কাছে থেকে বৃদ্ধ বাবা-মায়ের সেবা যত্ন করতে না পারায় অপরাধবোধের যন্ত্রণায় অভিবাসীরা
জুন ২৬, ২০১৭
খুরশিদ আলম : মায়ের পায়ের নিচেই সন্তানের বেহেস্ত। ইসলাম ধর্মে এই কথা বর্ণিত আছে। অন্যদিকে একটি ইহুদি প্রবাদ আছে এই রকম – ‘ঈশ্বর সব জায়গায় নাও থকতে পারেন, সেই জন্য তিনি মাকে সৃষ্টি করেছেন।’ বাবা সম্পর্কেও আছে নানান প্রবাদ এবং উক্তি। যেমন – ‘পৃথিবীতে অসংখ্য খারাপ পুরুষ আছে, অসংখ্য খারাপ জন্মদাতাও আছে, কিন্তু একটিও খারাপ বাবা নেই। সন্তানের ভালোর জন্য জীবনের অনেক কিছুই নির্দ্বিধায় ত্যাগ করেন বাবা।’ বাবা সম্পর্কে আরো বলা হয় – ‘The greatest gift I ever had came from God; I call him Dad!’
বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থে, হাদিসে, মনীষী ও বিদ্বানদের বর্ণনায়, গানে এবং কবিতায় বাবা মার প্রতি অনুগত্য প্রকাশ ও ভালবাসার কথা বলা হয়েছে। মা নামের এই মধুর শব্দটির সঙ্গে পৃথিবীর আর কোন শব্দের তুলনা হয় না। মা শাশ্বত, মা চিরন্তন। মায়ের নিঃস্বার্থ ভালবাসার তুলনা হয় না।
গীতিকার প্রণব রায়ের ভাষায় –
“ মধুর আমার মায়ের হাসি
চাঁদের মুখে ঝরে
মাকে মনে পড়ে আমার
মাকে মনে পড়ে ।।
তার মায়ায় ভরা সজল বীথি
সেকি কভু হারায়
সে যে জড়িয়ে আছে
ছড়িয়ে আছে
সন্ধ্যা রাতের তারায়
সেই যে আমার মা ।।
বিশ্ব ভূবন মাঝে তাহার নেই কো তুলনা”
পৃথিবীতে প্রতিটি সন্তানের কাছে মা পরম আরাধ্য। মা শব্দটাই অন্যরকম। এত প্রশান্তি এত নির্মলতা এত নির্ভরতা আর কোন শব্দে নেই। মায়ের ভালবাসা কোন কিছু দিয়েই পরিমাপ করা যায় না। সন্তানের জন্য মায়ের স্নেহ, মমতা আর ভালবাসা এবং মায়ের জন্য সন্তানের টান চিরায়ত। মা গত হলেও তার মধুর হাসি মধুর ভালবাসা স্মৃতিতে অম্লান হয়ে থাকে।
অন্যদিকে বাবার প্রতিও সন্তানের থাকে অগাধ ভালবাসা, শ্রদ্ধা ও সম্মান। বাবা শুধু একটি রক্তের সম্পর্ক নয়, বাবা ও সন্তানের মাঝে থাকে এক আত্মীক ও স্বর্গীয় সম্পর্ক। বাবা একটি পরম নির্ভরতার নাম। বাবা নিজের শেষ বিন্দু রক্ত দিয়ে হলেও সন্তানকে আলগে রাখেন যেমনটি রাখেন মা। বাবা তার সন্তানদের বড় করে তুলতে এবং যোগ্য মানুষ হিসাবে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করতে গিয়ে নিজের সুখ স্বচ্ছন্দ্য ও আনন্দকে বিসর্জন দেন। সন্তানের জন্য বাবার স্নেহ, আদর আর ভালবাসা থাকে সীমাহীন।
কিন্তু বাবা মা আর সন্তানদের মধ্যে এই যে স্নেহ ভালবাসা আর আদরের স্বর্গীয় সম্পর্ক, সেই সম্পর্ক কি অটুট থাকে যারা দেশে বাবা মাকে ফেলে এসে প্রবাসে স্থায়ী বসতি স্থাপন করেন? বিশেষত বাংলাদেশ থেকে বহু দূর দেশে যারা পাড়ি জমান? পৃথীবির এক পৃষ্ঠে বাংলাদেশ আর আরেক পৃষ্ঠে কানাডা। মাঝখানে যে এত সুবিশাল দূরত্ব, সেই দূরত্ব কি সম্পর্কের আত্মিক দূরত্বও সৃষ্টি করে?
কথায় বলে – চোখের আড়াল হলে মনেরও আড়াল হয় মানুষের সম্পর্ক। কিন্তু এ কথা কি বাবা মা আর সন্তানের সম্পর্কের বেলায়ও সত্যি? কানাডায় যারা বাস করেন তাদের সঙ্গে দেশে ফেলে আসা বাবা মা ও অন্যান্য আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে ভৌগলিক দূরত্বের পরিমাণটা খুব বেশী। প্রায় ১২ হাজার মাইলের দূরত্ব। অথবা বলা চলে অর্ধেক পৃথিবীর দূরত্ব! বিষুব রেখা বরাবর পৃথিবীটা একবার ঘুরে আসতে গেলে ২৫ হাজার মাইল দূরত্ব অতিক্রম করতে হয়। আর সে কারণে চাইলেও সহসাই বাবা মা’র সঙ্গে দেখা করা হয়ে উঠেনা কানাডা প্রবাসী বাংলাদেশীদের পক্ষে। অন্যদিকে বাংলাদেশ থেকেও বাবা মা বা অন্যকোন আত্মীস্বজনের পক্ষে এতটা দূরত্ব অতিক্রম করে আসা সম্ভব হয়ে উঠেনা সহসা। সেই সাথে আছে ইমিগ্রেশন ও ভিসা জটিলতা। কানাডা সরকার ভিসা প্রদানের ক্ষেত্রে যথেষ্ট কৃপণ। কৃপন বয়োবৃদ্ধ বাবা মাকে ভিসা প্রদানের ক্ষেত্রেও। নানারকম বাধা বিপত্তি তৈরী করে রেখেছে এই ক্ষেত্রে। আর খরচের বিষয়টিতো রয়েছেই।
কানাডায় বেশীর ভাগ বাংলাদেশীর আয় সীমিত। দুই বা তিন বছর পর পর পরিবারসহ দেশে যাওয়াটা তাদের জন্য অতি বিলাসিতার সামিল হয়ে দাড়ায় যার ক্ষতিপূরণ টানতে হয় পরবর্তী কয়েক বছর ধরে। এ সমস্ত কারণে প্রবাসী বাংলাদেশীদের পক্ষে দেশে ফেলে আসা বাবা মায়ের সঙ্গে নিয়মিত দেখা হয়ে উঠে না। কিন্তু তাদের মন পড়ে থাকে দেশে। প্রতিনিয়তই তাদের মনের পর্দায় ভেসে উঠে বৃদ্ধ বাবা মায়ের মুখখানি। তাদের জানতে ইচ্ছে করে, ‘মা তুমি কেমন আছ? সুগার লেভেলটা কি বেড়ে গেছে? কেন, ইনসুলিন নিচ্ছ না ঠিকমত? কোমরের ব্যাথাটা কমছে না? কেন কমছে না। ডাক্তারের কাছে গিয়েছিলে? কি বলে ডাক্তার? হার্টের কন্ডিশনটা ভাল আছেতো?’ এরকম আরো কত প্রশ্ন জাগে মনে। বাবার ব্যাপারেও একই প্রশ্ন জাগে।
হাত বাড়ালেই টেলিফোন। আজকাল ভিডিওতেও দেখা যাচ্ছে সবাইকে! মুহুর্তের মধ্যেই! কিন্তু প্রবাসীদের উদ্বিগ্নতা কি কমে তাতে? বাবা মায়ের কষ্টের কথা যখন প্রবাসীরা শুনে বা ভিডিওতে দেখে তখন উদ্বিগ্নতার মাত্রা আরো বেড়ে যায়। আর সেই সাথে বাড়ে তীব্র অপরাধবোধ। এই দৃষ্টিকোন থেকে বলা যায়, ‘চোখের আড়াল হলে মনেরও আড়াল হয়’ কথাটা প্রবাসীদের বেলায় প্রযোজ্য নয়। বিশাল ভৌগলিক ব্যবধানে থাকলেও প্রবাসীদের মনে সারাক্ষণই থাকে বাবা মায়ের প্রতি টান। থাকে তাদেরকে নিয়ে উদ্বেগ। গভীর রাতে টেলিফোনে লং ডিস্টেন্স রিং বেজে উঠলে অতংকিত হয়ে উঠেন প্রবাসীরা। তাদের মনে প্রথমেই যে চিন্তাটা আসে তা হলো, বাবা মায়ের কি কিছু হলো? কোন দুঃসংবাদ?
যারা দুর্বল চিত্তের মানুষ তাদের জন্য মধ্যরাতের লং ডিস্টেন্স রিং এর শব্দ একটি সমস্যাই বটে। আর মধ্য রাত কেন, দিনের যে কোন সময়ে লং ডিস্টেন্স রিং এর আওয়াজই আতংক ধরিয়ে দেয় যদি দেশে বাবা মা অসুস্থ অবস্থায় থাকেন। কানাডায় দুই চার বছর বা তারও বেশী সময় ধরে আছেন যে সকল প্রবাসী তারা দেশ থেকে টেলিফোনের মাধ্যমে কখনো দুঃসংবাদ পাননি এমন ঘটনা বিরল।
যে বাবা মায়েরা কোলে পিঠে করে একদিন আজকের এই প্রবাসী ছেলে মেয়েদেরকে বড় করেছেন, কত রাত না ঘুমিয়ে এবং কত কষ্ট সহ্য করে তাদের মানুষ করেছেন, সেই ছেলে মেয়েরা আজ প্রয়োজনের সময় কাছে থেকে বৃদ্ধ বাবা মার সেবা করতে পারছে না! অপরাধের মাত্রা আরো তীব্র হয়ে উঠে যখন প্রয়োজনীয় টাকা পয়সা দিয়েও সাহায্য করতে পারেন না কোন কোন প্রবাসী ছেলে মেয়ে। কারণ, তাদের আয় সীমিত।
অপর দিকে দেশেও চিকিৎসা ব্যবস্থা এখন অতি ব্যয়বহুল। প্রাইভেট হাসপাতাল বা ক্লিনিকগুলোতে গেলে চিকিৎসার নামে গলা কাটা হয়। এরকম ব্যয়বহুল হাসপাতালে বাবা মা কে ভর্তি করানো হলে সেই চিকিৎসার খরচ ভাল আয়ের প্রবাসীদের পক্ষেও মেটানো সম্ভব হয়ে উঠে না অধিকাংশ ক্ষেত্রে। তাছাড়া বিপুল পরিমাণ অর্থ নিয়ে থাকলেও চিকিৎসার মান নিয়ে রয়েছে প্রশ্ন। দেশে যারা নামী দামী চিকিৎসক তারা অসুস্থ হলে নিজেরাই চলে যান বিদেশে চিকিৎসা করানোর জন্য।
কোন বাবা মার একমাত্র সন্তান যদি প্রবাসে চলে আসেন স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য তবে সে ক্ষেত্রে সংকটের মাত্রাটা উভয় পক্ষের জন্য আরো কয়েক গুন বেড়ে যায়। যে সকল প্রবাসীর দেশে ভাই বোন রয়েছে তাদের উদ্বিগ্নতার মাত্রাটা কিছু কম থাকে। কিন্তু পরিবারের একমাত্র সন্তান হলে উদ্বিগ্নতার সীমা পরিসীমা থাকে না। কারণ, বৃদ্ধ ও অসুস্থ বাবা মায়ের সেবা যত্ন সন্তানেরা যতটা গুরুত্ব নিয়ে করবে অন্যেরা তা করবে না। তাছাড়া অসুস্থ অবস্থায় সবাই চান পরিবারের সদস্যরা কাছে থাকুক। ওতে মানুষের অসুস্থতা অনেকটাই হ্রাস পায় এবং মনের জোরও বৃদ্ধি পায়। কিন্তু একক সন্তান হলে দেশে বাবা মা সে সুযোগ থেকে বঞ্চিত হন, অপরদিকে প্রবাসে থাকা সন্তানের মানসিক যন্ত্রণা ও অপরাধবোধ হয়ে উঠে আকাশচুম্বী।
কিন্তু ব্যতিক্রম কি নেই? অবশ্যই আছে। দেশে পড়ে থাকা বাবা মায়ের খোঁজ নেন না এমন পাষন্ড সন্তানের উপস্থিতিও রয়েছে কানাডায়। এদেরকে কুসন্তানও বলা যেতে পারে। একটি সত্য ঘটনার উদাহরণ দেয়া যেতে পারে। এক বাঙ্গালী যুবক থাকতেন রাজধানী ঢাকার খিলগাঁও এলাকার সি ব্লকে। চেষ্টা-চরিত্র করে তিনি একসময় কানাডায় পাড়ি জমান। আসার সময় দেশে ছিল তার বিধবা মা। কানাডায় আসার পর প্রথম কিছু দিন মায়ের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল। পরে সেই যোগাযোগ আস্তে আস্তে কমতে থাকে। ইতিমধ্যে সেই যুকটি এক অবাঙ্গালী মেয়েকে নিয়ে লিভটুগেদার করতে থাকেন। তখন দেশে ফেলে আসা মায়ের সঙ্গে যোগাযোগ একেবারেই বন্ধ করে দেন তিনি। ওদিকে বৃদ্ধ মায়ের দেখা শুনা করার কেউ নেই দেশে। চিকিৎসা করানোর অর্থ নেই। একপর্যায়ে না খেয়ে থাকার অবস্থায় পতিত হন সেই মা তীব্র অর্থাভাবে। পাড়াপ্রতিবেশীরা নানান সূত্র ধরে ছেলের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেন। কিন্তু ছেলের দিক থেকে কোন সাড়া পাওয়া যায়নি।
ঘটনাটি প্রায় ১০ বছর আগের। হতভাগ্য ঐ বৃদ্ধা মহিলার এক প্রতিবেশীনির কাছে থেকে শুনা ঘটনা। পরে কি ঘটেছে তা আর এই প্রতিবেদকের জানা নেই। এতো গেলো দেশে ফেলে আসা এক মায়ের করুন কাহিনী। কিন্তু আমরা দেখছি খোদ কানাডাতেই বৃদ্ধ বাবা মায়ের প্রতি নিষ্ঠুর আচরণ করার ঘটনা ঘটছে। প্রবাসী কণ্ঠ ম্যাগাজিনের মার্চ ২০১৬ সংখ্যায় এ নিয়ে একটি প্রচ্ছদ প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছিল যার শিরোনাম ছিল ‘ইমিগ্রেন্ট পরিবারগুলোতে এলডার এবিউজের সংখ্যা বৃদ্ধ পাচ্ছে’। ঐ প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, কানাডায় বসবাসরত সাউথ এশিয়ান ইমিগ্রেন্ট পরিবারের কিছু কিছু বয়স্ক ব্যক্তি অধিকহারে নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। সাউথ এশিয়ান বয়স্ক ব্যক্তিদের মধ্যে ২৫% বাস করেন তাদের আত্মীয়-পরিজনদের সঙ্গে। সার্বিকভাবে কানাডিয়ানদের মধ্যে এই হার ৫%। সাউথ এশিয়ানদের মধ্যে এই হার বেশী হওয়ার কারণ- স্বল্প আয়, ভাষাগত সমস্যা, ইমিগ্রেন্ট স্ট্যাটাস, উচ্চমূল্যের বাসা ভাড়া এবং সাংস্কৃতিক পরিপ্রেক্ষিত। সাউথ এশিয়ান এই বয়স্ক ইমিগ্রেন্টদের কেউ কেউ নিভৃতে নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন কিন্তু তা প্রকাশ করছেন না লজ্জার কারণে এবং পরিবারিক ‘সম্মান বা সম্ভ্রম’ নষ্ট হবে এই ভয়ে।
বিদেশে বৃদ্ধ বাবা মাকে নিয়ে আসার উদ্দেশ্য হওয়ার কথা একটু সেবা যত্ন করা। কিন্তু তা না করে তাদের উপর নির্যাতন চালানো হচ্ছে! নির্যাতনের শিকার হওয়া এইসকল বাবা মায়ের কারো কারো ঠাই হচ্ছে শেল্টারে!
প্রসঙ্গ ক্রমে এখানে একটি উদ্বৃতি দেওয়া যেতে পারে। “এক ব্যক্তি রাসুল (সা.)-এর কাছে এসে জিজ্ঞেস করল, ইয়া রাসুলাল্লাহ (সা.), আমি সর্বাগ্রে কার সঙ্গে সদাচরণ করব? রাসুলাল্লাহ (সা.) উত্তরে বললেন, তোমার মায়ের সঙ্গে। লোকটি আবার বলল, তারপর কে? তিনি বললেন, তোমার মা। লোকটি পুনরায় জিজ্ঞেস করল, তারপর কে? উত্তরে তিনি বললেন, তোমার মা। লোকটি আবার জিজ্ঞেস করল, অতঃপর কে? রাসুলাল্লাহ (সা.) বললেন, তোমার বাবা। (বোখারি-মুসলিম শরিফ)।”
এই যে মা এবং বাবা, যাদের প্রতি সদাচরণ করার কথা বলা হয়েছে তা যদি যথাযথভাবে পালন করা না হয়, তাদের প্রতি যদি যথাযথ সম্মান দেখানো না হয়, তাদের সেবা যত্ন যদি সঠিক ভাবে করা না হয় তবে তার দায় সম্পূর্ণভাবে সন্তানের উপরই বর্তায়।
একটি শিশুর যখন জন্ম হয় তখন সেই জন্মলগ্ন থেকে শুরু করে প্রতিটি পদে পদে মা বাবা সন্তানের জন্য সব রকমের ত্যাগ স্বীকার করেন। সেই ত্যাগ মৃত্যুর পরও অব্যাহত থাকে। অর্থাৎ মৃত্যুর পর বাবা মায়ের সকল সম্পত্তি সন্তানেরাই ভোগ করেন। তাহলে সেই মা বাবার প্রতি সন্তানেরা কেন তাদের কর্তব্য পালন করবেন না?
আমরা প্রায়শই লক্ষ্য করি কোন কোন সন্তানের অবহেলার কারণে বৃদ্ধ বাবা মাকে মানবেতর জীবন যাপন করতে হয়। পত্রপত্রিকায় সব খবর না আসলেও তার কিছু কিছু ঘটনা প্রকাশ পেয়ে যায়। আর এগুলো পড়তে গেলে গা শিউড়ে উঠে। এরকমই একটি গা শিউড়ে উঠার ঘটনা ঘটেছিলে বছর দুই আগে বাংলাদেশের নারায়ণগঞ্জে। ঢাকার এক পত্রিকার খবরে বলা হয়, “ নারায়ণগঞ্জে ভরণপোষন দেওয়া থেকে বাঁচতে বস্তাবন্দি অবস্থায় সন্তানদের দ্বারা রাস্তায় ফেলে যাওয়া সেই আলোচিত দুখিনী মা বৃদ্ধা হাসিনা বেগমের (৮০) মারা গেছেন।
গত ১৩ জুলাই ফতুল্লা শাসনগাঁও এলাকার রাস্তায় বস্তাবন্দি অবস্থায় হাসিনা বেগমকে পাওয়া যায়। ওই সময় তিনি জানান, ছেলে মেয়েরা ভরণপোষণ না দিয়ে উল্টো তাকে বস্তায় ভরে ওই স্থানে ফেলে যায়। তবে হাসিনা বেগম তার সন্তান ও পরিবারের কারো নাম বলতে পারেনি, দিতে পারেন নি নির্দিষ্ট ঠিকানাও। পরে হাসিনা বেগমকে উদ্ধার করে প্রথমে ১০০ শয্যা বিশিষ্ট নারায়ণগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এর মধ্যে অনেকেই তার সাহায্যে এগিয়ে আসেন। গত ১ সেপ্টেম্বর শহরের আয়শা-আলমাস নামে একটি বেসরকারি বৃদ্ধাশ্রমে পুনর্বাসন করা হয় হাসিনাকে। সেখানে গত সোমবার তার অবস্থার অবনতি হলে প্রথমে শহরের পলি ক্লিনিক চিকিৎসা দেওয়া হয় শুক্রবার রাত সোয়া ১০ টায় তার অবস্থার অবনতি ঘটলে রাজধানীর হলিফ্যামিলি হাসপাতালে নেওয়া হয়। রাত সোয়া ১১টা তার মৃত্যু হয়।”
ভাবা যায়না এরকম অবহেলা আর এরকম করুন মৃত্যু! মানুষ এত অমানুষ হয় কি করে? কদিন আগে ঢাকার প্রথম আলো পত্রিকায় একটি খবরের শিরোনাম ছিল ‘পাঁচ ছেলের চারজনের হাতেই মার খেয়েছেন শতবর্ষী বাবা’। পরে বিষয়টি শুনানি পর্যন্ত গড়ায় এবং ছেলেরা বাবার কাছে ক্ষমা চান। খবরে বলা হয়, “পাঁচ ছেলের চারজনের হাতেই মার খেয়েছেন শতবর্ষী বাবা জামির উদ্দিন শেখ। মার খেলেও বাবা জামির উদ্দিন শেখ সন্তানদের ক্ষমা করে দিয়েছেন।
ঝিনাইদহের শৈলকুপার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ওসমান গণির অফিসে সন্তানদের উপস্থিতিতে শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে তিনি সন্তানদের ক্ষমা করে দেন।
ওসমান গণির অফিস কক্ষে সকালে শুনানির একপর্যায়ে সন্তানেরা তাঁদের ভুল বুঝতে পারেন। বড় ছেলে সাহেব আলী বাবার পা ধরে ক্ষমা চান। ছেলেরা বাবার সঙ্গে আর কোনো দিন খারাপ ব্যবহার করবেন না বলে অঙ্গীকারও করেন। তাঁরা এখন থেকে বাবার ভরণপোষণ, চিকিৎসার খরচসহ যাবতীয় দায়িত্ব পালন করবেন।
ছেলেরা বাবাকে নির্যাতন করলেও বাবা তার মহানুভবতা দেখিয়েছেন তাদেরকে ক্ষমা করে দিয়ে।
বাবা মা বৃদ্ধ হয়ে গেলে তাদের আচরণ হয়ে উঠে অনেকটাই শিশুদের মত। এই বিষয়টি ছেলেমেয়েদেরকে অনুধাবন করতে হবে। মনে রাখতে হবে, এই বাবা মা-ই একসময় নিজ সন্তানদের অনেক অন্যায় আবদারও সহ্য করেছেন।
আগেই উল্ল্লেখ করা হয়েছে যে, এই প্রবাসেও বৃদ্ধ বাবা মা’র প্রতি অবহেলা ও নির্যাতনের ঘটনা ঘটছে। কিছু কিছু বাঙ্গালী পরিবারেও তা ঘটছে। কিন্তু যারা এহেন অপকর্ম করছেন তাদের মনের মধ্যে কি কোন অপরাধবোধ জাগ্রত হয়? বা অনুশোচনা? হয়তো হয়, অথবা নাও হতে পারে। যাদের মধ্যে অপরাধবোধ জাগ্রত হয় না বা কোন অনুশোচনা হয় না তারা মানুষ নামের কলংক।
অনেকে হয়তো ভাবতে পারেন, আমরা বাবা মাকে কাছেই পাই না, তারা থাকেন সেই সাত সমুদ্র তের নদীর ওপারে। আর যারা বাবা মাকে এই সুদূর প্রবাসে কাছে পেলেন তারা করেন এহেন আচরণ?
দেশে ফেলে আসা বাবা মায়ের ব্যপারে প্রথম প্রজন্মের প্রবাসীদের মনে আরো একটি অপরাধবোধ এবং একই সঙ্গে বেদনাও কাজ করে। সেটি হলো, প্রবাসে দ্বিতীয় প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা তাদের দাদা-দাদী ও নানা-নানীকে মিস করছে। এই মিসিং এর কারণে হ্যারিডিটি বা বংশগতিও ব্যহত হচ্ছে। শিশু সন্তানদের মধ্যেও দাদা-দাদী ও নানা-নানীকে কাছে না পাওয়ায় রয়েছে মনবেদনা। এর প্রমাণ মিলে সেন্টার অব এক্সিলেন্স ফর রিসার্স অন ইমিগ্রেশন এন্ড সেটেলমেন্ট এর নলেজ এক্সচেঞ্জ অফিসার মনিকা ভেলেনসিয়ার একটি নিরীক্ষায়। পরিকল্পনা অনুযায়ী তিনি ১০ জন শিশু শিক্ষার্থীর হাতে সাদা কাগজ ও ক্রেয়ন (রঙ্গিন পেন্সিল) তুলে দিয়ে বলেন কানাডা আসার পর তাদের মনের মধ্যে সবচেয়ে বেশী যে বিষয়গুলো প্রভাব বিস্তার করেছে সে সম্পর্কে কিছু ছবি আঁকার জন্য। এই শিশুদের বয়স ছিল ৯ থেকে ১১ বছর। তারা যে ছবি আঁকে তার মধ্যে দিয়ে ফুটে উঠে তাদের মনের গভীরে লুকিয়ে থাকা কিছু বেদনার চিত্র। এর মধ্যে ছিল দেশে ফেলে আসা তাদের দাদা-দাদী, নানা-নানী ও অন্যান্য আত্মীয়-স্বজনের জন্য আকুতি। তাদেরকে ফেলে আসায় এই শিশুদের মনের মধ্যে সর্বক্ষণ কাজ করছে এক গোপন বেদনা।
দাদা-দাদী, নানা-নানী ও অন্যান্য আত্মীয়-স্বজনকে কাছে না পেয়ে ইমিগ্রেন্টদের দ্বিতীয় প্রজন্মের মধ্যে বেদনা বোধ কাজ করে। কিন্তু অপরাধবোধ হয়তো কাজ করে না। কারণ, তারা নিজেদের সিদ্ধান্তে কানাডায় আসেনি। অপরাধবোধ কাজ করে প্রথম প্রজন্মের ইমিগ্রেন্টদের মধ্যে। কারণ তারা নিজেদের সিদ্ধান্তে এবং নিজেদের ভবিষ্যত চিন্তা করে বাবা মাকে ফেলে কানাডায় চলে এসেছেন। আসার আগে হয়তো বাবা মার বিষয়টি নিয়ে অতটা ভাবেননি তারা। কিন্তু আসার পর এখন অনুধাবন করতে পারছেন বাবা মার স্নেহ আদর আর ভালবাসা থেকে নিজেরা যেমন বঞ্চিত হচ্ছেন তেমন বঞ্চিত করছেন শিশু সন্তানদেরও তাদের দাদা-দাদী, নানা-নানী ও অন্যান্য আত্মীয়-স্বজনের আদর ও ভালবাসা থেকে। স্নেহ আদর আর ভালবাসাতো স্বর্গীয় বিষয়। এগুলোতো অর্থ দিয়ে কেনা যায় না। শক্তিশালী কানাডীয় ডলার দিয়েও না। কানাডার অর্থ বিত্ত, নিরাপদ জীবন, উন্নত ও ফ্রি চিকিৎসা, ফ্রি শিক্ষা ব্যবস্থা এর কোনটাই বাবা মার অভাবকে পুরণ করতে পারে না। পুরণ করতে পারে না স্নেহ আদর আর ভালবাসার অভাবকে।
এই পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে মূলত বর্তমান যুগের বিশ্বায়ন এবং ইমিগ্রেশন প্রক্রিয়ার কারনে। এর জন্য যে প্রথম প্রজন্মের ইমিগ্রেন্টরাই দায়ী তা ষোলআনা বলা যাবে না। পূঁজিবাদী বিশ্বব্যবস্থা শোষণ, নিপিরন আর যুদ্ধবিগ্রহের মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী মানুষের মধ্যে তৈরী করেছে অস্থিরতা নিরাপত্তাহীনতা আর দারিদ্রতা। বিশ্বপূজিবাদ এর কারণে বিশ্বের গুটিকতক মানুষ ধনী থেকে সুপার ধনী হচ্ছেন আর অন্যদিকে বিপুল সংখ্যক মানুষ দরিদ্র থেকে আরো দরিদ্র হচ্ছেন। সম্প্রতি প্রকাশিত অক্সফ্যামের গবেষনা পত্রে বলা হয়, বিশ্বের সবচেয়ে ধনী আট ধনকুরের হাতে কুক্ষিগত হয়ে আছে ৩৬০ কোটি মানুষের সমপরিমাণ সম্পদ। আর কানাডার মাত্র দুই ব্যক্তির হাতেই কুক্ষিগত হয়ে আছে ১ কোটি ১০ লাখ দরিদ্র মানুষের সমপরিমান সম্পদ। কানাডার মোট জনসংখ্যই ৩ কোটির সামান্য উপরে।
এই বিষয়গুলো বর্তমান বিশ্বে মাইগ্রেশন প্রক্রিয়াকে উদ্বুদ্ধ করেছে এবং সেই সাথে মাইগ্রেটেড মানুষগুলোর মধ্যে তৈরী করেছে নতুন এই সমস্যা। মাইগ্রেশন প্রক্রিয়া পৃথিবীতে আগেও ছিল। কিন্তু তার ব্যাপকতা এখনকার মত ছিল না। অন্যদিকে মাইগ্রেটেড মানুষের জন্য সহজ কোন আইন বা অন্যান্য সুযোগ সুবিধাও পূঁজিবাদী বিশ্ব রাখেনি যাতে করে তারা সহজে ও স্বল্প ব্যয়ে দেশে ফেলে আসা বাবা মা বা অন্যান্য আত্মীয় স্বজনের সঙ্গে ঘন ঘন দেখা করতে পারেন। কানাডাসহ নর্থ আমেরিকার যে সকল ইমিগ্রেন্ট এশিয়া থেকে এসেছেন তাদেরকে একবার পরিবারসহ দেশে যেতে হলে অন্তত ৫/৭ বছরের সঞ্চয় ব্যয় করতে হয়। অবশ্য সঞ্চয় যদি থাকে তাদের। পূঁজিবাদী ব্যবস্থা এমন সব আইন কানুন করে রেখেছে যাতে করে সাধারণ কর্মজীবী ইমিগ্রেন্টরা স্বচ্ছল না হতে পারেন। তাদের আয় থাকবে সীমিত। মাস শেষে ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করতে হবে এবং সুউচ্চ হারে সুদ দিতে হবে। বাড়ি কিনতে হলে ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে হবে। ২০/২৫ বছর পর দেখা যাবে ৪/৫ লাখ ডলারের ঋণের জন্য মোট সুদ গুনতে হয়েছে দেড় থেকে দুই লাখ ডলার।
অর্থাৎ প্রবাসীদেরকে পূঁজিবাদের কাজে জিম্মি হয়েই থাকতে হবে এবং সেই সাথে হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হতেই বাকী জীবন বাবা মাকে কাছে না পাওয়ার কারণে বা তাদের সেবা যত্ন করতে না পারার কারণে।
কানাডা প্রবাসী বেশীরভাগ ইমিগ্রেন্ট এর আয় এত সীমিত যে তারা বাবা মাকে কানাডায় স্পন্সরও করতে পারেন না। ফলে কানাডায় এনে তাদেরকে যে সেবা যত্ন করবেন সেই সুযোগও তাদের নেই। আর যাদের সুযোগ রয়েছে বাবা মাকে স্পন্সর করে কানাডায় নিয়ে আসার জন্য তারাও যে খুব একটা সুবিধাজনক অবস্থানে আছেন তাও বলা যাবে না। কারণ, দেখা গেছে বৃদ্ধ বাবা মাকে কানাডায় স্পন্সর করে নিয়ে আসার পর অনেকেই এখানকার বৈরী আবহাওয়া আর আত্মীয়-বন্ধুহীন পরিবেশে বেশীদিন থাকতে চান না। ঘরে তারা সারাদিন বন্দি জীবন যাপন করতে বাধ্য হন। বছরের বেশীর ভাগ সময়ই আবহাওয়া থাকে ঠান্ডা। কেউ তাদের বাইরে না নিয়ে গেলে একা একা যেতেও পারেন না। ভাষার সমস্যা, পথঘাট না চেনার সমস্যা, পরিচিতজন নেই সেটাও এক সমস্যা। দেশে রেখে আসেন অন্যান্য ছেলে মেয়ে ও আত্মীয়স্বজনদের। তাদের জন্যও মন টানে। সব মিলিয়ে একটা জটিল অবস্থার মধ্যে পড়তে হয় তাদেরকে। ফলে কানাডায় আসার পর অনেকেই আবার দেশে ফেরত চলে যান। এভাবে আবারো তৈরী হয় প্রবাসী ছেলে মেয়েদের সঙ্গে দূরত্ব। তখন অবশ্য প্রবাসী ছেলে মেয়েদের মধ্যে একটা সান্ত্বনা অন্তত তৈরী হয় যে, চেষ্টাতো করেছি।
প্রবাসীদের এই অপরাধবোধ নিয়ে গবেষণা করেছেন এমন দুজন গবেষক হলে ড. ক্যাথেরিন হল্ ওয়ার্ড এবং ড. আইরেন স্টেইলস। তাদের যৌথ গবেষণার একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অব এ্যাপ্লাইড সাইকোএনালাইটিক স্টাডিজ এ। প্রতিবেদনটির শিরোনাম হলো, ‘Guilt as a consequence of migration’। গবেষণায় তারা যা দেখতে পান তা হলো, মাইগ্রেশন কারো কারো ক্ষেত্রে অত্যধিক মানসিক চাপ সৃষ্টি করতে পারে। গবেষণা পরিচালনা করতে গিয়ে তারা যে সকল ইমিগ্রেন্ট এর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন তাদের কারো কারো মধ্যে দেখা গেছে বাবা মাকে পেছনে ফেলে আসায় তাদের মনের মধ্যে অপরাধবোধ অতি প্রচন্ডভাবে কাজ করছে এবং এই অপরাধবোধের স্থায়িত্ব দীর্ঘমেয়াদী। এই অপরাধবোধের জন্ম হয় প্রথমত, ছেলে মেয়েরা যখন বাবা মাকে দেশে ফেলে আসেন। দ্বিতীয়ত, যারা একমাত্র সন্তান (ছেলে বা মেয়ে) তারা যখন বাবা মাকে দেশে ফেলে আসেন। তৃতীয়ত, যখন এই ইমিগ্রেন্ট ছেলে মেয়েদের সন্তানদের সঙ্গে (প্রবাসে দ্বিতীয় প্রজন্ম) দাদা-দাদী বা নানা-নানীর সঙ্গে দূরত্ব তৈরী হয়। গবেষণায় আরো দেখা গেছে এই অপরাধবোধ ইমিগ্রেন্ট মহিলাদের মধ্যে খুব বেশী প্রভাব বিস্তার করে এবং এর পরিনতিতে ঐ মহিলার পরিবারেও নানারকম অশান্তি দেখা দেয়।
এই গবেষণায় যাদের সাক্ষাৎকার নেয়া হয়েছে তাদের মধ্যে একজন মহিলা বলেন, আমি বিদেশে আসার পর আমার শ্বশুরের অকাল মৃত্যু ঘটে। আমার কাছে মনে হয়েছে, তার এই অকাল মৃত্যুর জন্য আমিই দায়ী। কারণ, আমি তার নাতি নাতনিদের নিয়ে বিদেশে চলে এসেছি। আমার শ্বশুর জানতেন তিনি আর তার নাতি নাতনিদের দেখতে পাবে না। যখনই আমি এই বিষয়টি নিয়ে ভাবি তখনই তা আমাকে খুব পীড়া দেয়। সাঙ্ঘাতিক রকমের এক অপরাধবোধ কাজ করে আমার মধ্যে।
লেবাননে জন্ম নেয়া অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী রিমা সানবার বলেন, ‘আমার তিন সন্তানের কেউই দাদা-দাদী, নানা-নানী বা অন্যান্য আত্মীয়স্বজনের øেহ ভালবাসা পায়নি।’ ছবি : এসবিএস এরাবিক
অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন এর একটি রেডিও স্টেশন ‘এসবিএস এরাবিক’ এর সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী রিমা সানবার বলেন, ‘আমার তিন সন্তানের কেউই দাদা-দাদী, নানা-নানী বা অন্যান্য আত্মীয়স্বজনের স্নেহ ভালবাসা পায়নি।’
রিমা সানবার এর জন্ম লেবাননে। নিজের ও সন্তানদের সুন্দর ভবিষ্যত গড়ার স্বপ্ন নিয়ে প্রায় ১৮ বছর আগে তিনি বাবা মা ও অন্যান্য আত্মীয়স্বজনদের পিছনে ফেলে চলে আসেন অস্ট্রেলিয়ায়। তিনি বলেন, এই চলে আসাটা আমার পুরো পরিবারের উপরই প্রভাব বিস্তার করেছে।
এসবিএস রেডিওকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী নেলী স্কোফাটোগলূ বলেন, অস্ট্রেলিয়ায় আমার জীবনটা খুবই সুন্দর হতো যদি দেশে ফেলে আসা মায়ের কথা চিন্তা না করতে হতো। নেলী গ্রীস থেকে অস্ট্রেলিয়া আসেন ২০১৪ সালে। তিনি বলেন, আমি যদি দেশে ফোন দেই এবং ফোনে মাকে না পাই তখন অনবরত কল করতে থাকি। আমি প্রায় পাগল হয়ে যাই ঐ সময়। আমার মধ্যে তখন একটা অপরাধবোধ কাজ করে এই ভেবে যে, আমার মায়ের যদি কিছু হয়ে তবে আমিতো যথাসময়ে পৌঁছাতে পারবো না দেশে।
জর্জ এবং ক্লদিয়া কলম্বিয়া থেকে আসেন অস্ট্রেলিয়ায়। এখানে এসে তারা এক সময় নাগরিকত্বও পায়। বর্তমানে তারা অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্নে তাদের সন্তানদের নিয়ে ভালই আছেন। এসবিএস রেডিওকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে জর্জ বলেন, যখনই দেশে ফেলে আসা বাবা মায়ের কথা তাদের মনে আসে তখনই তাদের মনে অপরাধবোধ কাজ করে। তারা যখন অস্ট্রেলিয়ায় আসেন তখন তাদের বাবা মা মোটামুটি সুস্থ্যই ছিলেন। কিন্তু ইতিমধ্যে তাদের বয়স বেড়েছে। এখন তারা বৃদ্ধ। প্রায়ই তাদেরকে ডাক্তারের কাছে যেতে হয়। জর্জ বলেন যদি তাদের কোন এমার্জেন্সী প্রয়োজন দেখা দেয় তখন আমরা কি করবো? এটি আসলে সত্যিই খুব কঠিন কাজ ঐ সময়ে তাদের কাছে দ্রুত পৌঁছানো।
জর্জ এবং তার স্ত্রী ক্লদিয়া বলেন, কে জানে হয়তো আমাদের বাবা মার এই প্রয়োজনের দিনে আমাদেরকে শেষপর্যন্ত দেশেই ফিরে যেতে হবে।
টরন্টো প্রবাসী লেখিকা ঈশাত আরা মেরুনা প্রবাসী কণ্ঠে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, আমি যখন কানাডায় আসি, তখন ভাবিনি এতো কিছু। বুঝিওনি একদিন বাবা মা বৃদ্ধ হবেন… মনে হয়েছে তাঁরাতো তো এমনই থাকবেন আজীবন। ভুল। এখন স্বার্থপর লাগে নিজেকে। ভীষণ অপারগতা কুড়ে কুড়ে খায়…। বাবা মায়ের সেবা যত্ন করার জন্য দেশে ফিরে যাবো কোনদিন, এ আশা মনে লালন করি। তবে এর সাথে জড়িত সংসার সন্তান অর্থনৈতিক স্বাচ্ছন্দ্য আরো কিছু বিষয়। … অসহায়ত্ব গ্রাস করে। যতদিন তারা বেঁচে থাকবেন অন্ততঃ ততদিনের জন্যে… কেউ কী বলতে পারে সে কতদিন!
মেরুনা আরো বলেন, ১৬ বছর আগে যখন কানাডায় আসি, তখন আব্বা নিয়মিত চিঠি লিখতেন আমাকে মানসিকভাবে শক্ত করার জন্যে। দার্শনিকতায় ভরা নানা উপদেশ থাকতো সেসব চিঠিতে। খুব সহজভাবেই লিখেছিলেন একদিন, যদি কখনো মৃত্যুর খবর আসে, তখন বিচলিত না হতে। বিচলিত হয়ে প্লেনে না উঠতে। দীর্ঘ ভ্রমণ, শারীরিক মানসিক উদ্বেগ, এর চেয়ে ভালো দোয়া করা, কারণ এছাড়া আর কী ই বা করার থাকে!
টরন্টো প্রবাসী লেখক ও সাংবাদিক সুব্রত নন্দী প্রবাসী কণ্ঠে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, বাবা মারা যান হঠাৎ করেই। স্ট্রোক হয়েছিল। পরপর দুটো সন্তানের মৃত্যু ও বড় সন্তান হিসেবে স্বার্থপরের মতো কানাডায় চলে আসাতে উনি মানসিকভাবে বিপর্যস্ত ছিলেন। হ্যা একটা অপরাধবোধ সবসময়ই কাজ করে। বাবা হিসেবে শুধু নিজের বাচ্চাদের ভবিষ্যত চিন্তা করে মা কে ফেলে চলে এলাম!
এখন প্রশ্ন উঠতে পারে এই বলে যে, যারা দেশে থাকেন অর্থাৎ বৃদ্ধ বাবা মা, তাদের মধ্যেও কি কোন অপরাধবোধ কাজ করে? তারা কি কখনো মনে মনে এই ভেবে বিচলিত হন যে, কেন ছেলে মেয়েদের বিদেশে যেতে দিলাম? বিদেশ বিভুইয়ে ছেলে মেয়েরা কি করে, কেমন থাকে, আপদ বিপদ হলে কি ভাবে সামাল দেয়, অসুখ বিসুখে কে তাদের সেবা যত্ন করে, নাতি নাতনিগুলো কিভাবে অনাত্মীয় পরিবেশে বড় হচ্ছে এরকম আরো কত কিছুইতো তাদের মনে আসতে পারে এবং আসেও। আর এরকম মনে হওয়াটাই স্বাভাবিক।
দেশে যারা থাকেন তাদের চারপাশে অনেক আত্মীয়স্বজন থাকেন। এক ছেলে বা মেয়ে বিদেশে গেলেও আরো কয়েকজন নিজের কাছেই থাকেন। আছে পাড়া প্রতিবেশী যারা যে কোন প্রয়োজনে বা আপদে বিপদে এগিয়ে আসেন। ফলে একাকিত্ব বা অসহায়ত্ববোধটা তাদের মধ্যে কাজ করে না। কিন্তু বিদেশে সেই সুযোগ কোথায়? এই সকল বিবেচনায় এনে বৃদ্ধ বাবা মা নিশ্চই তাদের প্রবাসী ছেলে মেয়ের জন্য একটা উদ্বিগ্ন অবস্থায় দিন কাটান সবসময়। প্রবাস থেকে নিয়ম করে যারা প্রতি উইকএন্ডে ফোন করেন দেশে, সেই ফোন করা কোন এক সপ্তাহে বিরতি পড়লে দেশে বাবা মার উদ্বিগ্নতার সীমা থাকে না। কি হলো ছেলেটার বা মেয়েটার? অসুস্থ হয়ে পড়লো না তো? বা অন্য কোন বিপদ? তখন দেশ থেকেই ফোন কল শুরু হয়। আগের দিনগুলোতে তো দেশ থেকে ফোন করার তেমন সুযোগ ছিল না। তখন খুবই সমস্যা হতো তাদের।
আর যদি বিদেশে ছেলে মেয়েদের কোন আপদ বিপদ হয়ই তখন কি-ই বা করার থাকে দেশে পড়ে থাকা বাবা মায়ের? একে তো বয়সের ভার, তার উপর ভিসার জটিলতা। চাইলেই সহসা চলে আসা যায় না কানাডায়। ফলে এক ধরণের চাপা কষ্ট নিয়েই থাকতে হয় বাবা মায়ের।
দেশে বাবা মায়ের এই চাপা কষ্ট আর প্রবাসে ছেলে মেয়েদের অপরাধবোধ গোটা পরিবারকেই এক মানসিক পীড়ার মধ্যে ফেলে দেয়। কারো কারো ক্ষেত্রে এই পীড়া এক পর্যায়ে মানসিক রোগের কারণও হয়ে দাড়াতে পারে।
কিন্তু উপায় কি? যারা বিদেশে আসেন স্থায়ীভাবে বসবাস করার জন্য তাদের পক্ষে তো আর দেশে ফিরে যাওয়ারও উপায় থাকে না সাধারণভাবে। তাদের ছেলে মেয়েরা একসময় বড় হয়ে যায়। স্থানীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে ডিগ্রি নিয়ে চাকরীর বাজারে প্রবেশ করেন তারা, পাতেন সংসার। এদেরকে ফেলে রেখে তখন তাদের আর দেশে যাওয়া হয় না নিজ বাবা মায়ের সেবা যত্ন করার জন্য। দেশে ফেলো আসা বাবা মায়ের সেবা যত্ন করতে না পারায় প্রবাসীদের মধ্যে যে অপরাধবোধ কাজ করে, এ পর্যায়ে এসে সেই অপরাধবোধের মধ্যে নতুন মাত্রা যোগ হয়। তারা তখন অনুধাবন করতে পারেন সন্তানের প্রতি বাবা মায়ের যে স্নেহ ভালবাসা তার গুরুত্ব কতখানি গভীর। অথচ একদিন দেশে ছেড়ে চলে আসার সময় নিজ বাবা মায়ের মানসিক অবস্থা কি হতে পারে সে বিষয়টি নিয়ে তেমন ভাবে চিন্তা করেননি। আর বিদেশে গিয়ে কি পরিস্থিতির মুখমুখি হতে হবে নিজেদেরকে তাও আন্দাজ করতে পারেননি।
কানাডায় যারা নতুন এসেছেন অথবা যাদের অনেক দিন হয়ে গেল কানাডায়, তাদের এই অপরাধবোধ কাটানোর কয়েকটি উপায় বাতলেছেন ক্লিনিকাল সাইকোলজিস্ট যোশেফ মেথিও যিনি এই বিষয়টির সঙ্গে পরিচিত। এসবিএস রেডিওর ওয়েবসাইটে প্রকাশিত তার পরামর্শ হলো :
১. আধুনিক প্রযুক্তি যেমন টেলিফোন, ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, ভিডিও কল ইত্যাদি ব্যবহার করে দেশে অবস্থানরত বাবা মা বা অন্যান্য আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ স্থাপন করা।
২. আর্থিক সহায়তা ও অন্যান্য সহায়তা প্রদান করা।
৩. বৃদ্ধ বাবা মায়ের সেবা যত্ন করার জন্য কাজের লোক ঠিক করে দেয়া।
৪. বছরে একবার অন্তত দুই সপ্তাহের জন্য দেশে গিয়ে বাবা মার পাশে থেকে আসা। সম্ভব হলে বাবা মাকেও মাঝে মধ্যে বিদেশে নিয়ে আসা।
৫. অপরাধবোধ থেকে যদি উদ্বেগ, দুশ্চিন্তা, ভয় ইত্যাদির সৃষ্টি হয় তবে কাউন্সিলার বা মনোরোগ চিকিৎসকের স্মরনাপন্ন হওয়া।
যোশেফ মেথিও মনে করেন, যদি কারো মধ্যে অপরাধবোধটা বেশী মাত্রায় কাজ করে এবং এর কারণে যদি বিষাদ বা মর্মযন্ত্রণা সৃষ্টি হয় তবে তার উচিৎ হবে বিষয়টি নিয়ে মনোরোগ চিকিৎসকের সাথে পরামর্শ করা যাতে পরিস্থিতি আরো খারাপের দিকে মোড় না নেয়।
যখন বিদেশে আসি তখন বুঝিওনি একদিন আব্বা আম্মা বৃদ্ধ হবেন, মনে হয়েছে তারা তো এমনই থাকবেন আজীবনএখন স্বার্থপর লাগে নিজেকে : ভীষণ অপারগতা কুড়ে কুড়ে খায়… ঈশাত আরা মেরুনা
দেশে রেখে আসা বৃদ্ধ বাবা মাকে কাছে উপস্থিত থেকে সেবা যত্ন করতে না পারায় অপরাধবোধে ভুগেন প্রবাসীরা। কিন্তু জীবনের বাস্তবতা প্রবাসীদেরকে বঞ্চিত করে রেখেছে সেই সুযোগ থেকে। বিষয়টি নিয়ে প্রবাসীদের মনের মধ্যে কি প্রতিক্রিয়া হচ্ছে সে সম্পর্কে কয়েকটি প্রশ্ন করা হয় টরন্টোতে বসবাসরত কবি ও লেখক ঈশাত আরা মেরুনার কাছে। নিচে তা তুলে ধরা হলো।
ঈশাত আরা মেরুনার বাবার বয়স ৮৫, মার ৭৫। ডায়াবেটিস, পারকিনসন’স ডিজিজ সহ বার্ধক্যজনিত আরো নানাবিধ জটিলতা আছে তাদের। চলাফেরা খুব একটা করতে পারেন না দু’জনই। স্ট্রোক হবার পর তার মায়ের কথাও স্পষ্ট বোঝা যায়না। বাসাতেই থাকেন তারা। মেরুনার দুই ভাই দেশেই থাকেন। বড় ভাই এবং তার পরিবার বাবা মার সাথেই। প্রায় বিশ বছর যাবত বাসার কাজের সহকারী নার্গিস। মূলত: নার্গিসই তাদের দেখাশোনা করেন।
মেরুনা তার বাবা মাকে কানাডায় নিয়ে আসার চেষ্টা করেননি কখনো। কারণ, তারা কখনোই বিদেশে এসে থাকতে চাননি। মেরুনা জানান, “আম্মা অবশ্য কানাডায় ঘুরে গেছেন। ছিলেন বছরখানিক। কিন্তু সবাইকে রেখে দেশে, এখানে থাকার ইচ্ছে পোষণ করেননি।”
মেরুনা জানান তার বাবা মার সঙ্গে যোগাযোগ হয় প্রতিদিনই। টেলিফোনে। মাঝে মাঝে ভিডিও কলেও। মেরুনা জানান, “আগে বাবা মাকে দেখার জন্য ৪/৫ বছর পর পর যাওয়া হতো দেশে। কিন্তু এখন ওদের শরীর বেশি খারাপ হওয়াতে বছর দুইয়ের ভেতর যাবার চেষ্টা করি।”
গভীর রাতে বা অন্য যে কোন সময় দেশ থেকে লং ডিস্টেন্স ফোন আসলে প্রথমেই মনের মধ্যে কি উকি মারে? এই প্রশ্নের জবাবে মেরুনা বলেন, “দুঃসংবাদ। মৃত্যুসংবাদ…এবং তাই-ই আসে….”
মেরুনার কাছে প্রশ্ন ছিল, বিদেশে থাকার কারণে আপনি নিজে তাদের দেখাশুনা করতে পারছেন না। এ জন্য কি আপনার মনে কোন অপরাধবোধ কাজ করতো?
উত্তরে তিনি জানান, “জ্বি কাজ করে অপরাধবোধ। ১৬ বছর আগে যখন কানাডায় আসি, তখন আব্বা নিয়মিত চিঠি লিখতেন আমাকে মানসিকভাবে শক্ত করার জন্যে। দার্শনিকতায় ভরা নানা উপদেশ থাকতো সেসব চিঠিতে। খুব সহজভাবেই লিখেছিলেন একদিন, যদি কখনো মৃত্যুর খবর আসে, তখন বিচলিত না হতে। বিচলিত হয়ে বিমানে না উঠতে। দীর্ঘ ভ্রমণ, শারীরিক মানসিক উদ্বেগ, এর চেয়ে ভালো দোয়া করা, কারণ এছাড়া আর কী ই বা করার থাকে!
এসব ভাবিনি আগে। কিন্তু এখন যতই বছর পেরোয়, আব্বা-আম্মার যে ছবি চোখে ধরে দেশ থেকে এসেছিলাম, তা যখন পাইনা… যতবার যাই, দেখি, তারা বৃদ্ধ থেকে বৃদ্ধতর, শীর্ণ থেকে শীর্ণকায়…। তখন ভেতরে ভেতরে ভীষণ মুষড়ে পড়ি। ভেংগেচুরে যাই। কাউকে বোঝানো যায়না…”
মেরুনা আরো বলেন, “ তাদেরকে এ দেশে নিয়ে আসা যেত। কিন্তু তাতেই বা কী! বাস্তবতা তো ভিন্ন। ২৪/৭ এর প্রাত্যহিকতায় তাদেরকে কী তাদের প্রাপ্য সময়টুকু দেয়া যেতো? ভাবি কখনও। অন্ন বস্ত্র বাসস্থান স্বাস্থ্য ছাড়াও মানুষের দরকার মানসিক সেবা। বৃদ্ধ বয়সে তার প্রয়োজন আরো বেশি। পরিচিত পরিবেশ থেকে উঠিয়ে আনলেই হয়না, নার্সিং দরকার হয়। গাছের মতো। মাছ যেমন পানি ছাড়া বাঁচেনা। সেগুলো কতটুকু যথাযথভাবে করতে পারে প্রবাসীরা, দেখিতো। এক দোটানা অপরাধবোধ তো থাকেই। অনেকেই বাবা মাকে দেশে টাকা পাঠান তাদের ঔষধ-পথ্য বা নানা কারণে। তবে এটা শুধু কর্তব্য। বাবা-মায়ের কোন অবদান এ জীবনে পরিশোধযোগ্য নয়। তৃপ্তি আসারও কথা নয়।”
মেরুনার বাবা মা দুজনেই শিক্ষক ছিলেন। তিনি জানান, “ছোটবেলায় দেখেছি দেশের বাইরের বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকুরীর প্রস্তাব আব্বা ফিরিয়ে দিয়েছেন বহুবার, শুধু আমার দাদা-দাদুকে দেখভাল করবেন বলে। আমার নানা-নানু যখন অসুস্থ, নানার ক্যান্সারের চিকিতসার সময়ও আম্মাকে দেখেছি পরিচর্যা করতে। তারা যে ডিসিশান নিতে পেরেছেন, স্বাবলম্বী বলে, তা অনেকের পক্ষেই সম্ভব হয়না। মেয়েদের পক্ষেতো আরো দুরুহ। তবে এখন অবস্থা পাল্টেছে।
আমি যখন বিদেশে আসি, তখন ভাবিনি এতো কিছু। বুঝিওনি একদিন তারা বৃদ্ধ হবেন… মনে হয়েছে আব্বা আম্মা তো এমনই থাকবেন আজীবন। ভুল। এখন স্বার্থপর লাগে নিজেকে। ভীষণ অপারগতা কুড়ে কুড়ে খায়…”
আপনার বাবা মা এখন বৃদ্ধ। তাদেরকে কাছে থেকে সেবা যত্ন করার জন্য দীর্ঘ সময় হাতে নিয়ে দেশে ফিরে যাবার কোন চিন্তা ভাবনা আছে কি? এ প্রশ্নের জবাবে মেরুনা বলেন, “দেশে ফিরে যাবো কোনদিন, এ আশা মনে লালন করি। তবে এর সাথে জড়িত সংসার সন্তান অর্থনৈতিক স্বাচ্ছন্দ্য আরো কিছু বিষয়। এ মুহুর্তে যেতে পারলে খুব ভালো, আবার কয়েক বছর পর হলে হয়তো আরেকটু থিতু হওয়া যাবে সব দিক দিয়ে… অনেক ভাবনা মাথায় ঘোরে। অসহায়ত্ব গ্রাস করে। ‘যতদিন তারা বেঁচে থাকবেন অন্ততঃ ততদিনের জন্যে’… কেউ কী বলতে পারে সে কতদিন!”
গভীর রাতে দেশ থেকে ফোন এলে অজানা আশঙ্কায় বুকের ভেতর ছ্যাত করে উঠে, মা বেঁচে আছেন তো!
সুব্রত নন্দী একজন কৃষি বিজ্ঞানী। পাশাপাশি একজন সাংবাদিক ও লেখক। প্রথম আলোর টরন্টো প্রতিনিধি তিনি। টরন্টো আছেন বেশ কয়েক বছর ধরে। তার কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল, দেশে রেখে আসা বৃদ্ধা মাকে কাছে উপস্থিত থেকে সেবা যতœ করতে না পারায় অপরাধবোধে ভুগেন কি না। তিনি যা বলেন তা নিচে তুলে ধারা হলো।
বাবা মারা গেছেন হঠাৎ করেই। স্ট্রোক হয়েছিল। পরপর দুটো সন্তানের মৃত্যু ও বড় সন্তান হিসেবে স্বার্থপরের মতো কানাডায় চলে আসাতে উনি মানসিকভাবে বিপর্যস্ত ছিলেন।
মা বেঁচে আছেন। বয়স এখন একাত্তর। তিনি শারীরিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। ডায়াবেটিক উচ্চ রক্তচাপ এবং আর্থাইটিসে আক্রান্ত। আমার ছোট ভাইয়েরা তাঁকে দেখা শোনা করেন। কানাডায় আসার সাত বছর পর এখানে নিয়ে আসার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু তিনি আসতে চাইতেন না। এখন আসতে চান, কিন্তু শারীরিকভাবে অক্ষম।
মায়ের সঙ্গে যোগাযোগ হয় নিয়মিত? এ প্রশ্নের জবাবে সুব্রত বলেন, যোগাযোগ বলতে ফোন। মাঝে মাঝে ভিডিও কল করি। মাসে তিন দিন কথা হয়। আগে দেশে যেতাম দুবছর পর পর। এখন চারবছর পর।
তিনি বলেন, হঠাৎ দেশ থেকে ফোন এলে বিশেষ করে গভীর রাতে ফোন এলে অজানা আশঙ্কায় বুকের ভেতর ছ্যাত করে উঠে মা বেঁচে আছেন তো!
দেশে রেখে আসা বৃদ্ধা মাকে কাছে উপস্থিত থেকে সেবা যত্ন করতে না পারায় অপরাধবোধে ভুগেন কি না এ প্রশ্নের উত্তরে সুব্রত বলেন- হ্যা, একটা অপরাধবোধ সবসময়ই কাজ করে মনের মধ্যে। বাবা হিসেবে শুধু নিজের বাচ্চাদের ভবিষ্যত চিন্তা করে মা কে ফেলে চলে এলাম সুদূর এই প্রবাসে! টাকা পাঠিয়ে ঢাকায় বন্ধু বান্ধব ডাক্তারদের কাছে পরামর্শ করে মা কে চিকিৎসার ব্যবস্থা নিই।
বাবা মাকে দেশে ফেলে আসার কারণে নিজেকে কখনো স্বার্থপর বলে মনে হয়েছে আপনার? এ জন্য কি কোন অপরাধবোধ আছে আপনার মনে? এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, হ্যা তাই মনে হয়। খারাপ লাগে। মানুষ মাত্রই কমবেশি স্বার্থপর ।
সুব্রত আলো বলেন, দেশে ফিরে গিয়ে তাঁকে দেখাশোনা করা আসলেই কঠিন। এখানে জীবিকার জন্য একটা অবস্থান আছে। দেশে গেলে কি করে খাবো?
আমরা বিদেশে থাকাতে আমাদের বৃদ্ধ বাবা মায়েরা সব সময়ই কষ্টে থাকেন
কারণ যেটাই হোক, সেই কষ্টের জন্য আমরা দায়ী
ফায়েজুল করিম একজন কৃষি বিজ্ঞানী। দেশে ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন ওতপ্রোতভাবে। কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের ভাইস প্রেসিডেন্ট (ভিপি) ছিলেন। টরন্টোতেও বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। তার কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল দেশে বৃদ্ধ বাবা মাকে ফেলে আসার কারণে এবং এখন কাছে থেকে তাদের সেবা যত্ন করতে না পারার কারণে কোন অপরাধবোধ কাজ করে কি না তার মধ্যে। উত্তরে তিনি যা বলেন তা এখানে তুলে ধরা হলো।
প্রশ্ন : আপনার বাবা ও মায়ের বয়স এখন কত?
উ: বাবা নেই। তিনি গত হয়েছেন আরো আগেই। মার বয়স এখন সত্তরোর্ধ্ব ।
প্রশ্ন : উনার শারীরিক অবস্থা কি রকম এখন?
উ: মোটামোটি ভালই আছেন। তবে মাঝে মাঝে বার্ধক্য জনিত কিছু সমস্যায় ভুগছেন। যেমন- পায়ে ব্যথা, খাবারে অরুচি, অনিদ্রা ইত্যাদি।
প্রশ্ন : দেখাশুনা কে করে?
উ: আমার ছোট দুই ভাই ও তাদের স্ত্রীরা।
প্রশ্ন : উনাকে কানাডায় নিয়ে আসার চেষ্টা করেছিলেন?
উ: কখনোই চেষ্টা করিনি কারণ আম্মা আমার ছোট দুই ভাইয়ের পরিবারের সান্নিধ্যে আর দেশের গ্রামের বাড়িতে থাকতেই আগ্রহী সব সময়।
প্রশ্ন : কতদিন পর পর আপনার মায়ের সঙ্গে যোগাযোগ হয়? যোগাযোগ মাধ্যমটা কি? শুধু টেলিফোন না ভিডিও যোগাযোগ?
উ: মাসে কয়েকবার শুধু টেলিফোনে যোগাযোগ হয়। গ্রামে ইন্টারনেট না থাকায় ভিডিও যোগাযোগ করা যায়না। তবে কোন সময় ছোট বোনের ঢাকার বাসায় এলে চেষ্টা করি ভিডিও যোগাযোগ করার।
প্রশ্ন : মাকে দেখতে দেশে যান কত দিন পর পর?
উ: অনেক বছর হলো এদেশে এসেছি। কিন্তু মাকে দেখতে দেশে যেতে পারিনি নানাবিধ কারণে ।
প্রশ্ন : গভীর রাতে বা অন্য যে কোন সময় দেশ থেকে লং ডিস্টেন্স ফোন আসলে প্রথমেই মনের মধ্যে কি উকি মারে?
উ: আত্মীয় স্বজন, বন্ধু বান্ধব, সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিচিতদের কাছ থেকে আমার প্রায়শই ফোন আসে। তাই লং ডিস্টেন্স ফোনে খুবই অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি দিনে দিনে। তাছাড়া ফেসবুকের মাধ্যমে ভাইবোন ও তাদের ছেলেমেয়েদের কাছ থেকে প্রতি মুহূর্তেই সবকিছুই জানা যায়। তাই হঠাৎ কোন কিছুর আশঙ্কা অমূলক ।
প্রশ্ন : বিদেশে থাকার কারণে আপনি নিজে আপনার মাকে দেখাশুনা করতে পারছেন না। এ জন্য কি আপনার মনে কোন অপরাধবোধ কাজ করে?
উ: মা-বাবাকে দেখাশুনা করা প্রত্যেক সন্তানের জন্য অবশ্য কর্তব্য। বার্ধক্যের সময় সন্তানের তাদের কাছে থাকা উচিত। কিন্তু জীবনের প্রয়োজনে ও অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে প্রবাসী হবার কারণে সেই কর্তব্য পালন করতে পারছি না সেজন্য খুব খারাপ অনুভব হয়।
প্রশ্ন : কি রকম সেই অপরাধবোধ? একটু বিস্তারিত বলবেন কি?
উ: সন্তানেরা মা-বাবার পাশে থাকলেই তাঁদের শান্তি । দূরে থাকলে তাঁরা মানসিক ভাবে ভাল থাকতে পারেন না। আমরা বিদেশে থাকাতে তাঁরা সব সময়ই কষ্টে থাকেন। যে কোন কারনেই হোক আমরা সেই জন্য দায়ী । সঙ্গ দেয়া ছাড়াও এই সময় তাঁদের খাবারদাবার, সেবা- শুশ্রূষা করা ও চিকিৎসার ব্যবস্থা করা একান্তই জরুরি । এইসব নিজে করতে না পারার কষ্ট তো আছেই।
প্রশ্ন : এই অপরাধবোধ থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য কোন পদক্ষেপ নিয়েছেন কি কখনো? নিয়ে থাকলে সেটা কি?
উ: দেশে থাকা ভাইবোনদের মাধ্যমে উপরোক্ত বিষয়গুলো সম্পর্কে খোঁজখবর নেয়া ছাড়া আমার কাছে এই সময় অন্য বিকল্পও নেই ।
প্রশ্ন : এতে কি আপনার মনে পরিপূর্ণ তৃপ্তি আসে এই ভেবে যে আপনি আপনার কর্তব্য যথাযথ পালন করেছেন?
উ: তৃপ্তি তো নয়ই বরং নিজের ভেতর এক ধরণের মানসিক যন্ত্রণা কাজ করে।
প্রশ্ন : মাকে দেশে ফেলে আসার কারণে নিজেকে কখনো স্বার্থপর বলে মনে হয়েছে আপনার? এ জন্য কি কোন অপরাধবোধ আছে আপনার মনে?
উ: রাজনৈতিক, সামাজিক অবিচার ও ষড়যন্ত্রের কারণে আমার দেশে উপস্থিতির জন্যই তাঁদের বেশী হয়রানির শিকার হতে হয়েছিল। তাই আমার কারণে যেন তাদের কষ্ট না হয় সেজন্যই দেশ ত্যাগ করেছিলাম, মায়ের সম্মতিতে। সন্তানের মঙ্গলের জন্যই মাকে মানসিক ভাবে শক্ত হতে হয়েছিল ।
স্বার্থপরতা হয় বরং সামাজিক অবস্থার বিরুদ্ধে সঠিক ভাবে লড়তে না পারার ক্ষোভ আছে।
প্রশ্ন : বৃদ্ধ মাকে দেখা শুনা করার জন্য দেশে চলে যাওয়ার কথা ভাবেন? স্থায়ীভাবে না হলেও অন্তত যতদিন তারা বেচেঁ থাকেন ততদিনের জন্য?
উ: আশাবাদী হয়ে সেদিনের অপেক্ষা করছি। সে ক্ষেত্রে এখানে আমার দুই ছেলের স্বাবলম্বী হওয়ার বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ ।
মায়ের জীবনের বাকিটা সময় যতদূর সম্ভব তাঁর পাশে থেকে সেবা করে কিছুটা হলেও অপরাধবোধ থেকে মুক্ত হতে চাই ।