দ্বৈত নাগরিকদের নাগরিকত্ব বাতিল আইনে সংশোধনী প্রস্তাব
সংসদে পাশ হলেও আটকে আছে সিনেট কমিটির অনুমোদনের জন্য
অক্টোবর ৮, ২০১৬
প্রবাসী কণ্ঠ প্রতিবেদন : কানাডায় দ্বৈত নাগরিকদের নাগরিকত্ব বাতিলের আইনসহ অন্যান্য কিছু বিতর্কিত আইনের (স্ট্রেংথেনিং কানাডিয়ান সিটিজেনশীপ এ্যাক্ট, যা বিল সি -২৪ নামেও পরিচিত) সংশোধনের প্রস্তাব থার্ড রিডিং এর পর পার্লামেন্টে পাস হয়েছে গত জুন মাসের ১৭ তারিখে। একই দিনে সংশোধনের প্রস্তাবটির ফার্স্ট রিডিং অনুষ্ঠিত হয় সিনেট কমিটিতে। কিন্তু সিনেট কমিটিতে ঐ দিন তা অনুমোদন পায়নি। এর পর শুরু হয় সংসদ ও সিনেট কমিটির সামার ভ্যাকেশন। সরকার আশা করেছিল পার্লামেন্টে এই স্ট্রেংথেনিং কানাডিয়ান সিটিজেনশীপ এ্যাক্ট এর সংশোধনী প্রস্তাব পাশ হওয়ার পর সিনেট কমিটিতে তা পাশ হলে ১ জুলাই কানাডা ডে’তে তারা বিষয়টি ঘটা করে ঘোষণা দিতে পারবে।
এদিকে সামার ভ্যাকেশনের পর পার্লামেন্ট ও সিনেটের অধিবেশন আবারো শুরু হয়েছে। কিন্তু এখনো সিনেট কমিটি কোন সিদ্ধান্ত দেয় নি। উল্লেখ্য যে, কানাডার সিনেট কমিটিতে কনজারভেটিভ পার্টির আধিপত্য বেশী। আর এই কনজারভেটিভ পার্টিই স্ট্রেংথেনিং কানাডিয়ান সিটিজেনশীপ এ্যাক্ট এর প্রবর্তক ও অনুমোদনকারী।
উল্লেখ্য যে, সাবেক কনজারভেটিভ সরকার কর্তৃক প্রণীত বিতর্কিত এই আইনটি সংশোধন করার জন্য গত ২৫ ফেব্রুয়ারি পার্লামেন্টে বিল (বিল সি – ৬) তুলেছিল লিবারেল সরকার। গত জাতীয় নির্বাচনের আগে লিবারেল পার্টির নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিও ছিল এটি। তারা বলেছিল, লিবারেল পার্টি ক্ষমতায় এলে দ্বৈত নাগরিকেদের নাগরিকত্ব হরণের আইনটি বাতিল করা হবে এবং সিটিজেনশীপ এ্যাক্ট এর অন্যান্য বিতর্কিত ধারাগুলো সংশোধন করা হবে।
লিবারেল সরকার তার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেছে সিটিজেনশীপ এ্যাক্ট সংশোধনী পার্লামেন্টে পাশ করিয়ে। এখন সিনেট কমিটিতে পাশ হলে বাকি থাকবে রানীর হয়ে গভর্নর জেনারেলের অনুমোদন।
বাকি কাজগুলো সঠিকভাবে সম্পাদিত হলে দ্বৈত নাগরিকদের নাগরিকত্ব আর হরণ করা যাবে না এবং প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে যারা কানাডিয়ান সিটিজেনশীপের জন্য আবেদন করবেন তাদেরকে এই মর্মে কোন ঘোষণা দিতে হবে না যে, সিটিজেনশীপ পাওয়ার পর তারা কানাডায় অব্যাহতভাবে বাস করবেন।
সাবেক কনজারভেটিভ সরকার আরো আইন করে গিয়েছিল কানাডার নাগরিকত্ব লাভ করতে হলে ইমিগ্রেন্টদেরকে ৬ বছরের মধ্যে কমপক্ষে ৪ বছর কানাডায় বাস করতে হবে। আগে নিয়ম ছিল ৪ বছরের মধ্যে তিন বছর কানাডায় থাকতে হবে। লিবারেল সরকার এখন নিয়ম করেছে ৫ বছরের মধ্যে কমপক্ষে ৩ বছর কানাডায় বাস করতে হবে সিটিজেনশীপের জন্য আবেদন করার আগে।
সাবেক কনজারভেটিভ সরকার নিয়ম করে গিয়েছিল সিটিজেনশীপের জন্য আবেদন করতে হলে যেদিন থেকে আবেদনকারী পার্মানেন্ট রেসিডেন্সী লাভ করেছেন সেদিন থেকে দিন গণনা শুরু হবে। কিন্তু লিবারেল সরকারের হালনাগাদ করা সিটিজেনশীপ আইনে বলা হয়েছে, আবেদনকারী যেদিন থেকে কানাডায় স্বশরীরে উপস্থিত হয়েছেন সেদিন থেকে দিন গননা শুরু হবে। অর্থাৎ পার্মানেন্ট রেসিডেন্সী পাওয়ার আগের দিনগুলোও হিসাবের মধ্য পড়বে। তবে আগের দিনগুলো গননা হবে অর্ধেক দিন হিসাবে। অর্থাৎ এক বছর অবস্থান করে থাকলে তা ৬ মাস হিসেবে গন্য হবে। আর আগের অবস্থান থেকে ক্রেডিট পাওয়া যাবে সর্বোচ্চ এক বছর। অর্থাৎ দুই বছর অবস্থান করে থাকলে এক বছরের ক্রেডিট, আর তিন বছর অবস্থান করে থাকলেও ঐ এক বছরেরই ক্রেডিট পাওয়া যাবে।
নাগরিকত্ব লাভের জন্য ল্যাংগুয়েজ টেস্টকেও কঠিন করে গিয়েছিল সাবেক কনজারভেটিভ সরকার। বয়স্ক ব্যক্তিদের পক্ষে ল্যাংগুয়েজ টেস্ট পাস করা এমনিতেই কঠিন। তা জানা সত্বেও কর্তৃপক্ষ বয়সের মাত্রা আরো বৃদ্ধি করেছিল। আগে নিয়ম ছিল ১৮ থেকে ৫৫ বছর বয়স পর্যন্ত ব্যক্তিদেরকে ল্যাংগুয়েজ টেস্ট পাস করতে হবে। কনজারভেট্ভি সরকার নিয়ম করেছিল ১৪ থেকে ৬৪ বছর বয়স পর্যন্ত ব্যক্তিদেরকে ল্যাংগুয়েজ টেস্ট পাস করতে হবে। এবার লিবারেল সরকার নতুন নিয়ম করেছে যাতে বলা হয়েছে ১৮ থেকে ৫৪ বয়স পর্যন্ত ব্যক্তিদেরকে ল্যাংগুয়েজ টেস্ট পাস করতে হবে।
বিতর্কিত স্ট্রেংথেনিং কানাডিয়ান সিটিজেনশীপ এ্যাক্ট বা বিল সি-২৪ এ নাগরিকত্ব বাতিল করার যে নতুন আইনটি বিগত সরকার করে গিয়েছিল তাতে বলা ছিল- দ্বৈত নাগরিকদের কানাডিয়ান নাগরিকত্ব বাতিল করা যাবে যখন:
-কেউ নাগরিকত্ব লাভের জন্য আবেদনপত্রে মিথ্যা তথ্য দিবেন।
-কেউ যদি এমন কোন সশস্ত্র বাহিনীর সদস্য হয়ে থাকেন বা কোন সংগঠিত সশস্ত্র গ্রুপের সদস্য হয়ে থাকেন যেটি কানাডার সঙ্গে সশস্ত্র সংঘাতে জড়িত।
-কেউ যদি বিশ্বাসঘাতকতার জন্য সাজা প্রাপ্ত হয়ে থাকেন, গুপ্তচরবৃত্তির অপরাধে অপরাধী হয়ে থাকেন এবং জাবজ্জীবন কারাদন্ডে দন্ডিত হয়ে থাকেন।
-কেউ যদি সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের জন্য দন্ডপ্রাপ্ত হয়ে থাকেন অথবা সমজাতীয় অপরাধে বিদেশে অভিযুক্ত হয়ে থাকেন এবং সেই সাজার পরিমান যদি ৫ বছর বা তারো বেশী হয়ে থকে। তবে সেই দ্বৈত নাগরিকের যদি দ্বিতীয় কোন দেশে যাওয়ার উপায় না থাকে তবে তার নাগরিকত্ব বাতিল করা যাবে না। কারণ, কানাডা জাতিসংঘের “কনভেনশন অন দি রিডাকশন অব স্টেটলেসনেস (১৯৬১)” সনদে স্বাক্ষরকারীদের একটি দেশ। ঐ সনদ অনুযায়ী কাউকে রাষ্ট্রহীন করা যাবে না।
উল্লেখ্য যে, যারা মিথ্যা তথ্য দিয়ে কানাডার নাগরিকত্ব গ্রহনের চেষ্টা করেন বা করেছেন তাদের নাগরিকত্ব বাতিল করার ক্ষমতা সরকারের হাতে থাকবে আগের মতই।
এদিকে পার্লামেন্টে সিটিজেনশীপ এ্যাক্ট সংশোধীন বিল পাস হলেও সিনেট কমিটিতে তা এখনো আকটে থাকায় অনেকেই উৎকণ্ঠায় আছেন। কারণ, এই সিনেট কমিটিতে কনজারভেটিভ পার্টির প্রাধাণ্য বেশী। অন্যদিকে গত মার্চ মাসে প্রকাশিত Angus Reid Institute এর এক জরীপে দেখা যায় কানাডার শতকরা ৫৩ ভাগ নাগরিক চান সাবেক সরকার কর্তৃক বিতর্কিত স্ট্র্যাংথেনিং সিটিজেনশীপ এ্যাক্ট বহাল থাকুক। আর মাত্র ২১% কানাডিয়ান মনে করেন বিতর্কিত বিলটি বাতিল করা উচিৎ। ২৬% জানিয়েছেন তারা এ বিষয়ে নিশ্চিত নন কোনটি করা উচিৎ।
জরীপে দেখা গেছে কনজারভেটিভ পার্টির সমর্থকদের মধ্যে ৮৪%ই চান স্ট্র্যাংথেনিং সিটিজেনশীপ এ্যাক্ট বহাল থাকুক। এটিই স্বাভাবিক, কারণ তাদের দলের নেতারা এই আইন করে গেছেন। কিন্তু বিস্ময়ের বিষয় হলো- ইমিগ্রেন্ট বান্ধব বলে বিবেচিত লিবারেল পার্টি ও এনডিপি সমর্থকদের মধ্যেও একটা বড় অংশই চান না বিতর্কিত সিটিজেনশীপ এ্যাক্ট বাতিল হোক বা সংশোধন হোক! জরীপে দেখা গিয়েছে ৩৮% লিবারেল সমর্থক ও ৪০% এনডিপি সমর্থক সিটিজেনশীপ এ্যাক্ট বহাল রাখার পক্ষে মত দিয়েছেন।
তবে কম বয়সী (১৮-৩৬ যাদের বয়স) এবং উচ্চশিক্ষিত কানাডিয়ানদের মধ্যে এই সিটিজেনশীপ এ্যাক্ট বাতিল অথবা সংশোধন কারার পক্ষে সমর্থন লক্ষনীয়। এদের মধ্যে ৩৩% মনে করেন বিতর্কিত সিটিজেনশীপ এ্যাক্ট বাতিল করা উচিৎ। তবে ৩৬% মনে করেন এটি বহাল থাকা উচিৎ। কিন্তু যাদের বয়স ৩৫ থেকে ৫৪ তাদের মধ্যে ৫২% চান সিটিজেনশীপ এ্যাক্ট বহাল থাকুক। আর যাদের বয়স ৫৪ থেকে ৬৭ তাদের মধ্যে ৫৫% চান সিটিজেনশীপ এ্যাক্ট বহাল থাকুক।
উল্লেখ্য যে, সিটিজেনশীপ এ্যাক্ট বা বিল সি – ২৪ এর মধ্যে দ্বৈত নাগরিকদের নাগরিকত্ব বাতিল করার বিষয়টি সবচেয়ে বেশী উদ্বেগের কারণ হয়ে দাড়ায় অভিবাসী সম্প্রদায়ের মধ্যে। এই আইনের ফলে তারা নিজেদেরকে কানাডায় দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক ভাবতে শুরু করেছেন। সরকার এই আইনের ক্ষমতাবলে যারা দ্বৈত নাগরিক তাদের কেউ যদি সন্ত্রাসী কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত হয়ে অভিযুক্ত হন বা কানাডার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে অথবা অন্যকোন গুরুতর অপরাধ করে অভিযুক্ত হন তবে কানাডা থেকে তাকে বহিস্কার করতে পারবে। এমনকি যাদের জন্ম কানাডায় কিন্তু পিতা-মাতা অন্যদেশের তাদের নাগরিকত্বও বাতিল করে দিতে পারে সরকার। নতুন এই আইনের সবচেয়ে বিতর্কিত দিক হলো- সিংহভাগ দ্বৈত নাগরিকের কানাডিয় নাগরিত্ব বাতিলের ক্ষমতা ফেডারেল কোর্ট এর বিচারকদের হাতে না দিয়ে দেওয়া হয়েছে ইমিগ্রেশন মন্ত্রী বা তার প্রতিনিধিদের হাতে।
সিভিল রাইটস গ্রুপস এবং এ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল মনে করে নতুন এই আইন দ্বৈত নাগরিকদের জন্য বৈষম্যমূলক। এর মাধ্যমে দ্বৈত নাগরিকদেরকে একঅর্থে ‘লেস কানাডিয়ান’কাতারে ফেলা হয়েছে এবং কানাডায় জন্ম নেয়া নাগরিকদের চেয়ে কম অধিকারসম্পন্ন করে তোলা হয়েছে। ঐ সময় আইনজীবীদের অনেকেই বলেন, কোন দ্বৈত নাগরিক অপরাধ করে থাকলে কানাডার ক্রিমিনাল কোডই যথেষ্ট তার বিচার করার জন্য। এ জন্য নাগরিকত্ব হরণ করার কোন প্রয়োজনীয়তা নেই।
কানাডার বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর বক্তব্য হলো, ‘A Canadian is a Canadian is a Canadian’। গত নির্বাচনের আগে তিনি জোরেশোরেই এই বক্তব্য প্রচার করেন।
এখন অপেক্ষার পালা সিনেট কমিটি কি সিদ্ধান্ত নেয় তা দেখার। অতীতে অবশ্য সিনেট কমিটি পার্লামেন্টের প্রায় সব সিদ্ধান্তকেই মেনে নিত। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেখা গেছে সিনেট কমিটি আগের চেয়ে বেশী মাত্রায় পার্লামেন্টের মতের সঙ্গে দ্বিমত প্রকাশ করছে।