অধ্যাপক ড. মীজান রহমান মরণেও যিনি অমর অক্ষয়…
মহান এই শিক্ষাবিদের মৃতুত্যে প্রবাসী বাংলাদেশীরা হারালো নির্ভরযোগ্য এক গুরুজনকে
খুরশিদ আলম , ফেব্রুয়ারি ৮, ২০১৫ : আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন গণিতজ্ঞ ও কানাডার কার্লটন বিশ্ববিদ্যালের প্রফেসর ইমেরিটাস ড. মীজান রহমান আর নেই আমাদের মাঝে। গত ৫ জানুয়ারী অটোয়ার সিভিক হাসপাতালে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৮২ বছর।
সদালাপী, মিশুক, অমায়িক, বন্ধুভাবাপন্ন কিন্তু স্পষ্টভাষী ড. মীজান রহমান ছিলেন উত্তর আমেরিকায় একজন জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব। প্রবাসে এবং দেশে তাঁর রয়েছে অসংখ্য ভক্ত। গণিতশাস্ত্রে পন্ডিত ড. মীজানের পান্ডিত্য ছিল বাংলা কথা সাহিত্যেও। পাঠককূলে তাঁর জনপ্রিয়তা আকাশচুম্বী।
মৃত্যুকে ভয় পেতেন না মীজান রহমান। তিনি নিজেই বলতেন, “মানুষের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা দুটি। এক, তার আকাক্সক্ষা। দুই, তার ভয়। বিশেষ করে মৃত্যুভয়। আকাক্সক্ষা তাকে খর্ব করে, মৃত্যু ভয় তাকে কুব্জ করে। মানুষ জীবনে সুখি হতে চায়, কিন্তু এ এক অদ্ভুত বিড়ম্বনা জীবনের যে সেই সুখের প্রত্যাশার ভেতরেই সুপ্ত তার অসুখের বীজ। যতই চাই আমরা ততই হারাই- এ কেমনতরো বিচার বলুন তো।
কিন্তু তারও চেয়ে বড় বিড়ম্বনা হল মৃত্যুভয়। প্রতিটি মানুষ জানে যে তার জন্মের পর কেবল একটা কথাই ধ্রুবসত্যের রূপ ধারণ করে আবির্ভূত হয় তার সামনে-মৃত্যু। অথচ এটিকেই তার সবচেয়ে বড় ভয়। মানুষ মরতে চায় না। তাই মৃত্যুঞ্জয় হবার আশায় কত না ফন্দী সে আবিষ্কার করেছে। কত না স্বর্গ বেহেশত আর দোজখ আখের সে রচনা করেছে অমরত্বের অর্বাচীন আকাক্সক্ষায়। আমার মতে, মানুষ মৃত্যু দ্বারা যত না মরে, তার চেয়ে বেশি মরে মৃত্যুর ভীতি দ্বারা। এবং এই ভয় কোনও জৈবিক উপায়ে তার অভ্যন্তরে প্রবেশ করে না, প্রবেশ করে সামাজিক আর সাংস্কৃতিক উপায়ে। জীবনের প্রথম প্রভাত থেকেই তাকে প্রস্তুত হতে হয় মৃত্যুর পরবর্তী সেই অলীক পৃথিবীটির জন্যে। যা অস্তিত্বহীন, তার জন্যে তাকে বিসর্জন দিতে হয় যা অস্তিত্বমান ও বাস্তব। জীবনের প্রতিটি সজাগ মুহূর্ত আমরা মরে মরে ক্ষয় করি অমর হবার মূঢ় বাসনাতে। এর চেয়ে বড় আত্মবিড়ম্বনা আর কি হতে পারে?”
১৯৩২ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর ঢাকায় জন্মগ্রহণকারী ড. মীজান রহমান দেশ ছাড়েন প্রায় অর্ধশত বছর আগে। ১৯৫৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণিত ও পদার্থবিদ্যায় স্নাতক, ১৯৫৪ সালে ফলিত গণিতে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নেয়ার পর উচ্চশিক্ষার্থে ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছিলেন তিনি। সেখানে গণিতশাস্ত্রে বিএ, এমএ ডিগ্রি নেন। ১৯৬৫ সালে কানাডার ইউনিভার্সিটি অফ নিউ ব্রানসউইক (Brunswick) থেকে পিএইচডি ডিগ্রী নেন। কানাডার রাজধানী অটোয়ার কার্লটন বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগেই কেটেছে তাঁর বর্ণাঢ্য গণিতজ্ঞের জীবন। এখানে তিনি যোগ দেন ১৯৬৫ সালে। অবসর গ্রহণ করেন ১৯৯৮ সালে। গণিতে তাঁর খ্যাতি ও পান্ডিত্য এতই ছিল যে অবসর গ্রহণের পরও কার্লটন বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে প্রফেসর ইমেরিটাস হিসেবে নিয়োগ দেয় এবং মৃত্যুর আগপর্যন্ত তিনি ওখানেই ছিলেন। ‘হাইপারজিওমেট্রিক সিরিজ’ নিয়ে তাঁর লেখা (সহলেখক) বই গণিতশাস্ত্রে খুবই উচ্চতম কাজ বলে স্বীকৃত।
গণিত শাস্ত্র ও লেখালেখির পাশাপাশি তিনি প্রবাসের বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের সঙ্গেও জড়িত ছিলেন। তাঁর মৃত্যুর পর কানাডায় নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনার কামরুল আহসান এক শোক বাণীতে বলেন, “তিনি ছিলেন বাংলাদেশের গৌরব ও অহংকার। মহান এই শিক্ষাবিদের মৃত্যুতে বাংলাদেশ হারিয়েছে এক কীর্তিমান সন্তানকে যিনি দেশ ও কালের সীমানা পেরিয়ে বাংলাদেশের মর্যাদাকে তুলে ধরেছিলেন আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে। পরোপকারী, শিল্প-সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষক, বন্ধুবৎসল এবং সদাহাস্য এই প্রবীণ অধ্যাপকের প্রয়াণে কানাডা প্রবাসী বাংলাদেশীরা তাঁদের এক নির্ভরযোগ্য গুরুজনকে হারালো। অধ্যাপক মীজান রহমানের চলে যাওয়াতে যে বিশাল শূন্যতা সৃষ্টি হলো, তা কখনোই পূরণ হবার নয়। জাতির এই কীর্তিমান সন্তানকে বাংলাদেশ এবং বিশ্বের নানা প্রান্তে বসবাসকারী বাংলাদেশীরা স্মরণে রাখবেন চিরকাল।”
গুণী ও দেশ দরদী এই মানুষটিকে নিয়ে প্রবাসীদের কৌতুহলও ছিল প্রচুর। সে কারণে প্রবাসী কন্ঠ ম্যাগাজিনে ড. মীজান রহমানের উপর একটি কভার স্টোরী করারও পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল। এ বিষয়ে তাঁর সঙ্গে কথাও হয়েছিল প্রবাসী কন্ঠের সম্পাদক খুরশিদ আলমের যখন তিনি তার বাসায় নিমন্ত্রিত হয়ে এসেছিলেন সম্প্রতি। মীজান রহমান সম্মতও হয়েছিলেন।
কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য। আমাদেরকে সেই সুযোগ দেওয়ার আগেই তিনি চলে গেলেন পরপারে। তাঁর ওপর প্রবাসী কন্ঠ ম্যাগাজিনে কভার স্টোরী হলো ঠিকই, কিন্তু তা মরনোত্তর।
ড. মীজান রহমানের মৃত্যুর সংবাদ শুনে গত ৫ জানুয়ারী কমিউনিটিতে নেমে এসেছিল গভীর শোকের ছায়া। শোকে মূহ্যমান হয়ে পড়েছিলেন টরন্টোর শিল্পী, সংস্কৃতি কর্মী, লেখক ও সাংবাদিকগণ। ফেসবুকে আপলোড হচ্ছিল একের পর শোকবাণী আর স্মৃতিকথা।
টরন্টোর বিশিষ্ট রিয়েল এস্টেট ব্যবসায়ী, সংস্কৃতি সেবী ও বাংলা টিভির অন্যতম নির্বাহী সাজ্জাদ আলী তার ফেসবুকে সেদিন লিখেছিলেন,
“প্রফেসর ড: মিজান রহমান, একটি নাম, একটি প্রতিষ্ঠান। যাঁকে অনুসরণ করেছি, অনুকরণও করেছি। অভিভাবক মেনেছি, কিন্তু তিনি কখনও অভিভাবকত্ব দেখাননি। আমরা মেনেছি তিনি বড় মানুষ, কিন্তু তিনি নিজে কখনও তেমনটি বলেননি। আমি নিজে, বিদ্যা বা বুদ্ধির সংকটে তাঁর শরণাপন্ন হয়েছি এবং সমৃদ্ধ হয়েই ফিরেছি। আশ্রয় ও ভরসার জায়গাটা হারালাম। কত পরিকল্পনা তাঁকে ঘিরে, এটা করবো, সেটা করবো তাকে মধ্যমণি করে। সব কাজই আমাদের জন্য ফেলে রেখে চলে গেলেন আত্মার আত্মীয়!”
টরন্টো প্রবাসী বিশিষ্ট কবি ফেরদৌস নাহার লিখেন, “আপনি অসীম অক্ষয় অমর। আপনাকে জানাই আমার চিরপ্রণতি। মীজান মামা, আপনাকে কখনই ভুলতে পারব না। ওই যে ভেসে আসছে রবি ঠাকুরের গান
“জীবনমরণের সীমানা ছাড়ায়ে,
বন্ধু হে আমার, রয়েছ দাঁড়ায়ে”
বিশিষ্ট কন্ঠ শিল্পী ফারহানা শান্তা লিখেন, “মিজান স্যার আপনার মনের বিশালতার জন্যই হয়তো আপনি জানেন না যে, এই সমাজে প্রশংসা করার লোকের খুবই অভাব। আপনার মত একজন উচ্চমাপের মনিষী আমার মত ক্ষুদ্র শিল্পীর গান শুনে যেভাবে উচ্ছসিত প্রশাংসা করেছেন, আমি খুব ভালো করেই জানি আমি এর যোগ্য নই, তবে আপনার মত বিশাল হৃদয়ের মানুষেরা তো কাউকে কোন কিছু ক্ষুদ্র করে দিতে পারেন না । তাইতো আপনি ক্ষুদ্রকে বৃহৎ করে দেখেন, যেমন দেখেছেন আমাকেও। আপনার কাছে আমার এ ঋণই যে আমার অমূল্য সম্পদ। আপনি চিরশান্তিতে থাকুন।”
বিশিষ্ট কবি দেলওয়ার এলাহী ফেসবুকে তাঁর অনুভূতি ব্যক্ত করেন এভাবে,
আমাদের সবার সৌভাগ্য কানাডায় আমরা ড. মীজান রহমানের আলোয় আলোকিত আর তাঁর স্বর্গীয় সান্নিধ্য পেয়েছিলাম। খুব খাঁটি পর্যবেক্ষণ, ড.মীজান রহমান একজন সম্পূর্ণ এবং সম্পন্ন ‘মানুষ’ ছিলেন।”
এরকম আরো বহুজনের অনুভূতি, স্মৃতিকথা আর শোকবাণীতে ছেয়ে গিয়েছিল ফেসবুক।
মীজান রহমানের শৈশব কেটেছে পুরানো ঢাকায়। কলতাবাজার এলাকায় রোকনপুর নামে ছোট একটি পাড়ায় থাকতেন তিনি। তাঁর বাবার নাম ছিল মোহাম্মদ আলী। জন্ম নরসিংদী জেলার হাসনাবাদে। চাকরি করতেন ফৌজদারি কোর্টে। তাঁর বাবা – মা দুজনেরই জন্ম গ্রামে। মীজান রহমান প্রায়ই বলতেন, “আমি এখনও গর্বের সঙ্গে বলি আমার গায়ে গোবরের গন্ধ আছে। এটা এই ভাবনায় বলি- সে কালের মাটির যে স্বাদ, সেই স্বাদ প্রধানত আসত গোবর থেকে। সুতরাং ঐ যে গোবরের সঙ্গে আমাদের নাড়ির একটা যোগসূত্র সেটা যে মানুষ ভুলে যায়, সে মানুষ নিজের মূলটাকেই ভুলে যায়।”
মীজান রহমান তাঁর নয় ভাই বোনের মধ্যে সবার বড় ছিলেন। পাঁচ ভাই আর চার বোন। ভাইদের মধ্যে একজন থাকেন অস্ট্রেলিয়াতে, আরেকজন থাকেন মার্কনযুক্তরাষ্ট্রে। এক বোন লন্ডনে। মীজান রহমানের ইমিডিয়েট ছোট বোন থাকতেন করাচিতে। সেখানে তিনি পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসে যোগ দেন। সেখানেই পরিচয় হয় কাশ্মীরের এক যুবকের সঙ্গে। পরবর্তীতে বিয়ে হয় তার সঙ্গে। সেই বোনটি অবশ্য বেচে নেই আর। ১৯৮৬ সালে মৃত্যুবরণ করেন তিনি। মীজান রহমানের ছোট ভাই হাবিবুর রহমান বাংলাদেশে সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ের সচিব ছিলেন। তিনি অবসর নেন ১৯৯৫ সালে।
মীজান রহমানের মায়ের নাম ছিল আছিয়া খাতুন। ২০১২ সালে ঢাকা সফর কালে মীজান রহমান স্থানীয় ‘সাপ্তাহিক’ ম্যাগাজিনের প্রতিবেদক শুভ কিবরিয়ার সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে নিজের মা প্রসঙ্গে বলেছিলেন, “ মার সম্পর্কে ‘মা’ বলে একটি লেখা আছে আমার। She was like a shadow, lived like a shadow, died like a shadow. তিনি ছিলেন ছায়ার মতো। বেঁচেছেন ছায়ার মতো, মরেছেন ছায়ার মতোই। ‘মা’ এমন একটা সম্পর্ক, যতদিন ‘মা’ জীবিত থাকে ততদিন তাঁকে আমরা লক্ষ্যই করি না। তাঁকে বুঝতে চাই না। তাঁর ভেতরে যে কষ্ট আছে তা ভাবি না। যখন নিজেদের কষ্ট মোচন করার কথা ভাবি, তখনই মায়ের কাছে যাই। মা আমাদের কষ্টের ওপর মলম মেখে দেয় তাঁর কথা দিয়ে, স্নেহ দিয়ে। কখনই আমরা ভাবি না তিনি শুধু মা’ই নন, তিনি একজন নারী। আমাদের সবচাইতে বড় দুর্বলতা বা ফাঁক হলো এখানেই। আমরা মায়ের বাইরেরটাই দেখি, কিন্তু তাঁর ভেতরের খবর একেবারেই রাখি না। আমার ‘মা’ হচ্ছেন তেমনই একজন মানুষ। সেই মায়ের কাছেই আমার লেখাপড়ার শুরু।”
বাবা প্রসঙ্গে ড. মীজান রহমান বলেছিলেন, “ বাবা ছিলেন স্বল্প বেতনের চাকুরে। কেরানি। বাবার একটা ত্রুটি ছিল। উনি ছিলেন একজন সৎ কেরানি। সৎ কেরানি হলে তাঁর পরিবারের যে কি দুর্গতি হয় সেটা আমরা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি। ঐ যে হাড়ে হাড়ে টের পাওয়া, জীবন দেখাÑ আমি সেটাকেই বলি ‘অভাবের সিন্ধুক’। সেই অভাব থেকেই আমাদের স্বপ্নের জন্ম। আমাদের জীবনে যতকিছু প্রেরণা, তাড়না, বাসনা সবকিছুর মূলেই হলো সেই ‘অভাব’। সেই অভাবের মধ্যে আমরা নয় ভাইবোন একসঙ্গে থেকে নিজেদের মধ্যে জড়াজড়ি করে, শেয়ার করে বড় হয়েছি। একই বিছানায় হয়ত চারজন করে থাকতাম, একটা টেবিলে প্রায় পাঁচজন একত্রে বসে একটা হারিকেনের আলোতে পড়তাম। এভাবে কষ্ট করে করে আমরা মানুষ হয়েছি।”
শৈশবে অভাব আর কষ্টের মধ্যে বড় হলেও ড. মীজান ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী। তিনি যখন ঢাকার মুসলিম হাই স্কুলে যখন পড়তেন, তখন দুটো বৃত্তি পেতেন। একটা হলো স্কলারশিপ আরেকটা হলো পুওর ফান্ডের বৃত্তি। ম্যাট্রিকে ঢাকা বোর্ডে তিনি মেধা তালিকায় ১২তম স্থান অধিকার করেন। ১৯৫৩ সালে তিনি ফিজিক্স অ্যান্ড ম্যাথমেটিক্সে অনার্স (ডাবল অনার্স) পাস করেন প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হয়ে। এরপর মাস্টার্স করলেন এপ্লাইড ম্যাথমেটিক্সে। এ পরীক্ষায়ও তিনি প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হন।
সেই সময় অনার্স, মাস্টার্স মিলে বিশ্ববিদ্যালয়ের সব বিভাগের রেজাল্ট নিয়ে গড় করার পর দেখা যায় মীজান রহমান সমগ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে দ্বিতীয় স্থানে ছিলেন। আর প্রথম স্থানে ছিলেন মঞ্জুর-ই খুদা (ড. কুদরত-ই খুদার ছেলে)। এর মধ্যে ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় মঞ্জুর-ই খুদা ইংল্যান্ডে পড়ার সুযোগ পেয়ে যান। তার অনুপস্থিতিতে বিশ্ববিদ্যালয়ে তখন মীজান রহমান হয়ে যান প্রথম। সেকালে নিয়ম ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ে যার সর্বোচ্চ নাম্বার থাকে সে মেরিট স্কলারশিপে পড়তে যায় বিদেশে। এটা তখনকার পাকিস্তান সরকারের নিয়ম ছিল। প্রতি বছর প্রত্যেক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একজন এই বৃত্তি পেত মেধার ভিত্তিতে। সে সুবাধে মীজান রহমান চলে যান ক্যামব্রিজে। সেখানেও তিনি ভাল রেজাল্ট করেন। ক্যামব্রিজ থেকে তিনি হার্ভাডে যেতে পারতেন ভাল রেজাল্ট করার জন্য। তখন নিয়ম ছিল ক্যামব্রিজ থেকে যে কেউ ভালোভাবে পাস করবে, স্বাভাবিক নিয়মেই হার্ভাডে তাকে অ্যাডমিশন দেয়া হবে। কিন্তু পরিবারের বড় ছেলে, দায়বদ্ধতা রয়েছে। আর্থিকভাবে তাঁর পরিবার নির্ভরশীল ছিল তাঁর উপর। তাই তাঁকে দেশে ফিরে আসতে হয়েছিল সেদিন। দেশে ফিরে এসে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতায় যোগ দেন।
তাঁর এই মেধার কারণে পরিবারের সদস্যরা, বন্ধু-বান্ধব, স্কুলের শিক্ষক সবাই তাঁকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতেন। অবশ্য তিনি নিজের সম্পর্কে বলতেন, “সবাই ধারণা করত অসম্ভব ভালো কিছু করব আমি। But I was nobody. ”
পরবর্তীতে মীজান রহমান ম্যাথমেটিক্সে পিএইচডি করেন কানাডা থেকে। সেটা ১৯৬৫ সালের কথা। কানাডায় আসেন তিনি ১৯৬২ সালে। কানাডার ইউনিভার্সিটি অব নিউ ব্রানসউইক থেকে পিএইচডি ডিগ্রি নেন। এরপরই যোগ দেন অটোয়ার কার্লটন বিশ্ববিদ্যালয়ে। বাকি জীবন তিনি এই বিশ্ববিদ্যালয়েই কাটিয়ে দেন।
গত বছর টরন্টোতে অনুষ্ঠিত নজরুল সম্মেলনে টরন্টো প্রবাসী কবি ও সহিত্যিকদের সঙ্গে মীজান রহমান
অটোয়া শহরটিও ছিল তাঁর খুব প্রিয়। তিনি মনে করতেন অটোয়া একটি আদর্শ শহর। শহরটি বড়ও নয় আবার ছোটও নয়। পরিবার নিয়ে বাস করার মত একটি সুন্দর জায়গা। রাজধানী শহর, খোলামেলা স্থান, আলোবাতাস, হ্রদ, পাখি, বৃক্ষ, নদী সবই আছে এই শহরে। ১৯৬৫ সাল থেকে ২০১৪ সাল প্রায় অর্ধশতাব্দী কাটিয়ে দিয়েছেন তিনি তাঁর এই ভাললাগার শহরটিতে।
ড. মীজান রহমান টরন্টোতে আসতেন প্রায়ই। বাঙ্গালীদের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যোগ দিতেই তিনি আসতেন প্রধানত। তখন তাঁকে নিয়ে প্রায় কাড়াকাড়ি পড়ে যেতো তিনি কার বাসায় উঠবেন। আর তিনিও হোটেলে না উঠে কারো না করো বাসায় উঠতেন। তাঁর ভক্তের অভাব ছিল না। গত বছর শেষের দিকে ড. মীজান একাধিকবার টরন্টো এসেছিলেন। এই ৮২ বছর বয়সেও তিনি নিজেই অটোয়া থেকে গাড়ি ড্রাইভ করে চলে আসতেন টরন্টোতে। একাই চলে আসতেন। প্রায় চার ঘন্টার এই ড্রাইভে তার সঙ্গী ড্রাইভারের প্রয়োজন হতো না। শুধু তো আসা নয়। ফেরত যাওয়ার পথেও আবার সেই চার ঘন্টার ড্রাইভ।
জীবনের শেষ অধ্যায়ে এসে তিনি খুব নিঃসঙ্গতায় ভুগতেন। তাঁর স্ত্রী মারা যান প্রায় এক যুগ আগে (২০০২ সালে)। সেই থেকে তিনি মূলত একাই জীবন যাপন করতেন। দুই ছেলে থাকেন যুক্তরাষ্ট্রে। তবে এই নিঃসঙ্গতাকে তিনি উপভোগও করতেন। এ প্রসঙ্গে তিনি ‘সাপ্তাহিক’ ম্যাগাজিনের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, “নিঃসঙ্গতা আমাকে কষ্ট দেয় না। এটা খানিকটা কাব্যিক মনে হতে পারে। কিন্তু আমি প্রায় আক্ষরিক অর্থে সেটা মিন (Mean) করি। এই যে একাকিত্ব, এই একাকিত্বই আমার এক ধরনের সার্বক্ষণিক নীরব সঙ্গী হয়ে থাকে। অনেকটা আবহ সঙ্গীতের মতো আমাকে ঘিরে থাকে। আমার স্মৃতি আমাকে সঙ্গ দেয়। আমি যখন লেখালেখি করি সেটা আমাকে সঙ্গ দেয়। ভাবনার জগতে আমি ভীষণ মুক্ত। সেই মুক্তি আমাকে সঙ্গ দেয়।”
মীজান রহমান আরো বলেছিলেন, “আমার ব্যক্তিগত চরিত্র একটু ভিন্নরকম। আমি অনেক সময় খুব ভালোভাবে নিঃসঙ্গ হই যখন অনেক লোকজন থাকে আমার চারপাশে। রাস্তায় যখন চলি, যখন সবাই নিজের নিজের পথে চলছে, তখন নিঃসঙ্গতা আমাকে দরুণ আনন্দ দেয়। মনে হয়, এই যে এত লোক রাস্তায় হাঁটছি, চলছি, কেউ জানছে না আমার মনের ভেতর কি ভাবছি আমি। যদিও আমি মোটামুটি মুখরই থাকি। কথাবার্তা প্রচুর বলি। কিন্তু নিঃসঙ্গতাই আমার এক ধরনের সঙ্গী। নিঃসঙ্গতা আমাকে যন্ত্রণা দেয় না, সঙ্গ দেয়।”
আগেই উল্লেখ করা হয়েছে ড. মীজানের পান্ডিত্য ছিল বাংলা কথা সাহিত্যেও। ছাত্র অবস্থায় সাহিত্য নিয়ে কিছু একটা করার চেষ্টা করেছিলেন তিনি। সাহিত্যের প্রতি তাঁর প্রবল ঝোক ও ভালবাসা ছিল শৈশব থেকেই। তিনি নিজেই পত্রিকান্তরে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, “আমার ভেতরে পোকাটা ছিল সাহিত্যের। বরাবরই তাই ছিল। আমি যদি বিদেশে জন্মগ্রহণ করতাম সম্ভবত আমি ম্যাথমেটিশিয়ান হতাম না। I am a very poor mathematician. I think I could be better writer.” উল্লেখ্য যে, জগন্নাথ কলেজে পড়ার সময় (বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়) ছাত্রদের এক সংগঠনের তিনি সাহিত্য সম্পাদকের দায়িত্বও পালন করেন।
কিন্তু পরবর্তীতে লেখাপড়ার চাপে ও জীবন জীবিকার ব্যস্ততায় সে দিকটি নিয়ে আর তেমন অগ্রসর হতে পারেন নি। চাপা পড়ে গিয়েছিল সাহিত্য প্রেম। তবে মনের গহীনে নিশ্চই সাহিত্যের প্রতি আকর্ষণটি সুপ্ত অবস্থায় বিরজমান ছিল। আর তারই প্রতিফলন আমরা দেখি তার জীবনের অপরাহ্ন অধ্যায়ে এসে। তিনি পুনরায় লিখতে শুরু করেন নব্বুই দশকের গোড়া থেকে। তখন কানাডা ও আমেরিকার বিভিন্ন বাংলা পত্র-পত্রিকায় তাঁর লেখা বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠে।
ইতোমধ্যে দশটির বেশি বই বেরিয়েছে তাঁর। সাহিত্য, দর্শন, ইতিহাস সবই এসেছে তাঁর লেখায়।
তিনি নিজেই নিজের সম্পর্কে বলেছেন, “যদিও আমি যে লেখক, এটা এখনও নিজে বোধ করি না। নিজের মধ্যে সেই বোধটা আসেনি। কারণ, আমি তো কবিতা লিখি না, উপন্যাস লিখি না, গল্প মাঝেমধ্যে লিখি, যদিও আমি গল্পকার নই। অর্থাৎ আমি ঠিক প্রচলিত লেখক বলতে যা বোঝায় তা নই। ওদিকে আমি আবার প্রচলিত কলামিস্ট বলতে যা বুঝায় তাও নই। কলামিস্ট হলে সাম্প্রতিক ঘটনাবলি নিয়ে লিখতে হয়। আমি তা করি না। আমি তা হলে কি নিয়ে লিখি?
মোটা দাগে বলা যায়, আমি জীবন নিয়ে লিখি। জীবনের প্রতিফলন নিয়ে লিখি। আমার জীবন আমার ওপর যে পদচিহ্ন রেখে যাচ্ছে সেই চিহ্নগুলোকে আমি সম্প্রসারণ করি। সে হিসেবে আমি ঠিক প্রথামাফিক লেখক নই।”
ড. মীজান নিজেকে যে ভাবেই চিত্রায়িত করুন না কেন তিনি ছিলেন পাঠক নন্দিত। তার প্রতি পাঠকের ভালবাসা ছিল অকৃত্রিম ও অপরিসীম। তিনি নিজেও এটি জানতেন। ‘ব্যানাফ’ (এডমনটনের কাছে একটি পর্যটন শহরের নাম) শিরোনামে তাঁর একটি লেখাতে তিনি এ প্রসঙ্গে নিজেই লিখেছেন, “ আমার মত সাধারণ লেখকের ভাগ্যে এই অসাধারণ প্রাপ্তি এত অফুরন্ত ভালোবাসা এত এত হৃদয়বান মানুষের কাছ থেকে। ক্যানাডা-আমেরিকার যেখানে যাই সেখানেই মানুষ উদারচিত্তে তাদের দুয়ার খুলে দেয় আমার কাছে।”
মীজান রহমান তার এক কলামে (অবসর মানে আলস্য) লিখেছেন, “আমার ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে অনেকেরই কৌতূহল। ওরা আমাকে ‘আত্মজীবনী’ লিখতে বলে। সব্বনাশ! শব্দটা শোনামাত্র আমি আঁতকে উঠি। একাজটি কোনদিনই হবে না আমার দ্বারা, সেকথা তো আগেও বলেছি আমার পাঠকদের। প্রথমতঃ জীবনী লিখে বই প্রকাশ করার মত মূল্যবান জীবন আমার নয়। দ্বিতীয়তঃ ‘আত্মজীবনী’তে আত্মকথা সব খোলাখুলি ব্যক্ত করা হয় সেকথা আমাকে বিশ্বাস করতে বলবেন না দয়া করে। সেখানে দারুণ সেন্সরশীপ হয় ভাই। নিজের সব গোপন কথা অকপটে ফাঁস করে দেবার মত সৎসাহস সংসারে কজনার আছে জানিনা, অন্তত আমার নেই সেটা জানি। তাছাড়া লেখকদের জীবন এমনিতেই বন্ধুহারা, স্বজনহারা। সামান্য লেখালেখি করেই তো একে একে সবাইকে হারালাম আমি। এখন যদি ‘আত্মজীবনী’ লিখে বাকি তথ্যগুলিও ফাঁস করে দিই তাহলে তো জনপ্রাণী একজনও থাকবে না আমার পাশে। অতএব ভাই, ওই অনুরোধটি করবেন না আমাকে।”
জীবন নিয়ে এই লেখকের দৃষ্টিভঙ্গিও ছিল খুব বাস্তববাদী এবং আধুনিক চিন্তা চেতনার অনুকুলে। যুক্তিনির্ভর ছিল তার চিন্তা চেতানা ও বিশ্বাস। “আমাদের মেয়েরা ও আমরা” শিরোনামের একটি লেখাতে লেখকের এই পরিচয় মিলে খুব স্পষ্টভাবে। তিনি লিখেছেন, “আমাদের প্রবীনদের একটা কথা বুঝতে হবেঃ যুগ আমাদের মনের দিকে চেয়ে তার ধারা পরিবর্তন করবে না। বিদেশে তো নয়ই, দেশেও না। পরিবর্তনটা হতে হবে আমাদের নিজেদের ভেতরই। পোশাকে-আশাকে সাজসজ্জায় আর বাহ্যিক আচার আচরণে তো হয়েই যাচ্ছি, কিন্তু বড় পরিবর্তনটা আসতে হবে মনমানসিকতায়। পূব থেকে পশ্চিমে এসেছি আমরা উন্নত জীবনযাপনের আশাতে। পশ্চিমের অগ্রমুখি সমাজের সুযোগসুবিধাগুলো সব উপভোগ করে যাব অবলীলাক্রমে, অথচ পূর্বদেশের পশ্চাতমুখী ধ্যানধারণাগুলি প্রাণপন আঁকড়ে বসে থাকব তা তো হতে পারেনা। কিন্তু তা হয়, অধিকাংশ পরিবারেই হয়। এবং সেকারণে নতুন প্রজন্মের সাথে ঠোকাঠুকিটাও হয় অবধারিতভাবে। এর একটা বিহিত না করতে পারলে একদিকে যেমন স্থানীয় সমাজ থেকে ক্রমেই বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ব আমরা, বহুলপ্রচারিত বহুজাতীয়তা সত্বেও, অন্যদিকে বিচ্ছিন্ন হব আমাদের ছেলেমেয়েদের কাছ থেকেও। এই ‘বিহিতের’ প্রচেষ্ঠাতে ব্যক্তি আর পরিবারকে কেবল নয়, পুরো সম্প্রদায়কেই এগিয়ে আসতে হবে। সমষ্টির যুগ্ম প্রয়াস ছাড়া একক চেষ্টাতে দীর্ঘস্থায়ী সমাধান প্রায় অসম্ভব বলেই আমি মনে করি।”
ধর্ম বিষয়েও তাঁর সুষ্পষ্ট বক্তব্য ছিল। ‘সাপ্তাহিক’ এর সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, “জীবনে এক সময় ছিলাম পূর্ণ আস্তিক। যখন আমার বিশ্বাসকে বিশ্লেষণ করার বুদ্ধিগত বৈদগ্ধময় চিন্তার যোগ্যতা ছিল না। তারপর যখন আস্তে আস্তে যুক্তি দিয়ে সব কিছুকে ভাববার, প্রশ্ন করার আস্থা তৈরি হলো, তখন আমিও বিবর্তিত হলাম। এখন আমার বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই, বিশ্বাসের সঙ্গে সত্যের কোনো সম্পর্ক নেই। বিশ্বাসটা ব্যক্তিগত। সত্যটা অত্যন্ত অব্যক্তিগত এবং নৈর্ব্যক্তিক। আসলে ধর্মের সৃষ্টিটাই হলো মৃত্যুর ধারণার মধ্য দিয়ে। মৃত্যু যদি না থাকত, তাহলে ধর্মের সৃষ্টি হতো না। মৃত্যু না থাকলে ঈশ্বর থাকত না। সবকিছুর মূলেই হচ্ছে মৃত্যু। এখন মৃত্যুক যদি আমি জীবনের অংশ বলে মেনে নেই, ভাবতে পারি, তখন আর সেই ভয়টা থাকে না।
আমি নিজে মৃত্যু ভয়ে ভুগি না। মৃত্যুকে আমি বরণও করি না, আবার বিচরণও করি না। একে আমি জীবনের অখন্ড অংশ বলেই ভাবি। আমি মনে করি মৃত্যু যদি না থাকে তাহলে সতর্কতাও থাকবে না। মৃত্যুর প্রয়োজনেই আমরা জীবনে সতর্ক হই, সাবধান হই!
আমাকে যদি কেউ বলে, তুমি কি অবিশ্বাসী? আমি বলব, আমি বিশ্বাসী। তবে যুক্তিকে সঙ্গে নিয়ে। Belief (ভরসা) আর Faith (প্রশ্নাতীত বিশ্বাস) এর মধ্যে পার্থক্য আছে। Faith is without any logic. Belief is with logic. I have acquired a set of belief, that is my acquisition not imposition. আমার বিশ্বাস অর্জিত, আরোপিত নয়। আমি যুক্তিনির্ভর মানুষ।”
ড. মীজান রহমানের বাস্তববাদিতা ও যুক্তিনির্ভরতার আরো প্রমান মিলে তার বিভিন্ন লেখায়। ‘রহস্য’ শিরোনামের একটি লেখায় তিনি লিখেছেন, “আমার রহস্য যদি থাকে কিছু তা হল যে, আমি নালিশ পছন্দ করি না। জীবন আমাকে যা দেয় তা’ই আমি গ্রহণ করি অম্লানবদনে। আক্ষেপ আমার অসহ্য। হাহুতাশ আমার দুচক্ষের দুষমন। ‘কি হতে পারতাম কি হইনি’ বলে আহাজারি করার মত কাপুরুষ আমি নই, ভাগ্যিস (তাহলে নিজেকে সহ্য করা দুষ্কর হয়ে যেত)। আমার মতে বিগতকে অতীতের দেশে বাস করতে দিন। তাকে আমি বদলাতে পারব না। ওটা নিয়ে ভাবতে গেলে বরং বর্তমানটিও হাতছাড়া হয়ে যাবে। আমার দর্শন অনুযায়ী, গতকাল ইতিহাসের অন্তর্গত, আগামীর বাস স্বপ্নের রাজ্যে। কেবল আজকের দিনটিই আমার অধীন। আমি অদ্যের অধিপতি। যে-কোন কাজ, যে-কোন পরিকল্পনা, যে-কোন উদ্যোগ, আমি আগামীকালের জন্যে ফেলে রাখব না, আজই শুরু করা চাই। আজ, এবং এই মুহূর্তে। আগামী একটি সুদূর সম্ভাবনা মাত্র যার ভিত্তি আজকের উদ্যম। সিক্রেট যদি জানতে চান ভাই এই আমার বিনীত সিক্রেট। সাধারণ মানুষের সাধারণ সিক্রেট।
আরেকটা জিনিস আমি মানি-নিজেকে খুব বেশি গুরুত্ব দিই না। কেউ কেউ ভাবেন তিনি চলে গেলে সর্বনাশ হয়ে যাবে, পৃথিবীর একটা অংশ ধ্বসে পড়বে একেবারে। আপনি আশ্বস্ত হোন, আপনি চলে গেলে সংসার যেভাবে চলছে ঠিক সেভাবেই চলতে থাকবে- পৃথিবী তার কক্ষপথ থেকে বিন্দুমাত্র বিচ্যুত হবে না। নিজেকে কখনোই অপূরণীয় ভাববেন না। আমি যেমন ভাবি না, এবং এটি আমার আরেকটি সিক্রেট। বরং আমি নিজেকে নিয়ে হাসি। নিজের অসঙ্গতিকে নিয়ে ব্যঙ্গ করি-ভেংচি দিই নিজেকে। অনেক চেষ্টা করে আমি আয়ত্ত করেছি কিভাবে নিজের রক্তমাংসের কাঠামো থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে দূরবর্তী পর্যবেক্ষকের সারিতে দাঁড়াতে। তাই আমার মনে খ্যাতির মোহ প্রশ্রয় পায়না। চাওয়া-পাওয়ার প্রাত্যহিক প্রত্যাশা প্রশ্রয় পায়না। আমি যা পাই তা চাই বলে পাই না, চাই না সত্বেও পেয়ে যাই কখনো কখনো তখন তা সকৃতজ্ঞচিত্তে গ্রহণ করি। গ্রহণ করি, প্রধানত যার কাছ থেকে পাওয়া তারই সম্মানার্থে। নিজের সম্মান? সে-ভাবনাটাই আমার কাছে দারুণ হাস্যকর মনে হয়।”
মীজান রহমান এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, “বিয়ে তো সবাই করে। আমিও করলাম। যদিও গরিব ঘরের বড় ছেলের বোধহয় বিয়ে না করাটাই ভালো। তবুও আমি করলাম। অনেকটা সে কারণেই আমি দেশের বাইরে চলে গেলাম।”
মীজান রহমানের স্ত্রী শামসুন্নাহার যার ডাক নাম ছিল পারুল তিনি বিয়ের পর থেকেই কিডনির রোগে ভুছিলেন। কিডনিতে গুরুতর সমস্যা ছিল। চিকিৎসকরা বলেছিলেন, ভবিষ্যতে কিডনি ফেইলিউর হবার সম্ভাবনা খুবই বেশি। শুধু তাই নয়, চিকিৎসকরা পরামর্শ দিয়েছিলেন, যদি সন্তান নিতে চাও, আর দেরি করো না। তখনই মীজান-পারুল দম্পত্তি সন্তান নেবার সিদ্ধান্ত নেন। প্রথম তিন বছরে তাঁদের দুই পুত্র সন্তান জন্ম নেয়।
মীজান রহমান এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, “ভাবতে পারেন, আমার স্ত্রী হাসপাতালে আর আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াব? ছেলেদের স্কুলে নিয়ে যেতে হবে, আনতে হবে। তাদের জন্য রান্না করতে হবে। আমার নিজের খাবার রান্না করতে হবে। আমি কি এসব কাজ করার জন্য একজন সুপারম্যান? এক হাতে সব করতে পারব? অথচ ৩০ বছর ধরে আমাকে এসব কাজ করতে হয়েছে। আমরা যেন ভুলে না যাই, আমার জীবনের ৩০টা বছর কেটেছে মূলত আমার স্ত্রীকে রোগশয্যাতে দেখে। মানুষ এটা ভুলে যায়। এটা যে কি জিনিস ভুক্তভোগী ছাড়া কেউ তা অনুধাবন করতে পারবে না।”
স্ত্রী শামসুন্নাহারের এক ভাই ছিলেন মৃত্তিকা বিজ্ঞানের অধ্যাপক। অপর ভাই ভাষা সৈনিক ও রাজনীতিবিদ অলি আহাদ।
কানাডায় যাবার ফলে বাংলাদেশে আপনার পরিবারকে (বাবা-মা-ভাইবোন) কি কিছুটা আর্থিক সহায়তা করতে পারছিলেন? নাকি নিজের স্ত্রী সন্তানদের নিয়েই ব্যস্ত থাকতে হয়েছিল? ‘সাপ্তাহিক’ এর এরকম এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছিলেন, “এ বিষয়ে আমার ভেতরে যে অন্যায়, বিবেকের যে দংশন, সেটা নিয়েই আমাকে মরতে হবে। সেই দায়িত্বটুকু আমি নিচ্ছি। স্ত্রীর অসুস্থতা ছাড়াও আরও অনেক পারিবারিক কারণে আমার মনে হলো দূরত্বটা প্রয়োজন। আমি জানি, বাংলাদেশে আমার পরিবারের সে সময় দারুণ অর্থকষ্টে দিন কেটেছে। আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করেছি। কিন্তু আমার যথাসাধ্য চেষ্টা আমার পরিবারের জন্য যথেষ্ট হয়নি।”
ড. মীজান রহমানের বড় ছেলে বাবু কানাডার কার্লটন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে গ্রাজুয়েশন করেছেন। পরে আমেরিকার ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া থেকে এমএসসি ও পিএইচডি করেছেন। সেখানেই চাকরি করছেন আইবিএম কোম্পানিতে। ওখানেই থাকেন। আমেরিকাই তার নিবাস, চাকরিস্থল। বিয়ে করেছেন ওখানে জন্মনেওয়া গুজরাটি এক মুসলমান মেয়েকে। সোফিয়া তার নাম।
ছোট ছেলে রাজা। তার জীবন হলো সঙ্গীতনির্ভর। তিনি পিয়ানিস্ট। তাকে পাঠানো হয়েছিল কনজারভেটরি অব মিউজিক, সেন্ট লুইস-এ। সেখান থেকে পাস করার পর চান্স পেলেন নিউইয়র্কের জুলিয়ান স্কুলে। জুলিয়ান স্কুলকে ধরা হয় হার্ভাড অব মিউজিক। সেখান থেকে ডিগ্রী নেওয়ার পর এখন ফ্রিল্যান্সার হিসেবে কাজ করছেন। থাকেন লাসভেগাসে। প্রোগ্রাম করে বেড়ান নানা জায়গাতে।
‘সাপ্তাহিক’ এর পক্ষ থেকে তাকে আরো প্রশ্ন করা হয়েছিল এই বলে যে, আপনি বাংলাদেশের জলকাদায় বেড়ে উঠলেন, এখানকার স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করলেন। এরপর প্রায় সারাজীবন ব্যয় করলেন প্রবাসে। আপনার তাহলে দেশের প্রতি অবদান কি? কি ফেরত দিলেন দেশকে? নাকি নিজেকে এখন একজন বৈশ্বিক নাগরিক হিসেবে ভাবতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন?
জবাবে ড. মীজান রহমান বলেছিলেন, “হোয়াট ডু ইউ মিন বাই দেশের প্রতি কনট্রিবিউশন? দেশের প্রতি কনট্রিবিউশন মানেটা কি? আমি যখন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে যাই, লোকে আমাকে সম্মাননা দেয়, আমি যখন গর্বের সঙ্গে বলি আমি বাংলাদেশের মানুষ, তখন কি বাংলাদেশের সুনাম হয় না। It’s not a contribution?
কি ধরনের কনট্রিবিউশন আপনারা চান? আমি তো বিশাল মাপের কোনো মানুষ নই। আমি নিজেকে যেভাবে describe করি, সেটা হলো আমার অত্যন্ত সীমিত মেধা দিয়ে যতটুকু সাফল্য অর্জন করা সম্ভব ছিল আমার পক্ষে, আমি মনে করি সেটা হয়ে গেছে। সুতরাং আমার কোনো regret নাই। আবার মনে রাখতে হবে আমি এমন কোনো বিশাল ব্যক্তিত্ব নই, যেখানে সাফল্যের পাওনা আমি নিজের সঙ্গে সঙ্গে দেশকেও দিতে পারব। সুপারম্যান হলে আমি দেশ, পরিবার সবাইকে হয়ত আরও কিছু দিতে পারতাম। আমি গান্ধী, নেহেরুর মতো মানুষ হলে হয়ত পারতাম। কিন্তু আমি তা নই।”
১৯৭১ সালে বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ড. মীজান এর সঙ্গ গভীরভাবে যুক্ত ছিলেন। কারণ, পুরোটা কর্মজীবন প্রবাসে কাটালেও হৃদয়ে ছিল তার বাংলাদেশ। তার প্রমাণ আমরা দেখি একাত্তরে বাংলাদেশের মুক্তিআন্দোলনে সময়। তিনি নিজেই বলতেন, “আমি দেশে ফিরিনি ব্যক্তিগত কারণে, তা না হলে আমি দেশ ছেড়ে বাইরে যাবার মানুষ নই। কোনোদিনই সে রকম মানুষ ছিলাম না। সুতরাং দেশের কান্নাতে অন্যদের মতো আমিও আকুল হয়েছিলাম। আমার পক্ষে যতটুকু সম্ভব, মুক্তিযুদ্ধের সময় আমি তা করেছি, আমার স্ত্রী করেছেÑ আমরা সবাই করেছি।”
মীজান রহমান মৃত্যুর আগে তাঁর দেহটি দান করে গিয়েছিলেন হাসপাতালে। তবে তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর পরিবারের সদস্যরা তাঁকে সমাহিত করেন অটোয়ার কার্প রোডের নিকট অবস্থিত একটা কবরস্থানে। তার আগে মরহুমের এর জানাজা অনুষ্ঠিত হয় পাইন ক্রেস্ট এ একটা হলে।
অধ্যাপক ড. মীজান রহমান, আমাদের সকলের মীজান ভাই আর আমাদের মাঝে ফিরে আসবেন না। এ ক্ষতি পুষিয়ে নেবার মতো নয়। তাঁর এই চলে যাওয়ার মধ্য দিয়ে আমরা প্রবাসীরা যে ভাইকে হারালাম, যে অভিভাবককে হারালাম যে উদ্দীপনাদাতা ও অনুপ্রেরণাদাতাকে হারালাম যে ভালবাসার মানুষটাকে হারালাম তাঁকে আর ফিরে পাবো না। এ বড় কঠিন কষ্ট, বড় কঠিন সত্য।
(প্রচ্ছদে ব্যবহৃত মীজান রহমানের ছবিটি তুলেছেন মানিরুল ইসলাম। পারিবারিক এ্যলবামের ছবি শিল্পী শান্তার ফেসবুক থেকে সংগৃহীত।)