কানাডার জাতীয় নির্বাচন ও ইসলামোফোবিয়া

আগামী ১৯ অক্টোবর অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে কানাডার ৪২তম জাতীয় নির্বাচন। ইনোভেটিভ রিসার্স নামের একটি জরীপ সংস্থা পরিচালিত সর্বশেষ জরীপে (১ অক্টোবর) দেখা যাচ্ছে জনপ্রিয়তার মাপকাঠিতে এগিয়ে আছে লিবারেল পার্টি। দ্বিতীয় স্থানে কনজারভেটিভ পার্টি এবং তৃতীয় স্থানে নিউ ডেমোক্রেটিক পার্টি (এনডিপি)। তবে এই জরীপ রিপোর্টের ফলাফল প্রায় প্রতিদিনই পরিবর্তিত হচেছ। আবার একেক জরীপ প্রতিষ্ঠানের রিপোর্ট একেক রকম তথ্য দিচ্ছে। অন্যদিকে আনডিসাইডেড বা দোলায়মান ভোটারদের বিষয়ে কোন ভবিষ্যতবাণী করা যাচ্ছে না। ফলে নির্বাচনের ফলাফল কি হবে তা জরীপের উপর ভিত্তি করে সুস্পষ্টভাবে আগাম বলা যাবে না।

জরীপে আমরা দেখতে পাচ্ছি, দীর্ঘ প্রায় ১০ বছর একটানা ক্ষমতায় থাকার পর কনজারভেটিভ পার্টি এবার নির্বাচনী দৌড়ে পিছিয়ে আছে। বিষয়টি আরো আগে থেকেই টের পাচ্ছিল কনজারভেটিভ পার্টির নেতৃবৃন্দ। তাই তারা সময় থাকতেই নানান কুটকৌশলের আশ্রয় নিতে থাকে। আর তারই অংশ হিসেবে আমরা দেখতে পাই বিল সি-৫১ এবং বি সি-২৪ এর প্রবর্তন।

কানাডায় যারা ইসলামোফোবিয়াতে ভুগছেন তাদের জন্য এটি একটি উদ্দিপনা হিসেবে কাজ করেছে। তবে সন্ত্রাস বিরোধী বিল সি-৫১ এর বিরোধীরা মনে করেন, মধ্যপ্রাচ্যে ‘আই এস’এর সাম্প্রতিক কর্মকান্ড, গত বছর কানাডার পার্লামেন্টে মানসিক বিকারগ্রস্থ এক ফ্রেঞ্চ কানাডিয়ান যুবকের হামলা এবং তারো আগে কুইবেকে আরেক হতোদ্যম ও বিষন্নতায় ভোগা যুবক কর্তৃক একজন কানাডীয় সৈন্যকে হত্যা করার বিষয়টিকে জঙ্গীপনার ইস্যু বানিয়ে প্রধানমন্ত্রী স্টিফেন হারপার আসন্ন নির্বাচনে পুনঃনির্বাচিত হওয়ার জন্য এই সন্ত্রাস বিরোধী আইনটি পাস করিয়েছেন।

সমালোচকরা আরো বলছেন, ক্ষমতাসীন দল ভোট পাওয়ার জন্য সন্ত্রাস / জঙ্গীবাদ, বোরখা-নেকাব, অনার কিলিং ইত্যাদিকে ইস্যু করে সামনে এগুবার চেষ্টা করছে। ফল যা হবার তাই হচ্ছে। অর্থাৎ কানাডায় ইসলামোফবিয়া এবং মুসলমান বিরোধী মনোভাব ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে।

স্মরণ করা যেতে পারে যে, নাগরিকত্ব লাভের জন্য শপথ গ্রহণের সময় নেকাব পরা যাবে কি যাবে না এ বিষয়ে বিষয়ে ফেডারেল কোর্টের রায় ঘোষণার পর প্রধানমন্ত্রী স্টিফেন হারপার বলেছিলেন তাঁর সরকার এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করবে। ফেডারেল কোর্ট নেকাবের পক্ষেই রায় দিয়েছিল। পরে ক্ষমতাসীন সরকার এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করলে অতি সম্প্রতি আপিল আদালত আগের রায়কেই বহাল রাখে। ক্ষমতাসীন সরকার এখন বিষয়টি সুপ্রিম কোর্টে নিয়ে যাবে বলে ঘোষণা দিয়েছে।

নেকাব নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর ঐ বক্তব্য প্রচারের পর অবশ্য প্রশ্ন উঠেছিল তাঁর উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য নিয়ে। তিনি কি আসলেই নেকাব নিষিদ্ধ করার পক্ষে নাকি এই নেকাব নিয়ে নতুন কোন রাজনীতি শুরু করেছেন?

সমালোকচরা বলছেন, আগামী ১৯ অক্টোবরে অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় নির্বাচনে কুইবেকের ভোট বেশী সংখ্যায় পাওয়ার জন্যই তিনি এই নেকাব রাজনীতিতে নেমেছেন। নিকাবের বিরুদ্ধে কথা বললে কুইবেকের ভোটারগণ খুশি হবেন। কারণ, কুইবেকের সিংহভাগ ভোটার মুসলমানদের এই নেকাব আর হিজাবের ঘোর বিরোধী।

এদিকে আরো অভিযোগ উঠেছে যে, প্রধানমন্ত্রী স্টিফেন হারপার ওমর খাদারের (গুয়ান্তানামার সাবেক বন্দি যিনি আফগানিস্তানে আলকায়দার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন বালক বয়সে। তার বাবা তাকে সেখানে নিয়ে যায়) বিষয়টি নিয়েও অতি বাড়াবাড়ি করেছেন ভোট রাজনীতির কারণে। আদালত যেখানে ওমরকে জামিনে মুক্তি দিয়েছে সেখানে তিনি আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলেন তাকে জেলের অভ্যন্তরে আটকে রাখার জন্য। এই ইস্যুতে ওমরের আইনজীবী ডেনিস এ্যাডনি  প্রধানমন্ত্রী স্টিফেন হারপারকে প্রকাশ্যে মুসলমান বিরোধী এক ধর্মান্ধ ব্যক্তি বলে আখ্যায়িত করেন। তিনি বলেন, “এটি প্রমান করার জন্য যথেষ্ট প্রমানাদিও রয়েছে।”

এভাবে ক্ষমতাসীন দল ও প্রধানমন্ত্রী স্টিফেন হারপার মিলে ভোট রাজনীতির নামে মুসলমানদের বিরুদ্ধে কানাডার সাধারণ মানুষদের মন বিষিয়ে তুলছেন এমন অভিযোগ তুলেছেন অনেকেই।

ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর গুইডা ম্যান-এর মতে, নাগরিকত্বের অনুষ্ঠানে নেকাব পরার মত বিষয়ে অটোয়া থেকে যেসব কথা বলা হয় সেগুলো ইমিগ্রেন্টদের সম্পর্কে বর্ণবাদী মনোভাব তৈরিতে ভূমিকা রাখে। তিনি আরো বলেন, “এত বেশি সংখ্যক মানুষের বর্ণবাদী দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণের অন্যতম কারণ হলো আমাদের সরকারের, বিশেষ করে রক্ষণশীল সরকারের এবং নির্দিষ্ট করে প্রধানমন্ত্রী স্টিফেন হারপারের বক্তৃতাবাজী।”

আর এর সবকিছুর মূলে রয়েছে কানাডার জনগনের মধ্যে ইসলামোফোবিয়া তৈরী করে আসন্ন নির্বাচনে পুননির্বাচিত হওয়ার স্বপ্ন।

তবে এ কথাও সত্যি যে, কানাডায় ইসলামোফোবিয়া তৈরীতে খোদ মুসলমানদেরই একটি অংশ নানাভাবে ইন্দন যুগিয়েছেন। আর তাতে ঘি ঢেলেছেন ক্ষমতাসীন রক্ষণশীল দলের রাজনীতিবিদরা।

আমরা দেখেছি, কানাডায় মুসলমানদের মধ্যেই লুকিয়ে আছেন কিছু জঙ্গী অথবা জঙ্গী সমর্থক। ম্যাগডোনাল্ড লরিয়ার ইনস্টিটিউট কর্তৃক প্রকাশিত এক জরীপ রিপোর্ট থেকে জানা যায় “কানাডার শতকরা ৬৫ ভাগ মুসলমান ইসলামী জঙ্গী সংগঠনের কার্যক্রম পছন্দ করেন না। তবে শতকরা ৩৫ ভাগ মুসলমানের সমর্থন রয়েছে ইসলামী জঙ্গী সংগঠনগুলোর কার্যক্রমের পক্ষে। যা মোটেও সুখকর নয়। বেশীরভাগ কানাডীয় মুসলিম জঙ্গীবাদের বিপক্ষে থাকলেও শতকরা ৩৫ ভাগ রয়েছে এর পক্ষে।”

ফলে রক্ষণশীল দলের পক্ষে মুসলিম বিরোধী অপপ্রচার চালানো খুব সহজ হয়ে উঠেছে এবং তারই ফলশ্রুতিতে মুসলমানদের বিরুদ্ধে অবিশ্বাস, ঘৃণা ও ভীতি ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। কানাডার বাইরে আই এস জঙ্গীরা ইসলাম ধর্মের নামে যা করছে সেটিও এই অবিশ্বাস, ঘৃণা ও ভীতি বাড়ানোর ক্ষেত্রে ইন্ধন যোগাচ্ছে।

ইসলামিক সুপ্রিম কাউন্সিল অব কানাডার প্রেসিডেন্ট সৈয়দ সোহরাওয়ার্দী ইতিপূর্বে কানাডার সিবিসি নিউজকে বলেন, “এক দশক আগের চেয়ে এখন স্থানীয় তরুণদের মৌলবাদী হয়ে উঠার প্রবণতা অনেক বেড়ে গেছে। ”

এর সাথে আরো আছে নেকাব পরা নিয়ে গোড়া মুসলমানদের বাড়াবাড়ি, অনার কিলিং এর মতো জঘন্য অপরাধ, মূল সমাজ ব্যবস্থা থেকে নিজেদেরকে গুটিয়ে রাখার সংকীর্ণতা ইত্যাদি।

এ কারণে অনেকেই মনে করেন, এই যদি হয় পরিস্থিতি তবে কানাডায় সাধারণ মানুষের মধ্যে মুসলমান বিরোধী মনোভাব কেন গড়ে উঠবে না? অবিশ্বাস, ঘৃণা ও ভীতি কেন জন্ম নিবে না? সুযোগতো বাস্তব অর্থে মুসলমানদের মধ্যে যারা গোড়াপন্থী রয়েছেন তারাই করে দিচ্ছেন।

আমাদেরকে মনে রাখতে হবে নির্বাচন ইস্যুতে দুনিয়ার তাবত রাজনীতিবিদদের চরিত্র কমবেশী একই রকম। অর্থাৎ নির্বাচনের আগে নির্বাচনে জয়ী হওয়ার জন্য তারা নানান কুটকৌশলের আশ্রয় নেন। কনজারভেটিভ পার্টি কর্তৃক ইসলামোফোবিয়া তৈরী করার চেষ্টাও সেরকমই একটি কুটকৌশল।

এখন দায়িত্বটা মুসলমানদেরই। তাদেরকেই প্রমাণ করতে হবে যে তারা জঙ্গীবাদকে ঘৃণা করেন। মুসলমানদের মধ্যে একটি অতি ক্ষুদ্র অংশ যারা গোঁড়া বা মৌলবাদে বিশ্বাসী তাদেরকে প্রতিহত করার জন্য সাধারণ মুসলমানদেরকেই এগিয়ে আসতে হবে। আসন্ন নির্বাচনে ভোট পাওয়ার জন্য কনজারভেটিভ পার্টি ইসলামোফোবিয়া তৈরী করছে, সুতরাং দোষ তাদের, একথা বলে বসে থাকলে হবে না। মোট কথা, কনজারভেটিভ পার্টির উপর এককভাবে দোষারোপ করে মুক্তি মিলবে না। নিজেদেরকেই উদ্যোগ নিতে হবে নিজেদেরই স্বার্থ রক্ষার জন্য।

অক্টোবর ৯, ২০১৫