কানাডার ফেডারেল সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা চাইল গুয়ান্তনামোর সাবেক বন্দী ওমর খাদারের কাছে
দেয়া হলো ১০.৫ মিলিয়ন ডলার ক্ষতিপূরণ
আগস্ট ১৫, ২০১৭
প্রবাসী কণ্ঠ ডেস্ক : কানাডার ফেডারেল সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা চাইল কুখ্যাত গুয়ান্তানামো বে’র সাবেক বন্দী ওমর খাদারের কাছে। একই সাথে কাদের কর্তৃক সরকারের বিরুদ্ধে চলমান মামলা বন্দের জন্য একটি আর্থিক মীমাংসায় পৌঁছেছে ফেডারেল সরকার। মীমাংসা অনুযায়ী ওমর ১০.৫ মিলিয়ন ডলার ক্ষতিপূরণ পেয়েছে সরকারের কাছ থেকে। সে সরকারের বিরুদ্ধে মামলা করে ২০ মিলিয়ন ডলার ক্ষপিপূরণ চেয়েছিল। ওমরের অভিযোগ ছিল সরকার তার নাগরিক অধিকারকে লঙ্ঘন করেছে। খবর সিবিসি নিউজের।
উল্ল্লেখ্য যে, ওমর সংক্রান্ত মামলায় ইতিমধ্যে সরকারকে ৫ মিলিয়ন ডলার খরচ করতে হয়েছে।
কানাডার পাবালিক সেফটি মিনিস্টার র্যাল্ফ গুডেল ও ফরেইন এ্যাফেয়ার্স মিনিস্টার ক্রিস্টিয়া ফ্রিল্যান্ড এক যৌথ বিবৃতিতে বলেন, “বিদেশের মাটিতে ওমর খাদার যে কঠিন শাস্তির মুখমুখি হয়েছে এবং সে কারণে তাকে যে ক্ষতি পোহাতে হয়েছে তাতে কানাডিয় কোন কর্মকর্তার কোন ভূমিকা থেকে থাকলে তার জন্য ফেডারেল সরকারের পক্ষ থেকে আমরা তার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করছি।”
মন্ত্রীদ্বয় আরো বলেন, “আমরা আশা করবো আমাদের পক্ষ থেকে এই অভিব্যক্তি এবং আর্থিক মীমাংসা ওমর খাদারকে সাহায্য করবে কানাডায় তার জীবনের নতুন এবং আশাব্যঞ্জক এক অধ্যায় শুরু করার ক্ষেত্রে।”
কানাডার ফেডারেল সরকার ইতিমধ্যেই ওমর খাদারের নামে ১০.৫ মিলিয়ন ডলারের একটি চেক ইস্যু করেছে যাকে কেউ কেউ ইসলামী জঙ্গী হিসাবে চিহ্নিত করছেন আবার কেউ কেউ তাকে শিশু সৈনিক হিসাবে দেখছেন যে কিনা চরম নির্যাতনের শিকার হয়েছে অন্যের দ্বারা। উল্ল্লেখ্য যে, সাম্প্রতিক সময়ে কানাডায় সবচেয়ে আলোচিত ব্যক্তিদের একজন হলেন ওমর খাদার। আফগানিস্তানে এক মার্কিন সৈন্য হত্যার অভিযোগে তাকে কুখ্যাত গুয়ান্তনামায় প্রায় ১৩ বছর জেল খাটতে হয়েছে যেখানে তার উপর চালানো হয়েছিল অমানবিক অত্যাচার। লিবারেল সরকার ঐ সময় ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় ওমরকে কুখ্যাত গুয়ান্তানামো বন্দি শিবির থেকে কানাডায় স্থানান্তরের কোন পদক্ষেপ নেয়নি। পদক্ষে নেয়নি পরবর্তী কনজারভেটিভ সরকারও। বরং কানাডার কর্তাব্যক্তিরা যখন গুয়ান্তানামায় ওমরের সঙ্গে দেখা করতে যান তখন ওমর তাদেরকে তার শরীরে বিভিন্ন স্থানে নির্যাতনের চিহ্ন দেখালে ঐ কর্তাব্যক্তিরা তাকে মিথ্যাবাদি বলে আখ্যায়িত করেন। তাকে কোনরকম সহায়তা দিতে চায়নি অতিতের কোন সরকারই। বরং কানাডিয়ানদের টেক্সমানি খরচ করে তার বিরুদ্ধে নানারকম আইনী প্রক্রিয়া চালিয়ে গেছে সাবেক কনজারভেটিভ সরকার। তবে শেষ পর্যন্ত ওমরকে কানাডায় ফেরত এনেছিল কনজারভেটিভ সরকার। কিন্তু নিজে থেকে নয়। বা নৈতিকতার খাতিরেও নয়। যুক্তরাষ্ট্রের চাপে পড়েই ওমরকে কুখ্যাত গুয়ান্তানামো বন্দি শিবির থেকে কানাডার জেলে স্থানান্তর করা হয়েছিল।
গুয়ান্তানামো বন্দি শিবিরে থাকা অবস্থায় ওমরকে স্বীকার করতে বাধ্য করা হয়েছিল যে সে যুদ্ধাপরাধী। এই স্বীকারটুকু না করলে সে গুয়ান্তানামো থেকে বেরিয়ে আসতে পারতো না। এই সুযোগে কানাডার সাবেক সরকারের মন্ত্রীরা এমনকি তখনকার খোদ প্রধানমন্ত্রী স্টিফেন হারপার দাবী করে আসছিলেন যে ওমর নিজেই স্বীকার করেছে যে সে মার্কিন যুদ্ধাপরাধী এবং প্রতিপক্ষ সৈন্যকে খুন করেছে। অথচ যুদ্ধ আইন বলে, যুদ্ধক্ষেত্রে প্রতিপক্ষের সৈন্যকে হত্যা করলে তা যুদ্ধাপরাধ নয়। তাছাড়া খোদ কানাডার সুপ্রিম কোর্টও বলেছে গুয়ান্তানামোতে যে নির্যাতন চালানো হয়েছে তা আইনবিরুদ্ধ।
২০১৫ সালের মধ্যভাগে যখন ওমর খাদারকে কানাডার জেল থেকে মুক্তি দেওয়া হয় তখনও বেশ বিতর্ক জমে উঠেছিল। কানাডার মেইনস্ট্রিম পত্রপত্রিকাগুলোও ওমরের ইস্যুতে বিভক্ত হয়ে পড়েছিল। রক্ষনশীলদের পত্রিকা হিসেবে পরিচিত টরন্টো সান তাদের সম্পাদকীয়তে তখন ওমরকে একজন “নিরাপত্তা ঝুঁকি” ব্যক্তি হিসেবে চিহ্নিত করে পাঠকদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে ওমরের বাবা ছিলেন ওসামা বিন লাদেনের অন্তরঙ্গ বন্ধু। পত্রিকাটি তখন এও বলে যে ওমরের পরিবার কানাডার প্রথম সন্ত্রাসী পরিবার।
অপরদিকে উদারপন্থী পত্রিকা টরন্টো স্টার তাদের সম্পাদকীয়তে লিখেছিল, ‘ওমর খাদারের উপর যে অবিচার করা হয়েছে তার লজ্জার ভার আমাদের সকলের।’ পত্রিকাটি আরো বলেছিল, ’কানাডা নাগরিক অধিকার রক্ষায় এবং আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় বদ্ধপরিকর বলে সবাই জানে। কিন্তু অটোয়া ওমরের বিষয়ে যে কদর্য ভূমিকা পালন করেছে তাতে করে কানাডার সেই ভাবমূর্তি যথেষ্ট পরিমানে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আর সেই ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধার সহসাই হবে বলে মনে হয় না।’
উল্ল্লেখ্য যে, ওমরের মানসিক অবস্থা পর্যবেক্ষন করে ইতিপূর্বে মনোরোগ চিকিৎসকরাও রায় দিয়েছেন এই বলে যে সে কানাডার জন্য কোন বড় ঝুঁকি নয়। মুক্তির পর সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলার সময় ওমর নিজেও বলেছে সে নতুন জীবন গড়ে তুলতে চায়। সে জঙ্গীবাদকে সমর্থন করে না। ওমরের আইনজীবীদের একজন নেট ওয়েটলিং বলেন, “ওমরের চিন্তায় বা চেতনায় জঙ্গীবাদ সমর্থনের কোন আলামতই নেই। কখনো কোন অবস্থায়ই তার মধ্যে জঙ্গীপনা বা জঙ্গীবাদের প্রতি কোন সমর্থনের কোন লক্ষণ দেখিনি।”
ওমর আফগানিস্তানে নিজের ইচ্ছায় যায়নি। তার বাবা ছিলেন জঙ্গীবাদে বিশ্বাসী। তিনিই ওমরকে তার ইচ্ছের বিরুদ্ধে সেখানে নিয়ে যান। ওমরের বয়স তখন মাত্র ১৫। রাজনীতি, সমরনীতি, জঙ্গীবাদ এগুলো বুঝার বয়স তার ছিল না তখন। সে ছিল ঘটনার শিকার। ভুল সময়ে ভুল স্থানে ছিল সে। যুদ্ধকালীন সময়ে যে স্থান থেকে ওমরকে গ্রেফতার করা হয়েছিল সেখানে একজন মার্কিন সৈন্য নিহত হন। ওমরকে ঐ ঘটনার জন্য দায়ী করা হয়। পরবর্তীতে ঐ মার্কিন সৈন্য নিহত হওয়ার ঘটনায় ওমর একাধিকবার ক্ষমাও চেয়েছেন।
ইতিপূর্বে কানাডার জেল থেকে মুক্তি পাবার পর ওমর খাদারকে নিয়ে বিতর্ক যেমন তুঙ্গে উঠেছিল, এবার সরকার ক্ষমা চওয়ার পর এবং তাকে ১০.৫ মিলিয়ন ক্ষতিপূরণ দেওয়ার পর সেই বিতর্ক আরো জোড়ালো ভাবে শুরু হয়েছে।
পাবলিক সেফটি মিনিস্টার র্যাল্ফ গুডেল স্বীকার করে বলেন ওমর খাদারের বিষয়ে কানাডিয়ানদের মধ্যে গভীর বিভক্তি দেখা দিয়েছে। কিন্তু তার বিষয়ে এই আর্থিক মীমাংসাটির প্রয়োজন ছিল। কারণ, কানাডার নাগরিক হিসাবে তার যে অধিকার রয়েছে সেটি লঙ্ঘন করা হয়েছে কানাডীয় কর্মকর্তাদের দ্বারা।
অন্যদিকে ফেডারেল কনজারভেটিভ পার্টির নবনির্বাচিত নেতা এন্ড্রু শিয়ার বলেন এটা খুবই ঘৃণ্য ও ন্যাক্কারজনক ঘটনা যে সরকার সিক্রেট ডিলের মাধ্যমে একজন কনভিক্টেট টেররিস্টকে কয়েক মিলিয়ন ডলার প্রদান করেছে । এটি স্পষ্টতই আমাদের সেনাবাহিনীর মুখের উপর চড় মারার মত একটি ঘটনা যারা প্রতিনিয়ত অবিশ্বাস্য বিপদের মধ্যে থেকে আমাদেরকে নিরাপদে রাখছেন।