জোর পূর্বক বিয়ে: কানাডার এক অনুচ্চারিত সমস্যা
প্রবাসী কন্ঠ রিপোর্ট : হায়া (পুরো নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক)পাকিস্তানী বংশোদ্ভূত ২০ বছরের এক তরুণী।যখন তার বয়স ১৬ তখন তার পরিবারকে কানাডা ছেড়ে পাকিস্তানে চলে যেতে হয়।দেশে ফেরার পর এক আত্মীয়ের সঙ্গে তার বিয়ে ঠিক করে হায়ার বাবা-মা। কিন্তু সে ওই বিয়েতে রাজি ছিলনা। বিয়েতে অসম্মতি জানালে হায়ার ওপর চাপ দেয় তার পরিবার। এক পর্যায়ে বাড়ি পালায় হায়া। কানাডার কনস্যুলেটে গিয়ে সাহায্য চায় সে।“কানাডায় আমার কোন স্ট্যাটাস ছিল না তখন। তাই কানাডিয়ান কর্মকর্তারা আমাকে সাহায্য করতে বাধ্য ছিল না। আমি ছিলাম পাকিস্তানী নাগরিক”।তাকে সাহায্য করায় কানাডিয়ান কর্মকর্তাদের প্রতি যারপরনাই কৃতজ্ঞ হায়া। অনেক চড়াই উৎরাই পার হয়ে সে এখন কানাডার মিসিসাউগার বাসিন্দা। কানাডার স্থায়ী বাসিন্দা হওয়ার জন্য আবেদন করেছে সে।এটা শুধু হায়ার একার গল্প নয়। এরকম হাজারো হায়া ইচ্ছার বিরুদ্ধে জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হচ্ছে।মেয়েরা তো বটেই ছেলেদেরকেও অনেক সময় এ ধরণের কঠিন সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। তবে ভিকটিমদের মধ্যে মেয়েদের সংখ্যাই বেশি। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মেয়েরাই এ ধরণের ঘটনার শিকার হয়।নারী নির্যাতন, পারিবারিক সহিংসতা অথবা যৌন নির্যাতনের মতো এই সমস্যা নিয়ে কোথাও তেমন একটা উচ্চবাচ্য নেই। অনেকটা নিভৃতে লোকচক্ষুর অন্তরালেই প্রায় প্রতিটি সমাজে বা কমিউনিউটিতে প্রতিনিয়ত ঘটছে এ ধরণের ঘটনা।
সম্প্রতি জোরপূর্বক বিয়ের ওপর একটি জড়িপ চালিয়েছে সাউথ এশিয়ান লিগাল ক্লিনিক অব ওন্টারিয়। গেলো ২০ সেপ্টেম্বর টরন্টোতে এক সংবাদ সম্মেলনে তাদের গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করে সংস্থাটি।প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ২০১০ থেকে ২০১২ সাল এই দুই বছরে ওন্টারিয়তে দুই শতাধিক নারী তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে বিয়ে করতে বাধ্য হয়েছে।
এই প্রথমবারের মতো এ বিষয়ে জড়িপ চালাতে গিয়ে দুই বছরে ২১৯টি জোর পূর্বক বিয়ের ঘটনার কথা জানতে পারে তারা। ভিকটিমদের মধ্যে ৯৭ শতাংশই ছিল নারী।যারা ইচ্ছার বিরুদ্ধে বিয়ে করতে বাধ্য হয়েছে তাদের মধ্যে ৮১ শতাংশের বয়স ছিল ১৬ থেকে ৩৪ বছর। প্রতিবেদনের তথ্যমতে, বাবা-মা, ভাই-বোন, আত্মীয়-স্বজন, দাদা-দাদি, নানা-নানি এবং ধর্মীয় নেতারা ইচ্ছার বিরুদ্ধে বিয়ে করার জন্য চাপ দেয়।
জোর পূর্বক বিয়ে দেয়ার ঘটনা যেসব কারণে ঘটে তারমধ্যে অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য।তবে পারিবারিক সম্মান, অর্থ এবং অভিবাসনের কারণেও এ ধরণের বিয়ের ঘটনা ঘটে।
প্রতিবেদন অনুযায়ী ভিকটিমদের বেশিরভাগই কানাডিয়ান নাগরিক(৪৪%) অথবা স্থায়ী বাসিন্দা(৪১%)।চার শতাংশের কানাডায় কোন লিগাল স্ট্যাটাস নেই, সাত শতাংশ শরণার্থী, বিদেশী নাগরিক অথবা অস্থায়ী ভিসায় কানাডায় কাজ করে।
জোর পূর্বক বিয়ে করতে বাধ্য হওয়া অনেকেই নানা ধরণের নির্যাতনের শিকার হয়। এরমধ্যে হুমকি ৬৮ শতাংশ, শারীরিক নির্যাতন ৫৯ শতাংশ এবং যৌন নির্যাতনের শিকার হয় ২৬ শতাংশ।
সাউথ এশিয়ান লিগাল ক্লিনিকের নির্বাহী পরিচালক ও আইনজীবী শালিনি কানাউর বলেন, “ সমীক্ষা পরিচালনা করতে গিয়ে আমরা দেখেছি ওন্টারিয়র অনেক কমিউনিটিতেই এই ঘটনা ঘটছে”।
“সবাইকে এটা বুঝতে হবে যে এ ধরণের ভিকটিমরা সম্ভবত সমাজের অন্যতম কোনঠাসা গোষ্ঠী। তাদের আয় খুবই সামান্য, ক্ষমতা এবং নিজেকে চালানোর সামর্থ নেই বললেই চলে”।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, ইচ্ছার বিরুদ্ধে বিয়ে করতে বাধ্য করার ঘটনা সবচেয়ে বেশি ঘটে মুসলিম সমাজে।আফগানিস্তান, ফিলিস্তিন, সেনেগাল, সোয়াজিল্যান্ড, তুরস্ক ও বৃটেন এমনকি কানাডিয়ান বংশোদ্ভূত মুসলমান কমিউনিটিতেও এই সমস্যা বিদ্যমান। তবে হিন্দু, শিখ ও খ্রীষ্টান কমিউনিটিতেও এ ধরণের ঘটনা ঘটে।
জোরপূর্বক বিয়ের বিরুদ্ধে যারা সচেতনতা তৈরির কাজ করছেন তাদের মধ্যে অন্যতম সন্দ্বীপ চাঁদ। তিনি বলেন, “ প্রকৃতপক্ষে যে হারে এই ধরণের ঘটনা ঘটেছে, এই প্রতিবেদনে তার সামান্যই উঠে এসেছে। কারণ এ ধরণের অনেক ঘটনা লোকচক্ষুর অন্তরালেই থেকে যায়”।
তিনি বলেন, “এটা সবখানেই ঘটছে। এটা শুধুমাত্র দক্ষিণ এশিয়ার নয়, এটা একটা বৈশ্বিক ইস্যু, এটা মানবাধিকার বিষয়ক ইস্যু”।
কানাউর জানান, বাল্য বিবাহ ও জোর পূর্বক বিয়ের বিরুদ্ধে জাতিসংঘে কানাডা বেশ জোড়ালো ভূমিকা নিয়েছে। তার প্রত্যাশা কানাডা সরকার নিজের দেশেও একইভাবে এ বিষয়ে ভূমিকা রাখবে।
ইচ্ছার বিরুদ্ধে বিয়ে নিয়ে সুর্নিষ্ট কোন আইন কানাডায় নেই বলে প্রতিবেদনে উলে¬খ করা হয়।
কানাউর বলেন, “কানাডিয়ানদের কানাডায় ফিরে আসায় সহযোগিতা করার ক্ষেত্রে পররাষ্ট্র বিষয়ক দফতর চমৎকার কাজ করছে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে শুধু দেশের ভেতরে নয়, বাইরেও এই ইস্যু নিয়ে কিভাবে কাজ করা হবে সে বিষয়ে কোন দিক নির্দেশনা নেই”।
দেশের ভেতরে যেভাবে এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেয়া হয় ঠিক সেভাবে ভিকটিম কোন দেশে আছে তা বিবেচনায় না নিয়ে দেশের বাইরেও যাতে কর্মকর্তারা একইভাবে কাজ করতে পারেন সেজন্য সুনির্দিষ্ট কর্ম পরিকল্পনার বাস্তবায়ন দেখতে চান তিনি।
সংস্থাটি শুধু জড়িপ করেই খান্ত হয়নি শিক্ষক, গাইডেন্স কাউন্সেলর, স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ও পুলিশদের এ বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেয়ারও সুপারিশ করেছে তাদের প্রতিবেদনে। সেইসাথে ইচ্ছার বিরুদ্ধে বিয়েকে পারিবারিক নির্যাতন হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ারও প্রস্তাব করেছে তারা।
এমনকি যাদের স্থায়ী বাসিন্দার কোন লিগাল স্ট্যাটাস নেই তাদেরকে রক্ষায়ও ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলা হয়েছে প্রতিবেদনে।
জোর পূর্বক বিয়ে এবং পারিবারিক নির্যাতন প্রতিরোধে স্পাউজাল স্পন্সরশিপ আইন পরিবর্তন করা উচিৎ বলে প্রতিবেদনে উলে¬খ করা হয়। বর্তমান আইনে নাগরিকত্ব পেতে হলে বিয়ে করে কানাডায় আসা স্পাউসকে সুনির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত বৈবাহিক সম্পর্ক টিকিয়ে রাখা বাধ্যতামূলক।
চাদ বলেন, “আমি আশা করি ইচ্ছার বিরুদ্ধে বিয়ে সম্পর্কে একদনি সবার ধারণা আরো স্পষ্ট হবে এবং জানতে পারবে যে এটা আমাদের সমাজে কত সাধারণ একটি ঘটনা। এ ধরণের ঘটনা হয়তো আমাদের পাশের বাড়িতেই ঘটছে। আমরা শুধুমাত্র সংকেতটা ধরতে পারি না”।
ইচ্ছার বিরুদ্ধে বিয়ের ঘটনা রোধে প্রতিবেদনের সুপারিশগুলো পর্যালোচনা করে দেখার আশ্বাস দিয়েছে ওটোয়া কর্তৃপক্ষ। সিটিজেনশিপ অ্যান্ড ইমিগ্রেশন কানাডার মুখপাত্র ন্যান্সি ক্যারোন জানান, “জোর পূর্বক বিয়ে ইস্যুটিকে আমরা খুবই গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করছি এবং প্রতিবেদনের সুপারিশগুলো পর্যালোচনা করে দেখা হবে”।
ডিপার্টমেন্ট অব জাস্টিসও প্রতিবেদনের সুপারিশ পর্যালোচনা করবে বলে জানিয়েছে।মুখপাত্র অ্যান্ড্রু গোউইং জানান, “নারী ও অন্যান্য অসহায় ব্যক্তিদের জোর পূর্বক বিয়েসহ সব ধরণের নির্যাতন থেকে রক্ষায় সরকার অঙ্গীকারাবদ্ধ”।
পররাষ্ট্র বিষয়ক মন্ত্রী জন বেয়ার্ড ১৮ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘকে জানান, “প্রতি বছর লাখ লাখ মেয়ে ইচ্ছার বিরুদ্ধে বিয়ে করতে বাধ্য হচ্ছে, এদের কারো কারো বয়স থাকে ৮ বছরের মধ্যে। আমাদের সরকার এসব মেয়েদের রক্ষায় সব সময় তাদের পাশে আছে। এ জন্য শিশু, আগেভাগে ও ইচ্ছার বিরুদ্ধে বিয়ে বন্ধের বিষয়টিকে আমাদের পররাষ্ট্রনীতিতে প্রাধান্য দিচ্ছি”।
কানাউর আশা করেন, আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বেয়ার্ডের প্রচেষ্টা দেশের ভেতরেও পরিবর্তন আনবে।
সংস্থাটির প্রতিবেদনের একটি কপি বেয়ার্ডের কাছে পৌঁছে দেয়া হয়েছে। তিনি সংস্থাটির কর্তকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকে কানাডায় এই সমস্যা কিভাবে সমাধান করা যায় তা পর্যালোচনা দেখার আশ্বাস দেন বেয়ার্ড।
অভিবাসন মন্ত্রীর প্রেস সেক্রেটারি অ্যালেক্সিস পালভিক জানান, জোর পূর্বক বিয়ের ঘটনা বন্ধে কানাডা সরকার আইনের সর্বোচ্চ ব্যবহার করতে অঙ্গীকারাবদ্ধ।
তিনি বলেন, জোর পূর্বক বিয়ে কানাডায় শুধুমাত্র বেআইনীই নয়, এটি কানাডার মূল্যবোধের বিরোধী এবং এদেশে এর কোন স্থান নেই।
জোর পূর্বক বিয়েকে বেআইনী বলার মতো সুনির্দিষ্ট আইন যদিও কানাডায় নেই তারপরও বিদ্যমান আইনে এর বিচার করা সম্ভব বলে জানিয়েছেন ডিপার্টমেন্ট অব জাস্টিসের মুখপাত্র গোউইং।
কানডিয়ান কনসুলার অফিস যাতে সারা বিশ্বে ভিকটিমদের সাহায্য করতে পারে সে জন্য প্রতিবেদনে কিছু সুপারিশ করা হয়। এর প্রেক্ষিতে পররাষ্ট্র বিষয়ক মুখপাত্র জন ব্যাবকক জানিয়েছেন, জোর পূর্বক বিয়ে সংক্রান্ত কানাডিয়ান ভিকটিমদের সাহায্যে কনসুলারের সামর্থ্যের উন্নয়ন ঘটানো অব্যাহত রেখেছে পররাষ্ট্র দফতর।