কানাডায় ইমিগ্রেন্ট পরিবারগুলোতে এলডার এবিউজের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে

নিভৃতে নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন কেউ কেউ : লজ্জার কারণে অথবা পরিবারিক সম্মান বা সম্ভ্রম নষ্ট হবে এই ভয়ে তা প্রকাশ করছেন না অনেকেই

এপ্রিল ৯, ২০১৬

খুরশিদ আলম : ফেব্রুয়ারী মাস। বাইরে প্রচন্ড শীত। সকাল থেকেই অবিরাম তুষার পড়ছিল। বেলা বাড়ার সাথে সাথে ড্যানফোর্থের দুপাশের ফুটপাথে তুষারের স্তুপও বৃদ্ধি পাচ্ছিল। সিরাজুল ইসলাম ও তার স্ত্রী আঞ্জুমান ইসলাম এ পথ ধরেই হাটছিলেন খুব সাবধানে। এই বৃদ্ধ বয়সে পড়ে গিয়ে হাত পা বা কোমড় ভাঙলে আর রক্ষা নেই।

আজ তারা একটা চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে ঘর থেকে বের হয়েছেন। তারা মেয়ের বাড়িতে আর থাকবেন না। মেয়ের জামাই অনেকদিন ধরেই পছন্দ করছেন না তাদের থাকাটাকে। মুখ ফুটে সরাসরি কিছু বলছেন না। কিন্তু আকারে ইঙ্গিতে এবং আচরণে সেটা ফুটিয়ে তুলছেন বার বার। মেয়ের সঙ্গে এ নিয়ে ঝগড়াঝাটি লেগেই আছে জামাই বাবুর। অবস্থা এমন দাড়িয়েছে যে মেয়ের ঘর হয়তো আর টিকবে না। গতরাতে মেয়েও বাবা-মা’কে এ কথা বলতে বাধ্য হয়েছে যে, তোমরা তোমাদের ব্যবস্থা দেখ। আমি আর পারছি না।

ভিক্টোরিয়া পার্ক অতিক্রম করে পশ্চিম দিকে এগুলেই হাতের ডান দিকে সারি সারি একতলা দোতলা ভবন। এই ভবনগুলোর প্রায় সবগুলোতেই রয়েছে  বাঙ্গালী ব্যবসায়ীদের দোকান বা অফিস। কয়েকটি ভবনের মালিকও বাঙ্গালীরাই। সিরাজুল ইসলামের দৃঢ় ধারণা, ড্যানফোর্থের এই বাঙ্গালী পাড়ায় কোন না কোন দোকান বা অফিসে একটি কাজ জুটে যাবেই।

প্রবীণদের এই হাসি বিলীন হতে সময় লাগে না যখন তারা এবিউজের শিকার হন (প্রচ্ছদে ব্যবহৃত এই ছবিটি মডেল হিসাবে ব্যবহার করা হয়েছে। ছবির পাত্র-পাত্রী হলেন টরন্টো প্রবাসী চিত্র শিল্পী ও সাংবাদিক কামাল আহমেদ ও তাঁর স্ত্রী সাঈদা কামাল। ছবিটি তুলেছেন ম্যাক আজাদ)

কিন্তু কি কাজ করবেন তিনি? আর কেই বা কাজ দিবে তাকে? বয়স তার সত্তুর ছাড়িয়ে গেছে। দেশে সরকারী চাকরী করতেন। শিল্প মন্ত্রণালয়ে কারনিকের কাজ। সেই অভিজ্ঞতা দিয়ে এখানে কোথায় কাজ পাবেন তিনি? স্ত্রী আঞ্জুমান ছিলেন গৃহবধূ। চাকুরীর কোন অভিজ্ঞতাই নেই। দুজনের একজনও ইংরেজী জানেন না।

ঘটনাটি ২০১২ সালের। বৃদ্ধ এই দম্পতির সঙ্গে এই প্রতিবেদকের সঙ্গে দেখা হয়েছিল বাঙ্গালী পাড়ার একটি অফিস কক্ষে। তারা তাদের দুর্দশার কথা বলে একটা চাকরী দেওয়ার আবেদন জানাচ্ছিলেন। কিন্তু ঐ প্রতিষ্ঠানের মালিকের সেই সুযোগ ছিল না একটা চাকরীর ব্যবস্থা করে দেওয়ার। আশাহত হয়ে এই বৃদ্ধ দম্পতি যখন সিড়ি বেয়ে ধীরে ধীরে নিচে নেমে যাচ্ছিলেন তখন অফিসে উপস্থিত কয়েকজন বাঙ্গালী নিরবে সেদিকে তাকিয়ে ছিলেন। অক্ষমতা এবং একটা অপরাধবোধ তাদের সকলের চোখে মুখে ফুটে উঠেছিল।

কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, কেন এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হলো? এটি তো মাত্র একটি ঘটনার উদাহরণ। এরকম আরো অনেক ঘটনাই ঘটছে প্রবাসে আমাদের কমিউনিটির কিছু কিছু পরিবারে। কামিউনিটি ওয়ার্কারগণ দিনে দিনে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠছেন এইরকম শত শত ঘটনার কথা জানতে পেরে।

প্রবাসী কন্ঠ ম্যাগাজিনেও গত কয়েক সংখ্যা ধরেই ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়ে আসছে এইসব অত্যাচারের কাহিনী। টরন্টোর বাংলাদেশ সেন্টারের উদ্যোগে সংগৃহীত অত্যাচারের এই কাহিনীগুলো প্রায় একই রকম। দেখা গেছে কিছু কিছু প্রবাসী পরিবার বাবা-মা’কে স্পন্সর করে নিয়ে আসে কানাডায় নানান স্বপ্ন দেখিয়ে। এরপর কিছুদিন যেতে না যেতেই প্রকাশ হতে শুরু করে স্পন্সর করে নিয়ে আসার আসল উদ্দেশ্য। আর সেই উদ্দেশ্য সফল না হলেই শুরু হয় অত্যাচার আর অপমানের পর্ব। কানাডায় যাকে বলা হয় এলডার এবিউজ।

আমরা সবাই নারী নির্যাতন, শিশু নির্যাতন এই সকল শব্দগুলোর সঙ্গে কম বেশী পরিচিত। কিন্তু এলডার এবিউজ বা বয়স্ক নির্যাতন শব্দটি আমাদের কাছে তেমন পরিচিত নয়। বা পরিচিত হলেও এটি যে নির্যাতনের পর্যায়ে পড়ে তা আমরা অনেকেই জানি না বা মানি না। নির্যাতন যে শুধু শারীরিক আঘাত করাকে বুঝায় তাও কিন্তু নয়। কারো মনে কষ্ট দেওয়াটাও নির্যাতনের মধ্যেই পড়ে। আর দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো, এই প্রবাসে কিছু কিছু বাঙ্গালী পরিবারে এই নির্যাতনের ঘটনাগুলো অহরহই ঘটছে।

টরন্টো স্টার পত্রিকার এক প্রতিবেদনেও বলা হয় নতুন আসা কিছু কিছু ইমিগ্রেন্ট পরিবারে এলডার এবিউজের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে যা ক্রমবর্ধমান উদ্বেগ এর কারণ হয়ে দাড়িয়েছে।

ঐ প্রতিবেদনে বলা হয়, গ্রেটার টরন্টো এলাকার কমিউনিটি ওয়ার্কারগণ আগের চেয়ে বেশীমাত্রায় উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছেন। কারণ তারা প্রতিনিয়তই দেখতে পাচ্ছেন কোন কোন ইমিগ্রেন্ট পরিবারে স্পন্সর করে আনা বৃদ্ধ বাবা-মা পরিবারে সদস্যদের হাতে নিগৃহীত হচ্ছেন।

অন্যদিকে ইন্দো কানাডিয়ান ভয়েস পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, কানাডায় বসবাসরত সাউথ এশিয়ান ইমিগ্রেন্ট পরিবারের কিছু কিছু বয়স্ক ব্যক্তি অধিকহারে নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। সাউথ এশিয়ান বয়স্ক ব্যক্তিদের মধ্যে ২৫% বাস করেন তাদের আত্মীয়-পরিজনদের সঙ্গে। সার্বিকভাবে কানাডিয়ানদের মধ্যে এই হার ৫%। সাউথ এশিয়ানদের মধ্যে এই হার বেশী হওয়ার কারণ- স্বল্প আয়, ভাষাগত সমস্যা, ইমিগ্রেন্ট স্ট্যাটাস, উচ্চমূল্যের বাসা ভাড়া এবং সাংস্কৃতিক পরিপ্রেক্ষিত। সাউথ এশিয়ান এই বয়স্ক ইমিগ্রেন্টদের কেউ কেউ নিভৃতে নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন কিন্তু তা প্রকাশ করছেন না লজ্জার কারণে এবং পরিবারিক ‘সম্মান বা সম্ভ্রম’ নষ্ট হবে এই ভয়ে।

টরন্টোর বাঙ্গালী কমিউনিটিতে বয়স্ক ব্যক্তিদের কেউ কেউ কিভাবে নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন তার কিছু চিত্র ফুটে উঠেছে প্রবাসী কন্ঠ ম্যাগাজিনের বিগত কয়েকটি সংখ্যায় এলডার এবিউজ এর উপর রচিত কয়েকটি কলামেও। যেমন মনিস রফিক  লিখেছেন, “…আমি তার কপালের কালো দাগের কারণ জানতে চাইলাম। এবার তিনি আবার ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলেন। তিনি জানালেন, তিনি এখন প্রায় সবকিছু ভুলে যান আর কোনো কাজ করতে লাগলে প্রায়ই তার হাতটা কাঁপতে থাকে। কয়েকদিন আগে ছুটির দিনে তার তিন বছরের নাতিকে ঠিক সময়ে খাবার দিতে ভুলে যাওয়ায় তার বউমা তাকে বকাঝকা শুরু করে দেয়। তখন ভয়ে তিনি দ্রুত তার নাতির খাবার তৈরী করে তাকে খাওয়াতে যাচ্ছিল, কিন্তু যেহেতু তার হাত কাঁপে, সেজন্য দ্রুত কাজ করতে গিয়ে তার হাত থেকে প্লেটটা মেঝেতে পড়ে গিয়ে ভেঙ্গে যায়। এতে তার বউমা তাকে গালাগালি করতে করতে ধাক্কা দিয়ে মেঝেতে ফেলে দেয়। আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম সেই সময় তার ছেলে বাড়ীতে ছিলো কিনা। তিনি জানিয়েছিলেন, ছেলে বাড়ীতেই ছিল, সে তার সাথে তার বউয়ের মতই আচরণ করে আর বাচ্চাকে সময়মত না খাওয়ানোর জন্য বকাঝকা করে। ভদ্রমহিলা কিছুক্ষণ থেমে আবার বলতে থাকেন, তারা বলে আমি নাকি কোনো কাজ করতে চাই না, আর আমি নাকি ইচ্ছা করেই জিনিসপত্র হাত থেকে ফেলে দিই। কিন্তু বাবা আমিতো আমার ছেলে আর নাতিনাতনির জন্য আমার সব দিয়ে কাজ করতে চাই, কিন্তু আমার শরীরটাতো এখন ভালো যায় না…।”

একই বিষয়ের উপর একটি কলামে সেরীন ফেরদৌস লিখেছেন, “…এমনও গল্প শোনা যায় যে, তাঁদেরকে আনার আগে বিদেশ সম্পর্কে নানারকম ইলিউশন তৈরি করে থাকে সন্তানেরা। দেশের চেয়ে কত আরামে তাঁরা থাকবে তার বিস্তারিত ফর্দ তুলে ধরে ছেলেমেয়েরা। তাঁরা সেই স্বপ্নে বিভোর হয়ে পাসপোর্ট হাতে প্লেনের সিঁড়িতে পা রাখেন দেশ ছাড়বেন বলে। এখানে আসার পরপর সেই স্বপ্ন উবে যেতে সময় নেয় না বরং ফিরে যাবার ব্যাপারে অনেক সময় তাঁদের উপর বড় ধরনের মানসিক চাপ তৈরি করা হয়। এগুলো অতি অবশ্যই মানসিক প্রতারণার অংশ। কেউ কেউ পিতামাতাকে আর্থিকভাবে দেউলিয়া করতে পিছ-পা হন না। এসব পিতামাতার ব্যাংক এ্যাকাউন্ট থেকে মোটা অংকের টাকা বেরিয়ে যায় সন্তানের চাপে। …”

অথচ এই সন্তানদের কি যতেœই না বড় করেছেন করেছেন এই পিতামাতাগণ। নিজেদের সবটুকু ঢেলে দিয়েছেন তাদের পিছনে। আর আজ এই বিদেশ-বিভূইয়ে নিয়ে এসে এমনভাবে তার প্রতিদান?

এলডার এবিউজ বিষয়ে শাহনাজ পারভীন তার কলামে লিখেছেন, “…Family sponsorship এর মাধ্যমে বাংলাদেশের সুদূর রংপুর শহর থেকে মা বাবা দুজনকেই নিয়ে আসা হলো টরন্টো শহরের আভিজাত এলাকার দোতলা বিশাল ভবনে। … প্রথম দু,সপ্তাহের মধ্যেই মা-বাবাকে তাদের রোজনামচা ধরিয়ে দেয় ছেলেরা। বিশেষ কিছু না, মাকে শুধু রান্নাটা করতে হবে আর ফুটফুটে ৪ জন কানাডিয়ান নাতি নাতনীদের দেখাশুনা করতে হবে। যাতে নিশ্চিন্তে ছেলের বউ দু’জন বাইরের কাজে মনোযোগী হতে পারে। যাতে সংসারের চাকাকে আরও বেগবান করা যাবে। তা ছাড়া কানাডাতে বসবাস করেও বেচারা দাদা-দাদীর আদর সোহাগ আর শিক্ষা থেকেও বঞ্চিত হলো না। সব পরিকল্পনা আগে থেকেই করা ছিল এখন শুধু বাস্তবায়নের পালা। রোকেয়া খানম আর আব্বাস আলী নতুন উদ্যোগে ছেলেদের সংসার সংরক্ষনে ঝাঁপিয়ে পড়েন। কিন্তু অল্প সময়ের মধ্যেই দুজনেই বুঝতে পারেন, তাদের বয়স হয়েছে।

…অবশেষে মাস দু’য়েকের মাথায় রোকেয়া দম্পতী সিদ্ধান্ত নিলেন দেশে ফিরে যাবার। কিন্তু বিপত্তটা ঘটল তখনি। পুত্রদ্বয় সাফ জানিয়ে দিলেন ‘‘তোমাদের এখানে আনতে আমাদের বহু টাকা খরচ হয়েছে, এখন ইচ্ছা করলেই তোমরা দেশে ফিরে যেতে পার না।

… এমনি এক সময়ে আমার সাথে পরিচয় হয় রোকেয়া খানমের। ১-২ দিনের আলাপচারিতার পরেই উনি আমার সামনে তুলে ধরেন জীবনের এক নতুন আধ্যায়, জানতে পারিঃ-

০ মা -বাবার টেলিফোন ধরা বারন যাতে অন্য ভাই বোনেরা অথবা আশেপাশের মানুষ পারিবারিক বিষয়গুলো জানতে না পারে।

০ নামাজ রোজা করাটা সময়ের অপচয় মাত্র- বরং এই সময়টা সংসারের কাজে দিলে সংসারের সবার উপকার হবে। ছেলেদের পরামর্শে দেশ থেকে আসার আগে নিজেদের সারাজীবনের সঞ্চয় আর পেনশনের টাকায় বানানো বাড়ীটা বিক্রি করে টাকাগুলো তুলে দিয়েছেন ছেলেদের হাতে, কথাছিল নতুন আরও একটা বাড়ী কিনবে যার মালিকানা থাকবে মা-বাবার। কিন্তু বাস্তবে নতুন বাড়ীর down payment  হয়েছে ঠিকই তবে মালিকানায় রয়েছে ছেলে এবং তাদের স্ত্রীরা ।

০ বাড়ীতে কোন দাওয়াত বা আতিথি এলে মা-বাবাকে নিজেদের ঘরে থাকতেই পরামর্শ দিয়েছে ছেলেরা।

০ মা-বাবার পাসপোর্ট জোড়াও রয়েছে ছেলেদের দখলে।

রোকেয়া খানম ছলছল চোখে আমার দিকে তাকিয়ে জানতে চান -আমরা কি আর কোন দিনও দেশে যেতে পারবোনা? …এরপরের সবকিছু আমার কাজের রুটিন মাফিক। ছেলেদের সাথে দেখা করি। কানাডিয়ান আইন অনুযায়ী তাদের অবস্থাটা তুলে ধরি। দু’সপ্তাহের মাথায় দেখা করেন রোকেয়া খানম ও আব্বাস আলী। ছেলে দু’টো ভয় পেয়েছে। পাসপোর্ট ফেরত দিয়েছে। টিকিটও দিয়েছে বাংলাদেশে যাবার। তবে সম্পর্ক আর রাখবে না। আমাকে ধন্যবাদ জানাতে এসেছেন ‘জেলখানা থেকে মুক্তি দেবার জন্য’। আমি হতভম্ভ হয়ে গেলাম। এরা কি ছেলে? কি কৌশলে অর্থ আদায় করে নিল অথচ কী ব্যবহার-ই না করলো মা-বাবার সাথে।”

উপরে উল্লেখিত ঘটনাগুলো কোন কল্প কাহিনী নয়। প্রবাসের বাস্তব জীবন থেকে নেওয়া। এরকম আরেকটি ঘটনার কথা সিরাজুল কাদের রাজু লিখেছেন তার কলামে।

…“ইমিগ্রেশান শেষে বেড়িয়ে তসলিমা বেগম দেখেছিলেন, ছেলে, ছেলের বউ, প্রথমবারের মতো দেখা নাতি ফুলের তোড়া হাতে। সংবর্ধনা ভালোই লেগেছিল। জীবনে এত ফুলের তোড়া নিয়ে তার জন্য কেউ অপেক্ষায় থাকেনি এর আগে। … পরের দিন সকালে উঠেই ছেলে আর ছেলের বউ নিশা কাজে চলে গিয়েছিল। সাথে নিয়েছিল চৌদ্দ বছরের বড়ো ছেলেকে। যাবার সময়ে বলে গেলো , মা’ জ্যাকিকে রেখে যাচ্ছি-ওকে এখনো কিন্ডারগার্টেনে দেয়া যাবেনা। এদিকে দেরি হয়ে যাচ্ছে কাজের। দেখে রেখো, প্লীজ। ব্যস্, ওইটুকুই। জ্যাকি কি খায়, না খায় ,কিছুই দেখিয়ে যায়নি। … বিকেলের দিকে জ্যাকি খেলছিল ফ্লোরে, লিভিং রুমে। উনি পাশেই বসেছিলেন ফ্লোরে পাতা কার্পেটে। হঠাৎকরে ঘুম এসে গিয়েছিল। ‘জেট-ল্যাগ্ এর ব্যাপার। কিছুতেই চোখ খুলে রাখতে পারছিলেন না। ঘুমিয়ে পড়েছিলেন কখন জানতেও পারেননি। একেবারে যাকে বলে কুম্ভকর্ণের ঘুম। ঘুম ভেঙ্গেছিলো ছেলে আর ছেলের বউ-এর উচ্চস্বরে। …তুমিওনা মা, আশ্চর্য! দিব্যি নাক ডেকে ঘুমাচ্ছো, অথচ তোমার নাতি তোমারই সামনে একনাগাড়ে কেঁদে চলেছে! ‘দেখছো, দেখছো ওর অবস্থাটা, কেঁদে কেঁদে গা-র জামাটাও ভিজিয়ে ফেলেছে! বাইরে থেকে ওর কান্নাশুনতে পাচ্ছিলাম, কী আক্কেল আপনার!-ছেলে-বউ-এর গলা।

… পরের দিন ওরা ঘরে ঢুকলো বরাবরের মতো সন্ধ্যার একটু পর-ই। তসলিমার ছেলে আর বড় নাতিদু’জনেই সোজা চলে গেল ফ্রিজের দিকে। ছেলে ফ্রিজ খুলেই চীৎকার করে উঠল, ‘মা, তুমি ঘরে আছ কি করতে? একটু রান্না-বান্নাওতো করে রাখতে পারতে! জানোইতো ক্ষিদে নিয়ে ঘরে ঢুকবো।’ উনি কোন ধরনের উত্তর দেবার আগেই ছেলের বউ-এর কথা শোনা গেল। ও সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠছিল। ওখানে দাঁড়িয়েই বললো ‘মা কি বসে বসে খেয়ে যাবে? কোন কাজ করবেনা?’ ছেলের কথাগুলো পুরো গিলে উঠতে পারেনি তসলিমা। বিশ্বাস-ই হচ্ছিলনা এটা তার পেটের ছেলে স্বাধীনের কথা। ও’কি তার মাকে চেনেনা? ওরমা’কি অসুস্থ থাকলেও ও’কে র্ন্নাা করে খাওয়ায়নি? কাজের মেয়েতো ওনার কোন কালেই ছিলনা। আর ছেলে বউ-নিশা-ই বা একি বলে বসলো? উনি কি এখানে বসে বসে খেতেই এসেছেন? ওনার কি সাধ নেই এতকাল পরে ছেলে, ছেলে-বউ আর নাতিদের মনের মতো করে রেঁধে খাওয়ানোর? কিন্তু ঘরে চাল-ডাল-তরিতরকারী বা মাছ না থাকলে উনি কি করে করবেন? তাই বলে উনি কি এখানে কাজের মেয়ে বা ’বুয়া’ হয়ে এসেছেন? তাইতো মনে হচ্ছে নিশার কথায়। এও শুনতে হলো পাঁচদিনের মাথায়! …কথাতো নয় আর্টিলারী শেল! ছেলের কাছ থেকেই এসেছিল।-‘মা’ তুমি এবাড়ী থেকে বেড়িয়ে যাও। ঝামেলা বাড়িয়েই চলেছো তুমি। আর দাঁড়ায়নি স্বাধীন। সোজা উপরে উঠে গিয়েছিল। নাতী দুটোও উপরে। ওরা বাংলা জানেইনা। বোঝেওনি বোধ হয় কি ঘটে চলেছে। সম্বিত হারা মা অনেকক্ষণ নীচেই দাঁড়িয়েছিলেন। বেশ পরে উপরে নিজের ঘরে ঢোকেন। দেশ থেকে আনা সুটকেস এ কটাতে ছিল ছেলের পরিবারের সবারই জন্য টুকটাক উপহার। ওটা দেয়া হয়েগিয়েছিল প্রথম রাতেই। বাকিটা থেকে খুব একটা বেশী কিছু বের করেননি উনি। বের করা টুকিটাকি জিনিস আবার সুটকেসে ভরলেন। মাথাটা ঘুরছিল। ঘুম আসছিল না। স্বাধীন, তার সাধের স্বাধীন এমন চেহারা নিলো। চোখ দুটো ঘোলাটে হয়ে এসেছিল। চশমাটা খুলে আঁচল দিয়ে চোখ মোছেন তিনি। চশমা চোখে লাগান। ছেলে আর ছেলের বউ যা করলো তার সাথে তাকে বাংলায় কি বলবেন তিনি? অপব্যবহার করেছে? কোন ধরনের অন্যায় সুযোগ বা সুবিধা গ্রহন করেছে? গালাগালি করেছে? না, কোন ভাবেই বাংলায় উনি বোঝাতে পারছেন না যা তার জীবনে ঘটে গেলো।”

অবশেষে এই তসলিমা বেগমের ঠাই হয়েছিল টরন্টোর একটি সেল্টারে। তার সেই ‘গুণধর’ পুত্রের এক বন্ধু তাকে সেদিন ক্যালগারী থেকে টরন্টো নিয়ে এসে এই ব্যবস্থাটুকু করে দিয়েছিলেন।

ইতিপূর্বে এলডার এবিউজ বিষয়ে টরন্টোর সুপরিচিত ডাক্তার আবু আরিফ প্রবাসী কন্ঠ ম্যাগাজিনের এক প্রশ্নের জবাবে বলেছিলেন, এটা প্রায়ই

ঘটে। অনেকেই বাবা-মাকে নিয়ে আসেন ঠিকই কিন্তু ঠিকমত দেখাশুনা করেন না। তাদেরকে দিয়ে ঘরের সমস্ত কাজ করানো হয়, থাকতে দেয়া বেসমেন্টে, ঘরের বাইরে কাজ করতে চাপ দেয়া হয়, জরুরি ওষুধপত্র কিনে দেয়া হয় না। এ কারণে যারা বাংলাদেশ থেকে ডায়াবেটিস বা অন্যান্য রোগ নিয়ে এখানে আসেন তাদের অবস্থা আরো খারাপের দিকে যায়।

এ প্রসঙ্গে তিনি আরো বলেছিলেন, আমার মনে হয় বাবা-মাকে নিয়ে আসার আগে স্পন্সরকারীদের অবশ্যই আগে থেকেই ভেবে দেখা উচিৎ, তাদেরকে ভরণ পোষণ করতে পারবেন কিনা। কারণ বাবা-মা তো বয়স্ক। তারা এখানে এসে কাজ করতে পারবেন না। সেহেতু এদের ভরণ পোষণ করার সামর্থ্য থাকলে তবেই তাদের নিয়ে আসা উচিৎ। আনার পর এতো কষ্ট দেয়া ঠিক না। আমি বলবো এটা এক ধরণের নির্যাতন।

উল্লেখ্য যে, ইউনিভার্সিটি অব অন্টারিওর ইনস্টিটিউট অব টেকনলজী ও রেহমা কমিউনিটি সার্ভিসের যৌথ প্রচেষ্টায় পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা গেছে সাউথ এশিয়ান পরিবারে যে সকল বয়স্ক ইমিগ্রেন্ট দশ বছরের কম সময় ধরে কানাডায় আছেন এবং যাদের ইংরেজী ভাষায় দখল কম তারাই নির্যাতনের শিকার হন বেশী। অন্যদিকে যারা দশ বছর বা তারো বেশী সময় ধরে আছেন কানাডায় এবং ইংরেজী ভাষার উপর মোটামুটিভাবে দখল আছে তারা নির্যাতনের শিকার হন কম।

এলডার এবিউজ এর বিষয়টি অবশ্য নতুন নয়, কিন্তু সাম্প্রতিককালে এর মাত্রা যেন বৃদ্ধি পেয়েছে। বিষয়টি আরো বেশী করে নজরে আসছে ২০০৫ সালে অন্টারিও প্রভিন্সের সঙ্গে সিটিজেনশীপ এন্ড ইমিগ্রেশন কানাডার একটি চুক্তি সম্পাদনের পর। ঐ চুক্তি অনুযায়ী অন্টারিও প্রভিন্স ফেডারেল সরকারের কাছ থেকে কিছু আর্থিক সহযোগিতা পায় সিনিয়র সিটিজেনদেরকে ইংরেজী শিখানোর জন্য এবং একই সাথে তাদের জন্য কিছু বিনোদনমূলক প্রকল্প চালু  করার জন্য। টরন্টোর নিউকামার ওমেন’স সার্ভিসের নির্বাহী পরিচালক মায়া রায় বলেন, অনেক ইমিগ্রেন্ট সিনিয়রদের ধারণাই নেই যে এলডার এবিউজ বিষয়টি কি। যখন তারা ইংরেজী শেখার জন্য ক্লাসে আসেন বা কোন বিনোদনমূলক প্রোগ্রামে অংশগ্রহন করতে আসেন এবং শিক্ষকসহ অন্যান্য কমিউনিটির সদস্যদের সঙ্গে মিলিত হন তখনই কেবল তারা আস্তে আস্তে জানতে পারেন এলডার এবিউজ কি।

অনুমান করা হয় অন্টারিওতে শতকরা ৪ থেকে ১০ জন বয়স্ক ইমিগ্রেন্ট ব্যক্তি নির্যাতনে শিকার হচ্ছেন। কিন্তু সঠিক সংখ্যা নির্নয় করার জন্য এখন পর্যন্ত বড় মাপের কোন জরীপ কার্য পরিচালিত হয়নি। এ কথা বলেন অন্টারিও নেটওয়ার্ক ফর দি প্রিভেনশন অব এলডার এবিউজ এর কর্মকর্তা টেরি ক্যায়ে। অন্যদিকে এলডার এবিউজ অন্টারিও নামের একটি দাতব্য সংস্থার ওয়েবসাইট থেকে যে তথ্য পাওয়া যায় তাতেও দেখা যায় কানাডায় এ বিষয়ে বড় আকারে কোন জরীপ চালানো হয়নি। যেটুকু জরীপ চালানো হয়েছে তাতে আসল চিত্রটি ফুটে উঠেনি।

এলডার এবিউজ অন্টারিও এর ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, কানাডায় এলডার এবিউজ একটি গুরুতর এবং ক্রমবর্ধমান সমস্যা। কিন্তু এর প্রয়োজনীয় ও প্রকৃত চিত্রটি ফুটে উঠছে না কারণ, অনেক এবিউজের ঘটনা পরিবারের সদস্যরা বা এবিউজের শিকার ব্যক্তি নিজেই গোপন রাখেন। ধারণা করা হয় নর্থ আমেরিকায় ২ থেকে ১০ পার্সেন্ট বয়স্ক ব্যক্তি প্রতিবছর কোন না কোন ধরণের নির্যাতনের শিকার হন।

বর্তমানে ২ মিলিয়ন সিনিয়র সিটিজেন বাস করেন অন্টারিওতে যাদের বয়স ৬৫ বা তারো উপরে। এরা অন্টারিও প্রভিন্সের মোট জনসংখ্যার ১৪.৬%। উপরে উল্লেখিত নর্থ আমেরিকার হিসাবটিকে (২-১০%) আদর্শ হিসাবে ধরে নিলে অন্টারিওর যে চিত্রটি ফুটে উঠে তা হলো এখানে বর্তমানে ৪০ হাজার থেকে ২ লক্ষ সিনিয়র সিটিজেন প্রতি বছর কোন না কোন ভাবে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন বা হচ্ছেন।

কানাডায় সার্বিকভাবে সিনিয়র সিটিজেনদের সংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের হিসাব মতে আগামী ২০৩৬ সালের মধ্যে কানাডায় সিনিয়র সিটিজেনদের সংখ্যা দ্বিগুন হবে। অন্টারিওতেও একই অবস্থা হবে। সেই হিসাবে এখানে সিনিয়র সিটিজেনদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে দাড়াবে ৪.২ মিলিয়নে। শতকরা হিসাবে প্রভিন্সের মোট জনসংখ্যার ২৪% হবেন সিনিয়র সিটিজেন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সিনিয়র সিটিজেনদের এই সংখ্যা বৃদ্ধির বিষয়টি গুরত্বসহকারে বিচেনায় নিয়ে এখন থেকেই সচেতন হতে হবে যাতে তারা এবিউজ বা নির্যাতনের শিকার না হন পরিবারের সদস্যদের হাতে।

টেরি ক্যায়ে বলেন, কিছু কিছু ইমিগ্রেন্ট পরিবারে এলডার এবিউজের ঘটনাগুলো সবেমাত্র প্রকাশ পেতে শুরু করেছে। তবে ইমিগ্রেন্ট পরিবারের সাংস্কৃতিক ভিন্নতা এবং ভাষার প্রতিবন্ধকতার কারণে এই এবিউজের ঘটনাগুলো সম্পূর্ণভাবে প্রকাশ পাচ্ছে না, যার ফলে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়ার জন্যও তেমনভাবে কোন উদ্যোগ নেয়া যাচ্ছে না।

টরন্টো স্টারের প্রতিবেদন থেকে আরো জানা যায়, এলডার এবিউজের বিষয়ে টরন্টোর ওয়েলেসলি ইনস্টিটিউট বছর দুই আগে এক রিপোর্ট প্রকাশ করে। ঐ রিপোর্টে ৪৩ জন বয়স্ক তামিল মহিলার কেস স্টাডি করে দেখা হয়।

স্বল্প পরিসরে পরিচালিত ঐ রিপোর্ট থেকে কিছু কিছু তামিল ইমিগ্রেন্ট পরিবারের যে আপাত ও সংক্ষিপ্ত চিত্রটি উঠে এসেছে তাতে দেখা যায় পরিবারের নিকটতম সদস্যকর্তৃকই বয়স্ক ব্যক্তিরা নানাভাবে নির্যাতিত হয়ে আসছেন। নির্যাতনকারীর মধ্যে আছেন তাদের নিজেদের সন্তান, সন্তানদের স্বামী বা স্ত্রী এবং নিজের স্বামী। শারীরিক ভাবে নির্যাতিত হওয়া, আর্থিক ভাবে অনটনের মধ্যে থাকা এবং অবহেলার শিকার হওয়ার অভিযোগ এনেছেন এই বয়স্ক মহিলারা। এমনকি যৌন নির্যাতনের অভিযোগও উঠেছে এই বয়স্ক মহিলাদের কারো কারো কাছ থেকে।

নির্যাতনের শিকার হওয়ার পরও এই মহিলাদের অনেকেই পরিবার থেকে বের হয়ে আসছেন না। বের হয়ে না আসার পিছনে যে বিষয়গুলো তাদের বিবেচনায় থাকে তা হলো, নাতি-নাতনীদের কল্যান, আর্থিক বিষয়, ভাষার সমস্যা, যাতায়ত সমস্যা, কমিউনিটিতে পরিবারের বদনাম হওয়ার ভয়, ইমিগ্রেশন সংক্রান্ত বাধ্যবাধকতা, তথ্যহীনতা এবং বিভিন্ন সাহায্য সংস্থার কাছে যেতে না পারার সমস্যা।

টরন্টোর রেক্সডেল ওমেন সেন্টারের কর্মকর্তা সাদিয়া আকরাম বলেন এলডার এবিউজ বিষয়টি নিয়ে কাজ করার ক্ষেত্রে তহবিল স্বল্পতা একটি সমস্যা। সাদিয়া আরো বলেন, ইমিগ্রেন্ট পরিবারের সংস্কৃতিটা এরকম যে, ঐ সকল পরিবারের কোন বয়স্ক ব্যক্তিকে ‘এলডার এবিউজ প্রোগ্রামের’ নাম করে ঘর থেকে বের করে আনা যায় না। বয়স্ক ব্যক্তিদেরকে ‘সিনিয়র সেফটি প্রোগ্রাম’ বা ঐ জাতীয় কিছু নামের কথা বলে বাড়ি থেকে নিয়ে আসতে হয় তাদেরকে সচেতন করার জন্য।

বিশেজ্ঞদের অভিমত হলো এলডার এবিউজ ঠেকাতে হলে বা এ বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হলে ইমিগ্রেন্টদের নিয়ে কাজ করে এমন সংস্থাসমূহের সম্মুখ সারির কর্মকর্তাদেরকে, ইমিগ্রেন্ট পরিবারের বন্ধু বা প্রতিবেশীদেরকে সার্বক্ষণিক নজর রাখতে হবে। আর যে সকল বয়স্ক ইমিগ্রেন্ট নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন বলে সন্দেহ করা হয় তাদের সঙ্গে কথা বলতে হবে স্বতন্ত্রভাবে। পরিবারের অন্যান্য সদস্যের উপস্থিতিতে বা তাদেরকে জানিয়ে ঐ বয়স্ক ইমিগ্রেন্টদের সঙ্গে কথা বলতে গেলে নির্যাতনের প্রকৃত তথ্য বের হয়ে আসবে না। অন্টারিও নেটওয়ার্ক ফর দি প্রিভেনশন অব এলডার এবিউজ গত ২০০৯ সালে ১৫৪ টি ভাষায় সিনিয়র সেফটি ফোনলাইন চালু করে। প্রথম বছরই তারা ৪৫০০ টি কল পান বলে জানান প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তা টেরি ক্যায়ে।

এলডার এবিউজের ধরণ

এলডার এবিউজ বা বয়স্ক নির্যাতন নানা ধরণের হতে পারে। elderabuseontario.com  এ বিষয়ে একটি বিস্তরিত একটি বিবরণ তুলে ধরা হয়েছে। তাতে দেখা যায়, কানাডায় সবচেয়ে কমন বা প্রচলিত যে  নির্যাতন গুলো হয়ে থাকে সেগুলো হলো শারীরিক নির্যাতন, আর্থিক নির্যাতন, মানসিক নির্যাতন, যৌন নির্যাতন এবং অবহেলার মাধ্যমে নির্যাতন।

শারীরিক নির্যাতন:

শারীরিক নির্যাতন হলো এমন আক্রমণ করা যার ফলে কেউ শারীরিকভাবে আহত হতে পারেন অথবা নাও হতে পারেন কিন্তু ব্যাথা বা অস্বস্তি অনুভব করতে পারেন।  শারীরিক আক্রমণের মধ্যে আছে – ধাক্কা দেওয়া, পদাঘাত করা, চড় মারা, খোঁচা দেওয়া, ঝাঁকুনি দেওয়া, চুল ধরে টান দেওয়া, লাঠি বা অন্য কিছু দিয়ে আঘাত করা, কামড় দেওয়া, হাত মোচড়ানো, থুথু নিক্ষেপ করা, কোন ঘরে জোর করে বন্দি করে রাখা ইত্যাদি।

আর্থিক ভাবে নির্যাতন:

মানুষকে আর্থিকভাবেও নির্যাতন করা যায়। বয়স্কদেরকে আর্থিকভাবে নির্যাতন করা কানাডায় একটি কমন বিষয়। এই ধরণের নির্যাতন ঘটে যখন কেউ একজন কাউকে না জানিয়ে বা না জানিয়ে তার সম্পদ (স্থাবর বা অস্থাবর) হাতিয়ে নেন। অন্টারিতে বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই বয়স্কদের সম্পদ হাতিয়ে নেন পরিবারের সদস্যরাই।

মানসিক নির্যাতন:

মানসিক নির্যাতন হলো এমন নির্যাতন যার মাধ্যমে একজন মানুষের পরিচয়, আত্মমর্যাদা, সম্ভ্রম, সন্মান এবং আবেগের উপর আঘাত আসতে পারে। এই আঘাত মৌখিক ভাবে করা যেতে পারে আবার আচার আচরণের মাধ্যমেও করা যেতে পারে। লেখার মাধ্যমেও কাউকে মানসিক নির্যাতন করা যেতে পারে।

মানসিক নির্যাতনের উদাহরণ:

-এমনসব কথাবার্তা বলা যার মাধ্যমে একজন বয়স্ক ব্যক্তি নিজেকে অযোগ্য বা মূল্যহীন ভাবতে পারেন।

– কারো ব্যক্তিগত ইচ্ছাকে

গুরুত্ব না দেওয়া। সিদ্ধান্ত গ্রহনের অধিকার থেকে বঞ্চিত করা।

-কারো ব্যক্তিগত বিষয়ের প্রতি সম্মান প্রদর্শন না করা কিংবা তার গৃহপালিত পশু-পক্ষীকে নির্যাতন করা।

– কাউকে কোন বিষয়ে হুমকী দেওয়া।

-শিশুদের প্রতি যেমন আচরণ করা হয় সেরকম আচরণ বয়স্কদের প্রতি করা।

-অবজ্ঞা করা বা এড়িয়ে চলা।

-ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে বাধ্য করা।

-‘বাড়ি থেকে বের করে দিব বা ওল্ড হোমে পাঠিয়ে দিব’ এই জাতীয় হুমকী দেওয়া।

-বয়স্কদেরকে সামাজিকভাবে মিশতে না দেওয়া, টেলিফোনে কারো সঙ্গে যোগাযোগ করতে বাধা দেওয়া, বাড়িতে অতিথি আসলে তাদের সঙ্গে মিশতে না দেওয়া।

-নাতি-নাতনীদের সঙ্গে মিশতে না দেওয়া।

যৌন নির্যাতন:

বয়স্ক ব্যক্তিরাও যৌন নির্যাতনের শিকার হতে পারেন। অনেকের কাছে হয়তো এটি অবিশ্বাস্য বা অকল্পনীয় বলে মনে হতে পারে। কিন্তু বাস্তবতা হলো এরকম ঘটনার নজীর অনেক আছে। তবে এ জাতীয় নির্যাতনের ঘটনা সাধারণত ওল্ডহোম বা  নার্সিং হোমগুলোতে ঘটে।

সরাসরি যৌন নির্যাতন করা ছাড়াও কাউকে উদ্দেশ্যমূলকভাবে ছোঁয়া বা চুমু খাওয়া যৌন নির্যাতন হিসাবে বিবেচিত হয়। যৌন মন্তব্য করাও যৌন নির্যাতনের মধ্যেই পড়ে।

এলডার এবিউজ সম্পর্কে লেখক সেলিনা সিদ্দিকী প্রবাসী কন্ঠ ম্যাগাজিনে প্রকাশিত তার এক কলামে লিখেছেন, “বৃদ্ধ মানুষ গুলোর অধিকার আছে পরিবার, সমাজ এবং রাষ্ট্রের কাছে সঠিক ব্যবহারটি পাবার। কারণ তাদের যৌবন বয়েসে তাঁরা তাদের পরিবার, সমাজ এবং রাষ্ট্রের জন্য তাদের মূল্যবান সময় ব্যয় করেছেন। ভালবাসা, মায়া-মমতার মোড়কে জড়িয়ে রেখে আমরা বাংলাদেশের বৃদ্ধরা প্রতি নিয়ত এবিউজ-এর স্বীকার হচ্ছি। আমরা প্রকাশ করতে লজ্জা পাচ্ছি, ভয় পাচ্ছি, পাছে লোকে কিছু বলে এই ভেবে। অন্যের দায় কে আমরা নিজের দায়, নিজের লজ্জা বলে চুপ করে থাকছি। আমাদের অনেক বেশি অধিকার সচেতন হতে হবে।”

তিনি আরো লিখেন, “কানাডা একটি উন্নত দেশ, এখানে বসবাসকারী বৃদ্ধদের রয়েছে নানা ধরনের সুবিধা। কেউ যদি তার পরিবারে অথবা অন্য কোথাও এবিউজের স্বীকার হন তাৎক্ষণিক ভাবে তাকে সাহায্য করার জন্য কানাডার বিভিন্ন প্রদেশে রয়েছে অনেক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। আমাদের বৃদ্ধদের উচিত যদি কোন ধরনের বৈষম্যের শিকার হই, এবিউজের মুখোমুখি হই তবে সব লজ্জা, দ্বিধা দ্বন্দ ত্যাগ করে যথাযথ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে দ্রুত যোগাযোগ করা।”

এলডার এবিউজ মূলত পৃথিবীর সব দেশেই ঘটে থাকে। কোথাও কম কোথাও বেশী। আর এটি ঘটার পিছনে বিভিন্ন কারণও রয়েছে। তবে কুসংস্কার, বিদ্বেষ এবং বৃদ্ধদের প্রতি নেতিবাচক মনোভাবই মূলত এলডার এবিউজ ঘটার পিছনে মূখ্য ভূমিকা পালন করে। অন্টারিও প্রভিন্সও এর ব্যতিক্রম নয়। ব্যতিক্রম নয় কানাডায় বসবাসকারী সাউথ এশিয়ান ইমিগ্রেন্টরা যাদের মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশী কমিউনিটিও। আর যেহেতু এই এলডার এবিউজের সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে আমাদের কমিউনিটিতেও তাই এ বিষয়ে এখনই সচেতন হওয়ার সময় এসে।

এলডার এবিউজ সব বিবেচনায়ই একটি নিষ্ঠুর কাজ। বৃদ্ধ মানুষের অধিকার হরনের কাজ। অন্টারিও হিউম্যান রাইটস কমিশনও এই এবিউজকে মানবাধিকার লংঘন হিসাবে বিবেচনা করে। কমিশন মনে করে সরকার ও বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের দায়িত্ব রয়েছে এ বিষয়টির উপর যথাযথ গুরুত্ব দেওয়া।

আমাদের কমিউনিটিতে মানসিক নির্যাতন, অবহেলা, ভারবাল এবিউজ এর ঘটনা গুলোই বেশী ঘটে থাকে : ড.মাহবুব রেজা

টরন্টোতে এলডার এবিউজ নিয়ে একটি প্রোজেক্ট শুরু করেছিল বাংলাদেশ সেন্টার। বাংলাদেশী কমিউনিটিতে এলডার এবিউজ এর বিরুদ্ধে সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে করা এই প্রজেক্টটির দায়িত্বে ছিলেন সেন্টারের ভাইস প্রেসিডেন্ট ড.মাহবুব রেজা। নিচে তার একটি সাক্ষাৎকার প্রকাশ করা হলো।

প্রশ্ন : আমরা দেখেছি অন্টারিওতে বসবাসকারী সাউথ এশিয়ান কমিউনিটিতে এলডার এবিউজ ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। এখানকার বাংলাদেশী কমিউনিটিও ঐ সাউথ এশিয়ান কমিউনিটিরই অংশ। কিন্তু আমাদের কমিউনিটিতে এ বিষয়ে তেমন কোন সচেতনতা ইতিপূর্বে  লক্ষ্য করা যায়নি। তবে সম্প্রতি আপনারা এ বিষয়ের উপর একটি উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন। সেই উদ্যোগটা কি ছিল এবং আপনার কতটুকু সফল হয়েছেন তা নিয়ে একটু বিস্তারিত বলবেন কি?

ড.মাহবুব রেজা

উত্তর : বাংলাদেশ সেন্টার এল্ডার এবিউজ এর উপর সত্যিকার অর্থে ২০১৫ সালের মার্চ থেকে কাজ শুরু করে ফেডারেল সরকারের অর্থায়নে “অনার আওয়ার এলডারসঃ স্টপ এবিউজ” একটি প্রোজেক্ট এর মাধ্যমে। আনন্দের কথা হল, ২০১৬ এর মার্চ মাসেই সমস্থ কার্যক্রম সফল ভাবে শেষ হোল।

আমার জানা মতে এলডার এবিউজ নিয়ে আমাদের কমিউনিটিতে বিসিসিএস এর আগে কোন কাজ হয়নি। তবে সিনিয়রদের কে নিয়ে কাজ হয়েছে এবং হচ্ছে।  যেহেতু এটা নিয়ে আগে কোন কাজ হয়নি তাই প্রথম দিকে আমাদের বেশ কষ্ট করতে হয়েছে। ভাল কথা হল, যেভাবে আমরা প্রোজেক্ট টা ডিজাইন করেছিলাম-তা সঠিক এবং সময়মত শেষ করতে পেরেছি। এজন্য আমাদের ভলান্টিয়ার এবং কমিউনিটির সিনিয়র সদস্যদের প্রতি আমরা অত্যন্ত কৃতজ্ঞ।

এই প্রোজেক্ট এর কার্যক্রমের মধ্যে ছিল ৬টা সচেতনতা মূলক ওয়ার্কশপ, যেখানে আমরা বাইরে থেকে স্পিকারদের কে আমন্ত্রণ

জানিয়ে তাদের কথা শুনেছি এবং প্রশ্নত্তর পর্বের আয়োজন করেছি। এতে আমরা অনেক তথ্য জেনেছি এবং উপকৃত হয়েছি। আমাদের আরেকটি উল্লেখযোগ্য কার্যক্রম ছিল- এবিউজ সম্পর্কে ১০টি প্রবন্ধ লোকাল কমিউনিটি নিউজ পেপারে  প্রকাশ করা। এটাও কমিউনিটিতে দারুনভাবে প্রতিফলিত এবং আদৃত হয়েছে। এজন্য আমরা সব লেখক সহ মিডিয়ার সবাইকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। তাছাড়া এবিউজ রিলেটেড ২টা পূর্ণ দৈর্ঘ্য ছবির প্রদর্শনীর আয়োজন করি। এছাড়াও বাস্তব ঘটনাকে অবলম্বন করে লেখা একটি নাটকও মঞ্চস্থ করি। এবিউজ এর তথ্য সম্বলিত বাংলায় লেখা একটি  পুস্তিকাও  বের করি। এ বিষয়ের উপর একটি ডকুমেন্টারীও তৈরী করেছি আমরা বাংলাদেশ সেন্টারের পক্ষ থেকে। এটি ইউটিউবে আপলোড করা আছে। যে কেউ ইচ্ছে করলে এটি দেখতে পারেন। ইউটিউব লিং হলো :https://www.youtube.com/watch?v=lQ6Lyo498is

এইসব কার্যক্রমের মাধ্যমে আমরা মনে করি আমাদের কমিউনিটির কাছে এলডার এবিউজ আর কোন নতুন শব্দ নয়। এটা একটা সমস্যা এবং আমাদেরকেই মোকাবেলা করতে হবে। এজন্য তারা এখন মোটামুটি তথ্যসমৃদ্ধ।

প্রশ্ন:  কানাডায় কিছু কিছু ইমিগ্রেন্ট পরিবারে এলডার এবিউজ বা বয়স্ক নির্যাতনের ঘটনা ঘটছে। এ বিষয়গুলোর ব্যাপারে আপনার বক্তব্য কি?

উত্তর : হাঁ ঠিকই বলেছেন, কানাডাতে বয়স্ক নির্যাতন হচ্ছে। যে ব্যাপারে আগে আমরা তেমন কিছুই জানতাম না। তবে, বাংলাদেশ সেন্টারে এ বিষয়ের উপর একটি প্রোজেক্ট শুরু করার পর থেকে আমরা অনেক কিছুই জানতে পেরেছি। এই যেমন- এবিউজ কত কত প্রকার এবং কি কি? সাহায্যকারী সংস্থার নাম-ঠিকানা, ইত্যাদি। আমাদের কমিউনিটিতে মানসিক নির্যাতন, অবহেলা, ভারবাল এবিউজ এর ঘটনা গুলোই বেশী ঘটে থাকে। সত্যি কথা বলতে কি, আমাদের কালচার এ এবিউজ এর ধারনাটা নাই বল্লেই চলে। তবে এখনও আমাদের কমিউনিটিতে এলডার এবিউজ তেমন একটা সমস্যা হিসেবে মাথাচারা দিয়ে উঠনি। কিন্তু এখনই সময় এবিউজ সম্পর্কে আরও জানা, এবিউজ এর আইন-কানুন, এবিউজড্ হলে কি কি করনীয় তার একটা সম্যক ধারনা নেয়ার।

প্রশ্ন : আপনি ব্যক্তিগতভাবে কয়টি ঘটনার সাক্ষী?

উত্তর : সঠিক সংখ্যা মনে নেই, তবে ৪-৫ টা তো হবেই। এর মধ্যে মহিলাদের সংখ্যাই বেশী। তারা আমাদের সেন্টারে সাধারনত ওয়াক-ইন-ক্লায়েন্ট। হয়ত এসেছেন এক কাজে কিন্তু ইন্টারভিউ এর সময় আসল কথা গুলো বলে ফেলেন। আমরাও মনোযোগ সহকারে সেগুলো শুনি এবং গোপনীয়তা রক্ষা করি।

প্রশ্ন : আপনি ব্যক্তিগতভাবে যে নির্যাতনের ঘটনাগুলোর সাক্ষী বা তৃতীয়পক্ষের মাধ্যমে যে নির্যাতনের ঘটনাগুলো অবগত হয়েছেন সেই নির্যাতনের ধরণগুলো কিরকম?

উত্তর : টু-টেল-দা-ট্রুথ, আমি কোন নির্যাতন নিজে দেখিনি, তবে নির্যাতিতের মুখ থেকে বিভিন্ন গল্প শুনেছি। আমরা সাধারনত ওইসব কেস গুলোকে যেখানে লিগ্যাল এইড পাওয়া যায় সেখানে রেফার করি। কারণ এই মুহূর্তে সেন্টারের ওই রকম জনবল নেই যে আমরা তাদেরকে নিয়ে আইনি লড়াই বা নেগোশিয়েশন করবো।

আমরা যে কেস গুলো শুনেছি সেগুলো মানসিক, ভারবাল, আর্থিক এবিউজ এর ক্যাটাগরির। তবে দুই একটা ডোমেস্টিক ভায়োলেন্সের ঘটনাও আছে।

প্রশ্ন : বয়স্ক বা বৃদ্ধ পিতা-মাতাকে কানাডায় এনে কিছু কিছু পরিবার তাদেরকে দিয়ে ন্যানি বা ঘরকন্যার কাজ করান। বাজার করা থেকে শুরু করে স্কুলে ছেলে-মেয়েদের আনা নেয়া করা, বাড়িতে দেখাশুনা করার কাজ করা ইত্যাদি প্রায় সবই করানো হয় তাদেরকে দিয়ে। অনেকটা চাপসৃষ্টির মাধ্যমেই এই কাজগুলো করানো হয়। এ বিষয়ে আপনার অভিমত বা প্রতিক্রিয়া কি?

উত্তর : এটা একটা খুবই সুন্দর প্রশ্ন এবং এটাই আমাদের কমিউনিটিতে সবচেয়ে বেশী ঘটছে বলে মনে হয়। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো, প্রথমদিকে এটা ঘটেনা, শুরু হয় আনার কিছুদিন পর, এরকম ঘটনা আপনিও হয়তো শুনে থাকবেন, এরকমই একটা বাস্তব ঘটনাকে নিয়ে গত ২৫শে মার্চ বিসিসিএস একটা নাটক মঞ্চস্থ করেছে। ভীষণ হিট হয়েছে। এ ব্যাপারে আমার মতামত হল আমাদের আরোও সচেতন হতে হবে- দুই পক্ষকেই, হয়তোবা কালচার এর কারনে বাবা-মা রা মুখ খুলতে চাইবেন না। তাই আমরা যারা ছেলেমেয়ে- তাদেরকেই আরো যতœবান হতে হবে। ভুলে গেলে চলবে না যে উনারা আমাদের জন্মদাতা এবং আজ আমাদের এই অবস্থানে পৌছার পেছনে তাদের অবদান অনেক।

প্রশ্ন : নির্যাতনের শিকার বয়স্ক ব্যক্তিগণ অনেক সময় নির্যাতনের ঘটনা চেপে যান পারিবারিক অশান্তি আরো বেড়ে যাবে বা বিষয়টি লজ্জাকর এমন ধারণা থেকে। এ বিষয়ে আপনার পরামর্শ কি?

উত্তর : এটাও একটা বাস্তব সত্য। এটা কিন্তু শুধু আমাদের কমিউনিটিতেই না, এই দেশেও মনে হয় একি অবস্থা। এবিউজ এর জরীপ থেকে জানা যায় যে আসল এবিউজ এর অর্ধেকও আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থার কাছে রিপোর্ট করা হয়না। তার মানে কি দাঁড়ালো ? এদেশেও কোন একটা সামাজিক বাধা কাজ করে। আমাদের বেলায় যেটা বেশী ঘটে- সেটা হোল বয়স্কদের নিয়ে আসার পর যদি কোন কারনে তারা এডজাস্ট করতে না পারেন (সেটা নির্যাতনের কারনেই হোক বা অন্য কারনেই হোক) আমরা উনাদেরকে আবার দেশে পাঠিয়ে দেই। কেউ জিজ্ঞেস করলে হয়তো বলি- বেশী ঠান্ডা বলে পাঠিয়ে দিলাম- আবার আসবেন, কিংবা অন্য একটা মিথ্যে অজুহাত দিই। সত্য কথা বলিনা- সন্মানের ভয়ে।

এখানেও আমি বলবো আমাদেরকে আরও সচেতন হতে হবে। বয়স্কদের আনার আগে অনেক বিচার-বিশ্লেষণ করতে হবে। তাদের শারীরিক অবস্থা, নিজের পরিবারের সম্পর্ক, বাচ্চাদের বয়স, বাসস্থানের আকার সহ আরও কিছু বিষয়।

প্রশ্ন : প্রবাসে বৃদ্ধ পিতা-মাতাকে ঠিকমত দেখাশুনা না করতে পারলে এবং তাদরে প্রাপ্য সম্মান ও অধিকার নিশ্চিত না করতে পারলে তাদেরকে এদেশে নিয়ে আসা কতটুকু যুক্তিযুক্ত? এ ব্যাপারে আপনার অভিমত ও পরামর্শ কি?

উত্তর : প্রত্যেক সমাজেই কালচার একটা বড় ফ্যাক্টর। তার দ্বারা আমরা সবাই প্রভাবিত হই। মনে হয় আমরা বঙ্গালীরা একটু বেশী ইমোশনাল, এতদূর থেকেও সারাক্ষণ চিন্তা করি – বাবা-মা দেশে না-জানি কত কষ্টে আছেন! এখানে এলে একটু হয়তো আরামে থাকবেন। আমার চোখের সামনে থাকবে, কমপক্ষে চিকিৎসাটা ত ঠিকমত হবে। আমাকে না কতই কষ্ট করে মানুষ করেছেন… এখনই ত সময় ঋণ পরিশোধ করার। এটা অত্যন্ত ভাল চিন্তা কিংবা যুক্তি।  এই চিন্তা করেই আমরা অনেকে উনাদেরকে নিয়ে আসছি। যারা এসেছেন হয়তবা তাদের অনেকেই খুব ভাল আছেন। তবে এই থেকে অনেক তিক্ত অভিজ্ঞতা সঞ্চয় হয়, সম্পর্ক নষ্ট হয়। বিশেষ করে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক, বাবা-মার সাথে ছেলেমেয়ের সম্পর্ক এমন এক পর্যায়ে পৌঁছে যে সেটা থেকে বিবাহ বিচ্ছেদ পর্যন্ত হতে পারে। বাবা-মা কর্তৃক এক ছেলের বাসা থেকে অন্য ছেলে বা মেয়ের বাসায় আসা যাওয়া মাত্রাতিরিক্তভাবে বেড়ে যায় এবং আরও অনেক কিছু ঘটে।

তাই আমি বলবো আবেগকে বেশী গুরুত্ব না দিয়ে বাস্তব অবস্থা গুলো বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নিন। বিশেষ করে তাদের অ্যাডাপটিভ-ক্যাপাবিলিটি, শারীরিক অবস্থা, নিজের পরিবারের মধ্যে সম্পর্ক, বাচ্চাদের বয়স, বাসস্থানের আকার, কানাডাতে কিম্বা ধারেকাছে বসবাসরত নিকট আত্মীয়র সংখ্যা সহ আরও কিছু বিষয়।

সবশেষে আর একটি বিষয় উল্লেখ করতে চাই-তা হল আমাদের কমিউনিটিতে সাপোর্ট গ্রুপ তৈরি করা। যদি আমরা সেটা করতে পারি তাহলে শুধু এবিউজ সমস্যা ই নয় অনেক সামাজিক সমস্যার সমাধানগুলোকে অনেক সহজ করতে পারি।

ড. গোলাম দস্তগীর

প্রবীণরা সবচেয়ে বেশী হারে নির্যাতিত হয়ে থাকেন নিজ পরিবারের সদস্যদের দ্বারাই : ড. গোলাম দস্তগীর

ড. গোলাম দস্তগীর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের প্রাক্তন বিভাগীয় প্রধান ও অধ্যাপক। বর্তমানে তিনি টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিজিটিং অধ্যাপক হিসেবে গবেষণা করেন এবং সেনেকা কলেজে অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত। তিনি একাডেমি অব লার্নিং কলেজের ওয়ার্ডেন/শেপার্ড শাখায় কমিউনিটি সার্ভিস ওয়ার্কার ডিপ্লোমা প্রোগ্রামের পূর্ণকালীণ শিক্ষক। তাঁর একাধিক গ্রন্থ টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারে সংকলিত আছে। তাঁর কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল প্রবাসে এলডার এবিউজের বিষয়টি তিনি কিভাবে দেখছেন এবং তার পরামর্শ কি।  প্রশ্ন : কানাডায় কিছু কিছু ইমিগ্রেন্ট পরিবারে এলডার এবিউজ বা বয়স্ক নির্যাতনের ঘটনা ঘটছে। নির্যাতনের এ বিষয়গুলোর ব্যাপারে আপনি কতটুকু অবগত?

উত্তর: বয়স্ক নির্যাতনের (elder abuse) বিষয়টি আলোচনার পূর্বে কানাডার প্রেক্ষাপটে “বয়স্ক” কথাটা স্পষ্ট করা প্রয়োজন। বার্ধক্যতা বা প্রবীণতা ¯্রষ্টা কর্তৃক সৃষ্ট প্রাকৃতিক নিয়মে বয়ঃপ্রাপ্তির পরিণত এবং অপরিহার্য পন্থা। সব সমাজে এবং সব দেশেই প্রবীণ জনগোষ্ঠি বিদ্যমান। আর সমাজভেদে তাঁদের ওপর আচরণের পার্থক্য পর্যবেক্ষিত হয়। বর্তমানে কানাডাতে ১৩ শতাংশেরও অধিক জনগোষ্ঠি প্রবীণ।

প্রতি বছর ১০ লক্ষের

অধিক প্রবীণ নির্যাতনের (elder abuse) শিকার হন, কিন্তু মাত্র পাঁচজন ভুক্তভোগীর মধ্যে একজনের খবর সংবাদ মাধ্যমে আসে। বর্তমান বিশ্বে প্রতি পাঁচ সেকে-ে একজন বয়স্ক ব্যক্তি নির্যাতনের শিকার হন। দুঃখের বিষয় যে, প্রবীণরা সবচেয়ে বেশী হারে নির্যাতিত হয়ে থাকেন নিজ পরিবারের সদস্যদের দ্বারাই। প্রবীণ ব্যক্তিরা যেসব ধরণের নির্যাতনের শিকার হন তা সাধারণত: তিনভাগে বিভক্ত – পারিবারিক (domestic), প্রাতিষ্ঠানিক (institutional) ও আত্ম-নির্যাতন self-abuse)।

প্রশ্ন : আপনি ব্যক্তিগতভাবে কয়টি ঘটনার সাক্ষী?

উত্তর: আমি ব্যক্তিগতভাবে দু’একটি ঘটনার কথা শুনেছি, কিন্তু নিজে প্রত্যক্ষভাবে এরূপ কোন ঘটনার সাক্ষী নই। তবে, এখানে বলে রাখা ভালো যে, আমি যেসব ঘটনার কথা শুনেছি তা শারীরিক কিংবা আর্থিকভাবে নির্যাতনের পর্যায়ে পড়ে না। বরং এগুলো মনস্তাত্ত্বিক নির্যাতনের অন্তর্গত বলা যায়, কেননা জন্মভূমি থেকে বয়স্ক পিতামাতাকে এদেশে এনে নিজের বাড়িতে রেখে ভাড়া হিসেবে তাঁদের প্রদত্ত ভাতা থেকে অর্থ আদায় করা আর ভাড়াটে হিসেবে গণ্য করার মধ্যে তফাৎ কোথায়? এতে বয়স্ক পিতামাতার মানসিক অবস্থাটা কীরূপ হয় তা সহজেই অনুমেয়।

প্রশ্ন : বয়স্ক বা বৃদ্ধ পিতা-মাতাকে কানাডায় এনে কিছু কিছু পরিবার তাদেরকে দিয়ে ন্যানি বা ঘরকন্যার কাজ করান। বাজার করা থেকে শুরু করে স্কুলে ছেলে-মেয়েদের আনা নেয়া করা, বাড়িতে দেখাশুনা করার কাজ করা ইত্যাদি প্রায় সবই করানো হয় তাদেরকে দিয়ে। অনেকটা চাপসৃষ্টির মাধ্যমেই এই কাজগুলো করানো হয়। এ বিষয়ে আপনার অভিমত বা প্রতিক্রিয়া কি?

উত্তর: বৃদ্ধ পিতা-মাতা আমাদের বাঙালী সমাজ ও সংস্কৃতিতে সম্মানিত স্থান পাওয়ার অধিকারী এবং একান্নবর্তী পরিবারে বয়োজ্যেষ্ঠ হিসেবে আলাদা শ্রদ্ধার পাত্র হিসেবে গণ্য। কিন্তু কানাডা তথা প্রাশ্চাত্য সমাজে তাঁদেরকে সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে না দেখে অর্থনৈতিকভাবে অনুৎপাদনশীল বা অক্ষম হিসেবে গণ্য করা হয় এবং বৃদ্ধাশ্রমকে উপযুক্ত স্থান বলা হয়। অসুখ-বিসুখ বা বাৎসরিক অনুষ্ঠান ছাড়া ছেলেমেয়েরা তাঁদের সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ করে না বললেই চলে।

আমাদের বাঙালী সমাজে বয়স্ক পিতা-মাতারা নাতি-নাতিনীদের সঙ্গ পছন্দ করেন আর ছোট বাচ্চারাও তাঁদের নিকট থেকে অনেককিছু শিখে থাকে। যদি তাঁরা একসঙ্গে একই পরিবারে বসবাস করে থাকে এবং প্রয়োজনে সানন্দে বাজার করা থেকে শুরু করে স্কুলে ছেলে-মেয়েদের আনা নেয়া করা, বাড়িতে দেখাশুনা করার কাজ করে থাকে তাতে দোষের কিছুই নেই। তাছাড়া তাঁদেরও তো সময় কাটাবার জন্য সঙ্গ ও কাজের প্রয়োজন। কিন্তু মুল বিষয়টা হলো আমরা তাঁদেরকে কীভাবে দেখছি। এসব কাজে আমরা তাঁদেরকে বাধ্য করছি, না তাঁরা এ ব্যাপারগুলো স্বেচ্ছায় এবং সানন্দে করছেন তা-ই মূখ্য বিষয়। তাঁরা যদি কানাডায় থাকার জন্য কিংবা সন্তানদের খুশি করার জন্য এরূপ কাজ করতে বাধ্য হন তাহলে তা হবে অবশ্যই অসৌজন্যমূলক ও অনৈতিক আচরণ।

প্রশ্ন : নির্যাতনের শিকার বয়স্ক ব্যক্তিগণ অনেক সময় নির্যাতনের ঘটনা চেপে যান পারিবারিক অশান্তি আরো বেড়ে যাবে বা বিষয়টি লজ্জাকর এমন ধারণা থেকে। এ বিষয়ে আপনার পরামর্শ কি?

উত্তর: একথা অতীব সত্য যে, আমাদের দেশের বৃদ্ধ পিতা-মাতারা অনেকসময় পারিবারিক অশান্তির ভয়ে চোখবুজেঁ অনেক ধরণের মানসিক নির্যাতন সহ্য করেন। এটি কোন সমাধান নয়। একথা মনে রাখতে হবে যে, এটি কানাডা, বাংলাদেশ নয়। এখানে, প্রত্যেকের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা সুরক্ষিত। তাঁদের মানসিক স্বাস্থ্য বা মনস্তাত্ত্বিক সুস্বাস্থ্য শারীরিক স্বাস্থ্যকে প্রভাবিত করে। তাঁদের শারীরিক ও মনস্তাত্ত্বিকভাবে সক্ষম থাকা প্রত্যেকের অধিকার। নির্যাতিত ও অধিকার বঞ্চিত প্রবীণরা অন্য প্রবীণদের সঙ্গে মতবিনিময় করতে পারেন। তাঁরা অবশ্যই স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যোগাযোগ করতে পারেন। কানাডার স্বাস্থ্যসেবায় “জনকল্যাণ সেবা কর্মী” (Community Service Worker) একটি উত্তম স্বাস্থ্যসেবা। প্রায় প্রতিটি হাসপাতাল বা চিকিৎসাকেন্দ্রে “সিএসডব্লিউ” (CSW) কর্মরত থাকেন যারা পারিবারিক চিকিৎসকের সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করেন। এছাড়া সরকারী ও স্বেছাসেবী একাধিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে যেখানে তাঁরা যোগাযোগ করতে পারেন, যেমন,National Centre for Elder Abuse, Canadian Network for the Prevention of Elder Abuse (CNPEA), Ontario Network for the Prevention of Elder Abuse (ONPEA), ElderCareCanada ইত্যাদি।  প্রয়োজনে বয়স্ক নির্যাতনের টেলিফোন লাইনে

(১-৮৬৬-২৯৯-১০১১) যোগাযোগ করা যায়।