কানাডা প্রতি বছর ১০ হাজারের বেশি লোককে দেশ থেকে বহিষ্কার করে
এদের মধ্যে কিছু লোককে পাঠানো হয় যুদ্ধ এবং নির্যাতনকারী শাসকগোষ্ঠী রয়েছে এমন দেশে
অক্টোবর ৫, ২০১৪: থেরেসি বেটোকোমেসো গত সোমবার তার স্বামী প্রিন্স ডিবেসিকে দেখার পর পিয়ারসন বিমানবন্দরে কানাডার বর্ডার সার্ভিস এজেন্সির অফিস থেকে বেরিয়ে আসেন। ডিবেসিকে তার দেশ ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক অব কঙ্গোতে ফেরত পাঠানো হয়েছিলো।
টরস্টার নিউজ সার্ভিসের হাতে আসা এক নতুন পরিসংখ্যানে দেখা গেছে যে, কানাডা প্রতি বছর ১০ হাজারের বেশি লোককে বহিষ্কার করে। এদের মধ্যে কিছু কিছু লোককে এমন সব দেশে ফেরত পাঠানো হয় যেখানে ‘‘মানবাধিকার পরিস্থিতির রেকর্ড নিবর্তনমূলক’’। বহিষ্কৃতদের বেশিরভাগকেই ইউরোপ বা আমেরিকার বিভিন্ন দেশে পাঠানো হলেও উদ্বাস্তুদের মধ্যে যারা আশ্রয় গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানায় তাদেরকে যুদ্ধ-সংঘাতময় দেশ যেমন ইরাক বা আফগানিস্তানে এবং নিবর্তনমূলক শাসকগোষ্ঠী রয়েছে এমন কোন দেশ যেমন উত্তর কোরিয়া বা ইরিত্রিয়ায় পাঠিয়ে দেয়া হয়। কানাডা বর্ডার সার্ভিসেস এজেন্সির (সিবিএসএ) দেয়া নথিপত্রে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
প্রাইভেসি সম্পর্কিত আইনের কারণে সিবিএসএ কোন ব্যক্তিকে বহিষ্কার সম্পর্কিত তথ্য প্রকাশ করে না। ফলে বেশিরভাগ কানাডীয়কে কেবল সংবাদমাধ্যমে মাঝেমধ্যে প্রকাশিত তথ্য পেয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয়। টরস্টারের পাওয়া তথ্যের ফলে এই দেশ থেকে জোর করে বের করে দেয়া লোকেদের সম্পর্কে বিষয়টি জানা সম্ভব হচ্ছে।
এসব পরিসংখ্যান দেখার পর কমিটি টু এইড রিফিউজিস-এর সমন্বয়কারী রিচার্ড গোল্ডম্যান বলেন, ‘‘আমার মনে হয়, নিবর্তনমূলক মানবাধিকারের রেকর্ড রয়েছে এমন সব দেশে লোকেদের পাঠিয়ে দেয়ার বিষয়টি মাত্র কয়েক বছর আগের তুলনায় এখন গুরুতর আকার ধারণ করেছে।’’ তিনি বলেন, ‘‘এসব ঘটছে কারণ ২০১২ সালের পরিবর্তিত নিয়ম অনুযায়ী উদ্বাস্তু ব্যবস্থাপনা দ্রুততর করা হয়েছে এবং অনেক লোক রয়ে গেছে যাদের উদ্বাস্তু হিসাবে আবেদন করার যোগ্যতা নেই। এর ফলে ওই ধরণের দেশে নির্যাতনের শিকার হওয়ার মত পরিস্থিতিতে ফেরত পাঠানোর ক্ষেত্রে ভারসাম্য রক্ষার ব্যবস্থা খুব সামান্যই রয়েছে।’’
সিবিএসএর রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে যে, ২০০৪ সালের শুরু থেকে চলতি বছরের জুনের শেষ পর্যন্ত সময়ের মধ্যে এক লাখ ৪৮ হাজার ৫৭ জন্য লোককে কানাডা থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। এদের মধ্যে ৭০ শতাংশ লোকই উদ্বাস্তু হিসাবে আশ্রয় পাবার জন্য প্রয়োজনীয় শর্ত পূরণ করতে পারেনি।
উদ্বাস্তু হিসাবে আশ্রয় লাভের আবেদন নাকচ হয়ে যাওয়া লোকেদের সংখ্যা প্রতি বছরই বেড়েছে। এক দশক আগে যে সংখ্যা ছিলো বছরে ৮০০০ সেটি ২০১২ সালে ছিলো ১৩০০০এর বেশি। ২০১৩ সালে অবশ্য সংখ্যাটি ১০,৫০৫ জনে নেমে আসে।
এসব লোকেদের মধ্যে ৫০০ জনকে এমন পাঁচটি দেশে পাঠানো হয় যেখানে কানাডার বহিষ্কারের আইনগত অধিকার রয়েছে। দেশগুলো হলো, হাইতি, কঙ্গো গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র, জিম্বাবুয়ে, ইরাক ও আফগানিস্তান। সিবিএসএর মুখপাত্র পিয়েরে ডেভিউ এক ই-মেল বার্তায় জানান, গত কয়েক বছর ধরে ফিলিস্তিনের গাজা, মালি, সোমালিয়ার নির্দিষ্ট অঞ্চল, সিরিয়া এবং মধ্য আফ্রিকান প্রজাতন্ত্রে এধরণের বহিষ্কৃত লোকেদের পাঠানো সাময়িকভাবে বন্ধ রয়েছে। তারপরও নথিপত্রে দেখা যাচ্ছে যে, ৮ থেকে ৩৭ জন লোককে ওইসব দেশে পাঠানো হয়েছে।
সরকার ওইসব দেশে লোকেদের বহিষ্কারের আইনগত অধিকার সংরক্ষণ করে। যুদ্ধাপরাধ বা মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ করেছে এমন লোকসহ অপরাধমূলক কর্মকান্ডে জড়িত থাকার রেকর্ড রয়েছে এমন লোকদেরও সেসব দেশে বহিষ্কারের অধিকার সরকারের রয়েছে। দোকান লুটের মত ঘটনায় দন্ডপ্রাপ্ত লোককেও বহিষ্কার করা হয়েছে এমন দৃষ্টান্ত দেখার পর গোল্ডম্যান বলেন, ‘‘সাধারণ নীতি নিয়ে আমাদের বলার কিছু নেই। ওইসব দেশ তালিকায় রয়েছে এবং আমরা সেখানে লোকেদের দ্বীপান্তরে পাঠাচ্ছি।’’
তবে গোল্ডম্যান বলেন, বহিষ্কারের আইনগত অধিকার রয়েছে এমন দেশের সংখ্যা খুবই সীমিত। এমন অনেক দেশ রয়েছে যেটি এই তালিকায় আসার যোগ্য। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায় ইরিত্রিয়ার কথা। সেখানে জোর করে সৈন্যদলে ভর্তি করানো, দাস-শ্রমিকদের অবস্থা, নিবর্তনমূলক বন্দিত্ব ইত্যাদির কথা জেনে মর্মাহত হতে হয়।
ওইসব দেশ ছাড়াও সিবিএসএ-র রিপোর্টে দেখা যায় ২৫০ জন লোককে পাঠানো হয়েছে ইরিত্রিয়া, উত্তর কোরিয়া, লিবিয়া, ইয়েমেন, সুদান ও দক্ষিণ সুদানে।
যেসব দেশে লোকদের বহিষ্কারের অধিকার রয়েছে, যেসব দেশে আপাতত বন্ধ আছে এমন দেশের বাইরে বিশ্বের সবচেয়ে বিপজ্জনক দেশ হিসাবে পরিচিত অন্তত ১৬টি দেশে ১০০০ লোককে বহিষ্কার করেছে কানাডা। এসব দেশের মধ্যে এমন ৮টি দেশ রয়েছে যেগুলোর অবস্থান বিশ্ব শান্তি সূচকের সবচেয়ে নি¤œতম স্থানে। এই সূচকে
সারা বিশ্বের যুদ্ধ, অপরাধ, সহিংসতা, সন্ত্রাসবাদ এবং আগ্নেয়াস্ত্রের প্রাপ্যতার পরিমাপ করা হয়। উল্লেখিত পরিসংখ্যান দেখার পর অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল কানাডার মহাসচিব অ্যালেক্স নেভে বলেছেন, ‘‘ওইসব দেশের কয়েকটিতে বিরাজমান মানবাধিকার পরিস্থিতি এতটাই ভয়াবহ যে, সেখানে বহিষ্কৃতদের নিশ্চিতভাবেই চরম ঝুঁকির মধ্যে পড়তে হবে।’’ নেভে বলেন, ‘‘ওইসব দেশের মধ্যে এমন কয়েকটি দেশ আছে যেখানে ব্যাপকভিত্তিক নিরাপত্তাহীনতা এবং সশস্ত্র সংঘাত চলছে। তালিকায় আমরা সোমালিয়ার নাম দেখেছি। এমন অনেক দেশের নাম রয়েছে যেখানে অহরহ নানা ধরণের নিবর্তনমূলক ব্যবস্থা বিদ্যমান রয়েছে। এর সবচেয়ে ভালো উদাহরণ হলো ইরিত্রিয়া। এমন দেশও রয়েছে যেখানে বাইরে থেকে যাওয়া বা ফেরত পাঠানো লোকেদের সন্দেহের চোখে দেখা হয়, যেমন উত্তর কোরিয়া।’’
নেভে বলেন, সাধারণভাবে দ্বীপান্তরের বিষয়ে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের বলার কিছু নেই। তিনি উল্লেখ করেন যে, উদ্বাস্তু হিসাবে কানাডায় অবস্থানের জন্য আবেদনকারীদের বিষয়ে যথাযথ শুনানী অনুষ্ঠান এবং তারপর তাদেরকে নিরাপদে তাদের নিজ দেশে ফেরত পাঠানো আন্তর্জাতিক আইনে অনুমোদিত। তবে কিছু কিছু দেশ আছে যেখানে লোকেদের ফেরত পাঠানো উদ্বেগের কারণ অবশ্যই।
নেভে বলেন, ‘‘কোনও ব্যক্তির বিরুদ্ধে যদি অপরাধমূলক কর্মকান্ডের রেকর্ড থাকে তাহলে তাকে ফেরত পাঠানোর অধিকার সরকারের রয়েছে। এর অর্থ এই নয় যে এসব দ্বীপান্তর প্রদান আন্তর্জাতিক আইনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ, কারণ এক্ষেত্রে মানবাধিকার সুরক্ষার কিছু বিষয় আছে যা অবধারিত।’’
তিনি বলেন, নির্যাতন, গুম এবং বিচার বহির্ভূত হত্যা এগুলো হলো অলংঘনীয় মানবাধিকার। ‘‘কোন ঘাতক বাহিনীর হাতে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যাওয়া বা গোপন পুলিশ বাহিনীর হাতে অপহৃত হওয়া এবং কোনরকম আইনী প্রক্রিয়া ছাড়াই নিখোঁজ হয়ে যাওয়ার মত ঝুঁকি বিদ্যমান থাকলে আন্তর্জাতিক আইনে কোন ব্যক্তিকে দ্বীপান্তরে পাঠানোর বিরুদ্ধে সুরক্ষার বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।’’ – টরস্টার নিউজ সার্ভিস