কানাডায় প্রায় অর্ধেক নারী কর্মস্থলে যৌন হয়রানির শিকার হন!

খুরশিদ আলম

কানাডায় গড়ে প্রায় অর্ধেক নারী (৪৭%) জীবনে কোন না কোন সময় কর্মস্থলে যৌন হয়রানির শিকার হয়ে থাকেন। এদের মধ্যে রয়েছেন অভিবাসী নারীরাও। অভিবাসী নারীদের প্রতি তিনজনের মধ্যে একজনের সামান্য বেশি (৩৪%) কর্মস্থলে একই অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হন। মাস কয়েক আগে স্ট্যাটিস্টিকস কানাডার ‘জেন্ডার, ডাইভারসিটি অ্যান্ড ইনক্লুশন স্ট্যাটিসিটিকস সেন্টার’ কর্মস্থলে যৌন হয়রানি ও হামলা সম্পর্কিত নতুন ডেটা টেবল প্রকাশ করেছে কানাডার সেন্টার ফর জাস্টিস অ্যান্ড কমিউনিটি সেফটি স্ট্যাটিস্টিকস-এর সহায়তায়।

অন্যদিকে হাফিংটন পোস্ট ইতিপূর্বে তাদের এক প্রতিবেদনে জানায়, অন্টারিও প্রভিন্সের কলেজ ও ইউনিভার্সিটির প্রায় অর্ধেক শিক্ষার্থীই যৌন হয়রানির শিকার হন। ২০১৯ সালে সরকার পরিচালিত এক জরীপে এই তথ্য প্রকাশ পায়। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল এই তথ্য “ডিস্টার্বিং”।

ঐ জরীপ কার্যক্রমে তখন অংশ নিয়েছিল ১ লক্ষ ১৬ হাজার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। এদের মধ্যে ৬৩% শিক্ষার্থী জানিয়েছিলেন তারা বিভিন্ন ধরণের যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন। জরীপে অংশগ্রহনকারী কলেজ শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল ৪২ হাজার। তাদের মধ্যে ৪৯.৬% শিক্ষার্থী জানান তারাও বিভিন্ন ধরনের যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন।

ডিস্টর্বিং চিত্রের শেষ এখানেই নয়। দেখা গেছে গ্রেটার টরন্টো সহ অন্টারিও প্রভিন্সের অন্যান্য অঞ্চলের স্কুলগুলোতেও যৌন হয়রানির ঘটনা প্রায়ই ঘটে আসছে। ইতিপূর্বে টরন্টোর আইনজীবী জুলিয়ান ফেলকনার পরিচালিত এক জরিপে দেখা গেছে ‘বিপজ্জনক হারে’ এই যৌন হয়রানির ঘটনা ঘটছে স্কুলগুলোতে। ঐ জরিপে অংশগ্রহণকারী টরন্টোর একটি স্কুলের ১৯% ছাত্রী বলেছেন তারা বিগত দুই বছরে বিভিন্ন সময়ে যৌন হয়রানির শিকার হয়েছে।

অন্যদিকে সেন্টার ফর এডিকশন এ্যান্ড মেন্টাল হেলথ এর এক গবেষণায় বলা হয়, এখানকার হাই স্কুলের প্রায় অর্ধেক ছাত্রীই অশালীন যৌন মন্তব্য ও অঙ্গভঙ্গির শিকার হন। আর এক তৃতীয়াংশ ছাত্রী শারীরিক স্পর্শ, জড়িয়ে ধরা বা চিমটি কাটার শিকার হন।

কানাডায় গড়ে প্রায় অর্ধেক নারী (৪৭%) জীবনে কোন না কোন সময় কর্মস্থলে যৌন হয়রানির শিকার হয়ে থাকেন। ছবি : দি বিজনেস ওমেন মিডিয়া

সেন্টার ফর এডিকশন এ্যান্ড মেন্টাল হেলথ কর্তৃক নবম গ্রেডের আঠার শ ছাত্রীর উপর পরিচালিত জরিপ থেকে যে তথ্য উঠে এসেছে তাতে দেখা যায় – স্কুলগুলোতে ৪৬% ছাত্রী যৌন মন্তব্য, কৌতুক, অঙ্গভঙ্গি বা দৃষ্টিকটু নজরের শিকার হয়েছেন। যৌনতার উদ্দেশ্যে স্পর্শ বা জড়িয়ে ধরার শিকার হয়েছেন ৩০% ছাত্রী।

উপরে উল্ল্লেখিত তথ্যগুলো ইতিপূর্বে প্রকাশিত হয় টরন্টো স্টার পত্রিকায়। সেখানে বলা হয়- বিপজ্জনক হারে এই যৌন হয়রানির ঘটনা ঘটছে।

উল্ল্খ্যে যে, কানাডায় সরকারী উদ্যোগে ইতিপূর্বে আদিবাসী শিশুদের জন্য ‘এ্যাবরিজিনাল রেসিডেন্সিয়াল স্কুল’ নামে এক সিস্টেম চালু করা হয়েছিল। ঐসব স্কুলে আদীবাসী জনগোষ্ঠির ছেলে-মেয়েদেরকে জোর করে ধরে আনা হতো। উদ্দেশ্য ছিল আদিবাসী ছেলে-মেয়েরা যাতে তাদের নিজ ভাষা ও সংস্কৃতি ভুলে যায় এবং কানাডিয়ান তথা ইংরেজ বা ফরাসী ভাষা ও সংস্কৃতি শিখে। কিন্তু দেখা গেছে সেখানেও আদিবাসী শিশুরা যৌন হয়রানী, যৌন নির্যাতনের শিকার হতো। এবং আরো দুর্ভাগ্যের বিষয় ছিল- নির্যাতনকারী বা ধর্ষকদের বিরুদ্ধে কোন শাস্তির বিধান ছিল না। বড়জোর কৃতকর্মের জন্য ঈশ্বরের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করতে বলা হতো!

স্কুলগুলো বাস্তব অর্থে ছিলো বন্দিশালা যেখানে শিশুদের উপর চরম নির্যাতন চালানো হতো। ঐ স্কুলগুলোতে যাদের ধরে আনা হতো তাদের তথাকথিত ‘শিক্ষাজীবন’ শেষ না করা পর্যন্ত এখানেই বন্দি থাকতো। প্রায় এক শত বছরেরও বেশী সময় ধরে চলে এই ভয়াবহ সিস্টেম। ভয়াবহ বলছি এ কারণে যে, এই শিশুদেরকে দেখতে যাতে ইউরোপিয়ানদের মত লাগে তার জন্য তাদেরকে বিষাক্ত কেমিক্যালযুক্ত পানিতে গোসল করানো হতো। শিশুদেরকে জোর করে খ্রীষ্টান ধর্মে দীক্ষিত করা হতো। অপুষ্টি, চিকিৎসাহীনতা, শীতে পর্যাপ্ত শীতবস্ত্র্রের অভাব ছিল এই শিশুদের নিত্যদিনের সাথী। স্কুলে বেশীর ভাগ সময়ই তাদের ব্যয় করতে হতো কায়িক পরিশ্রম করে। শিশুরা যদি ইংরেজী বা ফরাসী ভাষা ছাড়া নিজেদের ভাষায় কথা বলার চেষ্টা করতো তবে তাদের জিব্বা সুই দিয়ে ছিদ্র করে দেয়া হতো। আর এই শিশুদের উপর সবচেয়ে বড় যে নির্যাতনটি করা হতো তা ছিল যৌন নির্যাতন। শুধু মেয়ে শিশুরাই নয়, ছেলে শিশুরাও স্কুলের শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের হাতে যৌন নির্যাতনের শিকার হতো।

স্কুলগুলো পরিচালিত হতো খ্রীষ্টান চার্চ কর্তৃক। এই রেসিডেন্সিয়াল স্কুলগুলোতে প্রায় ৬ হাজার শিশুর অকাল মৃত্যু ঘটে নির্যাতন ও অযত্ন-অবহেলার কারণে। সর্বশেষ স্কুলটি বন্ধ করা হয় ১৯৯৬ সালে। (তথ্য সূত্র : উইকিপিডিয়া)

অন্টারিও হিউম্যান রাইটস কমিশনের সংজ্ঞা অনুযায়ী যৌন হয়রানি হলো :

– কোন সুবিধা প্রদানের বিনিময়ে, পক্ষপাত বা অনুকূল্য প্রদর্শন এর বিনিময়ে যৌন সম্ভোগের প্রস্তাব।

– বারংবার ডেটিং এর জন্য প্রস্তাব বা চাপ দেয়া। অসম্মতি প্রকাশের পরও সেটিকে গুরুত্ব না দেয়া।

– জড়িয়ে ধরার চেষ্টা করা বা দাবী করা।

– অনাবশ্যকভাবে শরীর স্পর্শ করা বা অবাঞ্ছিত স্পর্শ।

– মেয়ে বা মহিলাদের প্রতি অভদ্র বা অপমানজনক ভাষা ব্যবহার করা (বালক বা পুরুষদের প্রতিও- যা নির্ভর করে পরিস্থিতির উপর)।

– মানুষের যৌন-নির্দিষ্ট বিষয়ে মর্যাদাহানিকর কথা বলা।

– কারো শারীরিক বৈশিষ্ট্য বা স্বভাব বিষয়ে যৌনতাপূর্ণ কোন মন্তব্য করা।

– পর্নোগ্রাফী, যৌনতার ছবি, কার্টুন ইত্যাদি পোস্ট করা বা শেয়ার করা।

– যৌনতাপূর্ণ কৌতুক করা।

– কারো জেন্ডারের উপর ভিত্তি করে তাকে হুমকী প্রদান বা তাকে উৎপীড়ন করা।

– যৌনতা বিষয়ক গুজব ছড়ানো (অনলাইন সহ)

এছাড়াও স্টাটিসটিসক কানাডার বর্ণনা অনুযায়ী – কর্মস্থলে যৌন হয়রানি বলতে, কোনও ব্যক্তি কর্তৃক কর্মস্থলের সঙ্গে সম্পর্কিত যে কোন জায়গায় বা যে কোনও উপলক্ষে কারও সঙ্গে আপত্তিকর বা অনাকাঙ্খিত কোনও আচরণ, মন্তব্য বা কর্ম বোঝানো হয়। অযথার্থ যৌন আচরণ , বৈষম্যমূলক আচরণ এবং যৌন পীড়নও এর অন্তর্ভুক্ত।

অযথার্থ যৌন আচরণের মধ্যে রয়েছে অনুপযুক্ত মৌখিক এবং অন্য কোনওভাবে যোগাযোগ করা, স্পষ্ট যৌন উপাদান সম্পর্কিত আচরণ এবং অবাঞ্ছিত শারীরিক সংযোগ অথবা যৌন সম্পর্কের প্রস্তাব ইত্যাদি। বৈষম্যমূলক আচরণের মধ্যে পড়ে ব্যক্তির জেন্ডার পরিচিতি বা জেন্ডার অভিব্যক্তি এবং প্রকৃত বা ধারণাগত যৌন অভিমুখিতার ভিত্তিতে বৈষম্য করা অথবা একজন ব্যক্তিকে  ট্রান্সজেন্ডার বলে অথবা সেরকম ধরে নিয়ে তার সঙ্গে বৈষম্য করা।

যৌন হামলার অন্তর্ভুক্ত বিষয়ের মধ্যে রয়েছে যৌন আক্রমণ; অনাকাঙ্খিত যৌন স্পর্শ ইত্যাদি।

উল্লেখ্য যে, কানাডার সব কর্মস্থলকেই হয়রানি ও বৈষম্যবিরোধী আইন বাধ্যতামূলকভাবে মেনে চলতে হয় এবং অনেক নিয়োগদাতারই কর্মস্থলে অবাঞ্ছিত যৌন আচরণের সমস্যা নিরসনের জন্য নিজস্ব নীতি বহাল করেনÑ এর মধ্যে অবাঞ্ছিত যৌন আচরণের শিকার হলে যথাযথ ব্যক্তির কাছে রিপোর্ট করার প্রক্রিয়াও রয়েছে।

তবে স্ট্যাটিসটিকস্ কানাডার প্রতিবেদনে বলা হয়, তা সত্ত্বেও, প্রায় এক-তৃতীয়াংশ (৩২%) নারী বলেছেন, যৌন হয়রানি অথবা আক্রমণের শিকার হলে কীভাবে রিপোর্ট করতে হবে সে বিষয়ে তারা নিয়োগকর্তার কাছ থেকে কোনওরকম নির্দেশনা পাননি।

প্রাপ্ত তথ্যে আরো দেখা যায়, ঐতিহাসিকভাবে পুরুষেরা করে এসেছেন এমন পেশায় নিয়োজিত নারীদের ক্ষেত্রে অবাঞ্ছিত যৌন আচরণ ঘটে অনেক বেশি। নারীদের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি অবাঞ্ছিত যৌন আচরণের শিকার হন সেইসব নারী যারা এমন কোনও পেশায় যুক্ত যেখানে ঐতিহাসিকভাবে পুরুষেরই প্রাধান্য ছিলো। উদাহরণস্বরূপ- ব্যবসায়, পরিবহন, যন্ত্রপাতি চালনা ইত্যাদি। সংশ্লিষ্ট পেশাগুলোতে নিয়োজিত মহিলাদের প্রায় অর্ধেক (৪৭%) বলেছেন, মহামারির আগের বছর তারা এ ধরনের আচরণের শিকার হয়েছেন।

অন্যদিকে ঐতিহাসিকভাবে নারীরাই দখল করে ছিলো এমন কিছু পেশায় নিয়োজিত নারীরাও মহামারির আগের বছর বেশ উচ্চ হারে অবাঞ্ছিত বা অশোভন যৌন আচরণের শিকার হন। দৃষ্টান্তস্বরূপ, বিপনন ও পরিষেবা খাতে কর্মরত প্রায় প্রতি তিনজন নারীর একজন (৩২%) এবং স্বাস্থ্য সম্পর্কিত পেশার (৩০%) নারী বলেন, তারা মহামারির আগের বছরে কর্মক্ষেত্রে অবাঞ্ছিত যৌন আচরণের শিকার হয়েছেন।

বিপনন ও পরিষেবা খাতের পেশায় নিয়োজিত যেসব নারী এধরণের আচরণের শিকার হয়েছেন তাদের অর্ধেকেরও বেশি (৫৩%) বলেছেন, একজন গ্রাহক বা খদ্দের অন্তত একবার এ ধরণের আচরণ করার জন্য দায়ী। যৌনতাপূর্ণ টেক্সট ম্যাসেস, ভিডিও বা অডিও ইত্যাদির মাধ্যমে কর্মক্ষেত্রে হয়রানি হয়েছেন এমন প্রতি তিনজনে একজন এজন্যে কর্তৃপক্ষের কাউকে দায়ী করেছেন।

এখানে অবাক করার মত একটি বিষয় বিষয় হলো, ২০১৬ সালে প্রকাশিত এক গবেষণা তথ্যে দেখা যায় ধর্ষণের সর্বোচ্চ হার বিদ্যমান শীর্ষ দশ দেশের মধ্যে কানাডার নামও আছে! এবং উন্নত বিশ্বের দেশ কানাডা ধর্ষণের দিক থেকে অষ্টম স্থানে রয়েছে!

কানাডার মতো পৃথিবীর অনেক উন্নত দেশেই অহরহ ঘটছে ধর্ষণের ঘটনা। আর এ তালিকায় রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, সুইডেনসহ আরো অনেক উন্নত দেশ। সম্প্রতি ওনডার্সলিস্ট নামক একটি ম্যাগাজিনে এ সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, উন্নত বিশ্বের দেশ কানাডা ধর্ষণের দিক থেকে অষ্টম স্থানে রয়েছে। দেশটিতে প্রতি তিনজনে একজন নারী যৌন নির্যাতনের শিকার হন। তবে মাত্র ছয় শতাংশ অভিযোগই পুলিশের কাছে নথিভুক্ত হয়। বিট্রিশ কলম্বিয়ায় একটি জরিপে বলা হয়, প্রতি ১৭ জন নারীর মধ্যে একজন নারী ধর্ষণের শিকার হন যাদের ৬২ শতাংশই শারীরিকভাবে আহত হন।

কানাডার রাজনৈতিক অঙ্গণের নেতৃস্থানীয় কারো কারো বিরুদ্ধেও অভিযোগ রয়েছে তারা তাদের সহকর্মী বা অধিনস্তদের উপর যৌন হয়রানি বা যৌন নির্যাতন চালিয়েছেন। আর এই অভিযোগের ভিত্তিতে দলের শীর্ষ পদ হারিয়েছেন কয়েকজন। কেউ হারিয়েছেন মন্ত্রীত্ব। কয়েক বছর আগে এদের মধ্যে সবচেয়ে বেশী আলোচিত হয়েছিলেন প্যাট্রিক ব্রাউন নামের একজন রাজনীতিক। তার বিরুদ্ধে দুই মহিলা যৌন নির্যাতের অভিযোগ এনেছিলেন। ঐ সময় তিনি ছিলেন অন্টারিও প্রভিন্সের প্রগ্রেসিভ কনজারভেটিভ পার্টির প্রধান এবং প্রধান বিরোধী দলীয় নেতা। ইতিপূর্বে তিনি ফেডারেল পার্লামেন্টেরও এমপি ছিলেন। ঐ সময়টাতেই নাকি তিনি যৌন নির্যাতন এর ঘটনা ঘটিয়েছিলেন। সিটিভি নিউজের এক খবরে এই তথ্য প্রকাশিত হয়। প্যাট্রিক অবশ্য দাবী করেন ঐ অভিযোগ সুষ্পষ্টভাবে মিথ্যা। পরে তিনি দলীয় প্রধানের পদ থেকে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। কিন্তু পরবর্তীতে তিনি আবার ব্র্যাম্পটনের মেয়র নির্বাচিত হয়েছিলেন এবং এখনো তিনি ঐ সিটির মেয়র।

উল্লেখ্য যে ২০১৫ সালের জানুয়ারী মাসে প্রকাশিত অন্য এক জরীপে বলা হয়েছিল কানাডায় প্রতি ১০ জন মহিলার মধ্যে তিনজন ধর্ষণের শিকার হন। কিন্তু আইন বিশেষজ্ঞরা তখন বলেছিলেন এটি ‘‘কমিয়ে দেখানো’’ হিসাব।

অটোয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের শিক্ষক এলিজাবেথ শিহাই, যিনি যৌন হামলার আইন বিষয়ে পড়ান, তিনি বলেন, ‘‘এধরণের জরিপ যৌন সহিংসতার শিকার নারীদের প্রকৃত সংখ্যার কাছাকাছিও যেতে পারে বলে আমি মনে করি না।

ফোরাম সার্চ নামের একটি প্রতিষ্ঠান ওই জরিপ চালিয়েছিল যা ঐ সময় টরস্টার নিউজ সার্ভিসে প্রকাশিত হয়।

কানাডায় যৌন নির্যাতনের আরেক রূপ হলো হাজার হাজার তরুনীকে কৌশলে বা জোরপূর্বক যৌনদাসী বানানো। আর এই যৌনদাসীদের খদ্দেরদের মধ্যে আছেন ব্যবসায়ী, চিকিৎসক, আইনজীবী, পুলিশ অফিসার, শিক্ষক এমনকি আদালতের বিচারকও!

খদ্দেরদের মনোরঞ্জনে অবাধ্য হলে এই যৌন কর্মীদের উপর নেমে আসে শারীরিক নির্যাতন। দিনে ১০ থেকে ১৫ জন খদ্দেরের কাছে শরীর বিক্রি করতে হয় হতভাগ্য এই তরুণীদের কাউকে কাউকে। এদের মধ্যে কারো কারো বয়স ১২ বছর! আর এই যৌনব্যবসা দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে টরন্টোসহ গোটা অন্টারিও জুড়ে! ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে টরন্টো স্টার এর এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে এমনি চাঞ্চল্যকর তথ্য প্রকাশিত হয়েছিল।

আগের দিনের দাসদের মত হতভাগ্য এই তরুণীদের বেচা-কেনাও করা হয়। ২০১৩ সালে টরন্টোতে এমনি এক তরুণীকে পুলিশ উদ্ধার করে যাকে দালালদের কাছে বিক্রি করে দিয়েছিল তার নিজের জন্মদাত্রী মা! ঐ তরুনীর বয়স ছিল ১৭। তার মা ছিল ড্রাগ এডিক্টেড। প্রতিনিয়ত ড্রাগের পয়সা যোগার করতে গিয়ে একপর্যায়ে ঐ মহিলা ঋণগ্রস্থ হয়ে পরেন। আর সেই ঋণের টাকা পরিশোধ করার জন্য নিজের মেয়েকে বিক্রি করে দেন এক দালালের কাছে।

যৌনদাসী হিসাবে এই মেয়েরা যা আয় করেন তার সব টাই দালালদের পকেটে জমা হয়। আর সকলেরই ধারণা যে এই মেয়েদেরকে দেশের বাইরে থেকে উচ্চ বেতনের চাকরীর প্রলোভন দেখিয়ে আনা হয় নানান অবৈধ উপায় অবলম্বন করে। আর এখানে এনে তাদের পাসপোর্ট বা অন্যান্য কাজগপত্র আটক করা হয়। ভয় দেখানো হয়, কথার অবাধ্য হলে পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হবে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, এই মেয়েদের প্রায় সকলেরই জন্ম কানাডায়!

দেহ ব্যবসায় নিয়োজিত এই যৌনদাসীদের উপর অত্যাচারের সীমা থাকে না অনেক সময়। কখনো কখনো তা ভয়ঙ্কর ও বর্বরোচিত পর্যায়ে চলে যায়। টরন্টো এলাকায় কর্মরত গোয়েন্দা কর্মকর্তা ডেভিড কোরেয়া বলেন, আমি এমনো ঘটনা দেখেছি- এই যৌনদাসীদের জেনিটাল এরিয়ার অভ্যন্তরে জোর করে স্পঞ্জ ঢুকিয়ে রাখা হয় যাতে করে দিনে একাধিক খদ্দেরের সঙ্গে মিলিত হতে হলে রক্তপাত না ঘটে। টরন্টো পুলিশের সেক্সক্রাইম ইউনিটের ইন্সপেক্টর জনা বিইভেন বলেন, এই যৌনদাসীদের প্রতি এমন ব্যবহার করা হয় যেন তারা গবাদি পশু। তিনি আরো বলেন, এই যৌনব্যবসা শুধু টরন্টো বা অন্টারিওর সমস্যা নয়। গোটা কানাডাতেই চলছে এই অপকর্ম!

আসলে নারী নিরাপদ নয় অনুন্নত, উন্নত কোন দেশেই। সেটা ভারত হোক, বাংলাদেশ হোক, আফগানিস্তান হোক আর যুক্তরাষ্ট্র বা কানাডাই হোক, সর্বত্রই কম বেশী যৌন হয়রানী, যৌন নির্যাতন বা ধর্ষণ যেভাবেই বর্ণনা করি না কেন এগুলো অহরহই ঘটছে। এমনকি ধর্মযাযক, হুজুর, পুরহিত এরাও আছেন ধর্ষকের তালিকায়! বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে আলোচিত রাজনৈতিক ব্যক্তি ও  আমেরিকার সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিরুদ্ধেও যৌন হয়রানীর অভিযোগ উঠেছে একাধিকবার! আমরা আরো জানি, আগের দিনের রাজা, মহারাজা থেকে শুরু করে স্থানীয় জমিদারদের আলাদা রং মহলই থাকতো যেখানে নারী সম্ভোগ তথা নারীদের উপর যৌন হয়রানী, যৌন নির্যাতন চলতো নিয়মিত ভাবে এবং তা ছিল বিধিসম্মত!

যৌন হয়রানি এক গুরুতর অপরাধ। কারণ, এই অপরাধ বা পাপচারের যারা শিকার হন তাদের জীবনে নেমে আসে মহা বিপর্যয়। তছনছ হয়ে যায় তাদের জীবনের সব স্বপ্ন। বেঁচে থাকাটা তাদের জীবনে হয়ে উঠে কঠিন এক সংগ্রাম। ক্ষণে ক্ষণে যৌন হয়রানির স্মৃতিগুলো মনের পর্দায় ভেসে উঠে জীবনকে করে তুলে বিভীষিকাময়। বিতৃষ্ণায় ভরে উঠে মন। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এমনকি কর্মস্থলেও এই জাতীয় যৌন হয়রানি উপেক্ষা করার মত নয়। কারণ এগুলোর যারা শিকার হন তারা নানানভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারেন। আর শিশুদের বেলায় এর প্রভাব হতে পারে সুদূর প্রসারী। তাই বিষয়টিকে গুরুত্ব দেয়া বিশেষভাবে জরুরী। আমরা যারা ইমিগ্রেন্ট, তাদের পরিবারের সন্তানেরা স্কুলে তুলনামূলকভাবে কিছুটা জড়তাগ্রস্ত অবস্থায় থাকে বা তারা তাদের অধিকার সম্পর্কে ততটা জোড়ালো হয় না। বিশেষ করে যারা কানাডায় নতুন আসে।

অন্টারিও হিউম্যান রাইটস কমিশনের মতে, শিশুরা যদি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কোনভাবে যৌন হয়রানির শিকার হয় তবে তারা তাদের নিরাপত্তা নিয়ে শংকিত হয়ে উঠতে পারে। ব্যক্তিগত মর্যাদা বা সম্ভ্রম নিয়ে উৎকন্ঠিত হয়ে উঠতে পারে। তাদের শিক্ষা গ্রহণ ব্যহত হতে পারে যা তাদের ভবিষ্যতের সাফল্যকেও নষ্ট করে দিতে পারে। আর সময়মত যদি এই যৌন হয়রানি বন্ধের বিষয়ে পদক্ষেপ না নেয়া হয় তবে ভুক্তভোগী একসময় উগ্র ও হিংসাত্মক আচরণে অভ্যস্ত হয়ে উঠতে পারে।

তাই শিশুদের আচরণে হঠাৎ কোন পরিবর্তন লক্ষ্য করলে বিষয়টি গুরুত্বসহকারে পর্যবেক্ষণ করা জরুরী। দেখতে হবে তারা কি নিয়মিত স্কুলে যেতে অনিহা প্রকাশ করছে কি না, পড়ার টেবিলে মন খারাপ করে বসে থেকে কোন কিছু চিন্তা করছে কি না বা ডিপ্রেশনের অন্যকোন লক্ষণ তার মধ্যে প্রকাশ পাচ্ছে কি না।

যদি এরকম কোন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয় হবে বিষয়টি নিয়ে চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করা জরুরী এবং একই সাথে স্কুল কর্তৃপক্ষের সঙ্গেও। শুরুতেই এগুলোর সুরাহা করা না হলে ভবিষ্যতে এর ফলাফল মারাত্মক হতে পারে।

খুরশিদ আলম

সম্পাদক ও প্রকাশক

প্রবাসী কণ্ঠ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *