বিষ্ণুপ্রিয়াদের আয়োজনে দুর্গা পুজো

শুভ্রা সাহা

জ্বলছে গোটা বাংলাদেশ। কাপছে রক্তে ভেজা দেশের মাটি। আকাশে বাতাসে নির্যাতিতদের ক্রন্দন রোল। এর মাঝে মা দুর্গা আসছে আমাদের হৃদি পদ্মে বাঙালীর ঘরে ঘরে ন্যায় বিচার, সাহস ও শক্তি নিয়ে। অশুভ বিনাশ, শুভ সুন্দর আর সাফল্যের বার্তা নিয়ে। দূর্গো উৎসবের আমেজ প্রবাসের বাঙালীর হৃদয়ে জাগিয়ে তোলে দেশপ্রেম, সৃষ্টি করে বন্ধুত্বের আবেশ এবং একতার সংহতি । আমরা অনেকেই “মা” রেখে এসেছি দেশে অথবা হারিয়েছি মাকে । এই প্রবাসে মন্দিরে মাতৃ প্রতিমার মধ্য দিয়ে আমাদের মাকে দেখতে পাই আর দেই ভক্তি অর্ঘ্যের অঞ্জলি প্রাণের সবটুকু ভক্তি আর ভালবাসা দিয়ে। শ্যামলে শিশিরে নীল আকাশে মায়ের মুখ ভাসে।  সোনার ইন্দু ধনু বরণে মা আসেন হেসে হেসে আমাদের আনন্দ নিকেতনে ভবন আলো করে, আলোর বেনু বাজিয়ে মা আসেন ধরায় সব অশুভ দূর করতে। মৃণ্ময়ী মাঝে চিন্ময়ী মায়ের আবির্ভাব আমাদের ভাসিয়ে নিয়ে যায় কুসুম গন্ধ রাশির মত কিরণে নিখিলে স্বপ্নরাজ্যে! পুজোর কটি দিন কাটে আনন্দময়ী মায়ের সান্নিধ্যে ভক্তি আবেশে। শরতে কৈলাস থেকে দেবী দুর্গার আগমন মর্তে। ঈশ্বর মাতৃরূপে ধরিত্রীতে নেমে আসেন, দশভুজা দেবী দুর্গা শক্তির দেবী, মাতৃ দেবী, ভক্তির দেবী। সনাতনীদের বিশ্বাস, দেবী দুর্গার আরাধনায় আমরা শক্তি লাভ করি। দেবী দুর্গা, অসুর অন্য কোথাও বাস করে না, আমাদের মনের আলোকময়দিকটাই দেবী দুর্গা, অন্ধকার দিকটা অসুর। রিপুর ভাবগুলোই আমাদের মনের শুভ্রনীল আকাশে ছায়া নিয়ে আসে, আঁধার নিয়ে আসে। এই আমরাই সৎ, বিনয়ী, প্রেমময়, নির্লোভ, মোহহীন মনের অধিকারীও হই। এই সদ্ভাবগুলো যতোই আমাদের রিপুর উপর নিয়ন্ত্রণ আনবে, আমাদের মন ততই পরিচর্যা পাবে। আলো দিয়েই অন্ধকারের নিধন হয়। বিবেকই আমাদের মননকে নিয়ন্ত্রণ করে। সেদিনই আমি আমার ভেতরের আমাকে দেখতে পাবো, আমার মনের মানুষের দেখা পাবো, স্রস্টার দেখা পাবো! মায়ের কৃপায় সবার মধ্যে সঞ্চারিত হোক –  সম্প্রীতি, মঙ্গল আর শান্তি। মায়ের আশীর্বাদ বর্ষিত হোক সকলের প্রতিঃ  আরও প্রেমে প্রেমে ভরে উঠুক পৃথিবী। ডুবে যাক অন্ধকার, আলোয় উদ্ভাসিত হোক  চারিধার। সত্য আর সুন্দরের প্রতি জেগে উঠুক আমাদের গভীর অনুরাগ, আমাদের গভীর ভক্তি অর্ঘ্যের ডালা পূর্ণ হোক মায়ের অশেষ কৃপায় করুণার ধারায়। 

সকলের আন্তরিক সহযোগিতায় আমরা করবো মায়ের বন্দনা আর বাংলার শাশ্বত আবাহমান কালের সংস্কৃতির প্রচার প্রসার। এ উৎসব পৃথিবীর সকল মাতৃশক্তির জন্য উৎস্বর্গ ও ভক্তিপূর্ণ নিবেদন সহযোগিতায় আমরা করবো মায়ের বন্দনা আর বাংলার শাশ্বত আবাহমান কালের সংস্কৃতির প্রচার প্রসার। এ উৎসব পৃথিবীর সকল মাতৃশক্তির জন্য উৎসর্গ ও ভক্তিপূর্ণ নিবেদন।

মা আসছে আমাদের হৃদকোমলে। দুর্গা উৎসব মানেই বাংলার আবাহমান কালের শিল্প ও সংস্কৃতির চর্চা ও তার নান্দনিক উপস্থাপন। দু তিন মাস ধরে চলে কতশত প্রস্তুতি। বাড়ি ঘরদোর ঝাড় পোচ। নাড়ু, মোয়া, তকতি, নারকেলের চিড়ে কোটা আরও কত কি। বাড়ী ভর্তি আত্মীয় স্বজনের আগমন হত। এই প্রবাসেও ভক্তি অশ্রুতে মায়ের বরণ ডালা সাজাতে আসছে সুদুর PEI থেকে আমার বান্ধবী তার পরিবার নিয়ে। দেবীর কৃপায় ওদের যাত্রা শুভ হোক । মায়ের মন্ডপ সাজাতে পুজোর আয়োজনে SK থেকে আসছে আমার বৌমা। আমিও আমার শাশুড়ির সংগে এভাবে মহা আনন্দে পুজোর কাজ করতাম প্রতিবছর। বয়সের ভারে আমার শাশুড়ি মায়ের দেহ অচল। বাড়ীর মন্ডপে আজ আর তেমন করে মহা ধুমধামে পুজো হয় না। তাই আমাদের এ ক্ষুদ্র আয়োজন আমার শাশুড়ি মাকে সংকল্প করেই। মায়ের নামে জয়, রাধা নামে জয় ..

মাকে নিবেদনের জন্য বিষ্ণুপ্রিয়াদের শৈল্পিক হাতের কত রকমের কাজ। চলছে  বিষ্ণুপ্রিয়াদের কতশত প্রস্তুতি। দেখতে দেখতে আজ ১৪ বছর হল “বিষ্ণুপ্রিয়া” কোনো এক বছরের হরিনাম সংকীর্তনের মধ্যদিয়ে ছোট পরিসরে চলতে চলতে আজ এখানে। আচার-অনুষ্ঠান, পূজা-পার্বণ, সামাজিক-সাংস্কৃতিক নানান আনন্দ অনুষ্ঠান যজ্ঞের পাশাপাশি কখনও কখনও কারো শোকসন্তপ পরিবারের নিমন্ত্রণ যজ্ঞেও উপস্থিত হয়ে হরিনাম কীর্তন করে থাকে। প্রবাস জীবনের ব্যস্ততা কাটিয়ে প্রায়শই ইচ্ছে সত্ত্বেও সকলকে এক করতে সক্ষম হওয়াটা কঠিন। আমরা উপনীষদের কোন অংশ থেকে, গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা থেকে ও গুনীজনের ধর্মীয় ভাবনা অনুভূতি ও অভিজ্ঞতা থেকে সামান্য পাঠ, গান ও আলোচনা করে থাকি বিভিন্ন অনুষ্ঠানে । এই কোলাহলের জীব মানুষ শান্তি পায় যখন সে প্রভুর কাছে আত্মসমর্পন করে। সে শান্তি আর কোথাও নেই, জনহীন সমুদ্রে নেই, মরুভূমির স্তব্ধতায় নেই, পর্বতের দুর্গম শিখরে নেই। আত্মার মধ্যে সেই গভীর শান্তি। চারি দিকের কোলাহল তাকে আক্রমণ করতে গিয়ে পরাস্ত হয়; কোলাহলের ভিতরে নিবিড় রূপে সুরক্ষিত সেই শান্তি। হাট বসে গিয়েছে, বেচা-কেনার রব উঠেছে; তারই মধ্যে প্রত্যেক মানুষ তার আপনার আত্মার ভিতরে প্রভু কৃপা ধারণ করছে। ষড়রিপু ক্ষোভ-বিক্ষোভ-বিরোধের মাঝখানে অক্ষতশান্তি। সেখানে আমরা প্রভুর নামে প্রদীপ জ্বালি, কোনো অশান্ত বাতাস তাকে নেবাতে পারে না। ফলের গর্ভে শস্য যেমন তিক্ত আবরণের ভিতরে থেকে রক্ষা পায়, সেইরূপ কোলাহলের দ্বারাই বেষ্টিত হয়ে চিরকাল মানুষের শান্তি রক্ষা পেয়ে এসেছে। রবীন্দ্রনাথের মত করে বলতে ইচ্ছে হয় , জীবনের হাটে – যেখানে কেনাবেচার বিচিত্র লীলা চলেছে, এরই মধ্যে, এই মুখর কোলাহলের মধ্যেই অন্তরে সদাই প্রভুর নাম বাজছে। নিজেকে সপে দেই প্রভুর নামে সেখানে কোনো কোলাহল নেই, ভিড় নেই, ঠেলাঠেলি নেই; কত যুদ্ধবিগ্রহ বিরোধ সংগ্রামের কত বিচিত্র সুর শব্দ ঝংকৃত হচ্ছে, তার বৈচিত্র্যের সীমা নেই। কিন্তু এই-সমস্ত বৈচিত্র্যের মধ্যে, বিরোধের মধ্যে, শান্তির সুর বাজে। প্রিয় ভক্তরা তার বৈষয়িকতার বুকের উপর প্রতিষ্ঠিত করেছে প্রভুকে । সেখানেই মুক্তি , ভক্তি আছে,যার ভক্তি নেই, বিষয়ী ব্যবসায়ী পাপী, সকলেরই মধ্যে প্রভুর কৃপা বর্ষিত হচ্ছে । তিনি মহা উদ্ধারকারী, রক্ষা করছে সবাইকে সেই রক্ষা হরিনাম।

আবারও সবিনয়ে মনে করিয়ে দিচ্ছ  ক্ষুদ্র আয়োজনের সার্বজনীন মাতৃবন্দনায়  সকলের সাদর আমন্ত্রণ ৮ -১২ অক্টোবর ২০২৪ ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *