগাযোগ স্থাপনের ক্ষেত্রে। এমনকি পারস্পরিক সমঝোতার মাধ্যমে ডেটিং এ যাওয়া নিয়েও পুরুষদের মধ্যে এখন ভীতি কাজ করছে।
ক্রিস্টিন হার্ট বলেন, পরিস্থিতি এখন এমন হয়েছে যে, অনেক পুরুষ কর্মস্থলে জুনিয়র মহিলাদের সুপারভাইজার হতে আগ্রহী নন। ‘#মি টু’ বা ‘#টাইমসআপ’ এর ভয়ে তারা তটস্থ। এতে করে অনিবার্যভাবে ভাবে অনেক মহিলার কর্মজীবনের উচ্চ প্রত্যাশা ক্ষতিগ্রস্থ হবে। -সূত্র : কানাডিয়ান প্রেস।
আবার এমনো আশংকা দেখা দিয়েছে যে, কোন কোন মহিলা যৌন হয়রানির বিষয়ে মিথ্যা অভিযোগ আনতে পারে বা কোন ঘটনাকে বাড়িয়ে বলতে পারে যা পুরুষদের ক্যারিয়ার বা সুনামকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। পুরুষদের মধ্যে এ বিষয়টি খুব উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে। ক্রিস্টিন বলেন, পুরুষদের কেউ কেউ পরিস্থিতি বুঝে আগে থেকেই প্রতিরোধমূলক পদক্ষেপ নিচ্ছেন। একটি উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, এক পুরুষ তার কর্মস্থলে এক মহিলার সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়েছিলেন। পরে যখন তাদের মধ্যে সম্পর্কের বিচ্ছেদ ঘটে তখন ঐ পুরুষটি আগেভাগেই হিউম্যান রিসোর্স ম্যানেজারের কাছে বিচ্ছেদের আগে ঐ মহিলার সঙ্গে যে সব টেক্স ম্যাসেজ ও ইমেইল চালাচালি হয়েছিল তার কপি জমা দেন।
এদিকে সাম্প্রতিক সময়ে যাদের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ উঠেছে তাদের কেউ কেউ অভিযোগকারীনির বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে বিরোধীতা করছেন এবং দাবী করছেন যৌন হয়রানির অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা এবং ভিত্তিহীন।
অন্টারিওর প্রগ্রেসিভ কনজারভেটিভ পার্টির সাবেক প্রধান প্যাট্রিক ব্রাউন তাদের একজন। তার বিরুদ্ধে দুই মহিলা যৌন হয়রানির অভিযোগ তোলার পর তিনি পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। কিন্তু তিনি দাবী করছেন ঐ মহিলাদের অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা। তিনি আদালতে এর বিরুদ্ধে লড়বেন বলে জানিয়েছেন মিডিয়ার কাছে। তিনি পাল্টা অভিযোগ তুলে বলছেন, বিরোধী দলের সদস্যরা বা তার নিজ দলের কেউ হয়তো ঐ মহিলাদেরকে প্ররোচিত করেছেন তার বিরুদ্ধে এই জাতীয় মিথ্যা অভিযোগ দায়ের করার জন্য।
যৌন হয়রানির অভিযোগ উঠেছে টরন্টোর একজন সিনিয়র সাংবাদিক এবং টিভিও’র ((TVO) `Agenda’ শিরোনামের কারেন্ট এ্যাফেয়ার্স হোস্ট স্টিভ পাইকিন এর বিরুদ্ধেও। তিনি দীর্ঘদিন ধরে এই অনুষ্ঠানটির হোস্ট হিসাবে কাজ করে আসছেন। তার বিরুদ্ধে যিনি যৌন হয়রানির অভিযোগ এনেছেন তিনি হলেন টরন্টোর সাবেক মেয়র পদ প্রার্থী স্যারা থমসন। স্যারা থমসন দাবী করেন- স্টিভ তাকে প্রস্তাব দিয়েছিলেন যৌনতার বিনিময়ে তাকে টিভিতে প্রচারণার সুযোগ দিবেন।
সাংবাদিক স্টিভ পাইকিন পদত্যাগ করেননি প্যাট্রিক ব্রাউনের মত। তাছাড়া TVO কর্তৃপক্ষও অভিযোগ উঠামাত্রই স্টিভকে বরখাস্ত করেনি। বিষয়টি আদালতে প্রমাণ না হওয়া পর্যন্ত কোন সিদ্ধান্তে যাচ্ছে না বলে জানিয়ে দিয়েছে তারা। একই সাথে এটিও জানিয়ে দেয়া হয়েছে, যে কোন যৌন হয়রানির অভিযোগকে TVO কর্তৃপক্ষ গুরুত্বসহকারে নিয়ে থাকে।
স্টিভ পাইকিন বলেন স্যারা’র অভিযোগ ১০০% মিথ্যা। স্যারাকে উদ্দেশ্য করে তিনি বলেন, আপনি আমার মানহানি ঘটনোর চেষ্টা করেছেন মিথ্যা অপবাদ দিয়ে। আমি জানিনা কেন আপনি এই কাজটি করেছেন।
যৌন হয়রানির অভিযোগ উঠেছে সিটিভির সাংবাদিক পল ব্লিস এর বিরুদ্ধেও। অভিযোগ উঠার পর গত জানুয়ারীতে তাকে সিটিভি থেকে বরখাস্ত করা হয়।
এই প্রতিবেদনটি তৈরীর সময় সর্বশেষ যার বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ উঠে তিনি হলেন আরেক সেলিব্রিটি জেকব হোগার্ড। জেকব একজন জনপ্রিয় সঙ্গীত শিল্পী। সিবিসি নিউজের এক খবরে
বলা হয়, অটোয়া নিবাসী এক মহিলা অভিযোগ করেন ২০১৬ সালে জেকব তাকে ধর্ষণ করেন। কিন্তু জেকব ধর্ষণের অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, দুজনের সম্মতিতেই তারা হোটেলের বেডে গিয়েছিলেন। তিনি অবশ্য স্বীকার করেন যে অতীতে তিনি কেয়ারলেস ছিলেন এবং অনেকের সঙ্গেই তিনি সঠিক ব্যবহার করেননি এবং এজন্য তিনি আন্তরিকভাবে দুঃখ প্রকাশ করেছেন।
তবে অভিযোগকারিনী জেকবের এই দুঃখ প্রকাশকে মেনে নেননি। তিনি বলেছেন এই দুঃখ প্রকাশ পর্যাপ্ত নয় এবং সেটি অকৃত্রিমও নয়। ‘সম্মতি’ বলতে কি বুঝায় তা তিনি এখনো বুঝেন না। আর তিনি দুঃখ প্রকাশ করছে এই কারণে যে তার কুকীর্তি প্রকাশ পেয়ে গেছে।
জেকবের বিরুদ্ধে অভিযোগকারী মহিলা অবশ্য বিষয়টি পুলিশকে জানাননি।
উল্লেখ্য যে, গত ২০১৪ ও ২০১৫ সালে সিবিসি টেলিভিশন ও রেডিওর ব্রডকাস্টার জিয়ান গোমেসীর বিরুদ্ধে একাধিক মহিলা যৌন হয়রানি ও যৌন নির্যাতনের অভিযোগ এনেছিলেন। বিষয়টি তখন বেশ আলোচিত হয়ে উঠেছিল কানাডার বিভিন্ন মিডিয়ায়। তবে গোমেসী ঐ সব অভিযোগই অস্বীকার করেন। কিন্তু পরবর্তীতে তাকে গ্রেফতার করা হয় এবং অভিযোগের বিষয়গুলো আদালত পর্যন্ত গড়ায়। ২০১৬ সালে তার ট্রায়াল শুরু হয় এবং ঐ বছরই মাঝামাঝি সময় তার বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগসমূহ সত্য প্রমানিত না হওয়ায় তিনি মুক্তি পান।
কানাডার রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং মিডিয়া অঙ্গণের সাম্প্রতিক এই ঝড় এর পূর্বাভাষ দিতে শুরু করেছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যখন মি টু আন্দোলন জোরদার হতে থাকে তখন থেকেই। কারণ, সেখানে মি টু আন্দোলন এর জোয়ার দেখা দিলে তার আঘাত এসে লাগে কানাডাতেও।
যুক্তরাষ্ট্রে এই মি টু আন্দোলন জোরদার হয়ে উঠে যখন হলিউডের প্রভাবশালী প্রযোজক হার্ভে ওয়েইনস্টেন এর বিরুদ্ধে চলচ্চিত্রের অভেনেত্রীরা যৌন হয়রানি ও নির্যাতনের অভিযোগ তুলতে আরম্ভ করেন। অভিযোগ উঠার পর হার্ভের স্ত্রী তাকে ত্যাগ করেছেন, একাডেমী অব মোশন পিকচার আর্টস এ্যান্ড সায়েন্সের সদস্যপদ খুইয়েছেন তিনি। আর ‘মি টু’ আন্দোলন নুতন করে উজ্জীবিত হয়েছে এই হার্ভের বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপনের পর থেকেই।
হার্ভে ওয়েইনস্টেন হলিউডের একজন খুব গুরুত্বপূর্ন ব্যক্তি। তার বিরুদ্ধে যারা যৌন হয়রানির অভিযোগ উঠিয়েছেন তাদের মধ্যে হলিউডের নামকরা অভিনেত্রী এ্যাঞ্জেলিনা জোলিও আছেন।
বর্তমানে এই মি টু আন্দোলন আর হলিউডে সীমাবদ্ধ নেই, আমেরিকার সীমানা ছাড়িয়ে কানাডাসহ সারা বিশ্বেই ছড়িয়ে পরেছে।
গত বছর ১৩ নভেম্বর যৌন হয়রানির শিকার নারীদের প্রতি সমর্থন জানিয়ে বেশ বড়সড় মিছিলও বের করা হয়েছিল হলিউডে। বিবিসি’র খবরে বলা হয়, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ‘হ্যাশট্যাগ মি টু’ প্রচারণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে এ মিছিলে যৌন হয়রানির শিকার নারীরা ছাড়াও আরো অনেকে অংশ নেন। মিছিলকারীদের একটি বড় অংশ নারী হলেও সেখানে কিছু পুরুষকেও দেখা গেছে।
যৌন হয়রানির শিকার নারীদের প্রতি সমর্থন জানিয়ে অনুরূপ মিছিল বের করা হয়েছিল টরন্টোতেও। গত ২ ডিসেম্বর টরন্টোর ডাউনটাউনে অবস্থিত অন্টারিও পার্লামেন্ট ভবনের সামনে থেকে শুরু হয়ে মিছিলটি নেথেন ফিলিপস স্কয়ারে এসে শেষ হয়। কয়েক হাজার নারী এতে অংশ নেন। কিছু সংখ্যক পুরুষও ছিলেন মিছিলে।
উল্ল্লেখ্য যে, তারানা বুর্কে নামে এক কৃষ্ণাঙ্গ সামজকর্মী নারী ২০০৭ সালে যৌন নির্যাতনবিরোধী ‘মি টু’ আন্দোলন শুরু করেছিলেন। তখন এই আন্দোলন তেমন জোরালো হয়ে উঠতে পারেনি। কিন্তু এবার সেটি বিশ্বব্যাপী প্রচারণা পায়। এই হ্যাশট্যাগ মি টু-তে হাজার হাজার নারী জানিয়েছেন কি ভাবে তারা বিভিন্ন সময় যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন। এমন কি কিছু সংখ্যক পুরুষও জানিয়েছেন তারা কি ভাবে যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন।
কানাডার রাজনৈতকি অঙ্গণে ইতিপূর্বে যৌন হয়রানির ঘটনাগুলো মিডিয়াতে প্রকাশ পায়নি তেমনভাবে। তবে কিছু যৌন কেলেংকারীর ঘটনা বেশ আলোচিত হয়ে উঠেছিল। সেই কেলেংকারীর ঘটনাগুলো ছিল পরকীয়া বা অর্থের বিনিময়ে যৌন কর্মীর সঙ্গে রাতযাপনের ঘটনা। রাশিয়ান কেজিবির মহিলা এজেন্টদের যৌন ফাঁদে পা দিয়েও কোন কোন রাজনীতিক বিতর্কিত হয়েছেন ইতিপূর্বে।
ম্যাকলিন’স এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়, অতীতের আলোচিত ঘটনার মধ্যে আছে আলবার্টার পঞ্চম প্রিমিয়ার জন এডওয়ার্ডের কাহিনী। এটি ১৯৩৩ সালের ঘটনা। ঐ সময় তার বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির মামলা ঠুকে দিয়েছিল তারই এক রাজনৈতি সহকর্মীর মেয়ে ১৮ বছর বয়সী ভিভিয়ান ম্যাকমিলিয়ান। বিষয়টি তখন বেশ বিতর্কের সৃষ্টি করেছিল। বলা হচ্ছিল পুরো বিষয়টিই একটি রাজনৈতিক চাল। কিন্তু আদালতে গিয়ে এডওয়ার্ড হেরে হন। মামলার রায় হয় ভিভিয়ানের পক্ষে। এডওয়ার্ডকে তখন পদত্যাগ করতে হয়।
পরকীয়ার গুঞ্জন উঠেছিল সাবেক প্রধানমন্ত্রী পিয়ের ট্রুডোর প্রথম স্ত্রী মার্গারেট ট্রুডোর ব্যাপারেও। ১৯৭৭ সালে তাদের ষষ্ঠ বিয়ে বার্ষিকীর দিনে ট্রুডোর সাথে সময় না কাটিয়ে মার্গারেট নাইট ক্লাবে সময় কাটিয়েছেন ব্যান্ড সঙ্গীত দল রোলিং স্টোনস এর গান শুনে। পরে তাকে রোলিং স্টেনস এর শিল্পী মাইক জাগার এর লিমোজিনেও উঠতে দেখা গেছে। মার্গারেট অবশ্য পরে পরকীয়ার অভিযোগ অস্বীকার করেন।
গত শতকের পঞ্চাশের দশকের শেষের দিকে মুনসিঙ্গার নামের এক জার্মান যৌনকর্মী রাশিয়ার হয়ে গুপ্তচর বৃত্তিতে নাম লিখিয়েছিল। সেই মহিলা তখন কানাডার জনাকয়েক মন্ত্রীর মন যুগিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গণে ঝড় তুলেছিলেন। তিনি যাদের মন জয় করতে পেরেছিলেন তাদের মধ্যে একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ছিলেন তখনকার ন্যাশনাল ডিফেন্সের এসোসিয়েট মিনিস্টার প্যারি সেভিগনি। পরে অবশ্য এই গুপ্তচরকে কানাডা থেকে বহিস্কার করা হয়।
সুদূর অতীতে এরকম আরো কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ব্যক্তি নানারকম যৌন কেলেংকারীতে জড়িয়েছিলেন।
সাম্প্রতিক বছরের মধ্যে আলোচিত একটি ঘটনা ছিল সাবেক প্রধানমন্ত্রী স্টিফেন হারপারের ঘনিষ্ঠ রাজনৈকি ব্যক্তিত্ব ম্যাক্সিম বার্নিয়ারের এক কাহিনী। তিনি তখন কানাডার পররাষ্ট্র মন্ত্রী ছিলেন। ঐ সময় একবার তিনি সরকারী এক গুরুত্বপূর্ণ ফাইল তার এক বান্ধবীর বাসায় রেখে চলে এসেছিলেন। তার ঐ বান্ধবী একসময় হেল’স এঞ্জেলস এর দুই সদস্যের সঙ্গে ডেটিং করতেন। হেল’স এঞ্জেলস এর বিরুদ্ধে অর্গানাইজড ক্রাইম এর অভিযোগ রয়েছে।
উল্লেখ্য যে, কানাডার বর্তমান মন্ত্রীপরিষদের অর্ধেক সদস্যই নারী। কিন্তু তারপরও আমরা দেখছি এই দেশটিতেও নারীর প্রতি যৌন হয়রানি ও যৌন নির্যাতন চলে আসছে। গত অক্টোবর মাসের ২০ ও ২১ তারিখে এ্যাবাকাস ডাটা’র পরিচালিত এক জরীপে দেখা যাচ্ছে কানাডার ৫৩% নারী অবাঞ্ছিত যৌন হয়রানি বা চাপ এর শিকার হচ্ছেন। আর শতকরা ১০ জনেরও বেশী পুরুষ এবং নারী বলেন তাদের কর্মস্থলে নারীদের যৌন হয়রানির শিকার হওয়া খুবই কমন বা সাধারণ বিষয়। এ্যাবাকাস ডাটা’র চেয়াম্যান ব্র“স এন্ডারসন বলেন, জরীপে উঠে আসা এই তথ্য খুবই আঘাত হানার মত। সংখ্যার হিসাবে বলা যায় কানাডায় ৮০ লক্ষ নরী যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন তাদের জীবনের কোন এক পর্যায়ে।
লক্ষ্যনীয় যে, ‘মি টু, এর মাধ্যমে কানাডা সহ বিশ্বের অনেক দেশের মহিলারাই আজ সোচ্চার হয়ে উঠছেন। এমনকি বাংলাদেশী মহিলারাও। বাংলা ট্রিবিউন সূত্রে জানা যায় বাংলাদেশে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মহিলাদের কেউ কেউ এ বিষয়ে কথা বলছেন। যেমন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক নাসরিন খন্দকার বলেন, মি টু ক্যাম্পেইন আমাদের সামনে স্পষ্ট করতে পারে যে, যৌন হয়রানি কতোটা ব্যাপক। তিনি আরও বলেন, ‘আমি সাক্ষ্য দিতে পারি যে, আমার পরিচিত প্রত্যেকটি নারী জীবনের কোনও না কোনও সময়ে যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন। সাড়ে সাত বিলিয়ন মানুষের এই বিশ্বে যদি তিন বিলিয়ন মানুষ যৌন হয়রানির শিকার হয়ে থাকেন, তাহলে নিঃসন্দেহে একে মানবতার বিরুদ্ধে সর্বকালের সবচেয়ে বড় রোগ হিসেবে বিবেচনা করা উচিত।