নিরাপত্তার নিশ্চয়তা ছাড়া কানাডীয়রা কী ধরণের দেশ চায়?
॥ লে হুইটিংটন ॥
প্রায় ৮ বছরের কনজারভেটিভ দলের শাসনের পর এখন প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে যে কানাডার জীবনযাত্রার মান নিম্নগামী হয়ে পড়ছে।
অটোয়াÑপ্রধানমন্ত্রী স্টিফেন হারপার সরকারের প্রায় ৮ বছরের শাসনের পর এখন কানাডীয়রা কেমন ধরণের দেশ চায় এই প্রশ্নটি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে।
কনজারভেটিভরা ক্ষমতায় এসেছিলো দক্ষিণপন্থী, ব্যবসায়-বান্ধব অর্থাৎ অধিকতর মুক্তবাজার নীতি অনুসরণের অঙ্গীকার করে। অবশ্য ২৪ সাসেক্স ড্রাইভে যাওয়ার আগে হারপার এই মুক্তবাজার অর্থনীতির বিষয়টিকে প্রায়ই কর-আসক্ত জনকল্যাণ রাষ্ট্র বলে উপহাস করতেন।
বাস্তবে এর অর্থ দাঁড়ায় প্রবৃদ্ধিমুখি অর্তনৈতিক নীতিমালা গ্রহণ যাতে শত কোটি ডলারের করেপোরেট আয়কর কর্তন এবং লিবারেলদের গৃহীত একগুচ্ছ প্রগতিশীল কর্মসূচি কর্তন করার বিষয়টিও থাকবে। সরকার তার বার্ষিক বাজেট থেকে ৫’শ কোটি ডলার ব্যয় কর্তন করেছে। হারপার বলেছিলেন, সামাজিক কর্মসূচিগুলো টেকসই করার জন্য এখন এবং ভবিষ্যতের জন্য ব্যয় কমানো হবে। আর কনজারভেটিভরা বারবার জোর দিয়ে বলে আসছিলো যে, অন্যান্য শিল্পোন্নত দেশগুলোর চেয়ে কানাডার অর্থনীতি ভাল করছে।
কিন্তু কানাডার জীবনযাত্রার মান বহাল থাকছে না বলে জনমনে উদ্বেগ ক্রমশ বাড়ছে। মধ্যবিত্ত শ্রেণীর কানাডীয়দের জন্য কয়েক বছর ধরে বাড়ির ওপর কর বহাল রয়েছে এবং চাকরির বাজারের অবনতির কারণে চাকরিহীন যুবকদের একটি নতুন প্রজন্মের সৃষ্টি হয়েছে। অর্ধেকেরও বেশি সংখ্যক কানাডীয় চাকরিস্থলে পেনসন পাচ্ছে না এবং ধনী ও গরীবের মধ্যে ব্যাবধান কমিয়ে আনতে সরকারের নেয়া ব্যবস্থা যেমন আয়কর নীতি-এখন আর কার্যকর নয়। আর চিকিৎসকরা হুঁশিয়ার করে দিয়েছেন যে, ফেডারেল নেতৃত্বের অধিকতর হস্তক্ষেপ ছাড়া কানাডা হয়তো বৈষম্যপূর্ণ মেডিক্যাল সার্ভিসের এক জগাখিচুড়িতে পরিণত হতে পারে।
সরকারগুলো কী কানাডীয়দের নিত্যদিনের চাহিদা ও মূল্যবোধের প্রতি যথাযথভাবে সাড়া দিচ্ছে?
ওয়াটালু বিশ্ববিদ্যালয়ের জনকর্যাণ বিষয়ক এক সূচির সহ-চেয়ারম্যানরা তাদের ২০১২ সালের এক রিপোর্টে ওই প্রশ্ন তোলেন। তাদের রিপোর্টে দেখা গেছে যে, কানাডা পরিবেশ টেকসই রাখা, চাকরির সম্ভাবনা এবং সমাজে সাম্য প্রতিষ্ঠার উদ্যোগের দিক থেকে পিছিয়ে পড়ছে। সরকারী নীতিসম্পর্কিত একজন কনসালট্যান্ট স্টেভেন লুইস বলেন, উত্তর আমেরিকায় জীবনযাত্রার মানের অবনতিশীল অবস্থা দেখিয়েছে যে, স্বল্প-কর, সরকারের স্বল্প নিয়ন্ত্রণ নীতি যা থ্যাচার-রিগানের সময়ে জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলো তা এখন আর কাজ করে না। দি স্টার পত্রিকাকে তিনি বলেন, কর হারের দিক থেকে কানাডা এরই মধ্যে অন্যান্য দেশের চেয়ে এগিয়ে রয়েছে। সেজন্যেবর্তমানে যেরকম স্বল্পহারে করারোপ করা হয় এতটা কমিয়ে না রাখলেও চলে। প্রশ্ন হলো, কানাডীয়রা কী সরকারের দিক থেকে উচ্চমানের সেবা ও সামাজিক কর্মসূচী না থাকার সঙ্গে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে এবং তারা আর তেমনটা আর চায়ও না? আমরা কী জনগণের আশা-আকাঙ্খাকে এতটাই বধির কওে তুলতে পেরেছি যে এই অবস্থা নিয়েই আমরা সামনের দিকে এগিয়ে যাব?
স্টিভেন বলেন, তবে কানাডীয়রা নগর এলাকায় অবকাঠামো গড়ে তোলার জন্য অর্থব্যয় বন্ধ করে দেয়া বিজ্ঞতাকে প্রশ্ন করার দিকেই আরও বেশি পরিমাণে ঝোঁকপ্রবণ হচ্ছে যার ফলে মাধ্যমিকউত্তর শিক্ষা খুব বেশি ব্যয়বহুল হয়ে উঠতে দেয়া হয়েছে এবং আয়ের অসমতার দরূণ সামাজিক সমস্যাগুলো গভীর হয়েছে।
তিনি বলেন, ‘‘আমার মনে হয় জনগণ এখন বুঝতে শুরু করেছে যে, বিনা পয়সায় কোন খাবার পাওয়া যাবে না।’’
জাতীয় পর্যায়ের একটি ন্যানোস গবেষণা প্রকল্পে দেখা গেছে, ৪৫ শতাংশ জবাবদানকারী বলেছেন, স্বাস্থ্যসেবা খাতে অটোয়ার অতিরিক্ত বাজেট বরাদ্দ দেয়া উচিৎ এবং জাতীয় ঋণ কমিয়ে আনতে হবে (৩৭শতাংশ), কর কমাতে হবে(১৬শতাংশ)।
কানাডীয় হেল্থ কোযারিশনের এক জরিপেও দেখা গেছে, বেশিরভাগ মানুষ বলেছে, বাড়িতে স্বাস্থ্যসেবা ও ফার্মাসিউটিক্যালের ব্যয় সরকারের মাধ্যমে দেয়ার ব্যবস্থা করা হলে তারা অতিরিক্ত কর দিতে প্রস্তুত রয়েছেন। এছাড়া নির্দিষ্ট পরিমাণে অর্থ বরাদ্দের নীতি অব্যাহত রাখার পরিবর্তে ২০১৬ সালের পর কেন্দ্রীয় সরকারের স্বাস্থ্যসেবা খাতে দেয়া অর্থ বরাদ্দকে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করতে অর্থমন্ত্রী জিম ফ্ল্যাহার্টির পরিকল্পনার সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করেছেন ৬৫ শতাংশ লোক।
কানাডিয়ান হেল্থ কোয়ালিশনের নির্বাহী পরিচালক মাইকেল ম্যাকবেন বলেন, এখন সময় এসেছে কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে পদক্ষেপ নেয়ার, বয়স্ক লোকদের জন্য জরুরী স্বাস্থ্য সেবা চাহিদা পূরণে এগিয়ে আসার।
চলতি বছরের শুরুর দিকে একোস (ইকেওএস)-এর পোলস্টার ফ্রাঙ্ক গ্রেভস-এর এক জরীপ অনুযায়ী, ৭০ শতাংশ লোক বলেছে, অধিকতর সক্রিয় সরকারই পারে সুন্দর ভবিষ্যতের দিয়ে এগিয়ে নিয়ে যেতে।
এক বিশ্লেষণে গ্রেবস বলেছেন, ‘‘সরকারের স্বল্পতম হস্তক্ষেপ এবং স্বল্প করারোপ করার ধারণার প্রতি মানুষের সংশয় ক্রমশ বাড়ছে।’’ তিনি বলেন, ‘‘এটি সবার জন্য অধিকতর ভাল অর্থনীতি গড়ে তোলার ব্যাপারটি কোন এক অদৃশ্য হাতের কাছে ছেড়ে দেয়ার নামান্তর। ওই অদৃশ্য হাত সমৃদ্ধিও অঙ্গীকার শুনে শুনে হতাশ জনগণের সামনে একটি দৃশ্যমান মধ্যমা চাড়িয়ে দেয় বলে মনে হয় যার ফলে তাদেও অবস্থা যা আছে তাই থেকে যায় অথবা অবনতি ঘটে।’’
গ্রাভেস বলেন, সুন্দর ভবিষ্যৎ গড়ে তোলার জন্য সরকারকে স্বল্প নয় বরং অধিকতর ভূমিকা রাখতে হবে বলে একটি জোরালো ধারণা তৈরি হয়েছে।
এনডিপি নেতা টমাস মালকেয়ার বলেন, কানাডীয়রা অবসরকালীন সুবিধা, স্বাস্থ্যসেবা এবং নগর এলাকায় অবকাঠামো গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তার ব্যাপারে সরকারের তরফে বৃহত্তর আইন প্রণয়নের বিষয়ে এখন একমত। তিনি বলেন, এরপরও কম আয়করা, করপোরেট ট্যাক্সে ছাড়, ব্যাপক অব্যবস্থাপনাকে ধন্যবাদ কারণ কানাডীয়রা একইসঙ্গে পারিবারিক ঋণ, ছাত্রঋণ, সরকারী ঋণ ইত্যাদি পাচ্ছে। কানাডীয়দের বলা হচ্ছে, কেন্দ্রীয় সরকারের কাছ থেকে আরও কম গ্রহণ করতে।
মালকেয়ার বলেন, কানাডীয়দের উচিৎ কর্মসংস্থান সৃষ্টি, সামাজিক কর্মসূচির বিকাশ, এবং পরিচ্ছন্ন পরিবেশ নিশ্চিত করার বিষয়গুলোকে অগ্রাধিকার দেয়া হবে এমন একটি উদ্যোগের বিপরীতে বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকারের নীতিমালা বর্জন করা।
তিনি বলেন, ‘‘আমাদের দরকার প্রয়োজনের সময় মানুষের কাজে লাগে এমন একটি কর্মসংস্থান বীমা কর্মসূচিকে জোরদার করা তবে আমাদেরকে সবধরণের মানুষের সহায়তার জন্য কাজ করতে হবে। ভোক্তাদের সুরক্ষা দিতে হবে, মানুষকে অবসর সময়ের জন্য সঞ্চয়ে সাহায্য করতে এবং উচ্চমানের চাকরির সুযোগ তৈরি করতে হবে।’’
তিনি বলেন, অধিকতর সুষ্ঠু, পরিবেশ-বান্ধব ও সমৃদ্ধ অর্থনীতি গড়ে তোলা আমাদের পক্ষে সম্ভব।
লিবারেল দলের নেতা জাস্টিন ট্রুডো বলেন, দেশের সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো প্রবৃদ্ধিমূলক অর্থনৈতিক নীতি ও সকল কানাডীয়র জন্য উন্নততর জীবন নিশ্চিত করার মধ্যে সম্পর্ক পুনঃস্থাপন করা।
ট্রুডো বলেন, ‘‘কানাডা এবং অন্যত্র নানা ধরণের সরকার নির্বাচিত ও পুনঃনির্বাচিত হয়ে দায়িত্ব গ্রহণ কওে এবং তাদেও সবারই একই ধরণের অর্থনৈতিক নীতিগত ভিত্তি থাকে। সেগুলি হলো, অবাধ বাণিজ্য, মুদ্রাবাজারের শৃঙ্খলা, কম করারোপ করা, দক্ষতা, গবেষণা ও অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগ। কিন্তু ওই সূত্র এখন আর দেশের বেশিরভাগ মানুষের জন্য উন্নততর জীবন মানের নিশ্চয়তা বিধানে বাস্তবে রূপায়ন হচ্ছে না। কয়েক মাস আগে এক বক্তৃতায় ট্রুডো বলেন, ‘‘কানাডীয়রা এখন মনে করছে যে, তারা দারিদ্র্য পরিস্তিতি থেকে উন্নীত হয়ে মধ্যবিত্ত শ্রেণীতে উঠে আসার চেয়ে বরং মধ্যবিত্ত থেকে ক্রমশ দারিদ্র্য পরিস্থিতির দিকে নেমে যাচ্ছে এমনটাই সত্য।’’ তিনি বলেন, কানাডীয়দের বিশ্বাস নবায়ন করার প্রয়োজন রয়েছে এমনভাবে যাতে তারা ভাবতে পারে যে, দেশটি উচ্চাভিলাষী সামাজিক ও অর্থনৈতিক লক্ষ্য অর্জনে এখনও সহায়তা করতে পারে।
তিনি জাতীয় ইস্যুতে প্রদেশগুলোর সঙ্গে মিলেমিশে কাজ করার জন্য অটোয়ার কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতি আহবান জানান এবং কানাডার জন্য একটি জ্বালানি নীতি তৈরির কথা বলেন যাতে প্রদেশগুলো জ্বালানি নিয়ন্ত্রণ, কানাডীয় সম্পদ বিক্রির জন্য নতুন বাজার সৃষ্টি এবং গবেষণা ও উন্নয়নের বিষয়গুলোতে পরস্পরের সঙ্গে মিলেমিশে কাজ করতে পারে। তিনি শিক্ষার উন্নয়নে জাতীয় পর্যায়ে পদক্ষেপ নেয়ার প্রয়োজনের কথাও বলেন। তার ভাষায়, ‘‘আমাদের এমন একটি উচ্চাভিলাষী টার্গেট থাকতে হবে যা আমাদের মাধ্যমিক-উত্তর শিক্ষাক্ষেত্রে অর্জনের হার ৫০ ভাগ থেকে ৭০ভাগে উন্নীত করবে। সেইসঙ্গে অধিক সংখ্যক শিক্ষানবিশ, অধিক সংখ্যক বদলী কর্মচারী এবং প্রশিক্ষণের জন্য অধিকতর সম্পদ থাকতে হবে।’’
কনজারভেটিভ সরকার তার ব্যয় সংকোচনের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় সরকারের ১৭৯০ কোটি ডলারের ঘাটতি কমিয়ে আনার বিষয়ে এবং করহার বর্তমান পর্যায়ে স্থির রাখার ওপর সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। কানাডীয়রা অর্থ উপার্জনের জন্য কঠোর পরিশ্রম করছে। আর আমরা জানি, সরকারের চেয়ে অর্থ ব্যয়ের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে পরিবারের অবস্থান অনেক ভাল।
কানাডার সরকার আন্তর্জাতিক বাণিজ্য চুক্তি মেনে চলা, প্রাকৃতিক সম্পদ রফতানির জন্য ভাল বাজার তৈরি এবং চাকরির জন্য প্রশিক্ষণ কর্মসূচি তৈরির প্রতি আগ্রহী। কারণ অনেক কানাডীয় চাকরি হারিয়েছে অথচ চাকরিদাতারা বলছেন তারা চাকরির শূণ্যতা পূরণের মত লোক পাচ্ছেন না। সরকার এই পরস্পরবিরোধী অবস্থানের অবসান চায়। – সৈজন্যে : টরন্টো স্টার
এপ্রিল ৫, ২০১৪