কানাডায় দ্বিতীয় প্রজন্মের ছেলে-মেয়েদের মধ্যে বাড়ছে বিবাহবিচ্ছেদ
অক্টোবর ৭, ২০১৭
খুরশিদ আলম : গত সামারে আপনি যদি আমন্ত্রিত হয়ে ছয়টি বিয়ের অনুষ্ঠানে গিয়ে থাকেন তবে আগামী এক থেকে চার বা পাঁচ বছরের মধ্যে হয়তো দেখতে পাবেন ঐ ছয়টি বিয়ের অন্তত দুটি বিয়ে ভেঙ্গে গেছে। টরন্টোর বাঙ্গালী কমিউটিনিতে এরকম ঘটনাই ঘটে আসছে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে। আর এই অভিজ্ঞতা প্রায় সব বাঙ্গালীরই হয়ে গেছে ইতিমধ্যে। কমিউনিটির লোকদের সঙ্গে কথা বলে মোটামুটি এরকমই একটি চিত্র পাওয়া গেছে সম্প্রতি।
কমিউনিটিতে আমাদের দ্বিতীয় প্রজন্মের ছেলে মেয়েদের বিয়ে করাতে গেলে বা দিতে গেলে প্রথম যে সমস্যা সামনে এসে দাড়ায় তা হলো, ছেলের জন্য উপযুক্ত মেয়ে খুঁজে পাওয়া যায় না। অথবা মেয়ের জন্য উপযুক্ত ছেলে খুঁজে পাওয়া যায় না। ছেলে মেয়েরা নিজেরা যদি নিজেদের জীবন সঙ্গী সঠিক সময়ে খুঁজে নিতে না পারে সে ক্ষেত্রে অভিভাবকদের জন্য তা এক বড় ধরণের মাথা ব্যথার কারণ হয়ে দাড়ায়। এটি হলো প্রবাসে বিবাহ পূর্ব সংকট।
আর বিবাহ উত্তর সংকট হলো কানাডায় দ্বিতীয় প্রজন্মের ছেলে মেয়েদের সংসার টিকিয়ে রাখা। ২০১১ সালের ন্যাশনাল হাউজহোল্ড সার্ভের হিসাব অনুযায়ী দেখা যায় কানাডায় দৃশ্যমান সংখ্যালঘুদের মধ্যে বিবাহবিচ্ছেদের হার শতকরা ৪.৩৬। আর বিশেষভাবে সাউথ এশিয়ান অভিবাসীদের মধ্যে এই হার শতকরা ২.৪। প্রবাসী বাংলাদেশীরা এই সাউথ এশিয়ান গ্র“পের মধ্যে পড়েন। তবে ন্যাশনাল হাউজহোল্ড সার্ভে থেকে সাউথ এশিয়ানদের মধ্যে বিবাহবিচ্ছেদের যে চিত্রটি আমরা দেখছি তা প্রকৃত তথ্য নয়। কারণ, ঐ সার্ভেতে লোকজন যে তথ্য দিয়েছেন তা ছিল ভলন্টারী বা ঐচ্ছিক। অর্থাৎ বিচ্ছেদের তথ্য দিতেই হবে এমন কোন বাধ্যবাধকতা ছিল না তাতে। আর সাউথ এশিয়ানরা যেহেতু তাদের এই তথ্যটি গোপন রাখতে পছন্দ করেন বেশী তাই তাদের মধ্যে প্রকৃত পক্ষে কি পরিমাণ বিবাহবিচ্ছেদ ঘটছে তা জানার কোন সহজ উপায় নেই।
তবে কমিউনিটিতে যারা এই বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করেন বিশেষ করে লইয়ার বা কাউন্সিলর, তাদের কাছ থেকে এ বিষয়ে কিছুটা তথ্য পাওয়া যেতে পারে। যেমন ব্রিটিশ কলম্বিয়ার ম্যাকলিন ল গ্র“পের এসোসিয়েট লইয়ার সুমিত অহুজা বলেন, কানাডায় সার্বিকভাবে বিবাহবিচ্ছেদের ঘটনা কিছুটা হ্রাস পেয়েছে সত্যি। তবে সেটা ঘটছে কমন ল রিলেশনশীপ বা লিভ টুগেদার এর সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে। যারা লিভ টুগেদার করেন তারা আলাদা হয়ে গেলে সেটা বিবাহবিচ্ছেদের তালিকায় আসে না। কিন্তু সাউথ এশিয়ান কমিউনিটির চিত্রটি আলাদা। সেখানে প্রতি চারটি বিয়ের মধ্যে একটি বিয়ে ভেঙ্গে যাচ্ছে। (সূত্র: হাফিংটন পোস্ট)
বিবাহবিচ্ছেদ সাউথ এশিয়ান কমিউনিটিতে এখনো একটি অতি গোপনীয় বিষয় হিসাবে বিবেচিত। সহজে কেউ প্রকাশ করতে চান না। পাড়া-প্রতিবেশী তো দূরের কথা খুব নিকট আত্মীয় না হলে কেউ তা বলেন না। অন্যদিকে দাম্পত্য কলহ বা নির্যাতন কিংবা পরকীয়া যাই হোক না কেন, সেটি যদি বিবাহবিচ্ছেদের দিকে মোড় নেয় তবে অভিভাবকদের কেউ কেউ ক্রমাগত চাপ দিতে থাকেন যাতে কিছুটা অত্যাচার সহ্য করে হলেও সংসার টিকিয়ে রাখা হয়। এই চাপটা প্রধানত মহিলাদের উপরই বেশী আসে।
কিন্তু লক্ষ্য করা গেছে দ্বিতীয় প্রজন্মের অনেক মহিলাই আজ আর সেই সাউথ এশিয়ান ট্রেডিশনের তোয়াক্কা করছেন না। প্রয়োজন হলে অর্থাৎ সংসারে নির্যাতনের শিকার হলে তারা সেখান থেকে বেরিয়ে আসছেন বিবাহবিচ্ছেদের মাধ্যমে। তারা তাদের পূর্বগামীদেরকে অনুসরণ করে নির্যাতন সহ্য করতে নারাজ। হাফিংটন পোস্টকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে ফ্যামিলি কাউন্সিলর কুলদীপ গিল বলেন, বিবাহবিচ্ছেদ এখন সাউথ এশিয়ানদের মধ্যে অধিকতর সাধারণ বিষয়। তবে তা দ্বিতীয় প্রজন্মের মধ্যে। তারা কানাডিয়ান সংস্কৃতিতে বড় হয়ে সম্ভবত ভাবতে শিখেছে যে, সংকট বা দ্বন্দ্ব তৈরী হলে বিবাহবিচ্ছেদের পথ বেছে নেয়াই ভাল যা গোটা পরিবারের জন্যই মঙ্গল বয়ে আনবে।
গিল আরো বলেন, কানাডায় বিবাহবিচ্ছেদ আজ আর টাবু বা নিষিদ্ধ কোন বিষয় নয় সাউথ এশিয়ার দ্বিতীয় প্রজন্মের দম্পতিদের মধ্যে। কারণ, ফ্যামিলি ডাইনামিকস বা পারিবারিক মূল্যবোধ পরিবর্তন হচ্ছে এই প্রবাসে এসে। পরিবারে স্বামী-স্ত্রী উভয়েই এখন আয় করছেন, সংসারের কাজ কর্ম এবং দায় দায়িত্ব ভাগ করে নিচ্ছেন। তারা এখন আর একে অন্যের উপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল নন যেমনটা তাদের পিতা-মাতারা।
অবশ্য এই বিবাহবিচ্ছেদ প্রথম প্রজন্মের অভিবাসীদের মধ্যেও ঘটছে। দুই বা তিন দশক ধরে একত্রে সংসার করার পরও দেখা গেছে কারো কারো ঘর ভাঙ্গছে।
আমেরিকার ভার্জিনিয়ার অধিবাসী একজন থেরাপিস্ট সালমা আবুগিধারী বলেন, দাম্পত্য জীবনে নানান সংকট ও নির্যাতনের ঘটনা ঘটলেও ঐতিহ্যগতভাবে অভিবাসীগণ বিবাহবিচ্ছেদের দিকে সাধারণত অগ্রসর হন না। শোচনীয় অবস্থার মধ্যেও ঘর টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করেন তারা। আমার কাছে মনে হয় অভিবাসীরা স্বাস্থ্যকর পরিবারের চেয়ে অটুট পরিবারের উপর গুরুত্ব দেন বেশী। আমি মনে করিনা এটি একটি ভাল সিদ্ধান্ত। (সূত্র: সাউন্ডভিশন.কম)
২০১০ সালে প্রকাশিত এক গবেষণা তথ্যে দেখা যায় উত্তর আমেরিকায় মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে বিবাহবিচ্ছেদের হার বৃদ্ধি পেয়ে দাড়িয়েছে শতকরা ৩১.১৪ ভাগে। ঐ সময়ে বিভিন্ন মুসলিম দেশের মধ্যে সর্বোচ্চ বিবাহবিচ্ছেদের যে হার ছিল তার চেয়েও এটি ছিল প্রায় তিন গুণ বেশি। মিশর এবং তুরস্কে এই হার ছিল ১০%। সাউন্ড ভিশন এর পক্ষে গবেষণাটি পরিচালনা করেন নিউ ইয়র্ক ভিত্তিক সমাজবিজ্ঞানী ইলিয়াস বাই ইউনুস। গত দুই দশকে উত্তর আমেরিকায় এই পরিস্থিতির কোন উন্নতি হয়নি। এখানকার আইনজীবী, কাউন্সিলর এবং ইমামগণ অব্যাহতভাবেই বিষয়টি নিয়ে তাদের উদ্বেগের কথা জানিয়ে আসছেন। (সূত্র: iqra.ca)
উল্ল্লেখ্য যে, কানাডায় সার্বিকভাবে বিবাহবিচ্ছেদের হার প্রতি দশজনে চার জন। স্ট্যাটিসটিকস্ কানাডার ভবিষ্যতবাণী হলো ২০০৪ সালে সংঘটিত বিয়ের শতকরা ৩৮ টি ভেঙ্গে যাবে ২০৩৫ সালের মধ্যে। কিন্তু তারপরও বিবাহবিচ্ছেদের এই হার আগের তুলনায় কিছুটা কম। হিসাবে দেখা যায় আশির দশকের মাঝামাঝি কানাডায় বিবাহবিচ্ছেদের হার ছিল শতকরা ৪১। অবশ্য নব্বুইর দশকের মাঝামাঝি এই হার ছিল শতকরা ৩৭ ভাগ।
স্ট্যাটিসটিকস্ কানাডার সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী অবশ্য দেখা যায় যে, কানাডায় সার্বিকভাবে বিবাহবিচ্ছেদের ঘটনা কিছুটা কমে এসেছে। ‘ডিভোর্স কেস ইন সিভিল কোর্ট, ২০১০/১১’ শিরোনামে এক প্রতিবেদনে মেরী বেস ক্যালী জানান, ২০১০/১১ সালে সিভিল কোর্টে ৫৩,৮০৪ টি নতুন বিবাহবিচ্ছেদের মামলা দায়ের করা হয়। আগের বছরের তুলনায় এই হার ২% কম। তবে এই হিসাব সমগ্র কানাডার নয়। নভাস্কোশিয়া, অন্টারিও, আলবার্টা, ব্রিটিশ কলম্বিয়া, ইয়াকুন, নর্থওয়েস্ট টেরিটরিস এ্যান্ড নূনাভাট এর হিসাব এটি যেখানে কানাডার মোট জনসংখ্যার প্রায় ৬৬% লোক বাস করেন।
অন্যদিকে বিয়ের হারও হ্রাস পাচ্ছে কানাডায়। ক্যালীর তথ্য থেকে জানা যায় ২০০৮ সালে মোট বিয়ের সংখ্যা ছিল ১৪৭,২৮৮টি। আর ২০০৬ সালে এই সংখ্যা ছিল ১৫০,৫০৫টি। ক্যালি তার প্রতিবেদনে আরো জানান, কানাডায় ফ্যামিলি স্ট্রকচার বা পারিবারিক কাঠমোতে পরিবর্তন ঘটছে। দেখা গেছে গত দুই দশকে বিবাহিত দম্পতির সংখ্যা ক্রমশ হ্রাস পেয়েছে। অন্যদিকে কমন ল ইউনিয়ন বা অবিবাহিত দম্পতির (লিভ টুগেদার) সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। গত শতকের ষাটের দশকের মধ্যভাগ থেকে লোন (একক) প্যারেন্ট ফ্যামিলির সংখ্যাও বৃদ্ধি পাচ্ছে। অর্থাৎ পরিবারে শুধু মা অথবা বাবার অস্তিত্ব রয়েছে। তবে বিবাহিত দম্পতির সংখ্যা হ্রাস পেলেও এখনো তা কমন ল দম্পতির চেয়েও সংখ্যায় বেশী।
কানাডায় বিবাহিত দম্পতির সংখ্যা হ্রাস পাওয়ার পিছনে এই লিভ টুগেদার এর ভূমিকা রয়েছে। ডিভোর্স এক্সপার্ট ডেভরা মস্কোভিচ বলেন, ব্যাপারটি এমন নয় যে, লোকজন দাম্পত্য জীবন পছন্দ করছেন না। তারা দাম্পত্য জীবন অবশ্যই পছন্দ করেন, শুধু বিষয়টিকে অফিসিয়াল করতে চান না। অর্থাৎ কাগজে কলমে কোন স্বীকৃতি দিতে চান না। মস্কোভিচ অবশ্য আরেকটি তথ্য জানান যা সত্যিই বিস্ময়কর এবং অদ্ভুত। তিনি বলেন, কানাডায় এমন অনেক লোক আছেন যারা দাম্পত্য জীবনে সুখী হলেও বিবাহবিচ্ছেদের বিষয়টি মনের মধ্যে লালন করেন। (তথ্য সূত্র : রেবেকা জামান, হাফিংটন পোস্ট)
কানাডায় সাউথ এশিয়ান, বিশেষ করে মুসলিম কমিউনিটির চিত্রটি অবশ্য ভিন্ন। সাউন্ড ভিশন নামের জরীপ সংস্থা ২০০৯ থেকে ২০১০ সালের মধ্যে একটি জরীপ পরিচালনা করেছিল উত্তর আমেরিকার মুসলিম কমিউনিটিতে বিবাহবিচ্ছেদের পরিস্থিতি নিয়ে। রয়ৎধ.পধ এ প্রকাশিত ঞধযধ এযধুুঁৎ এর এক প্রতিবেদনে দেখা যায় ঐ জরীপে বেশীরভাগ অংশগ্রহনকারী ছিলেন কানাডা ও আমেরিকায় বসবাসকারী বাংলাদেশী, ভারতীয় ও পাকিস্তানী মুসলিমগণ। অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে কিছু সংখ্যক ছিলেন মধ্যপ্রাচীয়, আফ্রিকান ও শ্বেতাঙ্গ মুসলিম। জরীপে যারা অংশ নেন তাদের বেশীরভাগেরই বয়স ছিল ২৬ থেকে ৪০ বছরের মধ্যে।
জরীপের ফলাফলে দেখা গেছে, অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে এক তৃতীয়াংশের বিয়ে টিকে ছিল দুই থেকে পাঁচ বছর। একচতুর্থাংশের বিয়ে টিকে ছিল এক বছরেরও কম সময়। ২০% এর বিয়ে টিকে ছিল ছয় থেকে দশ বছর। ১৬% এর বিয়ে টিকে ছিল এগার থেকে বিশ বছর পর্যন্ত।
অর্থাৎ বেশীর ভাগ বিবাহবিচ্ছেদ ঘটেছিল বিয়ের প্রথম পাঁচ বছরের মধ্যে। জরীপে যারা অংশ নেন তাদের মধ্যে ৩১.৬৩% ছিলেন বিবাহিত। ৫৬.৫৫% ছিলেন ডিভোর্সড এবং ১১.৮২% ছিলেন সেপারেটেড।
উত্তর আমেরিকায় বিবাহবিচ্ছেদের ক্ষেত্রে ইমোশনাল এবিউজ সবচেয়ে বেশী ভূমিকা রাখে এমন তথ্যই জানায় সাউন্ড ভিশন। তাদের জরীপে যারা অংশ নেন তাদের মধ্যে শতকরা ৩২.৩২ ভাগ নারী-পুরুষ জানান বিভিন্ন ধরণের নির্যাতনের মধ্যে তারা ইমোশনাল এবিউজ বা মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন বেশী।
কৌতূহলোদ্দীপক বিষয় হলো, এই ইমোশনাল এবিউজের শিকার পুরুষরাই বেশী হচ্ছেন বলে জরীপে উঠে এসেছে। শতকরা ৩৭.৭০ ভাগ পুরুষ জানিয়েছেন তারা ইমোশনাল এবিউজের শিকার হয়েছেন। অন্যদিকে শতকরা ৩১.২৬ ভাগ নারী জানিয়েছেন যে তারা ইমোশনাল এবিউজের শিকার হয়েছেন। ভারবাল বা মৌখিক নির্যাতনের বেলায়ও দেখা গেছে পুরুষরাই বেশী শিকার হচ্ছেন। জরীপ রিপোর্টে দেখা যায় শতকরা ২৪.৫৯ ভাগ পুুরুষ দাবী করেন যে তারা কোননা কোনভাবে মৌখিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। আর নারীদের মধ্যে শতকরা ২১.৪৯ জন দাবী করেছেন তারা মৌখিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।
সাউন্ড ভিশন এর জরীপে আরো দেখা গেছে, বিবাহ বিচ্ছেদের পর কয়েক বছরের মধ্যেই শতকরা ৪৭.০৬ জন পুরুষ পুনরায় বিয়ে করেছেন এবং মহিলাদের মধ্যে এই হার শতকরা ২৬.৭৮ ভাগ। অর্থাৎ মহিলারা পুনরায় বিয়ের ক্ষেত্রে পুরুষদের তুলনায় প্রায় অর্ধেক পিছিয়ে আছেন। এর একটা কারণ হতে পারে, সাউথ এশিয়ান কমিউনিটিতে বিবাহবিচ্ছেদের পর সাধারণভাবে মহিলাদেরকে একধরণের অঘোষিত সমাজবিচ্ছিন্ন অবস্থায় দিনযাপন করতে হয়। পুনরায় তারা বিয়ে করবেন এটা অনেক ক্ষেত্রেই সমাজের লোকজন সহজভাবে নেন না। আর পুরুষরাও সাধারণত পাত্রী হিসাবে ডিভোর্সড মহিলাদের গ্রহণ করতে অনীহা প্রকাশ করেন। এমনকি ডিভোর্সড্ পুরুষরাও! আর যদি ডিভোর্সড্ মহিলার সন্তান থেকে থাকে তবে সেটা পুুরুষদের জন্য হয়ে দাড়ায় পর্বতসম বাধা। এমনকি ঐ পুরুষটির পরিবারে যে মহিলারা আছেন তারাও সাধারণত এরকম পরিস্থিতে পুরুষের পক্ষ নেন! যুগ যুগ ধরে পুরুষ শাসিত সমাজে এমনটিই হয়ে আসছে। পাশ্চ্যত্যের আধুনিক সমাজব্যবস্থাও এর থেকে সম্পূর্ণভাবে মুক্ত নয়।
কিন্তু লক্ষ্যনীয় বিষয় হলো, ইদানিংকালে মহিলারাই বিবাহবিচ্ছেদের উদ্যোগ ও প্রক্রিয়া শুরু করার ক্ষেত্রে পুরুষের তুলনায় বহুদুর এগিয়ে আছেন। সাউন্ড ভিশন তাদের জরীপে দেখতে পায়, আমেরিকা ও কানাডায় মুসলিম কমিউনিটিতে (যেখানে বাংলাদেশীরাও রয়েছেন) বিবাহবিচ্ছেদের যে সকল ঘটনা ঘটছে তার প্রায় দুই তৃতীয়াংশ ক্ষেত্রেই প্রথম উদ্যোগ ও প্রক্রিয়াটি শুরু করেন মহিলাগণ। পুরুষ উদ্যোক্তাদের মধ্যে এই হার এক তৃতীয়াংশ।
এর মূল কারণগুলো কি? পুনরায় বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হতে গেলে নানানরকম সমস্যা হতে পারে জেনেও মহিলাগণ কেন এরকম সিদ্ধান্ত নেওয়ার
ক্ষেত্রে এগিয়ে আছেন?
এর কারণ রয়েছে অবশ্যই। আর কারণ মাত্র একটি নয়, বহুবিধ কারণই রয়েছে এর পিছনে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কারণগুলো হলো – পারিবারিক সহিংসতা, সাংস্কৃতিক বিরোধ, পরকীয়া, বউ-শাশুরী বিরোধ, অসম বিয়ে, আর্থিক বিরোধ, আর্থিক স্বাধীনতা, হু কেয়ার্স সংস্কৃতি, ওয়ার্কএহোলিক প্রবণতা, প্রফেশনাল ক্যারিয়ারকে বেশী গুরুত্ব দেয়া সহ আরো কিছু কারণ।
বউ-শাশুরী বিরোধ ছাড়া উপরে উল্লেখিত এই বিষয়গুলো কেবল পুরুষের পক্ষ থেকেই যে করা হয় তা নয়। অনেক মহিলা আছেন যারা এগুলোর পিছনে ভূমিকা রাখেন। আর বউ-শাশুরী বিরোধ এড়ানো বা মিটানোর ক্ষেত্রে পুরুষদের কোন বলিষ্ঠ ভূমিকা থাকে না। এ ক্ষেত্রে পুরুষদের অবস্থানটা হয় ‘শ্যাম রাখি না কুল রাখি’র মত।
ভারত উপমহাদেশের বিভিন্ন দেশে এই বউ-শাশুরীর বিরোধ যুগ যুগ ধরেই চলে আসছে এবং পরিবারে বিশেষত যৌথ পরিবারে অশান্তি সৃষ্টির পিছনে এই বিরোধ একটি বড় রকমের ভূমিকা পালন করে। সুদূর এই কানাডা ও আমেরিকার মাটিতে এসেও সেই সংস্কৃতিকে পিছনে ফেলে আসতে পারেননি অনেকেই। এমনকি ‘শাশুরী দেশে এবং বউ বিদেশে’ এমন পরিস্থিতিতেও দ্বন্দ্ব লেগেই থাকে অনেক পরিবারে। এই দ্বন্দ্বের প্রভাব বিদেশে অবস্থানরত স্বামী-স্ত্রীর মধ্যেও পড়ে। এতে করে পরিবারে অশান্তি সৃষ্টির পাশাপাশি জটিলতাও ক্রমশ বৃদ্ধি পায়। আর কখনো কখনো তা বিবাহবিচ্ছেদের কারণও হয়ে দাড়ায়।
উল্লেখ্য যে, কানাডায় বিবাহিত মহিলাদের মধ্যে আর্থিক সহযোগিতার জন্য স্বামীনির্ভরতার অপরিহার্যতা কম। কারণ, দ্বিতীয় প্রজন্মের প্রায় সব মহিলাই এখানে চাকরী করেন। এতে করে তাদের মধ্যে পরনির্ভরতার প্রয়োজনীয়তা কমে আসে এবং একই সাথে কারো অন্যায় অত্যাচার সহ্য না করার মত ক্ষমতাও জন্ম নেয়। অর্থাৎ অর্থনৈতিক স্বাধীনতা তাদের মধ্যে শক্তি ও সাহস যোগায় অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাড়ানোর জন্য। তাছাড়া নির্যাতিত মহিলাদের জন্য এদেশে রয়েছে সরকারের বিভিন্ন সাপোর্ট সিস্টেম। ফলে প্রবাসে কোন বিবাহিতা মহিলা শাশুরী কর্তৃক অপমানিত, নাজেহাল বা নির্যাতনের শিকার হলে যৌক্তিক কারণেই তিনি প্রতিবাদী হয়ে উঠতে পারেন। আর এই নির্যাতন অব্যাহত থাকলে এক পর্যায়ে তা বিবাহবিচ্ছেদের কারণ হয়ে দাড়াতে পারে চূড়ান্ত পরিনতি হিসাবে।
সাউন্ড ভিশনের জরীপে দেখা গেছে কানাডা ও আমেরিকায় সাউথ এশিয়ান বংশোদ্ভূত দ্বিতীয় প্রজন্মের স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে অমিল বা বৈসাদৃশ্যের কারণে ঘর ভাঙ্গার হার শতকরা ১৬.৩৮। আর সর্বোচ্চ সংখ্যক ঘর ভাঙ্গছে এই কারণেই।
স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে অমিল থাকাটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। বা কোন কোন বিষয়ে বৈসাদৃশ্যও থাকে পারে। এমনকি একজন আরেকজনের তুল্য নাও হতে পারে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে এই বিষয়গুলো বিয়ের আগে যাচাই করে দেখা হয়না সব ক্ষেত্রে বা যাচাই করার সুযোগও হয়তো তেমন থাকে না এই প্রবাসে। ফলে সমস্যা শুরু হয় যখন এ বিষয়গুলো বিয়ের পর আস্তে আস্তে প্রকাশ পেতে থাকে।
অমিলের কথাটাই ধরা যাক। বিয়েটা যদি ঘটকের মাধ্যমে হয়ে থাকে বা দুই পক্ষের অভিভাবকগণ পূর্ব পরিচিত সেই সূত্র ধরে হয়ে থাকে তবে বর কনে সম্পর্কে এবং কনে বর সম্পর্কে আগে থেকে তেমন কিছু জানতে পারেন না। অথবা বিয়ের পূর্বে যে সকল তথ্য আদান প্রদান করা হয় তার সবকটি সত্য না ও হতে পারে। বিয়ের পূর্বে কোন কোন বিষয়ে সঠিক তথ্য লুকানোর একটি প্রবণতা প্রায়শ লক্ষ্য করা যায় দুই পরিবার বা হবু বর কনের মধ্যে। পরবর্তীতে এই লুকানো তথ্যই যে কাল হয়ে দাড়াতে পারে তা অনেকেই বুঝতে পারেন না।
উদাহরণ হিসাবে হবু স্বামীর স্বভাবের কথা বলা যেতে পারে। হবু স্বামী কথায় কথা রেগে যান, মেজাজ তার খিট খিটে, হাত উঠানোর অভ্যাসও আছে তার। আরো আছে নেশা করার বদভ্যাস, তিনি হয়তো ঋণে জর্জরিত। এরকম আরো কিছু তথ্য হয়তো বিয়ের আগে লুকানো হয়েছিল। অপরদিকে হবু স্ত্রী হয়তো স্বভাবে খুবই নমনিয়, মৃদুভাষী এবং সামাজিক। এখন এই দুইজনের মধ্যে যদি বিয়ে হয় তবে সংঘাত যে অনিবার্য তা আর বলার অপেক্ষা রাখেনা। আবার এর উল্টোটিও হতে পারে। অর্থাৎ হবু স্বামী বিনয়ী, মৃদুভাষী এবং আরো যা যা গুণ থাকা প্রয়োজন তার প্রায় সবই আছে তার মধ্যে। কিন্তু হবু স্ত্রী বদমেজাজী। কোন কথায় কার মর্যাদাহানি হয় সেই জ্ঞানটুকু তার নেই, আশপাশের মানুষকে অবজ্ঞা করা, উপেক্ষা করা তার নিত্যসময়ের অভ্যাস। এরকম ক্ষেত্রে উভয়ের মধ্যে বিয়ে হলে পরিবারে সংকট কাল শুরু হতে বেশীদিন লাগার কথা নয়।
বিয়ে যদি প্রেমের মাধ্যমে হয় তবে সেক্ষেত্রে আগে থেকেই অনেক কিছু জেনে নেয়ার সুযোগ থাকে। অর্থাৎ একজন আরেকজনের স্বভাব ও ভাল লাগা মন্দ লাগার বিষয়গুলো জেনে নিতে পারেন বিয়ের পূর্বেই। যদি মিল থাকে তবে তারা সামনে এগুবেন। আর মিল না থাকলে পিছু হটবেন।
মিল অমিলের বিষয়ে আরো কিছু বিষয় এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যেগুলো প্রবাসে দ্বিতীয় প্রজন্মের স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিবাহবিচ্ছেদে ইন্ধন যোগাচ্ছে। এর মধ্যে আছে সাংস্কৃতিক অমিল, বয়সের অমিল, চিন্তাভাবনায় অমিল, ধর্ম বিশ্বাসের উপর প্রভাব বিস্তারের প্রচেষ্টা, পোষাকের বিষয়ে আপত্তি তোলা, শিক্ষাগত যোগ্যতায় স্বামীর তুলনায় স্ত্রীর এগিয়ে থাকা, তথাকথিত বংশ বা পারিবারিক মর্যাদায় ‘বৈষম্য’ থাকা, ধনী-গরীবের অশোভনীয় অহংকার প্রদর্শনসহ আরো কিছু বিষয়।
সাংস্কৃতিক অমিলের বিষয়টি ঘটে যখন পাত্র বা পাত্রী যে কোন একজনকে দেশ থেকে নিয়ে আসা হয়। দেশে ছেলে-মেয়েরা বড় হয় এক সাংস্কৃতিক পরিবেশে আর প্রবাসে ছেলে-মেয়েরা বড় হয় ভিন্ন এক সাংস্কৃতিক পরিবেশে। দেশের সংস্কৃতি কতকটা রক্ষণশীল, প্রবাসের সংস্কৃতি উদার। প্রবাসের এই বহুজাতিক সংস্কৃতিতে ছেলে-মেয়েরা বড় হয়ে ভিন্ন এক মনমানসিকতায় গড়ে উঠে, তাদের দৃষ্টিভঙ্গি হয় ভিন্ন যার সঙ্গে দেশে থেকে আসা ছেলে-মেয়েদের অমিল থাকে। সমস্যা দেখা দেয় ভাষার কারণেও। বাংলাদেশে থেকে আসা ছেলে-মেয়েদের ইংরেজীর উপর যে দখল থাকে (যদি ইংরেজী মিডিয়ামে পড়াশুনা করে না থাকে) তা দিয়ে এখানকার ছেলে-মেয়েদের সঙ্গে ভাব বিনিময় ষোলআনা হয়ে উঠে না। আর এখানকার শতকরা প্রায় ৯০/৯৫ ভাগ ছেলে-মেয়ে বাংলায় কিছুটা কথা বলতে পারলেও ঐ ভাষার উপর তাদের দখল তেমনটা থাকে না যা দিয়ে তারা সারাক্ষণ স্বামী বা স্ত্রীর সঙ্গে ভাব বিনিময় করতে পারেন। এই সাংস্কৃতিক অমিল ও ভাষাগত সমস্যা কখনো কখনো উভয়ের মধ্যে ভুল বুঝাবুঝির সৃষ্টি করতে পারে যা বিবাহবিচ্ছেদে ইন্ধন যোগাতে
পারে। বয়সের অমিলও একটা কারণ হয়ে দাড়াতে পারে বিবাহবিচ্ছেদের ক্ষেত্রে। প্রবাসে উপযুক্ত পাত্র বা পাত্রী না পেয়ে অনেক সময় অভিভাবগণ বয়সের ব্যবধান বিষয়ে আপোস করেন। কখনো কখনো বয়সের এই ব্যবধানটি একটু বেশী হয়ে গেলেই সমস্যা দেখা দিতে পারে এবং দেয়ও। চিন্তা-ভাবনা থেকে শুরু করে পছন্দ-অপছন্দ ইত্যাদি অনেক বিষয়েই অমিল দেখা দিতে পারে যখন বয়সের পার্থক্যটি বেশী হয়ে যায়। এবং এই অমিল অন্যান্য অমিলের সঙ্গে মিশে দাম্পত্য জটিলতাকে কেবল বৃদ্ধিই করে যা ক্রমান্বয়ে বিবাহবিচ্ছেদের দিকে এগিয়ে নিয়ে যায় স্বামী-স্ত্রীকে।
এর পর আছে ধর্মীয় বিষয়ের উপর প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা। পরিবারে স্বামী বা স্ত্রীর মধ্যে কোন একজন হঠাৎ ধর্মকর্মে বেশীমাত্রায় মনোযোগী হয়ে উঠলে পরিস্থিতি জটিল আকার ধারণ করতে পারে। স্বামী যদি ধর্মকর্মে বেশী মনোযোগী হয়ে উঠেন তখন তিনি তার স্ত্রীর উপর তা চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেন। ধর্মবিশ্বাসে মুসলিম হলে তিনি হয়তো স্ত্রীকে পর্দনশীন হওয়ার জন্য চাপ দিতে পারেন। হিজাব পরার জন্য বা বোরখা পরার জন্য চাপ দিতে পারেন। স্ত্রী যদি খুব ধার্মিক না হন তিনি হয়তো এগুলো মেনে নিবেন না। অন্যদিকে স্ত্রীও যদি হঠাৎ খুব ধার্মিক হয়ে উঠেন তবে তিনিও হয়তো স্বামীর উপর নানান রকম চাপ সৃষ্টি করতে পারেন ধর্মকর্মে অধিক মনোযোগী হওয়ার জন্য। টুপি দাড়ি বা ইসলামী পোষাক পরার বিষয়ে হয়তো চাপ সৃষ্টি করতে পারেন। স্বামী যদি খুব ধার্মিক না হন তবে তিনি স্ত্রীর এই চাপ অগ্রাহ্য করবেন কিংবা একটা ঝগড়ার মত পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে যা ক্রমান্বয়ে তাদের মধ্যে একটি দূরত্ব সৃষ্টি করবে। আর এই দূরত্ব হয়তো একসময় বিবাহবিচ্ছেদের দিকে টেনে নিয়ে যেতে পারে স্বামী-স্ত্রীকে।
প্রবাসে পাত্র বা পাত্রী সংকটের কারণে অনেক সময় কম শিক্ষাগত যোগ্যতার পাত্রের সঙ্গে কনের বিয়ে দেওয়া হয়। এতে করে হয়তো তাৎক্ষনিক সমস্যার সমাধান হয়। কিন্তু পরবর্তীতে যে সমস্যাটা দেখা দেয় তা হলো পার্সোনালিটি কনফ্লিক্ট। স্ত্রী যদি প্রায়ই বিভিন্ন ইস্যুতে স্বামীর শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেন তখন স্বামী হয়তো একপর্যায়ে ক্ষোভে অপমানে ফেটে পড়তে পারেন যা পরিবারে অশান্তি ডেকে আনতে পারে এবং বিবাহবিচ্ছেদের পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারে।
আবার আয়ের বৈষম্য থাকলেও স্বামী-স্ত্রীতে পার্সোনালিটি কনফ্লিক্ট দেখা দিতে পারে। এরকমটা ঘটে সাধারণত দেশ থেকে কোন পাত্রকে নিয়ে আসা হলে। দেশ থেকে আসা পাত্রের শিক্ষাগত যোগ্যতা বা চাকরীর অভিজ্ঞতা কানাডায় অবমূল্যায়ন করা হয়। ইংরেজীতে তাদের দক্ষতাও কম থাকে। ফলে আয়ের ক্ষেত্রে তারা তাদের স্ত্রীদের চেয়ে অনেক পিছিয়ে থাকেন। এমন পরিস্থিতিতে পরিবারে স্ত্রীর প্রাধান্য থাকে প্রায় সবকিছুতেই। আর অর্থ যেহেতু সবকিছুর নিয়ন্ত্রক, সেহেতু পরিবারে স্ত্রী আধিপত্য হয়ে উঠে স্বামীর তুলনায় বেশী। বাংলাদেশ থেকে আসা একজন বাঙ্গালী সংস্কৃতির যুবক এই আধিপত্যকে সবসময় সহজভাবে নিতে পারেন না। আর স্ত্রীর আচরণ যদি একটু বাড়াবাড়ি রকমের প্রভুত্বসুলভ হয়ে থাকে তবে তা পরিস্থিতিকে আরো বেশী জটিল করে তুলে। এরকম অবস্থা অব্যাহত থাকলে সংসারে ভাঙ্গণ ধরাটা অস্বাভাবিক কিছু নয়।
সংসার ভাঙ্গার আরেকটি কারণ হলো, ইমিগ্রেশন লোভীদের প্রতারণা। বাংলাদেশে কিছু লোক আছেন যারা ইমিগ্রেশনের লোভে কানাডা প্রবাসীদের সঙ্গে বিয়ের প্রস্তাবে রাজী হন। এই সকল ক্ষেত্রে নিয়ম অনুযায়ী সবই হয়। এর পর স্পন্সর করা হলে তারা যথারীতি কানাডায় আসেন নতুন সংসার জীবন শুরু করার জন্য। কিন্তু কানাডায় আসার পর কিছু দিন যেতে না যেতেই তাদের আসল উদ্দেশ্য প্রকাশ পেয়ে যায়। শুরু হয় নানারকম টালবাহানা। এবং এক পর্যায়ে ছাড়াছাড়ি।
প্রবাসে বিবাহবিচ্ছেদের আরেকটি বড় কারণ হলো পারিবারিক সহিংসতা বা নির্যাতন। সাউন্ড ভিশনের জরীপে দেখা গেছে শতকরা ১৩.১২ ভাগ সংসার ভাঙ্গছে বিভিন্ন রকমের নির্যাতনের কারণে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে মানসিক নির্যাতন, মৌখিক নির্যাতন, আর্থিক নির্যাতন, শারীরিক নির্যাতন, ধর্মীয় নির্যাতন এবং যৌন নির্যাতন।
ভেঙ্গে যাওয়া সংসারে মানসিক নির্যাতনই (৩২.৩২%) সবচেয়ে বেশী হতো বলে সাউন্ড ভিশনের জরীপে অংশগ্রহনকারীরা জানিয়েছেন। মানসিক নির্যাতন নানান ভাবেই হতে পারে। পরিবারে কাউকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে কিছু করতে বাধ্য করা যেমন মানসিক নির্যাতনের মধ্যে পড়ে, আবার কারো ইচ্ছা পূরণে বাধা দেওয়াটাও মানসিক নির্যাতনের মধ্যেই পড়ে। অযৌক্তিকভাবে কারো সমালোচনা করা, চেঁচিয়ে কথা বলা, ভয় দেখানো, অপমান করা, অপমানজনক রসিকতা করা, কারো শারীরিক বা মানসিক ক্ষমতা নিয়ে কটাক্ষ করা, চেহারা বা শরীরের গঠন-ওজন-রং ইত্যাদি নিয়ে খেপানো বা বাজে মন্তব্য করা, প্রেম-মনোযোগ এবং স্পর্শ ইত্যাদি এড়িয়ে চলা, অবজ্ঞা করা, অসুস্থ অবস্থায় সেবা না করা অথবা ডাক্তার/হাসপাতালে নিয়ে না যাওয়া, বাইরের লোক বা পরিবারের অন্য সদস্য বা বাচ্চাদের সামনে হেয় করা, টেলিফোন ধরতে না দেওয়া এসবই মানসিক নির্যতনের মধ্যে পড়ে।
এরপর আছে মৌখিক নির্যাতন (২১.৮০%)। গালাগাল থেকে শুরু করে অপমানজনক কথা এসবই মৌখিক নির্যাতনের মধ্যে পড়ে। নির্যাতনকারী জেনেশুনেই এমনসব কথা বলেন যা তার স্ত্রী বা স্বামীকে আহত বা অপমানিত করতে পারে। বিবাহবিচ্ছেদের
পিছনে এই মৌখিক নির্যাতনও ভূমিকা রাখে।
ঘর ভাঙ্গার পিছনে আর্থিক নির্যাতনও দায়ী। আর্থিক নির্যাতনের (১৪.৭৯%) শিকার হন সাধারণত যে সকল মহিলার নিজের কোন আয় নেই তারা। তাদের এই অবস্থার সুযোগ নিয়ে অনেক স্বামী তাদেরকে পরিত্যাগ করার হুমকী দেন, এমনসব শর্ত আরোপ করেন যা তারা পালন করতে বাধ্য হন এবং তাদের প্রতিদিনকার প্রয়োজনীয় জিনিষপত্র কিনে দেন না। অনেক পরিবারে স্বামী তার স্ত্রীকে চাকরী করতে দেন না। বা চাকরী করতে দিলেও কোন ব্যাংক একাউন্ট খুলতে দেন না। অর্থকড়ি সব স্বামীর তত্বাবধায়নেই রাখা হয়। নিজের আয়ের অর্থ কোন কাজে ব্যয় করতে হলে স্বামীর অনুমতি প্রার্থণা করতে হয়। আবার এর উল্টো চিত্রও আছে। পরিবারে স্বামী স্ত্রী দুজনেই চাকরী করেন। স্ত্রী তার আয়কে নিজের আয় মনে করেন এবং স্বামীর আয়কে দুজনের আয় মনে করেন। অর্থাৎ নিজের আয় জমিয়ে রাখেন নিজের প্রয়োজনে। সংসারের কোন কিছুতে কোন কন্ট্রিবিউশন করেন না।
বিবাহবিচ্ছেদের আরেক কারণ শারীরিক নির্যাতন। শারীরিক নির্যাতনের কারণে ঘর ভাঙ্গছে (১৩.৮৭%) প্রবাসে অনেকেরই। এই নির্যাতনের মধ্যে আছে কিল-ঘুষি মারা, চর মারা, কামড়ে দেয়া, গলা চেপে ধরা, চুল ধরে টানা, ধাক্কা মারা, ছুড়ি বা লাঠি দিয়ে আঘাত করা, কিচেনের যন্ত্রপাতি দিয়ে আঘাত করা, গায়ের উপর থুথু নিক্ষেপ ইত্যাদি।
ধর্মীয় নির্যাতন বলেও একটি বিষয় আছে যার কারনে প্রবাসে সংসার ভাঙ্গে (৮.৯৯%)। কাউকে জোর করে ধর্ম পালনে বাধ্য করা, ধর্মীয় পোষাক পরতে বাধ্য করা, কথা মত ধর্ম পালন না করলে ঘর থেকে বের করে দেওয়ার হুমকী বা তালাক দেওয়ার হুমকী এগুলো ধর্মীয় নির্যাতনের মধ্যেই পড়ে।
যৌন নির্যাতন সংসার ভাঙ্গার একটি কারণ হতে পারে এবং সংসার ভাঙ্গছেও (৫.৭৯%) এই কারণে। এখানে অবশ্য প্রশ্ন উঠতে পারে এই বলে যে, স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের মধ্যে যৌন নির্যাতনের সুযোগ কোথায়? এ প্রশ্নের উত্তরে বলা যায়, সম্পর্ক বৈধ বা স্বীকৃত হলেও নির্যাতন হতে পারে। মোট কথা, বল প্রয়োগ করাটাই নির্যাতন। সেটি যৌনতার বেলায়ও সত্যি। সম্পর্ক বৈধ না অবৈধ সে প্রশ্ন পরে আসে।
যৌন নির্যাতনের মধ্যে আছে স্ত্রীর ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাকে বলপ্রয়োগের মাধ্যমে সয্যাসঙ্গীনি করা, অসুস্থ অবস্থায় স্ত্রীকে সয্যাসঙ্গীনি করা, পর্নগ্রাফী দেখতে বাধ্য করা, এ্যানাল বা ওরাল সেক্সে বাধ্য করা, সয্যাসঙ্গীনি না হলে তালাক দেওয়ার হুমকী বা অন্য যে কোন হুমকী, ধর্মের দোহাই দেয়া-যেমন ধর্মে বলা আছে তোমার শরীর তোমার নয়, সুতরাং না বলা যাবে না ইত্যাদি।
প্রবাসে দ্বিতীয় প্রজন্মে পরকীয়া আরেকটি অন্যতম ইস্যু ঘর ভাঙ্গার পিছনে। এখানে বিয়ের পরও দেখা যায় কেউ কেউ তাদের পূর্ববর্তী রোমান্টিক সম্পর্ক (যাদের থাকে) টিকিয়ে রাখেন বা রাখার চেষ্টা করেন। আবার পূর্ববর্তী সম্পর্ক না থাকলেও বিয়ের পর নতুন সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন। এটি স্বামী বা স্ত্রী উভয়ের ক্ষেত্রেই হয়। মূলত যে সকল কারণগুলো পরকীয়া সম্পর্কের পিছনে কাজ করে তার মধ্যে আছে অল্প বয়সে বিয়ে করা, ভুল কারণে বিয়ে করা, পরিস্থিতি পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ না খাওয়াতে পারা, সন্তানের বাবা হওয়া, শারীরিক চাহিদা পূরণ না হওয়া, ইমোশনাল বা আবেগ বিচ্ছিন্ন হওয়া, মূল মূল্যবোধের ক্ষেত্রে মতানৈক্য হওয়া, জীবনের অগ্রাধিকারের বিষয়গুলোতে মতানৈক্য হওয়া, উভয়ের কোন কমন ইন্টারেস্টের বিষয় না থাকা, সংসার জীবনে একঘেয়েমী চলে আসা, প্রমোশন বা অন্যান্য সুযোগসুবিধা পাওয়ার জন্য কর্মক্ষেত্রে বসের সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে পরা ইত্যাদি।
প্রবাসে নিজ কমিউনিটিতে পাত্র বা পাত্রী সংকটের কারণে কেউ কেউ অন্য কমিউনিটির দিকে ঝুঁকেন। সে ক্ষেত্রে ধর্ম, বর্ণ বা সংস্কৃতির বিস্তর ফারাক থেকে যায়। কিন্তু তারপরও কানাডা ও আমেরিকায় দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে এই জাতীয় অসবর্ণ বিয়ে। এর ছোঁয়া লেগেছে বাংলাদেশীদের মধ্যেও। প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায় প্রথম প্রজন্মে ইমিগ্রেন্ট বা ভিজিবল মাইনরিটিদের মধ্যে যারা এদেশে এসে বিয়ে করেছেন তাদের মধ্যে শতকরা ১২ ভাগ অসবর্ণ দম্পত্তি। তবে দ্বিতীয় প্রজন্মের ইমিগ্রেন্টদের (যাদের বাবা অথবা মা যে কোন একজনের জন্ম কানাডার বাইরে) মধ্যে এই হার অনেক বেশী, প্রায় ৫১ ভাগ। আর তৃতীয় প্রজন্ম (যাদের বাবা-মা উভয়ের জন্ম কানাডায়) ইমিগ্রেন্টদের মধ্যে এর হার ৬৯ ভাগ। এটি একটি সামগ্রিক চিত্র।
তবে অসবর্ণ বিয়ে বৃদ্ধি পেলেও এর সবই যে মসৃণ পথে চলছে তা কিন্তুু নয়। অনেক উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে চলতে হচ্ছে অনেককে। এদের মধ্যে কারো কারো ঘর ভেঙ্গেও যাচ্ছে। প্রধানত সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় বৈসাদৃশ্যের কারণেই এমনটি হচ্ছে।
উত্তর আমেরিকার অভিবাসী পরিবারগুলোতে দ্বিতীয় প্রজন্মের মধ্যে বিবাহবিচ্ছেদের যে বিস্তার বা ব্যাপকতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে তা নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়েছেন অনেক অভিভাবকই। কারণ এর সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত তৃতীয় প্রজন্মও। দেখা গেছে যারা বিবাহবিচ্ছেদ ঘটিয়েছেন বা এর শিকার হয়েছেন তাদের মধ্যে প্রায় দুই তৃতীয়াংশেরই (৬৬.৬৭%) এক বা একাধিক শিশু সন্তান রয়েছে। এই শিশু সন্তানেরা বাবার সঙ্গে থাকবে না মার সঙ্গে থাকবে এ নিয়েও রয়েছে আইনী জটিলতা। এই আইনী জটিলতা বিরাজ করছে ভেঙ্গে যাওয়া পরিবারগুলোর মধ্যে শতকরা প্রায় ২২.১৯ ভাগের। একে তো বিবাহবিচ্ছেদ, তার উপর শিশু সন্তানদের নিয়ে এই আইনী জটিলতা। এ নিয়ে রাতে ঘুম হারাম হয়ে যাচ্ছে অনেকের।
সাউন্ড ভিশনের জরীপে অংশ নেয়া শতকরা প্রায় ৭৫ ভাগ মহিলা বলেছেন বিচ্ছেদের পর তাদের শিশু সন্তানেরা তাদের সঙ্গেই থাকছে। অন্যদিকে শতকরা প্রায় ২৫ ভাগ পুরুষ বলেছেন বিচ্ছেদের পর তাদের শিশু সন্তানেরা তাদের সঙ্গেই থাকছে। জরীপে অংশ নেয়া বাকীরা বলেছেন, তাদের শিশু সন্তানেরা কখনো বাবার সঙ্গে আবর কখনো মার সঙ্গে থাকছে।
বর্তমান ভাঙ্গা সংসারের এই নারী-পুরুষদের মধ্যে আবার একচতুর্থাংশের সন্তান রয়েছে পূর্ববর্তী সংসার থেকে। এভাবে তাদের জীবন ক্রমইে জটিল থেকে জটিলতর হয়ে উঠছে বিবাহবিচ্ছদের মাধ্যমে।
তবে লক্ষণীয় যে, সাউথ এশিয়ান দেশগুলোতে বিবাহবিচ্ছেদকে কঠোরভাবে নিরুৎসাহিত করা হলেও কানাডা বা আমেরিকাতে আসা ঐ একই এলাকার অভিভাবকদের মধ্যে এ বিষয়ে যথেষ্ট শিথিল মনোভাব রয়েছে। দেশে কোন দম্পতি সংঘাতে জড়ালে বাবা-মা সহ অন্যান্য আত্মীয়-স্বজন কাউন্সিলিং এর উদ্যোগ নেন উভয়কে শান্ত করার জন্য। প্রয়োজনে পারিবারিক বৈঠকও বসে। সংঘাত যাতে বিবাহবিচ্ছেদের দিকে মোড় না নেয় সে জন্য প্রয়োজনীয় সব উদ্যোগই তারা গ্রহণ করেন। স্বামীর কিছুটা অত্যাচার বা অশোভন আচরণ মেনে নিয়ে হলেও সংসার টিকিয়ে রাখার
জন্য চাপ দিতে থাকেন তারা। সন্তানদের ভবিষ্যতের কথা স্মরণ করিয়ে দেন বার বার। আরো স্মরণ করিয়ে দেন পরিবারের সম্মানের বিষয়টি। বড় বোনের সংসার ভেঙ্গে গেলে পরবর্তী বোনগুলোর বিয়ে কঠিন হয়ে যাবে এ কথাও স্মরণ করিয়ে দেন অভিভাবকগণ। তাছাড়া খোরপোশ বা ভারণপোষণের বিষয়টিতো রয়েছেই। এর পাশাপাশি আরো স্মরণ করিয়ে দেয়া হয় যে, তালাক প্রাপ্ত বা তালাক প্রদানকারী মহিলাদের দ্বিতীয় বিয়ে করাটা খুবই কঠিন হয়ে দাড়ায় যদি না বিত্তবান পরিবারের মেয়ে হন তিনি।
কিন্তু লক্ষণীয় বিষয় হলো, এই প্রবাসে বিবাহবিচ্ছেদের ব্যাপারে অভিভাবকদের অনেকেরই চিন্তাভাবনা দেশের তুলনায় অনেকটাই ভিন্ন। তারা দেশী কায়দায় ছেলে-মেয়েদেরেকে জোর করে কিছু বলতে যান না, বা কোন কিছু চাপিয়েও দিতে চান না। এখানে তারা বলেন না যে পরিবারের সম্মান বা নিজের ভবিষ্যৎ ও বাচ্চাদের ভবিষ্যতের দিকে চেয়ে অন্যায় অত্যাচার কিছুটা হলেও তা মেনে নিয়ে সংসার টিকিয়ে রাখ। বরং স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে কোন সংকট তৈরী হলে বিশেষত কোন এবিউজ বা নির্যাতনের ব্যাপার ঘটলে বিবাহবিচ্ছেদের প্রক্রিয়ায় অভিভাবকরা সহায়তা করার জন্য এগিয়ে আসেন। ছেলে হোক মেয়ে হোক, উভয়ের ব্যাপারেই তারা এই কাজটি করেন। সাউন্ড ভিশনের জরীপে অন্তত সেই চিত্রই পাওয়া যায়। দেখা গেছে জরীপে অশংগ্রহণকারীদের মধ্যে প্রায় ৮২.১২% বিবাহবিচ্ছেদের প্রক্রিয়ায় অভিভাবকদের সমর্থন ও সহায়তা পেয়েছেন। সমর্থণ ও সাহায়তা পাওয়ার ব্যাপারে কার্যত মহিলারাই এগিয়ে আছেন পুরুষদের তুলনায়। জরীপ তথ্য অনুযায়ী দেখা যায় মহিলাদের মধ্যে শতকরা ৮৪.৬৮ জন সমর্থন পেয়েছেন অভিভবকদের এবং পুরুষদের মধ্যে সমর্থন ও সাহায়তা পাওয়ার হার শতকরা ৬৭.৩৯ জন।
উপরে বর্ণিত তথ্য এটাই প্রমাণ করে যে, বিবাহবিচ্ছেদের বিষয়ে পাশ্চাত্যের ধ্যান-ধারনা অনেকটাই প্রভাব বিস্তার করেছে প্রথম প্রজন্মের অভিবাসীদের উপরও। তারা দেশে থাকতে যে রক্ষণশীল মনোভাব পোষণ করতেন, প্রবাসে এসে তা বহুলাংশে শিথিল হয়ে গেছে। আর দ্বিতীয় প্রজন্মের জন্মই এখানে অথবা খুব ছোট বয়স থেকে তারা এদেশে বড় হয়েছেন। ফলে সমাজ-সংসার বা পারিবারিক বন্ধন বিষয়ে তাদের ধ্যান-ধারণা পাশ্চাত্যের মতই হবে তাতে আশ্চর্য হবার কিছু নেই। সে কারণে বিবাহবিচ্ছেদ ঘটানো তাদের কাছে পর্বতসম কোন বাধা নয় যদি তার যৌক্তিক কোন কারণ থাকে।
তবে সমাজ, সংসার বা বিবাহবিচ্ছেদের বিষয়ে পাশ্চাত্যের ধ্যানধারণায় সাউথ এশিয়ান কমিউনিটি কিছুটা প্রভাবিত হলেও এখনো অনেক লোকই বিবাহবিচ্ছেদকে নেতিবাচক দৃষ্টিতেই দেখেন। হয়তো অবস্থার প্রেক্ষিতে নিজেদের ছেলে বা মেয়ের বিবাহবিচ্ছেদকে মেনে নিচ্ছেন বা বিচ্ছেদ প্রক্রিয়ায় সহায়তা করছেন। কিন্তু পাশাপাশি এই বিষয়টিকে ইতিবাচক দৃষ্টিতে দেখছেন না অনেক অভিভাবক। কারণ বিচ্ছেদের অনেক ধকল আছে, আছে নানান যন্ত্রণা। বিচ্ছেদ হয়ে যাওয়া পরিবারের সন্তানদের উপর এর প্রভাব পড়ে সুদূরপ্রসারী।
সাউন্ড ভিশনের পক্ষ থেকে পরিচালিত জরীপে অংশগ্রহণকারীরাও জানিয়েছেন তাদের বিবাহবিচ্ছেদের সংবাদ কমিউনিটির অনেকে ভাল চোখে দেখেননি। শতকরা ২৪.৮৪ জন জানিয়েছেন তাদের বিবাহবিচ্ছেদের সংবাদ শুনে কমিউনিটির পরিচিত লোকজন নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। আর শতকরা ১২.৭৪ জন জানিয়েছেন বিবাহবিচ্ছেদের সংবাদ শুনে কমিউনিটিতে তাদের পরিচিতজনেরা ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। তবে শতকরা ৩১.৮৫ জন জানিয়েছেন তাদের বিচ্ছেদের সংবাদ শুনে কমিউনিটির লোকেরা নিরপেক্ষ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। জরীপে যারা অংশ নেন তাদের শতকরা ৩০.৫৭ ভাগ বিচ্ছেদের খবরটি প্রকাশ করেননি। ফলে তাদের বিষয়ে কি প্রতিক্রিয়া ছিল তা জানা যায়নি।
উপরের তথ্য থেকে দেখা যাচ্ছে প্রায় এক তৃতীয়াংশ লোকই তাদের বিবাহবিচ্ছেদের সংবাদটি কমিউনিটির পরিচিতজনের কাছে প্রকাশ করেননি। কারণ, বিচ্ছেদের বিষয়টিকে এখনো অনেকে ভাল চোখে দেখেন না। জরীপে অংশগ্রহণকারীদের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল তারা যখন বিবাহবিচ্ছেদের প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যাচ্ছিলেন তখন কমিউনিটির লোকদের কাছ থেকে কি কোন সমর্থন পেয়েছিলেন? উত্তরে শতকরা ৪৯.৩৪ জানিয়েছেন তারা কোন সমর্থন পাননি। সমর্থন পেয়েছেন এমন লোকের সংখ্যা ছিল ২৭.৬৩%। আর কিছুটা সমর্থন পেয়েছেন এমন লোকের সংখ্যা ছিল ২৩.০৩%।
বিবাহবিচ্ছেদের বিষয়ে দ্বিতীয় প্রজন্মের ছেলে-মেয়েরা কমিউনিটিতে সমর্থন কম পাচ্ছেন এই তথ্যটিই ফুটে উঠেছে উপরে। কিন্তু সারপ্রাইজিং ফ্যাক্ট বা আশ্চর্যের বিষয় হলো, যারা বিবাহবিচ্ছেদের পথ বেছে নিয়েছেন তাদের মধ্যে শতকরা ৯০.৬১ ভাগই এখন সুখী! কমিউনিটির সমর্থন বা সহযোগিতা পেল কি পেল না বা নিজেদের অভিভাবক ও আত্মীয়-স্বজন কে কি মনে করলো তা নিয়ে তাদের মাথা ব্যাথা নেই। বিবাহিত জীবনে তাদের যে সংকট বা সমস্যাগুলো তৈরী হয়েছিল সেগুলো থেকে মুক্তি পেয়ে এখন তারা বেশ সুখেই আছেন।
মানুষ বিয়ে করে সংসার জীবন শুরু করে নানারকম স্বপ্ন নিয়ে। সুখ শান্তি ও নিরাপদ ভবিষ্যত গড়ে তোলার লক্ষ্য থাকে সেই স্বপ্নের মধ্যে। সন্তানেরা বড় হবে। তারা একদিন সংসারের হাল ধরবে। বৃদ্ধ বাবা ময়ের সেবা যত্ম করবে, এরকম আরো অনেক স্বপ্ন নিয়েই মানুষ সংসার শুরু করে। কিন্তু সেই স্বপ্নে যদি ব্যাঘাত ঘটে বা ছন্দপতন ঘটে স্বামী বা স্ত্রীর অবহেলার কারণে অথবা নির্যাতনের কারণে কিংবা পরকীয়ার মতো কোন নীতিবর্হিভূত কারণে তখন নিশ্চই তা মেনে নেয়া সহজ কাজ নয় কোন পক্ষের কাছেই। প্রবাসে যারা এই কঠিন সিদ্ধান্তটি নেন বা নিতে বাধ্য হন তারা হয়তো প্রয়োজনীয় কাউন্সিলিং এর অভাবে এমনটি করেন অথবা সামনে আর কোন পথ খোলা থাকে না বলে শেষ পর্যন্ত ডিভোর্সকেই বেছে নেন মুক্তির পথ হিসাবে।
কিন্তু আলাদা হয়ে যাওয়া ঐ সংসারে যদি কোন সন্তান থেকে থাকে তখন তাদের কারো কারো ভবিষ্যৎ হয়ে উঠে বাস্তবিক অর্থেই খুবই কঠিন। নানারকম চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে তারা। মানসিক সমস্যায় ভোগার সম্ভাবনা তাদের অনেক বেশী থাকে। যে সকল পরিবার বিচ্ছিন্ন হয়নি তাদের তুলনায় এই বিচ্ছিন্ন পরিবারের সন্তানদের মানসিক সমস্যা হওয়ার সম্ভাবনা থাকে পাঁচগুন বেশী। বৃটেনের ডেইলি মেইল পত্রিকা সে দেশের সরকারী অর্থয়নে পরিচালিত এক গবেষণার বরাত দিয়ে এই তথ্য জানায়। গবেষণাটি পরিচালনা করে স্থানীয় ‘অফিস ফর ন্যাশনাল স্ট্যাটিসটিকস্’। প্রায় ৮ হাজার শিশুর (যাদের বয়স ৫ থেকে ১৬) উপর গবেষণা চালিয়ে আরো যে তথ্য পাওয়া যায় তাতে বলা হয়, বিচ্ছিন্ন পরিবার থেকে অবিচ্ছিন্ন পরিবার সন্তানদের জন্য অনেক ভাল যদি তাদেরকে আবেগগত দুর্দশা ও অসামাজিক কার্যকলাপ থেকে দূরে রাখতে হয়।
কানাডার কুইবেক থেকে পরিচালিত বেবীগাগা.কম এ প্রকাশিত এক প্রতিবেদনেও বলা হয়, ভেঙ্গে যাওয়া পরিবারের শিশুদের কারো কারো মধ্যে বেশ কিছু সমস্যা দেখা দিতে পারে। এই সমস্যাগুলোর মধ্যে আছে স্বাস্থগত সমস্যা, লাজুক ভাব, আত্মবিশ্বাসের অভাব, অস্বাভাবিক ভয় এবং উদ্বেগ, বিষন্নতা, আত্মহত্যার চিন্তা, শিক্ষায় পিছিয়ে পড়া, বয়স্কদের প্রতি অবিশ্বাস, আচরণ শিশুসুলভ না হওয়া, অনুভূতিতে অশান্তি বিরাজ করা, দারিদ্রতার শিকার হওয়া, অনিদ্রা, অসামাজিক আচরণ, দুঃস্বপ্ন দেখা ইত্যাদি।
উপরে বর্ণিত ব্রোকেন ফ্যামিলির শিশুদের এই সমস্যাগুলোর কোনটিই অবজ্ঞা করার মত নয়। কারণ এর যে কোন একটিই কোমলমতি শিশুদের জন্য বয়ে আনতে পারে বড় রকমের সমস্যা।
স্বাস্থ্যগত সমস্যার মধ্যে আছে মানসিক রোগে ভোগা, ঘন ঘন মাথা ব্যাথা হওয়া, হাপানী বা এ্যাজমাতে ভোগা ইত্যাদি। লাজুক ভাব সৃষ্টি হওয়ার কারণে তাদের অনেকের মধ্যে সামাজিক স্কিলগুলো ডেভলাপ করে না। দেখা দিতে পারে ব্যক্তিত্বের অভাব। অস্বাভাবিক ভয় এবং উদ্বেগ এই শিশুদের মনে সৃষ্টি করতে পারে গুরুতর মানসিক রোগ। বিষন্নতা শিশুদের জন্য অসহনীয় হয়ে উঠে। তাদের শারীরিক ও মানসিক ডেভলাপমেন্টে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। কখনো কখনো বিষন্নতার সমস্যাগুলো পুঞ্জিভূত হতে হতে হঠাৎ করেই তা ফেটে পরতে পারে যা তখন বড় রকমের বিপত্তি ডেকে আনতে পারে কোন কোন শিশুর বেলায়। সৃষ্টি করতে পারে একটি সর্বনাশা পরিস্থিতি। শিশুদের এই বিষন্নতা ক্রমান্বয়ে তাদেরকে আত্মহত্যা করার জন্য প্ররোচিত করতে পারে যদিও তা বিরল ক্ষেত্রেই ঘটে। ভেঙ্গে যাওয়া পরিবারের শিশু সন্তানদের অনেকেই শিক্ষা ক্ষেত্রেও পিছিয়ে থাকে। স্কুলে ভাল রেজাল্ট করতে পারে না। ফলে পরবর্তী জীবনে তারা পিছিয়ে থাকে। দারিদ্রতা পিছু ছাড়ে না।
কিন্তু এত কিছু ঘটার সম্ভাবনা থাকলেও অনেক বাবা মায়ের বিকল্প থাকে না বিবাহবিচ্ছেদ না করে। তাছাড়া ভেঙ্গে যাওয়া পরিবারে শিশুদের এই সমস্যাগুলো হতে পারে এরকম কোন ধারণা প্রায় কোন বাবা মায়েরই থাকে না। এমনকি এই বাবা মায়ের যারা বাবা মা অর্থাৎ প্রথম প্রজন্মের অভিবাসী তারাও এ সম্পর্কে ওয়াকিবহাল থাকেন না। সবাই সমস্যাগুলো টের পান যখন তা নিজের ঘাড়ে এসে চেপে বসে।
তবে বাবা মায়ের বিচ্ছেদ যে সবসময় শিশুদের জন্য অমঙ্গল বয়ে আসে তাও সত্য নয়। কখনো কখনো এই বিচ্ছেদ সন্তানদের জন্য মঙ্গলও বয়ে আনতে পারে। যেমন সাউন্ডভিশন এর এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, কুয়েন্দিয়েল নামের এক ১০ বছরের শিশু পরিবারে বাবা মায়ের ঝগড়া-ঝাটি দেখে সবসময়ই মনমরা হয়ে থাকতো। তার ভাষায়- “ঘরে সবসময় একটা উৎসাহশূন্য ও ঠান্ডা ভাব বিরাজ করতো। স্পষ্টতই কোন ভালবাসা বা øেহের কোন লক্ষণ ছিল না। পরিশেষে আমার বাবা মা বিবাহবিচ্ছেদ ঘটান এবং আমার মা এতে খুশী হন। সেই সঙ্গে একজন শিশু হিসাবে আমার নিজের জীবনও উল্ল্লেখযোগ্যভাবে উন্নততর হয়ে উঠে।”
প্রতিটি স্বামী-স্ত্রী-ই চান সংসার সুখী হোক। মানবজীবনে এটিই স্বাভাবিক চাওয়া এবং একটি আদর্শ দৃশ্যকল্প। এ জন্য স্বামী-স্ত্রী মিলে কম পরিশ্রম করেন না। নিজেদের সর্বস্ব ত্যাগ করে হলেও তারা চান তাদের সন্তান যেন সুখে থাকে। তারা বড় হয়ে সমাজে যাতে প্রতিষ্ঠা পায় সে জন্য বাবা মায়ের চেষ্টার কোন ত্র“টি থাকে না।
কিন্তু জীবনের কঠিন বাস্তবতা সবসময় সে পথে এগুতে দেয় না সব দম্পতিকে। শুভদৃষ্টি দিয়ে শুরু হয় যে শুভসূচনা, পরবর্তীতে নানান কারণে তাদের মধ্যে সৃষ্টি হয় দ্বন্দ্ব ও সঙ্কট। স্বপ্ন ভেঙ্গে চূড়মার হয়ে যায়। একসময়ের অনেক ভাললাগা ও অনেক ভালবাসার মানুষটি হয়ে যায় অনেক অচেনা, অনেক দূরের কেউ।
উপরে উল্লেখিত বিভিন্ন জরীপ থেকে জানা গেল যে, কানাডা ও আমেরিকায় সাউথ এশিয়ান কমিউনিটিতে বিবাহবিচ্ছেদ প্রবলভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। কানাডার গ্লোব এ্যান্ড মেইল পত্রিকায় প্রকাশিত সীমা খানের এক প্রতিবেদন থেকেও জানা যায় যে, গত ২৫ বছরের মধ্যে কানাডা ও আমেরিকার মুসলিম কমিউনিটিতেও বিবাহবিচ্ছেদ বৃদ্ধি পেয়েছে দ্রুতগতিতে। ইনস্টিটিউট ফর সোস্যাল পলিসি এ্যান্ড আন্ডারস্ট্যান্ডিং এর বরাত দিয়ে তিনি এ তথ্য জানান এবং বলেন, সংসারে জেন্ডার রোল এর পরিবর্তন একটা বড় ভূমিকা পালন করছে সাম্প্রতিকালের দাম্পত্য দ্বন্দ্বে। আগের তুলনায় কানাডায় এবং আমেরিকায় অধিক সংখ্যক মুসলিম মহিলা উচ্চ শিক্ষার দিকে ঝুকেছেন এবং ঘরের বাইরে কর্মজগতে প্রবেশ করছেন। কিন্তু তা সত্বেও মুসলিম মহিলাদেরকে সন্তান লালনপালনে এবং ঘরকন্যার কাজে পুরুষের তুলনায় অধিকতর সময় ব্যয় করতে হচ্ছে। ইনস্টিটিউট ফর সোস্যাল পলিসি এ্যান্ড আন্ডারস্ট্যান্ডিং এর জরীপে অংশগ্রহণকারী মুসলিম ইমামগণ এ বিষয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেছেন, স্বামীদেরকেও সংসারের কাজে সহায়তা করতে হবে যখন স্ত্রীরা বাইরের কাজে যোগ দেন।
আজকের দিনে নর্থ আমেরিকায় মুসলিম পরিবারগুলোতে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে দ্বন্দ্ব তৈরীর প্রাথমিক কারণ সম্ভবত পরিবারের কর্তৃত্ব নিয়ে। পুুুুরুষগণ এতদিন ধরে চলে আসা প্রথা অনুযায়ী মনে করে আসছেন যে পরিবারের কর্তৃত্ব তাদেরই। পরিবারের কোন বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হলে তাদেরকেই নেতৃত্ব দিতে হবে। এবং এ জন্য তাদের স্ত্রীদের সঙ্গে পরামর্শ করার প্রয়োজন নেই। অন্যদিকে স্ত্রীগণ চাচ্ছেন পরিবারের কোন বিষয় সিদ্ধান্ত নিতে হলে তাদের সঙ্গেও আলোচনা করতে হবে, তাদের মতামত নিতে হবে। তারা সমতার দাবীও করে আসছেন। মুসলিম মহিলাদের মধ্যে সাম্প্রতিক কালে এই চেতনা বা দাবী জাগ্রত হয়েছে নর্থ আমেরিকার মূলধারার পরিবারসমূহের পারিপাশ্বিক অবস্থা অবলোকন করে। এই ব্যাখ্যাটি দেন আমেরিকার বিশিষ্ট মুসলিম ফ্যামিলি কাউন্সিলর মোহাম্মদ রিদা বশির। তিনি আরো বলেন, মুসলিম পরিবারসমূহে পারিবারিক কোন বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহনের আগে মহিলা সদস্যদের সঙ্গে পরামর্শ করা উচিৎ। এমনকি সন্তানদের সঙ্গেও। (সূত্র: গ্লোব এন্ড মেইল)
ইনস্টিটিউট ফর সোস্যাল পলিসি এ্যান্ড আন্ডারস্ট্যান্ডিং এর গবেষণায় আরো যে তথ্য উঠে এসেছে তা হলো, অধিকাংশ অসবর্ণ বিয়ে ভাঙ্গার পিছনে স্বামী-স্ত্রীর সাংস্কৃতিতে ব্যাপক পার্থক্যই প্রধানত দায়ী। ধর্ম অনুশীলন ক্ষেত্রে ভিন্নতা থাকলেও পরিবারে অনৈক্যের সৃষ্টি হতে পারে। কোন কোন মহিলা এমনও অভিযোগ করেন যে, তাদের পুরুষ সঙ্গীরা ধর্মকে হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করেন তাদেরকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য।
উল্লেখ্য যে, উত্তর আমেরিকায় গত কয়েক দশকে অভিবাসীর সংখ্যা বৃদ্ধির সাথে পাল্লা দিয়ে অসবর্ণ বিয়ের হারও অনেকটাই বৃদ্ধি পেয়েছে। যারা অসবর্ণ বিয়ের সমর্থক তারা বলছেন, সনাতনী চিন্তাভাবনা বাদ দিয়ে এখন সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার সময়। আর এটি এখনকার বাস্তবতায় অনিবার্য হয়ে উঠেছে। অসবর্ণ বিয়ে কখনো হচ্ছে দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে যেখানে ধর্ম বিবেচ্য বিষয় নয়। আবার দুই এথনিক সম্প্রদায় হলেও ধর্ম এক এমন অসবর্ণ বিয়েও হচ্ছে। প্রবাসে দ্বিতীয় প্রজন্মের বাঙ্গালীরাও এর বাইরে নয়। জরীপ প্রতিষ্ঠান রিগ বিবি’র তথ্যে দেখা যায় বর্তমানে ৯২% কানাডিয়ান অসবর্ণ বিয়ে সমর্থন করেন। স্ট্যাটিসটিকস কানাডার হিসাবে দেখা যায় বর্তমানে কানাডায় অসবর্ণ দম্পতির সংখ্যা ৪%।
তবে কানাডার বড় শহরগুলো অসবর্ণ বিয়ের হার কমে আসছে। এর কারণ, সম্ভবত বিভিন্ন এথনিক কমিউনিটিতে নিজেদের লোকসংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়াতে এখন আর অন্য কমিউনিটিতে পাত্র-পাত্রী খোঁজার প্রয়োজন পড়ছে না।
স্ট্যাটিসটিকস কানাডার তথ্য হলো, ছোট শহর যেমন Trois-Rivières and Moncton এ অসবর্ণ দম্পতির সংখ্যা ৪০%। ঐ শহরগুলোতে দৃশ্যমান সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের লোকসংখ্যা অনেক কম। কিন্তু টরন্টোতে অনেক বেশী। ফলে দেখা গেছে এখানে মাত্র ১১% অসবর্ণ দম্পতির উপস্থিতি রয়েছে। ভেঙ্গুভারে এই হার ১২.২%।
বাংলাদেশী বা এশিয়ান অন্যান্য এথনিক গ্র“পের মধ্যে এ চিত্র অবশ্য কিছুটা ভিন্ন। তারা অসবর্ণ বিয়ের দিকে এখনো অতটা ঝুঁকেনি। কানাডায় চাইনিজ এথনিক গ্র“প এ অসবর্ণ বিয়ের ব্যাপারে খুবই রক্ষণশীল। বাংলাদেশীরাও মোটামুটি রক্ষণশীল। তবে খুব ধীরে হলেও বাংলাদেশী ছেলে-মেয়েরা অসবর্ণ বিয়ের দিকে ঝুঁকছে। হতে পারে এটি কানাডীয় সংস্কৃতির প্রভাব অথবা নিজ কমিউনিটিতে পাত্র-পাত্রীর সংকট।
তবে অসবর্ণ বিয়ের পরিনতি যে খুব একটা ভাল হয় না এবং বিবাহবিচ্ছেদ এর সমূহ সম্ভাবনা যে থাকে এমন তথ্যই জানালেন এ বিষয়ে গবেষণা পরিচালনাকারী Naomi Schaefer Riley তার ‘Til Faith Do Us Part: How Interfaith Marriage Is Transforming America (Oxford University Press) বই তে। তিনি তার বইতে কিছু লুকানো বাস্তবতা দেখিয়েছেন বিশেষ করে অসবর্ণ পরিবারের শিশুসন্তানদের বিষয়ে যা বিয়ে পরবর্তী জীবনে নানান সংকট ডেকে আনে। তিনি বলেন, অসবর্ণ বিয়ে সাধারণভাবে আরো অসুখী। বৈবাহিক সন্তুষ্টির হার কম। এই বিয়ে প্রায়ই ভারসাম্যহীন অবস্থায় থাকে। এরকম পরিবারে স্বামী-স্ত্রী প্রথম দিকে ঠিক বুঝে উঠতে পারে না সামনে কি সংকট আসছে। যখন তাদের পরিবারে কোন সন্তান জন্ম নেয় এবং একটু বড় হয়ে উঠে তখনই সংকটগুলো সামনে এসে হাজির হয়, বিশেষ করে ধর্মবিশ্বাস নিয়ে তখন একটি বড় রকমের সমস্যা তৈরী হয় এবং বিবাহবন্ধন টালমাটাল হয়ে উঠে। Naomi হুশিয়ার করে দিয়েছেন এই বলে যে, ভালবাসা অন্যসব সমস্যাকে পিছনে ফেলে সবসময় জয়ী হয় এ কথা যাতে সবাই অন্ধভাবে বিশ্বাস না করেন। তিনি আরো বলেন, ধৈর্য বা সহনশীলতাও অসবর্ণ বিয়ের সব সমস্যার সমাধান দিবে তার কোন নিশ্চয়তা নেই।
বস্তুুত Riley এবং the Pew Research Center তাদের গবেষণায় দেখতে পেয়েছেন সাধারণভাবে অসবর্ণ বিয়ে ভাঙ্গে উচ্চতর হারে।
এদিকে কানাডায় সাউথ এশিয়ান কমিউনিটির দ্বিতীয় প্রজন্মের মধ্যে বিবাহবিচ্ছেদ বৃদ্ধির পাশাপাশি ছেলেদের মধ্যে দেরীতে করার প্রবণতাও বৃদ্ধি পাচ্ছে। কারণ সংসার ভাঙ্গার অশান্তি, হাঙ্গামা, সন্তানদের ভবিষ্যত আর খরচের বিষয়টি বিবেচনায় রেখে ছেলেরা সহজে বিয়েতে রাজী হচ্ছে না। বিবাহবিচ্ছেদের মাধ্যমে শুধু যে স্ত্রী বিচ্ছেদই ঘটে তা নয়, সেই সাথে বিচ্ছেদ ঘটে অর্জিত সম্পদেরও একটা বিরাট অংশ। আরো আছে এলিমনির ঝক্কি।
৬৮% ডিভোর্স হয় অর্থনৈতিক কারণে: ব্যারিস্টার কামরুল হাফিজ আহমদ
সাধারণভাবে অর্থনৈতিক পরিস্থিতি, বিশ্বাসঘাতকতা, ভালবাসার অভাব, পারিবারিক সহিংসতা, এ্যালকহোল ইত্যাদি কারণে ডিভোর্স হচ্ছে
প্রবাসে আমাদের দ্বিতীয় প্রজন্মের ছেলে-মেয়েদের মধ্যে বিয়ে ভাঙ্গার হার বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিষয়টি ইতিমধ্যেই উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে অভিভাবক মহলে। কি কারণে এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে তা জানার জন্য আমরা মুখমুখি হয়েছিলাম টরন্টোর বাঙ্গালী কমিউনিতে পরিচিত মুখ ব্যারিস্টার কামরুল হাফিজ আহমদ এর।
প্রশ্ন : প্রবাসে দ্বিতীয় প্রজন্মের বাঙ্গালী ছেলে-মেয়েদের মধ্যে ডিভোর্সের হার কত বলে আপনার কাছে মনে হয়?
উত্তর: প্রবাসে আমাদের দ্বিতীয় প্রজন্মের বিবাহিত বাঙ্গালী ছেলে-মেয়েদের মধ্যে ডিভোর্সের হার কত তার সঠিক ডাটা পাওয়া মুশকিল। তবে এটা সত্য যে, ডিভোর্স হচ্ছে বাঙ্গালী ছেলে-মেয়েদের মধ্যে।
প্রশ্ন : সেপারেশন / ডিভোর্স এর পিছনে প্রধানত কি কি কারণ দায়ী? সবচেয়ে বেশী সেপারেশন / ডিভোর্স ঘটছে কোন কারণে?
উত্তর: প্রতিটি ডিভোর্সের কারণ ভিন্ন। তবে সাধারণভাবে যে সমস্ত কারণে ডিভোর্স হয় তার মধ্যে আছে : অর্থনৈতিক পরিস্থিতি, ইনফাইডিলিটি বা বিশ্বাসঘাতকতা, ভালবাসার অভাব, পারিবারিক সহিংসতা, এ্যালকহোল ইত্যাদি। ৬৮% ডিভোর্স হয় অর্থনৈতিক কারণে। কানাডাতে পারিবারিক সহিংসতার কারণে প্রতি বছর প্রায় ৪০ হাজার লোক গ্রেফতার হন। ডিভোর্সের আরেকটি কারণ ইগো বা অহংকার।
সেপারেশন আর ডিভোর্স এক বিষয় নয়। সেপারেশন একটি এগ্রিমেন্ট যা শুরু হয় ডিভোর্সের আগে। কানাডায় স্বামী-স্ত্রী এক বছর সেপারেশন অবস্থায় থাকার পর তারা তাদের ডিভোর্স আদালতের মাধ্যমে চূড়ান্ত করতে পারেন। তবে এই সেপারেশন সবসময় ডিভোর্সের দিকে মোড় নেয় না। সেপারেশন এর সময়টাতে অনেক সময় স্বামী-স্ত্রী পুণরায় একত্রিত হবার চেষ্টা করেন। ফ্যামিলি কাউন্সিলর এখানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
প্রশ্ন: ফিজিক্যাল এবিউজের হার কেমন দ্বিতীয় প্রজন্মের কাপলদের মধ্যে?
উত্তর : যেহেতু জন্মগতভাবেই মেয়েরা শারীরিকভাবে দুর্বল তাই তারাই বেশী শারীরিকভাবে নির্যাতিত হন। তবে উল্টোটিও আছে। অবশ্য তার হার নগন্য।
প্রশ্ন : দ্বিতীয় প্রজন্মের মধ্যে ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স কতটুকু ভূমিকা রাখছে সংসার ভাঙ্গার ক্ষেত্রে?
উত্তর : ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স এর কারণে সংসার ভাঙ্গে। কিন্তু এটি সংসার ভাঙ্গার প্রধান কারণ নয়। দ্বিতীয় প্রজন্মের মধ্যে ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স তুলনামূলকভাবে কম।
প্রশ্ন : এক্সট্রা মেরিটাল এ্যাফেয়ার্স এর কারণে ঘর ভাঙ্গছে এরকম ঘটনার হার কি রকম?
উত্তর: পরকীয়া প্রতিটি সমাজব্যবস্থায় আছে এবং থাকবে। সংসার ভাঙ্গার পিছনে এটি একটি অন্যতম কারণ। ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল এর এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, যুবক বয়সের (বয়স যাদের ৩০ এর নিচে) ছেলে মেয়েদের মধ্যে পরকীয়ার প্রবণতা বেশী। তবে বয়স্কদের মধ্যেও পরকীয়ার প্রবণতা দেখা যায়। নর্থ আমেরিকায় ৩০% থেকে ৬০% নারী-পুরুষ তাদের বিবাহিত জীবনের কোন এক পর্যায়ে অন্যের প্রতি আকর্ষিত হন। সাম্প্রতিক কালে ইন্টারনেটের বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এই প্রবণতাকে আরো সহজ করে দিয়েছে।
প্রশ্ন : বিয়ের পরও আগের ছেলে বা মেয়ে বন্ধুদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা (নন-এ্যাফেয়ার) বজায় রাখার কারনে ঘর ভাঙ্গার ঘটনা ঘটছে?
উত্তর : বিয়ের পর বিপরীত লিঙ্গের কারো সঙ্গে নন-এফেয়ার্স ঘনিষ্ঠতাও সংসার জীবনে সমস্যা তৈরী করে। এটা সব সমাজের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য।
প্রশ্ন: ছেলে বা মেয়ে এই দুইজনের কোন একজনকে যখন বিয়ের মাধ্যমে দেশ থেকে আনা হয় তখন কালচারাল কনফ্লিক্ট দেখা দেয়। এই কনফ্লিক্ট কি ঘর ভাঙ্গার কারণ হিসাবে ভূমিকা পালন করে?
উত্তর : এটা নির্ভর করে কাপল টু কাপল। তবে সাংস্কৃতিক পার্থক্য বিরাট একটা ভূমিকা রাখে ঘর ভাঙ্গার ক্ষেত্রে।
প্রশ্ন : প্রবাসে ‘বৌ শাশুড়ীর দ্বন্দ্ব’ কি কোন ভূমিকা রাখে সেপারেশন বা ডিভোর্সের বিষয়ে?
উত্তর : বৌ-শাশুড়ীর দ্বন্দ্ব পৃথিবীর সবার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। এটা শুধু বাঙ্গালীদের মধ্যেই ঘটে তা নয়।
প্রশ্ন : দ্বিতীয় প্রজন্মের ছেলে-মেয়েদের মধ্যে ফেসবুক, টুইটার প্রভৃতি সামাজিক যোগাযোগ মধ্যমের প্রতি যে অসক্তি লক্ষ্য করা যায় সেগুলো কি ঘরভাঙ্গার পিছনে কোন ভূমিকা রাখে?
উত্তর: ফেসবুকসহ অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ভাল দিকও আছে। এটি নির্ভর করছে একজন এই বিষয়টিকে কিভাবে নিচ্ছেন বা ব্যবহার করছেন।
প্রশ্ন : সংসারে কে কতটা আর্থিক কন্ট্রিবিউট করবে সে নিয়ে যদি দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয় তাহলে সেটিও কি ঘরভাঙ্গার পিছনে ভূমিকা রাখে?
উত্তর : এটাও নির্ভর করছে দুজনের আন্ডারস্ট্যান্ডিং এর উপর।
প্রশ্ন : স্বামী স্ত্রীর মধ্যে যখন সমস্যা তৈরী হয় তখন কাউন্সিলিং একটা বড় ভূমিকা রাখতে পারে ঘর না ভাঙ্গার পিছনে। এই কাউন্সিলিংটা কি ঠিক মত হচ্ছে না এখানে?
উত্তর : বিভিন্ন ধরণের কাউন্সিলিং আছে। দাম্পত্য সম্পর্কে সমস্যা তৈরী হলে ফ্যামিলি ডাক্তার সহযোগিতা করতে পারেন। কাউন্সিলিং অবশ্যই উপকারী।
প্রশ্ন : দ্বিতীয় প্রজন্মের মধ্যে হু-কেয়ার্স একটা ভাব দেখা দেয়। এবং পরিণতিতে ঘর ভাঙ্গেও। এ বিষয়ে আপনার অবজারভেশন কি?
উত্তর : এটা আমাদের ধারণা। আমাদের বুঝতে হবে দ্বিতীয় প্রজন্মের ছেলে-মেয়েরা আমাদের চেয়ে বেশী বুঝে। আমাদের অনেক আইডিয়া ওদের কাছে আউটডেটেড। কিন্তু আমরা কষ্ট পাই। অনেক সময় কারণে, অনেক সময় অকারণে।
প্রবাসে দ্বিতীয় প্রজন্মের বাঙ্গালী ছেলে-মেয়েদের মধ্যে ইদানিং বিয়ে ভাঙ্গার হার বেশী দেখা যায় : আফরোজা বেগম
প্রবাসে আমাদের দ্বিতীয় প্রজন্মের ছেলে-মেয়েদের মধ্যে বিয়ে ভাঙ্গার হার বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিষয়টি ইতিমধ্যেই উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে অভিভাবক মহলে। কি কারণে এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে তা জানার জন্য আমরা মুখমুখি হয়েছিলাম বাঙ্গালী কমিউনিটির পরিচিত মুখ অন্টারিও প্রভিন্সের রেজিস্টর্ড স্যোসাল ওয়ার্কার ও ফ্যামিলি কাউন্সিলর আফরোজা বেগমের। তিনি জানালেন, প্রবাসে আমাদের দ্বিতীয় প্রজন্মের বাঙ্গালী ছেলে-মেয়েদের (তরুন দম্পতিদের) মধ্যে ইদানিং বিয়ে ভাঙ্গার হার বেশী দেখা যায়। সচরাচর দেখা যায় যে, তারা বিয়ের অনুষ্ঠান পরিকল্পনা ও অনুষ্ঠান সম্পন্ন করার ক্ষেত্রে প্রচুর উদ্যোগ ও উৎসাহ দেখায়। কিন্তু দেখা যায় বিয়ের উদ্দেশ্য ও নতুন সম্পর্ক বজায় রাখার জন্য যে আন্তরিকতার প্রয়োজন সে ব্যাপারে অত্যন্ত উদাসীন। বাস্তব জীবনের দায় দায়িত্ব সম্পর্কেও তাদের মধ্যে উদাসীনতা লক্ষ্য করা যায়। তবে প্রতিটি বিয়ে ভাঙ্গার পিছনে কোন একটি প্রধান কারণ থাকে। প্রবাসে আমাদের বাংলাদেশী কমিউনিটিতে এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোন পরিসংখ্যান নেই।
প্রবাসে ঘর ভাঙ্গার পিছনে প্রধানত কি কি কারণ দায়ী এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন,
– যৌথভাবে সমাধান খোঁজার বদলে তর্ক-যুদ্ধ চালানো।
– প্রাত্যহিক কথোপকথনে পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধার অভাব, আন্তরিকতার অভাব, সহযোগিতার অভাব এবং বিশ্বাসের অভাব।
– অর্থনৈতিক চাপ ও অনিরাপত্তা।
– অবাস্তব প্রত্যাশা ও নিষ্ঠার অভাব।
– অবিশ্বাস ও বহু সম্পর্ক বজায় রাখা।
– পারিবারিক বন্ধন ও উন্নয়নের বদলে বহির্জগতে ব্যস্ত থাকা।
– অসম বয়স, শিক্ষা ও যোগ্যতা।
– অসুস্থতা, দুর্ঘটনায় দিশাহারা হওয়া এবং মাদকাশক্ত হওয়া।
আফরোজা বেগম বলেন, গড়ে ২ থেকে ৫ বছরের মধ্যে বিয়ে ভাঙ্গছে। আর বিয়ে ভাঙ্গার ক্ষেত্রে নর্থ আমেরিকায় মেয়েরা প্রধান ভূমিকা রাখছে। তিনি আরো জানান, ৯/১১ এ কল করার সংখ্যাটিও কম নয়। দ্বিতীয় প্রজন্মের দম্পতিদের মধ্যে প্রায় শতকরা ৫০ ভাগই করে এ কাজটি। তরুন দম্পতিদের মধ্যে দৌহিক নির্যাতনের সংখ্যা বিভিন্ন পরিসংখ্যান অনুসারে শতকরা ৫০ ভাগেরও বেশী। তবে দ্বিতীয় প্রজন্মের ছেলে-মেয়েরা সাধারণভাবে ভায়োলেন্স ফ্রি জীবন পছন্দ করে।
পরকীয়ার কারণে ঘর ভাঙ্গছে কি রকম? আফরোজা বেগম বলেন, পরকীয়ায় জড়ালে সম্পর্কে ফাটল ধরে আর এর ফলস্বরূপ উল্লেখযোগ্য হারে ঘর ভাঙ্গছে। তিনি আরো বলেন, বিয়ের পরও আগের ছেলে বন্ধু বা মেয়ে বন্ধুদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা (নন-এ্যাফেয়ার) বজায় রাখার কারণেও বিরাট ভুল বুঝাবুঝির সৃষ্টি হতে পারে এবং পরিবার দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করে। আর এই দ্বন্দ্ব এক পর্যায়ে বিবাহবিচ্ছে রূপ নিতে পারে।
প্রবাসে ‘বৌ শাশুড়ীর দ্বন্দ্ব’ কি কোন ভূমিকা রাখে সেপারেশনের বিষয়ে?
এ প্রশ্নের উত্তরে আফরোজা বেগম বলেন, কিছুটা প্রভাব থাকে দ্বন্দ্ব সৃষ্টির জন্য যে কারণে বিবাহবিচ্ছেদ ঘটতে পারে।
অনেক অভিভাবকের অভিযোগ, “প্রবাসে বিয়ের পর প্রায় কোন মেয়েই শ্বশুর-শাশুড়ীর সঙ্গে থাকতে চায় না।” এরকম পরিস্থিতিতে যদি কোন মেয়েকে বাধ্য করা হয় শ্বশুর-শাশুড়ীর সঙ্গে থাকতে বা সেরকম চেষ্টা করা হয় তবে সে ক্ষেত্রে ঘর ভাঙ্গার সম্ভাবনা কতটুকু থাকে?
এর উত্তরে আফরোজা বেগম বলেন, শ্বশুর-শাশুড়ির সঙ্গে থাকার কারণে ঘর ভাঙ্গে না। মূল কারণ হলো পরিবারের বিভিন্ন বয়সের মানুষের মধ্যে শ্রদ্ধা ও সম্পর্ক। এখনতো বাধ্য হয়ে কেউ শ্বশুর-শাশুড়ির সঙ্গে থাকে না।
সংসারে কে কতটা আর্থিক কন্ট্রিবিউট করবে সে নিয়ে যদি দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয় তাহলে সেটিও কি ঘরভাঙ্গার পিছনে ভূমিকা রাখে?
উত্তরে তিনি বলেন, হ্যা, এই দ্বন্দ্ব দীর্ঘ দিনের এবং এই বিষয়ে তিক্ততা বৃদ্ধি পেতে পেতে এক পর্যায়ে তা ঘর ভাঙ্গার কারণ হয়ে দাড়াতে পারে।
স্বামী স্ত্রীর মধ্যে যখন সমস্যা তৈরী হয় তখন কাউন্সিলিং একটা বড় ভূমিকা রাখতে পারে ঘর না ভাঙ্গার পিছনে। এর প্রসঙ্গে আফরোজা বেগম বলেন, এখানে দেখতে হবে কাউন্সিলিংটা কি সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার জন্য হচ্ছে না ঘর ভাঙ্গার জন্য হচ্ছে। সেটি সঠিকভাবে বুঝতে হবে।
প্রায় এক চতুর্থাংশ বিয়ে ভেঙ্গে যাচ্ছে দ্বিতীয় প্রজন্মের ছেলে-মেয়েদের মধ্যে : জহরুল ইসলাম
প্রবাসে আমাদের দ্বিতীয় প্রজন্মের ছেলে-মেয়েদের মধ্যে বিয়ে ভাঙ্গার হার বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিষয়টি ইতিমধ্যেই উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে অভিভাবক মহলে। কি কারণে এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে তা জানার জন্য আমরা মুখমুখি হয়েছিলাম টরন্টো প্রবাসী সমাজকর্মী জহরুল ইসলাম এর। তিনি টরন্টোতে ম্যাচ মেকিং এর একটি প্রতিষ্ঠানও পরিচালনা করেন।
জহরুল ইসলামের জানান, ডিভোর্সের ব্যাপারে কানাডায় শুধু বাঙ্গালী ছেলে-মেয়েদের জন্য আলাদা কোন জরীপ রিপোর্ট নেই। তবে আমার মনে হয় এই হার ২০ থেকে ২৫ এর মধ্যে হতে পারে।
ডিভোর্স এর পিছনে প্রধানত কি কি কারণ দায়ী? সবচেয়ে বেশী ডিভোর্স ঘটছে কোন কারণে?
এ প্রশ্নের উত্তরে জনাব ইসলাম বলেন, আমার মতে নিম্মোক্ত কারণগুলো ডিভোর্সের ক্ষেত্রে সার্বিকভাবে প্রভাব ফেলছে। এগুলো যেমন দ্বিতীয় প্রজন্মের দম্পতির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, তেমনি কিছু কিছু ক্ষেত্রে প্রথম প্রজন্মের (যাদের বয়স কম) বাঙ্গালীদের বেলাও প্রযোজ্য। কারণগুলো নিম্মরূপ :
-স্বামী-স্ত্রীর শিক্ষা-দীক্ষা, রুচিবোধ, পারিবারিক ও আর্থিক অবস্থার ক্ষেত্রে দুই পরিবারের অনতিক্রম্য পার্থক্য।
– স্বামী ও স্ত্রীর পারস্পরিক প্রত্যাশার ক্ষেত্রে অনতিক্রম্য পার্থক্য।
– পরিবারের আর্থিক অবস্থা। দুজন উপার্যন করলে সংসার পরিচালনায় খরচে অবদান, সাংসারিক কাজে পরস্পরের অংশগ্রহণ এবং এমনকি পরিবারের কৃর্তত্ব নিয়ে টানা পোড়ন।
-কানাডিয়ান সমাজের পরিবর্তন বা আন্ত প্রজন্মের নতুন নতুন ধারা-প্রবণতার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে উদ্ভূত সমস্যা।
-কর্মরত স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে সহকর্মীদের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে উঠা থেকে উদ্ভূত সমস্যা।
-প্রেমের বিয়ের ক্ষেত্রে পরিবারের সঙ্গে সংঘাত এবং পারিবারিক বিয়ের ক্ষেত্রে ছেলে-মেয়েদের মধ্যে বৈসাদৃশ্য।
-নিজ দেশ থেকে বিয়ে করে আনা স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে মূল্যবোধ, কালচার এবং মটিভেশনের পার্থক্য।
-কানাডায় বসবাসরত শ্বশুর-শাশুড়ী, ননদ-দেবরদের নেতিবাচক ভূমিকা।
-দম্পতির যে কোন একজনের পরকীয়ায় জড়িয়ে পড়া।
-সর্বোপরি অর্থনৈতিক স্বাধীনতা। এর ফলে মহিলাদের কেউ কেউ অনেকটা বেপরোয়া হয়ে উঠে।
প্রশ্ন : গড়ে বিয়ের কতদিন পর সেপারেশন/ডিভোর্স ঘটছে?
উত্তর : বাঙ্গালীদের ক্ষেত্রে এ ব্যাপারে আলাদা কোন গবেষণা ভিত্তিক তথ্য-উপাত্ত নেই। তবে লোকজনের সঙ্গে আলাপ আলোচনা করে অনুমান করা যায় শতকরা ১০ ভাগের মত বিয়েই এক বছরের মাথায় ভেঙ্গে যায়।
প্রশ্ন : ডিভোর্সের ক্ষেত্রে প্রধান ভূমিকা কার ছেলের না মেয়ের। অর্থাৎ ডিভোর্স কোন পক্ষ থেকে বেশী হচ্ছে?
উত্তর : এ ক্ষেত্রেও কোন উপাত্ত নেই। তবে অভিজ্ঞতার আলোকে বলা যায় মেয়েদের ভূমিকাই বেশী। ছেলেরা সহজে তালাক দিতে চায় না। কারণ তারা জানে তালাকের পরিনতি তার ক্ষেত্রে বিপরীত সঙ্গীর তুলনায় অনেক কষ্টকর। কারণ মেয়ে তালাক দিলে বা পেলে সে অনেক সরকারী বেসরকারী সুবিধা লাভ করবে। আর ছেলেকে ক্ষেত্র বিশেষে স্ত্রী ও সন্তানদের ভরণপোষন করতে হবে।
প্রশ্ন : ৯১১ কল রেট কেমন দ্বিতীয় প্রজন্মের মধ্যে?
উত্তর : এটা আমার মতে অনেক। প্রায় ৮০/৯০ পার্সেন্ট। কারণ পারিবারিক কলহের এক পর্যায়ে (প্রধানত স্ত্রীরাই) ৯১১ এ কল করে যার ফলে ডিভোর্স অবসম্ভাবী হয়ে উঠে।
প্রশ্ন : ফিজিক্যাল এবিউজের হার কেমন দ্বিতীয় প্রজন্মের কাপলদের মধ্যে?
উত্তর : তরুন প্রজন্মে ফিজিক্যাল এবিউজের হার কম। কারণ স্বামী জানে এর পরিনাম কি হবে। তবে নিতান্ত অসহ্য হলে ইমশনালি অনেক সময় স্বামী ফিজিক্যাল এবিউজ করে। তবে এর সংখ্যা অনেক কম। শতকরা হারে ৭/৮ এর বেশী হবে না।
প্রশ্ন : দ্বিতীয় প্রজন্মের বেলায় ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স কতটুকু ভূমিকা রাখছে সংসার ভাঙ্গার ক্ষেত্রে?
উত্তর : দ্বিতীয় প্রজন্মের দম্পতিরা উভয়ে শিক্ষিত হওয়ার কারণে ফিজিক্যাল এবিউজ কম হয়। অথবা এবিউজ শুরুর আগেই ৯১১ এ কল করা হয় এবং পুলিশের হস্তক্ষেপে সমস্যার সমাধান হয় অথবা ডিভোর্স এর মাধ্যমে দাম্পত্য জীবনের ইতি ঘটে।
প্রশ্ন : পরকীয়ার কারণে ঘর ভাঙ্গছে এরকম ঘটনার হার কি রকম?
উত্তর : নানা কারণে এর হারও কম নয়। ৮/১০% তো হবেই বলে আমার মনে হয়। আধুনিক যুগের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এর বদৌলতে পরকীয়া আরো সহজেই হচ্ছে।
প্রশ্ন : প্রবাসে ‘বৌ – শাশুড়ীর দ্বন্দ্ব’ কি কোন ভূমিকা রাখে সেপারেশনের বিষয়ে?
উত্তর : কানাডায় ব্যক্তি স্বাধীনতা, নারী স্বাধীনতা, প্রাইভেসী এ্যাক্ট ইত্যাদির ফলে ছেলে-মেয়েদের যে ইন্ডিপেন্ডেন্ট মাইন্ড গড়ে উঠে তাতে শ্বশুর-শাশুড়ীর সঙ্গে এক সঙ্গে থাকা খুবই কঠিন হয়ে উঠে। শ্বশুর-শাশুড়ী যদি সদাচারী, উদার, সহনশীল ও গঠনমূলক না হয় তাহলে পরিস্থিতির অবনতি হতে থাকে। আমি একটি বিয়ে ভাঙ্গার খবর জানি। শাশুড়ীর কারণে এক মাসের মধ্যে বিয়ে ভেঙ্গে গেছে।
প্রশ্ন : সংসারে কে কতটা আর্থিক কন্ট্রিবিউট করবে সে নিয়ে যদি দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয় তাহলে সেটিও কি ঘরভাঙ্গার পিছনে ভূমিকা রাখে?
উত্তর : প্রবাসে যেহেতু স্বামী-স্ত্রী দুজনেই আয় করে এবং দুজনেই ঘরের কাজে অংশগ্রহণ করে তাই উভয়েই সংসারের আর্থিক খরচে কন্ট্রিবিউট করবে এটা ধরে নেয়া হয়। কিন্তু অনেক সময় দেখা যায় স্ত্রী নিজের আয় থেকে সংসারে কন্ট্রিবিউট করতে চায় না। এরকম পরিস্থিতে সংসারে দ্বন্দ্ব শুরু হয় যা অনেক সময় ঘর ভাঙ্গার দিকে মোড় নেয়।
প্রশ্ন : স্বামী স্ত্রীর মধ্যে যখন সমস্যা তৈরী হয় তখন কাউন্সিলিং একটা বড় ভূমিকা রাখতে পারে ঘর না ভাঙ্গার পিছনে। এই কাউন্সিলিংটা কি ঠিক মত হচ্ছে না এখানে? উত্তর : প্রকৃত পক্ষে কাউন্সিলিং ই হচেছ পারিবারিক দ্বন্দ্ব নিরসনের সর্বোত্তম পন্থা। তবে আমাদের কমিউনিটিতে ভাল কোন কাউন্সিলিং প্রতিষ্ঠান নেই।