নিভৃতে

রীনা গুলশান

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

বিকট স্বরে কলিং বেল বেজে চলেছে। কতক্ষণ ধরে বেজে চলেছে ফাবিয়ান জানে না। হঠাৎ করে কানে যেন মেঘ গর্জনের মত আওয়াজ আসে। ফাবিয়ান নিজেই জানে না, সে কোথায় কোন লোকে চলে গিয়েছিল, কতক্ষণ? তাও জানে না। নিজেকে অনেক কষ্টে উত্থিত করে। কারণ, ওর মনে হচ্ছে মাথাটা যন্ত্রণায় ছিড়ে যাচ্ছে। সেই খুব ভোরে একটু খেয়েছিলো। আর সারাদিন খায়ওনি। শরীর ক্লান্তির ভারে নুহ্য। অনেক কষ্টে নিজেকে টেনে নিয়ে গেল দরজার কাছে। দরজা খুলে ফাবিয়ান হতবাক হয়ে চেয়ে রইলো। নাওমী। হ্যাঁ সে ভুল দেখছে না। তার শ্রেষ্ঠ শুভাকাক্সিক্ষনী নাওমী সুলেভান। ফাবিয়ান প্রচণ্ড বিস্ময়ে চেয়ে রইলো আপাদমস্তক শীতবস্ত্রে আবৃত নাওমীর দিকে।

: কি ঘরের ভেতরে ঢুকতে দেবে? নাকি আরো এক ঘণ্টা বাইরে দাঁড়া করিয়ে রাখবার বাসনা?

: ওহ্! নাওমী, সরি-সরি, প্লিজ ভেতরে এসো।

: ওহ্! মাগো- কুম্ভকর্ণ আর কাকে বলে? জানো আমি কতক্ষণ দাঁড়িয়ে আছি? আর কতবার বেল বাজিয়েছি। তারপর এত্ত জোরে দরজা ধাক্কিয়েছি যে পাশের বুড়িটা দু’বার দরজা খুলে আমার দিকে তাকিয়েছে। আমিতো আর লজ্জায় বাঁচি না। আবার প্রচণ্ড ভয়ও করছিল না জানি তোমার কি অবস্থা! নাওমীর কণ্ঠ দিয়ে যেন অমৃতের মতন মমতা ঝরে পড়ছিলো। ফাবিয়ানের হঠাৎ যেন ভ্রম হয়, এ নাওমী না- এ তার নন্না! সে হঠাৎ দৌড়ে যেয়ে নাওমীকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো। ঘটনার আকস্মিকতায় নাওমী বেশ কিছুক্ষণ স্থবির হয়ে রইলো। তারপর পরম মমতায় ফাবির মাথায় হাত বুলিয়ে দিল এবং ওর হাত ধরে কাউচের উপর বসিয়ে দিল। ভেজা টাওয়েল এনে ওর মাথা-মুখ খুব ভালো করে মুছে দিল। তারপর তার প্রায় সারাদিন ধরে ফাবির জন্য রান্না করা খাবার প্লেট ভরে নিয়ে এলো। এগুলো সব ফাবির অত্যন্ত প্রিয় খাবার। ভেজিটেবল পাস্তা, মিটবল কারি, আর ফিস ফিলেটের ঝাল ঝাল করে বেক করা। ফাবিয়ানের হাতে প্লেটটা তুরে দিল-

: নাও, শিঘ্রি খাও! খেয়ে আমাকে উদ্ধার কর। আমিও খাবো এবারে।

: তুমি খাওনি?

: কখন খাবো বল? সারাদিন ধরে তো এগুলো রান্না করলাম। তারপর এত দূর এলাম। এসে কোথায় জলদি করে খেতে বসবো, তা বাইরেই দাঁড়ানো ঘণ্টাখানেক।

: সরি, নাওমী।

: ওকে, ওকে- আর সরি হতে হবে না।

নাওমী প্লেটে অল্প কিছু খাবার তুলে আনলো নিজের জন্য। ফিস ফ্রাই ১টাও নিল না।

: কি হলো, ফিস ফ্রাই নিলে না?

: নাহ্, ঠিক আছে আমার অত প্রিয় নয়। বাকি আরো ৫/৬টা ফিস আছে আমি ফ্রিজে রেখে দিয়েছি। ৩/৪ দিন চলে যাবে সব, যা খাবার এনেছি।

: ঠিক আছে, তুমি আজ অফিসে যাওনি কেন?

: আমিও সিক-কল দিয়ে দিলাম। ভালো লাগছিল না!

: তা ভালো যখন লাগছিল না, তো সারা দিন ধরে রাঁধলে কেন?

: বারে খেতে হবে না?

: তাই বলে ‘সিক কল’ দিয়ে সারাদিন বসে রাঁধতে হবে? তাও নিজের জন্য না, অন্য কারো জন্যে?

: কে বললো? আমি বুঝি না খেয়ে আছি?

: তাতো দেখতেই পাচ্ছি?

: ওকে বাবা, আমার বুড়ো দাদাঠাকুর- তোমার সঙ্গে কথায় কে পারবে বল? আচ্ছা এখন বলুন স্যার, সারাদিনে কি কি হলো?

: তাও ভালো শেষ পর্যন্ত শুনতে চাইলে?

: কারণ, আমি জানি আমি শুনতে না চাইলেও তুমি আমাকে শুনিয়েই ছাড়বে!

অতপর ফাবিয়ান আজকের সমস্ত বিবরণ বিস্তারিত বললো। এমনকি যে এটা যে আসলে অনেক দিন থেকেই তাদের বিবাদ চলছিল। কিন্তু ফাবিয়ান সেটা বুঝতে পারেনি। অতপর ফাবিয়ান নাওমীকে বললো-

: সব তো শুনলে, বল এখন আমি কি করবো?

: হু! আমার এরকম সন্দেহ হয়েছিল, কিন্তু তোমাকে বলিনি- তাহলে তুমি আমাকে ভুল বুঝতে। ওতো বরাবরই খুব এ্যামবিশাস ছিল। তুমিই শুধু বুঝতে অনেকগুলো সময় নষ্ট করলে!

: ঠিকই বলেছো, আমার জীবনটাই এরকম। বার বার আমাকে শুধু হোচট খেতে হয়।

: তা এখন কি করবে ঠিক করেছো?

: বুঝতে পারছিনা, তবে নন্না বড় বেশি টানছে, নাওমী।

: আমিও সেটাই ভাবছিলাম জানো? তুমি ৫ বছর দেশে যাওনি। এখন তো আর আইনগত প্রবলেমও নাই। সিটিজেন তো কবেই হয়ে গেছো। তুমি একবার দেশের থেকে ঘুরেই আসো। নানীও তোমাকে কত দিন দেখেনি একবার ভাবো? এই ৫টা বছর নানী তোমাকে না দেখে কি কষ্টটাই না পেয়েছে! আহারে, একা একা বুড়ো মানুষ।

: ঠিক বলেছো। তাহলে আগে কোনটা করি, সেটা বল?

: এক কাজ করো আগে টিকিট বুক করো। দেখো কোন এয়ারলাইন্সে একটু চিফ পাওয়া যাবে? তারপর আগামীকালই ক্লাবে যেয়ে বসকে নানীর খুউব অসুখের কথা বলে ছুটি নেবে।

: কয় দিনের নেব?

: বেশি দিনের বললে আবার বুড়ো চটে যাবে। এক মাসের জন্যই নাও। তাছাড়া তোমার student-ও আছে। তারপর এজেন্টকেও তো মাসে মাসে ডলার দিচ্ছো। সব দিক চিন্তা করেই এগুতে হবে।

: ওকে বস! তারপর?

: আচ্ছা নানীর জন্য তো স্পন্সর-এর আবেদন করেছিলে তার কদ্দুর?

: হ্যাঁ, ক্যানো?

: কারণ, ওটা হয়ে গেলে নানীকে একেবারে সাথে নিয়েই আসতে পারতে। নানীর এখন তোমাকে সর্বদা প্রয়োজন।

: হু! ঠিক বলেছো। আমি লাস্ট উইকেও খোঁজ নিয়েছি। মনে হয় খুব বেশি দিন দেরি নাই। এবার যেয়ে নানীকে শুধু কনভিন্স করতে হবে।

: তুমি তাহলে এক্ষুনি টিকিটের ব্যাপারটি দেখো। আর আগামীকালই বসের সাথে কথা বলবে।

: ওকে আমি তাহলে এখন চলি।

: নাওমী, তুমি কি জানো, তুমি আমার জীবনে কে?

: কে?

: এ্যানজেল। তুমি আমার আকাশ থেকে নেমে আসা সুইট এ্যানজেল।

: রক্ষে করো, আমি আর এ্যানজেল হতে চাই না! মানুষ হয়েই বাঁচতে চাই। যাতে এই পৃথিবীর মানুষেরা আমাকে মাটির কাছাকাছিরই একজন মনে করে। তারা যেন ভাবতে পারে, আমারও কিছু চাওয়া-পাওয়া আছে!

নাওমীর এই কথাটায় ফাবিয়ানের কেমন জানি লাগলো। মনে মনে বেশ হোচট খেলো। বুঝলো নাওমী যতটা সহজভাবে বলেছে, ততটা সহজ কথা নয়। ফাবিয়ান কেমন জানি আনমনা হয়ে বললো-

: চলো তোমাকে ড্রাইভ ওয়ে পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে আসি।

নাওমীকে বিদায় দিয়ে, উপরে এসে আবার একটু গড়িয়ে নিলো ফাবিয়ান। এরপর চট করে উঠে একটা শাওয়ার নিলো। এবারে বেশ ঝরঝরে লাগছে। এমনিতেই ইটালি যাবার পরিকল্পনার সাথে সাথেই ওর ভেতরটা বেশ চাঙ্গা বোধ করছে।

আজতো জানুয়ারির মাত্র সাত তারিখ। এখন আবার টিকিটের দাম একটু বেশি। ফেব্রুয়ারির দিকে টিকিট বুক দিলে সম্ভবত টিকিটের দাম কিছুটা কম পড়বে।

ওর পরিচিত এক বন্ধু এক ট্রাভেল এজেন্সিতে কাজ করে। তাকেই ফোন দিল। পেয়েও গ্যালো। সেও একই কথা বললো। এখন টিকিটের দাম বেশ চড়া। ফেব্রুয়ারিতে নিলে একটু কম পড়বে। ফাবি বললো, ঠিক আছে তুমি আমাকে ফেব্রুয়ারিতেই দাও। ছেলেটা ১ ঘণ্টা টাইম চাইলো। বললো সে কল ব্যাক করবে।

ইতিমধ্যে ফাবিয়ান ১ মগ কড়া কফি বানালো, তারপর টিভি চালালো। কমেডি চ্যানেল। ওর এখন জোরে জোরে হাসা দরকার।

মজার ব্যাপার, হঠাৎ করেই ফাবিয়ানের ভেতরটা খুব হালকা লাগতে শুরু  করেছে। খুব ভালো লাগছে। ফ্রেশও লাগছে কি এক অজানীত কারণে। মনে হচ্ছে বুকের মধ্যে থেকে একটা বিরাট বোঝা নেমে গেছে। ভালোবাসাহীন সম্পর্ক কি তাহলে এই রকমই হয়। ফোনের কড় কড় শব্দ ফাবির চিন্তাসূত্র ছিন্ন হয়। ঐ ছেলেটির ফোন-

: ওকে ফাবিয়ান একটি ভালো টিকিট পাওয়া গেছে। দামও বেশ সস্তা পড়বে। ১৬ই ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যা ৬টার ফ্লাইট। তুমি ১ মাসের বলেছো। তাই ১৭ই মার্চ, সেম টাইম রোম থেকে আসতে হবে। রোম থেকে কাটিনজারোর ডোমিস্টিক বুকিংও আমি দিয়ে দিতে পারি, যদি তুমি বলো।

: ওকে, আমার কোন প্রবলেম নাই।

: তাহলে তুমি অনলাইনেই আমারে এজেন্সিতে গিয়ে টিকিট কেটে ফেলো। কারণ, এখনতো টিকিট বুকিং সিস্টেম নাই। তুমি কেটেই ফেলো। টিকিটও অনলাইনেই পেয়ে যাবে।

: আচ্ছা, আমি এক্ষুনি যাচ্ছি- তোমাদের অনলাইনে।

আধা ঘণ্টার মধ্যে টিকিট কাটার সব প্রক্রিয়া শেষ হয়ে গ্যালো।

ফাবিয়ান সাথে সাথেই নাওমীকে ফোন করলো। সব ডিটেলসে জানালো। নাওমী খুবই খুশি হলো এবং বললো, কাল আগেই বসের কাছ থেকে ছুটি মঞ্জুর করাবে। তারপর আমরা এক জায়গায় বসে ঠিক করবো, কার জন্য কি কি কিনতে হবে।

: OMG! তাইতো এটাতো আমার মাথায়ই আসেনি।

: তা আসবে কেন? মাথায় তোমার শুধু টন টন গোবর ভরা- বলেই নাওমী এই প্রথম তার স্বভাব বিরুদ্ধ ভাবে খিল খিল করে উচ্চ স্বরে হেসে চললো।

ফাবিয়ান যথাক্রমে খুবই অবাক হলো। আবার খুউব মজা পেল। নাওমী এত্ত জোরে হাসছে!

: ওকে, তাহলে এক কাজ করি- কাল একেবারে আমরা শপিংটাই সেরে ফেলি। কি বল? কালতো ক্লাব বন্ধ। তোমার কি ক্লাস আছে?

: আছে সকালের দিকে পর পর ২টা। অসুবিধা নাই। আমি একটার মধ্যে চলে আসবো। তুমি একেবারে রেডি হয়ে থাকবে। আমরা ‘ইটন সেন্টার’ থেকেই শপিংটা করে ফেলবো। তুমি শুধু একটা নামের লিস্ট করো। আর কাকে কাকে কি দেবে, মোটামুটি চিন্তা করে লিখে ফেলো। ৪ দিন সময় পাচ্ছি, কাল সোমবার থেকে বুধবার আমরা সব কিনে ফেলবো। বুঝলে?

: ওহ্! দারুণ দারুণ- তাই হবে দেবী। তোমার তুলনা শুধু তুমিই।

ব্যাস ফাবিয়ান প্রায় অর্ধেক রাত জেগে নাম্বারসহ কাকে কি দিতে চায় সব লিখে ফেললো। এখন ক্রেডিট কার্ডটা নিবে আর শপিং করবে। লিস্টিটা শুধু নাওমেিক ধরিয়ে দিবে।

পর দিন সকাল সকাল উঠেই ফাবিয়ান ফ্রেস হয়ে টোনা, মেয়োলিজ দিয়ে একটা বিগ বার্গার বানিয়ে খেলো। তারপর আরো একটা বিগ বার্গার বানালো টার্কি দিয়ে নাওমীর জন্য। নাওমী আবার ফিস জাতীয় কিছুই খায় না। একটা বেজে পনেরোতেই নাওমী নিচের ড্রাইভ ওয়ের থেকে ফোন দিল। এক থারমাস ভরে ক্রিম কফি বানিয়ে রেখেছিল, আর বার্গার সুন্দর করে র‌্যাপ করে নিচে তড়িঘড়ি নেমে এলো। সাদা জ্যাকেট আর স্কাই ব্ল­ু রিপট জিনসে ফাবিয়ানকে আজ সত্যি দারুণ লাগছিল।

নিচে এসেই নাওমীকে ইশারা করলো পাশের সিটে চলে যেতে। নাওমী বেশ অবাক হয়ে বাইরে বেরিয়ে পাশের সিটে বসলো। ফাবিয়ান ড্রাইভিং সিটেই বসলো। এরপর ফাবিয়ান নাওমীর হাতে বার্গারের র‌্যাপটা ধরিয়ে দিল আর কফির থারমাসও গাড়ির মাঝখানে রেখে দিল। নাওমী বেশ অবাক হলেও খুব বেশি অবাক হলো না। কারণ ফাবিয়ান মাঝে মধ্যে তাকে এই সারপ্রাইজটা দ্যায়। নাওমী ক্লাস করে প্রচণ্ড ক্ষুধার্ত ছিল, ভেবেছিল ‘ঈটন সেন্টারে’ গিয়ে প্রথমে ‘Fresh Burger’ থেকে একটা বার্গার খেয়েই শপিং-এ নামবে। ও বাব্বা, এ তো মেঘ না চাইতেই জল। “তার মানে বাবু আজ খুব মুডে আছে” নাওমী মনে মনে ভাবলো।

হু তা আছে- গাড়ি চালাচ্ছে আবার সিটি বাজিয়ে গানও গাচ্ছে। নাওমী খুব মজাচ্ছে বার্গার খতম করে, পানি খেয়ে, কফি ঢাললো থারসামের মগে। ফাবিয়ানকে কফির কথা বলতেই বললো, কফি খেয়েই নেমেছে।

কিং ধরে কিং এন্ড ডাফরিনের দিকে এগিয়ে গ্যালো। যদিও এদিকটাতে স্ট্রীটকার থাকে তবু, ফাবিয়ান সোজা এগিয়ে যাচ্ছে। ও ভেবেছে সোজা ‘এ্যাট্রিয়াম অন বে’র মধ্যে গাড়ি ঢুকাবে। ওখানে সারা দিনের জন্য  ২৫ ডলার নিবে পার্কিং-এ। তাতে সুবিধা আছে। এটা ডাউনটাউনের জন্য খুবই চিফ। এবং গাড়িও খুব সেফ থাকবে। সেই জন্যই সে ড্রাইভিং-এর সিট-এ বসেছে। না হলে নাওমী তার পকেট থেকে ক্রেডিট কার্ড বেরই করতে দিবে না।

যাক এলিভেটরের বেশ কাছেই পার্কিং পেয়ে গ্যালো। দিনটা সুন্দর চলছে। লিস্টটা গভীর মনোযোগ দিয়ে পড়ছে নাওমী। মাঝে একবার খুব অবাক হয়ে তাকালো ফাবির দিকে। অবশ্য ওকে কিছু বুঝতে দিল না।

প্রথমেই ওরা ‘নরদ স্ট্রম’-এ ঢুকলো। যদিও এটা খুবই এক্সপেনসিভ স্টোর। তবু নাওমী ঢুকলো।

প্রথমেই ডোরিনের জন্য একটা ‘ল্যান্ডকমের কসমেটিকসের’ পুরা সেট কিনলো। ওরা পুরা একটা বিউটি বক্সের মধ্যে সাজিয়ে দিল।

সারা আনটির জন্য এখান থেকে ল্যান্ডকমের ২টা পারফিউম নিল। BEBE-এর ১টা টপস নিল ডোরিনের জন্য। আর একটা নিল নাটালীর জন্য। সারা আন্টির জন্য ৪টা টপস আর ২টা জিনস নিল ‘guess’-এর।

একটা পার্স’ও নিল কালো রঙের ‘guess’এর সারা আন্টির জন্য।

‘কেভিন আঙ্কেলের জন্য আর রোডিকা আন্টিার জন্য ‘guessু’ ঘড়ি কিনলো।

এরপর ‘মাইক এন্ড জোনস’ এর Polo টিসার্ট ৪টা কিনলো। যদিও ফাবিয়ান ২টা লিখেছিল। কিন্তু নাওমী ১টা কিনলে অন্যটা ৫০% দেখে ৪টা ৪ রঙের নিল। বললো, অন্য বন্ধুদের সাথে দেখা হলে দিও। আর ডেভিটকে ১টি দিও।

ডেভিডের জন্য Roots-এর ঘড়ি আর হুডি জ্যাকেট নিল।

নাটালির জন্য ‘ফসিলের’ খুব সুন্দর একটা ঘড়ি নিল।

মাঝে DG-এর থেকে ২ট ভ্যানিলা আইসক্রিম কিনে দুজন খেলো। টায়ার্ড হয়ে গিয়েছিল।

এরপর ‘ZARA’তে ঢুকে স্টিভেন ড্যাডের জন্য একটা মেরুন রঙের ব্লে­জার কিনলো।

তারপর লিস্টে নানীর জিনিস ছাড়া আর কিছু লেখা ছিল না। নাওমী জিজ্ঞাসার দৃষ্টিতে তাকালো ফাবির দিকে, এরপর?

দুজনের হাতে প্যাকেট ভরে গেছে।

: আজই কিনবে? নাকি আবার কাল আসবে? নাওমী বললো।

: হু আসা যায়! তুমি কি বল?

: আজ টায়ার্ড লাগছে।

: তাহলে আজ চলো। কাল আবার সেম টাইম তাই না? ডিনারটা সেরেই যাই।

নিচে ‘ফুড কোর্টে’ গ্যালো। দুজনের প্রিয় খাবার ‘শর্মা র‌্যাপ’ খেলো। সাথে কোল্ড ড্রিংসও নিলো।

পর দিন আবারও এলো। আজ একটু দেরিতে এলো। কারণ নাওমীর ক্লাস একটা ৩টা পর্যন্ত ছিলো। ৫টার একটু পর এলো।

আজকের হাল ধরলো ফাবিয়ান। সে সোজা নাওমীকে নিয়ে ‘ People’ ডায়মন্ড স্টোরে ঢুকলো।

নাওমী মনে মনে খুব অবাক হলো, যদিও মুখে কিছুই বললো না। ঘড়ির সাইডে গিয়ে অনেক দেখেশুনে ৮৭৭ ডলার দিয়ে একটা সিকো ঘড়ি কিনলো white gold-এর plated belt। ঘড়িটা খুবই চমৎকার। নাওমীর খুবই পছন্দ হলো।

এরপর ডায়মন্ড সেকশনে গিয়ে নেকলেস দেখা শুরু করলো। নাওমী যথারীতি বিস্ময়ে মনে মনে ফেটে পড়ছিল, যদিও মুখে কিছুই বললো না। মাঝখানে একটা বড় বাকিগুলো ছোট ছোট অনেক ভি সেপের একটা নেকলেস দুজনে পছন্দ করলো। দাম পড়লো $ ৫৩৭৭। তারপর ইন্স্যুরেন্স নিল আরো ২২৫ ডলার পড়লো। এতে সুবিধা হলো একটা ডায়মন্ড পড়ে গেলে, ওরা বসিয়ে দেবে। শুধু ইন্স্যুরেন্স পেপারটা শো করতে হবে।

আজ শুধু এই ২টা জিনিসই কিনলো। পথে যেতে যেতে ফাবি বললো, জানতে চাইলে না, কার জন্য নেকলেসটা কিনলাম?

: মনে হয় জানি।

: কার জন্য?

: সারা মাম্-এর জন্য!

: আশ্চর্য! কিভাবে বুঝলে তুমি! তুমি কি অন্তর্যামী? আমিতো গত ৫ বছর শুধু মায়ের নামে তোমার কাছে ঘৃণার কথাই বলেছি।

: আর সেই ঘৃণাটাই যে তোমার এক সাগর ভালোবাসা সেটা একটা পিচ্চিও বুঝবে। নাওমী খুব শান্ত আর মিষ্টি একটা হাসি দিল। তারপর বললো-

: জানো আজ এই গিফটা যখন কিনলে, তখনই তোমার জীবনের মাঝখানের ২০টা বছর ঝরে গেছে।

ফাবিয়ানকে নামিয়ে দিল নাওমী আর বললো, বৃহস্পতিবার দেখা হবে ক্লাবে। আর নানীর গিফট আর চকোলেট যাবার আগে আগে কিনবো। কাল তুমি শুধু ২টা স্যুটকেস কিনবে খুব হালকা ধরনের আর একটা হাত ব্যাগ কিনো।

: ওকে ম্যাডাম।

বৃহস্পতিবার ঘণ্টা খানেক আগেই ফাবিয়ান ক্লাবে পৌঁছালো। কারণ আজ বসকে তেল দিতে হবে। ছুটি মঞ্জুর করাতে হবে। এ্যান্থনি বারজেমের সামনে হাজির হলে, দেখে বস মিটমিট করে হাসছে। তারপর হেড়ে গলায় একটা হাক দিল-

: কিহে, শেষ পর্যন্ত বেঁচে বর্তে আছো? তা তোমার নানীর অবস্থা নাকি খুবই সিরিয়াস?

: জি, জি- ফাবিয়ান তোতলাতে থাকে। সে ঠিক মিথ্যা বলতে পারে না। কিন্তু বুঝলো এটাও নাওমীই তার জন্য করে রেখেছে যাতে ছুটিটা সহজেই হয়ে যায়।

: আহা তারতো দেখাশোনারও কেউ নাই।

: হু! একদম একা!

: তাহলে তার দেখাশোনা, ডাক্তার- এসব কে করছে?

: আমার নানার ছোটবেলার বন্ধু, পাশাপাশিই বাড়ি, তার মেয়ে জামাই কিছুটা দেখছে আর কি?

: নাহ্ এভাবেতো হয় না! তাড়াতাড়ি তাকে এখানে নিয়ে আসা দরকার। তোমার নানীর স্পন্সরের খবর কি?

: আর বেশি দেরি নাই, কিছুটা ফরমালিটিস বাকি।

: তা ক’দিনের জন্য যেতে চাইছো?

: বেশি না বস, ৪ সপ্তাহের ছুটি দিলেই চলবে।

: ওকে, তা ফ্লাইট কবে?

: ফেব্রুয়ারি ১৬ তারিখের, ঐ দিন সোমবার আছে। রবিবার পর্যন্ত কাজ করে যেতে পারবো।

: ওহ্! তাহলে তো খুবই ভালো হলো।

: হ্যাঁ, সেই জন্যই তো সোমবার ফ্লাইট নিয়েছি।

: আমার জন্যও ভালো হলো, হ্যারিকে খবর দিয়েছি, তোমার বদলে এ ক’দিন গাইবে।

: ধন্যবাদ বস, আপনার ঋণ আমি কোন দিন ভুলতে পারবো না।

: ওকে, ওকে- ভাগো, আর তেল দিতে হবে না।

দেখতে দেখতে কখন জানি  ১৬ই ফেব্রুয়ারি রোববার চলে এলো। রবিবারে সুন্দরভাবে গাইলো। যদিও বুকের মধ্যে খুব উত্তেজনা অনুভব করছিল। ফেব্রুয়ারির ১৬ই সোমবার সন্ধ্যা ৬টার দিকে এয়ারপোর্ট যেতে হবে। রাত ৯টায় ফ্লাইট। নাওমী বলেছে, ফাবিয়ানকে সেই ড্রপ করে দিবে। এদিকে রায়ান, রবার্টও বলেছে ৬টার মধ্যেই চলে আসবে ওকে সিঅফ করতে। রায়ান আবার বলেছে, ছোট্ট একটা প্যাকেটও দিবে তার মায়ের জন্য। ফাবিয়ান ঠিক করেছে প্যাকেটটা ওর হাত ব্যাগে নিবে। এদিকে এ্যান্থনি গতকাল রাতেই আসবার সময় বলে দিয়েছিল, সোমবারে যেন ১২ থেকে ১টার মধ্যে তার সাথে একবার অফিসে দেখা করে।

ফাবিয়ান যাবার উত্তেজনায় রাতে একটুও ঘুমাতে পারেনি। ভোরেই উঠে নাস্তা বানিয়ে খেয়ে ফেললো। ঘরটা একটু গুছিয়ে ফেললো। নিচে যেয়ে ম্যানেজার ফিলিপকে একটা এ্যাডভান্স চেক দিয়ে আসলো। আর সিসিলিয়ার সমস্ত জিনিসপত্র আগেই নাওমীকে দিয়ে পাঠিয়ে দিয়েছে। স্যুটকেট, ব্যাগ সব গুছিয়ে দিয়েছে নাওমী। এখন কি পরে যাবে, সেগুলো রেডি করে অফিসমুখো রওনা হলো।

আজ জলদিই স্ট্রীটকার পেয়ে গেল। অফিসে নেমে দেখলো জনি চুপচাপ দাঁড়িয়ে সিগারেট ধরাবার উদ্যোগ নিয়েছে। আজ কি মনে করে ‘রাম গড়রের ছানা’ একটু হাসলো। বোঝা যাচ্ছে আজ মুডে আছে। কারণ আজ তো কোন মাতালের হ্যাপা নাই। আজ নিয়ম মাফিক দোরগোড়ায় দাঁড়ানো। কারণ, ক্লাব ৪ দিন খোলা থাকলেও (বৃহস্পতি থেকে রবিবার), বাকি তিন দিন ও এ্যান্থনি নিয়ম করে অফিসে বসে এবং কাজ করে। ১০টা থেকে পাঁচটা। এ্যানার্জি আছে বটে বুড়োটার। কখনো তাকে ফাবিয়ান ক্লান্ত দেখেনি। কখনো তেমন সিকও হতে দেখেনি। বছরে শুধু নিয়ম করে একটি বার ২ সপ্তাহের জন্য কোথাও হলিডে’তে যায় বৌ বাচ্চাদের নিয়ে। আর মজার ব্যাপার যেখানেই যাক না কেন আসবার সময় ক্লাবের সমস্ত এ্যামপ্লে­ায়ীদের জন্য একটা কিছু ছোটখাটো গিফট নিয়ে আসে। আর সব সময় বলে, তোমরা সবাই হলে আমার পরিবার! এ্যান্থনির বৌটাও খুব ভালো। ফিলিপিনো মহিলা। রোজমেরী। স্বামীর মত কর্মঠ, উদ্যমী এবং এনার্জেটিক। আর ওদেরকে সব ছেলেমেয়ের মত আদর করে। (চলবে)

রীনা গুলশান

লেখক রীনা গুলশান বাংলা সাহিত্যে মাস্টার্স। ইতিপূর্বে বাংলাদেশের বিভিন্ন দৈনিক, সাপ্তাহিক এবং মাসিকে তার কবিতা, ছোটগল্প, প্রবন্ধ, রম্য রচনা প্রকাশিত হয়েছে। প্রকাশিত হয়েছে কানাডার বিভিন্ন বাংলা পত্রিকাতেও। তিনি ‘প্রবাসী কণ্ঠ’ ম্যাগাজিন এর একজন নিয়মিত কলামিস্ট।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *