কানাডায় পারিবারিক সহিংসতা : অভিবাসী নারী, পুরুষ এবং বয়স্করাও যার নিষ্ঠুর শিকার

প্রবাসী কন্ঠ প্রতিবেদন : পারিবারিক সহিংসতা উন্নত, অনুন্নত, সম্পদশালী বধ দরিদ্র সবদেশেরই এক রুঢ় বাস্তবাস্তবতা। কানাডাও তার ব্যতিক্রম নয়। হয়তো সহিংসতার মাত্রায় রকমফের হতে পারে। কিন্তু কানাডার মতো উন্নত ও সুসভ্য দেশেও পারিবারিক সহিংতার মতো ঘটনা ঘটছে। এমনকি সহিংসতার শিকার হয়ে মৃত্যুর ঘটনাও এখানে নতুন নয়। কানাডায় প্রতি ছয়দিনে গড়ে একজন নারী খুন হয় তার জীবনসঙ্গীর দ্বারা। ২০০৯ সালে ৬৭ জন নারী তাদের সাবেক অথবা বর্তমান জীবনসঙ্গীর হাতে খুন হয়েছে।

পারিবারিক সহিংসতা থেকে বাঁচতে হাজার হাজার নারী তাদের সন্তানসহ জরুরি আশ্রয় কেন্দ্রে বাস করছে। প্রতি বছর পারিবারিক নির্যাতনের অভিযোগে ৪০ হাজার গ্রেফতারের ঘটনা ঘটে-যা কানাডার সব সহিংস অপরাধের ১২%। পারিবারিক নির্যাতনের যত ঘটনা ঘটে তারমধ্যে মাত্র ২২% পুলিশকে জানানো হয়। যদিও প্রকৃত সংখ্যা আরো অনেক বেশি।

মাত্র এক বছরে কানাডায় ১৫ বছর বা তার কম বয়সী ৪,২৭০০০ জন নারী যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছে। যদিও যৌন নির্যাতনের ঘটনা পুলিশের নজরে আসে মাত্র ১০%। সঠিক সংখ্যা এরচেয়ে বেশি। কানাডার প্রায় অর্ধেক নারীই ১৬ বছর বয়সের মধ্যে অন্তত একবার শারীরিক বা যৌন নির্যাতনের শিকার হয়।

তবে শুধু যে মূলধারার কানাডিয়ান পরিবারে সহিংসতার ঘটনা ঘটছে তা নয়, অভিবাসী পরিবারগুলোও এর ব্যতিক্রম নয়। অভিবাসী পরিবারগুলোতে নির্যাতনের ঘটনা অনেক সময় প্রকাশ প্রায়, আবার বহু গল্প লোকচক্ষুর অন্তরালেই থেকে যায়।

কানাডায় বাঙ্গালী পরিবারগুলোতেও সহিংসতা ঘটছে। তবে বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই তা থেকে যাচ্ছে লোকচক্ষুর অন্তরালে। পারিবারিক সুনাম ক্ষুন্ন হবে বা লোকে শুনলে কি বলবে ইত্যাদি কারণে নির্যাতনের কথা অনেকে চেপে যান। ভয়েরও ব্যপার আছে। আরো আছে কানাডিয়ান আইন-কানুন সঠিকভাবে না জানা। সংসার ভাঙ্গলে সন্তানদের ভবিষ্যত কি হবে এ জাতীয় ভাবনা থেকেও অনেকে নির্যাতন সহ্য করে চুপচাপ থাকেন। সম্প্রতি জামিনে বেরিয়ে এসেছেন এমন একজন বাংলাদেশী (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) জানালেন, নির্যাতনের অভিযোগে বেশ কিছু বাংলাদেশী ব্যক্তি হাজতখানায় আটক রয়েছেন। কারাগারে কত জন বাংলাদেশী সাজা ভোগ করছেন তার কোন হিসাব সংগ্রহ করা সম্ভব হয়নি।

গত প্রায় এক দশকে এই টরন্টোতেই আমরা দেখেছি তিনজন বাঙ্গালী মহিলা তাদের স্বামীর হাতে নির্মমভাবে খুন হয়েছেন। প্রথম ঘটনাটি ঘটেছিল ২০০৫ সালে। টরন্টোর ড্যানফোর্থ এলাকায় বেবী নামে এক মহিলা খুন হন তার স্বামীর হাতে যার সাথে তিনি ঘর করেছেন দীর্ঘ প্রায় ১৭ বছর। বেবীর স্বামী খুনের দায়ে ৮ বছর জেল খেটেছেন।

ঐ ঘটনার জের কাটতে না কাটতেই ২০০৬ সালের ২৯ এপ্রিল মেহেরুননেসা মিতা নামের আরেক মহিলা নির্মমভাবে খুন হন তার স্বামীর হাতে। স্বামীর নাম সাব্বির মাহমুদ। ঐ দিন ভোরে স্বামী সাব্বির ঘুমন্ত অবস্থায় মিতার বুকে দু-দুবার ছুরিকাঘাত করেন। প্রথমবার ছুরিটি আমূল বিদ্ধ হয়ে পিঠ পর্যন্ত পৌছে যায়। দ্বিতীয়বার ছুরিকাঘাত  করলে সেটি বুকের ভিতর হাড়ের সাথে আটকে যায়। নির্মম এ হত্যাকান্ডটি ঘটেছে তাদের মেয়ের সামনেই। পুলিশ সাব্বিরের বিরুদ্ধে সেকেন্ড ডিগ্রি মার্ডারের চার্জ আনে।

সর্বশেষ ঘটনাটি  ঘটেছে ২০০৮ সালের ২৮ আগস্ট। ঐদিন তাহমিনা ইয়াসমীন নামের এক মহিলার লাশ পাওয়া যায় টরন্টোর ডাউনটাউনেরর স্পাডাইনা ও ডানডাস স্ট্রিট ওয়েস্ট ইন্টারসেকশনের নিকটবর্তী এক এপার্টমেন্টের ওয়াশরুমে। ইয়াসমীনের গলায় ওড়নার ফাঁস লাগানো ছিল। তার স্বামী মিজান প্রথমে এটিকে আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু ডাক্তারী পরীক্ষায় পরে প্রমান হয়ে যে এটি ছিল হত্যাকান্ড। মিজান যখন ইয়াসমীনকে হত্যা  করে বাসা থেকে পালিয়ে যায় তখন পাশের রূমেই একা শায়িত ছিল তাদের দশ দিন বয়সের শিশুপুত্র। মিজানের সাজা হয়েছে ১০ বছরের জেল।

টরন্টোর বাঙ্গালী কমিউনিটিতে খুনের ঘটনা এর বাইরেও দু-একটি ঘটেছে বলে শুনা যায়। তবে সেগুলোর সঠিক তথ্য আমাদের কাছে নেই।

যদিও কানাডার মূলধারার নারীদের তুলনায় অভিবাসী নারীরা বেশী সহিংসতার শিকার হয়, এমন কথা বলা যায় না; তারপরও সাম্প্রতিক কয়েকটি ঘটনার কারণে অভিবাসীদের নিয়ে সবাই ভাবতে শুরু করেছে। পারিবারিক সহিংসতার পেছনে বিভিন্ন কারণ রয়েছে:

–     নিজেকে অন্যের তুলনায় বেশি গুরুত্বপূর্ণ ভাবা-এই মনোভাবের মধ্যে সহিংসতার বীজ প্রথিত।

–  প্রায়ই এ কথা বলা হয় যে, নারীর তুলনায় পুরুষ অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এরফলে নারীর প্রতি পুরুষের এক ধরণের প্রভুত্ববাদী মানসিকতা গড়ে উঠে। এই মানসিকতার কারণে পুরুষ বিশ্বাস করে যে, নারীকে নিয়ন্ত্রণ করা তার অধিকার। এই মনোভাব শুধু ভ্রান্তই নয়, এটা আইনেরও পরিপন্থী।

–    বাংলাদেশী কানাডিয়ান ব্যরিস্টার কামরুল হাফিজের মতে, অর্থনৈতিক কারণেই মূলত বিভিন্ন ধরণের পারিবারিক সহিংসতার ঘটনা ঘটে। এছাড়া বেকারত্ব এবং কানাডায় আসার পর সামাজিক অবস্থানের পরিবর্তনও এক্ষেত্রে ভূমিকা রাখে। যেমন, বাংলাদেশে একজন মানুষের সামাজিক অবস্থান হয়তো বেশ ভাল ছিল। কিন্তু কানাডায় আসার পর দেখা গেলো সে তেমন কোন ভাল চাকরি জোগার করতে পারলো না। এক্ষেত্রে অনেক সময় মানসিক অশান্তি হয়। আর এই মানসিক বিপর্যয়ের কারণে নির্যাতনের ঘটনা ঘটতে পারে।

তার মতে, পারিবারিক নির্যাতন হয় সাধারণত তিনটি পর্যায়ে: স্বামী-স্ত্রী, বাচ্চারা এবং বয়স্করা। তিনি বলেন, বয়স্ক পুরুষের তুলনায় মহিলারা বেশি নির্যাতনের শিকার হন। এর কারণ হচ্ছে, কানাডাতে মহিলাদের আয়ু পুরুষের চেয়ে ৯ বছর বেশি।ধরা যাক কোন মহিলার স্বামী ৯ বছর আগে মারা গেছে, কিন্তু সে বেঁচে আছে। বেশিরভাগ সময়েই এই সময়টা তাকে থাকতে হয় পরিবারের কারো না কারো আশ্রয়ে এবং এই সময়ে তার কোন আয়-রোজগার থাকে না। এমনও ঘটনা মাঝে মাঝে ঘটে, যখন সে বয়স্ক ভাতার চেক পায়, সেই চেকটাও তাদের কাছে ঠিকমতো পৌঁছে না।

ব্যারিস্টার কামরুল হাফিজ আরো বলেন, অনেক সময় স্বামী স্ত্রীকে নির্যাতন করে। যে স্বামী তার স্ত্রীকে নির্যাতন করে, সেই স্ত্রী তার বাচ্চাদের নির্যাতন করে। এই বাচ্চারা আবার তাদের তিন চারজন ভাইবোন থাকলে তাদের মধ্যে নির্যাতন করে। কারণ ওরা মনে করে, নির্যাতনের মাধ্যমে অন্যের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়।

বাংলাদেশী কানাডিয়ান ব্যারিস্টার পল্টু কুমার শিকদারের মতে, বাংলাদেশ ও কানাডার সিস্টেম ও জীবনযাত্রার পার্থক্যের কারণে অনেক সময় পারিবারিক সহিংসতার ঘটনা ঘটে। কানাডায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই স্বামী-স্ত্রী দু’জনেই কাজ করেন। বাংলাদেশে সাধারণত বাড়িতে কাজের লোক থাকে। কিন্তু কানাডায় তা থাকেনা। এখানে সবকিছু নিজেদেরকেই করতে হয়। কিন্তু বাংলাদেশে যারা কাজের লোকের উপর নির্ভরশীল ছিলেন তারা এখানে এসে ঝামেলায় পড়েন। কাজের মানুষের শূণ্যস্থান পুরণের মতো তৃতীয় ব্যক্তি এখানে পাওয়া যায় না। ফলে কে কোন কাজ করবেন তা নিয়ে ঝামেলা তৈরি হয়। এই ঝামেলা থেকেই অনেক সময় সহিংসতার সূত্রপাত হয়।

কিন্তু অনেক সময় তা সময়মতো পুলিশের গোচরে না আনায় নির্যাতন প্রতিরোধে ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব হয় না। নির্যাতনের বিষয়টি কর্তৃপক্ষকের অগোচরে থেকে যাওয়া বা পুলিশকে না জানানোর পেছনে অবশ্য বেশ কিছু কারণ রয়েছে:

–     কানাডার ক্রিমিনাল জাস্টিস সিস্টেম সম্পর্কে পর্যাপ্ত জ্ঞানের অভাব।

–   কানাডার পুলিশকে বিশ্বাস করা যায় না-এমন ধারণা। সাধারণত, অভিবাসীদের নিজের দেশে পুলিশ সম্পর্কে অভিজ্ঞতা তাদের মনে এই ধারণার জন্ম দেয়।

–    পারিবারিক বিষয় পুলিশ বা কাউন্সিলরকে না জানিয়ে পরিবারের মধ্যেই সীমাবন্ধ রাখার সংস্কৃতি।

–  ব্যারিস্টার কামরুল হাফিজের মতে, বয়স্করা নির্যাতিত হলেও পুলিশের কাছে যেতে ভয় পায়, কারণ তারা অর্থনৈতিকভাবে অন্যের উপর নির্ভরশীল। তারা মনে করে, পুলিশের কাছে গেলে আর বাসায় ঢুকতে পারবে না।

সম্প্রতি “জাস্ট্রিস ইন্সটিটিউট অব বি.সি” স্বামীর নির্যাতনের শিকার ৭৫ জন অভিবাসী নারীর ওপর একটি সমীক্ষা চালায়। এরা সবাই ছিল এশিয়ান, ফিলিপিনো, ল্যাটিন ও দক্ষিণ এশিয়ান। এই নারীদের সাথে কথা বলে সংস্থাটি জানতে পারে, তারা একেক জন একেকভাবে নির্যাতিত হয়েছেন।

অভিবাসী নারীরা কেন সঠিক সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন এবং তাদের সুরক্ষায় কোন কোন বিষয়ে নজর দেয়া প্রয়োজন সে বিষয়গুলো উঠে আসে সংস্থাটির গবেষণায়। তাদের মতে:

প্রথম এবং সম্ভবত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, অভিবাসী নারীদের ভাষাগত প্রতিবন্ধকতা। ভাষাগত সমস্যা সঠিক সেবা এবং সামাজিক অচলায়তন ভেঙ্গে বেড়িয়ে আসার ক্ষেত্রে নারীদের জন্য সবচেয়ে বড় বাধা।

দ্বিতীয়ত, অনেক নারীর পক্ষে তাদের অধিকার ও তাদের জন্য যেসব সেবা বিদ্যমান রয়েছে সে সম্পর্কে তথ্য পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। এই সমস্যা শুধুমাত্র অভিবাসী নারীদের মধ্যেই আছে তা নয়। এই সমস্যা আরো গভীর হয়েছে কারণ, নতুন অভিবাসীরা স্বাভাবিকভাবেই এদেশের সাথে তেমন একটা পরিচিত থাকে না এবং পারিবারিক নির্যাতন যে এখানে একটা অপরাধ সে সম্পর্কে তাদের ধারণার অভাব।

তৃতীয়ত, যেসব নারী তার স্বামী বা পরিবারের অন্য কারো স্পন্সরে এদেশে এসেছে, তারা অনেক সময় দেশে ফেরৎ পাঠিয়ে দেয়া হবে-এই ভয়ে থাকে। যারফলে তারা স্বামী বা পরিবারের অন্যকেউ তাকে নির্যাতন করলেও, তাদের সাথেই থেকে যেতে বাধ্য হয় অনেকে।

সবশেষ, অভিবাসীদের অর্থনৈতিক নিরাপত্তাহীনতা এবং দারিদ্রের ঝুঁকি।

অনেক সময়
প্রশ্ন উঠে নারী সহিংসতার শিকার হলে সম্পর্কে ভেঙ্গে চলে যায় না কেন? এর উত্তর হতে পারে অনেক রকম:

প্রথমত, নির্যাতনকারী প্রায়ই তাকে এবং তার বাচ্চাকে মেরে ফেলার হুমকি দেয়। তাই ক্রমাগত নির্যাতন চলতে থাকলেও অনেকে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসার সাহস পায় না।

দ্বিতীয়ত, নির্যাতিত নারী যখন সংসার ছেড়ে চলে যাওয়ার উদ্যোগ নেয় সে সময়টা তার জন্য খুবই বিপদজনক। দেখা গেছে, স্বামীর হাতে খুন হওয়া ২৫% মেয়েকে হত্যা করা হয়েছে সংসার ছেড়ে চলে যাওয়ার পরপরই।

তৃতীয়ত, অর্থনৈতিকভাবে স্বামীর ওপর নির্ভরশীল নারীরা নির্যাতিত হলেও, ইচ্ছা বা সাহস থাকলেও  সংসার ছেড়ে সংসার ছেড়ে চলে যেতে পারে না। দেখা গেছে বাচ্চাসহ যারা পরিবার ভেঙ্গে চলে যায় তারা স্বামীর সঙ্গে একসাথে থাকার চেয়ে পাঁচগুণ বেশি দরিদ্র জীবন যাপন করে।

চতুর্থত, যেকোন মূল্যে সংসার টিকিয়ে রাখায় যারা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাসী তারা শত নির্যাতন হলেও, থেকে যায়।

পঞ্চমত, পারিবারিক সহিংসতা প্রায় ক্ষেত্রেই ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। মারধর করার পর নির্যাতনকারী অনেক সময় ক্ষমা চায় এবং নিজেকে শুধরে নেয়ার অঙ্গীকার করে। নির্যাতন যে কোনদিনও থামবে না, অনেক সময় একথা বুঝতে কয়েক বছর সময় লেগে যায়। এই সময়টাতে নির্যাতন সহ্য করতে করতে তার আত্মবিশ্বাস কমে যায়। তার জন্য সামনে আরো ভাল কিছু অপেক্ষা করছে-তাকে এ কথা বিশ্বাস করানো কঠিন হয়ে পড়ে। একটা সময় সে চলে যাওয়ার মনোবল হারিয়ে ফেলে।

তবে পারিবারিক সহিংসতার শিকার যে শুধু নারীরাই হয় তা নয়; অনেক সময় পুরুষরাও এর শিকার হতে পারে। পুলিশের ভাষ্যমতে, কানাডায় ৪৯% পুরুষ ও ৫১% নারী সমভাবে সহিংসতার শিকার হওয়ার ঝুঁকির মধ্যে থাকে। পুরুষদের মধ্যে অপরিচিত বা পরিবারের বাইরের কারো দ্বারা আক্রমণের শিকার হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। যেখানে নারীরা সাধারণত নির্যাতিত হন পরিবারের সদস্যদের দ্বারা। তবে কিছু সমীক্ষায় দেখা গেছে, পুরুষেরা পারিবারিক নির্যাতনের কথা স্বীকার করতে লজ্জাবোধ করেন। এ কারণে নারী নির্যাতনের কথা যতটা প্রকাশ পায় পুরুষ নির্যাতনের কথা ততটা প্রকাশ পায় না।

ব্যারিস্টার পল্টু কুমার শিকদার বলেন, মাঝে মাঝে এমন হয়, স্ত্রী তার স্বামীকে স্পন্সর করেছে কিন্তু ইমিগ্রেশনের প্রক্রিয়া শেষ হয়নি। এসব ক্ষেত্রে, মাঝে মাঝে দেখা যায়, স্ত্রী তার স্বামীকে হুমকি দেয়, “আমাকে কিছু বললে পুলিশ ডাকবো”। আবার যে লোকটি স্ত্রীর স্পন্সর পেয়ে কানাডায় আসে, তার হয়তো এখানে কোন আত্মীয় স্বজন থাকে না কিন্তু স্ত্রীর অনেক আত্মীয় স্বজন থাকে। সেক্ষেত্রে স্বামী নির্যাতন বা সহিংসতার শিকার হতে পারে। তবে সব ঘটনা প্রকাশ পায় না। মাঝে মাঝে শারিরিক নির্যাতনের ঘটনাও ঘটে।

তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পারিবারিক সহিংসতার শিকার হয় নারীরাই। পুলিশের কাছে পারিবারিক সহিংসতার যে পরিমাণ অভিযোগ আসে, তার ৮৩%ই ঘটে নারীদের বিরুদ্ধে। এই ধারা কানাডার সব প্রদেশ ও অঞ্চলে প্রায় একই।

–     পারিবারিক সহিংসতার ক্ষেত্রে পুরুষের তুলনায় নারী তিনগুণ বেশি মারধর, যৌন নির্যাতন, ছুড়িকাঘাত বা গুলি করার হুমকিসহ বিভিন্ন ধরণের সহিংসতার হুমকির মধ্যে থাকে।

–     গত ৩০ বছরে দেখা গেছে, কানাডায় স্ত্রীর হাতে স্বামীর খুন হওয়ার ঘটনার তুলনায় স্বামীর হাতে স্ত্রীর খুন হওয়ার ঘটনা চারগুণ বেশি।

–     ছেলেদের তুলনায় মেয়েরা পরিবারের সদস্যদের দ্বারা চারগুণ বেশি যৌন নির্যাতনের শিকার হয়।

পারিবারিক সহিংসতার ঝুঁকি কাদের মধ্যে বেশি:

সব সংস্কৃতি ও ধর্ম, সব জাতি ও বর্ণ, যেকোন বয়স বা অর্থনৈতিক গ্রুপের নারীরাই সহিংসতার শিকার হতে পারে। তবে যারা আদিবাসী নয় তাদের তুলনায় জীবনসঙ্গীর দ্বারা আটগুণ বেশি হত্যাকাণ্ডের শিকার হয় আদিবাসী নারীরা। মেয়েদের মধ্যে বয়স্কদের চেয়ে তরুণীরা বেশি ঝুঁকিতে থাকে। নির্যাতনের শিকার ৬৬% নারীর বয়স ২৪ বছরের নিচে এবং ১১% এর বয়স ১১ বছরের নিচে। প্রতিবন্ধী ৬০% নারী কোন না কোন ধরণের নির্যাতনের শিকার হয়। সাধারণত, অর্থনৈতিক নির্ভরশীলতা, ভাষাগত প্রতিবন্ধকতা এবং কমিউনিটি সার্ভিস সম্পর্কে জ্ঞানের অভাবের কারণে অভিবাসী নারীরা বেশি ঝুঁকিতে থাকেন।

নতুন অভিবাসীরা যদি পারিবারিক সহিংসতার বিষয়টি পুলিশকে না জানায়, তাহলে ভবিষ্যতে তা মারাত্মক পরিণতি ডেকে আনতে পারে, যেমন:

–     নির্যাতন অব্যাহত থাকা এবং এরমাত্রা বৃদ্ধি পাওয়ার ঝুঁকি থেকে যায়।

–     বাড়িতে বাচ্চাদের ভালমন্দ ও নিরাপত্তা সবসময় ঝুঁকির মধ্যে থাকে।

–     আক্রমণকারীর মধ্যে একটি ভুল ধারণা তৈরি হতে পারে যে, ভিকটিম তার আচরণকে শুধুমাত্র ক্ষমা করেই দেয়নি বরং ভয় এবং সাংস্কৃতিক গ্রহণযোগ্যতার কারণে পরবর্তীতেও অত্যাচার নির্যাতন সহ্য করতে প্রস্তুত।

–    দিনের পর দিন ধরে চলা নির্যাতন একজন স্পাউসের মৃত্যুর কারণ হতে পারে।

অপরাধ পরিসংখ্যানের ক্ষেত্রে একটি কথা প্রচলিত রয়েছে, তাহলো, কি পরিমাণ সহিংসতা হচ্ছে তা তখনই সঠিকভাবে নির্ণয় করা সম্ভব হবে যখন ভিকটিম তা কর্তৃপক্ষকে অবহিত করবে। অপরাধের সঠিক তথ্য সম্পর্কে জানার পরই কেবল পুলিশ ও সামাজিক সংগঠনগুলো প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহন করতে সক্ষম হয়। তাই যেকোন ধরণের নির্যাতন তা উস্কানী বা অন্যকারণ এবং তা যে পরিস্থিতিতেই হোক না কেন, কোন স্পাউস যদি মনে করে তার নিরাপত্তা হুমকির মুখে তাহলে তার পুলিশ ডাকা উচিৎ। পরবর্তীতে আর কোন বিপদের মুখে পড়তে না চাইলে ভিকটিম যদি ৯-১-১ এ ফোন করার সুযোগ পায়, তাহলে তার সেই সুযোগ কাজে লাগাতে কোনরুপ দ্বিধা করা উচিৎ নয়। তার অভিযোগের ভিত্তিতে নির্যাতনের সঠিক তথ্য প্রমাণ যদি উপস্থাপন করা যায় তাহলে আদালত অভিযুক্তকে উপযুক্ত শাস্তি দিতে পারে।

আশার কথা হলো অন্যসব অপরাধের মতোই সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কানাডায় পারিবারিক সহিংতার হার কমেছে। সহিংসতার পরিমাণ কমার কারণ হচ্ছে, নারীদের জন্য সামাজিক সমতা ও অর্থনৈতিক স্বাধীনতা বৃদ্ধি পেয়েছে। এরফলে নিগৃহ জীবনকে পেছেনে ফেলে আসার ক্ষেত্রে মেয়েরা আগের তুলনায় অনেক বেশি সাহসী পদক্ষেপ নিতে পারে। এর আরো একটি কারণ হচ্ছে, যারা পারিবারিক সহিংসতা নিরসনে কাজ করছে সেসব সংগঠনের নিরলস প্রচেষ্টা। তাদের চেষ্টায় জনগণের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি পেয়েছে, পুলিশ অফিসার ও ক্রাউন এ্যাটোর্নিদের উন্নততর প্রশিক্ষণ এবং কানাডার কিছু এলাকায় পারিবারিক সহিংসতা বিরোধী আইন তৈরি হয়েছে।

(এই প্রতিবেদনের সঙ্গে প্রচ্ছদে ব্যবহৃত ছবিটি একটি ড্রামাটাইজেশন। টরন্টোর অন্য থিয়েটারের দুই নাট্যকর্মী ববি ও শারমিন এতে অভিনয় করেন। ছবি তুলেছেন ম্যাক আজাদ। পরিচালনায় ছিলেন আহমেদ হোসেন)