‘কানাডিয়ান এক্সপিরিয়েন্স’

ইমিগ্রেন্টদেরকে চূড়ান্তভাবে অপদস্থ ও অসম্মান করার বুলি এটি

এটি বর্ণবাদী আচরণ এবং মানবাধিকারের লংঘন : অন্টারিও হিউম্যান রাইটস কমিশন

কানাডার চাকরী বাজারে নতুন আসা ইমিগ্রেন্টদেরকে চূড়ান্তভাবে অপদস্থ ও অসম্মান করার এক বুলির নাম হলো ‘‘কানাডিয়ান এক্সপিরিয়েন্স’’। লক্ষ লক্ষ পেশাজীবী ইমিগ্রেন্টদেরকে পঙ্গু করে রাখা হয়েছে চাকরীর বাজারে “কানাডিয়ান এক্সপিরিয়েন্স” নেই এই অজুহাত তুলে । তাদের অবস্থা এখন হয়েছে ‘‘না ঘরকা না ঘাটকা’’। দেশেও তারা ফিরে যেতে পারছেন না পুরনো চাকরীটি ফিরে পাওয়ার জন্য, অন্যদিকে কানাডায়ও তারা প্রবেশ করতে পারছেন না তাদের নিজ নিজ পেশার চাকরীতে।

এটি শুধু অপমান ও অপদস্থ করা নয়, নতুন আসা ইমিগ্রেন্টদের মানবাধিকারও লংঘন করা হচ্ছে ‘‘কানাডিয়ান এক্সপিরিয়েন্স’’ নামক ঐ বর্ণবাদী বুলির মাধ্যমে। সম্প্রতি অন্টারিও হিউম্যান রাইটস কমিশনও এর নিন্দা জানিয়েছে এবং তাদের নতুন এক পলিসিতে এই অভিমত দিয়েছে যে এটি নিশ্চিতভাবেই ইমিগ্রেন্টদের মানবাধিকার লংঘন। কানাডায় অন্টারিও হিউম্যান রাইটস কমিশনই প্রথম সংগঠন যারা এই ধরণের একটি বক্তব্য দিল।

অনেকেই ধারণা করছেন অন্টারিও হিউম্যান রাইটস কমিশনের এই পলিসি গ্রহনের ফলে কানাডার বাইরে থেকে ডিগ্রি ও কাজের অভিজ্ঞাতা নিয়ে আসা পেশাজীবী ইমিগ্রেন্টদের চাকরি খুঁজে পাওয়া সহজ হবে। মূলত এই কমিশন চেষ্টা করছে যাতে ‘‘কানাডিয়ান এক্সপিরিয়েন্স’’ নামক বর্ণবাদী বাধাটিকে দূর করা যায়।

আমরা জানি গত প্রায় দুই দশকের মধ্যে পৃথীবির বিভিন্ন দেশ থেকে থেকে প্রচুর সংখ্যক পেশাজীবী কানাডায় এসেছেন ইমিগ্রেন্ট হয়ে। আর এও জানি যে, এদের সিংহভাই চাকরী পাননি তাদের নিজ নিজ পেশায়। এই পেশাজীবীদের মধ্যে আছেন ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, কৃষিবিদ, বিজ্ঞানীসহ আরো নানান পেশার লোক। নিজ নিজ পেশায় চাকরী না পেয়ে তারা কেউ হয়েছেন পিজ্জা ডেলিভারী ম্যান, কেউ হয়েছেন ক্যাব ড্রাইভার, কেউ হয়েছেন মিল-ফ্যাক্টরীর দিন মজুর। যাদের সকালে চাকরী থাকে তো বিকেলের গ্যারান্টি নেই। সারাদিন হারভাঙ্গা পরিশ্রম করে যা আয় হয় তা দিয়ে সংসার চলেনা। মাস শেষে বাড়ি ভাড়া দিতে গিয়ে বা অন্যান্য বিল পরিশোধ করতে গিয়ে ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করতে হয়। পরে মাসে গিয়ে এক ক্রেডিট কার্ডের বিল পরিশোধ করতে গিয়ে আরেক ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করতে হয়। মাঝখান দিয়ে আকাশচুম্বী উচ্চ হারের সুদের ফায়দা লুটে নিচ্ছে ক্রেডিট কার্ড প্রদানকারী ব্যাংক ও অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো। ইমিগ্রেন্টদেরকে ক্রেডিট কার্ড দিয়ে ব্যাংক ও অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো এতই লাভবান হচ্ছে যে, তা দেখে কিছু কিছু নন-ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠানও ইমিগ্রেন্টদেরকে টার্গেট করে বাজারে ক্রেডিট কার্ড ছেড়েছে। নতুন ইমিগ্রেন্ট আসলেই তার পিছনে হামলে পড়ে বিভিন্ন ক্রেডিট কার্ড প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলো। নানারকম প্রলোভন দেখাতে থাকে। উদ্দেশ্য একটাই, প্রতি বছর বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার শুষে নেয়া এই ইমিগ্রেন্টদের কাছ থেকে। কারণ তারা জানে, কানাডায় আসার পর পেশাভিত্তিক চাকরী না পেয়ে কয়েক মাসের মধ্যেই এই ইমিগ্রেন্টরা ক্রেডিট কার্ড থেকে লোন নেয়া শুরু করবে। আর একবার লোন নেয়া শুরু করলে এ থেকে তাদের মুক্তি নেই। বছরের পর বছর তারা উচ্চ হারে সুদ দিতেই থাকবে। এর চেয়ে সহজ অথচ আকাশচুম্বী লাভ আর কোন ব্যবসায় হতে পারে?

কানাডায় আকাশচুম্বী লাভের ব্যবসা আরো আছে যেগুলোর মূল টার্গেট হলো ইমিগ্রেন্ট। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো বাড়ি, গাড়ী ও টেলিফোন ব্যবসা। যারা এইসব ব্যবসা করেন তারা সবাই মিলে বিলিয়ন নয়, ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন ডলার কামিয়ে নিচ্ছেন এই ইমিগ্রেন্টদের কাছ থেকে। নামমাত্র ডাউনপেমেন্ট এর সুযোগ দিয়ে কোনরকমে একটি বাড়ি ধরিয়ে দিতে পারলেই হলো। পরবর্তী ২৫/৩০ বছরের গোলামী নিশ্চিত হয়ে যায়। খাক বা না খাক, মাঝ বয়সী এই ইমিগ্রেন্টরা তাদের বাকী জীবন চড়া সুদের মর্টগেজ পেমেন্ট দিয়ে যেতে থাকবেন। হিসাবে দেখা যায় ৪ লাখ ডলারের একটি বাড়ি কিনলে সুদসহ ২৫ বছরে বাড়ির মালিককে প্রায় ৬ লাখ ডলার দিতে হয়। অর্থাৎ এক একটি ইমিগ্রেন্ট পরিবার থেকে বিল্ডার, ব্যাংক এবং অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো গড়ে প্রায় ২ লাখ ডলার করে কামিয়ে নিচ্ছে! কি রমরমা ব্যবসা ইমিগ্রেন্টদের নিয়ে।

কানাডার আবহাওয়া এবং প্রধান প্রধান শহরগুলোর যোগাযোগ ব্যবস্থা এমন যে এখানে গাড়ি ছাড়া চলা কষ্টকর। সুতরাং ইমিগ্রেন্টদেরকে গাড়ি কিনতেই হয়। আর গাড়ি কিনা মানে বীমার পলিসি কেনাও বাধ্যতামূলক। টরন্টোতে এই বীমার প্রিমিয়ামও আকাশচুম্বী। গোটা নর্থ আমেরিকার মধ্যে সর্বোচ্চ রেটের প্রিমিয়াম গুনতে হয় টরন্টোবাসী ইমিগ্রেন্টদেরকে। টরন্টোর সিংহভাগ অধিবাসীই ইমিগ্রেন্ট। ভেঙ্কুভারের অবস্থাও প্রায় টরন্টোর মতোই। অবশ্য মন্ট্রিয়লে গাড়ি বীমার প্রিমিয়াম টরন্টোর তুলনায় অনেক কম। টরন্টোতে গাড়ি বীমা কেম্পানীগুলোর বাৎসরিক লাভ ২  বিলিয়ন ডলারের উপর।

কানাডায় টেলিফোন বিলও অনেক বেশী। বিশেষ করে সেলফোন ব্যবহারকারীদের যে অর্থ ব্যয় করতে হয় তা বিশ্বের সর্বোচ্চ রেটের একটি। ২০০৯ সালে অরগানাইজেশন ফর ইকনমিক কোঅপারেশন এন্ড ডেভলাপমেন্ট (ওইসিডি) এর পরিচালিত এক জরীপে দেখা যায় কানাডার সেলফোন ব্যবহারকারীরা মাস শেষে যে বিল দেন তা বিশ্বের মধ্যে তৃতীয় সর্বোচ্চ বিল। প্রথমস্থানে আছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও দ্বিতীয়স্থানে আছে স্পেন।

ওইসিডি’র তথ্য অনুযায়ী আরো দেখা যায়, কানাডার ইন্টারনেট ব্যবহারকারীরাও চরম মূল্য দিয়ে থাকেন। বিশ্বে সর্বোচ্চ রেটের ইন্টারনেট হলো Slovak Republic  এ। কানাডা দ্বিতীয় স্থানে। অর্থাৎ সেলফোন এবং ইন্টারনেটের মাধ্যমেও কানাডার ইমিগ্রেন্টরা ফতুর হচ্ছেন। অন্য দিকে যে সকল জায়েন্ট কোম্পানীগুলো এই সেলফোন এবং ইন্টারনেট সার্ভিস প্রদান করে আসছে, তাদের উর্ধতন কর্মকর্তারা মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার কামিয়ে নিচ্ছেন বেতন হিসেবে। রজার্সের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মি. লরেন্স গত বছর বেতন ও অন্যান্য সুবিধা বাবদ পেয়েছেন ১৪.৭ মিলিয়ন ডলার!

যারা দুই দশক আগে কানাডায় এসেছেন তারা জানেন সে সময় লং ডিস্টেন্স ফোন কল ব্যবহারকারীদের বাড়িতে বেল কানাডা কি রকম রাক্ষুসে বিল পাঠাতো। সেই সময় বাংলাদেশে প্রতি মিনিট লং ডিস্টেন্স ফোন কলের জন্য ৩ ডলারেরও বেশী করে চার্জ করা  হতো। এর সাথে ছিল আবার টেক্স। প্রতিবছর কয়েক বিলিয়ন ডলার শুধু এই ইমিগ্রেন্টদের কাছ থেকেই কামিয়ে নিয়েছে বেল কানাডা সেই সময়ে।

সুতরাং ইমিগ্রেন্টরা কানাডিয়ান ব্যবসায়ীদের কাছে হলো দুধেল গাই। যতো পারে ইমিগ্রেন্টদের কাছ থেকে কামিয়ে নেও। এই হলো কানাডিয়ান ব্যবসায়ীদের নীতি। আর ইমিগ্রেন্টদেরকে দুধেল গাই বানিয়ে রাখতে হলে তাদেরকে অর্থনৈতিকভাবে সচ্ছল হতে দেয়া যাবে না। কারণ অর্থনৈতিকভাবে সচ্ছল ব্যক্তিদেরকে শাসন ও শোষণ করা যায় না। সুতরাং যে কোন উপায়েই হোক, ইমিগ্রেন্টদেরকে পদানত করে রাখতে হবে। আর এই পদানত করে রাখার সবচেয়ে সহজ ও মোক্ষম অস্ত্র হলো ‘‘কানাডিয়ান এক্সপিরিয়েন্স’’নামক বর্ণবাদী বুলিটি। ইমিগ্রেন্টদের ‘‘কানাডিয়ান এক্সপিরিয়েন্স’’ নেই এই অজুহাত তুলে তাদেরকে পেশাভিত্তিক কাজ থেকে দুরে রাখতে হবে। যদি দুরে রাখা না যায় তবে তারা অর্থনৈতিকভাবে সচ্ছল হয়ে উঠবে। সে ক্ষেত্রে তাদের কাছে ৪ লাখ ডলারে বাড়ি বিক্রি করে ২ লাখ ডলার সুদ আদায় করা যাবে না। আদায় করা যাবে না ক্রেডিট কার্ডের আকাশচুম্বী চড়া সুদ। শুধু তাই নয়, তথাকথিত মেইনস্ট্রিম কানাডিয়ানদের চাকরী হারাবার ভয়ও রয়েছে এই পেশাজীবী ইমিগ্রেন্টদের আগমনের ফলে। পেশাজীবী ইমিগ্রেন্টদেরকে নিজ নিজ পেশায় চাকরী করার সুযোগ দিলে কোনঠাসা হয়ে পড়বেন ঐ তথাকথিত মেইনস্ট্রিম কানাডিয়ানরা। মেইনস্ট্রিম কানাডিয়ানরা চান ইমিগ্রেন্টদের দিয়ে ঐ সকল কাজ করাতে যেগুলো তারা করতে চান না এবং যে কাজগুলোতে পরিশ্রম বেশী ও বেতন সর্বনিু।

‘‘কানাডিয়ান এক্সপিরিয়েন্স’’ নামক বুলিটি যে কতটা অসভ্য রকমের আচরণ তা প্রতিটি পেশাজীবী ইমিগ্রেন্টই আজ হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন। ‘কানাডা ইজ এ ল্যন্ড অব অপরচিউনিটি’। ধন দৌলত, সুখ শান্তি, নিরাপত্তা, দুশ্চিন্তাহীন নতুন জীবন ইত্যাদি সবই আছে কানাডায়। আছে আরো অনেক কিছু। একবার শুধু কানাডায় পৌঁছাতে পারলেই হয়। আর পিছনে ফিরে তাকানোর প্রয়োজন নেই। শুধুই সামনে এগিয়ে যাওয়া। যারা কানাডায় আসতে চান ইমিগ্রেন্ট হয়ে – এই হলো কানাডা সম্পর্কে তাদের ধারণা। এই ধারণা তারা নিজের মন থেকে যে তৈরী করেন তা কিন্তু নয়। তাদেরকে এই স্বপ্ন দেখানো হয়। আর সেই স্বপ্নে বিভোর হয়েই অধিকাংশ লোক কানাডায় আসেন ইমিগ্রেন্ট হয়ে। দেশের মায়া, বাবা-মা, ভাই -বোন, আত্মীয়-বন্ধুদের মায়া ত্যাগ করে চলে আসেন সুদূর এই বৈরী আবহাওয়ার দেশ কানাডায়।

এরকমই একজন ইমিগ্রেন্ট ড. জহিরুল ইসলাম। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইন্সটিটিউটে একজন ভাল বিজ্ঞানী বলে সুনাম ছিল তার। তার গবেষণা প্রবন্ধ দেশী ও বিদেশী জার্নালে ছাপা হয়েছে। গবেষণার বিষয় ছিল ধানের বালাই

(pest) ইকোলজি ও ব্যবস্থাপনা। শুধু দেশেই নয়, দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় তার বেশ পরিচিতি ছিল। ভেবেছিলেন উন্নত বিশ্বে গেলে তার কেরিয়ারের আরও উন্নতী হবে। কারণ তার একাডেমিক ব্যাকগ্রাউন্ড ছিল- বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কৃষিতে স্নাতক ডিগ্রী, ইম্পেরিয়াল কলেজ, লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কীটতত্ত্ব বিষয়ে এম এস, সি ও পি এইচ ডি ডিগ্রী, আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা ইন্সটিটিউট (ফিলিপাইন) থেকে পোষ্ট ডক্টরাল ফেলোশিপ।  কানাডায় আসার আগে এখানকার চাকরীর বাজারের কি অবস্থা তা নিয়ে কোন গবেষণা বা খোঁজ-খবর নেয়ার প্রয়োজন মনে করেননি তিনি। কারণ, এসেসমেন্টের সময় তার প্রফেশনে জব ডিমান্ড বিষয়ে তিনি ২০ এর মধ্যে ১৭ পয়েন্ট পেয়েছিলেন। তাই ভেবেছিলেন যে তার বিষয়ে চাকুরীর অনেক চাহিদা আছে এবং তার  চাকুরী ও শিক্ষার যা রেকর্ড তাতে তিনি একটি চাকুরী পেয়ে যাবেন। কিন্তু এখানে নিজ পেশায় জব পাওয়া যে এতটা কঠিন তা তিনি দেশে থাকা অবস্থায় আন্দাজ করতে পারেন নি। ‘‘কানাডিয়ান এক্সপিরিয়েন্স’’ নামক এক অসভ্য ও অপমানজনক বুলি যে তাকে শুনতে হবে তাও তিনি ভাবেননি।  প্রবাসী কন্ঠ ম্যাগাজিনে প্রদত্ত এক সাক্ষাৎকারে তিনি ইতিপূর্বে বলেছিলেন, ‘কানাডিয়ান ইমিগ্রেশনের জন্য যে ইভালুয়েশন পদ্ধতি ও তথ্য সেটি আমাকে ভ্রান্ত ধারনা দিয়েছিল।’

তিনি বলেন, ‘কানাডায় পরিচয় সংকট (আইডিয়েন্টি ক্রাইসিস) নিয়ে কখনও মাথা ঘামাই নি। তবে আশা ছিল কানাডায় এসে নিজ ফিল্ডে ভাল একটা ক্যারিয়ার গড়তে পারবো। কিন্তু সে আশার সঙ্গে বাস্তবতার কোন মিল নাই।’

ড. জহিরুল ইসলাম আরো বলেন, বর্ণবাদের শিকার সরাসরি না হলেও যোগ্যতা থাকা সত্যেও কোন ডিসেন্ট চাকুরী না পাওয়াটাকে আমার কাছে মনে হয়েছে আমি বর্ণবাদের শিকার হয়েছি। সকল যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতা থাকার পরও নিজ পেশায় চাকরী না পাওয়ার কারণে আমি অপমানিত বোধ করছি।’

শুধু ড. জহির নয়, ‘‘কানাডিয়ান এক্সপিরিয়েন্স’’ নামক এই অশোভন বুলি কর্তৃক বুলিং (bullying) এর শিকার  হয়ে লক্ষ লক্ষ ইমিগ্রেন্ট আজ নানারকম সংকটের মধ্যে দিনযাপন করছেন কানাডায়। তাদের প্রশ্ন, ‘আমরা যদি এখানকার চাকরীতে প্রবশে করার সুযোগই না পাই তবে ‘‘কানাডিয়ান এক্সপিরিয়েন্স’’ কোথা থেকে পাবো? কানাডায় আসা একজন নতুন পেশাজীবী ইমিগ্রেন্টের ‘‘কানাডিয়ান এক্সপিরিয়েন্স’’ নেই একথা সবাই জানেন। কিন্তু তারপরও আমাদের কাছে কোন যুক্তিতে এবং কোন রহস্যজনক কারণে ‘‘কানাডিয়ান এক্সপিরিয়েন্স’’ চাওয়া হয়?

উত্তর একটাই। সেটি হলো বর্ণবাদ। ইমিগ্রেন্টদের ভাষ্য, আমাদের গাত্র বর্ণ, আমাদের এথনিসিটি, আমাদের ধর্ম এ সবই ফ্যাক্টর হিসেবে কাজ করে আমাদের চাকরী না পাওয়ার পিছনে। আর চাকরী যাতে দিতে না হয় সে জন্য এক উদ্ভট বাহানা তৈরী করেছে যার নাম ‘‘কানাডিয়ান এক্সপিরিয়েন্স’’। এর মাধ্যমে কানাডিয়ান ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো ইমিগ্রেন্টদের মানবাধিকার লংঘন করছে। তাদেরকে দ্বিতীয় বা তৃতীয় শ্রেণীর মানুষ হিসেবে গন্য করা হচ্ছে। এমন কি যে সকল পেশাজীবী ইমিগ্রেন্ট কানাডায় এসে তাদের ডিগ্রি আপগ্রেড করেছেন বা নতুন কোন বিষয়ে ডিগ্রি বা ডিপ্লোমা নিয়েছেন তাদেরকেও পেশাভিত্তিক চাকরী থেকে দুরে সরিয়ে রাখা হচ্ছে ঐ ‘‘কানাডিয়ান এক্সপিরিয়েন্স’’ নামক উদ্ভট বুলির দোহাই দিয়ে। আরো আশ্চর্যের বিষয় হলো, যে সকল অশ্বেতাঙ্গ ইমিগ্রেন্ট মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে ডিগ্রি ও দীর্ঘদিনের কাজের অভিজ্ঞাতা নিয়ে কানাডায় এসেছেন তাদেরকেও ‘‘কানাডিয়ান এক্সপিরিয়েন্স’’ নেই এই অজুহাত দেখিয়ে পেশাভিত্তিক চাকুরীর বাজারে প্রবেশ করতে দেয়া হচ্ছে না।

বর্ণবাদী এই আচরণের কারণে পেশাজীবী ইমিগ্রেন্টদের মেধা ও অভিজ্ঞতার অপচয় হচ্ছে বিপুল পরিমানে। ইমিগ্রেন্টদের দুধেল গাই বানিয়ে কানাডার ব্যবসায়ীরা বিপুল পরিমানের বিত্তবৈভব গড়ে তুললেও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে কানাডার সরকার। কারণ, একদিকে ইমিগ্রেন্টদের টেক্স থেকে বঞ্চিত হচ্ছে সরকার অন্যদিকে তাদেরকে কিছু কিছু ক্ষেত্রে অর্থসাহায্য (ওয়েলফেয়ার, ওষধ, চাইল্ড টেক্স বেনিফিট ইত্যাদি) দিতে হচ্ছে। বছর শেষে এর পরিমানও বিপুল অংকের অর্থ। আমরা জানি, কানাডার চিকিৎসা ব্যবস্থায় আরো বহুসংখ্যক চিকিৎসক প্রয়োজন, নির্মান শিল্পে আরো বহু সংখ্যক প্রকৌশলীর প্রয়োজন, কৃষি ক্ষেত্রে আরো অনেক কৃষি বিজ্ঞানীর প্রয়োজন। অন্যান্য ক্ষেত্রেও অনেক অভিজ্ঞ ও দক্ষ কর্মীর প্রয়োজন। পেশাজীবী ইমিগ্রেন্টদের সেই অভিজ্ঞতা ও দক্ষতা রয়েছে। এরা কানাডার সার্বিক  উন্নয়নে বিপুল পরিমানে অবদান রাখতে পারতেন। অথচ সেটি করতে দেয়া হচ্ছে না।

আমাদের অভিজ্ঞতায় দেখেছি, মিথ্যাকে বার বার সত্য বলে অথবা সত্যকে বার বার মিথ্যা বলে প্রচারণা চালাতে থাকলে একসময় মানুষজন তাই বিশ্বাস করতে থাকে। তদ্রুপ ভাল মানুষকে পাগল বলে ক্রমাগত প্রচারণা চালাতে থাকলে একসময় সেই ভাল মানুষটিও নিজেকে পাগল ভাবতে থাকে। কানাডায় নতুন আসা ইমিগ্রেন্টদেরও হয়েছে সেই দশা। স্বার্থান্বেষী মহল বার বার প্রচারণা চালিয়ে আসছেন এই বলে যে, ইমিগ্রেন্টদের ‘‘কানাডিয়ান এক্সপিরিয়েন্স’’ নেই। তারা এদেশে অযোগ্য, অকর্মার ঢেঁকি তারা, ভাষা  জানেনা, আদব-কায়দা জানেনা। আরো অনেক অভিদায় চিহ্নিত করা হয় তাদেরকে। এতে করে দেখা যায়, ঐ ইমিগ্রেন্টদের বেশীরভাগই একসময় নিজেদেরকে তাই ভাবতে থাকেন। আর এর অবধারিত পরিনতি হলো হতাশা, হীনমন্যতা ও মানসিক বৈকল্যতা। যারা নিজ নিজ পেশায় চাকরী পাননি তাদের বেশীর ভাগই এই রোগগুলোতে আক্রান্ত।

তবে আশার কথা এই যে, অনেক দেরীতে হলেও শেষ পর্যন্ত ইমিগ্রেন্টদের চাকুরীর সমস্যাটি কানাডার কিছু কিছু প্রতিষ্ঠান অনুধাবন করতে শুরু করেছে। অন্টারিও হিউম্যান রাইটস কমিশন যে পদক্ষেপ নিয়েছে (আরো বহু বছর আগেই নেয়া উচিৎ ছিল) তার দেখাদেখি হয়তো অন্যেরাও এগিয়ে আসবে। তবে সবাই যে এগিয়ে আসবে না তা কিন্তু নিশ্চিৎ। কারণ ইমিগ্রেন্ট বিরোধী একটি চক্র সর্বদাই সক্রিয় এদেশে। চরম প্রতিক্রিয়াশীল ও রক্ষণশীল এই মহলটি বরাবরই নানান কৌশলে ইমিগ্রেন্ট বিরোধী প্রচারণা চালিয়ে আসছে কানাডায়। প্রকাশ্যে তারা বিষয়টি স্বীকার করে না। কিন্তু ভিতরে ভিতরে তারা এই কাজটিই অতি সুুক্ষ্মভাবে করে থাকে। কানাডার ‘ফ্রেজার ইনস্টিটিউট’ এরকম একটি চরম ডানপন্থী প্রতিষ্ঠান যারা মূলত কর্পোরেট প্রচারণার কৌশলের মাধ্যমে এখানকার ইমিগ্রেন্ট বিরোধী রক্ষণশীল গোষ্ঠির স্বার্থ রক্ষা করে। খুঁজলে এরকম প্রতিষ্ঠান ও গোষ্ঠি আরো পাওয়া যাবে। এমনকি সরকারের ভিতরও সক্রিয় এ গোষ্ঠিটি। ইমিগ্রেন্টরা যাতে এদেশে দ্বিতীয়শ্রেণীর নাগরিক হয়ে থাকেন অথবা অর্থনৈতিকভাবে যাতে তারা সচ্ছল হয়ে উঠতে না পারেন সে জন্য তারা নানাভাবে ইমিগ্রেন্টবিরোধী প্রচারণা চালাতে থাকেন। সরকারের কানে কুমন্ত্রণা দেন এই বলে যে, ইমিগ্রেন্টরা দেশের অর্থনীতির বারটা বাজাচ্ছেন। সামাজিক বিশৃংখলা সৃষ্টি করছেন। সন্ত্রাসবাদের প্রসার ঘটাচ্ছেন ইত্যাদি ইত্যাদি। আজকে এ বিষয়টি সন্দেহ করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে যে, এই রক্ষণশীলদের প্ররোচনায়ই এগুলো হচ্ছে অথবা নেপথ্যে ঘাপটি মেরে বসে থেকে হয়তো এরাই কানাডার বিভিন্ন প্রফেশনাল রেগুলেটরী কর্তৃপক্ষ বা এক্রিডিটেশন কর্তৃপক্ষের (যারা সার্টিফিকেট, এক্সপিরিয়েন্স ইত্যাদি মূল্যায়ন করে থাকে) কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করে আসছেন যাতে করে ইমিগ্রেন্টরা সহজে তাদের নিজ নিজ পেশার চাকরীতে প্রবেশ না করতে পারেন। আমরা জানি ইতিপূর্বে এই এক্রিডিটেশন কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধেও বর্ণবাদী আচরণে অভিযোগ উঠেছে। অন্যদিকে কানাডার ফেডারেল সরকারের ইমিগ্রেশন মন্ত্রণালয়ও ‘‘কানাডিয়ান এক্সপিরিয়েন্স’’ নামক বাধাটিকে ইমিগ্রেন্ট বাছাই পর্বের অন্তভূক্ত করেছে। অর্থাৎ কানাডায় আসার আগেই ‘‘কানাডিয়ান এক্সপিরিয়েন্স’’! কানাডায় যাদের কাজের অভিজ্ঞতা রয়েছে তারা বিশেষ অগ্রাধিকার পাবেন যদি ইমিগ্রেশনের জন্য আবেদন করে থাকেন। তার অর্থ হলো, একজন ইমিগ্রেন্ট বর্ণবাদী আচরণের শিকার হতে থাকেন কানাডায় আসার আগেই। বাইরে থেকে যারা ইমিগ্রেশনের জন্য আবেদন করে থাকেন তাদের মধ্যে শতকরা একভাগেরও এই অভিজ্ঞতা থাকে না। অথচ এটিকে একটি শর্ত  হিসেবে অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে।

এখন প্রশ্ন উঠতে পারে, অন্টারিও হিউম্যান রাইটস কমিশন যে বিষয়টিকে বর্ণবাদী আচরণ এবং মানবাধিকার লংঘন বলে আখ্যায়িত করলো সে বিষয়টিকে কি করে প্রফেশনাল রেগুলেটরী কর্তৃপক্ষ বা এক্রিডিটেশন কর্তৃপক্ষ এবং ফেডারেল সরকার তাদের নীতিমালায় অন্তর্ভূক্ত করলো? এর জাবাব কে দিবেন?

আমরা মনে করি ইমিগ্রেন্টদের স্বার্থে এবং একই সাথে কানাডার বৃহত্তর স্বার্থে এই ‘‘কানাডিয়ান এক্সপিরিয়েন্স’’ নামক অযাচিত, অশোভন, অলীক ও অপমানজনক বুলি যা একই সাথে বর্ণবাদ ও মানবাধিকার লংঘন হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে তাকে এখনি দুরে ঠেলে দিতে হবে। মুছে ফেলতে হবে চাকরীর শর্তের তালিকা থেকে। যথাযথভাবে মূল্যায়ন করতে হবে এবং একই সাথে গুরুত্ব দিতে হবে অন্য দেশের কাজের অভিজ্ঞতাকে। নয়তো কানাডার আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন পদে পদে বাধাগ্রস্ত হবে যা আমাদের কারোরই কাম্য হতে পারে না।

খুরশিদ আলম

সম্পাদক ও প্রকাশক, প্রবাসী কন্ঠ

এপ্রিল ২৮, ২০১৪