কানাডায় কেমন আছেন বাংলাদেশী সিঙ্গেল মাদাররা?
খুরশিদ আলম ॥ ৩০ মে ২০২৫: মানুষ প্রয়োজনে ঘর বাঁধে। আবার প্রয়োজনেই ঘর ছাড়ে। তবে একজন নারীর ঘর ছাড়ার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয় তখনই যখন আর উপায় না থাকে, পিঠ যখন দেয়ালে ঠেকে যায়। আর এ কাজটি মোটেও সহজ নয়। অনেক ভেবে চিন্তে এই সিদ্ধান্তটি নিতে হয়। কারণ সিঙ্গেল মাদার বা একক মা হিসেবে একজন নারীকে পাড়ি দিতে হয় জীবনের অনেক চড়াই-উতরাই। অভিবাসী সিঙ্গেল মাদারদের বেলায় এ সংগ্রামটি আরো বেশি কঠিন। তবে শুধু অভিবাসী সিঙ্গেল মাদারদেরকে নয়, কানাডার মূলধারার সিঙ্গেল মাদারদেরকেও মোকাবেলা করতে হয় এসব পরিস্থিতি। কিন্তু তুলনামূলকভাবে বেশি চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হয় অভিবাসী সিঙ্গেল মাদারদেরকে। প্রথম কারণ কানাডার এই অনাত্মীয় পরিবেশ। এখানে ঘর ছেড়ে বাবা-মা বা ভাই-বোনদের বাড়িতে গিয়ে আশ্রয় নিবেন সে রকম পরিস্থিতি প্রায় কারোরই নেই। কারণ সিংহভাগ অভিবাসীর বাবা-মা ও অন্যান্য আত্মীয়-স্বজন থাকেন দেশে। আর যদিও বা কানাডায় কেউ থাকেন, তাদের পক্ষে বেশিদিন আশ্রয় দেওয়া সম্ভব হয় না অধিকাংশ ক্ষেত্রেই। সীমিত আয়, স্বল্প পরিসরের বাসা-বাড়িসহ আরো কিছু সমস্যার কারণে এমনটা হয়।
কানাডায় এই অভিবাসী সিঙ্গেল মাদারদের মধ্যে বাংলাদেশ থেকে আসা মহিলারাও আছেন। এরা ঘর ছেড়েছেন কানাডায় আসার পর। প্রধান কারণ, পারিবারিক সহিংসতা। আমরা প্রবাসী কণ্ঠ ম্যাগাজিনের পক্ষ থেকে কথা বলেছি এরকম ৫ জন সিঙ্গেল মাদারের সঙ্গে। এরা সবাই টরন্টোর অধিবাসী। প্রবাসী কণ্ঠ ম্যাগাজিনের পক্ষ হয়ে এদের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন টরন্টোর বাংলাদেশী কমিউনিটির একজন সাংস্কৃতিক কর্মী ও সমাজবেসী আফরোজা বেগম। সাক্ষাৎকারে এরা সবাই জানিয়েছেন প্রবাসে সিঙ্গেল মাদার হিসাবে তাদের বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের কথা। কি ভাবে তারা অনাত্মীয় এই প্রবাস জীবনে কঠিন জীবন পার করছেন সেই সব কথা। পাঠকদের সঙ্গে আমরা শেয়ার করবো সেই সব কথা। তবে তার আগে জেনে নেই কানাডায় অভিবাসী সিঙ্গেল মাদারদের সার্বিক অবস্থার কথাগুলো।
বস্তুত কানাডায় অভিবাসী সিঙ্গেল মাদার বা একক মায়েদেরকে প্রধানত যে সকল চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে দিন যাপন করতে হয় তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো আশ্রয়, দারিদ্রতা, খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা এবং একক দায়িত্বে সন্তানদের মানুষ করা।

স্ট্যাটিসটিসক কানাডার সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে ২০২২ সালে একক পিতা বা একক মাতার পরিবারে বসবাসকারী প্রায় এক চতুর্থাংশ সদস্য ছিল দারিদ্রসীমার নিচে। আর যে সকল পরিবার ছিল সিঙ্গেল মাদারের নেতৃত্বে, তাদের বেলায় দারিদ্রসীমার নিচে বসবাসের সম্ভাবনা ছিল প্রায় চার গুণ বেশি।
দেখা গেছে ভাষাগত বাধা এবং কানাডার আইন ও পরিষেবা সম্পর্কে জ্ঞানের অভাবের কারণে অনেক অভিবাসী সিঙ্গেল মাদারদের পক্ষে বিদ্যমান সরকারী সহায়তা এবং সুযোগগুলির সুবিধা গ্রহণ করা অনেক সময় কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।
আবার নিঃসঙ্গতা, একক মাতৃত্বের জীবন, দারিদ্রতা, কারো কারো বেলায় অভিবাসনের চাপ এবং ভাষাগত বাধা মিলিত হয়ে সৃষ্টি করতে পারে মানসিক স্বাস্থ্যের চ্যালেঞ্জ। এই চ্যালেঞ্জের মধ্যে আছে মানসিক চাপ, উদ্বেগ এবং বিষণ্নতাকে মোকাবেলা করা। এই তথ্য জানায় স্বাস্থ্যবিষয়ক একটি ওয়েবসাইট এ্যাসেণ্ডাহেলথ.অরগ।
আবার অভিবাসী নারীদের নিজস্ব সংস্কৃতিক এবং সামাজিক রীতিনীতি অনেক সময় পারিবারিক সহিংসতা বা অন্যান্য সমস্যা মোকাবেলা করার সময় সাহায্য চাওয়ার ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি করতে পারে।
কানাডায় এই সিঙ্গেল প্যারেন্টস পরিবারের সংখ্যা কিন্তু কম নয়। ২০২৪ সালে প্রকাশিত সর্বশেষ আদম শুমারীর রিপোর্ট অনুযায়ী দেখা গেছে দেশটিতে ১৮ লাখ ৩৬ হাজারেরও কিছুটা বেশি সিঙ্গেল প্যারেন্টস পরিবার আছে। আর এর মধ্যে শতকরা প্রায় ৮০টিরও বেশি পরিবারের নেতৃত্বে আছেন সিঙ্গেল মাদারগণ।
গবেষণায় আরো দেখা গেছে যে, সিঙ্গেল মাদাররা বিবাহিত মহিলাদের তুলনায় ঘণ্টায় ১৯% কম মজুরি পান কর্মক্ষেত্রে যা গত প্রায় ২৮ বছর ধরে কার্যত অপরিবর্তিত রয়েছে। কিন্তু পেশার পার্থক্য এবং শিক্ষাগত যোগ্যতার বিষয়গুলি বিবেচনায় নিলে এই ব্যবধানটির যথেষ্ট পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়।
সম্প্রতি আদমশুমারির তথ্য ব্যবহার করে প্রকাশিত স্ট্যাটিসটিকস কানাডার আরেকটি গবেষণায় দেখা গেছে যে যদিও নারীদের মজুরি পুরুষদের তুলনায় দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছে, তবুও লিঙ্গগত মজুরি বৈষম্য এখনও রয়ে গেছে। ২০২১ সালে, মধ্যম পদমর্যাদার ম্যানেজার বা ব্যবস্থাপকদের মধ্যে নারীরা পুরুষদের তুলনায় ৮.৭% কম উপার্জন করেছেন এবং সিনিয়র ম্যানেজারদের মধ্যে নারীরা ৯.০% কম উপার্জন করেছেন। ২০০১ সাল থেকে এই ব্যবধান অনেক কমেছে। সেই বছর, মধ্যম পর্যায়ের নারী ও পুরুষ ব্যবস্থাপকদের মধ্যে মজুরি বৈষম্য ছিল ১৯.৩% এবং নারী ও পুরুষ সিনিয়র ব্যবস্থাপকদের মধ্যে বৈষম্য ছিল ২০.০%।
২০২১ সালের আদমশুমারির তথ্য ব্যবহার করে অন্যান্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে যে ২০২০ সালে সিঙ্গেল প্যারেন্টস পরিবারে থাকা ব্যক্তিদের আয় সন্তানসহ দম্পতি পরিবারের ব্যক্তিদের তুলনায় প্রায় চার গুণ কম ছিল। অন্যদিকে একজন মহিলার নেতৃত্বে থাকা পরিবারের ব্যক্তিদের মধ্যে পুরুষের নেতৃত্বে থাকা ব্যক্তিদের তুলনায় আয় কম ছিল। এছাড়াও, একজন অভিবাসী মহিলার নেতৃত্বে থাকা পরিবারের সদসদ্যদের কম আয়ের সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি।
আমরা জানি অনেক অভিবাসী দম্পতি কানাডায় আসেন অর্থনৈতিক এবং শিক্ষাগত সুযোগ লাভের আশায়, বিশেষ করে তাদের সন্তানদের জন্য। কিন্তু আসার পর যদি কোন কারণে তাদের পরিবারে ভাঙ্গণ ধরে, উভয়ের মধ্যে ছাড়াছাড়ি হয়ে যায় তখন অল্পবয়সী সন্তানদের নিয়ে একাকী হয়ে যাওয়া মা নানান চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়ে যান। এর মধ্যে অন্যতম হলো সন্তানদের ভবিষ্যৎ।
বিবাহবিচ্ছেদের পর কখনো কখনো দেখা যায়, মা-সন্তানের সম্পর্ক দুর্বল হয়ে যায়। নানারকম চাপ, পারিবারিক পরিবেশের পরিবর্তন এবং বিবাহ-পরবর্তী দ্বন্দ্বের কারণে অনেক সময় মায়েরা তাদের সন্তানদের প্রতি আবেগগতভাবে কম সাড়া দিতে পারেন। আবার পাশ্চাত্য সমাজে বিবাহ বিচ্ছেদ ক্রমশ গ্রহণযোগ্যতা পেলেও বা একে স্বাভাবিক বলে মেনে নিলেও এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য বা অন্যান্য নন-ইউরোপীয় দেশগুলো থেকে আসা অভিবাসীদের বেলায় পরিস্থিতিটা সেরকম নয়। তাদের সংস্কৃতিতে বিবাহ বিচ্ছেদকে সহজভাবে নেওয়া হয় না যতটা নেওয়া হয় ইউরোপ, আমেরিকা ও কানাডাসহ অন্যান্য শিল্পোন্নত দেশে। অনেক পশ্চদপদ দেশে যেখানে আধুনিক শিক্ষার বিস্তার তেমন লাভ করেনি সে সব দেশে বিবাহিত মহিলাদেরকে নির্যাতন বা স্বামীর পরকীয়া সম্পর্ক থাকলেও সেটা মেনে নেওয়ার জন্য উপদেশ দেওয়া হয়। কানাডায় এসেও তারা এই সংস্কৃতি থেকে মুক্ত হতে পারে না অধিকাংশ ক্ষেত্রেই। ফলে মুখ বুজে নির্যাতন সহ্য করতে হয়। তাছাড়া এই অনাত্মীয় পরিবেশে কোথায় যাবে, কার কাছে যাবে সেই চিন্তা থেকেও অনেক সময় নির্যাতনকে সহ্য করে নিতে হয় অনেক মহিলাকে। আরো আছে অর্থনৈতিক চিন্তা। আলাদা হলে আহার-বাসস্থানের কি ব্যবস্থা হবে সে চিন্তায়ও অনেকে সাহস পান না সামনে এগুতে। বিশেষ করে যারা নবাগত। আর নবাগত না হলেও যারা চাকরী করেন না তারাও ভীত থাকেন। অন্যদিকে পারিবারিক সহিংসতার শিকার হয়ে যাদেরকে আলাদা হয়ে যেতে হয়, বিশেষ করে যারা নবাগত তারা অধিকাংশই জানেন না যে, কানাডায় নির্যাতিত নারীদের সহায়তা প্রদানের জন্য সরকারের বিভিন্ন কর্মসূচি রয়েছে। সেল্টার থেকে শুরু করে আর্থিক সহায়তা, কাউন্সিলিং ইত্যাদি সবই আছে।
এছাড়াও অভিবাসী সিঙ্গেল মায়েদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের পাশাপাশি সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং অভিভাবকত্বের চাহিদা সম্পর্কিত চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। আবার দেখা গেছে যে-সব শিশু বা তরুণ-তরুণী সিঙ্গেল মাদারের নেতৃত্বাধীন পরিবারে বড় হয় তারা অন্যসব তরুণ-তরুণীদের তুলনায় কিছুটা অবাধ্য হওয়ার ঝুঁকিতে থাকে এবং আচরণগত সমস্যায় ভোগার সম্ভাবনাও বেশি তাদের।
আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, কানাডায় সিঙ্গেল মাদারের জীবন বেছে নিতে বাধ্য হওয়ার পিছনে অন্যতম কারণ হলো পারিবারিক সহিংসতা। ইতিপূর্বে কানাডার সিবিসি নিউজে প্রকাশিত একটি রিপোর্ট থেকে আরো জানা যায় যে, কানাডায় প্রতিদিন গড়ে ২৩০ জন ব্যক্তি পারিবারিক সহিংসতার শিকার হন। এটি পুলিশের খাতায় নথিবদ্ধ করা হিসাব। এর বাইরেও আরো অনেক ঘটনা থাকতে পারে। কারণ, দেখা গেছে কানাডায় পারিবারিক সহিংসতা যা ঘটে তার প্রায় শতকরা ৭০ ভাগই গোপন থেকে যায়। পরিবারের সম্ভ্রমহানির ভয়ে, লজ্জার কারণে বা আরো নির্যাতনের ভয়ে সহিংসতার যারা শিকার
তারা চুপচাপ থেকে যান। এই প্রবণতা বেশি দেখা যায় অভিবাসী পরিবারগুলোর মধ্যে।
উল্লেখ্য যে কানাডায় পারিবারিক সহিংসতা সাম্প্রতিক সময়ে বেড়েই চলেছে। স্ট্যাটিস্টিকস কানাডা এ বিষয়ে ২০২২ সালের ১৯ অক্টোবর এক রিপোর্ট প্রকাশ করে। এতে দেখা যায়, ২০২১ সালে পুলিশে রিপোর্ট করা হয়েছে এমন পারিবারিক সহিংসতার শিকার হয়েছেন এক লাখ ২৭ হাজার ৮২ জন কানাডিয়ান।
অন্য এক রিপোর্ট থেকে জানা যায়, কানাডায় গড়ে প্রতি আড়াই দিনে একজন নারী বা মেয়ে নিহত হয়। ইতিপূর্বে নারীহত্যা সম্পর্কিত এক রিপোর্টে এ কথা বলা হয়েছে। ন্যায়বিচার ও জবাবদিহি বিষয়ক কানাডার নারীহত্যা পর্যবেক্ষণ সংস্থার (Canadian Femicide Observatory for Justice and Accountability) ২০২০ সালের রিপোর্টে বলা হয়, ওই বছর কানাডায় মোট ১৬০ জন নারী ও মেয়ে হত্যার শিকার হয়েছেন। ওই বছরের এপ্রিল মাস ছিল নারী ও মেয়েদের জন্য সবচেয়ে ভয়াবহ মাস। ওই মাসে মোট ২৬ জন নিহত হয় বলে রিপোর্টে জানানো হয়। সংবাদটি প্রকাশিত হয়েছিল সিটিভি নিউজে।
আমরা দেখেছি ইতিপূর্বে গ্রেটার টরন্টোতে তিনজন বাংলাদেশী মহিলা খুন হয়েছেন তাদের স্বামীদের হাতে। অন্যদিকে স্ত্রী নির্যাতনের সংখ্যা কম নয় বাংলাদেশী কমিউনিটিতে। বেশ কয়েক বছর আগে ড্যানফোর্থের এক বাংলাদেশী কানাডিয়ান ব্যারিস্টার কথাপ্রসঙ্গে এই প্রতিবেদককে বলছিলেন, টরন্টোর বাঙ্গালী পাড়া (ড্যানফোর্থ ও ভিক্টোরিয়া পার্ক এলাকায়) থেকে প্রতি একদিন পর পর গড়ে একজন বাংলাদেশী পুরুষকে পুলিশ ধরে নিয়ে যাচ্ছে স্ত্রী নির্যাতনের অপরাধে।
তবে পারিবারিক সহিংসতার শিকার শুধু মহিলারাই হন তা কিন্তু নয়। অনেক পুরুষও নির্যাতনের শিকার হন তাদের স্ত্রীদের হাতে। দেখা গেছে সরকারী হিসাবমতে ২০১৯ সালে কানাডায় ২৩,১৪৬ জন পুরুষ পারিবারিক সহিংসতার শিকার হয়েছেন। এই হিসাব হয়ত আরো বেশি হতে পারে। কারণ, সাধারণত পুুরুষরা স্ত্রী কর্তৃক নির্যাতনের বিষয়টি পুলিশের কাছে রিপোর্ট করেন না। ২০২১ সালে প্রকাশিত আরেক রিপোর্টে দেখা গেছে প্রায় ৩৬% পুরুষ (৪.৯ মিলিয়ন) তাদের লাইফটাইমে অন্তরঙ্গ সঙ্গীর হাতে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। মহিলাদের মধ্যে এই সংখ্যা ৪৪% (৬.২ মিলিয়ন)। তথ্য সূত্র : justice.gc.ca
উল্লেখ্য যে, কানাডায় সিঙ্গেল মাদারের জীবন বেছে নেওয়ার পিছনে পারিবারিক সহিংসতার পাশাপাশি আরো যে সকল কারণ থাকে তার মধ্যে আছে পরকীয়া, সঙ্গীর প্রতি সন্দেহপ্রবণতা, দারিদ্রতা, অপমানজনক ব্যবহার, দাম্পত্য জীবনে অসুখী হওয়া, দাম্ভিকতা ইত্যাদি। প্রবাসী বাংলাদেশীদের বেলায়ও একই কথা প্রযোজ্য।
এবারে আসা যাক সাক্ষাৎকারের বিষয়ে। প্রবাসী কণ্ঠ ম্যাগাজিনে যে পাঁচজন বাংলাদেশী সিঙ্গেল মাদার সাক্ষাৎকার দিয়েছেন তাদের কাছে প্রথমেই জানতে চাওয়া হয়েছিল সেপারেশন বা ডিভোর্স কি কারণে হয়েছিল। এই পাঁচজনের মধ্যে দুই জন বলেন ছাড়াছাড়ি হয়ে যাওয়ার পিছনে বড় ভূমিকা রেখেছে মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন। দুই জন বলেন স্বামীর অন্যত্র পছন্দ ছিল তাই ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। সেটা সম্ভত পরকীয়ার বিষয় ছিল। মহিলাদ্বয় স্পষ্ট করে কিছু বলেননি।
পঞ্চমজন বলেন, মতের অমিল হতো স্বামীর সঙ্গে, স্বামী খুব ডমিনেট করতো, সবকিছু কন্ট্রোল করতো, অবমূল্যায়ন করতো, ছোট ছোট কারণে গায়ে হাত তুলতো।
টরন্টোতে আরেক সিঙ্গেল মাদারের কাহিনীটা ছিল এরকম- তার স্বামী সন্দেহ করতেন স্ত্রী সম্ভবত কর্মস্থলে অন্য পুরুষের সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়েছেন। আর এ কারণে প্রায়ই কর্মস্থলে হাজির হয়ে আড়াল থেকে তার গতিবিধি লক্ষ্য করতেন। বিশাল কর্মস্থল হওয়ার কারণে আড়াল থেকে নজরদারি করাটা ছিল কিছুটা সহজ। এ ছাড়াও প্রায়ই শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনও করতেন স্বামী। একদিন স্বামী তার কর্মস্থল থেকে স্ত্রীকে ফোন দেন এবং কথা কাটাকাটির এক পর্যায়ে স্ত্রীকে খুন করার হুমকি দিয়ে বলেন, ‘রেড়ি হ, আমি আসছি’। তখন ঐ মহিলা তার মেয়ের পরামর্শে ৯১১ এ কল করেন। পুলিশ তখন বাড়িতে এসে ওৎ পেতে অপেক্ষা করতে থাকে। কিছুক্ষণ পর স্বামী বাড়ি আসলে পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে। সেই সংসার আর টিকেনি পরে। দু’জনের মধ্যে ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। এই কাহিনিটি ঐ সিঙ্গেল মাদারের এক পারিবারিক বন্ধুর কাছে শোনা।
প্রবাসী কণ্ঠকে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন যে পাঁচ সিঙ্গেল মাদার, আমরা সঙ্গত কারণেই তাদের নাম পরিচয় প্রকাশ করছি না। সাক্ষাৎকারে উনারা আরো কিছু কথা বলেছেন যা এখানে তুলে ধরা হলো।
ধরা যাক প্রথম মহিলার নাম রাবেয়া। তিনি যখন এই সাক্ষাৎকার দেন তার তিন বছর আগে স্বামীর সাথে তার ছাড়াছাড়ি হয়। প্রেমের বিয়ে ছিল তাদের। বিয়ে হয়েছিল দেশে থাকা অবস্থায়। তিনি জানান কানাডায় আসার পর স্বামী তাকে সবসময়ই মানসিক নির্যাতন করতেন। একবার শারীরিকভাবেও নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন তিনি। কিন্তু তারপরও রাবেয়া সেই স্বামীর বিরুদ্ধে কোন আইনী পদক্ষেপ নেননি। সেপারেশন বা ডিভোর্সের আগে কোন প্রফেশনাল কর্তৃক কাউন্সিলিংও হয়নি তাদের। আত্মীয়-বন্ধুদের মাধ্যমেও কাউন্সিলিং হয়নি তাদের। ছাড়াছাড়ির সময় তাদের দুই মেয়ে ছিল। বয়স তখন তাদের ৩০ ও ৩১। এক মেয়ে ইঞ্জিনিয়ার। আরেক মেয়ে থাকেন তার সঙ্গেই। তিনি জানান বাবার সঙ্গে মেয়েদের যোগাযোগ আছে কিন্তু সেটি নামমাত্র। বাবা সম্পর্কে মেয়েদের ধারণা ভালো নয়। তারা বাবাকে স্বার্থপর ভাবেন। আর বাবার অনুপস্থিতির কারণে মেয়েরা এখন আর নিরাপত্তাহীনতায়ও ভোগে না। তারা এখন যথেষ্ট বড় হয়েছে।
ছাড়াছাড়ি হয়ে গেলেও রাবেয়া কোন এলিমনি বা ভরণপোষণ পান না তার সাবেক স্বামীর কাছ থেকে। থাকেন তিনি ভাড়া বাসায়। তার কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল তাদের এই ছাড়াছাড়ির কারণে সন্তানদের উপর অন্য কোন বিরূপ মানসিক প্রভাব পরছে কি না। উত্তরে তিনি বলেন, হ্যাঁ বিরূপ মানসিক প্রভাব পড়ছে। তারা কেউই এখন আর বিয়ে করতে চায় না।
রাবেয়ার কাছে আরো জানতে চাওয়া হয়েছিল তিনি সিঙ্গেল মাদার হওয়ার কারণে পরিচিতজনেরা তাকে অন্য চোখে দেখেন কি না। জবাবে তিনি বলেন, হ্যাঁ অন্য চোখে দেখেন। আর পরিচিত পুরুষদের কেউ কেউ মাঝে মাঝে উত্ত্যক্ত বা বিরক্ত করেন বলেও জানান তিনি।
রাবেয়াকে আরো প্রশ্ন করা হয়েছিল, আপনার প্রাক্তন স্বামী কি আপনার কাছে ফিরে আসার ইচ্ছে প্রকাশ করেছিলেন কখনো? করে থাকলে আপনার দিক থেকে প্রতিক্রিয়া কি ছিল? উত্তরে তিনি জানান, না ফিরে আসার ব্যাপারে কখনো কিছু বলেননি। ছাড়াছাড়ি হয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্তটা তারই ছিল। আর মেয়েরাও ছাড়াছাড়ির পক্ষেই ছিল। তবে সে ফিরে আসলে আমি যাবো তার সাথে। রাবেয়া আরো জানান তিনি নিজেই সাবেক স্বামীর কাছে ফিরে যাওয়ার ইচ্ছে প্রকাশ করেছিলেন ইতিপূর্বে। কিন্তু পুনর্মিলনটা আর হয়ে উঠেনি। তবে রাবেয়া জানান বর্তমান অবস্থায় তিনি ভালো আছেন এবং সুখীও। রাবেয়ার শেষ কথা ছিল, ‘দুষ্টু গরুর চেয়ে শূন্য গোয়াল ভালো।’
দ্বিতীয় সিঙ্গেল মাদারের নাম ধরা যাক রেনু। তিনি জানান তার স্বামীর অন্যত্র পছন্দ ছিল। সে কারণে ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। রেনু যখন এই সাক্ষাৎকার দেন তার চার বছর আগে তাদের ডিভোর্স হয়ে যায়। তাদের বিয়ে হয়েছিল কানাডাতেই। বিয়ের পর মানসিক নির্যাতন হতো। তবে শারীরিক নির্যাতন হয়নি কখনো। মানসিক নির্যাতের জন্য রেনু এখানকার পারিবারিক আদালতে গিয়েছিলেন। তবে কোন প্রফেশনাল ব্যক্তি কর্তৃক কাউন্সিলিং হয়নি তাদের। অবশ্য আত্মীয়-বন্ধুদের মাধ্যমে কাউন্সিলিং হয়েছিল। কিন্তু তাতে কোনো ফল হয়নি।
তাদের বিয়ে হয়েছিল ২০০৫ সালে। এবং সেটি ছিল রোমান্টিক অর্থাৎ প্রেমের বিয়ে। তাদের তিন ছেলে। সাক্ষাৎকার দেওয়ার সময় বড় ছেলের বয়স ছিল ১০। পরের দুটি যমজ। বয়স ছিল তখন ৬ বছর। মায়ের সাথেই থাকে তারা। বাবা সম্পর্কে ছেলেদের ধারণা খারাপ। বিচ্ছেদের পর রেনু নিয়ম অনুযায়ী তার সাবেক স্বামীর কাছ থেকে ভরণপোষণ পান তবে তার পরিমান সামান্য।
রেনু জানান প্রথমে তিনি শেল্টারে ছিলেন। পরে বাসা পান ‘টরন্টো কমিউনিটি হাউজিং’ এ যেটা সাধারণভাবে সরকারী বাসা হিসাবে পরিচিত এখানে। নিম্ন আয়ের লোকদের জন্য এই ব্যবস্থা। তিনি আরো জানান, স্বামীর সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হয়ে যাওয়ার পর সেটার বিরূপ প্রভাব পড়তে দেখা গেছে ছেলেদের উপর। তারা নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে এবং এক ধরনের অসহায়ত্বও লক্ষ্য করা গেছে তাদের মধ্যে।
রেনুর ভাষ্য অনুযায়ী, যারা জানেন তিনি একজন সিঙ্গেল মাদার তারা তাকে অন্যরকম চোখে দেখেন।
পরিচিত পুরুষদের কেউ কেউ কি কখনো কোন রকম উত্তক্ত্য বা বিরক্ত করেন? এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন- হ্যাঁ করেন। একই সাথে পরিচিত ভাবীদেরও কেউ কেউ আমাকে সন্দেহের চোখে দেখেন এই ভেবে যে তাদের স্বামীদের হয়ত নজর রয়েছে আমার উপর।
রেনুর কাছে আরো প্রশ্ন ছিল – আপনার প্রাক্তন স্বামী কি আবার আপনার কাছে ফিরে আসার ইচ্ছে প্রকাশ করেছিলেন কখনো? তিনি জানান – না। আপনি কি কখনো আপনার প্রাক্তন স্বামীর কাছে ফিরে যাওয়ার ইচ্ছে প্রকাশ করেছিলেন? উত্তর – ভেবে দেখিনি।
রেনু আরো জানান ছাড়াছাড়ি হওয়ার আগে ছেলেদের কোনো অভিমত নেওয়া হয়নি। কারণ ওরা তখন অনেক ছোট ছিল।
স্বামীর সাথে রেনুর ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে কয়েক বছর হয়ে গেল। তিনি জানান বর্তমান অবস্থায় তিনি সুখী নন। আবার নতুন করে ঘর বাধবেন কি না এ প্রশ্নের জবাবে বলেন- হ্যাঁ। সব শেষে তিনি বলেন, মানুষ খুব স্বার্থপর।
তৃতীয় যে সিঙ্গেল মাদার প্রবাসী কণ্ঠকে সাক্ষাৎকার দেন তার নাম ধরা যাক জয়া। তিনি জানান তাকে শারীরিকভাবে মাঝে মধ্যেই নির্যাতন করা হতো। আর মানসিক ভাবে নির্যাতন করা হতো সবসময়ই। জয়া এই নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে এক পর্যায়ে আদালতের শরণাপন্ন হয়েছিলেন। তবে কোন প্রফেশনাল কাউন্সিলিং এর মধ্য দিয়ে যাননি। আত্মীয়-বন্ধুদের মাধ্যমে কাউন্সিলিং হয়েছিল। কিন্তু কাজে দেয়নি।
জয়ার বিয়ে হয়েছিল ১৯৮৮ সালে বাংলাদেশে। প্রেমের বিয়ে ছিল সেটি। তাদের বিবাহিত জীবনে দুটি সন্তান জন্ম নেয়। প্রথমটি মেয়ে। বয়স ২১। ইউনিভার্সিটিতে যায়। দ্বিতীয়টি ছেলে। বয়স ১৭। গ্রেড ১২ এ যায়। তারা মায়ের সাথেই থাকে।
এই তথ্যটি তিনি যখন সাক্ষাৎকারটি দেন তখনকার। সাক্ষাৎকার প্রদানের আরো প্রায় দশ বছর আগে তাদের ছাড়াছাড়ি হয়েছিল।
বাবা সম্পর্কে ছেলে-মেয়েদের ধারণা কি তা জানতে চাইলে জয়া বলেন, খুব খারাপ।
ছাড়াছাড়ি হয়ে যাওয়ার পর এখানকার নিয়ম অনুযায়ী তিনি সাবেক স্বামীর কাছে থেকে ভরণপোষণ পান তবে তার পরিমাণ খুব কম। ছাড়াছাড়ি হওয়ার পর প্রথমে সন্তানদের নিয়ে শেল্টারে উঠেছিলেন। পরে সরকারী বাসায়।
জয়া জানান সংসার ভেঙ্গে যাওয়ার একটা প্রভাব ছেলে-মেয়েদের উপর পড়েছে অবশ্যই। তবে আমার ছেলে-মেয়েদের বেলায় এক অর্থে সেটা ভালোই হয়েছে। কারণ তারা ওভার ম্যাচিওর হয়ে উঠেছে অল্প বয়সেই এবং একই সাথে স্বনির্ভরও। তবে বিচ্ছেদ হয়ে যাওয়ার পর প্রথম দিকে তারা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতো। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে তারা সেটি কাটিয়ে উঠেছে।
জয়ার কাছে আরো জানতে চাওয়া হয়েছিল – আপনি একজন সিঙ্গেল মাদার। এ কথা যারা জানেন তারা আপনার সঙ্গে স্বাভাবিক ব্যবহার করেন নাকি আপনাকে অন্য চোখে দেখে? উত্তরে তিনি বলেন, হ্যাঁ অন্য চোখে দেখেন। আর পরিচিত পুরুষদের কেউ কেউ সবসময়ই বিরক্ত করেন সুযোগ পেলেই। অন্যদিকে পরিচিত ভাবীদের মধ্যেও কেউ কেউ সন্দেহের চোখে দেখেন আমাকে। তারা হয়ত ভাবেন তাদের স্বামীদের নজর রয়েছে আমার উপর।
জয়ার কাছে পরের প্রশ্ন ছিল- আপনার প্রাক্তন স্বামী কি কখনো আপনার কাছে ফিরে আসতে চেয়েছিলেন বিচ্ছেদের পর? অথবা আপনি কি পুনর্মিলনের কথা ভেবেছেন কখনো? উভয় প্রশ্নের জবাবে জয়া জানান – না, সেরকম কোন ইচ্ছা আমার দিক থেকে হয়নি কখনো এবং তার দিকে থেকেও নয়। আর আমাদের বিচ্ছেদটা হয়েছিল কোন রাগের মাথায় নয়, আবার চিন্তাভাবনা করেও নয়। তবে নির্যাতনের কারণে আমার ছেলে মেয়েরা চাইতো আমি যেন আলাদা হয়ে যাই।
জয়ার কাছে আরো জানতে চাওয়া হয়েছিল – আপনার কি মনে হয় কানাডায় আসার কারণেই আপনাদের বিচ্ছেদ হয়েছে? দেশে থাকলে এমনটা হতো না? এর উত্তরে তিনি বলেন, মনে হয়। দেশে থাকলে হয়ত এমনটা হতো না।
জয়ার কাছে শেষ দুটি প্রশ্ন ছিল – আপনার বর্তমান অবস্থায় আপনি কি সুখী? নতুন করে কি ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখেন?
উত্তরে তিনি বলেন, হ্যাঁ নির্যাতনের হাত থেকে মুক্ত হয়ে আমি সুখী। আর নতুন করে ঘর বাঁধার স্বপ্নও দেখি।
সবশেষে জয়া বলেন, মানুষ আমাকে অহেতুক সন্দেহ করে।
চতুর্থ যে সিঙ্গেল মাদার সাক্ষাৎকার দেন তার ছদ্ম নাম অঞ্জনা। তিনি জানান তার স্বামীর অন্যত্র পছন্দ ছিল। যখন তিনি এই সাক্ষাৎকার দেন তার পাঁচ বছর আগে তাদের ডিভোর্স হয়। ডিভোর্সের আগে সেপারেশন পর্ব চলছিল দীর্ঘসময় ধরে। আর সেপারেশনের এক বছর আগে থেকে চলছিল মানসিক নির্যাতন। শারীরিক নির্যাতনও হয়েছিল একবার। তবে এইসব নির্যাতনের বিরুদ্ধে অঞ্জনা কোন পদক্ষেপ নিতে পারেননি বলে জানান। কোন প্রফেশনাল কাউন্সিলিংও হয়নি তাদের বেলায়। অবশ্য পারিবারিক বন্ধুদের মাধ্যমে কাউন্সিলিং এর চেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্তু কাজ হয়নি।
অঞ্জনার বিয়ে হয়েছিল ১৯৯৩ সালে। পছন্দের বিয়ে ছিল। তখন তারা বাংলাদেশ। তাদের পরিবারে জন্ম নেয় তিন সন্তান। সাক্ষাৎকার প্রদান কালে অঞ্জনার বড় মেয়ের বয়স ছিল ২৬। পিএইচডি করছিল সে তখন। বড় ছেলের বয়স ছিল ২৬। অনার্সের স্টুডেন্ট ছিল। আর ছোট ছেলের বয়স ছিল ২০। ইউনিভার্সিটিতে পড়ছিল। বাবার সঙ্গে যোগাযোগ নেই তার তিন সন্তানেরই। বাবা সম্পর্কে ধারণাও তাদের ভাল নয়। দায়িত্বজ্ঞানহীন একজন মানুষ হিসাবে দেখে তারা বাবাকে।
স্বামীর সাথে ডিভোর্স হলেও কখনো এলিমনি বা ভরণপোষণ পানি অঞ্জনা। থাকেন সরকারী বাসায়।
অঞ্জনা জানান, স্বামীর সাথে ছাড়াছাড়ি হয়ে যাবার পর স্বাভাবিকভাবেই সন্তানদের উপর তার প্রভাব পড়েছিল। অনিশ্চয়তা বা অসহায় বোধ করতো তারা। তবে সেটা কাটিয়ে উঠতে পেরেছিল তারা।
অঞ্জনার কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল- আপনি একজন সিঙ্গেল মাদার। এ কথা যারা জানেন তারা কি আপনার সাথে স্বাভাবিক ব্যবহার করেন নাকি অন্যরকম চোখে দেখেন? জবাবে তিনি জানান, আমার ব্যক্তিত্বের কারণে কেউ এরকমটা করেন না। তবে এটাও সত্যি যে, কিছু মানুষ তো অন্য চোখে দেখেনই।
তিনি আরো জানন, পরিচিত পুরুষদের মধ্যে কেউ কেউ উত্ত্যক্ত বা বিরক্ত করতেন আগে। তবে এখন কম। আবার এখানকার পরিচিত ভাবীরা আমাকে সন্দেহের চোখে দেখতেন অনেকেই। আগে এটি খুব বেশি ছিল। তবে এখন কম। সন্দেহটা এই যে, তাদের স্বামীরা আমাকে সিঙ্গেল পেয়ে আমার উপর নজর দেন কি না এই ভেবে।
আপনার প্রাক্তন স্বামী কি আপনার কাছে আবার ফিরে আসতে চেয়েছিল? এই প্রশ্নের জবাবে অঞ্জনা জানান, হ্যাঁ চেয়েছিল। সেটা অনেক আগের কথা। তবে ছেলে-মেয়েরা চায়নি তখন। তারা বলেছিল উনিতো তোমাকে কোনো সম্মান দেননি। আমরা চাই না উনি আবার ফিরে আসুক। অন্যদিকে আমিও আমার দিক থেকে চাইনি তার কাছে ফিরে যেতে। কারণ আমার অপমানবোধ অনেক বেশি।
অঞ্জনা জানান ছাড়াছাড়ির সিদ্ধান্তটা এক পর্যায়ে বাধ্য হয়ে নিয়েছি। আমার ছেলে-মেয়েরাও চাইত আমি আলাদা হয়ে যাই যদিও তারা তখন খুবই ছোট ছিল। বড় মেয়ের বয়স তখন মাত্র ৯ বছর। সে পুলিশের সাহায্য নিতেও বলেছিল।
আমার এই পরিস্থিতির কথা আমি দেশে বলিনি। অবশ্য আমার বাবা তখন জীবিত ছিলেন না। আর মা জানতে পেরেছিলেন সেপারেশনের এক বছর পরে। তবে আমরা কানাডায় না থেকে দেশে থাকলে হয়ত এরকমটা হতো না। সেখানে পরিবার- আত্মীয়স্বজনের একটা চাপ থাকতো নিশ্চই।
আপনি আপনার বর্তমান অবস্থায় কি সুখী? এ প্রশ্নের জবাবে অঞ্জনা বলেন, আমি খাপ খাইয়ে নিয়েছি। এখন আর খারাপ লাগে না।
নতুন করে ঘর বাধার পরিকল্পনা আছে? অঞ্জনার উত্তর ছিল, যদি ভাল মানুষ পাই, নইলে না।
সবশেষে তিনি বলেন, মেয়েদের লেখাপড়া শেষ না করে বিয়ে করা উচিৎ নয়। আর মেয়েদের আত্মসম্মানবোধ থাকা উচিৎ। ইচ্ছা শক্তি মানুষকে চলতে শিখায়।
পঞ্চম যে সিঙ্গেল মাদার সাক্ষাৎকার দেন তার ছদ্মনাম আমরা ধরে নেই মৌসুমী। তিনি বলেন ডিভোর্সের কারণ ছিল একাধিক। এর মধ্যে ছিল মতের অমিল। পরিবারের সবকিছুতেই আধিপত্য বিস্তার করার চেষ্টা করতো সে। আমাকে অবমূল্যায়ন করার প্রবণতা ছিল তার মধ্যে। ছোট ছোট কারণে গায়ে হাত তুলতো। যেমন চা বানাতে দেরি হলে, ভাত ঠিক মত না হলে, এরকম আরো অনেক কারণে। সে টাকা পয়সাও আমার হাতে দিত না। আমি চাকরী করে হাতে যা পেতাম সেটাও সে নিয়ে নিত। আমার পছন্দের মত কোনো খাবারও কিনতে পারতাম না। আমার বাবা-মা, ভাই-বোন, আত্মীয়স্বজন কারো সাথে যোগাযোগ করতে দিত না।
বিয়ে হয়েছিল ১৯৮১ সালে। স্যাটেল্ড ম্যারেজ ছিল। ছোট ছিলাম তখন। বাবা-মা বাধ্য করেছিলেন বিয়ে করতে।
বিয়ের পর প্রায় তিন দশক ধরে স্বামীকর্তৃক নির্যাতিত হয়েছি শারীরিক ও মানসিকভাবে। একবার মাথায় বাড়ি দিয়ে রক্ত বের করে ফেলেছিল। তখন আমার একমাত্র ছেলে ৯১১ এ কল করে এবং বাড়িতে পুলিশ এসে তাকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায়।
মৌসুমী আরো বলেন, আমি সবসময় ভয়ে ভয়ে থাকতাম তার কারণে। তার সব কথা মেনে চলার চেষ্টা করতাম যাতে সে রাগ না করে। আত্মীয়স্বজনরা এড়িয়ে চলতো। সহ্য করার পরামর্শ দিতো। বলতো আরেকটা বিয়ে করলে সেও তো তোমাকে মারতে পারে। তুমি স্বামীর কথা শুনে চলবে। বিয়ে একবারই হয়।
তারপরও আমি আলাদা হতে চাইনি। কিন্তু ২০১১ সালে একদিন সে আমাকে না বলে দেশে চলে যায় এবং ২০১২ সালে সেখানকার আদালতের মাধ্যমে আমাকে ডিভোর্স দেয়।
মৌসুমী জানান তার ছেলে বাবার এই অত্যাচার দেখে ঠিকমতো পড়াশোনাও করতো না। ফলে হাইস্কুলও পার হতে পারেনি। আমার সাথেই থাকতো সে। পরে প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পর এখন আলাদা থাকে। ওর বাবা এখানে নেই। তবে সে এখনও চায় ওর বাবা মা এক সাথে থাকুক। কিন্তু সে তার বাবাকে বিশ^াস করে না। এবং দুঃখজনক বিষয় হলো, সে তার মাকেও বিশ^াস করে না।
এলিমনি বা কোনো ভরনপোষণের টাকা পাননি মৌসুমী। মুসলিম মতে ডিভোর্স হয়েছে। যা পাওনা সেটাও দেওয়া হয়নি তাকে।
সবশেষে মৌসুমী বলেন, প্রায় ৩০ বছরের বিবাহিত জীবন ছিল আমাদের। কিন্তু শেষে আমি কিছুই পেলাম না।
উল্লেখ্য যে, কানাডায় বাংলাদেশী কমিউনিটিতে সিঙ্গেল মাদারদের সংখ্যা কত তা নিয়ে কখনো কোন গবেষণা হয়নি কখনো। আর গবেষণা করা হলেও এই সংখ্যা বের করা সহজ কাজ নয়। তবে প্রবাসে আমরা প্রায় প্রত্যেকেই আমাদের পরিচিত গণ্ডির মধ্যে দুই চারজন সিঙ্গেল মাদারকে চিনি। সেই হিসেবে বলা যায় তাদের সংখ্যাটা নিতান্ত কম নয়। আর তাদের দৈনন্দিন ভোগান্তি ও দিনকাল কিভাবে চলছে এই প্রবাসে তার কিছুটা ধারণা আমরা পেলাম উপরে বর্ণিত পাঁচজন সিঙ্গেল মাদারের কাছ থেকে।