শত বর্ষে গীতাঞ্জলী

দীপক বণিক

এ বছর সাহিত্যে নোবেল পুরষ্কার পেলেন কানাডীয় লেখিকা অষরপব গঁহৎড়। আর এখন থেকে ঠিক এক শ বছর আগে ১৯১৩ সালে গীতাঞ্জলীর হাত ধরে সাহিত্যে নোবেল পুরষ্কার পেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। শত বছর পেরিয়ে গেলেও গীতাঞ্জলীর মাধুর্য যেন আরো বিকশিত হয়েছে। আবেগে আপ্লুত হয়েছে আকাশ-বাতাস সাগর-নদী আর মানুষ। এক কথায় সারা বিশ্ব।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জাগতিক শান্তির প্রতীক এই গীতাঞ্জলী। বিপদে মোরে রক্ষা কর এ নহে মোর প্রার্থনা/ অন্তর মম বিকশিত কর / আমার মাথা নত করে দাও হে তোমার চরণ ধুলার তলে- এমন দেড় শতাধিক গানের সমন্বয়ে গীতাঞ্জলীর সৃষ্টি। আর এই গীতাঞ্জলীর স্রষ্ঠা কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তার সব শ্রম -কষ্ট, ঘাম-সাধনা-  কামনা-বাসনা সবই গীতাঞ্জলীর মধ্যে পূর্ণতা এনে দেয়। কতটা দার্শনিক, কতটা আধ্যাত্মিক, কতটা যোগী, কতটা সাধনার ফলে এমন কিছু কথা, এমন কিছু গানের জন্ম দেওয়া যায়। নিশ্চয় এটা বিধাতার ঐশ্বরিক শক্তির বহি:প্রকাশ। আজ হতে শতবর্ষ পূর্বে গীতাঞ্জলীর জন্ম হলেও কারো বলার অবকাশ নেই যে, গীতাঞ্জলী ফুরিয়ে গেছে।

গীতাঞ্জলী চির যৌবনা। তার যৌবন চির অনন্ত অক্ষত। আর তাই বাঙ্গালীর হৃদয়ে গীতাঞ্জলীর স্থান সবার উর্ধে।  উনিশ শতকের সেই সময় একমাত্র রবীন্দ্রনাথই সারা পৃথিবীতে বাঙ্গালীর সাহিত্য ও সংস্কৃতিকে পরিচয় করে দিয়েছিলেন। এই মহামানবের বদলৌতে বিশ্ব দরবারে বাঙ্গালীর ইতিহাস ঐতিহ্য, শিল্প, সাহিত্য ও সঙ্গীত আলোকিত হয়েছে।

আমরা কমবেশী সবাই জানি যে, এই গীতাঞ্জলী সৃষ্টির অন্তরালে আজকের বাংলাদেশ বা তৎকালীন পূর্ব-বাংলার জলহাওয়া বা উত্তর বঙ্গের মানুষের অবদান ছিল সবচেয়ে বেশী। আমরা রবীন্দ্রনাথকে যে রূপে চিনি, সেই আদলটা তিনি পেয়েছিলেন জমীদারী দেখুশোনা করতে কুষ্টিয়ার শিলাইদহ, নওগাঁর পতিসর আর সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর যাতায়ত, থাকা এবং মানুষের সঙ্গে মেশার মাধ্যমে। এখানে এসেই তিনি পরিচিত হওয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন লালনের গান তথা বাউলের গানের সঙ্গে। শুধুমাত্র লালনের গানের সুরই নয়, রবীন্দ্রনাথকে বাউলের দর্শন ভীষণভাবে প্রভাবিত করেছিল; যা তার পরবর্তীকালের গানের কথায় ও সুরে ফুটে উঠেছে। পূর্ব বাংলা থেকেই জমিদার রবীন্দ্রনাথ ক্রমান্বয়ে হয়ে উঠেছিলেন দার্শনিক রবীন্দ্রনাথ, ঋষি রবিন্দ্রনাথ ও গণমানুষের রবীন্দ্রনাথ। আর গীতাঞ্জলীর কবিতাগুলোও সেই  ভাবরসেরই পরিচয় বহন করে। রূপ, রস আর সুগন্ধে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বানীগুলো বিশ্বের দরবারে গীতাঞ্জলীর ফুল ও ফলে সুশোভিত হয়ে একটা জাগতিক বৃক্ষে পরিনত হয়েছে।

গীতাঞ্জলীর ইংরেজী  সংস্করনের পটভূমিকায় ডব্লিউ বি ইয়েটস রবীন্দ্রনাথের কবিতার প্রশংসা করে লিখেছেন, রবীন্দ্রনাথের কবিতা তার মননে যে আলোড়ন তুলেছে,বহু বছরের মধ্যে অন্য আর কিছুই তেমন আলোড়ন তুলেনি। রবীন্দ্রনাথের কবিতাকে তাঁর কাছে মনে হয়েছে প্রাচুর্যপুর্ণ স্বতস্ফূর্ত ও দুর্নিবার আবেগসম্পন্ন। এসব কবিতার ছন্দের নিগূঢ়তা, বর্ণের অবর্ণনীয় সুক্ষতা ও মাত্রায় নতুনতর দোলা তাকে মুগ্ধ করেছে। তিনি একথা জানাতেও কার্পণ্য করেননি যে, পাশ্চাত্যে ভক্তির ব্যাপারটি নেই বললেই চলে। আর সেখানে সবকিছু, এমনকি গম্ভীর বিষয় নিয়ে ঠাট্রা-মশকরা করা হয়। গীতাঞ্জলীর কবিতার প্রবল আবেগ, স্বার্গীয় প্রেমের অনুভূতি আর সারল্য তাকে চমকে দিয়েছিল। কেবল তাকে নয়, তা চমকে দিয়েছিল পুরো ইউরোপীয় ব্ু্দ্িধবৃত্তিক সমাজকে। যাদের নিকট এর বাণী ছিল স্বর্গীয় করুনার মতো। আর এর কাব্যিক আবেদন ছিল কেবল অশ্র“তপূর্বই নয়, অভূতপূর্বও। সেই সময় টালমাটাল ইউরোপ এমন কিছুই খুঁজছিল।

গীতাঞ্জলী বাঙ্গালীদের প্রিয় ধন। প্রিয় গর্বের বস্তু। গীতাঞ্জলীতে তিনি যে ভাবে প্রেম ও প্রকৃতি এবং জীবন দর্শনকে ফুটিয়ে তুলেছেন তার তুলনা চলেনা। গীতাঞ্জলী বাঙ্গালী জাতির ছন্দ ফিরিয়ে দিয়েছে। জাগিয়েছে এক অপূর্ব বাসনা। কবি নিজেই বলেছেন, কত অজানারে জানাইলে তুমি কত ঘরে দিলে ঠাঁই / কত দূরকে করিলে নিকট, বন্ধু পরকে করিলে ভাই। তিনি যে বাংলাকে কত নিবির ভাবে ভালবেসেছেন তার প্রমান পাওয়া যায় তার কবিতায় সঙ্গীতে আর চিত্রকর্মে। তাই  এই বাংলাকে বলেছেন সোনার বাংলা।

রবীন্দ্রনাথের মতো মহামানবেরা বার বার পৃথিবীতে  জন্ম নেয় না। তাঁর দেহটা শেষ হয়ে গেছে কিন্তু সৃষ্টি ধ্বংস হয়নি। সৃষ্টি চির অম্লান। এই সৃষ্টিশীল আলোকিত মানুষটিকে শুধুমাত্র খালি চোখে দেখা যায় না, তাকে পেতে হয় অনুভবে। আমরা গীতাঞ্জলীর দিকে তাকালে এর বাস্তব প্রমাণ পাই। ইংরেজী, চীনা এবং রূশ ভাষা থেকে শুরু করে পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষায় রবীন্দ্রনাথের কবিতা ও ছোট গল্পের অনুবাদ হয়েছে। পশ্চিমা দেশে তাঁর একমাত্র পরিচয় ঞধমড়ৎ। বিশ্বের দরবারে আমাদের শিল্প,সাহিত্য, সংস্কৃতি, ইতিহাস ও ঐতিহ্য একমাত্র রবীন্দ্রনাথই তুলে ধরেছিলেন। রবীন্দ্রনাথের তুলনা কেবল তিনি নিজেই। তাই তাঁর নোবেল প্রাপ্তির শতবর্ষ পরে তাঁর প্রতি আবারও একবার শ্রদ্ধাঞ্জলী। যতদিন পদ্মা,মেঘনা, যমুনা বইবে ততদিন রবীন্দ্রনাথও বাঙ্গালীর হৃদয়ে চির জাগরুক হয়ে রইবে। গীতাঞ্জলীর শত বর্ষে এটাই হোক সবার কামানা।