অমল ধবল চাকরি

জসিম মল্লিক

১.   আমি তখন টরন্টোর রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছি। বছর খানেক হয় এসেছি। মনমতো কোনো কাজ পাই না। ভালো কাজের জন্য যে এতো কিছুর দরকার লাগে আমার আগে জানা ছিল না। দেশে আমার বেশ ভালো একটা চাকরি ছিল। ভালো বেতন। কিন্তু একদিন ভাবলাম যাই। কানাডা যাই। অনেকেই যাচ্ছে। শুনেছি কনাডা নাকি হ্যাভেন। এর আগে আমি অফিস থেকে দেশ বিদেশ গিয়েছি। আমেরিকা গিয়েছি। লন্ডন গিয়েছি। প্যারিস গিয়েছি। এপ্লাই করলাম। ধরলাম ইমিগ্রেশন এজেন্সি। কানাডা আসতে গিয়ে প্রায় ফতুর দশা। লম্বা প্রসেস। তারা আমার কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা নিয়ে নিল ফী বাবদে। আসার সময় সাথে নিয়ে আসলাম প্রায় বিশ হাজার ডলার। সেই টাকা বসে বসে খাই। পরে জেনেছি ল্যান্ডিংপেপাড় জাল করেও অনেক লোকজন  এদেশে ঢুকেছে একসময়। অনেক খুনী ডাকাতও বাংলাদেশে থেকে এদেশে এসেছে। তারা বহাল তবিয়তে আছে। জাতির পিতার খুনীও আছে কানাডায়। ১১/১১ এর আমেরিকা থেকেও হাজার হাজার অবৈধ ইমিগ্র্যান্ট কানাডায় এসেছে। অনেকে আবার ওদেশে নানা ধরণের ক্রাইমের সাথে জড়িত ছিল। ক্রেডিট কার্ড জালিয়াতি, বাড়ি কেনাবেচায় জালিয়াতি। নানা কিছু ঘটে আমেরিকায়। অনেকে স্টুডেন্ট হিসাবে আমেরিকায় এসে আর  পড়াশুনা করেনি। ডলারের মোহে পড়ে পড়াশুনার পাট চুকিয়ে দিয়েছে। এরা কেউ ট্যাক্সি চালায় কেউ পিজা ডেলিভারি করে প্রচুর পয়সা রোজগার করেছে।

আমি কানাডায় এসে দেখি আমার জন্য এখানে কিছু করার নাই। কঠিন অবস্থা। যাকেই বলি ভাই একটা কাজ দেন সেই বলে কাজ পাওয়া এত সোজা না। যাকেই বলি ভাইসাব পড়াশুনা করতে চাই সেই বলে পড়ে কী হবে? পড়ে কারো কিছু হয় নাই। কেউ একটা ভালো বুদ্ধি দেয় না। উত্তর আমেরিকায় অড জবকে সবাই বলে ’কাজ’। আমি যখন প্রথমবার আমেরিকায় আসি তখন দেখি সবাই বলে কাজে যাচ্ছি। আমি একটু ফাপরে পড়ে যাই। এখন বুঝি ’কাজ’ জিনিসটা কী। আমার বন্ধু জালাল আহমেদ তাদের একজন। নিউইয়র্কে ট্যাক্সি চালাতো। নিউইয়র্কে একটা এক রুমের বাসায় ভাড়া থাকতো। জালালের স্ত্রী সারাদিন আর জালাল সারারাত কাজ করে। কারো সাথে কারো দেখা হয় না। জালালের স্ত্রী তার চার বছরের মেয়ে নিয়ে লিভিংরুমে ঘুমায় আর বেডরুম ভাড়া দেয়। সেখানে ছয়জন ব্যাচেলর যুবক থাকে। তারা সারাদিন কাজ করে। রাতে শুধু ফিরে আসে ঘুমোতে। সেই জালাল কানাডায় এসে স্বর্গ হাতে পায়। এখানেও ট্যাক্সি চালানো শুরু করে। সে একদিন আমাকে বললো, ঢাকার সোনালী ব্যাংকে আমার দুই কোটি টাকার বন্ড আছে। সে আমাকে বন্ড দেখায়। আমি বিস্মিত হয়ে বললাম, ট্যাক্সি চালিয়ে তুমি এত টাকা জমালা কিভাবে! সে বলল, ওই যে কষ্ট করে চলেছি। আমেরিকায় কাগজ হবে কিনা তার কেনো নিশ্চয়তা আছে! যত পেরেছি টাকা কামাই করেছি। আমার বন্ধু জালাল এখন বাংলাদেশে রিয়েল এস্টেটের ব্যবসা করছে। পুরনো বউ ছেড়ে দিয়ে নতুন আর একটা আস্ত বউ বিয়ে করেছে। যে বউ আমিরিকায় তার জন্য এত কষ্ট করেছে তার এখন কানাডায় নিঃসঙ্গ জীবন।

২.

কানাডায় পা রেখে এখানকার ভাব সাব দেখে মনে করলাম এত তাড়াহুড়োর কি আছে। আস্তে ধীরে কাজে নামি। হাতেতো টাকা আছেই। ইউএস ডলার ভাঙ্গিয়ে বাজার করি, ফার্নিচার কিনি আর বাড়ি বাড়া দেই। এভাবে তাইরে নাইরে করে সময় পার হয়। দেশের টাকা দিয়ে আর কতকাল চলে! আমার স্ত্রী কিন্তু বসে থাকেনি। সে স্মার্ট মেয়ে। আমার চেয়ে বুদ্ধিমান। এদেশে পা রেখেই বাতাস বুঝতে পারলো। আমিই বুঝিনি। দুই মাসের মাথায় সে একটা কাজ জুটিয়ে ফেললো। কারো কেনো হেল্প ছাড়াই। এদেশে মেয়েদের কাজের যত সুযোগ ছেলেদের তত নয়।

আমার স্ত্রী কাজে লেগে গেলো। আমারই কাজ হয় না। এদেশে কত জনেইতো দামী গাড়ি চালাচ্ছে, বাড়ি আছে। স্কুলের গন্ডিও পেরোওনি কিন্তু ঠাস ঠাস ইংরেজী বলছে। কেউ কেউ আছে যারা কখনও ঢাকা শহরই দেখেনি তারাও বলে গুলশানে বাড়ি ছিল। এখানে যার যা খুশী তাই বলে চালিয়ে নেয়। কেউ বাধা দেবার নাই। এরকম পরিস্থিতিতে আমার স্ত্রী দ্রুত খাপ খাইয়ে নিল। আমিই পারিনি।

প্রথম বছর যে কিছুই করিনি সেটা বললে ভুল হবে। প্রথম তিন মাসের মাথায় ড্রাইভিং লাইসেন্স নিয়ে নিলাম। অটোট্রেডে গাড়ির দাম দেখি কিন্তু গাড়ি আর কেনা হয় না। প্রথম কিছুদিন মহা উৎসাহে বায়োডাটা, এখানকার মানুষরা বলে রেজুমি সেটি তৈরীতে লেগে গেলাম। নেইবারহুড অফিসে যাই। সবকিছু ফ্রী। জব কর্মশলায় নেটওয়ার্কিংএর কথা বলে। রেজিুম তৈরী করে দেয়। এ্যাকশন প্ল্যান তৈরী হয়। ফ্রী ইএসএল ক্লাস করা যায়। সব ঠিক ঠাক আছে। কিন্তু আসল যেটা দরকার চাকরী সেটা আর হয় না। পরে জানলাম কানাডায় চাকরি পেতে হলে তিনটা জিনিস লাগবে এক- অভিজ্ঞতা দুই- এখানকার ডিগ্রী এবং তিন- রেফারেন্স। আমার এর কেনোটাই নাই। সুতরাং আমি যে ধরণের চাকরি খুঁজি তা পাবার কেনো সম্ভাবনা নেই। একদিন করলাম কী বিসমিল্লাহ বলে এক ব্রেড ফ্যাক্টরীতে গেলাম কাজে। আমার বাসা থেকে বাসে যেতে লাগে প্রায় দুই ঘন্টা। কে যেনো একজন আমাকে রেফার করেছিল। সুপারভাইজার তখনই কাজে লাগিয়ে দিল। সুপার ভাইাজারটা ছিল পাকিস্তানী। তার আন্ডারে কাজ করতে হবে ভেবেই দমে গেলাম। নয় মাস যুদ্ধ করে যাদের খেদিয়ে বিদায় করেছি তাদের আন্ডারে কিভাবে কাজ করি! ঘন্টাখানেক পরেই ওখান থেকে বিদায় হলাম। আর কেনোদিন ফ্যাক্টরীতে কাজের জন্য যাইনি।

তবে সেদিন একটা ঘটনার কথা মানে আছে। আমি দাঁড়িয়ে আছি বাসস্ট্যান্ডে। আরো একটা লোক বাসের অপেক্ষায়। বোঝা যায় এশিয়ান। আমাকে জিজ্ঞেস করে হোয়ার আর ইউ ফ্রম?

আমি বলি বাংলাদেশ।

সে বলে আই এ্যাম ফ্রম পাকিস্তান। আমরা ভাই ভাই।

মনে মনে বলি ধুশ্শালা আবারও সেই পাকিস্তানী!

এখানে কোথায় এসেছিলা।

আমি বললাম একটা ফ্যাক্টিরিতে কাজে এসেছিলাম কিন্ত ভেরি হার্ড। তাই চলে এসেছি।

হাউ লং হ্যাভ ইউ বীন ইন কানাডা?

তিন মাস।

ওকে।

আমি বললাম ইউ!

সে বলল, চৌদ্দ বছর।

দেশে তুমি কী করতা!

আমি বললাম।

সে বলল, তোমাকে একটা কথা বলি মনে রেখো। দিস ইস কানাডা। এখানে কখনও গায়ে খেটে কাজ করতে যেওনা। তোমার মাথা আছে সেটাকে কাজে লাগাও। সেদিন লোকটার কথাটা আমার পছন্দ হয়েছিল।”

৩.

কানাডার জীবনের দ্বিতীয় বছর চলছে। একটা গাড়ি কিনে ফেললাম দুম করে। টয়োটা ক্যামরি। ফাটাফাটি গাড়িটা। ঝকঝকে। লো মাইলেজ। গাড়ি কেনায় খরচ হঠাৎ করে বেড়ে গেলো। আমার পুরনো এক্সপেরিয়েন্স থাকা সত্বেও গাড়ির ইনস্যুরেন্স গুনতে হচ্ছে প্রায় তিনশ ডলার মাসে। ফুল কভারেজ, জিরো ডিডাক্টবল। ইনস্যুরেন্সের ব্যাপার স্যপার ভালো বোঝা যায়না। বেশী স্মার্ট যারা তারা বোঝে। একই ইনস্যুরেন্স কোম্পানীকে আমেরিকার চেয়ে কানাডায় কয়েকগুন বেশী প্রিমিয়াম দিতে হয়। কোনো মানে হয়! ইনস্যুরেন্স কোম্পানীগুলোর বিরুদ্ধে টরন্টোতে কিছুদিন আন্দোলন সংগ্রাম হয়েছে কিন্তু কোনো এফেক্ট চোখে পরেনি। ইন্ডিয়ান কমিউনিটি এই আন্দোলন আর্গানাইজ করেছিল। পৃথিবী জুড়েই কর্পোরেট জায়ন্টদের হাতে ৯৯ ভাগ মানুষের ভাগ্য। অকুপাই ওয়ালস্ট্রীট যে মুভমেন্ট শুরু করেছে তা ছড়িয়ে পড়ছে। দেখা যাক কোথায় গিয়ে পৌঁছায়। আমি থাকি টরন্টো। কানাডার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শহর। বাণিজ্যিক রাজধানী। এবং সবচেয়ে ব্যয়বহুল শহর। একটা চাকরির পিছনে যেখানে দশ বিশ জন ছোটে। একটা চাকরি পাওয়া এখানে মিলিয়ন ডলারের লোটো পাওয়ার সমান। আমি একদিন ড্যানফোর্থে একটা রেষ্টুরেন্টে আমার এক বন্ধূকে ডাকলাম। চা খাওয়ার জন্য। বাঙ্গালি রেষ্টুরেন্ট। ড্যানফোর্থ হচ্ছে বাঙ্গালিদের জায়গা। বাঙলা ভাষায় অসংখ্য সাইনবোর্ড দেখতে পাওয়া যায়। এটাকে বাঙলা টাউন বলা হয়। যারা প্রথম কানাডায় আসে বা যারা ভিজিট করতে আসে এই শহর, ড্যানফোর্থ তাদের ভালো লাগে। দূর প্রবাসে বাঙ্গালিদের আনাগোনো হঠাৎ আলোর ঝলকানির মতো মনে হবে।

আমার বন্ধু আলাল। সুইস বেকারিতে বসে আমরা চা আর পিঁয়াজু খাচ্ছি। অনেকে অবশ্য ড্যানফোর্থের নাম শুনলে আঁতকে উঠে বা নাক সিটকায়। যেখানে বাঙ্গালি সেখানেই  নাকি দলাদলি। অনেকে দলাদলির শিকারও হয়েছে। আবার যারা একটু ‘সৈয়দ বংশীয়’ তারা ড্যানফোর্থ এভোয়েড করে।  যারা দেশ থেকে টাকা পয়সা পাচার করেছে তারা থাকে আলাদা। লোকালয়ে আসেনা তারা।

৪.

আমি দেখেছি বিদেশে আসলেই কিছু মানুষ কেমন বদলে যায়। আমার বন্ধুরাই বদলে গেছে। চেহারা পাল্টে ফেলে। কেউ কাউকে বিশ্বাস করে না, সত্যি কথা বলে না। একটা হাইড করার মানসিকতা। ফোন করলে ফোন ধরে না। ব্যস্ত না থাকলেও বলে ব্যস্ত আছি। আবার কাউকে ইচ্ছার বিরুদ্ধে কিছু করানোও যায় না। সেই স্বাধীনতা এখানে নিশ্চিত করা আছে। এসবের কারণও আছে। কেউই আসলে নিজের মতো করে জীবনটা সাজাতে পারে না। যে জীবন ফেলে এসেছে ঠিক সেই রকম একটা জীবন পাওয়া যায়না। তাই মানুষ যা পায় তাই আকড়ে ধরতে চায়। একদিন আমিও ওরকম হয়ে যাবো।

সেদিন একজন বন্ধু আমাকে বলল, তুমি এসব কী লেখো!

আমি বললাম কেনো কী হইছে!

সে বলল, একজন তোমার উপর খুউব খেপছে!

আমি বললাম কোনো খেপার কী হইছে!

সে বলল, তুমি এখানকার চাকরি বাকরি নিয়ে কী সব লিখছো!

আমি তার নাম জানতে চাইলাম। সে নাম বলল।

আমি দেশে থাকতে এই সাংবাদিকের নাম কস্মিনকালেও শুনিনি। এখানে এসে অনেক কিছুই শুনছি দেখছি। বিদেশে না আসলে অনেক কিছু চেনা যায় না।

আসলে মানুষ খুউব অনরিাপদ এই পৃথিবীতে। নিরাপত্তার জন্য সে সব করতে পারে। কিছু মানুষ কমপ্লেক্সে ভোগে। কিছুতেই সে সত্যিকে মেনে নিতে পারে না। আমাদের দেশটা এতই ছেটো যে আমরা কে কী ছিলাম, কে কী হয়েছি সবাই সেটা জানে। সাবাই যে তালগাছ হবে বা সবাই সব করতে পারবে এটা মনে করার কেনো কারণ নেই। এজন্য কেউ তুচ্ছ হয়ে যায় না।

আজহার আমার এখন বন্ধু। আজাহারের মতো লোক বেশী একটা দেখা যায়না। আমার সমান বয়স হবে। আজাহারের বিদেশ জীবন প্রায় সতেরো বছরের। দশ বছর কাটিয়েছে মধ্যপ্রাচ্যে। দামী একটা হোটেলের শেফ ছিল। অথচ আজাহার এক লাইন ইংরেজী লিখতে পারে না। কিন্তু ইংরেজী বলতে পারে ভালো। ইংরেজী না লিখতে পারলেও যারা পারে তাদের ব্যবহার করে সে তার কাজ করিয়ে নিয়েছে। স্মার্ট লোক। সাহসী। রিস্ক টেকার।

কি করছেন এখন ভাই!

তেমন কিছু না। টুক টাক কাজ।

কেনো!

ভাল কিছু পাচ্ছি কই!

কী বলেন ভাই!

সত্যি আজহার ভাই।

শোনেন দেশে আপনার যতই লেখাপড়া থাক আপনি এতো সহজে ভাল জব পাবেন না। এটা আপনাকে মেনে নিতে হবে। গাধার খাটুনি খাটতে পারলে ঠিক আছে। নইলে না। আমাকে দেখেন না সাতদিন কাজ করি। নিজের কাজে নিজে করি। কোনো ল্জ্জা নাই। ভাইরে খামোখাই কানাডা সরকার শিক্ষিত লোকগুলিকে এনে কষ্ট দিচ্ছে। কানাডা দাবী করতে পারে তাদের দেশে সবচেয়ে বেশী শিক্ষিত লেবার। আপনাদের মতো লোকরা প্রথম কিছুই করতে চায় না। খালি নাক সিটকায়। পরে অবশ্য সবই করে। পিটে ক্ষিদে মুখে লাজ থাকলেতো হবে না।

আপনারতো নিজের ব্যবসা। চিন্তার কিছু নাই।

আরো ভাই সাতদিন কাজ করি।

তাও ভালো।

ব্যবসা কঠিন আছে এদেশে।

সহজ কী!

ডেলিভারি করবেন! এটাই সহজ। কিছু বাড়তি আয় হলো।

কখনও করিনি যে।

ট্রাই করে দেখেন। না পারলে নাই।

আমি রাজী হলাম। দেখাই যাক না ব্যপারটা কী।

প্রথম দিন চারটা ডেলিভারি করলাম। খুউব ভয় হচ্ছিল। আমার সব সময় যেটা হয় রাস্তা হারানোর ভয় থাকে। প্রথমদিন তিনটা ডেলিভারি করতে গিয়ে তিনবারই রাস্তা ভুল। যদিও ডেলিভারিতে বের হওয়ার সময় ঠিকানা পই পই করে দেখে নিয়েছি কিন্তু তারপরও রাস্তা ভুল করেছি। সবগুলো ডেলিভারি পৌঁছতে দেরী হয়।

চতুর্থ এবং শেষ ডেলিভারিতে ঘটলো ঘটনাটাটি। বাইরে তখন ফিনে ফিনে বরফ পরছিল। সেটা ডিসেম্বর মাস। কনকনে ঠান্ডাও পড়ে গেছে। আমি গাড়ি পার্ক করে গেলাম ডেলিভারিতে। বেশি দেরী হয় নাই। ফিরে এসে দেখি একটা হলুদ প্রিন্টেড কাগজ ড্যাশবোর্ডে আটকানো। মানে কি! কাগজটা খুলে দেখি টিকিট! ৬০ ডলারের পার্কিং টিকিট! ভুল জায়গায় পার্ক করেছি! কানাডায় প্রথম টিকেট!

৫.

কানাডা এসে শুনেছিলাম সকিউরিটি জব নাকি ফাটাফাটি আরামের। ছবি : সেন্ট্রাল প্রটেকশন সাভিসেস

কানাডা এসে শুনলাম সিকিউরিটি জব নাকি ফাটাফাটি আরামের। আমি তাহলে বসে আছি কেনো! কী করতে হবে! ট্রেনিং নিতে হবে। পকেটে তখনও অনেক টাকা। ট্রেনিং করলাম। প্রায় একমাসের ট্রেনিং। ফার্ষ্ট এইড থেকে শুরু করে সব শেখানো হলো। সতেরোশো ডলার নেমে গেলো। যেদিন গ্রাজুয়েশন সেদিনই অন স্পট একটা সিকিউরিট কোম্পানীর লোকজন এসে আমাদের কয়েকজনকে হায়ার করলো। আমি খুশীতে ডগমগ। পরের দিনই রিপোর্ট এবং পোষ্টিং। সেটা ২০০৩ সালের কথা।

আমাকে  কাজ দিল রাতে। রাত এগারোটা থেকে ভোর সাতটা পর্যন্ত। কাজের জায়গাটার নাম হচ্ছে কানাটা। আমার এক বন্ধুকে বললাম। বন্ধু বলল, তোমাকে আমি ওখানে পৌঁছে দেবো। চিন্তা করো না। রাতের ডিউটি বলে একটা ফ্ল্যাশ লাইট কিনতে হলো। কিছু খাবার দিয়ে দিল স্ত্রী যদি খিদে পায়! আমার রাত বাড়লেই খিদে বাড়তে থাকে। যদি ঘুম পায় তাহলে কী হবে! একটা ফ্ল্যাস্ক কিনলাম। স্ত্রী চা দিয়ে দিল। আমি যাতে কাজটা করতে পারি তার সব আয়োজনই সম্পন্ন হলো।

কাজের জায়গাটা আমার বাসা থেকে গাড়িতেই একঘন্টার ড্রাইভ। আমি শুরুতেই ভড়কে গেলাম। ঘটনাস্থলে পৌঁছে আমার মন খারাপ হয়ে গেলো। কেমন বিরান একটা জায়গা। চারিদিকে তেমন কিছু স্থপনা নাই। একটা গাড়ি ফ্যাক্টরীর কাজ চলছে। কিয়া কোম্পানীর গাড়ি। কোরিয়ান। সেখানে রাতভর ডিউটি। কোনো শেড নাই। শুধু একটা পুরনো গাড়ি পড়ে আছে। রাতে প্রয়োজনে সেটার মধ্যে ঢুকে পড়া যাবে। সময়টা ছিল অক্টোবর মাস। রাতে যদি ঠান্ডা লাগে তাহলে গাড়ি  স্টার্ট দিয়ে হিটিং চলানো যাবে। আগের শিফটের যে লোকটি ছিল সেই সব বুঝিয়ে দিয়ে চলে গেলো। যাওয়ার সময় আমার চেহারার অবস্থা দেখে বলল, ডোন্টওরি ম্যান! টেক ইট ইজি। আমরা একসাথেই ট্রেনিং করেছিলাম। ইয়েমেনি লোকটা।

আমি  আমার বন্ধুকে বললাম, আমি এই কাজটা করতে চাই না।

সে বলল, এখন এসব বললে তো হবে না।

তোমার ফোন দিয়ে একটা ফোন করো সুপার ভাইজারকে। আমার তখনো কোনো সেল ফোন নাই। চার মাস হয় এসেছি। এসব কাজে একটা সেল ফোন থাকা খুউব জরুরী।

আরে পাগল কিছু হবে না। সবাই করছে না! আমাকে বুঝিয়ে টুঝিয়ে বন্ধু চলে গেলো।

আমি সিকিউরিটির চাকরি শুরু করে দিলাম। নিয়ম কানুন সব জানাই আছে। রাত যত গভীর হতে লাগলো ততই বাড়ির কথা মনে পড়তে লাগলো। আমি একটু একটু নিঃসঙ্গবোধ করতে লাগলাম। একটু কী ভয়ও পাচ্ছি! চারদিকে কেমন সুন সান নীরবতা। দুরের রাস্তায় হুস হাস একটা দুটো গাড়ি যাচ্ছে। কোনো জন মানুষ্যি চোখে পড়ছে না। অনেক দুরে একটা টিম হরটনস দেখা যাচ্ছে। কফি শপ। কানাডার সবচেয়ে জনপ্রিয় কফি। মনে হয় চব্বিশ ঘন্টা খোলা থাকে। এটা ভেবে একটু সাহস পাচ্ছি। যদিও এখানে আমাকে মেরে পুতে ফেললেও কেউ টের পাবেনা, তা সত্ত্বেও দুরের আলো দেখে ভালো লাগছে। যদিও আমার হাতে একটা ওয়াকি টকি আছে। সেটা দিয়ে কন্ট্রোলরুমে কথা বলা যায়। বা আমি জেগে আছি কিনা এটা চেক করার জন্য মাঝে মাঝে কথা বলে ওঠে ও প্রান্ত থেকে।

আমি রাত জাগতে পারি না। একটা পুরো রাত জাগলে সেটা কাভার করতে আমাকে তিনচার দিন ঘুমোতে হয়। আজকে আমাকে রাতভর ডিউটি করতে হবে। শুরু হলো ডিউটি। মাঝে মাঝে আবিষ্কার করি আমি ঘুমোচ্ছি। গাড়িটার মধ্যে জবু থবু হয়ে বসে। কিছু করার নেই। এভাবে সকাল হলো। প্রথম সকাল। সাতটায় একজন এলো ডিউটিতে। তাকে দ্বায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে আমি বাসে করে সকাল নটায় ঘরে পৌঁছলাম।

চতুর্থ রাতে ঘটনাটা ঘটলো। মধ্যরাতে আমি গাড়ির মধ্যে ঘুমিয়ে আছি। আমি গল্পের বই নিয়ে আসতাম। গড়ির স্বল্প আলোয় বই পড়ি। বই পড়তে পড়তেই মরণ ঘুমটা এসেছিল। এদিকে আমার ওয়াকি টকি বেজে যাচ্ছে। আমি এমনই গভীর ঘুমে ডুবে গেছি যে কিছু শুনতে পাচ্ছিনা। হঠাৎ আমি আবিষ্কার করলাম কে একজন আমার গাড়ির দরজায় টোকা মারছে। আমি ভুত দেখার মতো চমকে উঠলাম। সুপার ভাইজার। সে আমাকে ওয়াকটকিতে না পেয়ে ছুটে এসেছে।

সে বলল, তুমি ঘুমোচ্ছিলে! আমিতো ভয় পেয়ে গেছিলাম। ভাবলাম কিনা কি।

আমি থতমত খেয়ে বললাম না মানে..। সে আর বেশী কিছু না চলে গেলো।

পরের দিন সকালে আমার বাসায় যাওয়ার কেনো বাস নাই। কারণ এই এলাকায় রবিবার কেনো বাস চলে না। কনস্ট্র্যাকশনের লোকজন এসে গেছে। তাদের একজনকে রিকোয়েষ্ট করে একটা ফোন করালাম আমার সুপারভাইজারকে। তারা গাড়ি পাঠিয়ে আমাকে বাসায় পৌঁছে দিল। মাত্র এক সপ্তাহ করলাম প্রথম চাকুরিটা।

এদেশে এসে শুনেছি হায়ার এ্যান্ড ফায়ার কোনো ঘটনা না। আবার অনেকে বলে

এদেশে থ্রি ডবি¬¬উর কোনো বিশ্বাস নেই। থ্রি ডাবি¬উ হচ্ছে ওয়েদার, ওম্যান এবং ওয়ার্ক। তবুও আমি একটু নির্ভার হলাম।

৬.

আমাদের বিল্ডিং এ সিকিউরিটির চাকরি করে একজন বাঙ্গালি। তার নাম হামিদ। এই কোম্পানীর অনেক বিল্ডিং আছে। হামিদ রাতে সিকিউরিটি দিনে ট্যাক্সি চালায়। একজন মানুষ কিভাবে রাতদিন কাজ করে আমি বুঝে পাই না। হামিদের সাথে আমার বেশ একটা ভাব হয়ে যায়।

আচ্ছা হামিদ ভাই আপনি রাতদিন কিভাবে কাজ করেন!

সে বলল, সিকিউরিটি কাজ এত হার্ড না।

আমি তাকে আমার পুরনো সিকিউরিটি চাকরির কাহিনী শোনালাম।

সে শুনে হাসলো। বলল, আমাদের এখানে লোক নেবে, আপনি করবেন? করলে আপনার কথা বলতে পারি। যেহেতু আপনার ট্রেনিং করা আছে, আসিুবিধা হবে না।

মনে মনে ভাবলাম আবার সিকিউরিটি!

আমি বললাম, ঠিক আছে। আচ্ছা হামিদ ভাই আপনার রাতে ঘুম পায় না! আমিতো রাত জাগতে পরি না।

সে হেসে বলল, ঘুম পেলে ঘুমাবেন!

কিভাবে!

আমাকে দেখেন আমি কিন্তু ঘুমাই কিন্তু কেউ বুঝতে পারে না।

কায়দাটা কী!

বসে বসে ঘুমাই। অভ্যাস করে নিয়েছি।

আমি দেখলাম হামিদ ভাইয়ের চোখ লাল। হয়ত আমি আসার আগে ঘুমোচ্ছিল বেচারা! কালকে সকালেই তাকে ট্যাক্সি নিয়ে বের হতে হবে। সারাদিন ট্যাক্সি চালিয়ে আবার আসবে সিকিউরিটি জবে।

হামিদ ভাই কথা রেখেছেন। বেশিরভাগ বাঙ্গালিই কথা দিয়ে কথা রাখে না। বলে একটা করে আর একটা।

আমাকে সিকিউরিটি জবের জন্য আবার ডাকা হলো। কালকে পরীক্ষা। পরীক্ষা জিনিসটা আমি খুব ভয় পাই। আমি জানি পরীক্ষা হলেই আমি নিশ্চিত ফেল মারবো।

একটায় গিয়ে পৌঁছলাম। আমরা দু’জন। অন্যজনও বাঙ্গালি। খ্রীষ্টান। মনে একটু বল ভরাসা পেলাম। পরীক্ষায় অনেক মাল্টিপল প্রশ্ন থাকলো। দু’জনে ভাগাভাগি করে শেষ করলাম। চাকরি হয়ে গেলো। আমার বাসা থেকে পনেরো মিনিটের ড্রাইভ। মাউন্টপেলজেন্ট এন্ড এরস্কিন। কনসিয়ারেজ বলে এটাকে। অর্থ্যাৎ এপার্টমেন্ট বিল্ডিং বা কনডোমোনিয়ামের ফ্রন্ট ডেস্কে বসে থাকো। আগের টার চেয়ে মাচ বেটার। কিন্তু এবারও রাতে। রাত আটটা থেকে ভোর পাঁচটা পর্যন্ত। মাঝখানে একঘন্টার ব্রেক। ইয়ারলি স্যালারি। খারাপ না। শুধু ঘন্টায় ঘন্টায় পেট্রোল দেওয়া। এতো হার্ড না। কিন্তু এক সপ্তাহ করার পর এটাও ভালো লাগলো না। কোনো কিছুতে লেগে থাকাটাই কঠিন আমার জন্য। কোনো কিছুতেই বেশীদিন কনসেনট্রেট করতে পারি না। আবার অনিশ্চয়তা।

জসিম মল্লিক

লেখক ও সাংবাদিক

টরন্টো

jasim.mallik@gmail.com

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *