সুফিবাদ ও বাংলাদেশ

অধ্যাপক ড. মো. গোলাম দস্তগীর

পর্ব – ৫

ইসলামের সর্বজনিন সমন্বয়কারী সংস্কৃতি মুসলিম সমাজের ভাবমূর্তিকে সুদৃঢ় করার কথা। বিশ্বনেতৃত্বে মুসলমানদেরই অগ্রণী ভূমিকা পালন করার কথা। ইসলাম আট শতাব্দিব্যাপী মানবসমাজের নেতৃত্ব দিয়েছিল, অথচ আজ মুসলমানরাই সবচেয়ে অবহেলিত জাতি। দিনে দিনে তাঁরা কোণঠাসা হয়ে পড়ছে। মুসলমানদের অনগ্রসরতার জন্য প্রথমেই দায়ী করা হয় অমুসলিমদের। কিন্তু মুসলমানরা কি কম দায়ী? প্রত্যেক সম্প্রদায়ের প্রথম শত্রু সেই সম্প্রদায়। যে কোন ব্যবস্থাপনার দিকে তাকালে আমরা দেখব যে, একটি দলের বা সংগঠনের শত্রুর সূত্রপাত হয় তার নিজের দলের বা সংগঠন থেকেই। মুসলমানদের প্রথম এবং প্রধান শত্রু মুসলমান, তারপর অন্যরা। সুফিদের যারা বিরোধিতা করেন, তারা আর কেউ নন, মৌলবাদী মুসলমান। একইভাবে ইহুদী, খ্রীষ্টান বা বৌদ্ধদের ঘরের শত্রুই তাদের প্রথম শত্রু। কথায় বলে ‘ঘর শত্রু বিভীষণ’। ব্যক্তি মানুষের বেলায়ও ঠিক তাই। আমার শত্রু আমি নিজেই, আমার নফ্স (অহং), যা আমাকে পাপের পঙ্কিল জগতের দিকে অহরহ ঠেলে দেয়। প্রত্যেকের নফ্স বা কু-প্রবৃত্তিই তার প্রধান শত্রু। রাসূলুল্ল­াহ (সা.) বলেছেন, ‘তোমার নফ্স তোমার শত্রুর চেয়েও ভয়ংকর, কেননা সে তোমার মধ্যে গোপনে রয়েছে।’ বাইরের শত্রুকে চেনা সহজ, কিন্তু নিজের মধ্যে লুক্কায়িত, গোপন শত্রুকে চেনা কঠিন। মানুষের জন্মগত স্বভাবই হলো নিজের দোষ অন্যের ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়া। আমরা আজ নিজেদের সমস্যার জন্য অন্যের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করি। মুসলমানদের তুলনামূলক অনগ্রসরতার জন্য যতটা না বাহ্যিক চাপ ও প্রভাব দায়ী তার চেয়েও বেশী দায়ী মুসলমানরা নিজেরাই। মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে ঐক্য ও পারস্পরিক সহযোগিতার অভাব, ধনী মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর অঢেল সম্পত্তির অপব্যবহার, ইসলামি নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয়, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অপ্রতুল ব্যবহার, গণতন্ত্রের পরিবর্তে কিছু মুসলিম রাষ্ট্রের স্বৈরতান্ত্রিক, রাজতান্ত্রিক ও সামন্তবাদী শাসন, ওহাবীবাদের  বিস্তারলাভ এবং সর্বোপরী উগ্র মৌলবাদী জঙ্গিগোষ্ঠির উত্থান মুসলিম জগতের উন্নয়নের প্রধান অন্তরায়। অসংখ্য মুসলিমপ্রধান দেশের অগণিত জনগণ অনাহারে, অর্ধাহারে ধুকে ধুকে মরছে, আর ঐশর্য্যমন্ডিত মুসলিম রাষ্ট্রগুলো মৌলবাদী সংগঠনগুলোকে অর্থ যুগিয়ে চলেছে যাতে তারা জিহাদ করে, বোমা মেরে মানুষ হত্যা করে, প্রগতিশীল শক্তিকে পরাজিত করে ইসলামি শাসন কায়েম করতে পারে, যেখানে তাদের প্রভূত্ব স্থান পাবে এবং রাজতান্ত্রিক শাসন স্থায়ী হবে। পাশ্চাত্যে ইসলামি সভ্যতার যারা বিরোধিতা করেন তারা মুসলিম রাষ্ট্রগুলোতে দুটো অপশক্তির লালন পালন দেখতে পছন্দ করেন। এর একটি হলো ইসলামি মৌলবাদ আর অপরটি হলো স্বৈরতান্ত্রিক সামরিক শাসন। এই দুই শক্তির তান্ডবে মুসলমানরা একে অন্যকে মারছে আর মরছে। অন্যরা চেয়ে চেয়ে দেখছে, কখনোবা কারও হাতে অস্ত্র তুলে দিচ্ছে, কখনোবা কারও অস্ত্রে শান দিয়ে দিচ্ছে।  মুসলমানদের আজ উপলব্ধি করার সময় এসেছে পাক কুরআনের অমর বাণী: “নিশ্চয়ই মানুষ ক্ষতির মধ্যে আছে, অবশ্য যাঁরা ঈমান এনেছে ও ভাল কাজ করে তাঁরা ব্যতিরেকে…” [সূরা আছর (১০৩):২-৩]।

গত কয়েক বছরে দক্ষিণ এশিয়ায় ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলের ছত্রছায়ায় উগ্র মৌলবাদের অভূতপুর্ব উত্থানের ফলে ইসলামি জঙ্গিবাদের বিধ্বংসী থাবা জাতির ঈর্ষণীয় অর্জন এবং ঐতিহ্যকে হুমকির মুখে ঢেলে দিয়েছে। এর ধাক্কা দেশের সর্বসাধারণের স্বীকৃত পবিত্র সুফি খানকাসমূহের ওপর পড়েছে। ইসলামের বিকৃত ব্যাখ্যায় পুষ্ট উগ্র মৌলবাদী ধর্মান্ধ জঙ্গিগোষ্ঠী অবলিলায় সুফিসাধকের ধর্ম প্রচারের কেন্দ্রগুলোতে আক্রমণ করেছে বোমা মেরে, গ্রেনেড নিক্ষেপ করে, মানুষ হত্যা করে। একদিকে শিয়া-সুন্নিরা একে অন্যকে মারছে ও মরছে; অন্যদিকে মওদুদী, ওহাবীপন্থি ও জঙ্গী-মৌলবাদীরা আহমদিয়া, সুফি ও অন্যান্য মতাবলম্বীদের ধর্মীয় স্থাপনাসমূহে সশস্ত্র আক্রমণ করছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, ‘যা আমার ভালো লাগে না, তা অন্যের ভালো লাগে, এই নিয়েই পৃথিবীতে যত রক্তপাত।’ আজ ধর্ম-বিশ্বাসীদের মধ্যেও এ কথার প্রতিফলন পাওয়া যায়। কতিপয় ‘মুখোশধারী ধর্ম-বিশ্বাসী’  আজ ব্যক্তিগত, দলগত বা অন্য কোন স্বার্থে ধর্ম-ব্যবসায়ীতে পরিণত হয়েছেন। এ কথা অস্বীকার করা যায় না যে, কতিপয় ভন্ড সাধু নিজেদেরকে ‘নকল পীর’ সাজিয়ে ধর্মপ্রাণ সহজ-সরল মানুষকে ধোকা দেয়। এ এক ধরণের অসাধু লোকের প্রতারণা। তবে এ কথাও সত্য যে, কোন কোন স্থানে অতি ভক্তির আতিশয্যে কিছু অসামাজিক এবং অগ্রহণযোগ্য কর্মকান্ড আমাদেরকে ব্যথিত করে। কিন্তু তা সুফি ক্রিয়াকর্মের তথা ইসলামের অন্তর্ভূক্ত নয়। কতিপয় ভন্ড এবং বিকৃত মানসিকতার ধর্ম-ব্যবসায়ীর আচরণ সুফিসমাজের সঠিক পরিচয় বহন করে না। অন্যের ধর্ম-মত সম্পর্কে আমাদের সঠিক জ্ঞানের অভাবেই আমরা নিজেদের মতকে চূড়ান্ত সত্য আর অন্যকে অবজ্ঞা করি। এটার দু’টো দিক আছেÑ অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক। মুসলমানদের মধ্যে এক মযহাবের অন্য মযহাব সম্পর্কে জ্ঞানের অভাব; আবার অ-মুসলিমদের ইসলাম সম্পর্কে অজ্ঞতা, একইভাবে অন্য ধর্ম সম্পর্কে মুসলিমদের জ্ঞানের অপূর্ণতা। এমনকি মানুষ তার নিজের ধর্মটাই সঠিকভাবে জানতে অপারগ। তাই সর্বাগ্রে আমাদের প্রয়োজন নিজেকে জানা এবং অন্যেকে বুঝা। অর্থাৎ আত্মিক জ্ঞানের উন্মেষ ঘটানো।

সুফি পেইন্টিং । এঁকেছেন মুাহাম্মদ সুলেমান রেহমান (সাচ্চি আর্ট)

পৃথিবীতে শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করতে হলে আট শত কোটি মানুষকে একসঙ্গে সহ-অবস্থান করতে হবে। সর্বাগ্রে প্রায় এক শত পঞ্চাশ কোটি মুসলমানকে তাত্ত্বিক ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। কে কোন্ মযহাবের এ পরিচয়ে নয়, ‘সবাই এক আল্ল­াহর সৃষ্ট মানুষ’ এই পরিচয়ে মুসলিম ভ্রাতৃত্বকে সুদৃঢ় করতে হবে। তা না হলে, প্রত্যেকেরই পরিণতি হবে নিম্নের এই রূপক গল্পের মতো।

এক ইদুর একদিন দেওয়ালের ফুটো দিয়ে দেখল গৃহকর্তা ও গৃহকর্ত্রী দুজনে মিলে ঘরের এককোণায় একটা নতুন বাক্স খুলে চকচকে কী-যেন একটা জিনিষ বের করছে। নিশ্চয়ই কোন মজাদার খাবার হবে! ইদুরের চোখ জ্বল জ্বল করে উঠল, মুখে পানি এসে গেল। কিন্তু পরক্ষণেই তার ভুল ভাঙল। এ যে ইদুর-মারা কল। ভয়ে ইদুরের বুক ঠান্ডা হয়ে গেল। এক দৌড়ে বাড়ির মোরগটার কাছে গেল। বলল, “আমার বড় বিপদ। ঘরে ইদুর-মারা কল বসেছে।” মোরগ ইদুরের কথা শোনার পর বলল, “কিন্তু আমি কী করব? ইদুর-মারা যন্ত্র তো ইদুর মারার জন্য, মোরগ মারার জন্য নয়। আমিতো মোরগ। আমাকে গৃহকর্ত্রী মারবে না।” ইদুর হতাশ হয়ে এবার ছুটে গেল ছাগলের কাছে। হাঁফাতে হাঁফাতে ইদুর বলল, “আমাকে সাহায্য কর। আমার বড় বিপদ। ঘরে ইদুর-মারা কল বসানো হয়েছে।” ছাগল দাড়ি নেড়ে নেড়ে বলল, “শোন, কথায় বলে ‘পাগলে কি-না বলে আর ছাগলে কি-না খায়’। কথাটা কিন্তু ঠিক নয়, কারণ আমি কি মাছ-মাংস খাই? আমিতো নিরামিষভোজী। যাহোক, আমি যা-ই খাই না কেন, আমি কিন্তু সত্য কথা বলি। তোমার বিপদ একান্তই তোমার। এতে আমি নিজের কোন বিপদ দেখছি না। আমি দুঃখিত, তোমার বিপদে আমার কিচ্ছু করার নেই।” এবার শেষ অবলম্বন হিসেবে ইদুর দৌড়াতে দৌড়াতে বলদ গরুটার কাছে গেল। আকুতি মিনতি করে তার বিপদের কথা বলে সাহায্য চাইল। ইদুরের কথা শেষ হবার আগেই বলদ বড় বড় দাঁত বের করে হেসে উঠল। বলল, “তুমি কি এই ভরা সন্ধ্যেবেলা আমার সাথে মশকরা করো নাকি, মিয়া? ইদুর-ধরা যন্ত্র কি গরুর কোন ক্ষতি করতে পারে? যাও মিয়া, আমার জাবর কাটার সময় নষ্ঠ করো না।” গরুর ধমক খেয়ে ইদুর তার গর্তের মধ্যে গিয়ে ঢুকল। সে-রাতে এক বিষাক্ত সাপ বের হলো ইদুর ধরার জন্য। ইদুরের গর্তের দিকে যেতে গিয়ে তার লেজ আটকে গেল ইদুর-মারা কলে। ঝটপট শব্দে গৃহকর্ত্রীর ঘুম ভেঙে গেল। ভাবল, নিশ্চয় কোন ইদুর যন্ত্রে আটকে পড়েছে। অন্ধকারে যেতে গিয়ে সাপের মুখের কাছে পা পড়ল, আর সে সুযোগে সাপ ছোবল দিল গৃহকর্ত্রীর পায়ে।

গুরুতর অসুস্থ্য গৃহকর্ত্রীকে হাসপাতালে ভর্তি করা হলো। ডাক্তার রোগীর জন্য ওষুধের পাশাপাশি ভালো পথ্য খাওয়ার ব্যবস্থাপত্র দিলেন। গরীব গৃহকর্তা বাড়ির মোরগটাকে জবাই করে স্যূপ করে খেতে দিলেন তার স্ত্রীকে। অসুখ ভালো হয় না। আরও টাকার দরকার। নিরুপায় হয়ে একদিন তিনি ছাগলটাকে বেঁচে দিলেন। কিন্তু দিনের পর দিন রোগীর অবস্থা আরও খারাপ হতে লাগল। ধার-দেনা বাড়তে লাগল। কিন্তু অবশেষে গৃহকর্ত্রী মারা গেলেন। ধার-দেনা শোধ, দাফন-কাফন আর  কুলখানির খরচ সংকুলানের জন্য গরুটাকে বিক্রি করা ছাড়া গৃহকর্তার আর কোন উপায় থাকল না। এই হলো আমাদের স্বভাব। অন্যের বিপদ কি একান্তই অপরের? পারস্পরিক সহযোগিতা ব্যতিরেকে কি সমাজজীবনে কেউ বাঁচতে পারে? হয়ত পারে, কিন্তু তাকে কি বাঁচা বলে? বর্তমান বিশ্বের প্রেক্ষাপটে আজ মুসলমানদের আচরণেই প্রমাণ করার সময় এসেছে তারা কুরআনে বর্ণিত উন্নত জাতি।

———-

অসংখ্য পূণ্যাত্মার আবির্ভাব-আলোকে উজ্জ্বল হয়ে আছে আবহমান বাংলার আকাশ-বাতাস। ধর্মীয় আচার ও আধ্যাত্মিকতা বাংলার সংস্কৃতি তথা মাটি মানুষের সাথে ওতপ্রতভাবে জড়িত। অসাম্প্রদায়িকতা, ধর্মীয় পবিত্রতা, নৈতিকতা, সরল-সুন্দর জীবন অনাদিকাল ধরে গর্বিত করে রেখেছে গঙ্গা-অববাহিকার এই শ্যামল-সুন্দর সমভূমিকে। মানুষের এমন সুন্দর সহ-অবস্থান বিশ্বে বিরল।

মানব জীবন ও সমাজে এই সব মনীষীদের আদর্শিক প্রভাব ছিল অপরিসীম। দুঃস্থ্য মানবতাকে তাঁরা দিয়েছেন এক জ্যোতির্লোকের সন্ধান। তাঁদের সংস্পর্শেই সমুন্নত হয়েছে নিগৃহীত মানবতা। বৈশাখী ঝড়ের মত উড়ে গেছে মেকি আভিজাত্যের বেড়াজাল, ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে নিস্পেষণ লাঞ্ছনার কৃষ্ণকাল। উদিত হয়েছে সভ্যতার নবদিগন্তে মুক্ত-মানবতার জয় নিশান!

যুগের প্রয়োজনে, বাংলার গগনে এমনই একজন ক্ষণজন্মা সাধু-পুরুষ হলেন শাহসুফি হযরত খাজা মুহাম্মদ ইউনুছ আলী এনায়েতপুরী (র.)। তিনি বাংলাদেশের সিরাজগঞ্জ জেলার এনায়েতপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন ১৩০৩ হিজরীর ১১ই জিলহজ্জ তারিখ (৭ই নভেম্বর ১৮৮৬ ইং, ২১শে কার্তিক ১২৯৩ বাং) শনিবার সুবে সাদেকের সময়।

এই মহা-মনীষীকে কেন্দ্র করেই উপমহাদেশের এতদঞ্চলে সংঘটিত হয়ে যায় আধ্যাত্মিকতার এক নীরব বিপ্ল­ব। বাংলার সমতট অতিক্রম করে সুদুর ত্রিপুরা, আসাম ও ভূটানের পাহাড়ী অঞ্চলে বিস্তৃত হয়ে পড়ে এই সাধকের আধ্যাত্মিক প্রভাবের আদর্শিক বলয়। মন্ত্রমুগ্ধ মানব সন্তান তাঁর নিবিড় সান্নিধ্যে ছুটে আসে দলে দলে, পালে পালে, ঝাঁকে ঝাঁকে। অসংখ্য-অগনিত ভক্ত অনুরক্ত হয়ে পড়ে তাঁর আত্মিক আকর্ষণের মায়া-ডোরে। মানবতাকে মুক্ত করতে এসে তিনি সবার অলক্ষে মানবতাকেই আবদ্ধ করে ফেলেন ভালবাসার কারা প্রাকারে!

তাই আজ আমরা দেখি সংখ্যাতীত মানব সন্তান তাঁরই আদর্শের স্নেহে আশ্রিত হয়ে আছে সকল বাধা ছিন্ন করে, সারা জীবনের তরে। আটরশি, চন্দ্রপাড়া, প্যারাডাইজপাড়া, শম্ভুগঞ্জসহ বাংলা-আসামের দিগন্তে-প্রান্তে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এই সাধকের আদর্শøাত প্রতিনিধিদের খানকা, প্রচারিত হচ্ছে মানবতা তথা ইসলামের সত্য-সুন্দর অমীয় দর্শনের হৃদয়স্পর্শি বন্দনা। হযরত এনায়েতপুরী (র.) ছিলেন ইতিহাসের ওপর বয়ে যাওয়া মারেফাতের ফুল-ফুটানো, প্রকৃতির প্রাণ জুড়ানো, আদর্শের সুবাস ছড়ানো স্বর্গের এক নির্মল হাওয়া।

হযরত খাজা এনায়েতপুরীকে ঘিরে এ দেশের এক বিশাল সংখ্যক লোকের রয়েছে অন্তর নিঃসৃত স্বতর্স্ফূত, শর্তহীন, স্বার্থহীন ভালবাসা, হৃদয়মথিত সীমাহীন গভীর শ্রদ্ধা। এ ভালবাসা কোন জাগতিক সংজ্ঞার ভালবাসা নয়। এ হচ্ছে ঐশ্বরিক প্রেমের অবছায়া। এনায়েতপুরী (র.) মানুষকে ভালবাসতে গিয়ে মানুষকেই আবদ্ধ করেছেন ভালবাসার ঋণে। “আল্ল­াহকে ভালবাসতে হলে আগে মানুষকে ভালবাস” – হযরত মুহাম্মদ (সা.) এই সার্বজনিন অমীয় বাণীর বাস্তব প্রতিফলন আমরা দেখতে পাই সিদ্ধসাধক এনায়েতপুরী (র.) এর আজীবনের ধ্যান ধারণায় ও তাঁর সাধ্য সাধনায়।

বংশ পরিচয়

হযরত এনায়েতপুরীর পূর্ব-পুরুষ এতদঞ্চলে ইসলাম প্রচারের মূখ্য উদ্দেশ্য নিয়ে আগমন করেছিলেন সুদূর অতীতে। তাঁর পূর্ব-পুরুষদের মধ্যে যে কয়েকজনের পরিচয় পাওয়া যায় তাঁরা হলেন শাহ্ দায়েম, শাহ্ বাহার, শাহ্ কবির এবং শাহ্ করিম। শাহ্ করিম ছিলেন এনায়েতপুরীর পিতা। এনায়েতপুরীর মাতা ছিলেন তাহ্মিনা বেগম। তাঁরা ছিলেন বিদ্যানুরাগী। শাহ্ আব্দুল করিম কলিকাতার বিখ্যাত মহ্ছিনা মাদ্রাসার শিক্ষক ছিলেন। পরবর্তিতে তিনি স্বীয় গ্রামে পূর্ব পুরুষের প্রতিষ্ঠিত বিখ্যাত মাদ্রাসার সংস্কার করে শিক্ষা সম্প্রসারণের সুদূর প্রসারী পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। মাতা তাহ্মিনা পরম স্নেহে গ্রামের অনাথ মেয়েদের দেন আরবি-ফার্সি শিক্ষা। তাই এনায়েতপুরীর পারিবারিক পরিবেশ ছিল অত্র এলাকার জন্য শিক্ষা সম্প্রসারণের সুতিকাগৃহ। এরই ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতায় এনায়েতপুর গ্রাম আজ শিক্ষা-সাহিত্য, শিল্প-স্বপ্ন, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও আধ্যাত্মিক আদর্শ নিয়ে বাংলাদেশের এক ঈর্ষণীয় স্থানে অবস্থিত।

ইসলাম প্রচার

খাজা এনায়েতপুরীর ইসলাম প্রচারকাল ছিল বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। তাঁর সময়ে পাশ্চাত্যে রেনেসাঁ বিভ্রান্তিকর নাস্তিকতাবাদের উত্থান, যান্ত্রিক জড়বাদের অভূতপূর্ব উন্নয়ন, বিস্ময়কর বৈজ্ঞানিক আবিস্কার, ইউরোপে শিল্পবিপ্ল­ব, উপমহাদেশে বৃটিশ বিরোধী আন্দোলন, প্রলয়ংকারী মন্বন্তর এবং সর্বোপরি পৃথিবীব্যাপী মানবতাবিরোধী অর্থহীন ধ্বংসাযজ্ঞের বিশ্বযুদ্ধ প্রভৃতি যুগান্তকারী ঘটনাপ্রবাহ যুগোপৎভাবে মানুষের চিন্তার জগতে নিয়ে আসে এক পরিবর্তনের ভূমিকম্প। পুরানো সংস্কার, সনাতন মতবাদ ও প্রচলিত ধ্যান-ধারণা প্রভৃতি বিলুপ্ত হতে থাকে এর উত্তাল আক্রোশে। জীবনের অত্যাবশ্যকীয় ধর্মীয় ও নৈতিক আচার-বিশ্বাস ক্ষতিগ্রস্থ হতে থাকে একইভাবে। সময়ের এমনই এক ক্রান্তিলগ্নে উপমহাদেশের এতদঞ্চলের অসহায় মানুষের মাঝে হযরত এনায়েতপুরী (র.) আবির্ভূত হয়েছিলেন আল্ল­াহপাকের আশির্বাদভরা বিস্ময় নিয়ে। আধ্যাত্মিকতায় তিনি ছিলেন প্রবাদতূল্য, নৈতিকতায় স্বর্গীয় আদর্শে অনুকরণীয়, ব্যবহারে কোমল কমনীয়, কর্তব্যপরায়নতায় বজ্রনিষ্ঠ এবং জনপ্রিয়তায় মধ্যাহ্ন সূর্যের ন্যায় নিরপেক্ষ ও শীর্ষস্থানীয়।

ঈমান এবং অস্তিত্ব হারানোর এমনই এক সর্বনাশা মুহূর্তে সর্বশক্তিমান আল্ল­াহর কুদরতি শক্তির ওপর তাওয়াক্কুল (ভরসা) করে বিশ্ববাসীকে ভ্রান্ত-ধারণা ঝেড়ে ফেলে পরিপূর্ণ জীবনবিধান ইসলামের পতাকা তলে সমবেত হওয়ার জন্য তিনি উদাত্ত আহবান জানান। আল্ল­াহ ও রাসূলের অমরবাণী মানব কল্যাণে মানুষের নিকট পৌঁছে দিতে মাত্র ১৭ জন সঙ্গী নিয়ে হযরত এনায়েতপুরী (র.) বেরিয়ে পড়েন উপমহাদেশের পূর্বাঞ্চলে এমনই এক হতাশাব্যাঞ্জক তমাশাচ্ছন্ন মুহূর্তে। তাঁর এই ঐতিহাসিক অভিযান ছিল এক মহা বিজয়ের সূচনালগ্ন এবং মহৎ ঘটনার মাইলফলক। এ যাত্রাপথে তিনি পরিভ্রমণ করেন বৃহত্তর ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল, বৃহত্তর কুমিল্ল­াসহ ত্রিপুরা এবং গিরি-অরণ্য অধ্যুষিত আসাম রাজ্যের বিস্তীর্ণ এলাকা। মানুষের ঘরে ঘরে পৌঁছে দেন কালেমা তাইয়্যাবা’র জ্যোতির্ময় সওগাদ। ‘আল্ল­াহর প্রতি নিঃশর্ত, অকৃত্রিম বিশ্বাস, হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর প্রতি প্রাণ-নিঙড়ানো ভালবাসা, যিক্রে ক্বলবের অনুশীলন, অল্পাহার ও অল্পনিদ্রা’ Ñ এই  হলো হযরত এনায়েতপুরীর (র.) দর্শনের মূলধারা। আল্ল­াহর যিক্রে তিনি জিন্দা করেন লক্ষ লক্ষ মুরিদের মৃত-প্রায় ক্বল্বকে। মুরিদরা পরিচিত হয় ‘যাকের’ নামে।

মাযার শরীফ

হযরত খাজা এনায়েতপুরীর মাযার শরীফের জন্য এই গ্রাম আজ উপমহাদেশের এক অন্যতম শ্রেষ্ট আধ্যাত্মিক কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। বাৎসরিক উরস শরীফ সমগ্র এলাকাকে এক অকল্পনীয় অতিজাগতিক আকর্ষণীয় স্থানে রূপান্তরিত করেছে।

সিরাজগঞ্জের নিভৃতে প্রবাহমান যমুনার পশ্চিম তীরে, অগণিত আব্দাল, আবেদ, আশেকানের জমাট অশ্রুর মর্মরে নির্মিত খাজা এনায়েতপুরীর মাযার শরীফ অবস্থিত। এটি আজ বাংলাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ জিয়ারত স্থানে পরিণত হয়েছে। যুগ যুগ ধরে ভাগ্যহত-ভাগ্যবান, নিঃস্ব, দরিদ্র, চিত্তবান, বিত্তহীন-বিত্তবান মানুষ কামনা করেছেন এই পূণ্যাত্মার নৈকট্য, আল্ল­াহর অলীর মাযার সমীপে হতে চেয়েছেন সমাধিস্থ, জীবনান্তে কামনা করেছেন অলী-আল্ল­াহর পাকমজলিসের সান্নিধ্য।

তরিকা/বয়াত প্রথা

পবিত্র কুরআনপাকে আল্ল­াহ বলেছেন, “[হে মোহাম্মদ] তোমার হাতে যাহারা বাইয়াত হইল, তাহারা আমার হাতেই বাইয়াত হইল এবং আমার কুদরতি হাত তাহাদের হাতের উপর রইল। অতঃপর যে বাইয়াতের অঙ্গীকার রক্ষা করিল, সে লাভবান হইল এবং যে উহা ভঙ্গ করিল, সে নিজেই ক্ষতিগ্রস্থ হইল” [সূরা ফাৎহ (৪৮):১০]।

এই আয়াতের ভিত্তিতেই ইসলামজাহানে বাইয়াত তথা মুরিদ প্রথার সূত্রপাত হয়েছে। বহু তরিকার মধ্যে নক্শেবন্দিয়া-মুজাদ্দেদিয়া তরিকাই সমধিক প্রসিদ্ধ লাভ করেছে। এই তরিকা যেন একটি সোনার শিকল। হযরত মুহাম্মদ (সা.) হতে এনায়েতপুরী পর্যন্ত ৩৪ জন আধ্যাত্মিক ব্যক্তির সমন্বয়ে এই তরিকার অবকাঠামো গঠিত। অন্য তরিকার  বুযুর্গগণ সাধনার শেষে যা প্রাপ্ত হন এই তরিকার সাধকগণ প্রথমেই তা অর্জন করে থাকেন। অসংখ্য বুযুর্গের সমাহারে এই তরিকা ধন্য। বাহাউদ্দিন নকশেবন্দ (র.) [সমরকান্দ, রাশিয়া], ইমাম গাযালী (খোরাশান, ইরান), মুজাদ্দেদ-ই-আলফে-সানী (র.) [পূর্ব পাঞ্জাব, ভারত], সুফি ফতেহ আলী (র.) ও শাহ সুফি সৈয়দ ওয়াজেদ আলী (র.)  [কোলকাতা, ভারত], হযরত খাজা এনায়েতপুরী (র.) প্রমুখ এই তরিকার গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব। অনেকেই বিশ্বাস করেন যে, এই তরিকার স্বর্ণোজ্জ্বল রাজপথ ধরেই আসবেন সর্ব ধর্মের প্রতিশ্রুত সর্বশেষ মহাপুরুষ হজরত ইমাম মেহ্দেী (আ.)। তাঁর হাতেই বিশ্বের সমস্ত মানুষ প্রথম বারের মত ইসলামের আদর্শে একদল ভুক্ত হবে। হযরত ইসা (আ.) এই সিলসিলার মাধ্যমেই দাখিল হবেন পবিত্র ইসলামে। বিশ্বের বুকে নেমে আসবে বহু কাঙ্খিত সেই অনাবিল শান্তি, সুস্থির হবে ঝঞ্ঝা-বিক্ষুদ্ধ, ক্ষত-বিক্ষত, প্রাণ ওষ্ঠাগত ক্লান্ত ধরণী।

রূহে-সওয়াব রেছানী বা বিদেহী আত্মার জন্য দো’আ কামনা

হাদিস মতে, মানুষ মরে গেলে তার ভাল এবং খারাপ সব রকম আমল বন্ধ হয়ে যায়। তখন যদি পৃথিবীবাসী কেউ তাঁর জন্য আল্ল­াহর নিকট ক্ষমা প্রার্থণা করে এবং তার জন্য সওয়াব পাঠায় সেটা তাঁর নিকট পৌঁছে যায়। তাঁর নিকট ইহা তখন সমস্ত পৃথিবীতে সঞ্চিত সম্পদের চেয়েও অধিক উপকারী হয়। তাই এই দরবার শরীফের উরস মাহফিল তথা সারা বৎসরই পরলোকগত সমস্ত মুসলমানের জন্য রুহে ছোয়াব পৌঁছানোর এক অনুপম বিধানমালা চালু আছে। সমস্ত নবী, অলী এবং মুসলমানের পবিত্র বিদেহী আত্মার ওপর দো’আ পৌঁছানোর এক স্বর্গীয় মাহফিল এই পবিত্র উরস শরীফ, যা হিজরী সন অনুসারে প্রতি বছর জানুয়ারী-ফেব্রুয়ারি মাসে তিন দিনব্যাপী (শুক্র – রবি) অনুষ্ঠিত হয়।

আল্ল­াহু আকবার লেখা, চাঁদতারা আঁকা, পাক-ইসলামের প্রতীক পতাকা উত্তোলন করা হয় শুক্রবার বাদ জুম্মা। ইসলামের এই বিজয় পতাকা উড়তে থাকে নব-নীলিমায় এক স্বগীয় আবেশে, দিগন্ত বিস্তৃত মুক্ত আকাশে, মিথ্যার বিরুদ্ধে সত্যের জয়, জালেমের বিরুদ্ধে মজলুমের জয়, ঘোষিত হতে থাকে যুগ থেকে যুগান্তরে, দেশ থেকে দেশান্তরে, যাকের-আশেকানদের অন্তরে অন্তরে।

অধ্যাপক ড. মো. গোলাম দস্তগীর

টরন্টো

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *