নিভৃতে
রীনা গুলশান
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
: এ্যাই কি ভাবছো, স্টিভেনের আকস্মিক প্রশ্নে সারা আবার যেন বাস্তবে ফিরে আসে।
: কিছু খাচ্ছো নাতো? শুধু নাড়াচাড়া করছো? কি হয়েছে বেবী? তোমার কি খাবার ভালো লাগছে না?
: না, না স্টিভেন- সব খাবারই খুব ভালো লাগছে।
এরপর ডেজার্টের ট্রলি আসলো। ডেজার্টের ট্রলির উপরেই আবার একটি খুব সুন্দর লাল গোলাপ। যার সবুজ ডাটিটা বেশ লম্বা। স্টিভেন লাল গোলাপটি হাতে নিল তারপর সারাকে সম্পূর্ণভাবে বিস্ময়ের চরমে নিয়ে স্টিভেন তার সামনে হাঁটু গেড়ে বসলো। ফুলটা হাতে নিয়ে বললো-
: সারা বেবী, আমি জীবনে কখনো কাউকে ভালোবাসিনি। তুমি আমার প্রথম প্রেম। আমি তোমাকে এত বেশি ভালোবেসে ফেলেছি যে, আর একটি মুহূর্তও তোমাকে ছাড়া থাকতে পারছি না। আমি তোমাকে বিবাহ করতে চাই। তুমি কি আমাকে তার যোগ্য মনে কর?
সারা যদিও এর জন্য সম্পূর্ণভাবে মানসিকভাবে তৈরিই ছিল। তবু, তবুও যখন ঘটনাটি সত্যিই হলো; সারা ভালোবাসার আবেগে ঝর ঝর করে কেঁদে ফেললো। দুই হাতে মুখ ঢেকে সারা কেঁদেই চললো। আর ঘটনার আকস্মিকতায় স্টিভেন বিহ্বল হলো-
: সারা, তবে কি তুমি আমাকে পছন্দ করো না? তুমি কি আমাকে বিবাহের জন্য এখনও প্রস্তুত নও?
: না, না স্টিভেন, তা নয়। আমি, আমি- সারা কথা বলতে পারে না আবেগে। সে স্টিভেনের একটি হাত তার দু’হাতের মধ্যে নিয়ে চুম্বন করে। তখন যেন স্টিভেনের হতাশায় ভরা মুখে আলোকছটা দেখা দেয়-
: ওহ্! সারা, আমিতো রীতিমত ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। তাহলে তোমার জবাব কি, হ্যাঁ? কি না?
: অফকোর্স, হ্যাঁ।
তখন স্টিভেন ওকে আবারো একটা চমক দিলো, সেই লাল গোলাপের কোথায় যেন টিপ দিল আর ফুলটা ধীরে ধীরে মাঝখানে দু’ভাগ হয়ে গেল। আর মাঝখানে কালো ভেলভেটের উপর ঝকঝক করছে একটা অপূর্ব আংটি। বিশাল আকারের একটা পান্না আর চারপাশে ছোট ছোট ডায়মন্ডের আংটি।
: হানি, আমি কি তোমাকে আংটি পরিয়ে দিতে পারি?
: হ্যাঁ, স্টিভেন।
স্টিভেন তার বাম হাতের অনামিকাতে খুব ধীরে ধীরে আংটিটা পরিয়ে দিলো।
: সারা, তোমার কি আংটিটা পছন্দ হয়েছে?
: দারুন! দারুন, অসম্ভব সুন্দর! তুমি কি করে জানলে যে আমার ‘পান্না’ খুবই প্রিয়?
: আমি তোমার সব জানি, বেবী- তাছাড়া তুমি মিথুন রাশী। মিথুন রাশীদের জন্য ‘পান্না’ খুবই সৌভাগ্য বয়ে আনে।
: সত্যি! আমি তো জানতাম না। আমার এমনিতেই পান্না আর মুক্তা খুব পছন্দ।
তারপর ওরা ডেজার্ট খেল। সারা এবং স্টিভেন দুজনই তখন আনন্দে আপ্লুত। কেউই আর কথা বলতে পারছে না। এক সাথে যখন মানুষের ভেতরে অনেক আনন্দ, অনেক সুখানুভূতি, অনেক আবেগ আসে, তখন তারা বাক্যহারা হয়ে যায়। খানিকটা মূক হয়ে যায়। ঠিক বেদনার মত। অনেক দুঃখেও যেমন মানুষ পাথর হয়ে যায়।
অবশেষে ওরা আবার বাসায় যাবার প্রস্তুতি নিল। গাড়িতে কেউ আর তেমন কথা বললো না। এক সময় সারা তার বাড়ি দেখতে পেল। স্টিভেন নিজে আগে নেমে সারার দরজা খুলে দিল। তারপর সারার কোমর জড়িয়ে ধরে এই প্রথম ওকে গভীর চুম্বনে আবদ্ধ করলো। আর সারাও তার সমস্ত দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছাড়িয়ে তার চুম্বনে স্বতস্ফূর্তভাবে সাড়া দিল। স্টিভেনের চুম্বনও ওর মত গভীর। যেন আকণ্ঠ পান করছে সারার ভালোবাসাকে। সারার আবেশে চোখ মুদে এলো। এক সময় স্টিভেন ওকে ছেড়ে দিল। তারপর গভীর ভালোবাসায় ওর দিকে অপলক তাকিয়ে বলল-
: আজ থেকে তুমি এবং তোমার সমস্ত সুখ, দুঃখ আমার। কিন্তু আমরা আবার মিলিত হবো বিয়ের দিন। ঠিক আছে?
এই কথায় সারার স্টিভেনের প্রতি আরো ভালোবাসা এবং গভীর শ্রদ্ধায় হৃদয়ের ভেতরে নতজানু হয়ে গেল। সেও তখন স্টিভেনের গলা জড়িয়ে তার ঠোটে হালকা একটা চুম্বন করলো। তারপর তার বুকের উপর মাথা রেখে ফিসফিস করে বললো-
: স্টিভেন আজ থেকে আমার সব চিন্তা এবং আমার সমস্ত দায়িত্বও আমি তোমাকে দিলাম। তারপর সারা এই প্রথম স্টিভেনের কানের কাছে তার ঠোট নিয়ে বললো-
: আই লাভ ইউ সো মাচ।
: আই লাভ ইউ টু। ওকে, সারা- যাও হানি, তুমি বাসার মধ্যে যাও।
: উহু, তুমি আগে যাও।
: আচ্ছা, ভালো থেকো- আবার দেখা হবে।
: বাই, শুভ রাত্রি।
সারা বাসায় না যেয়ে আগে দৌড়ে রোডিকার বাসায় যায়। রাত যদিও অনেক হয়েছে। কিন্তু সারা জানে রোডিকা আর কেভিন এখনও ঘুমায়নি। রোডিকা তার বাবার বাড়িতেই থাকে। তার মার মৃত্যু হয়েছিল যখন রোডি মাত্র ১২ বছরের। সেই থেকেই তার বাবাই তাকে মানুষ করেছে। রোডিকার বাবা অনেক বেশি বয়সে বিবাহ করেছিল। তাই যখন রোডিকা কেভিনকে বিবাহ করলো, তখন তার বাবা অলরেডি ৭০ পার হয়েছে। তখন কেভিনই সহমর্মিতা জ্ঞাপন করেছে। সেই-ই বলেছে, এ সময়ে আমাদের তোমার বাবাকে ছেড়ে মোটেও যাওয়া উচিত নয়। যদিও কেভিন বেশ ভালোই ইনকাম করে। তবু তাদের বিবাহের পরও তারা রোডিকার বাবার কাছেই রয়ে গেল। রোডিকার সেই জন্য কেভিনের উপর কৃতজ্ঞতার সীমা নাই। আর রোডিকার বাবা রবার্ট ফাচিপন্টি এখন প্রায় ৮০’র কোঠায়। সারাক্ষণ ডোরিন আর ফাবিয়ানকে নিয়ে ব্যস্ত থাকে। কারণ, সারার বাবা আলবার্ট আর রবার্ট ছিলো অবাল্যের সাথী। এখনও আলবার্টের আকস্মিক মৃত্যু নিয়ে সারার সামনে ভেউ ভেউ করে কাঁদে।
আজ তাই রোডিকার বাসায় যখন মহাউৎসাহে যেয়ে ডোরবেল বাজালো, সারার একটু ভয় হচ্ছিল আঙ্কেল রবার্ট না উঠে যায়। কারণ তার ঘুম এখন খুবই পাতলা। কিন্তু না, একটি বেলের শব্দেই রোডি আর কেভিন দরজা খুলে সামনে দাঁড়ালো। আর সারা তার অবাল্যের একমাত্র বান্ধবীকে আনন্দে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেললো-
: ধূর মুখপুড়ি, আবার কাঁদিস কেন? তাড়াতাড়ি সব বল, আমার আর কেভিনের তর সইছে না! পেট ফেটে যাচ্ছে!
: এই দ্যাখ, সারা তার অনামিকার উপর স্পার্ক করা আংটি দেখালো।
: ওহ্! অপূর্ব- দুজনে এক সাথে চেচালো।
: চুপ, চুপ- আঙ্কেল রবার্ট উঠে যাবে।
: ঠিক আছে, ঠিক আছে- তুই আগে ডিটেলসে সব বল।
সারা তখন একে একে সব বলে আজকের সন্ধ্যায় যা যা ঘটেছে। কোন কিছুই গোপন করে না। এমনকি বিদায় নেবার সময় যে গভীর চুম্বন দিয়েছিল তাও বললো-
: দেখেছিস, আমি বলিনি- স্টিভেন খুবই গভীর মনের ছেলে। তুই তো শুধু চেহারা নিয়েই চিন্তা করে মরছিলি!
: হু ঠিকই বলেছিস, আমি সারা জীবন মানুষের উপরটা দেখেই মজেছি। কিন্তু আজ বুঝছি, মানুষের উপরেরটাই সব নয়!
: তা বিয়ে কবে হবে, কিছু বলেছে স্টিভেন? কেভিন উৎসুক হয়।
: নাহ, ডেট এখনও বলেনি! তবে এই বিয়েতে ওর বোন আসবে সুইডেন থেকে। ওরা অনেক ধুমধাম করতে চাচ্ছে।
: তাতো ঠিকই, এটাতো স্টিভেনের প্রথম বিয়ে। তাছাড়া তোর আগের বিয়েটাই বা কি বিয়ে ছিল। আঙ্কেল আলবার্ট তো কোন মতে নমো নমো করে বিয়েটা দিয়েছিল রাগের মাথায়।
: হ্যাঁ ঠিকই বলেছিস, সে জন্য বাবার দুঃখের অবধি ছিল না। সারাক্ষণ বলতো আমার এক মাত্র সন্তান তার এরকম বিয়ে দিতে হলো।
: বাদ দাও, ওসব পুরনো কাসুন্দি। যার শেষ ভালো তার সব ভালো, কেভিন আনন্দের সাথে বললো।
: তাহলে এখন যাইরে, রাত অনেক হলো- ছেলেটা আবার কি করছে কে জানে?
: ঠিক আছে, সাবধানে যা।
পর দিন সারা মাকে সব বলে। তার আংটি দেখায়। মাতো আনন্দে আটখানা। বার বার আংটিটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখছে আর আনন্দ প্রকাশ করছে। একবার কাঁদছে, একবার হাসছে।
: যাই বলিস মা, ছেলেটার পছন্দ আছে।
: হু, তাইতো দেখছি। যাই মা, পার্লারে দেরি হয়ে যাচ্ছে।
পার্লারে যাবার সাথে সাথে কলিগরা এক সাথে অভিনন্দন জানালো। এমনকি হবু শাশুড়িও কম যায় না। সবার সামনেই সারাকে খুব আদর করলো। তার হাতের আংটি দেখে মজা করলো-
: ওমা! কাঠখোট্টাটার তাহলে পছন্দ আছে। অবশ্য যখন তোমাকে পছন্দ করেছে, তখনই বুঝেছি ছেলেটার আমার পছন্দ আছে।
তারপর স্টিভেন এবং ওর মা জেনেলিয়া গ্যালাটি পর দিনই ওদের বাড়িতে আসলো, আমান্ডার সাথে দেখা করতে। সেখানে তারা বিবাহের দিনও ধার্য করলো। সামনের মাসের ২৩ তারিখে। জেনেলিয়া জানালো তার মেয়ে জামাই নাতিরা সব আসছে।
২৩ তারিখ আসন্ন। সারা দফায় দফায় দর্জির কাছে যাচ্ছে বিয়ের ড্রেসের ট্রায়াল দিতে। খুব সুন্দর ড্রেস। সিলভার কালার, কাঁধ খোলা, বুকের কাছে রিয়েল কিউবিক জিরকোনিয়া স্টোনের কাজ। সাথে ম্যাচিং করে পেন্সিল হীল কিনলো। রোডিকা আবার মজা করলো-
: বেশি উঁচু হিল কিনিস না, নাহলে চার্চে বিবাহের সময় ‘কিস’ করতে গেলে মই লাগবে স্টিভেনের।
: যাহ্! তোর খালি ফাজলামি।
অতপর ২৩ তারিখে খুব জমকালোভাবে বিয়েটা সম্পন্ন হলো। বিবাহে ১১৫ জন গেস্ট ছিল। সব খরচ করেছে স্টিভেন। সবাই তো বৌ দেখে প্রশংসায় পঞ্চমুখ। তার বন্ধুরাতো জোরে জোরে বললো-
: হ্যাই ডুড, উই জেলাশ টু সী হার।
সবাই বদ্ধ মাতাল হয়ে ঘরে ফিরলো। তারপর সারা এবং স্টিভেন ‘হাওয়াই’ দ্বীপে হানিমুনে গেল। সারার স্বপ্ন ছিল হাওয়াইতে যাওয়া। তাই বিয়ের দিনে স্টিভেন আবার তাকে সারপ্রাইজটা দিল।
হানিমুনে তারা দুই সপ্তাহের মত ছিল। এই দুই সপ্তাহ তার কিভাবে যে কেটেছে নিজেই জানে না। স্বপ্নের মত মনে হয়েছে প্রতিটি দিন-রাত্রি। তবু সেই স্বপ্নের মত দিন-রাত্রির মধ্যে একটিই কাঁটা ছিল তার ফাবিয়ান। যার কচি মুখটা যত বার মনে হয়েছে তত বারই বুকের মধ্যে উথাল-পাতাল করেছে। স্টিভেন ওর মুখের দিকে তাকিয়েই বুঝেছে। সাথে সাথে কল করেছে সারার বাসায়। আমান্ডা ফোন ধরেছে-
: মা কেমন আছো? ফাবি, ফাবি কেমন আছে?
: হ্যাঁ, আমরা খুব ভালো আছি।
: ও, মা একটু ফাবিকে দাও তো কথা বলি।
: ফাবি এখন এখানে নাইরে, ডোরিন-এর বাসায়। ওকি আর বাসায় থাকা ছেলে? সারাদিন টো টো করে ঘুরছে আর ডোরিনের সাথে খেলছে।
: ঠিক আছে মা, নিজের দিকে আর ফাবির দিকে খেয়াল রেখো।
দু’সপ্তাহ পর ফিরে এলো সারা। প্রথমে তাদের বাড়িতেই এলো। মাকে জড়িয়ে ধরলো। রোডিকা আর কেভিনের কাছে ছুটে গেল। রোডিকে খুব সুন্দর রিয়েল ‘ব্লাক পার্লের’ ইয়ারিং আর পেনডেন্ট গিফট করলো। মাকে আর জোনিলিয়াকেও ক্রিম কালারের পার্লের ইয়ারিং দিল। সবার সাথেই দেখা হলো। কিন্তু যার জন্য তার হৃদয় ছটফট করছে, তাকেই দেখছে না-
: মা, ফাবি কোথায়?
: কি জানি, জলপাই তলা দেখেছিস?
: হ্যাঁ, দেখলামতো।
: তবে লেকের পাড়ে নিশ্চয়ই! সারা ছুটলো লেকের পাড়ে। দেখে তার আদরের ফাবিয়ান একা বসে আছে লেকের পাড়ে। ছোট ছোট নৌকা বানিয়ে ভাসিয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে।
: ফাবি, ফাবি বাবা আমার- আমি তোকে কত খুঁজছি। দ্যাখ তোর জন্য কত কি এনেছি।
: আমার কিছু লাগবে না।
: সে কিরে? তোর প্রিয় ট্রেন এনেছি। পেইন্ট করার অনেক রকম পেন্সিল এনেছি। আরো একটা সারপ্রাইজ আছে, চল।
: না লাগবে না, ফাবি ঘাড় শক্ত করে বসে থাকলো।
: লক্ষ্মী বাবা আমার চল।
অনেক জোর জবরদস্তি করে ছেলেকে নিয়ে বাসায় গেল। তারপর তার হাতে একে একে অনেক গিফট দিল। তবু ছেলের মুখে হাসি নাই। তারপর আলাদীনের চেরাগের মত সারা ঘরের কোণ দিয়ে একটা বড় প্যাকেট নিয়ে এলো। বেশ লম্বা। ফাবিয়ানের থেকেও একটু লম্বা। ফাবিয়ান মোড়কটা খুললো, দেখে একটা আস্ত গিটার। নকল নয়। খেলনা নয়। অরিজিনাল গিটার! এবারে ছেলের চোখ চমচক করে উঠলো। মুখেও হাসি ফুটলো-
: গিটার মাম্, রিয়েল গিটার?
: হ্যাঁ সোনা, তুই কবে থেকে গিটার গিটার করছিলি। এবারে তোকে মিউজিক স্কুলেও দিয়ে দেব।
: ওহ্! মাম, তুমি খুব ভালো। কিন্তু ঐ লোকটার সাথে আর যাবে না বল?
: কিন্তু স্টিভেন তোমার ড্যাড! ফাবি।
: না, না-ও আমার ড্যাড নয়। ও পচা, তোমাকে নিয়ে যায়। খবরদার আর কখনো যাবে না।
: কিন্তু ফাবি, সারা আর কথা শেষ করতে পারে না। আমান্ডা তাকে ইশারা করে রান্না ঘরে নিয়ে যায়। তখন আমান্ডা খুব চিন্তিত স্বরে বলে-
: সারা মা, আমি তোকে বলিনি- তুই যখন হানিমুনে গেলি, তারপর থেকেই ফাবিয়ানের ব্যবহার খুবই বদলে গেছে। চুপচাপ হয়ে গেছে। এমন কি ডোরিনের সাথেও তেমন খেলেনি। ফাবি যে এই রকম করবে আমিতো বুঝতেই পারিনি!
: হু! তাইতো, তাহলে কি হবে মা!
তারপর সারা রোডিকা, কেভিন, স্টিভেন সবার সাথেই আলোচনা করলো। কেউ বুঝতে পারছে না, ফাবিয়ান কেন এমন করছে? শুধু আঙ্কেল রবার্ট তার ঘড়ঘড়ে কণ্ঠে বললো-
: তোমরা বেশি বোঝার চেষ্টা করো না। ওকে ওর মত থাকতে দাও। ওর মনের উপর যে চাপ সৃষ্টি হয়েছে তা বুঝতে গেলে তোমাদেরও ৬ বছর বয়সী হতে হবে।
তারপর সন্ধ্যার দিকে স্টিভেন এসে সারাকে নিয়ে গেল। সারা যাবার সময় অনেক খুঁজলো ছেলেকে, কোথাও পেল না। সারা কেঁদে ফেললো, স্টিভেন তাকে সান্ত্বনা দিল।
: সারা, লক্ষ্মী সোনা- সব ঠিক হয়ে যাবে। সময়ে সব ঠিক হয়ে যাবে।
এদিকে স্টিভেনের বোন এবং তার স্বামী তাদের বিবাহের সময়ে এসেছিল। তারা তখনও ছিল। এক বিকেলে স্টিভেনের বোন জুলিয়েন এবং তার স্বামী এডুইন সরাসরি স্টিভেনকে একটা খুব চমকপ্রদ প্রস্তাব দিল-
: স্টিভেন তুমি তো জানো যে আমি সুইডেনের স্টকহোমে বেশ বড়সড় একটা ‘অটোমোবাইল ওয়ার্কশপ’ করেছি।
: হ্যাঁ এডুইন, আমি তা শুনেছি। দিনে দিনে সেটা আরো বড় আকার নিচ্ছে তাওতো শুনলাম জুলিয়েনের কাছে।
: হ্যাঁ, ঠিকই শুনেছো। তো আমার একটা প্রস্তাব ছিল, আমি একা মানুষ, আমার বয়সও প্রায় ৫২। একা একা এত বড় ওয়ার্কশপ সামলাতে খুবই কষ্ট হচ্ছে! তা, তুমি যদি আমাকে একটু সাহায্য কর।
: আমি, আমি ঠিক বুঝলাম না এডুইন! আমি ইটলি থেকে তোমাকে কিভাবে সাহায্য করবো?
: না, সেটাতো সম্ভব নয়। আমি আসলে বিষয়টা নিয়ে অনেক দিন ধরেই ভাবছি। আর তুমিও অটোমোবাইলেই পড়াশুনা করেছো, তা পরের গোলামী না করে যদি নিজের ব্যবসাতে নামো, তাহলে কেমন হয়?
: কিভাবে?
: দ্যাখো আমি ভনিতা না করে সরাসরিই বলছি, আমি তোমাকে ফিপটি পারসেন্ট শেয়ার দিবো। তুমি আমার ওয়ার্ক পার্টনার হয়ে যাও। এটা অত্যন্ত প্রফিটেবল বিজনেস।
: ওহ্ গড! রিয়েলি? পাশ থেকে জেনেলিয়া চেচিয়ে উঠলো।
: এতো খুবই ভালো হয়। আমারও মনে হয় এর থেকে ভালো আর কিছু হয় না! এখন বিয়েও করেছো।
: কিন্তু মা, তুমি একা এখানে কিভাবে থাকবে?
: আমার কথা ভেবো না বাবা, আমি বহু দিন ধরে একাকী নিজেকে সামলাতে অভ্যস্ত হয়ে গেছি।
: ঠিক আছে, স্টিভেন তুমি আর কিছু দিন দরকার হলে ভাবো। তারপর আমাদের জানিয়ে দিলেই হবে।
: ঠিক আছে এডুইন, তাই হবে।
এরপর স্টিভেনের বোন-দুলাভাই চলে গেল সুইডেনে। আর জেনেলিয়া, স্টিভেন এবং সারার মধ্যে ক্রমাগত আলোচনা চলতে থাকলো। এমনকি আলোচনার মধ্যে আমান্ডাও আসলো। সবশেষে সারার বেস্টফ্রেন্ড রোডি আর কেভিনও আসলো। পর্যায়ক্রমে আলোচনা চলতেই থাকলো। প্রায় মাসব্যাপী। এবং ফলাফল একই। প্রত্যেকেরই অভিমত সুইডেনে চলে যাওয়াই ভালো। ওখানে স্টিভেনের জন্য রয়েছে পারমানেন্ট এবং অত্যান্ত লোভনীয় প্রস্তাব। শুধুমাত্র সারাই গাইগুই করে যাচ্ছে তার ফাবিয়ানের জন্য। কিন্তু আমান্ডা দৃঢ়ভাবে বলে চলেছে-
: প্রত্যেকের নিজস্ব একটা জীবন আছে। তোর জীবন এত দিন পর একটা গতি পেয়েছে। তুই কেন ফাবির কথা ভেবে তাকে জলাঞ্জলি দিবি? সামনে যখন যাবি, পেছনে ফিরে আর তাকাবি না। আজ তোর বাবা বেঁচে থাকলে, সেও একই কথা বলতো? বুঝলি?
: কিন্তু মা, ফাবিকে ছেড়ে আমি কিভাবে থাকবো?
: তোকে ছেড়ে আমি যেভাবে থাকবো!
: মা, ফাবিয়ান মাত্র সাতে পড়েছে- ওকি আমাকে রেখে থাকতে পারবে?
: ঠিক পারবে, তুই এসব নিয়ে ভাবিস না।
এরপর সুইডেনে যাবার ব্যাপারে প্রগ্রেস চলতে থাকলো। এডুইন সব কাগজপত্র পাঠিয়ে দিল। তার কাগজপত্রে সব কাজ দ্রুত হয়ে গেল। এডুইন এমনকি তাদের জন্য টিকিটও পাঠিয়ে দিল। শেষের এক সপ্তাহ সারা তার মায়ের বাড়ি গেল, ফাবিয়ানকে বেশি করে কাছে পাবার জন্য।
ফাবিয়ানতো খুব খুশি। মা স্যুটকেস নিয়ে চলে এসেছে-
: মাম্, তুমি একেবারে চলে এসেছো তো? ঐ আংকেলের কাছে আর যাবে নাতো?
সারা কোন জবাব দেয় না। ফাবিয়ান নিজের আনন্দেই বকবক করে যায়-
: মাম্, দ্যাখো আমি বাজাতে শিখে গেছি। মিউজিক স্কুলের টিচার খুব খুশি, দ্যাখো আমি বাজিয়ে গানও গাইতে পারি।
সারা এ বাড়িতে আসার পর এমনকি নানীর কাছে রাতে ঘুমাতেও গেল না। সারা রাত মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে থাকে। সারা গভীর চিন্তায় পড়ে গেল। কি করবে? কিভাবে ফাবিয়ানকে তার যাবার কথা বলবে? বুঝতে পারছে না। রাত-দিন বসে মা আর রোডি এবং কেভিনের সাথে শলাপরামর্শ করে। এক, একজন এক একটা বুদ্ধি দ্যায়। শেষ মেষ রোডিকা একটা বুদ্ধি বের করে। সে তার মেয়ে ডোরিনকে বলে।
: জানিস ডোরিন, তোর সারা আন্টিতো স্টিভেন আংকেলের সাথে সুইডেনে চলে যাচ্ছে।
: তাই নাকি মা, তাহলে কি ফাবিও চলে যাবে? ওর মায়ের সাথে?
: দূর বোকা, ফাবি কি তোকে ছেড়ে যেতে পারে?
: কি মজা! কি মজা, আমি এখুনি ফাবিকে বলছি।
ডোরিন দৌড়ে ফাবিয়ানকে লেকের পাড়ে ধরলো। আজকাল ফাবিয়ানের খুব মাছ ধরার শখ হয়েছে। নানী তাকে একটা ছোট্ট বর্শী বানিয়ে দিয়েছে, কিছু আটা গুলে চারাও বানিয়ে দেয়। সে স্কুল থেকে এসে ঐ বর্শী দিয়ে লেকের পাড়ে বসে থাকে, যদি একটা মাছ পাওয়া যায়? তো ডোরিন দৌড়ায় আর চিল্লাতে থাকে-
: ফাবি, ফাবি- খবর আছে।
: এ্যাই চুপ, উশ্শ- কথা বলিস না। তোর হেড়ে গলা শুনলে মাছ পালিয়ে যাবে।
: ইসরে, কি আমার জেলেরে- আজ পর্যন্ত ১টাও মাছ পেয়েছিস?
: পেয়েছি না, এই তো পরশুই একটা মাছ পেলাম না?
: ইসরে, কিনা- একটা ছোট্ট চ্যালা মাছ।
: তো কি, তুই একটা ধরে দ্যাখা না। হ্যাঁ তা কি বলছিলি, তাই বল!
: ওহ্ তাইতো, জানিস সারা আন্টি তো আগামী পরশু দিনই সুইডেন চলে যাচ্ছে। কি মজা বল? এত্ত বড় প্লেনে করে।
: কি বলছিস এসব? তোকে কে বলেছে?
: কেন মা বলেছে, সক্কলেই তো জানে। তুইতো কানা, তুই দেখতে পাস না।
ফাবিয়ান তার মাছ ধরার সব জিনিসপত্র ফেলে এক ছুটে বাড়ি। যেয়ে দেখে সারা কি সব গোছগাছ করছিল একটি বড় ব্যাগে। ফাবি তখন রীতিমত হাপাচ্ছিল উত্তেজনায়-
: মাম্, এসব কি শুনছি?
: কি শুনেছো বাবা?
: তুমি নাকি ঐ লোকটার সাথে সুইডেনে চলে যাচ্ছো?
: হ্যাঁ ফাবি, আমাদের যেতে হবে। তবে তুমি যেতে চাইলে অবশ্যই যেতে পারো।
: না, আমি কোথাও যাবো না। তুমিও যাবে না।
: ফাবি, এদিকে এসো বাবা। শোন আমার কথা শোন, সারা ফাবিয়ানকে দু’হাতে জড়িয়ে ধরে অজস্র চুমো দ্যায়। তারপর কাঁদো কাঁদো স্বরে তাকে বোঝাবার আপ্রাণ চেষ্টা করে-
: ফাবিয়ান, দ্যাখো আমার আর কোন উপায় নাই। দ্যাখো তোমার বাবা আমাদের ফেলে চলে গেছে ৬ বছরেরও উপর। কিন্তু আমি এতদিন ধরে শুধু তোমার মুখ চেয়ে কাউকে ভালোবাসিনি। বিয়ে করিনি। কিন্তু এখন তোমার নানীও চাইছে আমার জীবনের একটা সেটেলমেন্ট। এখন স্টিভেন আমার স্বামী। আমার তো তার কথা শুনতে হবে বাবা।
: নাহ, তুমি যাবে না- কোথাও যাবে না। ফাবি অকস্মাৎ চিৎকার করে কেঁদে এক ছুটে বাইরে চলে যায়। (চলবে)

লেখক রীনা গুলশান বাংলা সাহিত্যে মাস্টার্স। ইতিপূর্বে বাংলাদেশের বিভিন্ন দৈনিক, সাপ্তাহিক এবং মাসিকে তার কবিতা, ছোটগল্প, প্রবন্ধ, রম্য রচনা প্রকাশিত হয়েছে। প্রকাশিত হয়েছে কানাডার বিভিন্ন বাংলা পত্রিকাতেও। তিনি ‘প্রবাসী কণ্ঠ’ ম্যাগাজিন এর একজন নিয়মিত কলামিস্ট।