নিভৃতে

রীনা গুলশান 

(পূর্ব প্রকাশিতের পর) 

তিন

কতক্ষণ বসেছিল ফাবিয়ান নিজেই জানে না। ওর মাথা কেমন যেন কাজ করছে না। সব কিছু ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। এমনিতেই বেশ কয়েক সপ্তাহ ধরে ওর ঠিক মত ঘুম হয় না। সারারাত কাজ করে এসেও ঘুম হয় না। যার জন্য ওর শরীরটা খুবই খারাপ হয়ে যাচ্ছে। আর যদিও বা ঘুম হয়, তখন ঘুমের মধ্যে অজস্র দুঃস্বপ্ন দেখে চলে। যে সব স্বপ্ন ও আদৌ দেখতে চায় না। হ্যাঁ, ঘুম এলেই স্বপ্ন আসে। স্বপ্ন এলেই ডোরিন চলে আসে। আর স্বপ্নই হোক আর বাস্তবেই হোক ডোরিনের কথা মনে এলেই ওর মধ্যে অসম্ভব একটা কষ্ট বোধ তাড়না করে। তাই ওর কথা সে মনে করতে চায় না।

এখনও ভাবতে পারছেনা, ফাবিয়ান, একটু আগে সিসিলিয়া ওকে যা বললো তা আদৌ সত্যি কিনা। ওর সমস্ত ব্যাপারটাই দুঃস্বপ্নের মত লাগছে। এরপর অবশ্যই সিসিলিয়ার সাথে থাকবার কোন প্রশ্নই আসে না। যদিও এপার্টমেন্টটি ফাবিয়ানের, তবুও অন্তত এই ব্যাপারে অবশ্যই সিসির সাথে ওর আলোচনা করতে হবে। সে যদি এখানে থাকতে চায়, তবে তাকে এখান থেকে চলে যেতে হবে। আর যদি সিসি এখান থেকে চলে যেতে চায় তাহলে তার কাপড়-চোপড় তাকে দিয়ে দিতে হবে। সে যাই হোক, ফাবিয়ানের শরীরটা ভেঙে আসছে ঘুমে। সম্ভবত আজ ওর খুউব ভালো ঘুম হবে। বেশ কিছু দিন ধরে ওর যে সিসির সাথে সম্পর্কটা খুবই শীতল চলছিল এই কথাটা অবশ্য নাওমীও জানে। যদিও সব জানে না। বিশেষ করে যখন থেকে সিসি এই স্পাতে জয়েন করেছে। ওর এ্যাটিচ্যুট পুরো বদলে গেছে। ‘মুই কি হনুরে’ টাইপ। প্রায়ই ওকে বলতো-

: ফাবিয়ান, তুমিতো এখন অন্য কোন জব করতে পারো! তাছাড়া তোমার এ্যালবামের তো কোন খবরই নাই। আরো কি সব ভবিষ্যতের স্বপ্নের কথা এতকাল ধরে বলেছো, তারওতো কোনই খবর নাই।

: তুমিতো জানো আমি চেষ্টা করছি। বিভিন্ন জায়গাতে আমার অডিও এবং ভিডিও সিডি জমা দিয়েছি। এমনকি চলচ্চিত্র এন্ড টিভিতে চান্স পাবার ব্যাপারে একজন এজেন্টকেও নিয়োগ করেছি। সে আমার হয়ে কাজ করছে এবং তার জন্য ভালো টাকাও দিতে হচ্ছে এজেন্টকে। কিন্তু তুমি জানো এসব ব্যাপারে এত সহজ নয়। এসব ব্যাপারে ভাগ্যেরও একটা স্পার্ক লাগে।

: আর লেগেছে! সিসিলিয়া ঠোট মটকায়।

কিন্তু ফাবিয়ান ভাগ্যে বিশ্বাসী। বার বার সে ভাগ্যের কাছে পরাজিত হয়েছে। আবার ডুবতে ডুবতে ওর ভাগ্য ওকে টেনে তুলেছে। নাহলে এত দুঃখের মধ্যেও ওর হাসি পেয়ে যায়। নাহলে নাওমীর সাথে ওর পরিচয়ই বা হবে কেন?

নাওমীর জন্যই তো ওর এই ক্লাবের চাকরিটা পাওয়া। এমনকি সিসিলিয়ার সাথে ওর পরিচয়, তাও সেই নাওমী। সিসিলিয়া এ নাওমীর খুব ভালো একজন বন্ধু ছিলো। নাওমী সব সময়ই ফাবিয়ানকে একজন খুউব ভালো বন্ধু মনে করেছে। নাওমী একদমই একটা অন্য রকম চরিত্রের মেয়ে। খুব ভদ্র, শান্ত এবং খুবই রিজার্ভ ধরনের মেয়ে। ফাবিয়ানের সাথে যখন নাওমীর আলাপ বন্ধুত্বে গড়িয়েছে, তখন একদিন ফাবিয়ান বলেছিলো-

: নাওমী, তোমার চরিত্রের সাথে তোমার চাকরি একদম বেমানান!

নাওমী হেসেছে। গভীর দুঃখের হাসি। নাওমীর হাসিটাও চমৎকার। এত সুন্দর ওর হাসি, মাঝে মাঝে ফাবিয়ান অবাক হয়ে ভাবে, কোন মানুষ এত সুন্দর করে কিভাবে হাসতে পারে! নাওমী সেই সুন্দর হাসিটা দিয়ে ওকে বলেছে-

: মানুষ যা ভাবে তাই কি সে করতে পারে? আমারও সেই রকম কিছু মনে করো…

: তবুও, তুমি এত শান্ত , এত ভদ্র, তোমার চরিত্রের কোনোখানে এত উগ্রতা নাই, অথচ তুমি কিনা ‘বারটেন্ডারের’ চাকরিটা করছো, এটা কি করে সম্ভব?

: এই পৃথিবীতে সবই সম্ভব ফাবিয়ান, না হলে দেখো কোথায় কোন ইটালির একটা ছোট শহরে তুমি বড় হয়েছো, তুমি কি কখনো ভেবেছো কখনও কানাডাতে আসবে! এই রকম করে নাইট ক্লাবে গান গাইবে?

: নাহ! ভাবিনি, ঠিকই বলেছো- কখনো ভাবিনি। তবুও আজ আমি জানতে চাই তুমি কেন এই বারটেন্ডারের কাজ করছো?

: আমার কোন উপায় ছিল না ফাবি।

: কেন? আমি ঠিক বুঝতে পারছি না, তুমি তো রিয়াল ক্যানাডিয়ান। ক্যানাডারই মেয়ে তুমি।

: তা ঠিক, আসলে হয়েছে কি, আমি মা-বাবার সাথে অনেক ফাইট করে এই টরেন্টোতে এসেছিলাম।

তখন নাওমী একটু একটু করে তার জীবনের সব সুখ-দুঃখের কথা বলে। নাওমী সুলেভান। ও কানাডার নিউ ব্রান্সউইকের মেয়ে। ওরা ব্রিটিশ ক্যানাডিয়ান। ওর বাবা আইটি ইঞ্জিনিয়ার। আর মা লাইব্রেরিয়ান। ওরা চার ভাই-বোন। নাওমীই সবার বড়। প্রচন্ড ভালো ছাত্রী। গ্রেড টুয়েল্ভে খুব ভাল রেজাল্ট করেছিল। তখন অন্য সব বিশ্ববিদ্যালয়ে এ্যাপ্ল­াই করবার সময়ে ও গোপনে রায়ারশন বিশ্ববিদ্যালয়ের নামও দিয়েছিল। ও নার্স হতে চেয়েছিল। এখানেই বিপত্তি হলো। ওর বাবা-মা চেয়েছিল ওখানকার কোন বিশ্ববিদ্যালয়েই তাদের মেয়ে পড়ুক। অথবা নোভাস্কোশীয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যাক। কিন্তু অন্টারিওর টরেন্টোতে নয়। অনেক দূর। ওদের পরিবারের কেউ কখনো অত দূরে যায়নি। কিন্তু সবার মানা সত্বেও নাওমী জিদ করে টরেন্টোতে এলো। রায়ারশানের ডর্ম এ ছিল। নার্সিংয়ের প্রথম সেমিস্টারে খুউব ভালই করেছিল। দ্বিতীয় সেমিস্টারে ফাইনালের পরীক্ষার সময় নাওমীর কি যেন হলো, ঘুম হয় না। খেতে ইচ্ছা করে না। কেমন যেন ডিপ্রেশন-এর মত হলো। আসলে কখনো বাবা-মা, ভাই-বোনকে রেখে থাকেনিতো? পড়তে ইচ্ছা করতো না। চুপি চুপি শুধু কাঁদতো। ব্যাস, যা হবার তাই হলো। ফেল করলো। ফেল করবার পর ওর বাবা-মা বললো-

: অনেক হয়েছে টরেন্টোতে থাকা, এবার দয়া করে চলে আসো।

কিন্তু নাওমী অসম্ভব জিদ্দি। ও খুব জলদি বারটেন্ডারের একটা কোর্স করলো এবং এখানে জয়েন করলো। টাকা-পয়সা এখানে ভালোই পায়। শুধু টিপসের টাকা দিয়ে ওর খরচা চলে যায়। আর চেকের টাকা প্রথম এক বছর টানা জমিয়েছে। এখন সেনটেনিয়াল কলেজে ভর্তি হয়েছে নার্সিংয়ে। এখানে দু’বছর পড়া। অলরেডি ৪ সেমিস্টার হয়ে গেছে। এবার ভার্সিটিতে যাবে। সেখান থেকে নার্সিং পাশ করবে। এখন ওর একা থাকা এ্যাডজাস্ট হয়ে গেছে এবং ওছাপ’ও (পড়ার জন্য সরকারি ঋণ) একদম নিচ্ছে না। তবে খুউব কষ্ট করতে হচ্ছে। একটা বেজমেন্টে ৩ জন মেয়ে এক সাথে রুম শেয়ার করে থাকে। ওর রুমেমেটই ছিল সিসিলিয়া ক্যালাডাইন। আর মজার ব্যাপার, স্বভাবে দুজন ঠিক দুই গ্রহের বাসিন্দা। তবুও বন্ধুত্ব হয়ে যায়। যদিও রাতে দুজনই বারটেন্ডারের কাজ করে, ওটুকুতেই মিল ছিল। বাকি চরিত্রগত কোন মিলই ছিল না। পরে যখন সিসিলিয়া ফাবিয়ানের সাথে লিভিং টুগেদার করবার জন্য ওর ঘর ছাড়লো নাওমী হাফ ছেড়ে বেঁচেছিল। কারণ, খুব অগোছালো এবং হল্লাবাজ। নাওমীর খুবই রাগ হতো। কিছু বলতেও পারতো না, সইতেও পারতো না। তার পড়ার খুব ডিসটার্ব হতো। এখন অবশ্য নাওমী একটা ১ বেডরুমের এ্যাপার্টমেন্টে থাকে এগলিংটন এন্ড কেনেডিতে। এটা একটা ব্যাচেলর এ্যাপার্টমেন্ট। মাত্র ৭৫০ ডলার ভাড়া, হাইড্রো ইনক্লুডেট।

হঠাৎ টেলিফোনের শব্দে ফাবিয়ান যেন গভীর সমুদ্র থেকে ভেসে উঠলো-

: হ্যালো।

: নন্না, কেমন আছো? ফাবিয়ান আর কথা বলতে পারে না। গভীর কষ্টে তার কণ্ঠরোধ হয়ে আসে।

: আমি তো ভালোই আছি। তোর কি হয়েছে সোনা, প্রায় ২/৩ সপ্তাহ তোর ফোন আসে না, আমি তো খুবই চিন্তার মধ্যে আছি।

: আমি, আমি ভালো আছি। হয়তো খুব শিগগিরই তোমার কাছে আসবো।

: তাই? আয় সোনা, তোকে রেখে আর থাকতে পারি না। এখন এই বয়সে একা থাকা খুব কষ্টের। তোকে রেখে… ফাবিয়ানের নানী কান্নায় ভেঙে পড়ে-

: তুই ছাড়া আমার আর কে আছে বলতো?

: নন্না তুমি কেঁদো না, প্লি­জ। আমি শিঘ্রি আবার ফোন করবো, আমার আর একটা ফোন এসেছে।

ফাবিয়ান কলার আইডিতে নাওমীর নাম দেখে ফোন রিসিভ করে-

: হ্যালো, কি ব্যাপার তুমি এখনও ঘুমাওনি? আজ স্কুল নাই?

: স্কুল, স্টুপিড! আজ রবিবার ভুলে গেছো। তবে ঘুম পড়ার চেষ্টা করছি, এখন এই দুপুরে একটু না ঘুমালে রাতে কাজ করতে পারবো না। নাওমী কথা বলতে বলতে হাই তোলে।

: তোমার সমানে হাই আসছে! ঘুমিয়ে পড়ো।

: হু! ঘুমাচ্ছি, তুমি ঠিক আছো তো? তোমাকে আজ খুব ডিসটার্ব লাগছিল। সিসি ভালো আছে তো?

: ওহ! ইয়া, খুব খুউব ভালো আছে। নাওমী আমি রাখছি, আমার খুবই ঘুম পাচ্ছে।

নাওমী কিছুটা হতভম্ভ হয়ে ফোন রেখে দিল। ফাবিয়ান জীবনে কখনো এভাবে ফোন রাখে না। তার খুবই দুশ্চিন্তা হচ্ছে, কেন যেন তার সিক্সথ সেন্স বলছে ফাবিয়ান ভালো নেই। নাওমী ঘুমাতে গেল! এমন সময় এ্যান্থনির ফোন এলো-

: হ্যালো নাওমী।

: হাই এ্যান্থনি, কি ব্যাপার? এ সময়ে…

: নাহ্! রিসিপশন থেকে ফোন আসলো যে, ফাবিয়ান নাকি সিক কল দিয়েছে, আজ রাতে আসবে না। কি ব্যাপার বলতো? তুমি তো আবার ওর খুব ভালো বন্ধু! গতকাল রাতে স্টেজেও গান গাইতে গাইতে ওর চোখ দিয়ে কান্না ঝরছিল। আমি কিছু বুঝতে পারছি না! আজ এত বছরের মধ্যে ওতো কখনো সিক কল দেয়নি। তাও আবার রবিবারে।

: আমিও বুঝতে পারছি না বস্। আমি ফোন করেছিলাম তো বেশি কথা বললো না। খুব দ্রুত ফোন রেখে দিল।

: হু! আমার মনে হয় ঐ পাজী মেয়েটার সাথে কিছু হয়েছে। ফাবিয়ান যখনই ওর সাথে মুভঅন করেছিল, আমার ভালো লাগেনি। কিন্তু আমার কি করার ছিল বল? তবে কিনা আমি ওকে আমার ছেলের মত ভালোবাসি!

: জানি বস। আমি এখনি দেখছি! আপনি চিন্তা করবেন না।

: ওকে! বাই হানি, টেক কেয়ার।

নাওমী গভীর চিন্তার মধ্যে পড়ে গেল। ঠিক কি করা উচিত ও বুঝতে পারছে না। গভীর দ্বিধায় পড়ে যাচ্ছে। আবার ফোন করা বা ওর বাসায় যাওয়া, সেটা কি একটু বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে না? ফাবিয়ান মনে করতে পারে নাওমী তার জীবনে খুব বেশি ইন্টারফেয়ার করছে! আর সব থেকে বিশ্রি ব্যাপাটার হলো সিসিলিয়াও এক সময় তার রুমেমেট ছিল, বন্ধুও বটে। বন্ধু! বুলসিট, সিসিলিয়াতো তার জীবনটাই…!

চার

ফাবিয়ান বালিশে নাক ডুবিয়ে গভীর কান্নায় ভেঙে পড়েছে! নিজের উপর তার গভীর ঘৃণা হচ্ছে। ও চিরটাকাল যা কিছু করেছে কোন কিছু চিন্তা করে করেনি। আজ ওর ভেতরে আর একটা গভীর অপরাধ বোধ কাজ করছে। একটা কথা ওর তীব্রভাবে মনে পড়ছে। যে রাতে সে সিসিলিয়ার সাথে লিভিং টুগেদার করবার সিদ্ধান্ত  নিয়েছিল সে রাতে ওরা ক্লাবে কলিগ, বন্ধুদের মধ্যে একটা পার্টি থ্রো করেছিল। এখন ফাবিয়ানের সব মনে পড়ছে একে একে। সব বন্ধুরা খুব হৈ চৈ করছিল। ফ্রি ওয়াইন সাথে পিৎজা এবং চিকেন উইংগস পেয়ে মহা উৎসাহে তারা খাচ্ছিল এবং সিসি, ফাবিকে শুভেচ্ছা জানাচ্ছিল। কিন্তু তার বস এ্যান্থনি বারজেস আগাগোড়াই মুখটা গোমড়া করে ছিল এবং নাওমীও আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল আনন্দিত হবার। কিন্তু ওর গভীর সবুজ চোখে মোটেই কোন আনন্দের ছোঁয়া ছিল না? বরং একটা মারাত্মক বিষন্নতা, ক্লান্তি , উদ্বিগ্নতা সেই চোখে বিরাজমান ছিল? কেন? ফাবিয়ান এটা নিয়ে অনেকবার ভেবেছে। ওর ভেতরে এক ধরনের অস্বস্তি কাজ করছিল ক্রমাগত। আবার পার্টি শেষে ফাবিয়ান এ্যান্থনিকে যখন বাই করতে গিয়েছিল এ্যান্থনি তখন কেনো জানি বাঁকা হেসেছিল, আর বলেছিল-

: ইয়াংম্যান, গড ব্লেস ইউ। কিন্তু জানোতো, মানুষ জীবনের শেষ দিন পর্যন্তও ভুল করতে থাকে। তারা কেবলই হীরা ফেলে কাঁচ ধরে-

: বস্, ঠিক বুঝলাম না।

: বুঝবে কি করে হে, শুনেছি রেসের মাঠেই শুধু মানুষ (জকিরা) একটা ঘোড়া থেকে আর একটা ঘোড়া ডিঙ্গায়। বাস্তবেও দেখছি মানুষ ঘোড়া ডিঙ্গিয়ে ঘাস খায়!

: এ্যান্থনি! তুমি এসব কি বলছো?

: কিছু না, কিছু না। সারাক্ষণ মানুষকে মদ বেচাকেনা করি, দেখি কেউবা মদ খেয়েও মাতাল হয় না। আবার কেউ না খেয়েও মাতাল হয়ে যায়!

ফাবিয়ান সেদিন বুড়োর উপর মনে মনে বেশ চটেছিল। শালার বুড়ো! মাঝে মাঝে আবার ফিলোসফি কপচায়! ব্যাটা তুই মদ বেচিস! মদ বেঁচে খা। বড় বড় বুলি কপচানো কেন? মনে মনে বুড়োকে অজস্র গালি দিয়ে তার সুইট হানি সিসিলিয়াকে নিয়ে মনের আনন্দে বাড়ি ফিরেছিল। মনের আনন্দের খই ফুটছিল। শরীরে ছিল ভালোবাসার জোয়ার। সিসিলিয়াকে পেয়ে সুখের কোনো সীমা ছিলো না। এই প্রায় ৩০ মাসের মত সময়ে সিসি তাকে শারীরিক ভালোবাসায় ডুবিয়ে রেখেছিল। তবে এই আড়াই বছরের প্রায় প্রতিটি মুহূর্তে তার মনে হয়েছে সিসি তার মন ছুঁতে পারেনি। ওর কারো মন ছোঁয়ার ক্ষমতাই নাই।

সিসিলিয়া ক্যালাডাইন একটা ফস্টার বেবি। ওখানেই ও বড় হয়েছে। ওর বাবা রবার্টসন ক্যালাডাইন সিসিলিয়ার মাকে ডিভোর্স করেছিল কারণ, সিসির মা দ্বিতীয় কন্যা লিনিয়া ক্যালাডাইন-এর জন্মের পর পর মানসিকভাবে ভারসাম্য হারায়। বছর খানেক রবার্টসন অপেক্ষা করেছিল তার সুস্থ হবার। তারপর সিসিলিয়াকে ফস্টারে আর

ছোটটাকে দত্তক দিয়ে তার নিজের এলাকায় নোভাস্কাশীয়ায় ফিরে যায়। আর ওর মা একটা মানসিক প্রতিবন্ধী রিহ্যাবে আছে। তখন সিসির বয়স মাত্র ১৪ বছর। সিসি তার ছোট বোনটাকে খুবই ভালোবাসতো। এখনও পর্যন্ত  ছোট বোনের ছবি দেখে সিসি কাঁদে। হয়তো এসব কারণেই সিসির মধ্যে ভালোবাসার কোন বিলাস নাই। অসম্ভব উচ্ছৃঙ্খল এবং উদভ্রান্ত। ওর মায়ের মত মারকাট সুন্দরী। ৫ ফুট ৭ ইঞ্চি লম্বা। মডেলদের মত ফিগার। তবে ওর সৌন্দর্য্যরে মধ্যে আছে একটা ধারালো উগ্রতা। আর যত টাকা ইনকাম করে তার সিংহভাগই নিজের কাপড়, মেকআপ, জুয়েলারির পেছনে উড়িয়ে দেয়। সেই সাথে সিগারেট এবং এ্যালকোহল তো আছেই। মাঝে মধ্যে তার পুরানো (ফস্টারের) বন্ধুরা একত্রিত হলে মারিজুয়ানাও টানবে। ফাবিয়ান প্রচুর চেষ্টা করেছে তাকে শুধরানোর। যখনই তাকে একটু শুধরানোর চেষ্টা করেছে তখনই সিসি চিৎকার করতো-

: ইউ নো, সেই জন্য আমি কখনো বিয়ের কথা ভাবি না। আর মনে রেখো ফাবি, আমি তোমার বিয়ে করা বউ নই! এমনকি আমি তোমার বাগদত্তাও নই।

: কিন্তু, আমারতো কোন অসুবিধা ছিল না এসবে।

: নো, নো, না, আমার ওসব বিয়ে-ফিয়ে খুবই সিলি লাগে।

: কিন্তু সিসি, তোমার কি কখনো মা হতে ইচ্ছা করে না?

: সে যখন, তখন দেখা যাবে। আমি এখনই মা হবার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত নই।

আসলে পরিবার কি জিনিস সে সম্পর্কে ওর কোন ধারণাই ছিল না। বাবার উপর এক ধরনের ক্রোধ ওকে সর্বদা তাড়িত করে। আবার মাকেও প্রায় দেখতে যায়ই না বললে চলে। দু-একবার ফাবিয়ান মাতৃ দিবস এবং ওর মায়ের জন্মদিনে সিসিকে নিয়ে গিয়েছে। ওর মা প্রায় কথা বলেই না। শুধু ফিক ফিক করে হাসে। নিয়ে যাওয়া খাবার গভীর আগ্রহের সাথে খেয়ে ফেলে। আবার হাসতে থাকে। সিসিলিয়া বলে-

: মাম্, আমি তোমার সিসি, সিসিলিয়া।

: সিসি? ওর মা আবার হাসে এবং ওদের দিকে হাত বাড়িয়ে দ্যায় আরো খাবারের জন্য।

ফাবিয়ানের খুব কষ্ট হতো। প্রায় বলতো-

: সিসি, যাও না, মাকে দেখে এসো। তুমি তো তবু গেলেই মাকে দেখতে পাও, আমিতো…!

ফাবিয়ানের কণ্ঠরোধ হয়ে আসে বোবা কান্নায়। ফাবিয়ান আর বলতে পারে না। আর সিসিলিয়া কখনো গভীর আগ্রহ নিয়ে শুনতেও চাইনি তার জীবনী। ওর এত সময় কোথায়? কারো কথা ধৈর্য্য ধরে শুনবে, সে মানুষই সে নয়। যখনই সে একটু সময় পায়, কোন না কোন মেকআপ নিয়ে বসে পড়বে। কখনও বা পেডিকিউর করে, মেনিকিউর করে, অথবা নেইল খুব সুন্দর করে কার্ট করবে। প্রত্যেক রবিবার ঝাড়া দু’ঘণ্টা সে ব্যায় করে চুলের জন্য।

রান্না এই আড়াই বছরে সম্ভবত ৩/৪ বারের বেশি সে কখনও করেনি। কত দিন ফাবিয়ান সারা রাত কাজ করে এসে দেখেছে ফ্রিজ খালি। ঐ তার ডে-অফে ফাবিয়ানই ৩/৪ পদের রান্না করে রাখে। ফাবিয়ানের এমনিতে ফুলটাইম জব বৃহস্পতিবার থেকে রবিবার পর্যন্ত। রাতে জব, দিনে ঘুম। সোম থেকে বুধবার তার নাইট ক্লাবে কাজ নাই। তবু সে বসে থাকে না। প্রথমে একটি ছেলেকে গান শিখাতো, সাথে গিটারও শিখাতো। এখন ঐ ছেলের বাড়িতেই আরো ৪টা ছাত্র জুটেছে। ওদের ৬টা থেকে ৮টা পর্যন্ত  শিখায়। ঐ দিনগুলোতে রান্না করে লন্ড্রি করে। এমনকি ঘরও ক্লিন করে। আবার এজেন্ট-এর সাথেও দেখা করে। সিসিলিয়ার একটিই কাজ ছিল, ঘরে এসেই হাত-পা ছড়িয়ে বসে বলবে-

: ওহ! বেবি, সো টায়ার্ড। আজ যে কি হ্যাপা গেছে কি আর বলবো তোমায়!

ঘর ভাড়াতো দিতই না। কথা ছিল গ্রোসারী এবং আনুষাঙ্গিক সবই সে করবে। প্রথম প্রথম কিছু দিন গ্রোসারী করেছে তারপর ঢিলেমী শুরু করেছে। ফাবিয়ান প্রায় দিনই ঘরে এসে দেখবে ফ্রিজে রান্নাতো দূরে থাক কোন গ্রোসারীই নাই। কারণ সে নিজে বাইরে খেতেই ভালোবাসে। কিন্তু ফাবিয়ানের বাইরের খাবার একদম অভ্যেস নাই। কত দিন এটা নিয়ে রাগারাগি হয়েছে। আবার ফাবিয়ানই প্রত্যেক বার নিজেই গ্রোসারী করে রান্না করে সিসিকে খাইয়েছে। কারণ ও সম্পর্কে মেঘ, ঝড় একদম পছন্দ করে না। ও শান্ত  প্রকৃতির এবং শান্তি ভালোবাসে। যার জন্য নাইট ক্লাবে কাজ করলেও ও খুব কম মদ্য পান করে। যখন মনটা খুবই নৈরাশ্যে ভরা থাকে তখনই কেবল ও মদ্য পান করে। আর গান গাইবার আগে ১ পেগ খায়, তাতে কণ্ঠস্বরটা খুব সতেজ থাকে।

গভীর ক্লান্তিতে নৈরাজ্যে ওর শরীর ঝুম মেরে আসে। ফাবিয়ান গায়ে ব্ল­্যাংকেটটা টেনে নেয় এবং এত দুঃখের মধ্যেও আজ অনেক দিন পর ফাবিয়ান গভীর ঘুমে নিমজ্জিত হয়। অনেকক্ষণ পর টেলিফোনটায় বিকট স্বরে ডেকে চলে, কিন্তু ফাবিয়ান গভীর ঘুমে তলিয়ে যায়। (চলবে)

রীনা গুলশান

লেখক রীনা গুলশান বাংলা সাহিত্যে মাস্টার্স। ইতিপূর্বে বাংলাদেশের বিভিন্ন দৈনিক, সাপ্তাহিক এবং মাসিকে তার কবিতা, ছোটগল্প, প্রবন্ধ, রম্য রচনা প্রকাশিত হয়েছে। প্রকাশিত হয়েছে কানাডার বিভিন্ন বাংলা পত্রিকাতেও। তিনি ‘প্রবাসী কণ্ঠ’ ম্যাগাজিন এর একজন নিয়মিত কলামিস্ট।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *