বেইজিং-এর স্মৃতিকথা
(পর্ব-৬)
কাজী সাব্বির আহমেদ
আমরা যখন বেইজিং-এ আসি তখন সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি। সেই সময়ে ঢাকার আবহাওয়া গরম হলেও বেইজিং-এ তখন শীত আসি আসি করছে। আমাদেরকে বেইজিং-এর শীতের তীব্রতা সম্পর্কে ঢাকাতেই চীনা দূতাবাস থেকে সতর্ক করে দেয়া হয়েছিল। তখন তাতে তেমন গা করিনি। কারণ রংপুর ক্যাডেট কলেজে পড়ার সুবাদে আমি দীর্ঘ ছয়টি বছর বাংলাদেশের অন্যতম শীতের অঞ্চল রংপুরে কাটিয়ে এসেছি। রংপুরের সেই হাড় কাঁপানো শীতের ভোরে খোলা মাঠে পিটি প্যারেড করেছি। শীতের রাতে আমাদের হোস্টেলের রুমে কোন হিটিং-এর ব্যবস্থা ছিল না। শীতকালে আমাদেরকে দু’টো করে কম্বল দেয়া হতো। তাতেই মনে করেছিলাম যে শীতকে আমি জয় করে এসেছি। আসলে আমরা যারা গরমের দেশ থেকে এসেছি তারা বেইজিং-এর সেই শূন্যের নীচে পনের কিংবা বিশ ডিগ্রী সেলসিয়াসের শীতের তীব্রতা কখনই কল্পনা করতে পারব না। হাড় কাঁপানো শীত যে কী জিনিষ সেটা বেইজিং-এ আসার পর হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি। শীতকালে বেইজিং-এ সাইবেরিয়া থেকে ঠান্ডা বাতাস আসে। হু হু করে সেই বাতাস যখন বয়ে যায় তখন চেনা জায়গাকেও অচেনা লাগে। মনে হয় পৃথিবীর বাইরে অন্য কোন গ্রহে এসে পড়েছি। এই পরিস্থিতিতে সিনিয়ার স্টুডেন্টরা আমাদেরকে আশ্বাস দিলেন যে, পর্যাপ্ত গরম কাপড় পরে বাইরে বেরুলে আর শীতকে মোকাবিলা করার কিছু কৌশল জানা থাকলে ভয়ের কিছু নেই। তারা আমাদেরকে এই বলে অভয় দিলেন যে, দেখতে দেখতে শীত কেটে যাবে এক সময়। আর উপদেশ দিলেন শীতেরও যে একটা আলাদা সৌন্দর্য্য এবং প্রাণ-চাঞ্চল্য রয়েছে সেটাকে উপভোগ করার। শীতের সৌন্দর্য্য হচ্ছে তুষারপাত। আর প্রাণ-চাঞ্চল্য হচ্ছে উইন্টার স্পোর্টস যেমন আইস স্কেটিং। কালক্রমে এই দুটোরই অভিজ্ঞতা আমার হয়েছিল। তাই বেইজিং-এর শীতকে আমার কাছে তেমন ভয়াবহ কিছু মনে হয়নি। বরং বেইজিং-এর শীতকালকে উপভোগ করেছি আলাদাভাবে।
একজন বাংলাদেশীর জন্য জীবনের প্রথম তুষারপাত দেখাটা এক অনন্য অভিজ্ঞতা। বাংলাদেশ গ্রীষ্ম প্রধান দেশ হওয়াতে এদেশের কোথাও তুষারপাত হয় না। তাই তুষারপাতের শ্বেতশুভ্র দৃশ্যপট নিয়ে প্রতিটি বাংলাদেশীর মানসপটে রয়েছে এক ধরনের ফ্যান্টাসি। তুষারপাতের দৃশ্যপট যে অদ্ভুত রকমের সুন্দর হতে পারে সেটি আমাদের মননে প্রথম প্রবেশ করিয়ে দেন রম্য লেখক সৈয়দ মুজতবা আলী। তার রচিত ‘দেশে বিদেশে’-এর অংশ বিশেষ ‘প্রবাস বন্ধু’ শিরোনামে ক্লাস নাইনে আমাদের পাঠ্য ছিল। সেখানে লেখকের ভৃত্য আব্দুর রহমান তার নিজ শহর পানশিরের তুষারপাতের এত সুন্দর বর্ণনা দিয়েছে যেন শুধু ভূ-স্বর্গেই এমনতর তুষারপাতের দেখা পাওয়া যেতে পারে। তাই বেইজিং-এর শীতের শুরু থেকেই গভীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষাই আছি কবে সেই কাঙ্ক্ষিত তুষারপাতের দেখা পাব। অবশেষে সেই প্রত্যাশিত মূহুর্তটি এলো একদিন। ক্যালেন্ডারে সেদিনের তারিখটি ছিল ৩০শে অক্টোবর, ১৯৮৭। বেইজিং ল্যাংগুয়েজ ইনস্টিটিউট থেকে আমরা কয়েকজন মিলে আমাদের বাংলাদেশ অ্যাম্বাসীর এক অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম। অনুষ্ঠান শেষ হতে হতে রাত হয়ে গেল। বাইরে এসে দেখি গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে। হোস্টেলে ফেরার জন্য আমাদেরকে বেশ কিছুদূর হেঁটে সাবওয়ে নিতে হবে প্রথমে। সেই হাঁটার মাঝেই টের পেলাম যে বৃষ্টির ফোঁটা গুলো ধীরে ধীরে তুষারকণায় পরিণত হয়ে যাচ্ছে। আর সেগুলো ফুটপাতের উপর জমা হয়ে হাল্কা এক শুভ্র আস্তরণের সৃষ্টি করছে। ল্যাম্পপোষ্টের আলোয় সেই তুষারপাতের দৃশ্য দেখে মনে হচ্ছিল এটা অন্য কোন এক পৃথিবীর দৃশ্য। অদ্ভূত সুন্দর এই দৃশ্যটিকে আমরা কেউই মিস করতে চাচ্ছিলাম না। তাই পাতাল ট্রেনে না চড়ে আমরা ট্যাক্সি নিলাম। আমরা যখন আমাদের হোস্টেলে এসে পৌঁছলাম তখন নরম ভেজা ভেজা তুষারে ডুবে যাচ্ছে পায়ের গোড়ালি অব্দি। দেখি চারিদিকে ভীড়। আমাদের মতন অনেক দেশের ছাত্রদের জন্যও হয়ত এটা প্রথম তুষারপাত। তাই ছবি তোলার ধুম পড়ে গেছে চারিদিকে। শিশুদের মতন স্নো বল বানিয়ে বড়রাও মেতে উঠেছে সেই বল ছুড়াছুড়িতে। চারিদিকে নির্মল আনন্দ ছড়িয়ে পড়েছে এই তুষারপাত উপলক্ষ্যে। বেশ রাত অবধি আমরা বাইরেই কাটিয়ে দিয়েছিলাম সেদিন।
চীনের উইন্টারের একটি বিশেষ আকর্ষণ হচ্ছে আইস স্কালপচার বা বরফের তৈরি ভাস্কর্যের প্রদর্শনী। এই প্রদর্শনী অবশ্য শুরু হয়েছিল চীনের সবচেয়ে ঠাণ্ডা প্রদেশ হেইলোংচিয়াং-এর রাজধানী হারবিন শহরে। ১৯৬৩ সালে স্থানীয় কিছু শিল্পীর উদ্যোগে হারবিন-এর ট্রাওলিন পার্কে তাদের তৈরি আইস স্কালপচারের প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়। রাতের বেলায় অনুষ্ঠিত এই প্রদর্শনীতে বরফের তৈরি ভাস্কর্যগুলিকে বিভিন্ন রঙের আলোর মাধ্যমে সাজিয়ে এক অপার্থিব বর্ণিল পরিবেশ তৈরি করা হয়। সম্পূর্ণ নতুন ধরনের এই প্রদর্শনী খুব সহজেই সাধারণ মানুষের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠে। ফলে পরবর্তী বছরগুলিতে অন্যান্য প্রদেশের ভাস্কররাও এই প্রদর্শনীতে অংশ গ্রহণের জন্য আগ্রহী হয়ে উঠে। কিন্তু কালচারাল রেভ্যুলেশনের সময় এই প্রদর্শনী বন্ধ হয়ে যায়। ১৯৭৬ সালে মাও সেতুং-এর মৃত্যুর পর আবারও এই প্রদর্শনী শুরু হলেও সেটি ছিল অনিয়মিত। কিন্তু ১৯৮৫ সাল থেকে এই প্রদর্শনীকে একটি বাৎসরিক ইভেন্টে পরিণত করা হয়। তখন থেকে শুধু দেশীয় ভাস্কর নয় বিদেশী ভাস্কররাও এসে যোগ দিতে শুরু করে হারবিন-এর ট্রাওলিন পার্কের এই প্রদর্শনীতে। কালক্রমে হারবিনের এই প্রদর্শনীটি পৃথিবীর সবচেয়ে বৃহৎ আইস স্কালপচার প্রদর্শনী হিসেবে স্বীকৃতি পায়। আরও একটা মজার তথ্য এই যে ২০০৭ সালে চীনের কম্যুনিস্ট পার্টিতে কানাডিয়ান সার্জেন নরম্যান বেথুন-এর অবদানকে স্মরণ করে এই প্রদর্শনীর মূল স্কালপচারটি ‘কানাডিয়ান’ থিমের উপর নির্মিত হয়। আড়াই শত মিটার প্রশস্ত আর সাড়ে আট মিটার উঁচু সেই ‘কানাডিয়ান’ থিমের আইস স্কালপচারটি সেই সময়ে গিনেস বুক অব রেকর্ডে বিশ্বের সবচেয়ে বড় আইস স্কালপচার হিসেবে বিবেচিত হত। হারবিনের আইস স্কালপচার প্রদর্শনীর অনুকরণে ১৯৮৭ সাল থেকে বেইজিং শহরের অদূরে লোংছিংশিয়া নামক স্থানেও আইস স্কালপচার প্রদর্শনী শুরু হয়। ১৯৮৮ সালে আমার সৌভাগ্য হয়েছিল লোংছিংশিয়া-র সেই আইস স্কালপচার প্রদর্শনী দেখার। আমি তখন বেইজিং পোস্ট এন্ড টেলিকম্যুনিকেশন ইউনিভার্সিটির ফার্স্ট ইয়ারের ছাত্র। উইন্টারের এক সন্ধ্যায় ইউনিভার্সিটির সব ফরেন স্টুডেন্টদেরকে নিয়ে যাওয়া হয় সেই প্রদর্শনীতে। আমার স্মৃতিপটে সেই বর্ণিল সন্ধ্যাটি এখনও ভাস্বর হয়ে আছে।
বেইজিং-এর প্রথম উইন্টার আমাদেরকে অনেক নতুন নতুন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি করেছিল। যেমন সাব-জিরো টেম্পারেচার। এই টেম্পারেচারে বাইরের জগতটা আক্ষরিক অর্থেই একটা রেফ্রিজারেটরে রূপান্তরিত হয়। আর সেই ভয়াবহ উইন্টারের প্রাত্যহিক জীবনের সাথে সামারের জীবনের রয়েছে বিস্তর ফারাক। পোশাক-আশাক, খাওয়া-দাওয়া থেকে শুরু করে অন্যান্য চালচলনে এই পার্থক্য সহজেই চোখে পড়ে। শীতকালে যে শুধু একটা মোটা জ্যাকেট পরলেই ঝামেলা চুকে যাবে তা কিন্তু নয়। পোশাক পরতে হয়ে লেয়ার বাই লেয়ার। যেমন, প্যান্টের নীচে ‘লং জনস’ বা থার্মাল আন্ডারওয়্যার সেই সাথে মুখে বালাকলাভা। বালাকলাভা হচ্ছে এক ধরনের টুপি যা কিনা মাথা থেকে গলা পর্যন্ত ঢেকে রাখে শুধুমাত্র চোখদুটি ছাড়া। আমাদের দেশে আমরা এই ধরনের টুপিকে ‘মাঙ্কি ক্যাপ’ও বলে থাকি। উইন্টারের সময় হাতে দস্তানা, মাথায় ক্যাপ আর বালাকলাভা দিয়ে মুখ ঢেকে যখন বাইরে বেরুতাম তখন মনে হতো আমি তো নই বরং দস্যু বনহুর বেরিয়েছে কোন এক অভিযানে। শীতে বেইজিং-এর মানুষের খাওয়ার মেন্যুতে যোগ হয় ফারমেন্টেড নাপা ক্যাবেজ। উইন্টারের শুরুতেই দেখা যায় যে প্রায় প্রতিটি বাড়ীর ব্যালকনিতে পালা দিয়ে রাখা হয়েছে এই নাপা ক্যাবেজ যাকে চাইনিজে বলে ‘পাইছাই’। সাব-জিরো টেম্পারেচারে এগুলি বাইরে থাকে, প্রয়োজন মতন তারা সেগুলিকে ব্যালকনি থেকে নিয়ে রান্না করে খায়। চালচলনের পরিবর্তনের ভেতর রয়েছে আউটডোর খেলাধুলা যেমন বাস্কেটবল, ভলিবল কিংবা ফুটবল এগুলি বন্ধ। এর বদলে শুরু হয় উইন্টার স্পোর্টস। আমাদের ল্যাংগুয়েজ ইনস্টিটিউটের লাগোয়া এক পুকুরের পানি যখন সাব-জিরো টেম্পারেচারে জমে পুরোপুরি শক্ত বরফে পরিণত হলো তখন সেখানে শুরু হয়ে যায় আইস স্কেটিং। বিকেল তিনটা থেকে পাঁচটা পর্যন্ত খোলা থাকত সেই চত্বর। টিকেট কেটে ঢোকার সময় ওদের কাছ থেকেই স্কেটিং-এর জুতো নেয়া যেত। আমরা কয়েকজন ফরেন স্টুডেন্ট নিয়মিত যাওয়া শুরু করলাম এই আইস স্কেটিং-এর চত্বরে। হাঁটি হাঁটি পা পা করে হাঁটা শেখার মতন করে এক-পা দু-পা করে আস্তে আস্তে স্কেটিং-ও শিখে ফেললাম কিছুদিনের ভেতর। নতুন একটা স্কিল রপ্ত করার প্রবল উত্তেজনায় প্রায় প্রতিদিনই ছুটে যেতাম সেখানে। শীত শেষে যখন স্কেটিং বন্ধ হয়ে গেল তখন মনে মনে ঠিক করলাম প্রতি শীতেই স্কেটিং করব। কিন্তু পরবর্তী উইন্টারগুলোতে কিছুটা লেখাপড়ার চাপে আর বাকীটা আলসেমির কারণে চীনের জীবনে এই স্কেটিং আর করা হয়ে উঠেনি। প্রায় তিরিশ বছর পর কানাডার অন্টারিও প্রভিন্সের ব্লু-মাউন্টেন রিসোর্টে গিয়ে যখন দেখি সবাই স্কেটিং করছে তখন আমারও ইচ্ছে হয়েছিল ওদের সাথে যোগ দিতে। কিন্তু সাহস হচ্ছিল না। আমার মনে হচ্ছিল আমি স্কেটিং করা পুরোপুরি ভুলে গেছি। একেই বলে অনভ্যাসে বিদ্যানাশ।

আমাদের দেশে সারা বছরে ঘড়ির কাঁটার হিসেবে সময়ের কোন পরিবর্তন হয় না। চীনে এসে দেখলাম এরা বছরে দুইবার ঘড়ির কাঁটা আগে-পিছে করে সময় পরিবর্তন করে। ইউরোপে এবং পশ্চিমা দেশগুলিতেও একই নিয়ম চালু আছে। এই নিয়ম অনুযায়ী শীতের আগে আগে অর্থাৎ ‘ফল’ সিজনে ঘড়ির কাঁটাকে এক ঘণ্টা পিছিয়ে দেয়া হয় যাকে কিনা বলা হয় ‘ফল ব্যাক’। আর স্প্রিং-এর আগমনে হয় ‘স্প্রিং ফরওয়ার্ড’ অর্থাৎ ঘড়ির কাঁটাকে এক ঘণ্টা এগিয়ে দেয়া হয়। পশ্চিমাদের অনুকরণে বাংলাদেশে অবশ্য একবার এই নিয়ম চালু করেছিল ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’-এর সরকার। জনগণ কিন্তু এই সময় পরিবর্তনকে মেনে নেয়নি। তারা নতুন প্রবর্তিত সময়কে ‘ডিজিটাল টাইম’ আর আগের সময়কে ‘অ্যানালগ টাইম’ বলে তাদের প্রাত্যহিক জীবনকে চালিয়ে নিত। ফলে এক সময়ে কোন ঘোষণা ছাড়াই ‘ডিজিটাল টাইম’-এর বিলুপ্তি ঘটে বাংলাদেশে। সময়ের এই পরিবর্তনে বেইজিং-এ শীতকালে দিনের দৈর্ঘ্য এতটাই কমে যায় যে বিকেল পাঁচটার সময় চারিদিক আঁধার করে সন্ধ্যা নামে। আবার সূর্য উঠতে উঠতে বেলা বেজে যায় সাতটা। শীতের রাতগুলি হয় দীর্ঘ। দীর্ঘ রাতগুলিকে পার করার উপায় হিসেবে আমরা বেছে নিলাম আড্ডার আশ্রয়। উইকএন্ডগুলোতে সিনিয়ার স্টুডেন্টরা আমাদেরকে তাদের ইউনিভার্সিটিতে দাওয়াত দিতেন ডিনারের জন্য। ততদিনে আমাদের সবারই সাইকেল কেনা হয়েছে। ফলে স্বল্প দূরত্বে অবস্থিত তাদের ইউনিভার্সিটিগুলিতে যেতে আমাদের তেমন বেগ পেতে হতো না। সাধারণত ডিনার সারা হত ডাইনিং হলে। কেউ কেউ আবার আমাদের জন্য রান্নার আয়োজন করতেন। ডিনারের পর শুরু হতো আড্ডা। অনেক সিনিয়র স্টুডেন্টদের রুমে ছিল ভিসিআর। সেখানে আমরা দেখতাম হলিউডের সিনেমা। ছুটিতে হংকং থেকে অনেকেই হলিউডের লেটেস্ট মুভিগুলির ক্যাসেট কিনে আনতো আর সেই ক্যাসেটগুলি হোস্টেলের স্টুডেন্টদের হাতে হাতে ঘুরত।
দেশে থাকতে আমি কখনই সিনেমার পোকা ছিলাম না। ক্যাডেট কলেজে আমাদেরকে মাঝে মাঝে প্রজেকটরে ভারতীয় বাংলা সিনেমা দেখানো হতো। ম্যাট্রিক পরীক্ষার ছুটিতে ক্যাডেট কলজের রুমমেট ফয়সলের সাথে অভিসার সিনেমা হলে দেখেছিলাম হলিউডের ছবি ‘ম্যাকানাস গোল্ড’। এ ছাড়াও ব্রুস লী অভিনীত বেশ কিছু মার্শাল আর্টসের ছবিও দেখা হয়েছিল। বেইজিং যাওয়ার পর প্রথম যে সিনেমাটি দেখি সেটি ছিল ‘দ্য শাওলিন টেম্পল’। বেইজিং ল্যাংগুয়েজ ইনস্টিটিউটের একটি অডিটরিইয়ামে আমাদের ভাষা শিক্ষার ক্লাস থেকে দেখানো হয় এই সিনেমা। অনেকটা ক্যাডেট কলেজে যেমনটি আমাদেরকে দেখানো হতো। এই মুভিতে দেখানো হয় কিভাবে নায়ক জেট লি তার পিতার হত্যার প্রতিশোধ নেয়ার জন্য চীনের ঐতিহ্যবাহী শাওলিন টেম্পলে গিয়ে মার্শাল আর্টস রপ্ত করে। জেট লি পরবর্তীতে হলিউডের মার্শাল আর্টস ক্যাটেগরির মুভিতে অভিনয় করে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেন। আমাদেরকে দ্বিতীয় যে সিনেমাটি দেখানো হয় তার নাম ‘রেড সারগাম’, চাইনিজে ‘হৌং কাওলিয়াং’। সিনেমাটি সেই বছরেই অর্থাৎ ১৯৮৭ সালে মুক্তি পেয়েছিল চীনে। পরিচালক ট্রাং ইমৌ এবং ছবির নায়িকা কোং লি দু’জনেই এই ছবির মাধ্যমে সিনেমার জগতে প্রবেশ করেন। এই ছবিতে অভিনয়ের সময় নায়িকা কোং লি বেইজিং-এর ‘সেন্ট্রাল একাডেমী অব ড্রামা’-র স্টুডেন্ট ছিলেন। আর পরিচালক ট্রাং ইমৌ-এর জন্য এই সিনেমাটি ছিল চীনের ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে ঢোকার একটি সুযোগ। সেই সুযোগটি তিনি পুরোপুরি কাজে লাগিয়েছিলেন। প্রাক-কম্যুনিস্ট-চায়নার চিকিৎসক পিতামাতার সন্তান ট্রাং ইমৌ-এর বেড়ে উঠার সময়টা ছিল বেশ কষ্টের। কারণ তিনি যখন বালক তখন শুরু হয়ে যায় কালচারাল রেভ্যুলেশন। সেই সময় তাকে পাঠানো হয় গ্রামের একটি কমিউনে যেখানে তাকে অন্যান্য কৃষকদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কৃষিকাজ করতে হয়েছিল। এই সময় তার সুযোগ হয় গ্রামীণ জীবন যাপনকে খুব কাছ থেকে দেখার। এই সময় ফটোগ্রাফীর প্রতি তার আগ্রহ জন্মায়। নিজের রক্ত বিক্রী করে একটা ক্যামেরা কিনেন এবং গ্রামের দৃশ্যাবলীর ছবি তুলে স্টিল ফটোগ্রাফীতে হাত পাকান। কালচারাল রেভ্যুলেশনের পর তিনি ভর্তি হন ‘বেইজিং ফিল্ম একাডেমী’ যেখানে তিনি সিনেম্যাটোগ্রাফীতে গ্রাজুয়েশন করেন। জীবন থেকে অর্জিত অমূল্য সব অভিজ্ঞতা তিনি পুরোপুরি কাজে লাগিয়েছেন তার প্রথম সিনেমা ‘রেড সারগাম’-এ। কাহিনী বিন্যাস, অনবদ্য অভিনয়, ক্যামেরার সূক্ষ্ম কারুকাজ আর গ্রাম্য চীনের বিশাল পটভুমিতে বিভিন্ন প্রাকৃতিক রঙের শৈল্পিক উপস্থাপনের কারণে ‘রেড সারগাম’ মুভিটি চীনের দর্শকদের মাঝে বিপুল সাড়া ফেলে। চীনের সমাজের বিভিন্ন ট্যাবুকে আঘাত করেছে এই সিনেমার কাহিনী যা চীনের সিনেমা জগতে একটি সাহসী পদক্ষেপ। বলা যেতে পারে কালচারাল রেভ্যুলেশনের পর এই মুভিটিই প্রথম গতানুগতিক ধারার বাইরে গিয়ে চীনের ফিল্ম ওয়ার্ল্ডে নতুন একটি মাত্রা সংযোজন করে। এই সিনেমার মাধ্যমে পরিচালক ট্রাং ইমৌ এবং নায়িকা কোং লি রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে পড়েন। পরবর্তীতে তারা দু’জনে একত্রে বেশ কয়েকটি জনপ্রিয় মুভি তৈরি করেন যা আমি আগ্রহ নিয়ে দেখেছি।
কালচারাল রেভ্যুলেশনের সময় চেয়ারম্যান মাও দেশের শিক্ষিত জনগোষ্ঠীকে ‘বুর্জোয়া’ আখ্যা দিয়ে শ্রেণীশত্রু হিসেবে চিহ্নিত করেন এবং প্রথাগত শিক্ষা ব্যবস্থার উপর কঠোর সেন্সরশীপ আরোপ করেন। স্কুলের ছাত্রছাত্রীদেরকে বানানো হয় রেড গার্ড যারা ছিল মাও-এর হাতের পুতুল। সেই রেড গার্ডরা তখন বুর্জোয়াদের বাড়ী বাড়ী গিয়ে সার্চ করত এবং সমস্ত নিষিদ্ধ বই অর্থাৎ মাও-এর আদর্শের পরিপন্থী যে কোন বই তারা জব্দ করে বহ্ন্যুৎসবে মেতে উঠত। ফলে সেই সময়ে একমাত্র মাও-এর প্রিয় প্রাবন্ধিক ল্যু সুন ব্যতীত অন্য যে কোন চীনা লেখকের বই ছিল নিষিদ্ধ। সাহিত্যের পাশাপাশি সিনেমা তৈরিতেও ছিল কঠোর বিধিনিষেধের বেড়া। সেই সময়ে চীনে শুধুমাত্র প্রোপাগান্ডামূলক সিনেমা তৈরি হত। বিদেশী ছায়াছবি বলতে গেলে নিষিদ্ধ ছিল। কিন্তু তারই মাঝে ১৯৫৫ সালে রাজ কাপুর অভিনীত ভারতীয় ছায়াছবি ‘আওয়ারা’ ইন্ডিয়ার কম্যুনিস্ট ঘরনার সংগঠন ‘ইন্ডিয়ান পিপলস থিয়েটার এসোসিয়েশন’-এর সৌজন্যে চীনে মুক্তি পায়। স্বয়ং চেয়ারম্যান মাও এই ছবি দেখে বেশ প্রশংসা করেছিলেন এবং ছবিটির টাইটেল সং ‘আওয়ারা হু’ গানটিকেও খুব পছন্দ করেছিলেন। সেই সময়কার চীনের ছেলে-বুড়ো প্রায় প্রত্যেকেই এই ছবিটি উপভোগ করেছে। আমার বেইজিং-এর জীবনে আমি অনেক চাইনিজকে পেয়েছি যারা কথা প্রসঙ্গে আমাকে ‘আওয়ারা’ ছবির কথা বলেছে এবং সেই সাথে ‘আওয়ারা হু’ গানের দুই লাইনও গেয়ে শুনিয়ে দিয়েছে। অথচ আমার নিজেরই কখনো দেখা হয়ে উঠেনি ‘আওয়ারা’ সিনেমাটি। হয়ত সেটি আমার আগের জেনারেশনের সিনেমা বলে তেমন একটা আগ্রহ বোধ করিনি। কিন্তু বেইজিং-এ এসে ‘রেড সারগাম’ দেখার পর আমি সমসাময়িক চাইনিজ সিনেমার প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠি। তাই চাইনিজ ভাষা কিছুটা আয়ত্বে আসার সাথে সাথে সিনেমা হলে গিয়ে মুভি দেখা শুরু করি। এই সময় চীনের বিখ্যাত কমেডিয়ান ঠ্রেং ছিয়াং এবং তার ছেলে ঠ্রেং পেই-স অভিনীত কয়েকটি কমেডি সিনেমা বেশ জনপ্রিয় হয়। আমিও সেগুলি সিনেমা হলে গিয়ে দেখে বেশ উপভোগ করেছিলাম। (চলবে)
(কাজী সাব্বির আহমেদ বর্তমানে কানাডা প্রবাসী। পেশায় একজন সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার। বাংলাদেশে কলেজ ম্যাগাজিনে নিয়মিত কবিতা এবং সায়েন্স ফিকশন লিখতেন। চীনে অবস্থানকালে প্রবাসী জীবন নিয়ে বিচিত্রার ‘প্রবাস থেকে’ কলামে লিখতেন।)