সুফিবাদ ও বাংলাদেশ

অধ্যাপক ড. মো. গোলাম দস্তগীর

পর্ব – ৮

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

পর্দার খেলাপ:

বাংলাদেশের কিছু সুফিসাধক বর্তমানে পুরুষ ও নারী সবাইকে মুরিদ করেন এবং মহিলারা পীর সাহেবের খানকায় আসা যাওয়া করেন। সেক্ষেত্রে পর-পুরুষের সাথে দেখা সাক্ষাৎ ঘটে যা শরিয়ত অনুমোদন করে না। কোন কোন মহিলা পীর সাহেবের হাত-পায়ে চুম্বন করেন। এমনি পর্যায়ে সরাসরি জ্বেনা কাজে জড়িত হওয়ার মত ঘটনাও ঘটেছে।

কোন কোন জায়গায় নারী ও পুরুষ একত্রিত হয়ে রাতে যিকর, মিলাদ বা কোন অনুষ্ঠানের নামে একত্রিত হয়ে প্রথমে বাতি জ্বালানো অবস্থায় যিকর শুরু করল পরে বসা থেকে উঠে নাচতে আরম্ভ করল এর মধ্যে একজন ছন্দের তালে তালে বলছেনÑ ‘দেলের বাতি বড় বাতি, বাইরের বাতি নিভারে’। এর মধ্যে কেউ বাতি বন্ধ করে দিল। অন্ধকার হল, এবার বলছেন, ‘দেলের পর্দা বড় পর্দা বাইরের পর্দা উঠারে।’ এবার কি অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে ধারণা করুন তো?

এখানে আল্লাহ ও রাসূল (সা.) কোন আইন বা আদর্শ মানা হচ্ছে কি? কিভাবে এটাকে সমর্থন করা যায়, বা সুফিবাদের চর্চা বলা যায়? এই ধরণের কাজে পবিত্র কুরআনের সূরা নূরে ও সূরা আহযাবে বর্ণিত পর্দার নির্দেশের বিপরীত বিধায় হারাম ও নিষিদ্ধ।

খাজা এনায়েতপুরীর দরবার বিশ্ব শান্তি মঞ্জিল নামে পরিচিত। এ দরবারে অসংখ্য মহিলা যাকের আছে। তাঁদেরকে ‘যাকের-বোন’ বলে সম্বোধন করা হয়। উপরে বর্ণিত বে-পর্দার কোন কাজ এখানে হয় না। মহিলাদের জন্য দরবারে প্রবেশের পৃথক রাস্তার ব্যবস্থা আছে। দায়রা শরীফে তাঁদের বসার বা থাকার সম্পূর্ণ পর্দা-ঘেরা জায়গার ব্যবস্থা আছে, যেখানে পুরুষের প্রবেশের কোন সুযোগ নেই। পুরুষরা যে পথ দিয়ে মাযারে যাতায়াত করেন, সে পথ দিয়ে নারীরা যাতায়াত করেন না।

দ্বিতীয়ত: যিকর প্রসঙ্গ। এনায়েতপুর দরবার শরীফে মহিলা যাকেরবৃন্দ পৃথক স্থানে বসেন। তাদের থাকা, খাওয়ার ব্যবস্থা পৃথক এবং মহিলা যাকেররাই মহিলাদের থাকা, খাওয়ার তত্ত্বাবধান করেন। তাই নারী-পুরুষ একত্রে যিকর করার কোন সুযোগ নেই। এমনকি মহিলাদের কন্ঠস্বর পুরুষের কর্ণে যাতে না পৌঁছায় সে ব্যবস্থাও দরবার শরীফে আছে।

তৃতীয়ত: এখানে কোন নাচানাচি, বাতি নিভানো, পর্দ ওঠানো বা এরূপ কোন বে-পর্দা বা বেÑশরমের কার্যাবলী ঘটে না। এখানে পুরুষ ও মহিলা যাকের পৃথক স্থান থেকে কেবল হালকা যিকর করেন এবং তা বসা অবস্থায়, যাকে ‘যিকরে-ক্বলব’ বলে। এখানে উচ্চস্বরে নেচে নেচে কোন প্রকার যিকর করা হয় না। উল্লেখ্য, এনায়েতপুর দরবার শরীফে নিজস্ব জেনারেটরের মাধ্যমে ২৪ ঘন্টা বিদ্যুতের ব্যবস্থা আছে।

চতুর্থত: এনায়েতপুর দরবার শরীফে পীর বা সাজ্জাদানিশিন কোন অবস্থাতেই মহিলা যাকেরের সঙ্গে দেখা দেন না এবং দেখা করেন না। তাই মহিলা যাকেরের দ্বারা পীরের হাতে-পায়ে চুম্বন দেয়ার প্রশ্নই ওঠে না। এমনকি পুরুষ যাকেরদেরকেও পীরের কদমবুচি করতে নিবৃত্ত করা হয়।

এ প্রসঙ্গে একটি ঘটনার উল্লেখ না করলেই নয়। একবার (আনুমানিক ১৯৪৪-৪৫ ইং সাল) আসামের বিভিন্ন এলাকা হতে বেশ কিছু যাকের এনায়েতপুর দরবারে এসেছিলেন। সঙ্গে সতের জন মহিলা যাকেরও ছিলেন। কয়েকদিন থাকার পর ঐ মহিলাগণের ইচ্ছা হলো খাজা হুজুরের দর্শন লাভ। তাঁর সহধর্মিনীর (মুরিদদের পীর মা) মাধ্যমে এ খবর খাজা হুজুরের নিকট পৌঁছালে তিনি জানালেন: “মা সকল! দুনিয়াতে রাসূলের বিধান অনুযায়ী তোমাদের সঙ্গে চাক্ষুস দেখা করার হুকুম নেই। তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের হুকুম নিষেধ মেনে চল তা হলে খোদা চাহে সেই মহাপ্রলয়ের দিন তোমাদের সঙ্গে আমার দেখা হবে। আমি তোমাদের জন্য হুজুর পাক (সা.) এর কাছে সুপারিশ করবো।” 

পঞ্চমত: এনায়েতপুর দরবার শরীফে মহিলাদের বায়াত দেয়া হয় মহিলাদের মাধ্যমে। দূর-দূরান্ত থেকে আগত মহিলাদের থাকা, খাওয়া বা মাযার জিয়ারতের সকল ব্যবস্থা  সম্পূর্ণরূপে মহিলা প্রতিনিধিদের  মাধ্যমে সম্পন্ন করা হয়।

হারাম বা নেশার দ্রব্য গ্রহণ:

তাসাউফ বা সুফিবাদের চর্চা করতে গিয়ে বাংলাদেশের অনেক মাযার বা দরবার শরীফ এর পাশে দৈনিক, সাপ্তাহিক, মাসিক ও বাৎসরিক উরস, মজমা, মিলাদ, সভা ইত্যদির নামে একত্রিত হয়ে মদ, জুয়া, গাজা ইত্যাদি হারাম জিনিসের আসর জমাতে দেখা যায় এবং কেই কেউ একথাও বলেন ‘যত বেশি নেশা করা যায় ততবেশী আল্লাহকে চেনা যায়।’ অথচ রাসূল পাক (সা.) সকল প্রকার নেশার দ্রব্যকে হারাম ঘোষণা করেছেন। পবিত্র কুরআনে পরিষ্কারভাবে মদ হারাম ঘোষণা দিয়েছেন। অনেক ফকীর দরবেশ ধুমপান করেন। রাসূল পাক (সা.) দূর্গন্ধযুক্ত খাবারকে অপছন্দ করতেন। তা খেয়ে মসজিদে আসতে নিষেধ করেছেন।

উপরে বর্ণিত ঘটনার বিন্দুমাত্র এনায়েতপুর দরবার শরীফে দেখা যাবে না। যেখানে মদ, গাজা, নেশা ভাঙ করা হয় তা কোন পবিত্র দরবার হতে পারে না। এনায়েতপুর দরবার শরীফে মদ খাওয়াতো দূরে থাক, কোনপ্রকার ধূমপান পর্যন্ত কেউ করতে পারে না। আর এখানকার পীর, সাজ্জাদানিশিন, ক্বারী, মোদারেছ, ইমাম কেহই কখনই ধুমপান করতেন না বা এখনও করেন না। শাহসুফি খাজা এনায়েতপুরী বারবার বলে গেছেন, ‘যদি পুরাপুরি মুসলমান হইতে চাও, তবে ছোট বড় শরিয়তের যাবতীয় হুকুম মানিয়া চল’। তাঁর অনুসারীরা এটা অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলেন। শরিয়তের বিন্দুমাত্র বরখেলাপী এ দরবারে বরদাস্ত করা হয় না।

শরীয়তের অনুসরণের অভাব:

কতিপয় ফকির দরবেশ তাসাউফের অনুসারী দাবি করেন এবং তাঁদের বেশ অনুসারী ও মুরিদান আছেন। অথচ তাঁদের কুরআন ও সুন্নাহর ওপর আমল নেই। এমনকি তাঁরা নামাজও ঠিকমতো পড়েন না। অথচ যাকে অনুসরণ করব তাঁর মধ্যে আল্লাহ ও রাসূল (সা.) এর এত্তেবা থাকতে হবে। আল্লাহর বাণী, “হে হাবীব, ‘আপনি বলুন, তোমরা আল্লাহর অনুকরণ কর, আল্লাহর রাসূল (সা.) এর অনুকরণ কর এবং তোমাদের মধ্যে যারা উলিল আমর তথা আল্লাহ ও রাসূল (সা.) এর অনুসারী তাঁদের অনুসরণ, অনুকরণ কর।”

‘দরবেশ’ বলে মনে হলো এমন একজনকে রাস্তায় হাঁটতে দেখলাম। সাথে নারী-পুরুষ অনেক আছেন। পরিধেয় পোশাক অত্যন্ত নোংরা। তিনি নাকি কখনো গোসল করেন না। এই আদর্শ রাসূল (সা.) এবং সাহাবায়ে তাবেঈন বা তাবে-তাবেঈন যাদেরকে অনুসরণ করতে বলা হয়েছে তাঁদের জীবনকর্মের সাথে সংগতিহীন। বাংলাদেশে কিছু ফকির সাধক আছেন যাদের অনেক অনুসারী থাকা সত্ত্বেও তাদের লেবাছ-পোশাক, সীরাত, সূরাত-এর সাথে সুন্নাহর মিল নেই।

উপরে বর্ণিত কার্যক্রমকে ইসলামের তথা তাসাউফের বলা যাবে না। এটা ভন্ড সাধকের ভিন্ন মতের প্রতিফলন, কোন প্রকৃত সুফিসাধকের নয়। একজন প্রকৃত সুফি কখনই  শরিয়তের বিরোধী কাজ করেন না। কারণ, সুফিবাদ  ইসলামের অন্তর্নিহিত মরমীবাদ। এর ভিত্তি হলো কুরআন ও হাদিস। শাহসুফি খাজা এনায়েতপুরী স্পষ্ঠভাবে ঘোষণা করে গেছেন যে, ‘জাহিরে শরিয়ত মত চলবে, বাতেনে আল্লাহ ও রাসূলের এশকের আগুনে পুড়িতে থাকিবে’।

এনায়েতপুর পাক দরবারে শরিয়তের রোকনসমূহ অক্ষরে অক্ষরে পালন করা হয়। কখনই কোনভাবে নামাজের বরখেলাপ করা হয় না। এ সম্পর্কে এনায়েতপুরীর অনেক উপদেশ রয়েছে। খাজা এনায়েতপুরী (র.) কোনদিন শরিয়তের বরখেলাপ কোনকিছু করেন নি, বা কাউকে করতে দেন নি। শরিয়ত পরিপূর্ণভাবে মেনে চলার জন্য তিনি সবাইকে সবক দিতেন। এ সম্পর্কে তিনি বাণীও রেখে গেছেন। তিনি বলেছেন, ‘শরিয়ত, তরিকত, হকিকত ও মারেফত- এই চারটি জিনিস একত্রে আদায় করলেই পুরা শরিয়ত আদায় হইল। শরিয়ত ছাড়িয়া দিয়া তিন জিনিসের যে কোন এক জিনিস আদায় করিলে তাহা মূল্যহীন।’

একথা অনস্বীকার্য যে, শরিয়ত শিক্ষা করা ও তা পালনের মাধ্যমে মারেফতের চর্চা করার প্রতি খাজা এনায়েতপুরীর(র.) হুকুম ছিলো সুষ্পষ্ট। তাই তাঁর কণ্ঠে ধ্বনিত হয়:

হে তামাম দুনিয়ার মুসলমান সকল! যাহারা আল্লাহর উপর ঈমান আনিয়াছেন, তাঁহারা পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়েন। যেহেতু রাসূল (সা.) হামেশাই নামাজ পড়িতেন। জেহাদের মাঠেও নামাজ পড়িতেন। আপনাদের পীরও পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়েন। কঠিন বিমারেও এক ওয়াক্ত নামাজ ছাড়েন না। আপনারাও তাই নামাজ ছাড়িবেন না। আল্লাহর নাম কাহ্হার! নামাজ ছাড়িলে আগুনের দরিয়ায় ডুবাইবেন। রক্ষা নাই।

এখন প্রশ্ন হলো: যিনি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়েন, এমনকি কঠিন বিমারেও নামাজ পড়েন, ওজিফা করেন, মোরাকাবা করেন এবং আল্লাহর যিকরের মাধ্যমে আল্লাহর তাজাল্লীতে ক্বলব তাজা রাখেন, তাঁর পক্ষে নোংরা, ময়লা কাপড়-চোপড় পরা বা অপবিত্র থাকা কি সম্ভব?

সুফি সাধকের ছবির তাজিম:

কতিপয় ভক্তকে দেখেছি তাদের পীরের ছবি সুন্দরভাবে বাধাই করে চারপাশে ফুল দিয়ে সাজিয়ে রাখেন আবার সকাল সন্ধ্যায় আগর বাতি, মোমবাতি চারদিকে জ্বালিয়ে সামনে নিয়ে ধ্যান করেন, সালাম করেন, বা সেজদাও করেন। কেউবা দেয়ালে সুন্দর করে সাজিয়ে রাখেন। এ সকল কাজগুলো পৌত্তলিকদের মূর্তিপূজা সদৃশ্য। যা ধ্বংস করার জন্য ইসলামের আগমন ঘটেছিল। এ পর্যায়ে একখানা হাদিস উল্লে­খ করা যেতে পারে রাসূল (সা.) বলেন, ‘যে ঘরে ছবি লটকানো এবং কুকুর থাকে সে ঘরে আল্লাহর রহমতের ফেরেশতা প্রবেশ করে না।’ (বুখারী ও মুসলিম)।

এ জাতীয় কার্যক্রম এনায়েতপুর দরবার শরীফে দেখা যায় না। সেখানে কোন পীর-পূঁজা বা কবর-পূঁজা করার রীতি নেই। ছবি টাঙ্গানো বা ছবিতে সালাম – এ জাতীয় ঘটনার বিন্দুমাত্র নিদর্শনও এ দরবার শরীফে নেই। দরবার শরীফের কোথাও কারও কোন ছবি নেই। বস্তুত: খাজা এনায়েতপুরী (র.)-এর কোন ছবি কোথাও নেই। তিনি কোনদিন কোন ছবি তোলেন নি। এমনকি তাঁর পরিবারের সঙ্গে বা সন্তান-সন্ততির সঙ্গেও তাঁর কোন ছবি নেই। এনায়েতপুর দরবার শরীফের কোথাও কোন ছবি নেই। খাজা এনায়েতপুরীর যে-সকল মুরিদ আজও জীবিত আছেন তারাও খাজা এনায়েতপুরীর কোন ছবি কখনও দেখেন নি বলে দাবি করেন।

অপচয় ও অপব্যয়:

বর্তমানে বাংলাদেশে কিছু কিছু সাধক এবং তাঁদের অনুসারী অত্যন্ত বিলাস বহুল জীবন যাপন করেন। যেমন, যেখানে ভালোভাবে চলার জন্য ১০/১২ লাখ টাকায় একটি গাড়ী হলেও চলে সেখানে দেখা গেছে হুজুরের গাড়ীর দাম ৫০ লাখ টাকার উপরে। আবার তাঁদের খানকা, বাসা সর্বত্র স্বাভাবিক থেকে বেশি বিলাস বহুল দৈনন্দিন ব্যবহার্য বস্তু-দ্রব্যাদি। অপ্রয়োজনীয় আলোকসজ্জা। যা প্রকৃত সুফিসাধকদের জীবনের সাথে সংগতিপূর্ণ নয়। কেননা আল্লাহ পাক বলেন, “তোমরা খাও, পান কর। কিন্তু অপচয় কর না। নিশ্চয়ই আল্লাহ অপচয়কারীকে ভালোবাসেন না” [সূরা আন’আম (৬):১৪১]।

বিশ্বশান্তি মঞ্জিল তথা এনায়েতপুর দরবার শরীফে যে সব ভক্ত-মুরিদ আসেন তাঁরা জানেন যে, এ দরবারের কোন শান-শওকত নেই। আর তাঁদের পীরও কোন আড়ম্বরপূর্ণ জীবন যাপন করেন না বা করতেন না। খাজা এনায়েতপুরী সারাজীবন নফসের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে গেছেন। তাঁর কঠোর সাধনার তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক উভয় দিকের তাৎপর্য রয়েছে। তিনি যেমন দীর্ঘকাল অনাহারে-অল্পাহারে দিন কাটিয়ে নিজের নফ্সকে সংযত করার ব্যবহারিক শিক্ষা গ্রহণ করেছিলেন, তেমনি তিনি তাঁর মুরিদদেরকেও অল্প আহার ও অল্প নিদ্রা আর অধিক আল্লাহর ইবাদতের শিক্ষা দিয়েছিলেন। এ ধারা আজও অব্যাহত আছে। ‘অল্প আহার, অল্প নিদ্রা ও অল্প কথার অভ্যাস করা একান্ত আবশ্যক’Ñ এটা ছিল তাঁর একটি অমূল্য বাণী।  এ সম্পর্কে তাঁর আর একটি বাণী উল্লে­খ না করলেই নয়। তিনি বলতেন, ‘দিনে কম খাও যদিও তুমি রোজাদার নও। ভরা পেট খাইও না, কারণ তুমি চার পাইয়া পশু নও।’

যারা প্রকৃত সুফি তাঁরা জীবনের, দুনিয়ার আরাম-আয়েশকে হারাম করে আল্লাহর নৈকট্য লাভে অধিক ইবাদতে নিমগ্ন থাকেন। খাজা এনায়েতপুরী একটি ছোট্ট টিনের ঘর থেকে তরিকা প্রচার করতেন। আর বরই গাছের নিচে বসে যাকেরদেরকে শরিয়তের-তরিকতের আহকামসমূহ বুঝিয়ে দিতেন। একশত বছরেরও পুরাতন সে বরই গাছ এখনও আছে এবং আজও সেখান থেকে বর্তমান সাজ্জাদানিশিন শাহসুফি খাজা কামাল উদ্দীন (নূহমিয়া) খাজা এনায়েতপুরীর তরিকা শিক্ষা দিয়ে থাকেন। তিনি অত্যন্ত সাধারণ জীবন যাপন করেন। অত্যন্ত অল্পাহারী, শিশুসুলভ স্বভাবের আধ্যাত্মিকতার উজ্জ্বল এই জ্যোতিস্ক একটি কলাকে তিন ভাগ করে তিনবার খান, একটি বড়ো খেজুরকে দু’ভাগ করে দুইবার খান, প্রতিবেলায় এক থেকে দেড় চামচ ভাত খান। খাজা এনায়েতপুরীও এরূপ জীবনযাপন করতেন। এখানেই খাজা এনায়েতপুরীর তরিকার সঙ্গে অন্যান্য মাযার কেন্দ্রিক পীরবাদের মৌলিক পার্থক্য।

ভন্ডামী ও হটকারীতা:

এক মাযারের কাছে গেলাম। পাশে বিশাল মসজিদ। আমরা নামাজের জন্য জামাত ধরার জন্য যাচ্ছি অথচ একজন খুবই সুস্বাস্থ্যের অধিকারী শরীরে মোটা শিকল বাধা বস্ত্রহীন। কয়েকজন পা টিপছে আর বলছে, ‘দিয়ে যা কাজ হবে’। এ সকল ভন্ডামী শরিয়ত সমর্থন করে না।

আর এ রকম ভন্ডামীর জন্য যারা প্রকৃত সুফিসাধক তাঁদেরকেও মানুষ ভুল বোঝে। মোদ্দাকথা হলো আসল আর মেকির পার্থক্য বুঝা দরকার। দুনিয়ায় আল্লাহ মানুষ সৃষ্টি করেছেন শ্রেষ্ঠ করে, আবার তাকে রেখেছেন সবচেয়ে নিকৃষ্ট করে, কারণ সে খারাপ কাজও করতে পারে। মন্দের বিপরীতে ভালো, অন্যায়ের বিপরীতে ন্যায়, মিথ্যার বিপরীতে সত্য খুঁজে বের করা সহজ নয়। অথচ, আমরা না বুঝে মিথ্যাটাকে সত্য বলে ভুল করি। উপরে বর্ণিত কার্যক্রম সম্পূর্ণ ভন্ডামীপূর্ণ এবং এর সাথে সুফিবাদের কোন সম্পর্ক নেই।

উপসংহারে বলা যায় যে, কিছু ভন্ড ব্যবসায়ী ভন্ড বেশ-ভূষা বা পরিচয়ে বাংলাদেশের সহজ সরল মানুষকে প্রতারিত করে থাকে। এদেশে ভন্ড কবিরাজ, ভন্ড সাধু, ভন্ড দরবেশের প্রভাবে অসংখ্য মানুষ প্রতারিত হয়, যেমনভাবে ভন্ড পুলিশ বা ভন্ড আর্মি অফিসারের দ্বারা সাধারণ মানুষ প্রতারিত হয়ে থাকে। তবে ব্যতিক্রম যেমন দৃষ্টান্ত হতে পারে না, তেমনি কোন বিক্ষিপ্ত বা মিথ্যা ঘটনাও সার্বিক সত্যের ধারক হতে পারে না।

এ নিবন্ধে আলোচিত অভিযোগগুলো ঢালাওভাবে সকল সুফি খানকা বা দরবার সম্পর্কে করা হয় নি। সুফিচর্চার নামে যে সকল অসঙ্গতি সমাজে পরিলক্ষিত হয় সেগুলোই কেবল তুলে ধরা হয়েছে। আর এতে দেখানো হয়েছে যে, খাজা এনায়েতপুরীর প্রচারিত ও প্রসারিত তরিকায় ঐ সমস্ত অভিযোগের সাথে কোন সম্পর্ক নেই। এ তরিকার রাসূলুল্লাহর সত্য তরিকার অনুসারী। এখানে শরিয়তবিরোধী বা ইসলামবিরোধী কোন কার্যক্রম হয় না, কেননা এসব অসামাজিক কার্যক্রমের বিরুদ্ধেই তিনি ইসলামের সঠিক চিত্র প্রচার করেছিলেন। যে দরবারে সামান্য শোরগোল বা বেয়াদবী করলে আল্লাহ বেজার হন বলে শিক্ষা দেয়া হয়, সে দরবারে কী করে ইসলামবিরোধী কার্যকলাপকে মেনে নেয়া হবে?

খাজা এনায়েতপুরীর শিক্ষার মূল লক্ষ্য ছিল ইসলামের আলোকে তাঁর মুরিদকে পরিপূর্ণ মোমিন করে আল্লাহর তাজাল্লীতে দেল (ক্বলব) উজ্জ্বল করিয়ে দেয়া। তাঁর শিক্ষার যেমন আধ্যাত্মিক দিক আছে, তেমনি আছে নৈতিক ও মানবিক দিক। তিনি শিক্ষা দিয়েছিলেন, ‘এই তরিকার মূল প্রতিজ্ঞা হলো: চুরি করিব না, ডাকাতি করিব না, খুন করিব না, মিথ্যা বলিব না, জ্বেনা করিব না এবং শরিয়তের যাবতীয় হুকুম মানিয়া চলিব। এই সকল প্রতিজ্ঞার বাহিরে যে যাইবে, সে এই তরিকতের লোক নয়’। খাজা এনায়েতপুরী আরও বলেন, ‘চুরি, ডাকাতি, জ্বেনা, খুন, হারামী করা ও হারাম খাওয়া তরিকতের নীতির বহির্ভূত’। আজও এই প্রতিজ্ঞায় শপথ করিয়ে এ তরিকায় বায়াত প্রদান করা হয় এবং শরিয়ত ও তরিকতের পূর্ণ আমলের দ্বারা ইলমে শরিয়ত ও ইলমে আসরার জ্ঞানে সমৃদ্ধ করে যাকেরকে আলমে আরোয়াহতে উপনীত হতে সাহায্য করে দ্বীন ইসলামের খেদমত করা হয়। (সমাপ্ত)

অধ্যাপক ড. মো. গোলাম দস্তগীর

টরন্টো

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *