কানাডায় অভিবাসীরা কাজ পেতে পারেন কিন্তু ওপরে ওঠার সিঁড়ি খুঁজে পাওয়া ভিন্ন ব্যাপার

টরন্টোর জনসংখ্যার ৫০ শতাংশই অভিবাসী হলেও বেসরকারি, সরকারি এবং অলাভজনক খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোতে নেতৃস্থানীয় পদে তাদের সংখ্যা মাত্র ছয় শতাংশ

প্রবাসী কণ্ঠ ডেস্ক : লেবাননের একটি ছোট্ট শহরে শৈশব শুরু করে রোলা ডেঘার যেভাবে সিসকো কানাডার প্রেসিডেন্টের পদে উঠে এসেছেন সেটি যেন হোরাশিও অ্যালগের-এর উপন্যাসের কাহিনী।

লেবাননের গৃহযুদ্ধ থেকে গাড়ির ট্রাঙ্কে (মালপত্র রাখার জায়গা) চড়ে পালিয়ে আসেন সেদিনের টিনএজ মেয়ে রোলা ডেঘার। নিজের শিশু মেয়ে স্টেফানিকে সঙ্গে নিয়ে মাত্র ১৭ বছর বয়সে তিনি কানাডায় আসেন।

কানাডায় এসে ক্রমশ উপরের দিকে ওঠার জন্য তিনি টেলিমারকেটারের খুচরা বিক্রির কার্যক্রমে কেরাণীর কাজ থেকে শুরু করে ডেল-এর উচ্চতর করিৎকর্মা বিক্রয় নির্বাহী হিসাবে কাজ করেছেন। এর পরেই টেক জায়ান্ট সিসকো তাদের কানাডা বিভাগের প্রধান হিসাবে যোগ দেয়ার জন্য তাকে প্রস্তাব দেয়।

সেরা বহুজাতিক নগরী হিসাবে সারা বিশ্বে টরন্টোর সুখ্যাতি থাকলেও এখানেই কোনও অভিবাসী যখন তার কর্মক্ষেত্রের শীর্ষ পদের জন্য প্রার্থী হন তখন তিনি তার পথের সামনে একটি স্বচ্ছ কাচের দেয়ালের বাধা দেখতে পান। কোলাজ ছবি : ক্যানমেনওয়াকার /ডুগাল ওয়াটার্স-গেটিইমেজ

বছর কয়েক আগে হাফপোস্ট কানাডার প্রতিবেদক ডেনিয়েল টেনসারকে  টেলিফোনে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে ডেঘার বলেন, “তারা যখন আমাকে প্রেসিডেন্টের ভূমিকা নেবার প্রস্তাব দেয়, তখন মনে করেছিলাম তারা বোধ হয় ভুল লোককে ফোন করেছে। কিন্তু তারা বললো, ‘না না, আমরা আপনার কর্মজীবন সম্পর্কে জেনেছি।’ এটা ছিলো আমার জন্য এক বিস্ময়কর ও অভিভূত হবার মুহূর্ত।” 

হাফপোস্ট সেই সময় তাদের প্রতিবেদনে উল্লেখ করে- লেঘারের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার অভাব রয়েছে, তবে তিনি নিজের সম্পর্কে বলেন, আমার “জীবনের ওপর মাস্টার্স” করা আছে। এক দশক আগে তিনি ক্যান্সারের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন এবং তিনি চ্যালেঞ্জ জয়ের সত্যিকারের অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন।

কিন্তু সেটাই হচ্ছে সমস্যা। লেঘারের কাহিনী অভিনব। সাফল্য অর্জনের জন্য তাকে অভিবাসীদের জন্য বিদ্যমান হাজারও বাঁধা-বিপত্তি কাটিয়ে উঠতে হয়েছে। বিশেষ করে নারী ও জাতিগত পরিচয়ের অভিবাসীদের জন্য কানাডার ব্যবসায়িক জগৎ, সরকার ও অলাভজনক প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ পর্যায়ে যে বিরূপ পরিস্থিতি বিদ্যমান রয়েছে সেগুলোকে পরাস্ত করতে হয়েছে লেঘারকে।

হাফপোস্ট সেই সময় আরো জানায়, ইতিপূর্বে প্রকাশিত টরন্টোর আঞ্চলিক অভিবাসী কর্মসংস্থান কাউন্সিলের (TRIEC) এক রিপোর্ট অনুযায়ী, সেরা বহুজাতিক নগরী হিসাবে সারা বিশ্বে টরন্টোর সুখ্যাতি থাকলেও এখানেই কোনও অভিবাসী যখন তার কর্মক্ষেত্রের শীর্ষ পদের জন্য প্রার্থী হন তখন তিনি তার পথের সামনে একটি স্বচ্ছ কাচের দেয়ালের বাধা দেখতে পান।

সার্বিকভাবে চাকরিপ্রার্থী অভিবাসীদের জন্য পরিস্থিতি দৃশ্যত বেশ ভালোÑ তাদের মধ্যে বেকারত্বের হার রেকর্ড পরিমাণ কম, সারাদেশেও একই অবস্থাÑ কিন্তু মই বেয়ে উপরের দিকে উঠে এলেই দরোজার সামনে দেখবেন ভিন্ন কাহিনী।

ইতিপূর্বে সমীক্ষায় দেখা গেছে, টরন্টোর জনসংখ্যার ৫০ শতাংশই অভিবাসী হলেও বেসরকারি, সরকারি এবং অলাভজনক খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোতে নেতৃস্থানীয় পদে অভিবাসীদের সংখ্যা মাত্র ছয় শতাংশ।

ইতিপূর্বে অভিবাসী কর্মসংস্থান কাউন্সিলের এক বিবৃতিতে বলা হয়, “এমনকি যেসব খাতে নবাগতদের সবচেয়ে বেশি নিয়োগ দেয়া হয় সেখানেও কর্মজীবনে স্থবিরতার উদাহরণ আছে। আর্থিক ও বীমা প্রতিষ্ঠান এবং একই সঙ্গে পেশাদারি, বৈজ্ঞানিক ও কারিগরি পরিষেবা খাতে অভিবাসীরা শীর্ষে আরোহন করতে পারে না।  অথচ এই সব খাতেই অভিবাসীদের বৃহত্তম অংশ কর্মরত।”

নারী এবং অশ্বেতাঙ্গ অভিবাসীদের ক্ষেত্রে পরিস্থিতি আরও বেশি গুরুতর। টরন্টোর করপোরেট হাউজের নির্বাহী পদে কাজ করছেন জাতিগত পরিচয়ের নারীদের মাত্র এক শতাংশ। অথচ জনসংখ্যার হিসাবে তাদের সংখ্যা আট শতাংশ।

অভিবাসী কর্মসংস্থান কাউন্সিলের সেই সময়কার নির্বাহী পরিচালক মারগারেট ইটন বলেন, অচেতনভাবে যে বৈষম্য করা হয় সেটিই এক্ষেত্রে বড় বাধা। হাফপোস্ট কানাডাকে তিনি বলেছিলেন- জনগণ, বিশেষ করে উচ্চপদে অবস্থানকারী লোকেরা তাদেরকেই নিয়োগ করতে চায় যারা দেখতে তাদের নিজেদেরই মত। তারা তাকেই নিয়োগ করতে চায় যে ম্যাকগিলের গ্রাজুয়েট। আপনি তেমন কাউকেই নিয়োগ করতে চাইবেন যার সঙ্গে আপনি স্পোর্টস টিম নিয়ে কথা বলতে পারবেন… আমরা অচেনা কাউকে নিয়োগ বা পদোন্নতি দিতে শঙ্কা বোধ করি।”

ঝুঁকি বিমুখতা

সেই সময় ইটন হাফপোস্টকে আরো বলেন, “কানাডা যদি তার শীর্ষ পদের কর্মকর্তাদের মধ্যে বৈচিত্র্য আনার ক্ষেত্রে অন্য কিছু দেশের চেয়ে খারাপ কিছু করে থাকে তাহলে তার কারণ সম্ভবত এই যে, কানাডার ব্যবসা-বাণিজ্য ঝুঁকি নিতে চায় না।” তিনি বলেন, এক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যে “মেধার ওপর বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়।” 

কিন্তু এটি নিছক অচেতন বা সচেতন বৈষম্য নয়, এক অর্থে অভিবাসীদের পিছিয়ে রাখাটাই হলো কানাডার নীতিগত বিষয়। অনেক অভিবাসীকে হয়তো প্রত্যয়ন করা যেতো, কিন্তু কানাডা প্রায়শ তাদের ক্রেডেনশিয়ালের স্বীকৃতি দিতে ব্যর্থ হয়, বিশেষ করে চিকিৎসা, অ্যাকাউন্টিং এবং প্রকৌশলের মত বিশেষায়িত পেশার ক্ষেত্রে।

অভিবাসীদের জন্য নিজের লেখাপড়ার বিষয়ে কোন কাজ পাওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম

হওয়ার এগুলি হলো কিছু কারণ। ২০০৬ সালের আদমশুমারির উপাত্তের ভিত্তিতে স্ট্যাটিস্টিকস কানাডার এক বিশ্লেষণ অনুযায়ী, ওই সময় বিদেশ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রিধারী নবাগতদের মধ্যে মাত্র ২৪ শতাংশ তাদের নিজের বিষয়নির্ভর চাকরিতে নিয়োজিত ছিলো। অন্যদিকে কানাডায় জন্মগ্রহণকারী অভিবাসীদের মধ্যে এই হার ছিলো ৬২ শতাংশ।            

ইটন বলেন, “নিয়ন্ত্রিত (regulated professions) পেশাগুলোই এমন যে তারা নিজেদের বাজার সংরক্ষণ করতে চায়। তারা চায় না, অনেক বেশি মানুষ তাদের পেশায় আসুক।”

তিনি উল্লেখ করেন যে, অন্টারিও ও কুইবেকসহ কিছু প্রদেশ নিয়ন্ত্রিত পেশার স্বচ্ছতা ও সুষ্ঠুতা নিশ্চিত করতে ফেয়ারনেস কমিশনার নিয়োগ করেছে। তিনি বলেন, এটা হয়তো কিছুটা কার্যকর, কিন্তু সমস্যার সমাধানে পুরোপুরি কার্যকর নয়।

তিনি বলেন, “আমরা দেখছি আরও বেশি সংখ্যক অভিবাসী ওইসব পেশায় যোগ দিচ্ছে।”

সমস্যা নিয়ন্ত্রিত পেশার বাইরেও ছড়িয়ে পড়ছে। ডেঘার কখনই সিসকোর প্রেসিডেন্ট হতে পারতেন না যদি সংস্থাটি তার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার ব্যাপারে কঠোর হতো।

তাহলে, একজন নিয়োগদাতা কিসের ওপর ভিত্তি করে সিদ্ধান্ত নেন যে, একজন অভিবাসী সংশ্লিষ্ট পদের উপযুক্ত কিনা? ইটন স্বীকার করেন, “এর মধ্যে কৌশল আছে।” তবে তিনি চাকরিদাতা ব্যবস্থাপকদের প্রতি আহবান জানান, প্রার্থীর যোগ্যতার দিকে মনোযোগ দেবার জন্য। এটি হলো প্রার্থীর সক্ষমতার উদ্ঘাটন ও মূল্যায়ন।

ইটন হাফপোস্টকে বলেন, আর “নিয়োগদাতাদের নিজেদের দিকে তাকানোটাও তাদের জন্য মানানসই। উপাত্তের দিকে তাকান। আপনি কি তা-ই দেখছেন যেটা আমরা দেখছি? এরপর আপনি চিন্তা করুন, কীভাবে (প্রান্তিক গ্রুপের লোকেদের) শীর্ষপদে যাবার পথরেখা তৈরি করবেন।” 

সুষ্ঠু ব্যবসা : ডেঘারের জন্য করপোরেট জগতের মইয়ের শীর্ষস্থানে ক্রমবর্ধমান বৈচিত্র মানে নিছক তার মতো অনেককে কাজ করতে দেখার মত বিষয় ছিলো না। এটি তার কাছে ছিলো ব্যবসার সাফল্যের মূল উপাদান।

তিনি বলেন, চিন্তা ও ধারণার ঘাটতি রয়েছে এমন করপোরেশনগুলো অধিকতর বৈচিত্র্যপূর্ণ সংস্থাগুলোর সাফল্যের সূত্র ধরতে ব্যর্থ হবে। ডেঘার জোর দিয়ে বলেন, বিচিত্র সব প্রার্থীদের বেছে নেয়ার বিষয়টি নির্বাহী মনোনয়নের জন্য বাক্স খুঁজে দেখার মত বিষয় হওয়া উচিৎ নয়। তার ভাষায়, “চিন্তার বৈচিত্র হলো ব্যবসার জন্য একটি স্মার্ট ব্যাপার। আমি সেইসব লোকদের চাই না যারা আমারই মত চিন্তা করে আর আমি যা করি ঠিক সেই কাজই করে।”

তিনি আরও বলেন, তিনি একজন নারীকে কখনই এজন্যে নিয়োগ দেবেন না যে, তিনি একজন নারী। তবে “আমি আমার টিমকে  আরও বেশি সংখ্যক নারী নেতৃত্ব খুঁজে নিতে উৎসাহিত করি।”

তাহলে একজন অভিবাসী হিসাবে আপনার কর্মজীবনে যদি কোনও স্বচ্ছ প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হন তাহলে কী করবেন?  ডেঘার ও ইটন উভয়েই এ ক্ষেত্রে একজন বিজ্ঞ পরামর্শদাতা বা মেন্টর খুঁজে নেয়ার ওপর গুরুত্বারোপ করেন, যিনি আপনাকে অফিস রাজনীতি এবং কানাডা ও আপনার স্বদেশী সংস্কৃতির পার্থক্যের ভেতর দিয়ে এগিয়ে যেতে সাহায্য করতে পারেন।

ডেঘার বলেন, “আপনাকে সাহায্য করতে পারে এমন প্রতিষ্ঠান খুঁজে বের করুন এবং আপনার প্রকৃত আগ্রহ কোন বিষয়ে সেটি নির্ণয় করুন। আপনি কোথায় পৌঁছতে চান, আপনার লক্ষ্য  কোনটি এবং কীভাবে সেখানে পৌঁছতে পারবেন সেটি খুঁজে বের করুন।

তবে, সেটাই কিন্তু সাফল্যের নিশ্চয়তা নয়।

ইটন বলেন, “একটা বড় কিছু করেছেন সেজন্যে আপনাকে স্বীকৃতি দেয়া হবেই এমন নয়। লোকেরা মনে করে যে, বড় কাজ করলে তারা শীর্ষধাপে পৌঁছবেই। আমাদের গবেষণা থেকে দেখা যাচ্ছে, তেমনটা সত্যি নয়।”

তিনি বলেন, “দুর্ভাগ্যজনক হলেও এই পরামর্শের একটি দিক হলো, আপনি আপনার আশেপাশের অন্য লোকেদের চেয়ে ভালো থাকবেন।” আর, “বেশ কয়েক দশক ধরে নারী প্রার্থীদের ক্ষেত্রে এটাই সত্য।”

ডেঘার বলেন, অভিবাসীদেরকে তাদের “নিজেদের ওপর, তাদের সক্ষমতার ওপর আস্থাশীল হতে হবে এবং কেউ যেন তাদের স্বপ্ন ভেঙ্গে গুড়িয়ে দিতে না পারে সেদিকে মনোযোগী হতে হবে। কারণ তাদেরকে যেমন আমাদের দরকার আছে তেমনই আমাদেরকেও তাদের দরকার আছে।”

এ প্রসঙ্গে তিনি ধৈর্য ও অধ্যবসায়ের প্রয়োজনীয়তার কথাও বলেন।

তিনি বলেন, “আমি কানাডায় আছি ৩০ বছর ধরে, আর আজ আমি যেখানে আছি সেখানে আসতে আমার ৩০ বছরই লেগেছে।… এটি হলো একটি সফর।”

-সূত্র : হাফপোস্ট.কম