স্বল্প আয়ের মানুষেরা শ্রমবাজারের আনুকূল্য পাচ্ছে না
২০০০ সাল থেকে শুরু করে ২০১৫ সালের মধ্যে কানাডায় আয়ের ক্ষেত্রে বৈষম্য বেড়েছে। কানাডিয়ান সেন্টার ফর পলিসি অল্টারনেটিভ-এর এক নতুন রিপোর্টে এ তথ্য প্রকাশ পেয়েছে
সেপ্টেম্বর ২, ২০১৭
প্রবাসী কণ্ঠ ডেস্ক : পায়ের গোড়ালির হাড় ভেঙে যাওয়ার পর চিকিৎসার জন্য ইসাবেলা ডালেকে এক বন্ধুর কাছ থেকে ১৬৯ ডলার ধার করতে হয়। তিনি plaster করার ব্যয় বহন করতে পারেননি। সেজন্য তাকে বেশ কয়েকদিন কাজ বাদ দিয়ে বিশ্রামে থাকতে হয়েছে। আর কাজে অনুপস্থিতির জন্য ওই কয়েকদিনই তাকে বিনা বেতনে ছুটি নিতে হয়েছে। এর ফলে পরিস্থিতি আরও কঠিন হয়ে ওঠে। তার সময়গুলো আরও কঠিন ছিলো যখন ২০০৫ সালে তার ২২ বছর বয়সী ছেলে মারা যায়। সেই বিয়োগ বেদনার তুলনায় এই হাড় মচকে যাওয়ার ব্যথা নিতান্তই সামান্য।
ইসাবেলা ডালে বলেন, “ছেলেকে কবর দেয়ার মত অর্থ আমার ছিলো না। কেন থাকবে? আমার সন্তানের জন্য কোনও বীমা করা ছিলো না।” তিনি আরও বলেন, “আমার কোনও সঞ্চয়ও ছিলো না। সন্তানের শেষকৃত্যের জন্য কে সঞ্চয় করে?”
তিনি সন্তানের শেষকৃত্যের ব্যবস্থা করেন সেইসব মানুষের অনুদানে যাদেরকে তিনি কখনই চিনতেন না।
বর্তমানে হ্যামিলটনে বসবাসকারী ডালে তিনটি খন্ডকালীন চাকরি করেন। তারপরও গত এক বছরে বিভিন্ন চাকরী থেকে তিনি সর্বমোট বেতন পেয়েছেন মাত্র ১৫ হাজার ডলার।
৫৫ বছর বয়সী ডালে হলেন আয়-বৈষম্য বেড়ে যাওয়ায় আর্থিক দিক থেকে টানাপোড়নের মধ্যে বসবাসকারী হাজার হাজার অন্টারিওবাসীর একজন। কানাডিয়ান সেন্টার ফর পলিসি অল্টারনেটিভ-এর নতুন এক রিপোর্টে জানা গেছে, অন্টারিওর মোট জনগণের মধ্যে সবচেয়ে ধনী অর্ধেক লোক প্রদেশটির আয়ের ৮১ শতাংশ নিয়ে যান। অবশিষ্ট অর্ধেক মানুষ আয় করেন মোট আয়ের মাত্র ১৯ শতাংশ। ২০০০-২০০২ সালে আয়ের বৈষম্য ছিলো ৭৮-২২ শতাংশ। তা থেকে বেড়ে বর্তমান পর্যায়ে পৌঁছেছে।
লুজিং গ্রাউন্ড নামের ওই গবেষণার লেখক স্বাধীন গবেষণা প্রতিষ্ঠানটির জ্যেষ্ঠ অর্থনীতিবিদ শেইলা বলেন, “আয়ের দিক থেকে শীর্ষ পর্যায়ে অবস্থানরত অর্ধেক পরিবার তাদের কাজের জন্য ক্রমশই বেশি হারে অর্থ পাচ্ছে।”
তিনি বলেন, “আয়-কাঠামোর সবচেয়ে নিচে অবস্থারত অর্ধেক মানুষের জন্য চিত্রটা সম্পূর্ণ ভিন্ন। তাদের মজুরি দিন দিন কমছে এবং শ্রমবাজার তাদের জন্য কোনওরকম আনুকূল্য দেখাচ্ছে না।”
রিপোর্টে বলা হয়, ঝুঁকিপূর্ণ ও স্বল্প-মজুরির কাজ বাড়তে থাকায় মন্থর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং পণ্য উৎপাদন খাতে এক ধরণের ধসের কারণে অন্টারিওর স্বল্প আয়ের পরিবারগুলোর ওপর অনানুপাতিক হারে বিরূপ প্রভাব সৃষ্টি করছে।
এতে বলা হয়, সরকারের স্থানান্তর ও শুল্ক নীতি ওই প্রভাব কমিয়ে আনতে সহায়ক হলেও ন্যূনতম মজুরি বাড়ানো এবং সংগঠন গড়ে তোলার বিষয়টি সহজতর করার একটি প্রস্তাবিত আইন পাস করা দীর্ঘদিন ধরেই ঝুলে আছে।
শেইলা বলেন, কানাডায় গড় আয় গত ১৫ বছর ধরে নিরবচ্ছিন্নভাবে বাড়তে থাকলেও অন্টারিওতে ২০০০ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত তা স্থবির হয়ে ছিলো। তবে ২০১৪ সালে অন্টারিওতে গড় আয় কিছুটা বাড়ার লক্ষণ দেখা যায়। ওই পুরো সময় ধরেই স¦ল্প আয়ের মানুষদের আয় ক্রমশ কমতে থাকলেও ন্যূনতম আয়ের মানুষদের ক্ষেত্রে তা মাত্রাতিরিক্ত হারে কমেছে।
এদিকে সর্বোচ্চ আয়ের মানুষদের গড় আয় বেড়েছে।
সবচেয়ে ধনী ১০ শতাংশ মানুষের আয় না বড়লেও ২০১৫ সালে তারা গড় পরিবারগুলোর চেয়ে এক লাখ ৮৪ হাজার ৯১৯ ডলার বেশি আয় করেছেন।
শেইলা বলেন, “শ্রমবাজার কিছু কিছু কর্মজীবীর জন্য সুবিধা সৃষ্টি করে দিচ্ছে অন্যদের ক্ষতির কারণ ঘটিয়ে।” তবে তিনি আরও বলেন যে, এটি কোনও কাকতালীয় বিষয় নয় যে, একইসঙ্গে সংগঠিত হওয়ার হার কমে আসছে।
যদিও কানাডার ৯০ শতাংশ পরিবারের আয় বেড়েছে তবু আয়ের ক্ষেত্রে বিরাজমান বৈষম্য উল্লেখযোগ্য পরিমাণেই রয়ে গেছে।
রিপোর্টে বলা হয়, “কানাডার গড় পারিবারিক আয়ের ১৮১ শতাংশ আয় করেছে সবচেয়ে ধনী ১০ শতাংশ পরিবার। এতে করে এদেশের শ্রমবাজারের দুর্বিনীত ও অনমনীয় চরিত্রের ইঙ্গিত
পাওয়া যায়।”
ঝুঁকিপূর্ণ ও স্বল্প-মজুরির কাজের পরিমাণ বেড়ে যাওয়া সর্ব নি¤œ আয়ের মানুষদের কাজ বেছে নেয়ার সুযোগ কঠিন করে দিয়েছে।
ইসাবেলা ডালে বলেন, “আপনার সন্তান যদি কোনও ফিল্ড ট্রিপে যায় তাহলে আপনার অবস্থা হবে সঙ্কটজনক, আপনার সন্তানেরা যদি বেড়ে উঠতে থাকে তাহলে জন্য সেটাও সঙ্কটের কারণ।” ডালের মেয়েদের একজনের বয়স ১৯, অন্যজনের ২৪ এবং তারা দুজনেই বাড়িতেই থাকে।
দারিদ্র্য নিরসন সম্পর্কিত হ্যামিলটনের এক গোলটেবিল আলোচনায় ডালে বেঁচে থাকার মতো মজুরির পক্ষে সুপারিশ করেন। তিনি বলেন, “এমনকি মুদির দোকানে গেলেও ভাবতে হয়, শ্যাম্পু কিনবো নাকি ঘরবাড়ি পরিষ্কারের সরঞ্জাম কিনবো।”
১০ ও ১৪ বছরের দুটি সন্তানের পিতা স্কারবরোর বাসিন্দা এমারি কোল ওই চ্যালেঞ্জটা বোঝেন। তিনি বলেন, “ওদের জুতা দরকার, কাপড় দরকার, বই দরকার। আমি জানি না কীভাবে এসব চাহিদা মেটাবো।”
পেশাগতভাবে একজন ওয়েল্ডার মি. কোল ২০০৬ সাল থেকে ১৫টির বেশি কাজে যোগ দিয়েছেন। কিন্তু অন্টারিওতে পণ্য উৎপাদন খাতের ক্রমবনতির কারণে তাকে অনেকবার কারখানা বন্ধের কারণে চাকরি হারাতে হয়।
এখন তিনি তার তরুণ প্রজন্মের চাকরি খুঁজে পাওয়া নিয়ে উদ্বিগ্ন।
তিনি বলেন, “কানাডায় আমি একটি বড় ধরণের বিপর্যয় ঘনিয়ে উঠতে দেখতে পাচ্ছি।”
রিপোর্টে বলা হয়, আয় কাঠামোর বিভিন্ন স্তরের পরিবারগুলো সরকারের কর্মসূচির কারণে লাভবান হলেও একেবারে নি¤œস্তরের মানুষদের জন্য সেটা জটিলতর কারণ ট্যাক্স কেটে নেয়ার পর তারা যে অর্থ হাতে পান সেটা দিন দিন কমে যাচ্ছে।
শেইলা বলেন, “এখন শ্রমবাজার এবং কর্মীদের ‘ন্যায্য হিস্যা’ বুঝিয়ে দেয়া দরকার।”
তিনি বলেন, অন্টারিওর জন্য যে জিনিসটি সবচেয়ে বেশি দরকার সেটা হলো, ১৪৮ নম্বর বিল বা সুষ্ঠু কর্মক্ষেত্র ও উত্তম চাকরির আইন অনুমোদন। তিনি আরও বলেন, আইনটি পাস হলে নিয়োগদাতারা যাতে সেটি যথাযথভাবে মেনে চলে তা নিশ্চিত করারও প্রয়োজন রয়েছে।
উল্লেখ্য, প্রাদেশিক বিধানসভা ন্যূনতম মজুরির পরিমাণ ১১.৪০ ডলার থেকে বাড়িয়ে ২০১৯ সালের মধ্যে ১৫ ডলার করা এবং সংগঠিত হওয়ার নিয়ম-কানুন পাল্টানোর প্রস্তাব করেছে। – টরন্টো স্টার