টরন্টোতে হাজার হাজার তরুনীকে কৌশলে বা জোরপূর্বক যৌনদাসী বানানো হচ্ছে
খদ্দেরদের মধ্যে আছে ব্যবসায়ী, চিকিৎসক, আইনজীবী, পুলিশ অফিসার, শিক্ষক এমনকি আদালতের বিচারকও!
ফেব্রুয়ারি ১৩, ২০১৬
প্রবাসী কন্ঠ ডেস্ক : টরন্টোসহ অন্টারিও প্রভিন্সের বিভিন্ন অঞ্চলে হাজার হাজার তরুনীকে কৌশলে বা জোর করে বাধ্য করা হচ্ছে যৌনদাসী হিসাবে কাজ করার জন্য। অবাধ্য হলে এদের উপর নেমে আসে শারীরিক নির্যাতন। দিনে ১০ থেকে ১৫ জন খদ্দেরের কাছে শরীর বিক্রি করতে হয় হতভাগ্য এই তরুনীদের কাউকে কাউকে। এদের মধ্যে কারো কারো বয়স ১২ বছর। আর এই যৌনব্যবসা দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে টরন্টোসহ গোটা প্রভিন্সজুড়ে! গত ডিসেম্বরে টরন্টো স্টার এর এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে এমনি চাঞ্চল্যকর তথ্য প্রকাশিত হয়েছে।
আগের দিনের দাসদের মত হতভাগ্য এই তরুনীদের বেচা-কেনাও করা হয়। গত ২০১৩ সালে টরন্টোতে এমনি এক তরুনীকে পুলিশ উদ্ধার করে যাকে দালালদের কাছে বিক্রি করে দিয়েছিল তার নিজের জন্মদাত্রী মা। ঐ তরুনীর বয়স ছিল ১৭। তার মা ছিল ড্রাগ এডিক্টেড। প্রতিনিয়ত ড্রাগের পয়সা যোগার করতে গিয়ে একপর্যায়ে ঐ মহিলা ঋণগ্রস্থ হয়ে পরে। আর সেই ঋণের টাকা পরিশোধ করার জন্য নিজের মেয়েকে বিক্রি করে দেয় এক দালালের কাছে।
যৌনদাসী হিসাবে এই মেয়েরা যা আয় করে তার সবটাই দালালদের পকেটে জমা হয়। আর সকলেরই ধারণা যে এই মেয়েদেরকে দেশের বাইরে থেকে উচ্চ বেতনের চাকরীর প্রলোভন দেখিয়ে আনা হয় নানান অবৈধ উপায় অবলম্বন করে। আর এখানে এনে তাদের পাসপোর্ট বা অন্যান্য কাজগপত্র আটক করা হয়। ভয় দেখানো হয়, কথার অবাধ্য হলে পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হবে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, এই মেয়েদের প্রায় সকলেরই জন্ম কানাডায়!
টরন্টোর আইন-শৃংখলা পরিস্থিতি অনেক উন্নত। গোটা নর্থ আমেরিকায় যতগুলো শহর আছে তার মধ্যে টরন্টোর অবস্থান প্রথম সারিতে। কিন্তু আইন-শৃংখলার আলোকজ্জ্বল এই শহররের একটি অন্ধকার দিক হলো যৌনদাসীদের এই বিষাদাচ্ছন্ন বন্দী জীবন।
টরন্টো স্টার এই অনুসন্ধানী প্রতিবেদনটি তৈরী করে সরকারী বিভিন্ন ডকুমেন্ট সংগ্রহ করে এবং সোস্যাল ওয়ার্কার ও আইন-শৃংখলা বাহিনীর বিভিন্ন সদস্যদের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করে। অপরাধের শিকার কয়েকজন তরুনী ও তাদের অভিবাবকেরও সাক্ষাৎকার গ্রহন করা হয়। সাক্ষাৎকার নেয়া হয় একজন গ্রেফতারকৃত দালালেরও।
গোয়েন্দা বিভাগের একজন কর্মকর্তা এ প্রসঙ্গে জানায়, যৌনদাসীদের নিয়ে এই ব্যবসা দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে কারণ, এটি প্রায় বিনা পূঁজিতে অতি লাভজনক একটি ব্যবসা। দালালেরা মাত্র একজন যৌনদাসীকে কাজে লাগিয়ে বছরে প্রায় তিন লক্ষ ডলার আয় করতে পারে। আর ইন্টারনেট এই ব্যবসাকে এখন আরো সজহ ও তুলনামূলকভাবে নিরাপদ করে দিয়েছে দালালদের জন্য। কারণ, এখন যৌনদাসীদেরকে আর রাস্তায় দাড়িয়ে থেকে খদ্দের সংগ্রত করতে হয় না।
গ্রেফতারকৃত এক দালাল ম্যাথিও ডিয়াকো জানায়, গত এক দশকে টরন্টোর অন্ডারগ্রাউন্ড সেক্স ট্রেড বৃদ্ধি পেয়েছে ব্যাপক আকারে। সে আরো জানায়, একজন যৌনদাসী দিনে গড়ে এক হাজার ডলারের মত আয় করতে পারে। আর কোন দালালের অধীনে যদি অন্তত চারজন যৌনদাসী থাকে তবে মাসে সত্তর হাজার ডলার কামানো কোন ব্যাপারই না।
ম্যাথিও জানায়, একজনকে যৌনদাসী বানানোর প্রক্রিয়টা শুরু হয় তার বয়ফ্রেন্ড সেজে তার সঙ্গে মেলামেশার মধ্য দিয়ে। ক্রমে মেয়েটিকে স্বপ্ন দেখানো হয় অর্থ জৌলুস আর নিরাপদ ভবিষ্যতের। আর সহজভাবে অর্থ আয়ের পথ হলো সেক্স ট্রেড। সহজভাবে অধিক অর্থ আয় করে তারা বাড়ি বানাবে, বিয়ে করবে। এইরকম আরো অনেক স্বপ্ন দেখানো হয়। একই সাথে এই বার্তাও মেয়েটির কাছে পৌঁছে দেয়া হয় যে, অন্যের সঙ্গে সেক্স করলেও তাদের সম্পর্ক অটুট থাকবে।
এই যৌনদাসীদের প্রায় সকলেরই একই কাহিনী। তাদেরকে এই অন্ধকার জগতে নিয়ে আসা হয় নানান প্রলোভন দেখিয়ে যার মধ্যে আছে অর্থ ও নিরাপদ ভবিষ্যত। কাউকে কাউকে আনা হয় প্রেমের ফাঁদে ফেলে। কেউ কেউ নিজেরাই পরিবার থেকে পালিয়ে আসে। কেউ আছে যারা পিতা-মাতা কর্তৃক পরিত্যক্তা।
একবার এই অন্ধকার জগতে এসে পারলে তাদের পালাবার আর পথ থাকেনা। কারণ, পালাতে গেলে দালালরা তাদেরকে মারধর করে। গায়ে আগুনের স্যাকা দেয়। হত্যা করা হবে এরকম ভয়ও দেখানো হয়। ভয় দেখানো হয় তাদের পরিবারের ক্ষতি করা হবে।
কদিন পর পর এই যৌনদাসীদের অবস্থানও বদল করা হয় । টরন্টোর ফোরস্টার হোটেল থেকে শুরু করে সস্তার মোটেলেও যৌনদাসীদের নিয়ে চলে এই দেহ ব্যবসা। বিভিন্ন দালালদের মধ্যে যৌনদাসীদের বেচা কেনাও চলে।
এই যৌনদাসীদের খদ্দের কারা? প্রাপ্ত তথ্যে যা দেখা যায় তাতে চোখ কপালে উঠার মত। খদ্দেরদের মধ্যে আছে ব্যবসায়ী, চিকিৎসক, আইনজীবী, পুলিশ অফিসার, সাধারণ দিনমজুর, ড্রাগ ডিলার, কলেজ স্টুডেন্ট, শিক্ষক এমনকি আদালতের বিচারকও! মাঝে মধ্যে লেসবিয়ান মহিলাদেরও দেখা যায় খদ্দের হিসাবে।
গত ২০১৩ সাল থেকে এ পর্যন্ত টরন্টোর পুলিশ সাড়ে তিনশরও বেশী দেহ ব্যবসার দালালদের ধাওয়া করে এবং ১১৪ জন দালালকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়।
দেহ ব্যবসায় নিয়োজিত এই যৌনদাসীদের উপর অত্যাচারের সীমা থাকে না অনেক সময়। কখনো কখনো তা ভয়ঙ্কর ও বর্বরোচিত পর্যায়ে চলে যায়। টরন্টো এলাকায় কর্মরত গোয়েন্দা কর্মকর্তা ডেভিড কোরেয়া বলেন, আমি এমনো ঘটনা দেখেছি – এই যৌনদাসীদের জেনিটাল এরিয়ার অভ্যন্তরে জোর করে স্পঞ্জ ঢুকিয়ে রাখা হয় যাতে করে দিনে একাধিক খদ্দেরের সঙ্গে মিলিত হতে হলে রক্তপাত না ঘটে। টরন্টো পুলিশের সেক্সক্রাইম ইউনিটের ইন্সপেক্টর জনা বিইভেন বলেন, এই যৌনদাসীদের প্রতি এমন ব্যবহার করা হয় যেন তারা গবাদি পশু। গবাদি পশুদেরকে একস্থান থেকে অন্যস্থানে সরিয়ে নেয়ার সময় যে রকম ব্যবহার করা হয়, এই যৌনদাসীদের প্রতিও ঠিক ঐরকম ব্যবহার করা হয় যখন তাদেরকে কিছুদিন পর পর একস্থান থেকে অন্যস্থানে সরিয়ে নেয়া হয়। তিনি আরো বলেন, এই যৌনব্যবসা শুধু টরন্টো বা অন্টারিওর সমস্যা নয়। গোটা কানাডাতেই চলছে এই অপকর্ম।
মিসিসাগায় অবস্থিত গেটস ইন্ এর মালিক সুনি জানান, টরন্টোর বড় বড় হোটেল এবং ছোটখাট মোটেল বা ইন্ সব জায়গাতেই এই সমস্যা বিরাজ করছে। প্রতিদিনই এই যৌনদাসী, তাদের মক্কেল ও দালালদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে হচ্ছে।
কানাডায় যৌনতা বা অন্য শ্রমের জন্য মানব পাচার করাকে বেআইনী ঘোষণা করা হয়েছে ২০০৫ সালে। কিন্তু কোন দালাল এই আইনে সাজাপ্রাপ্ত হয়েছে এমন ঘটনার নজীর প্রথম দেখা যায় ২০১৪ সালে।