জীবনের বহু রং
সাইদুল হোসেন
(এগার)
এপ্রিল ১০, ২০২৫
আমি পীরবাবার দেয়া সন্তান
কোন এক পার্টিতে উপস্থিত দু’জন বাংলাদেশী স্বামী-স্ত্রীর সংগে পরিচয় হলো। নানা প্রসংগ নিয়ে আলাপ-আলোচনা ও মত বিনিময় করলাম আমরা। সেই মহিলা একজন এম.বি.বি.এস ডাক্তার এবং ২০ বছর বয়সের এক ছেলের মা। কোনও একটা প্রাইভেট মেডিকেল ক্লিনিকে বর্তমানে কর্মরত। কথা প্রসংগে তিনি আমাদেরকে জানালেন যে পীরদের উপর তার খুব বিশ্বাস ও ভক্তি কারণ তিনি নিজেই একজন পীরবাবার দেয়া সন্তান।
শুনে খুব ইচ্ছা হলো তার জন্মের ইতিহাসটা জানতে। তাই বিনীতভাবে বললাম, “ঘটনাটা কি ঘটেছিল কোন আপত্তি না থাকলে খুলে বলবেন কি, প্লীজ?”
মহিলা হেসে দিয়ে বললেন যে তার কোনই আপত্তি নেই। তারপর তিনি নিজমুখে এই বর্ণনাটা দিলেন।
“আমার মায়ের বিয়ের পর প্রথম দশ বছর তাঁর কোন সন্তানাদি হয়নি। সমস্ত ডাক্তারী চিকিৎসা বিফলে গেল। মা-বাবার মন খারাপ।”
“এমনি এক সময়ে মায়ের এক বান্ধবী একদিন মাকে নিয়ে তার পীরবাবার কাছে গেলেন, পরিচয় করিয়ে দিলেন এবং মায়ের সন্তান লাভের জন্য দু’আ করতে অনুরোধ জানালেন। তিনি মনোযোগ দিয়ে সব শুনলেন।”
“পীরবাবা তখন মায়ের চোখে চোখ রাখলেন, তারপর কাছে গিয়ে মায়ের পেটে তাঁর ডানহাতের শাহাদাৎ আংগুলটি দিয়ে একটা গুঁতা মারলেন, তারপর হাসতে হাসতে বললেন, “আপনার পেট থেকে এখন সব বাঘের বাচ্চারা বের হবে। এখন বাড়ি যান।”
“মা-বাবা বাড়ি ফিরে এলেন।”
“কিছুদিন পর জানা গেল যে মা প্রেগন্যান্ট। বছরের শেষে জন্মালো আমাদের বড় ভাই (বর্তমানে সে একজন নামীদামী ইনজিনিয়ার ঢাকা শহরে); পরে জন্মালো আরো এক ভাই (সেও একজন প্রতিষ্ঠিত ধনী ব্যক্তি); তারপর জন্মালাম আমি, এবং সর্বশেষে আমার এক ছোট বোন। মোট চারটি সন্তানের মা হলেন আম্মা।”
“আনন্দই আনন্দ পরিবারে। সেই কামেল পীরবাবার কেরামতিতেই আমরা চার ভাইবোনের জন্ম। এটাই আমার বিশ্বাস।”
“তাই পীরের দরগায় যাওয়া, তাঁদের দু’আ নেয়া ইত্যাদিতে আমি গভীর বিশ্বাস রাখি।”
এই বলে তার কাহিনীটার ইতি টানলেন মহিলা। বললাম, কাহিনীটা শোনানোর জন্য অশেষ ধন্যবাদ আপনাকে।
(বার)
এপ্রিল ১২, ২০২৫
বাংলা ভাষা ও কর্মচঞ্চল বাংগালীরা
(একটি অতি সংক্ষিপ্ত বহুমাত্রিক আলোচনা)
ভূমিকা
বাংলাদেশে এবং ইন্ডিয়ার ওয়েষ্ট বেংগল ও ত্রিপুরা রাজ্যে বাংগালীদের বাস যাদের বর্তমান সংখ্যা ২৯ কোটির কাছাকাছি। তাদের ভীতু, ঘরকুনো এবং উদ্যমহীনতার কারণে বহু যুগ আগে যখন বাংগালীদের সংখ্যা ছিল সাত কোটি মাত্র বেংগল প্রোভিন্সে, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর এক কবিতায় আক্ষেপ করে লিখেছিলেন :

“সাত কোটি সন্তানেরে, হে মুগ্ধ জননী,
রেখেছ বাঙালী করে, মানুষ কর নি।”
কিন্তু সেই যুগ সম্পূর্ণ বদলে গেছে। বর্তমান যুগের দেশ-বিদেশ জুড়ে বাংগালীদের কর্মচাঞ্চল্য আজ গর্বের বস্তু যা দেখলে কবিগুরু আনন্দিত চিত্তে নিশ্চয়ই প্রশংসা করে নূতন কবিতা লিখতেন।
আমরা বাংগালী। বাংলা আমাদের মাতৃভাষা। আমাদের প্রাণের ভাষা বাংলা। বলে আনন্দ পাই, শুনেও আনন্দ পাই। অন্য ভাষাভাষীরা কখনো আমাদের সংগে বাংলা বললেও আমরা আনন্দিত বোধ করি। সবই ঠিক। কিন্তু আমাদের মাতৃভাষার ইতিহাসটা আমরা কতটুকু জানি? চলুন সেই প্রসংগে কিছু নানামুখী আলোচনা করা যাক। আমি কোন পন্ডিত নই। তাই এই লেখাতে কোন পান্ডিত্য আশা করবেন না।
নানা বইপত্র, ইন্টারনেট ইত্যাদি ঘেঁটে আমি যতটুকু উদ্ধার করতে পেরেছি- বিস্তারিত কোন গবেষণা নয়, নিছক কৌতুহল মাত্র- সেই বিবরণটা এখানে আমি তুলে ধরছি। তাই আমি কোন মৌলিকতার বা নির্ভুলতার দাবী করছি না।
১. উৎপত্তি : সংস্কৃত ও মগধী [বর্তমান বিহার রাজ্য (state), ইন্ডিয়া] প্রাকৃত ভাষা থেকে বাংলা ভাষার উৎপত্তি ১০০০ থেকে ১২০০ খৃষ্টাব্দের মাঝে। কোন কোন সূত্র মতে খৃষ্টিয় ৪র্থ থেকে ৭ম শতাব্দীর মাঝে পর্যায়ক্রমে। Bangla belongs to Indo-Aryan languages group.
২. শব্দ সংখ্যা (vocabulary) : ১ লাখ ১৫ হাজার (জ্ঞানেন্দ্র মোহন দাশ রচিত বাংলা অভিধান- পরিবর্ধিত ও সংশোধিত দ্বিতীয় সংস্করণ, ১৯৮৮)
সংসদ বাঙ্গালা অভিধান (সংশোধিত ও পরিবর্ধিত চতুর্থ সংস্করণ), সাহিত্য সংসদ, কলিকাতা, পঞ্চম মুদ্রণ মে ১৯৮৮) এতে ৫০ হাজারেরও অধিক শব্দ ও দুই হাজারেরও অধিক বিশিষ্টার্থ প্রকাশক শব্দসমষ্টির পরিচয় দেয়া হয়েছে।
২.১ বাংলা একাডেমী প্রকাশিত সংক্ষিপ্ত বাংলা অভিধানের ফেব্রুয়ারী ১৯৯৬- দ্বিতীয় সংস্করণের “প্রবেশক” অধ্যায় থেকে জানা যায় যে “আমাদের লেখ্য বাংলা ভাষার শতকরা প্রায় সত্তরটি শব্দই হচ্ছে অবিকৃত সংস্কৃত ভাষার শব্দ। তাছাড়াও রয়েছে সংস্কৃত শব্দের বিকৃতরূপ নিয়ে অসংখ্য শব্দ। তাই আমরা শত চেষ্টা সত্ত্বেও আমাদের বাঙলা ব্যাকরণকে যেমন নিছক বাঙলা ভাষার ব্যাকরণরূপে দাঁড় করাতে পারিনি, পারব না কখনো, তেমনি বাঙলা অভিধানকেও রাখতে হচ্ছে সংস্কৃত শব্দকোষের অনুগত। কেননা আমরা সংস্কৃত কৃৎ-তদ্ধিত প্রত্যয় আর সন্ধি-সমাস পরিহার করতে পারি না।”
২.২ অন্য এক সূত্র (Google) থেকে জানা গেল যে বাংলা ভাষার শব্দ সংখ্যা মোট এক লাখ যার বিন্যাস নিম্নরূপ-
তদ্ভব শব্দ ১৬,০০০
(Indo Aryan words)
তৎসম শব্দ ৪০,০০০
(Directly from Sanskrit)
দেশী (Native) শব্দ ১৬,০০০
অন্য ভাষা থেকে ধার নেয়া শব্দ ২৮,০০০
(Loan words) ———–
সর্বমোট ১০০,০০০
২.৩ ইতিপূর্বে উল্লিখিত বাংলা একাডেমী সংক্ষিপ্ত বাংলা অভিধানের দ্বিতীয় সংস্করণের প্রসঙ্গ-কথা থেকে জানা যায় যে সেই অভিধানে অন্তর্ভূক্ত শব্দ সংখ্যা মোট ১৯,৮৫২টি।
৩. LOAN WORDS:
৩.১ অন্য ভাষা থেকে ধার নেয়া শব্দ সমষ্টির (Loan words) মাঝে প্রচুর ইংরেজী শব্দ তো আছেই তৎসংগে আছে ইসলাম ধর্ম ও মুসলিম সংস্কৃতি থেকে গৃহীত শব্দও যার সংখ্যা প্রায় ৬ হাজার যেগুলো ধার করা হয়েছে আরবী, ফার্সী, হিন্দি ও টার্কিশ ভাষা থেকে। প্রাচীন বাংলাদেশে (সুবাহ বাংগালাহ-ফার্সী) মুসলিম মুঘল-পাঠান সম্রাট ও নবাবদের শাসনামলে গৃহীত ঐ সব শব্দ পরবর্তী বৃটিশ শাসনামলের প্রায় ২০০ বছরেও সমান দাপটে চালু ছিল। এবং আজো আছে। ইসলাম ধর্মীয় বিষয়ে যেমন, ঠিক তেমনি আইন-আদালত, ব্যবসা-বাণিজ্য, পারিবারিক ও সামাজিক জীবনের সর্বত্র সেই সব Muslim origin words বাংগালী হিন্দু-মুসলিম-খৃষ্টান-বৌদ্ধ সবার মুখেই উচ্চারিত হচ্ছে দৈনন্দিন। কিছু দৃষ্টান্ত : আইন-আদালত, থানা, দলীল, এজলাস, উকিল, উস্তাদ, আলেম-উলামা, এজমালী, কৈফিয়ৎ, খরচ, দোকান, খালাস, বাদী-বিবাদী, খুন, খুনী, গুজব, গাফিল, গালিচা, হক, হাজির, তুফান, তানপুরা, নসীব, নরম, নাপাক, ফায়সালা, তদবীর, বমাল, বয়ান, মুকদ্দমা, নালিশ, মুকাবেলা, মওজুদ (মজুদ), শরীক, শাবাশ, ইত্যাদি।
৩.২ উক্ত ছয় হাজার শব্দ নিয়ে আজ থেকে ১০০ বছর আগে এক ইংরেজ পাদ্রী একটি বইও প্রকাশ করেছিলেন : A MUSSALMANI BENGALI-ENGLISH DICTONARY By The Rev. WILLIAM GOLDSACK. (বইটার একটা কপি আমার হাতে আছে সেই ১৯৭৩ সন থেকে।)
৪. বাংলা ভাষা ও পর্তুগীজগণ/পর্তুগীজ ভাষা
৪.১ বাংলাদেশে (অতীতের বাঙ্গাঁলা বা Bengal-এ) ইউরোপীয় শক্তি বৃটিশদের পাশাপাশি পর্তুগীজগণও ১৭০০-১৮০০ খৃষ্টাব্দে ভিন্নভিন্ন এলাকায় ঘাঁটি প্রতিষ্ঠা করে ব্যবসা-বাণিজ্য করতো। পর্তুগীজরা কয়েকটা তৎকালীন যুদ্ধজাহাজ নিয়ে এক সংগে বিভিন্ন অঞ্চলে ঘুরে বেড়াতো, এবং ব্যবসা-বাণিজ্যের সংগে চুরি-ডাকাতিও করতো। বাংগালী নারী-পুরুষ-শিশুকে ধরেধরে সেই সব জাহাজে বন্দী করে অন্যত্র ক্রীতদাস (slaves) হিসাবে বিক্রি করতো। একটা ভীতিজনক, আতংকগ্রস্ত অবস্থায় দিন কাটাতো লোকেরা।
৪.২ সেই দলবদ্ধ যুদ্ধজাহাজের নাম ছিল Armada. সেই Armada থেকেই বাংলা ভাষায় সৃষ্টি হয় হার্মাদ (হারমাদ) কথাটার যার অর্থ জলদস্যু বা জল ডাকাত, অত্যাচারী।
৪.৩ কিন্তু শুনতে অবিশ্বাস্য লাগলেও সত্য যে এই হার্মাদদের সংগে খৃষ্টান ধর্ম প্রচারকারী উচ্চ শিক্ষিত পাদ্রীগণও থাকতেন যারা ধর্মের পাশাপাশি বাংলা ভাষারও চর্চা করতেন। এবং ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে সেই পর্তুগীজ পাদ্রীগণই বাংলা ভাষার সর্বপ্রথম ব্যাকরণগ্রন্থ (Grammar book) লিখে প্রকাশ করেছিলেন ১৭৪৩ খৃষ্টাব্দে যেটা পর্তুগালের রাজধানী লিসবন থেকে প্রকাশিত হয়েছিল। সেটার নাম ছিল BENGAL Vocabulary Grammar. গবেষকের নাম ছিল Manuel Da Assumpacao. তিনি ছিলেন একজন ধর্ম প্রচারক পাদ্রী। দশ বছর সময় লেগেছিল সেই কাজটা সমাপ্ত করতে।
৪.৪ সেই সব পর্তুগীজদের সংগে স্থানীয় বাংগালীদের ব্যবসা-বাণিজ্য-শিক্ষা-খৃষ্টান ধর্ম প্রচার ইত্যাদির সূত্র ধরে কিছু পর্তুগীজ শব্দও ক্রমে বাংগালীরা গ্রহণ করে নেয় এবং ব্যবহার করতে থাকে যেগুলো আজো চালু রয়েছে। বিভিন্ন বাংলা ডিকশনারী খুঁজে আমি ৩০টি শব্দের দেখা পেয়েছি যা নিম্নরূপ :
বাংলা রূপ (মূল পর্তুগীজ)
পেয়ারা (Pera)
পেরেক (Prego)
আনারস (Ananas)
আলকাতরা (Alcatrao)
কপি (Couve)
কামরা (Camara)
আচার (Achar)
ইস্পাত (Espada)
টুপি (Topo)
পাউরুটি (Pao)
পেঁপে (Papaya)
বালতি (Balde)
বেহালা (Viola)
ইস্তিরি (Estirar)
গামলা(Gamella)
জানালা (Janella)
গির্জা (Igreja)
গুদাম (Gudao)
আয়া (Aya)
ইংরেজ (Engrez)
যীশু খ্রীষ্ট (Jisu Cristo)
আলমারি (Armario)
বোতাম (Botao)
সাবান (Sabao)
কেরাণী/কেরানি (Escrevente)
কামিজ (Camisa)
পাদ্রী (Padre)
বোমা (Bomba)
বোতল (Botelha)
হার্মাদ/হারমাদ (Armada)
৫. বর্ণমালা (Alphabets)
৫.১ বাংলা বর্ণমালাতে ইংরেজী ভাষার মত স্বরবর্ণ (vowels) এবং ব্যাঞ্জনবর্ণ (consonants)ও আছে। স্বরবর্ণের সংখ্যা ১১টি এবং ব্যাঞ্জনবর্ণের সংখ্যা ৩৬টি। সর্বমোট ৪৭টি। উল্লেখ্য যে ‘ক্ষ’ অক্ষরটা একটা যুক্তাক্ষর (ক+ষ)।
এই যুক্তাক্ষর “ক্ষ”-টা হিন্দি ভাষাতেও আছে তবে সেটার উচ্চারণ সম্পূর্ণ ভিন্ন। হিন্দিভাষীরা ক ও ষ দু’টিই আলাদা-আলাদাভাবে বলে থাকে।
৫.২ বাংলায় লিখিত শব্দগুলোর সঠিক উচ্চারণে সাহায্য করার জন্য স্বরচিহ্ন আছে ২৫টি। যথা : আ-কার (া), ই-কার ()ি, এ-কার ()ে, র-ফলা ( ্রা), রেফ (র্ ), রি-কার ( ৃ), য-ফলা (্য) ইত্যাদি।
৬. বাংলাভাষায় কত লোক কথা বলে?
৬.১ বাংলাদেশ (১৭৪ মিলিয়ন), ইন্ডিয়ার ওয়েস্ট বেংগল এবং ত্রিপুরা রাজ্যের (১১০ মিলিয়ন) লোক বাংলা ভাষায় কথা বলে। একই বর্ণমালা, grammarও একই, তবে উচ্চারণ ভংগী ভিন্নভিন্ন।
৬.২ ২০২৫ সনের শুরুতে পৃথিবীর জনসংখ্যা ছিল ৮.২৩ বিলিয়ন। ভাষা ভিত্তিক লোকসংখ্যা ছিল নিম্নরূপ।
Top 11 languages spoken all over the world: (Google search):
১. ইংলিশ ১.৫ বিলিয়ন
২. ম্যান্ডারিন চাইনীজ ১.২ বিলিয়ন
৩. হিন্দি ৬০৯ মিলিয়ন
৪. স্প্যানীশ ৫৫৮ মিলিয়ন
৫. স্ট্যান্ডার্ড এরাবিক ৩৩৪ মিলিয়ন
৬. ফ্রেঞ্চ ৩১২ মিলিয়ন
৭. বাংলা (বেংগলী) ২৮৪ মিলিয়ন
৮. পর্তুগীজ ২৬৭ মিলিয়ন
৯. রাশ্যান ২৫৩ মিলিয়ন
১০. ইন্দোনেশিয়ান ২৫২ মিলিয়ন
১১. উর্দু ২৪৬ মিলিয়ন
৬.৩ সর্বাধিক সংখ্যক লোকেরা কথা বলে তেমন ভাষাগুলোর মাঝে বাংলা ভাষার স্থান পৃথিবীতে ৭ম (সপ্তম)।
৬.৪ ইন্ডিয়ার প্রধান প্রধান ভাষাগুলোর মাঝে বাংলা ভাষাটা শেখা তুলনামূলকভাবে সহজতর এবং ভাষাটা মিষ্টিও বটে। (Source: Google)
৬.৫ বাংলা অক্ষর জ্ঞান অথবা বাংলা গ্রামারের জ্ঞান ছাড়াই spoken Bengali (কথ্য বাংলা) শেখানোর সহজ পদ্ধতি উদ্ভাবন করে আমেরিকার AMAZON company ৭২ পৃষ্ঠার একটা বই পাবলিশ করেছে। সেটার একটা কপি আমাকে একজন গিফ্ট দিয়েছে। আগাগোড়া বইটা আমি পড়েছি। অতি সহজ পদ্ধতি। Colorful book. নির্দিষ্ট কোন শিক্ষকের প্রয়োজন নেই। যে কোন বাংলা-ইংরেজী জানা একজনকে দেখালেই সে শিখিয়ে দিতে পারবে। বইটার নাম :
MY FIRST 1000 WORDS
BENGALI (BENGALI-ENGLISH)
LEARN BENGALI
FOR BEGINNERS
৬.৬ ম্যান্ডারিন চাইনীজ ভাষায় বাংলাদেশকে বলা হয় Meng Jia la guo (মেংজিয়ালা গো)। guo অর্থ দেশ অথবা জাতি।
৭. নোবেল প্রাইজ, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস এবং অমর একুশে ফেব্রুয়ারী ১৯৫২।
৭.১ আপন মেধা ও কৃতিত্বের স্বীকৃতি আদায় করে নিয়েছে বাংগালীরাও। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (সাহিত্য, ১৯১৩), অমর্ত্য সেন (১৯৯৮), ডঃ মুহাম্মাদ ইউনুস (বাংলাদেশ) (২০০৬) এবং অভিজিৎ ব্যানার্জী (২০১৯) বিভিন্ন বিষয়ে নোবেল প্রাইজ বিজয়ী হয়ে বাংগালী জাতিকে গর্বিত করেছেন।
৭.২ ১৯৫২ সনের ২১শে ফেব্রুয়ারী মাতৃভাষা বাংলার ন্যায্য দাবীকে প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে ঢাকার রাজপথে পুলিশের রাইফেলের গুলিতে ইউনিভার্সিটির ছাত্রদের প্রাণ দানের ফলেই একদিকে যেমন পরবর্তীকালে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা (১৯৭১), অন্যদিকে তেমনি ২০০০ সন থেকে United Nations-এর উদ্যোগে পৃথিবীর সব দেশে প্রতি বছর International Mother Language Day প্রতিপালনেরও গোড়া পত্তন ঘটে।
৭.৩ অমর হয়ে থাকবে একুশে ফেব্রুয়ারী ১৯৫২ সন তারিখটা। প্রতিটি বছর এক মাস ব্যাপী একুশে ফেব্রুয়ারী বইমেলা তো বাংলাদেশীদের জন্য এক আনন্দোৎসব যে মেলা যুগযুগ ধরে বাংলা লেখক ও পাঠককূল সৃষ্টি করে যাচ্ছে। বাংলা একাডেমী, ঢাকা, এই বইমেলার আয়োজন করে থাকেন। পশ্চিম বংগের (ইন্ডিয়ার) বাংগালীরাও এতে যোগ দেন।
৭.৪ অতীতে দুর্নাম ছিল যে বাংগালীরা ভেতো বাংগালী (অর্থাৎ ওরা শুধু ভাত খায়), ওরা ঘরকুনো ভীতু বাংগালী (অর্থাৎ ঘরের কোনায়, দেশেগ্রামেই শুধু বাস করতে ভালোবাসে, দেশের বাইরে যেতে ভয় পায়, ওরা ভীতু)। কিন্তু সেই দুর্নাম বাংগালীরা ঝেড়ে ফেলে দিয়েছে বহু যুগ আগেই। বর্তমানের ছেলেরা তো বটেই, এমন কি মেয়েরাও শিক্ষাদীক্ষা নিয়ে নির্ভয়ে দলেদলে দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে প্রতিদিন। পৃথিবীর এমন কোন দেশ নেই যেখানে হাজার হাজার বাংগালী নেই। ওরা দেশের জন্য বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের মূল্যবান Foreign Exchange earners ওদের পাঠানো আয়ের ডলার বাংলাদেশকে অগ্রগতির দিকে ঠেলে দিচ্ছে। বাংগালীরা বর্তমানে ভাত তো খায়ই, অন্য দেশের সব অপরিচিত খাদ্যকেও আপন করে নিয়েছে। একই সংগে ওরা করে বাংলা ভাষা চর্চাও। উৎসব-অনুষ্ঠান করে যাচ্ছে দেশে ১লা বৈশাখ, একুশে ফেব্রুয়ারী, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, ঈদ উৎসব, হিন্দু-বৌদ্ধদের ধর্মীয় অনুষ্ঠান। নাচ-গান দিয়ে বাংগালী ভাষা ও সংস্কৃতির চর্চা সারাটি বছর ধরে। মাধ্যম বাংলা ভাষা। বিদেশীরা পরিচিত হচ্ছে বাংলা ভাষা ও বাংগালী সংস্কৃতির সংগে। বীরের মত এগিয়ে চলেছে পৃথিবীর শত দেশে বাংগালীরা। গাইছে, শোনাচ্ছে বাংলা গান- আমার সোনার বাংলা; আমার ভাইয়ের রক্তে রাংগানো একুশে ফেব্রুয়ারী; জয় বাংলা বাংলার জয়; সাদা সাদা, কালা কালা; ভ্রমর কইও গিয়া; কতদিন পরে এলে একটু বসো; তোমারে লেগেছে কত যে ভালো; যে পাখি ঘর বোঝে না, এবং আরো কত শত নাচ-গান-নাটক।
৮. ইন্ডিয়ার বর্তমান জনসংখ্যা প্রায় ১৫০০ মিলিয়ন, ওদের ব্যবহৃত প্রধান ভাষা হিন্দি। ২৯টি রাজ্য (ংঃধঃব), এবং ৮টি ইউনিয়ন টেরিটোরিজ। ১২টি প্রধান ভাষা। সেখানে হিন্দি ভাষার (৬০৯ মিলিয়ন) পরই বাংলা ভাষার স্থান; সে ভাষায় ১১০ মিলিয়ন (১১ কোটি) লোক কথা বলে থাকে। ওয়েস্ট বেংগল ও আগরতলা রাজ্যে। রাজধানী কলকাতা থেকে প্রতিবছর গড়ে ১০০টি বাংলা মুভি রিলিজ করা হয়। কলকাতাতে সর্বপ্রথম বাংলা সবাক মুভি তৈরী হয় ১৯৩১ সনে। নাম : “জামাই ষষ্ঠী”। দ্বিতীয়টির নাম ছিল “দেনা পাওনা”।
৮.১ অন্যদিকে প্রায় ১৮০ মিলিয়ন (১৮ কোটি) বাংগালীর বাসভূমি বাংলাদেশে প্রতি বছর গড়ে ৫১টি বাংলা মুভি রিলিজ করা হয়। বাংলাদেশের সর্বপ্রথম মুভি “মুখ ও মুখোশ” ১৯৫৬ সনে নির্মিত হয়।
৯. বাংলা ভাষায় সর্বপ্রথম Color movie তৈরী করেছিলেন কলকাতা থেকে সত্যজিৎ রায় ১৯৬২ সনে। ফিল্মটার নাম ছিল “কাঞ্চন জংঘা।” সত্যজিৎ রায় OSCARS Film Prize-ও জিতেছিলেন চলচ্চিত্রে তার সার্বিক অবদানের জন্য।
৯.১ বাংলাদেশে নির্মিত “হাওয়া” মুভিটা ২০২২ সনে OSCARS Prize-এর জন্য nomination পেয়েছিল বটে কিন্তু শেষ পর্যন্ত প্রাইজটা জিততে পারেনি। চঞ্চল চৌধুরী ছিলেন নায়ক, নায়িকার ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন নাজিফা তুশি।
সেই মুভির “সাদা সাদা, কালা কালা, রঙ জমেছে সাদা-কালা” গানটা খুব জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল।
১০. United Nations-এর Peace Keeping Agency’র তত্ত্বাবধানে বহু বাংলাদেশী মিলিটারী পারসোনেল পৃথিবীর বিভিন্ন যুদ্ধরত দেশে শান্তি রক্ষার কাজটা অতি নিষ্ঠা এবং সুনামের সংগে করে যাচ্ছে বহুদিন ধরেই। তাদেরই একটি Peace Keeping Unit আফ্রিকার সিয়েরা লিওন রাজ্যে রক্তক্ষয়ী সিভিল ওয়ার বন্ধ করে সেদেশে শান্তি-শৃংখলা পুনঃপ্রতিষ্ঠার কাজে এমনি সুনাম অর্জন করেছিল যে সেদেশের সরকার তাঁদের কৃতজ্ঞতার স্বাক্ষর স্বরূপ বাংলা ভাষাকে ওদেশের Honorary official language হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছে ২০০২ সন থেকে।
১১. আমি তোমাকে ভালোবাসি
১১.১ হিন্দি-উর্দুভাষীরা বেংগল কথাটাকে সচরাচর “বাংগাল” বলে উচ্চারণ করে থাকে। যথা West Bengalকে ওরা বলে “পচ্চিম বাংগাল” অর্থাৎ বাংলা। বাংলা ভাষায় “বাংগাল” কথাটার অর্থ অশিক্ষিত গ্রামবাসী। কিন্তু হিন্দি-উর্দুওয়ালারা তো সেই অর্থটা জানে না।
১১.২ আজ থেকে প্রায় ৪০ বছর আগে ইন্ডিয়ার বিখ্যাত বলিউড মুভি স্টার অমিতাভ বচ্চন কোন একটা হিন্দি মুভির সংলাপে বলেছিলেন “আমি তোমাকে ভালোবাসি”। কথাটা তিনি বুঝেশুনেই বলেছিলেন কারণ তাঁর স্ত্রী জয়া ভাদুরী একজন বাংগালী মহিলা। অমিতাভ বচ্চন বাংলা জানেন, বোঝেন। কথাটা হিন্দিওয়ালাদের খুব পছন্দ, যদিও সেটার অর্থটা ওরা জানে না। তাই বাংগালীদের সংগে কথাবার্তা বলার সময় fun হিসাবে বলে ফেলে “আমি তোমাকে ভালোবাসি!”
এমনি পরিস্থিতির সম্মুখীন অতীতে আমিও হয়েছি একাধিকবার। একদিন টরন্টো সিটিতে এক ফাংশানে পরিচিতা এক ইন্ডিয়ান হিন্দিভাষী মহিলা আমাকে বললেন যে তিনি বাংলা ভাষা জানেন। হেসে বললাম, “খুশী হলাম সেকথা জেনে। এবার একটা কিছু বাংলা ভাষাতে বলুন তো”।
হেসে দিয়ে তিনি বললেন, “আমি তোমাকে ভালোবাসি!”
শুনে তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, “যা বললেন সেটার অর্থ জানেন?”
মাথা নাড়িয়ে বললেন, “না।”
বললাম, ‘What you said means, “I love you.”
আমার কথা শুনে মহিলার মুখটা লজ্জায় লাল হয়ে গেল। অর্থ না জেনে কথাটা বলার জন্য লজ্জিত হলেন। বললেন, ”Very sorry. It’s a good lesson for me. In future, I must be careful before I open my mouth about anything without knowing its meaning first. Thank you.”
১২. আমাদের বাংলাদেশী মুদ্রা টাকা কথাটার উৎপত্তি সংস্কৃত টঙ্ক/টঙ্কা থেকে।
১২.১ আমরা বাংগালীদের নিত্যব্যবহার্য তিন বস্তু- গেঞ্জি, লুংগী, গামছা- এরাও কিন্তু সবাই বাংলা নয়। গেঞ্জি কথাটার উৎপত্তি ইংরেজী guernsey থেকে, লুংগী কথাটা আমরা ধার করেছি বার্মিজদের জাতীয় পোশাক “লাউন্জি” থেকে। তবে গামছাটা বাংলা বটে। “গা মুছিবার টুকরা কাপড়”এর সংক্ষিপ্ত রূপ হলো গামছা।
রাস্তাঘাটে যখন দাবীদাওয়া নিয়ে strike চলে, অফিস, দোকানপাট বন্ধ থাকে, আমরা তখন বলি “হরতাল” চলছে। কথাটা আমরা ধার করেছি ইন্ডিয়ার গুজরাটি ভাষা থেকে। আমাদের কাগজ, কলম, হিসাব, কিতাব, দোকান, নগদ, বাকি, শুরু, মুনাফা, লোকসান এরা সবই মূলতঃ আরবী ভাষার শব্দ।
কিন্তু এতে আমরা লজ্জিত নই। পৃথিবীতে শক্তিশালী যত ভাষা রয়েছে তারা সবাই ভিন্নভিন্ন ভাষা থেকে অগণিত শব্দ ধার করে আরো শক্তিশালী হচ্ছে। ভাষাটা একটা চলমান প্রক্রিয়া, সে কখনো স্থবির নয়।
১৩. সাধু ভাষা ও চলিত ভাষা
বাংলা ভাষাটা প্রকাশের দু’টি রূপ- সাধু বাংলা (ভাষা) এবং চলিত বাংলা (ভাষা)। অতীতে সাধু ভাষার প্রচলন ছিল কিন্তু প্রয়োজনের দাবী মিটাতে গিয়ে সেটার রূপান্তর ঘটেছে। সহজতর চলিত বাংলার প্রচলন ঘটেছে- বলাতে যেমন, লেখাতেও তেমনি। বর্তমানে আমরা বাংগালীরা চলিত বাংলা ভাষাটাই ব্যবহার করে থাকি। ব্যবধানটা বোঝানোর জন্য নীচে কয়েকটা উদাহরণ দেয়া হলো।
অতীতের সাধু বাংলা ভাষা বর্তমানের চলিত বাংলা ভাষা
১. আমি ইহা করিতে পারিব না। ১. আমি এটা করতে পারবো না।
২. দ্রব্যমূল্য ক্রমশঃ বৃদ্ধি পাইতেছে। ২. দ্রব্যমূল্য ক্রমেই বাড়ছে।
৩. তুমি এমন করিতেছ কেন? ৩. তুমি এমন করছ কেন?
৪. অনবরত বৃষ্টি পড়িতেছে। ৪. অনবরত বৃষ্টি পড়ছে।
৫. কোথায় যাইতেছেন? ৫. কোথায় যাচ্ছেন?
৬. দিনগুলি ফুরাইয়া গেল। ৬. দিনগুলো ফুরিয়ে গেল।
৭. দেখিতে দেখিতে সন্ধ্যা হইয়া গেল। ৭.দেখতে দেখতে সন্ধ্যা হয়ে গেল।
৮.গাছের পাতাগুলির রং বদলাইয়া যাইতেছে। ৮.গাছের পাতাগুলোর রং বদলে যাচ্ছে।
আর আমাদের বাংলাদেশের মূল ভাষাটা বাংলা বটে কিন্তু দেশের জেলায় জেলায় চালু রয়েছে জেলাভিত্তিক বৈচিত্র্যেভরা মজাদার সব আঞ্চলিক টানের বাংলা ভাষা। যেমন- পুরানো ঢাকার কুট্ট্রিদের ভাষা। এছাড়াও রয়েছে নোয়াখালী, বরিশাল, চট্রগ্রাম, সিলেট, রংপুর, বগুড়া ইত্যাদি অঞ্চলের আঞ্চলিক টানের বাংলা ভাষা।
সাইদুল হোসেন
মিসিসাগা