ঐক্য সংহতি ও সংস্কারের পথে বাংলাদেশ
মাহবুবুর রব চৌধুরী
বাংলাদেশ – ১৮ কোটি মানুষের অপার সম্ভাবনাময় গর্বের দেশ। স্বাধীনতার ৫৪টি বছর পর অনেক বাধাবিঘ্ন পাড়ি দিয়েই আজ আমরা এখানে। শত সমস্যার মাঝেও অর্জন কিন্তু একেবারে কম নয়। তবে বিভিন্ন সময় অনুকূল পরিবেশ পেয়েও দেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতি তারপরও কেন কাঙ্খিত মাইল ফলক স্পর্শ করতে পারেনি? অভিষ্ঠ লক্ষ্য অর্জনে প্রতিষ্ঠিত হয়নি জাতীয় ঐক্যমত? মৌলিক বিষয়গুলিতে কেন আজও বিভক্তি! কেন অনৈক্য? প্রশ্ন এখানে অনেক গুলো ও মূলত এটিই এ আলোচনার উদ্দেশ্য। আমাদের জাতীয় ঐক্য, উন্নয়ন ও অগ্রগতি যে বাঁধা গুলোতে আজও আটকে আছে, সেগুলো জানতে হবে। এবং খুঁজে দেখতে হবে। অতঃপর বাধা গুলো দূর করে জাতীয় ঐক্যমতের মাঝেই আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। এর কোন বিকল্প নাই।
জাতীয় উন্নয়ন ও অগ্রগতির পথে অন্তরায় হয়ে যে বিষয় গুলো আজও আমাদের সামনে দাঁড়িয়ে আছে, মূলত তা হল: –
১. অনৈক্য ও আত্মঘাতী বিভেদ।
২. দুর্নীতি।
৩. নেতিবাচক মন মানসিকতা ও তার প্রভাব।
৪.জাতীয় ইতিহাস, ঐতিহ্য, কৃষ্টি কালচার যথাযোগ্য ভাবে তুলে না ধরা।
৫. জাতীয় শিক্ষা কারিকুলামকে জাতীয় আশা আকাঙ্খার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ করে গড়ে না তোলা।
৬.গবেষণায় ও জাতীয় মেধা মূল্যায়নে উপযুক্ত নজর না দেওয়া।
৭. দেশে সত্যিকার পরমতসহিষ্ণু গণতান্ত্রিক কালচার তৈরি না হওয়া।
ইতিহাস : – ইতিহাস, ঐতিহ্য, কৃষ্টি কালচার সহ জাতীয় পরিচয়, পরিচিতি বিনির্মানে জাতীয় স্বার্থের রাজনীতি ও অর্থনীতির প্রকৃত রূপ যথাযথ ভাবে তুলে ধরতে না পারা ব্যর্থতা। এ বিষয়টি জাতীয় ঐক্যমত সৃষ্টিতে সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারেনি। অনৈক্য ও আত্মঘাতী বিভেদ বিভাজন এখান থেকেই শুরু হয়েছে। জাতীয় ঐক্যের মূল ভিত্তি থাকে জাতীয় দর্শনে। এই দর্শনটিও জাতির সামনে পরিষ্কার করে তুলে ধরা হয় নি। এ কাজটি করতে হবে। এখন সময় এসেছে সেটি করবার। এ গুলো সঠিক ভাবে না হওয়া পর্যন্ত দেশে সত্যিকার পরমতসহিষ্ণু গণতান্ত্রিক কালচার তৈরি হওয়া কষ্টকর।

অনৈক্য ও বিভেদের পাহাড়সম বাধা পেরিয়ে সুখী, সমৃদ্ধ উন্নত, শক্তিশালী, অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ আমরা পেতে চাই। এটি দেশের ১৮ কোটি মানুষের স্বপ্ন। চাওয়া পাওয়া ও এ স্বপ্ন আমরা আজও বাস্তবায়ন করতে পারিনি। কিন্তু কেন? এটি অর্জন করতে এবং বাস্তবে পেতে উন্নয়ন ও অগ্রগতির পথে প্রয়োজন জাতীয় ঐক্য। সমস্যার সমাধান কল্পে তাই যত দ্রুত সম্ভব মৌলিক বিষয় গুলিতে চাই সর্বাত্মক প্রচেষ্টায় জাতীয় ঐক্যমত গড়ে তোলা। ঐক্যের কোন বিকল্প নাই।
পর্যায় ক্রমে এ বিষয় গুলিই আলোচিত হবে। জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠায় প্রয়োজন নিজস্ব রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক স্বার্থের সাথে, ইতিহাস, ঐতিহ্য কৃষ্টি কালচারের সংমিশ্রনে গঠিত প্রেক্ষাপটটিও সঠিক ভাবে জেনে নেওয়া। একই সঙ্গে দেশের জন শক্তির গঠন, বিন্যাস ও তার ভারসাম্য, রাজনৈতিক স্থিতি, ধর্মীয় ও মানবিক মূল্যবোধ, পরিবেশ, পরিস্থিতি এবং ভৌগলিক অবস্থান ও তার গুরুত্বের দিক সম্পর্কেও সঠিক ধারনা থাকতে হবে। এ বিষয়টি শুধু মাত্র আবেগের ফসল হতে পারে না। দেশের শতকরা ৯৯% এরও বেশি মানুষ বাংলাভাষী বাংলাদেশী বাঙালি। তাদের মাতৃভাষা বাংলা। নাগরিক পরিচয় বাংলাদেশী। এ ছাড়াও বাকি অংশে আছেন – কিছু সংখ্যক উপজাতি নৃ-গোষ্ঠি, আর আছেন কিছু উর্দু ভাষী মুসলিম বিহারি। মূলত এরাই দেশের ভিন্ন ভাষী বাংলাদেশী। দেশের মানুষের ধর্মীয় পরিচয়ের পরিসংখ্যান হিসাবটা নিলে দেখা যায় – প্রায় ৯২% মুসলিম ও বাকি ৮ % মিলিত ভাবে হিন্দু, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ ও অন্যান্য। দেশে সুন্দর স্বাভাবিক সমতার পরিবেশ গঠনে এটি একটি সহজ আদর্শ পরিস্থিতি চিত্র। মূলত আমাদের দেশটি বিশ্বের বুকে সম্ভাবনাময় আদর্শ স্থান।
কৃষ্টি কালচার ও ধর্মীয় মূল্যবোধ : – কৃষ্টি কথাটির সঙ্গে যেমন কৃষির একটি ভাব ও ভাষাগত মিল আছে ও তেমনি কালচার শব্দটির সঙ্গে কালটিভেশন কথাটির একই প্রকার আত্মীয়তা ও ঘনিষ্ঠতা আছে! কৃষ্টি কালচার একটি জাতির স্বকীয়তা, নিজস্বতাকে পরিশীলিত সৃজনশীলতায় সর্বোৎকৃষ্ট ভাবে তুলে ধরে ও এবং তুলে ধরবার চেষ্টা করে ও মূলত এভাবেই তুলে ধরা হয় দেশের স্বার্থ,দেশের মানুষের জীবনাচার, চিন্তা, চেতনা, আচার ব্যবহার, আশা আকাঙ্খা। কৃষ্টি কালচার ও ধর্মীয় মূল্যবোধের দিকে আমরা অবশ্যই রিচ।
মানব ইতিহাসের সূচনা লগ্ন থেকেই বিশ্বের সকল জাতি গোষ্ঠি নিজ মন, মানসিকতা চিন্তা চেতনা, অভ্যাস ও কর্মের মাঝেই তাদের নিজস্ব কৃষ্টি কালচার গড়ে তুলছে। ক্রমবিকাশের এই ধারায় তারা বিভিন্ন সূচকে, বিভিন্ন ভাবে সভ্য, অসভ্য, উন্নত, অনুন্নত, অনগ্রসর, অগ্রসর – জাতি গোষ্ঠি হিসাবে পরিচয়, পরিচিতি লাভ করছে। অগ্রসর, সভ্য জনগোষ্ঠীর সাথে অনুন্নত, অনগ্রসর, অসভ্য, জনগোষ্ঠীর মন মানসিকতায় এবং চিন্তা ,চেতনায় পার্থক্য আছে। সেটি সত্য। পাশ্চাত্যের উন্নত দেশের কালচারের সাথে অনুন্নত অনগ্রসর দেশ ও জাতি গোষ্ঠির কালচারে বিভিন্ন দিকে, বিভিন্ন বিষয়ে সুস্পষ্ট কিছু পার্থক্য আছে। আছে ভিন্ন কিছু বৈশিষ্ট্য। যদিও বিশ্বে একে অপর থেকে নেবার ও দেবার অনেক কিছুই আছে। তার পরও বলতেই হয় অতি কথন, দ্রুত মত পরিবর্ত, নেতিবাচক মন মানসিকতা, নেতিবাচক আলাপ আলোচনা সমালোচনা, সহ হুজুগেপনা হুজুগ কালচার, মব কালচার এবং পরমতসহিষ্ণুতার অভাব অনুন্নত অনগ্রসর দেশ ও জাতি গোষ্ঠির কালচারে বেশি দেখা যায়। এগুলির মাঝে সত্যিকার গণতান্ত্রিক সভ্য কালচারের ভিত্তি গড়ে উঠা সত্যিই কঠিন। আমাদের সমাজকে গণতান্ত্রিক সমাজের স্তরে উন্নীত করতে এ বিষয় গুলোর প্রতি অবশ্যই নজর দিতে হবে ও অনুন্নত অনগ্রসর দেশ ও জাতিসমূহের মাঝে অনুসন্ধানও গবেষণার ক্ষেত্রেও থাকে আলসেমি আর অনুৎসাহ। তুলনামূলক ব্যাপক ঘাটতি থাকে। এ ক্ষেত্রে বাজেটও থাকে খুবই কম। অধিকন্তু তাদের শাসক দলের মাঝে থাকে কর্তৃত্ব বাদ। তাই সে দেশে যোগ্য শিক্ষিত মানুষের দেশী রাজনীতি ও প্রচলিত রাজনৈতিক কালচারের প্রতি গড়ে উঠে এক ধরনের অনীহা। এ ধরনের সিমটম আছে বলেই বাংলাদেশের রাজনৈতিক কালচার দেশের রাজনৈতিক পরিবেশ উন্নয়নে উপযুক্ত, অবদান রাখতে পারছে না।
ইতিহাস, ঐতিহ্য কৃষ্টি কালচার দেশ গঠনে এবং জাতীয় ঐক্য ও সংহতি রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। আমাদের দেশের সাধারণ মানুষের জীবনাচার সরল সহজ ও আনন্দ উদ্দীপনায় ভরপুর। তবে আমাদের মাঝে সম্প্রদায় ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ক্ষেত্রে কিছু বিবভ্রান্তি মূলক কথা, কিছু বয়ান সমাজে নেগেটিভ অবদান রাখছে। দেশে সাম্প্রদায়িকতার ভাইরাস বহিরাগত কলোনিয়াল আমলে প্লান্টেড। দেশের সাধারণ মানুষ সরল সহজ, প্রকৃতি গত অর্থাৎ স্বাভাবিক ভাবেই তারা অসাম্প্রদায়িক। সাম্প্রদায়িকতা মানবিকতা বিরধী। সভ্য সমাজ ও আধুনিক গণতান্ত্রিক রীতি নীতির বিপক্ষে ও দেশের মানুষ জানেন নিজ নিজ ধর্ম ও কৃষ্টি কালচার পালন করা বা নিজ ধর্মের পক্ষে কথা বলা সাম্প্রদায়িকতা নয়। সাম্প্রদায়িকতা হল অন্য ধর্মের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ।
সমাজে কিছু বিষয় চালু আছে। যা শোভনীয় নয়। যেমন যে কোন ফর্মে ধুতি শাড়ী, সিঁদুর লাল টিপ্ নিয়ে কুটক্তি কে বাউন্ডারি ক্রস করার নামান্তর ঠিক তেমনি হিজাব, দাঁড়ি, টুপি নিয়ে উপহাসও একই ব্যাকরণ অনুসরণ করবে। সামাজিক সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষায় আন্তরিকতার সাথে বিষয়গুলো সমাধান করতে হবে। সেটি আমাদের বুঝতে হবে।
অনেকে জেনে বা না জেনে – বুঝে বা না বুঝে এইসব নিয়ে নিয়ে গেম প্লে করেন। এই সব গেম এক সময় তাদের বিরুদ্ধেই ব্যাক ফায়ার করে এবং তা করবেই। দেশে নিজস্ব কৃষ্টি কালচারের ভিত্তি শক্ত করতে এবং বিশ্ব ইসলামো ফবিক প্রচার প্রোপাগান্ডার সাথে দেশের অভ্যন্তরে গজিয়ে উঠা কিছু মানুষের অযৌক্তিক কথা বার্তাকে যৌক্তিক ভাবে খন্ডন করতেই আমাদের প্রয়োজন দ্রুত দেশে একটি বিশ্ব মানের – ইসলামিক কৃষ্টি – কালচার বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা। এটি সামাজিক সম্প্রীতি ও কালচারাল ভারসাম্য এবং সম্প্রীতি রক্ষায় অবশ্যই পজেটিভ অবদান রাখবে।
পাশ্চাত্যে ইউরোপ বা আমেরিকাতে বসবাসকারি কেউ যদি রবিবারের পরিবর্তে শুক্রবারকে সাপ্তাহিক ছুটি ঘোষণার আবদার তোলেন বা ভ্যাটিকানের পোপ যে প্রোটকল পান সেই একই প্রটোকল যদি তারা কাশীর পুরহিত বা ঢাকার বায়তুল মোকাররম মসজিদের ইমাম সাহেবের জন্য দাবি করেন, অথবা ইন্ডিয়াতে কেউ যদি তাদের ভারতের জাতীয় প্রতীক অশোক স্তম্ভকে সরিয়ে কুতুব মিনার করতে চান তবে এ দাবি গুলো যতটুকু যৌক্তিকতা পাবে, তেমনি ৯২% মুসলিম অধ্যুষিত বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও শুক্রবারের পরিবর্তে পুনঃ রবিবারকে যারা ছুটি হিসাবে দেখতে চান বা এই রূপ মুসলিম কালচার সম্বলিত বিষয় গুলোতেও আধুনিকতার বা অন্য কোন ন্যারেটিভে বক্তব্য তুলে সেকুলার প্রতিস্থাপন চান তাদের যুক্তিগুলোও দেশে আপাতত ততটুকু যৌক্তিকতাই পাবে। সেকুলার টার্ম ব্যবহার করলেও প্রকৃত পক্ষে এ বিষয়গুলো দেশে অসাম্প্রদায়িকতা প্রমোট করে না। বপন করে ভিন্ন আঙ্গিকে সাম্প্রদায়িকতার বীজ। এটি প্রকৃত পক্ষে কারো জন্যই কোন সুফল আনবে না। বিস্তারিত ব্যাখ্যা পরবর্তীতে তুলে ধরা হবে।
দুনিয়াতে কিছুই স্থায়ী নয়। এক সময় হয়ত ভিন্ন মতই প্রধান মত হিসাবে হাজির হতে পারে। তবে আজ এই সময়, এই মুহূর্তে দেশ ও দেশের মানুষের জন্য জরুরি গণতন্ত্রিক বাংলাদেশ এবং সবার জন্য নিরাপদ, সুখী, সম্মৃদ্ধশালী, সভ্য, উন্নত বাংলাদেশ ও নাগরিক অধিকারে ক্ষেত্রে দেশের প্রতিটি মানুষের জন্যই ন্যায় ও ইনসাফ অধিকার পূর্ণ মাত্রায় বাস্তব প্রতিষ্ঠা। তা না হলে মানুষ তো আওয়াজ তুবেই। গাইবেই বকশিশ চাইনা মালিক হিসাবের পাওনা চাই। এগুলো পেতে যা কিছু প্রয়োজন চাহিদা তালিকায় প্রায়রিটি হিসাবে সে গুলোকেই সর্ব শক্তিতে প্রাধান্য দেওয়া প্রয়োজন।
দুর্নীতি :- মানবিক এবং বৈষয়িক উভয় দিকেই উন্নয়ন ও অগ্রগতির পথে প্রধান বাধা দুর্নীতি। দুর্নীতি দমনে প্রয়োজন মূলত দেশে দুর্নীতি মুক্ত উন্নত আধুনিক সিস্টেম প্রচলন। সিস্টেম পরিবর্তন না করে শুধু মাত্র সরকার পরিবর্তন, চূড়ান্ত সমাধান নয়। প্রকারন্তরে তা হয়ে দাঁড়ায় যে লাউ সেই কদু। বিষয়টি আমাদের চিন্তা, চেতনা ধ্যান ধারনায় তেমন একটা গুরুত্ব পায় না। এবং তা পাচ্ছেও না।
দুর্নীতিপূর্ণ বা দুর্নীতি সহায়ক সিস্টেম পরিবর্তন করা না হলে, এই সিস্টেমের মাঝে দেশের সৎ মানুষের জন্যও সর্বক্ষেত্রে সৎ থাকা প্রায় অসম্ভব হয়ে উঠে। এ বিষয়টিকে গুরুত্বের সাথে আমাদের উপলব্ধি করা প্রয়োজন। সৎ মানুষ দেশের সম্পদ। এটি সত্য ও দুর্নীতি দমনে তারা গুরুত্ব পূর্ন ভূমিকা রাখেন এবং রাখতে পারেন। সেটি ও সত্য।
তবে শুধু মাত্র ব্যক্তিগত সততায় নির্ভর করে রাষ্ট্র এবং সমাজ থেকে দুর্নীতি উচ্ছেদ সম্ভব নয়। নানা প্রকার অধ:পতনের পরও দেশে এখনও প্রচুর সৎ মানুষ আছেন। উন্নত সিস্টেম প্রতিষ্ঠিত হলে এবং উন্নত ও দুর্নীতি মুক্ত সিস্টেমের সহায়তা পেলে তারা তাদের সততার সত্যিকার পরিপূর্ণ স্বাক্ষর দেশ, জাতি ও সমাজের জন্য রেখে যেতে পারবেন। সিস্টেম এবং সততা মিলিত ভাবে উন্নত দেশের মতই রাষ্ট্র ও সমাজে সম্ভাব্য সর্বোচ্চ সুন্দর পরিবেশ পরিস্থিতি তৈরি করা সম্ভব। দুর্নীতিযুক্ত সিস্টেম সৎ মানুষকেও অসৎ বানাতে পারে। এবং তা অর্থাৎ এই দুর্নীতিপূর্ণ সিস্টেমটি, সৎ মানুষের জন্য সৎ থাকাটাই প্রায় অসম্ভবই করে তোলে।
সৎ না সিস্টেম ? আমাদের সমাজে এরূপ একটি বিতর্ক চালু আছে। এ বিষয়টি নিয়ে অকারণে ডিম না – মুরগি আগে এরূপ বিতর্ক না তোলাটাই ভালো। সমাজ ও রাষ্ট্রে সৎ মানুষ পেতে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাকে ন্যয় নীতি, নৈতিকতা ও মানবিক মূলবোধ সম্পন্ন মানুষ তৈরির জন্য সাজাতে হবে। একই সাথে পারিবারিক ভাবেও মূল্যবোধ বিকাশে সর্বাত্বক প্রচেষ্টা নিতে হবে। অপর দিকে দুর্নীতি মুক্ত সিস্টেমের মাধ্যমে সরাসরি দুর্নীতিকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। এবং দুর্নীতি দমনে প্রতিজ্ঞা বদ্ধ হতে হবে। এ দুটি বিষয় একে অপরের সাথে কোন ভাবেই সাংঘর্ষিক নয়। অর্থাৎ দুর্নীতিযুক্ত বা দুর্নীতি সহায়ক সিস্টেম যেমন সৎ মানুষকেও অসৎ করে তুলতে পারে! তেমনি সৎ মানুষও দুর্নীতি মুক্ত সিস্টেমটি কে সরল, সহজ, সুন্দর সাবলীল গতিতে স্বতঃস্ফূর্ত ভাবেই এগিয়ে নিয়ে যেতে পারেন।
এবার প্রশ্ন আসে, দুর্নীতি মুক্ত সিস্টেম কি? যে সিস্টেম প্রশাসনের সকলকে অর্থাৎ সর্বচ্চো কর্মকর্তা থেকে শুরু করে সর্ব নিম্ন কর্মকর্তা সবাইকেই স্বচ্ছ এবং জবাবদিহিতার আওতায় রাখে। এবং সিস্টেমই – সিস্টেম অনুসারেই সবার উপর সার্বক্ষণিক নজরাদি করে। এটিই দুর্নীতি মুক্ত স্বচ্ছ জবাবদিহি এবং সময় নিয়ন্ত্রিত সিস্টেম। দুর্নীতির বিরুদ্ধে এটি একটি শক্ত রক্ষা কবচ। এর দ্বারা সেবা দাতা ও সেবা গ্রহীতার সম্পর্কটি সব সময় সুন্দর সহজ সরল থাকে। দুর্নীতি মুক্ত পদ্ধতিতে, সমগ্র প্রশাসনিক সিস্টেমটিকে একটি জাহাজের সঙ্গে তুলনা করা হয়। যেমন জাহাজের তলদেশের যে কোন স্থানে ছিদ্র হলে পুরা জাহাজটি ডুববার কারণ হয়ে উঠে। তেমনি প্রশাসনের যে কোন স্থানে ছাড় দিলে, বা একটু সুযোগের ব্যবস্থা রাখা হলেই, সেখান থেকেই দুর্নীতির চারা গজিয়ে উঠবেই। এর কোন ব্যাতিক্রম হয় না। হতে পারে না। ছাড় দেবার সংস্কৃতিই পর্যায়ক্রমে স্বৈরাচার হয়। এবং স্বৈরাচার তৈরী করে। ২য় মহাযুদ্ধ শেষে জাপান নিজস্ব পদ্ধতি ডেভলাপ না করা পর্যন্ত আমেরিকার পদ্ধতিটি ব্যবহার করেছে। অনুকরণ ও অনুসরণ করেছে। আমরাও তেমনি শুরুতে বিশ্বের যেকোন উন্নত একটি দেশের দুর্নীতি মুক্ত সিস্টেমকে আমাদের প্রয়োজনে ব্যবহার করতে পারি।
নেতিবাচক মন মানসিকতার প্রভাব : – নেতিবাচক মন মানসিকতা কখনো সমস্যা সমাধানে সহায়ক নয়। আমাদের অবশ্যই এর প্রভাব মুক্ত হতে হবে। অতীত ইতিহাসের দুঃখ বেদনাকে ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে সংরক্ষিত রেখে, ইতিহাসের আলোকে উজ্জীবিত হয়েই বর্তমানকে, শক্ত ভিত্তি ভূমির উপর সুন্দর ভাবে গড়ে তুলতে হবে। জাতি গঠনে নিজস্ব জাতীয় ইতিহাস, ঐতিহ্য, কৃষ্টি কালচারের অনুপ্রেরণা অপরিসীম। এটি মানতেই হবে।
দেশে ছাত্র জনতার সম্মিলিত ২০২৪ এর ৫ আগস্ট বিপ্লব এবং নাগরিক, গন অভ্যুত্থান জাতীয় জীবনে নয়া আশাবাদ জাগ্রত করেছে। এ বিপ্লব, সারা বিশ্বের আন্দোলন সংগ্রাম, ইতিহাসে এক নতুন সংযজন! এটি ছাত্র, যুব, কিশোর, কিশোরী, নাগরিক সমন্বিত-ঐক্যবদ্ধ বাংলাদেশের বিপ্লবী নয়া বাংলা বসন্ত। যা বাংলাদেশকে নতুন রূপে বিশ্বে তুলে ধরেছে।
বাংলাদেশীরা আবারো একবার এপথেই স্বপ্নের আকাশ ছুঁয়েছে। বিপ্লব পরবর্তী সময় স্বাভাবিক নিয়ম অনুসারেই আকাশ ছোঁয়া স্বপ্নগুলো জমিনের কঠিন বাস্তবতার আলোকে প্রশ্নের মুখোমুখি হচ্ছে। এবং তা হবেই। এটা স্বাভাবিক। এটিই বাস্তব আর ইতিহাসের ধারা।
ইতিহাসের এ পথে এ ধারাতেই আমরা পেয়েছি – ১৯৪৭, ১৯৫২, ৬৯, ৭১, ৯০ এবং ২০২৪। সব গুলোই গুরুত্বপূর্ণ। সময়ের প্রেক্ষাপটে এরা যার যার নিজস্ব গুরুত্ব ও স্বকীয়তা বহন করে। এ সবই বাংলাদেশের ইতিহাসের একেকটা টার্নিং পয়েন্ট। কোনটাই কোনটার সাথে বিচ্ছিন্ন নয়। প্রতিটিই আগেরটির ধারাবাহিকতা এবং সময়ের প্রয়োজন। প্রতিটিরই আছে অসীম ঐতিহাসিক মূল্য এবং তাৎপর্য। তারা আলাদা হলেও স্ব স্ব মহিমায় মহিমান্বিত। ইতিহাসের এ ধারাবাহিকতা স্বীকার করেই আমাদের সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে।
একই সাথে আমাদের বুঝতে হবে, কেন বার বার বুকের তাজা রক্তের বিনিময়ে অর্জিত রক্ত ক্ষয়ী সংগ্রাম সফল হবার পরও, সে সংগ্রাম তার অভিষ্ঠ লক্ষ অর্জনে সফল হচ্ছে না? আন্দোলন, বিপ্লব বা গণঅভ্যুত্থান যে যেভাবে যে নামেই ছাত্র, জনতা নাগরিক সম্মিলিত সংগ্রামকে অভিহিত করা হোক তাতে বড় কোন সমস্যা নাই। প্রকৃত সমস্যাটি দেখা দেয় তখন, যখন গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী সময় যারা দেশ পরিচালনায় আসেন প্রতিবারই তারা আন্দোলনের মূল উদ্দেশ্য ও দেশবাসীর আকাঙ্খাকে ধারণ করতে ব্যর্থ হন। পরবর্তিতে তাদের এই ব্যর্থতার দায়ভার বহন করতে হয় সমগ্র দেশ বাসীকে। এই প্রসঙ্গে আর একটি বিষয় উল্লেখ করতে হয়। দেশের বাস্তব অবস্থা এবং দেশের মানুষের কৃষ্টি কালচার ও ধর্মীয় মূল্যবোধকে অবজ্ঞা করে কোন কিছু চাপিয়ে দেবার প্রচেষ্টাও স্থায়িত্ব পাবার সম্ভাবনা কম। এই ধরনের প্রচেষ্টা দেশের অন্যান্য সমস্যাবলির সাথে যুক্ত হয়ে সাধারণ সমস্যা গুলোকেও ভারী করে অসমাধানযোগ্য করে ফেলে।
দেশের শতকরা ৯৯% এরও বেশি মানুষ বাংলাভাষী। আর ধর্মীয় পরিচয় পরিসংখ্যান হিসাবে মুসলিম প্রায় ৯২% ও বাকি ৮% সবাই মিলিত ভাবে হিন্দু, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ ও অন্যান্য।
সে দেশের রাজনৈতিক বিকাশের ক্ষেত্রে এর প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ প্রভাব কি হতে পারে ও সে বিষয়টি নিয়ে গবেষণা – বিশ্লেষণ হতে পারে। তবে সাধারণভাবে একটি বিষয় দেখা যায় যে দেশের মানুষের জীবন, জীবিকা আয় উপার্জন কর্ম কর্মসংস্থানসহ দেশের মানুষ এবং দেশের মানুষের কালচারকে অবজ্ঞা বা যথাযথ মূল্যায়ন না করার জন্যই দেশের ধর্মীয় বা, ধর্ম কেন্দ্রিক রাজনৈতিক দল গুলো জনসমর্থিত দল হয়ে গড়ে উঠতে পারেনি। তেমনি দেশের বামপন্থী নামে পরিচিত দল গুলো একই ভাবে ধর্ম বিরোধী এরূপ নেগেটিভ পরিচিতির কারণে কিছুটা সমর্থন তারা পেলেও তারা কখনোই দেশের মূল বড় দলের সম পর্যায়ে উঠে আসতে পারেনি।
এরূপ বিভিন্ন চিহ্নিত জানা শোনা বিষয় ও অচিহ্নিত অমীমাংসিত সমস্যার ক্ষেত্রগুলিও তুলে ধরে তার সঠিক সমাধানের পথ গুলোও বের করতে হবে। তা না করতে পারলে সমাধানের সূত্র পেলেও তার বাস্তবায়ন কঠিন হয়ে পড়বে। সহজ বিষয় গুলোও আর সহজ থাকবে না। সব প্রচেষ্টাই ঘুরে ফিরে পরিবর্তনে অপরিবর্তনিয় হয়ে সিন্দাবাদের বুড়া হয়ে ঘাড় থেকে নামবে না। নামতে চাইবে না। এখনই সঠিক সময় সকল বাধা পেরিয়ে সামনে এগিয়ে যাবার। কথা নয় কাজে।
মাহবুবুর রব চৌধুরী, টরন্টো
লেখক পরিচিতি: ইতিহাস গবেষক, রাজনীতি বিশ্লেষক।