মানব-হিতৈষী, রোল মডেল সোফি গ্রেগওয়া
স্বামী জাস্টিন ট্রুডোর পাশে তাঁর নিজের ঔজ্জ্বল্যও কম নয়
এপ্রিল ১৫, ২০১৭
প্রবাসী কণ্ঠ : সোফি গ্রেগওয়া কানাডার বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর সহধর্মীনি। যেমনি তার রূপ তেমনি তার গুণ। রূপে গুণে তার স্বামীও বিশ্বখ্যাত। বলা হয়ে থাকে বর্তমান বিশ্বে সর্বাধিক যৌন আবেদনময়ী প্রধানন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো।
সোফি গ্রেগওয়া সম্পর্কে লোকজনের জানার আগ্রহ কম নয়। তবে গত ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষ্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এক পোস্টিং দিয়ে বেশ বিতর্কের মধ্যে পড়ে যান তিনি। ঐ পোস্টে তিনি নারীদের প্রতি আহ্বান জানান তাদের পুরুষ মিত্র, বন্ধু বা সুহৃদদের ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্ট করার জন্য যারা তাদেরকে উৎসাহ যুগিয়েছেন তারা কে এটি অনুধাবন করার জন্য এবং যারা মহিলাদেরকে শ্রদ্ধা করেন। পোস্টটি ছড়িয়ে পড়ার পর অনেকেই একে ‘লজ্জাজনক’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। তবে প্রশংসাই বেশী হয়েছে। পোস্টটি দেয়ার পরপরই প্রায় ১৯ হাজার প্রতিক্রিয়ার মধ্যে ১৫ হাজারেরও বেশী লোক ‘লাইক’ বা ‘লাভ’ বাটনে প্রেস করেছেন। অনেকে ছবিও পোস্ট করেছেন তাদের পুরুষ সঙ্গীদের সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে।
যারা নেতিবাচক মন্তব্য করেছেন তাদের উদ্দেশ্যে সোফি গ্রেগওয়া বলেন, সমতার অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য নারী ও পুরুষ একে অপরের অংশীদার। তিনি আরো বলেন, আমি নারী ও পুরুষ, বালক ও বালিকাদের আহ্বান জানিয়েছি একে অপরের হাত ধরে আরো অধিকতর সমতার জন্য লড়াই করতে। আমি মনে করি পুরুষ এবং বালকরাও যদি সমতার এই লড়াইয়ে অংশীদার না হন তবে আমরা শান্তি ও সমৃদ্ধি লাভ করতে পারবো না যা আমরা প্রত্যাশা করি মানুষ হিসাবে। নারী পুরুষের সমতার অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য আমরা একটি দল, আমরা পরষ্পরের অংশীদার এবং আমরা একসঙ্গে অবস্থান করি। সম্প্রতি প্লান ইন্টারন্যাশনাল কানাডার এক অনুষ্ঠানে তিনি এ কথা বলেন।
কানাডিয়ান ওমেন’স ফাউন্ডেশনের প্রেসিডেন্ট ও চীফ এক্সিকিউটিভ অফিসার পলেট সিনিয়র এ প্রসঙ্গে টরন্টো স্টার পত্রিকায় প্রদত্ত এক বিবৃতিতে বলেন, পুরুষ ও বালকদের সহযোগিতা ছাড়া আমরা কখনোই সমাজে লিঙ্গ সমতা প্রতিষ্ঠা করতে পারবো না।
সোফি গ্রেগওয়া নিজে একজন লিঙ্গ-সমতার জোড়ালো প্রচারক এবং প্ল্যান কানাডার ‘Because I Am a Girl’ এর ন্যাশনাল এম্ব্যাসেডার। তার স্বামী জাস্টিন ট্রুডো নিজেকে একজন ফেমিনিস্ট বা নারীবাদী হিসাবে দাবী করেন। শুধু মুখে মুখে এই দাবী নয়। গত জাতীয় নির্বাচনে জয়লাভ করার পর তিনি তার মন্ত্রীসভায় অর্ধেক মন্ত্রীর নিয়োগই দিয়েছেন দলের মহিলা এমপি থেকে।
এরকম একজন নারীবাদী স্বামীর স্ত্রী হয়ে সোফি গ্রেগওয়া নিজে কতটা জোরালভাবে নারীবাদী সে বিষয়ে অনেকেরই কৌতুহল থাকতে পারে। সে কথায় পরে আসছি আমরা। তার আগে দেখে নেই তিনি কতটা মিডিয়া বান্ধব।
উল্লেখ্য যে, সোফি গ্রেগওয়া তার শ্বাশুরীর মতই ছিলেন একজন টিভি হোস্ট। বিভিন্ন চ্যারিটি কার্যক্রমের সঙ্গে তিনি ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত। তার মা ইসতেল ব্লে পেশায় একজন নার্স। বাবা জেন গ্রেগওয়া একজন স্টকব্রোকার। সোফির জন্ম মন্ট্রিয়লেই ১৯৭৫ সালের ২৪ এপ্রিল। এবং সেখানেই তিনি বড় হয়ে উঠেন। ম্যাকগিল ইউনিভারসিটিতে পড়েছেন কামার্সে। উদ্দেশ্য ছিল বাবার পেশায় যোগ দিবেন। কিন্তু পরে সিদ্ধান্ত পাল্টে কমিউনিকেশন বিষয়ে ভর্তি হন এবং মন্ট্রিয়ল ইউনিভারসিটি থেকে গ্রাজুয়েশন লাভ করেন।
ছাত্রী হিসাবে বেশ ভাল ছিলেন তিনি। খুব সহজেই কারো সাথে বন্ধুত্বও গড়ে তুলতে পারেন। খেলাধুলা পছন্দ করেন। তিনি জানান শৈশবে সময়টা সুখের ছিল।
ক্যারিয়ারের শুরুতে একটি বিজ্ঞাপনী সংস্থার রিসেপশনিস্ট কাম এ্যাসিস্টেন্ট ছিলেন। পরে একাউন্ট ম্যানেজার পদে উন্নীত হন। কিন্তু সেই পেশা বেশীদিন ভাল লাগেনি। বছর তিনেকের মাথায় তিনি মিডিয়া জগতের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে উঠেন। রেডিও টেলিভিশনের সাংবাদিকতা জগতের সঙ্গে নিজেকে ক্রমশ জড়িয়ে ফেলেন।
এ কারণে তার স্বামী জাস্টিন ট্রুডো যখন কানাডার প্রধানন্ত্রী হলেন তখনো তিনি মিডিয়া থেকে আড়ালে থাকেন নি। তিনি মিডিয়া বান্ধবই থেকে যান। আমরা দেখেছি, কানাডায় ইতিপূর্বেকার প্রধানমন্ত্রীদের স্ত্রীরা তেমনটা মিডিয়ায় আসেন নি। স্টিফেন হারপারের স্ত্রী লরেন হারপার, পল মার্টিন এর স্ত্রী শীলা মার্টিন, জন ক্রিশ্চিয়েন এর স্ত্রী এলিন ক্রিশ্চিয়েন, ব্রায়ান মালরুনীর স্ত্রী মিলা মালরুনী এদের কারোরই উপস্থিতি মিডিয়াতে তেমন ছিল না যেমনটা আজকে দেখতে পাচ্ছি সোফি গ্রেগওয়ারের ব্যাপারে। সোফি’র শ্বাশুড়ী সাবেক প্রধানমান্ত্রী পিয়ের ট্রুুডোর স্ত্রী মার্গারেট ট্রুডো অবশ্য মিডিয়াতে প্রচার পেয়েছিলেন বেশ। তিনিও সোফির মত টিভি হোস্ট ছিলেন। তবে মার্গারেট যে প্রচার পেয়েছিলন তার বেশ খানিকটা জুড়ে ছিল স্ক্যান্ডেল নিউজ।
জাস্টিন ট্রুডোর বাবা পিয়ের ট্রুডোর সঙ্গে মার্গারেটের বিয়ে হয় ১৯৭১ সালের ৪ মার্চ। প্রেমের বিয়ে। তখন তাদের মধ্যে বয়সের ব্যবধান ছিল ৩০ বছর। কিন্তু তা সত্বেও শুরুতে এই দম্পতির মধ্যে কোন সমস্যা দেখা দেয়নি। ভালই চলছিল সবকিছু। কিন্তু কয়েক বছর যেতে না যেতেই মার্গারেটের বিরক্ত হবার পালা শুরু হয়ে যায়। কারণ, পিয়ের ট্রুডো সরকারী কাজ ও রাজনীতি নিয়ে বেশী ব্যস্ত থাকতেন। সন্তানদের দেখাশুনার পুরো দায়িত্বই তখন মার্গারেটকে করতে হচ্ছিল। একপর্যায়ে কিছুটা বিষন্ন ও হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েন। মাদকাশক্তও। প্রধানমন্ত্রীর লাগেজে করে মাদক আনার দায়ে একবার নিজউ হেডলাইনও হন মার্গারেট। পরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটর টেড কেনেডির সঙ্গে সম্পর্কেও জড়িয়ে পরেন। এক পর্যায়ে ট্রুডোর সঙ্গে মার্গারেটের ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। সময়টা ছিল ১৯৭৭। ছাড়াছাড়ি হলেও আনুষ্ঠানিক ডিভোর্স হয়নি তখনো। মার্গারেট তখন বেপোরোয়া জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়ে পড়েন। তখন আদালতের মাধ্যমে তিন সন্তানের অভিভাবকত্বের দায়িত্ব পান ট্রুডো । ছাড়াছাড়ির পর মার্গারেটকে ট্রুডো কোনরকম স্পাউজাল সাপোর্ট দেননি। বছর দুই পরে যখন ট্রুডো নির্বাচনে পরাজিত হন তখন সেই খবর পেয়ে মার্গরেট নিউয়র্কের একটি নাইটক্লাবে নৃত্য করছিলেন। সেই নৃত্যের ছবি তখন অনেক পত্রিকার ফ্রন্ট পেজে ছাপা হয়েছিল ফলাও করে। তাদের আনুষ্ঠানিক ডিভোর্স হয় ১৯৮৪ সালে। এর কিছুদিন পরই মার্গারেট বিয়ে করেন অটোয়ার রিয়েল এস্টেড ডেভলাপার ফ্রেইড কেম্পারকে। এই ঘরে মার্গারেটের দুই সন্তানের জন্ম হয়।
২০০৬ সালের মে মাসে মার্গারেট সবাইকে জানান যে তিনি বাইপোলার ডিজঅর্ডার নামক এক মানসিক রোগে ভুগছিলেন। পরে ভাল হয়ে তিনি মানসিক রোগ প্রতিরোধে বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে কাজ করেছেন। কিন্তু তার এই রোগটি বিয়ের পর যখন পিয়ের ট্রুডোর সঙ্গে ঘর করছিলেন তখন ধরা পড়েনি। ফলে ঐ সময় তার অস্বাভাবিক আচরণগুলো কেন হচ্ছে তা অনুধাবন করা যায় নি।
একধরণের বিষন্নতা ও মানসিক রোগ অবশ্য সোফি’রও ছিল। তবে সেটা শৈশবে। তিনি অসম্ভব রকমে খেতে ভালবাসতেন। অর্থাৎ কোন রকম নিয়ন্ত্রণ ছিল না খাবার দেখলে। এ রোগটির নাম বুলিমিয়া (bulimia)। তবে তার বাবা-মা তাকে এই মানসিক রোগ থেকে বেড়িয়ে আসতে যথেষ্ঠ সহায়তা করেছেন। সোফি নিজেও তা খোলামেলা ভাবেই স্বীকার করেন।
মিডিয়াতে সাবলিল উপস্থির পাশাপাশি সোফি গ্রেগওয়ারের মানবিক গুণাবলীও খুব উঁচুমানের। তিনি একদিকে যেমন মনে করেন যে নারী পুরুষের সমতা প্রতিষ্ঠার জন্য পুরুষের অংশগ্রহনও জরুরী তেমনি মনে করেন পৃথীবিতে মানুষে মানুষে কোন মৌলিক পার্থক্য নেই। তিনি নিজেই বলেছেন প্রধানমন্ত্রীর স্ত্রী হওয়া সত্বেও আমি সোফি সোফিই রয়ে গেছি। মার্কিন রাজনীতিক হেনরী কিসিঞ্জার বা স্থপতি শিল্পী ফ্রেঙ্ক গেরীর সঙ্গে বসে লাঞ্চ করি আর কোন সাধারণ কৃষকের সঙ্গে তার খামারের সমস্যা নিয়ে কথা বলি-আমার কাছে তা বিশেষ কোন পার্থক্য বহন করে না। কারণ আমি এমন একটি পরিবেশে মানুষ হয়েছি যেখানে মানুষে মানুষে কোন মৌলিক পার্থক্য আছে এমনটা বিশ্বাস করা হয় না।
সোফি গ্রেগওয়া বলেন, মাঝে মাঝে আমার ইচ্ছে হয় এই রাজনৈতিক জীবন থেকে পালিয়ে একটু বনে গিয়ে একাকি ঘুড়ে বেড়াই, দৌড়-ঝাপ করি, আমার বাচ্চাদের সঙ্গে খেলি। এবং আমি সুযোগ পেলে এগুলো করি। এগুলো আমাকে আনন্দিত করে। অবশ্য মাঝে মাঝে যখন আমি আমার স্বামীর সঙ্গে রাস্তায় হাটি এবং দুপাশের জনতা আমাদের দিকে তাকিয়ে থাকেন,
ছবি তুলেন তখন আমি অনুভব করি এটি আমাদের প্রতি মানুষের ভালবাসা। এই ভালবাসাও উপভোগ করি।
আমি জানি অনেকে হয়তো উৎসুক একটি বিষয়ে জানতে যে, আমি কি আমার স্বামীর সঙ্গে কোথাও একটু নিরিবিলি সময় কাটাতে চাই? অবশ্যই আমি চাই। গলাটা একটু নামিয়ে কতকটা ফিসফিসিয়ে কথাটি বললেন তিনি। তিনি আরো বলেন, যে যতই ব্যস্ত থাকুক, তারা সবাই চান তার প্রিয় মানুষটার সঙ্গে নিরিবিলি কিছু সময় কাটাতে। সোফি বলেন, আমাদের সম্পর্ক অনেক স্থিতিশীল, আবেগের কিন্তু পরিপক্ক এবং অনেক খোলামেলা।
সোফি গ্রেগওয়া যখন কথা বলেন বিশেষ করে কোন প্রশ্নের উত্তর দেন তখন বেশ সাবলিলভাবেই কথা বলেন। এমন নয় যে, অনেক চিন্তাভাবনা করে কথা বলেন বা কোনরকম সংকোচ করে কথা বলেন। কোনরকম স্নায়বিক দুর্বলতা বা শীতলতাও লক্ষ্য করা যায় না তার কথা বলার সময় যেটা লক্ষ্য করা যেত পূর্ববর্তী অনেক প্রধানমন্ত্রীর স্ত্রীদের বেলায়। যেটা ছিল একধরণের ট্রেডিশন বজায় রেখে কথা বলার প্রবণতা যেটাতে মেকীত্ব প্রকাশ পায়।
সোফি আর জাস্টিন ট্রুডোর তিন সন্তান। বড়টির বয়স ৮, দ্বিতীয়টির বয়স ৭ এবং সবার ছোটটির বয়স ২ বছর। জাস্টিন ট্রুডোকে সরকারী কাজ এবং রাজনৈতিক কাজ নিয়ে অসম্ভব ব্যস্ত থাকতে হয়। প্রধানমন্ত্রীর স্ত্রী হওয়াতে সোফিকেও ব্যস্ত থাকতে হয় নানাভাবে। এরকম ব্যস্ততার জীবনে তিনটি সন্তান লালনপালন করা সহজ কথা নয়। ব্যাপারটি কিভাবে সামাল দেন এরকম একটি প্রশ্নের উত্তরে সোফি বলেন, মাঝে মধ্যে জাস্টিনকে আমার স্মরণ করিয়ে দিতে হয় যে সংসারেও মনোযোগ দিতে হবে। তখন সে হয়তো ওকে, সরি ইত্যাদি বলে। তবে সে জানে সংসারের বিষয়টি। আর আমরা একে অপরের খুব কাছাকাছি। আমরা আমাদের দায়িত্ব ও নৈতিকতা সম্পর্কে খুবই সচেতন।
সোফি গ্রেগওয়া প্রেম করেই বিয়ে করেছেন জাস্টিন ট্রুডোকে। তারা একজন আরেকজনকে চিনতেন সেই শৈশব থেকেই। কারণ সোফি ছিলেন জাস্টিনের ছোট ভাই মিশেল ট্রুডোর সহপাঠীনি। মিশেল ট্রুডো ১৯৯৮ সালে এক তুষার ধ্বসের দুর্ঘটনায় মারা যান। তবে সোফি আর জাস্টিনের মধ্যে সম্পর্ক গড়ে উঠে আরো অনেক পরে। সেটি ছিল ২০০৩ সালের ঘটনা যখন দুজনে একটি চ্যারিটি প্রগ্রামের সঙ্গে যুক্ত হন। তখন থেকেই একজন আরেকজনের প্রতি কৌতুহলী হয়ে উঠেন এবং কিছুদিনের মধ্যেই তা গভীর পরিনয়ে পরিনত হয়।
সোফি হাইস্কুল শেষ করার পর একদিন মন্ট্রিয়লের উত্তরে অবস্থিত ট্রুডো কটেজে এক পার্টিতে গিয়েছিলেন তার এক বয়ফ্রেন্ডের সাথে। সোফি বলেন, আমার মনে আছে সেদিন জাস্টিন আমাদেরকে বিয়ার সার্ভ করছিল। কিন্তু সে আমার দিকে একবারও তাকায় নি।
২০০৩ সালে চ্যারিটি প্রগ্রামের সঙ্গে যুক্ত হয়ে তারা আবার পুনরায় একজন আরেকজনকে নতুন করে জানা শুরু করেন। অতীতের দিনগুলোর কথা স্মরণ করেন। ট্রুডো বলেন, ঐ সময় আমরা হাসি-ঠাট্রায় মেতে উঠি। নিশ্চিতভাবেই তখন আমাদের মধ্যে একটা কেমিস্ট্রি কাজ করছিল। আমার তখন মনে হয়েছিল সোফিই সেই মেয়ে যাকে নিয়ে আমি গভীরভাবে চিন্তা করতে পারি।
সময়টা ছিল সামার। বিভিন্ন সামাজিক কর্মকান্ডে ট্রুডো তখন ব্যস্ত হয়ে পড়েন। এদিকে চ্যারিটি প্রগ্রাম থেকে ফিরে আসার কয়েকদিন পরে সোফি ট্রুডোকে একটি ইমেইল পাঠান। ইমেইলে তিনি ট্রুডোর সঙ্গে দেখা হওয়ায় তার আনন্দ অনুভূতির কথা জানান। কিন্তু ট্রুডো কেবল নাইস, ওকে, গুড এই জাতীয় দু একটি শব্দ লিখে দায় সারেন। চিঠির যা উত্তর হওয়া দরকার তার ধারে কাছে দিয়েও যাননি।
আসলে জাস্টিন তখনো চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে পারেন নি। অন্যদিকে জাস্টিনকে পাঠানো ইমেইলের উত্তর না পেয়ে সোফি কিছুটা আনইম্প্রেসড অবস্থায় ছিলেন তার সম্পর্কে।
পরে ঐ বছরই সামারের শেষে দুজনের দেখা হয় রাস্তায়। সোফি কথা না বাড়িয়ে কেবল হ্যালো বলে চলে যাচ্ছিলেন। কিন্তু ট্রুডো তার পিছু নেন। তার সব ব্যস্ততাই তখন কমে এসেছিল। তিনি সোফিকে বলেন, দেখ আমি আসলেই তোমাকে কল করবো ভেবেছিলাম। আমি চাচ্ছিলাম তোমার সাথে দেখা করি এবং ডিনারে যাই। ট্রুডো এই সময় সোফির নাম্বর চান যোগাযোগ করার জন্য।
সোফি তখন কিছুটা কঠিন মনোভাব প্রদর্শন করেন। তিনি বলেন, তোমার কাছেতো আমার নাম্বর থাকার কথা। সোফির সঙ্গে তখন তার এক বান্ধবী ছিল। সোফির এটিচ্যুড দেখে সেই বান্ধবীও তখন সোফির দিকে কড়া নজরে তাকান, ভাবখানা এই যে-তোমার সমস্যা কোথায় নাম্বর দিতে?
ট্রুডোর কাছে সোফির ইমেইল সেভ করা ছিল। সেই রাতেই তিনি সোফিকে ইমেইল পাঠান। পরে তারা দুজনেই নিকটস্থ একটি আফগান রেস্টুরেন্টে ডেটিং এ যাবার ব্যাপারে সম্মত হন।
ট্রুডো সোফিকে বিয়ের প্রস্তাব দেন প্রায় বছরখানেক পরে। সময়টা ছিল ২০০৪ সালের ১৮ অক্টোবর। ১৮ অক্টোবর জাস্টিন ট্রুডোর বাবা পিয়ের ট্রুডোর জন্মদিন। ঐ সময় তিনি বেঁচে থাকলে সেটা হতো তার ৮৫তম জন্মদিন?। সোফির জন্য এটি ছিল এক সারপ্রাইজ। সোফি বলেন, যদি সত্যি সত্যি ঐ সময়টা তিনি বেঁচে থাকতেন তবে নিশ্চই তার সাথে কতই না কথা হতো।
জাস্টিন কর্তৃক বিয়ের প্রস্তাবটা ছিল নাটকীয়। প্রথম নাটকীয়তা ছিল বাবার জন্মদিনে সোফিকে বিয়ের প্রস্তাব। দ্বিতীয় নাটকীয়তা ছিল এরকম – সেদিন তারা মন্ট্রিয়লের স্থানীয় এক হোটেলে (Hotel Le St-James) যান স্পা ট্রিটমেন্টের জন্য। তারা দুজনেই সেখানে হোল ডাবল ম্যাসেজ করান। কিন্তু যখন তারা ম্যাজেস রুম থেকে বেরিয়ে আসেন তখন দেখেন তাদের কাপড় যেখানে রাখা ছিল সেখান থেকে তা খোঁয়া গেছে! সেখান থেকে তাদেরকে নিয়ে আসা হয় রয়েল স্যুইটে বাহ্যত কাপড় খোঁজার ছল করে। তাদের পরনে তখনো স্পা’র ঢিলা গাউন। বিষয়টি আসলে ছিল একটি সাজানো নাটক। রয়েল স্যুইটে ছিল শ্যাম্পেইন ও ওয়েস্টার। ঘরময় জ্বালানো ছিল মোমবাতি আর ছড়ানো ছিল গোলাপের পাপড়ি। সেখানেই সোফির সামনে হাটু গেড়ে নাটকীয় ভঙ্গীতে বিয়ের প্রস্তাব দেন জাস্টিন। ২০০৫ সালের মে মাসে তাদের বিয়ে।
সোফি গ্রেগওয়া আর জাস্টিন ট্রুডোর দাম্পত্য জীবনের মূখ্য চাওয়া ছিল সন্তান। ট্রুডো চাইতেন বেশী সন্তান। তবে সোফি ততটা নয়। ট্রুডোর বক্তব্য ছিল, আমি চাই অন্তত তিন সন্তান। তবে আমি তিন জনেই সন্তুষ্ট হব পারফেক্টলি। অন্যদিকে সোফি তার বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান। ফলে তার পক্ষে এক সন্তান চাওয়াটাই স্বাভাবিক, সোফি বলেছিলেনও তাই। তবে দুটো হলেও ভাল, কিন্তু তিনটি হলে একটু বেশী হয়ে যায় না? এরকমই বক্তব্য ছিল সোফির। বর্তমানে এই দম্পতির তিন সন্তান।
বিয়ের পর সোফির কাছে সাংবাদিকদের প্রশ্ন ছিল, ভবিষ্যতে যদি রাজনৈতিক জীবন বেছে নেয়ার পরিস্থিতি সৃষ্টি হয় তবে তিনি বিষয়টিকে কিভাবে নিবেন?
উত্তরে সোফি বলেছিলেন, রাজনৈতিক জীবনে তাদের পদার্পন হতেও পারে আবার নাও হতে পারে। সেটি এখনো স্পষ্ট নয়। তবে যদি ঐ রকম পরিস্থিতি সত্যি সত্যি আসে আমাদের জীবনে তবে আমার দৃঢ় বিশ্বাস আছে আমি সেটি মোকাবেলা করতে পারবো এবং ঐ জীবনের সঙ্গে নিজেকে মানিয়েও নিতে পারবো। আমি জানি জাস্টিনের মধ্যে আছে ন্যায়পরায়নতা, সততা এবং চমৎকার জাজমেন্ট এর ক্ষমতা। কিন্তু কখনো কখনো আমার কাছে মনে হয় সে খুবই সেনসেটিভ এবং সেটাই আমার কাছে একটি উদ্বেগের বিষয়।
জাস্টিন ট্রুডো যদি হন কানাডার সবচেয়ে জনপ্রিয় পুরুষ তবে সোফি গ্রেগওয়ারকেও বলা যায় কানাডার সবচেয়ে জনপ্রিয় নারী। হতে পারে তার কিছু বিরুপ সমালোচক আছেন। যারা সামাজ কর্মী, রাজনৈতিক কর্মী বা যারা পাবলিক ফিগার কিংবা চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব, তাদের বিরুপ সমালোচক থাকবে না তা হয় না। বিরুপ সমালোচক থাকলে মাঝে মাঝে তা ভাল ফলও বয়ে নিয়ে আসে। জাস্টিন ট্রুডোরও সমালোচকের অভাব নেই। রক্ষণশীল ঘরনার কয়েকটি কানাডীয় পত্রিকায় প্রায় প্রতিদিনই তার সমালোচানায় কোন না কোন নিউজ বা ভিউজ থাকেই। এতে সুবিধা হলো, প্রধানমন্ত্রী সতর্ক থাকেন তার সব কাজে কর্মে।
আমরা জানি, প্রধানমন্ত্রীর স্ত্রীর পরিচয় ছাড়াও সোফির নিজেরও কিছু পরিচয় আছে। যেমন তিনি একজন লোকহিতৈষী, একজন মা, একজন নারী অধিকার আন্দোলনের নেত্রী। তিনি বিশ্বাস করেন জগতে সব মানুষই সমান। তার মতে মানুষে মানুষে কোন মৌলিক পার্থক্য নেই। তিনি স্বচ্ছতায় বিশ্বাস করেন। এরকম আরো কিছু গুণে তিনি গুনান্বিতা। সুতরাং তিনি প্রধানমন্ত্রীর স্ত্রী এই পরিচয় ছাড়াও নিজ গুণেই মিডিয়ার নজর কাড়তে পারেন। এবং বস্তুত মিডিয়ার নজর তিনি কেড়েছেনও।
mtlblog.com নামের একটি ব্লগে সোফি গ্রেগওয়া সম্পর্কে কয়েকটি গুণের কথা বলা হয়েছে। এখানে সংক্ষেপে তা তুলে ধরা হলো:-
১. সোফি তার মানসিক যন্ত্রণার কথা সাধারণের সঙ্গে শেয়ার করতে ভালবাসেন
সোফি যখন টিনএজ গার্ল তখন তার মধ্যে বিষন্নতা কাজ করেছিল। তিনি বুলিমিয়া নারভোসা (bulimia nervosa) নামের এক রোগে ভুগছিলেন। এই রোগে যারা ভুগেন তারা প্রচুর পরিমানে খাবার গ্রহণ করেন। খাবার দেখলে তাদের নিয়ন্ত্রণ থাকে না। ফলে শরীরের ওজন বৃদ্ধিসহ আরো নানারকম জটিলতা দেখা দেয়। এটি একটি বিব্রতকর রোগ। কিন্তু সোফি তার বাবা-মায়ের সহযোগিতায় এই রোগ থেকে মুক্তি পান। কিন্তু বিষয়টি তিনি গোপন করেননি পরবর্তীতে যখন পাবলিক ফিগারে পরিনত হয়েছেন। তিনি সবার সাথেই এই বিষয়টি শেয়ার করেন। এতে লাভ হয়েছে এই, যারা এই রোগে ভুগছেন তারা একজন পথপ্রদর্শক পেয়েছেন যাকে অনুসরণ করে এ সমস্যা থেকে বেড়িয়ে আসা যাবে। বুলিমিয়া নারভোসা এক ধরণের রোগ। সুতরাং এটি নিয়ে বিব্রত হওয়ার কারণ নেই। যথাযথ চিকিৎসা ও পরিবারের সদস্যদের সহযোগিতা পেলে এ সমস্যা থেকে সহজেই মুক্তি পাওয়া সম্ভব।
২. সোফি নিজগুনেই গুনান্বিতা
যখন কোন নেতা বা নেত্রীর জনপ্রিয়তা বেশী হয় তখন তাদের পতি বা পত্মীদের অবস্থানটা অনেকটাই ম্রিয়মাণ হয়ে পড়ে সেই জনপ্রিয়তার তুলনায়। অর্থাৎ নেতা বা নেত্রীর অনন্যসাধারণ প্রতিভা ও অন্যান্য গুণের কাছে তাদের পতি বা পতœীদের ঔজ্জ্বল্য বা জলুস ধামাচাপা পড়ে যায়। কিন্তু সোফি গ্রেগওয়ারের বেলায় কথাটা খাটে না। তার স্বামীর মত এমন একজন জনপ্রিয়, সুদর্শন ও জলুসমাখা ব্যক্তিত্বের পাশে থেকেও সোফি’র ঔজ্জ্বল্যও কম নয়। কানাডার সাবেক অনেক প্রধানমন্ত্রীর স্ত্রীদের তুলনায় সোফি অনেক বেশী সহজ সাবলিল এবং তথাকথিত অভিজাত্যের ধার ধারেন না তিনি। স্বামীর দীপ্তি বাড়াতে তিনিও একজন কন্ট্রিবিউটর।
৩. তিনি অন্যের জন্য ওকালতি করেন
না, তিনি ওকালতি পেশার সঙ্গে জড়িত নন। তবে তিনি বেশ কিছু দাতব্য সংস্থার পক্ষ হয়ে কাজ করেন, তাদের হয়ে প্রচার প্রচারণা চালান। মানব-হিতৈষী কাজে তার অবদান রয়েছে এবং এ কাজগুলো তিনি একজন প্রধানমন্ত্রীর স্ত্রী হওয়ার আগে থেকেই করতেন বিশ্বকে একটি সুন্দর জায়গা হিসাবে গড়ে তোলার স্বপ্ন নিয়ে। সোফি যে সকল দাতব্য সংস্থার সঙ্গে জড়িত তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো : Plan Canada’s “Because I Am A Girl” initiative, Girls for the Cure, the Bulimia Anorexia Nervosa Association, the Debra Dynes Family House, the Women’s Heart and Stroke Foundation, the Canadian Cancer Association, and the Canadian Mental Health Association.
৪. মাতৃত্বগুণেও গুণান্বিতা সোফি
সাম্প্রতিককালে আধুনিকতার নাম করে বা প্রফেশনের দোহাই দিয়ে একদল মানুষ নারীর মাতৃত্বকে সেকেলে ধ্যানধারণা বলে অবহেলা করার চেষ্টা করেন। সোফি তার ব্যতিক্রম। তিনি সক্রিয়ভাবেই মাতৃত্ব নিয়ে কথা বলেন এবং এ বিষয়ে যে চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হচ্ছে তাকে তিন সন্তানের জননী এবং একজন প্রধানমন্ত্রীর স্ত্রী হয়ে তাও গোপন করেন না। ব্রেস্ট ফিডিং থেকে শুরু করে তার সন্তানেরা ঘরে কোন ভাষায় কথা বলে সবই তিনি শেয়ার করেন। মাতৃত্বের মাহাত্ব্যকে তিনি সবার মাঝে তুলে ধরেন।
৫. সোফি গ্রেগওয়া একজন চমৎকার অনুকরণীয় চরিত্র
শক্তিশালী অনুকরণীয় নারী চরিত্র আজকালকার যুগে খুব বেশী দেখা যায় না। যে কজন আছেন তাদের অবদান আবার অনেকটাই চাপা পড়ে যায় রিয়েলিটি টিভি স্টার, অভিনেত্রী বা সোস্যাল মিডিয়ার সেলিব্রিটিদের অতিপ্রচারণার কারণে। তার অর্থ এই নয় যে, এই সেলিব্রিটিদের কেউ রোল মডেল বা অনুকরণীয় নারী চরিত্র হতে পারবেন না। হতে পারেন অবশ্যই। কিন্তু বাস্তবতা হলো তারা সাধারণত হন না।
সোফি এই ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। তিনি নারী পুরুষ উভয়ের জন্যই একজন উজ্জ্বল রোল মডেল বা অনুকরণীয় ব্যক্তি যিনি সাধারণ মানুষকে উদ্বুদ্ধ করেন কিভাবে আমাদের এই পৃথিবীকে সুন্দর করার জন্য এবং নিজেদের স্বপ্ন বাস্তবায়ন করার জন্য সংগ্রাম করতে হয়।
৬. সোফি গ্রেগওয়া কানাডার ‘ফার্স্ট লেডী’ যার প্রয়োজনীয়তা সবাই উপলব্দি করেন
কানাডায় কোন ফার্স্ট লেডী নেই। প্রধানমন্ত্রীর স্ত্রী ফার্স্ট লেডী নন। আর এখানে সরকারী কর্মকান্ডে প্রধানমন্ত্রীর স্ত্রীর কোন অফিসিয়াল ভূমিকাও নেই। কিন্তু তারপরও সোফি গ্রেগওয়া তার প্রধানমন্ত্রী স্বামীর সঙ্গে দেশে এবং বিদেশে বিভিন্ন রাষ্ট্রিয় অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে ইতিমধ্যেই লোকজনের নজর কেড়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর স্ত্রী হিসাবে বিভিন্ন গুরত্বপূর্ণ ইস্যুকে সবার নজরে আনার জন্য প্রচারণা চালিয়েছেন। কেউ তাকে এগুলো করতে বলেনি, কিন্তু তিনি করে যাচ্ছেন নিজ তাগিদে। এবং এগুলো তিনি করছেন বিনা পরিশ্রমিকে।
তথ্য সূত্র : উইকিপিডিয়া, গ্লোব এন্ড মেইল, হেমিলটন স্পেকটেটর, এমটিএলব্লগ.কম, ম্যাকলিনস। প্রচ্ছদে ব্যবহৃত ছবিটি নেয়া হয়েছে ellecanada.com থেকে।