সর্বজন শ্রদ্ধেয় অধ্যাপক ড. মহাদেব চক্রবর্তী আর নেই
প্রবাসী কণ্ঠ, ২২ মে ২০২৫: গতকাল দুপুরে অধ্যাপক ড. মহাদেব চক্রবর্তী টরন্টোতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৯৮ বছর। তাঁর মৃত্যুর খবরে গভীর শোকের ছায়া নেমে আসে টরন্টোর বাঙ্গালী কমিউনিটিতে।
অর্ধ শতাব্দীকালেরও বেশি সময় ধরে কানাডায় বসবাসকারী মহাদেব চক্রবর্তী ছিলেন টরন্টোর বাংলাদেশী কমিউনিটিতে সর্বজন শ্রদ্ধেয় একজন অভিভাবক। ইতিপূর্বে প্রবাসী কণ্ঠ ম্যাগাজিনে মনিস রফিক তার এক কলামে মহাদেব চক্রবর্তী সম্পর্কে লিখেছিলেন, মহাদেব চক্রবর্তী একজন এমনই এক বাতিঘর ছিলেন যিনি নিজ সংস্কৃতি ও ভাষাকে ভালোবেসে জীবনভর কাজ করে গেছেন এক মহাবৃক্ষের মতো। এ বৃক্ষটি ছিল এমন এক বৃক্ষ যার ছায়াতলে অবলীলায় জিরিয়ে নেয়া যায় আর চিনে নেয়া যায় আপন শেকড়কে।

১৯২৭ সালের ২৫শে ডিসেম্বর ভারতের উত্তর প্রদেশের বেনারসে জন্ম নেয়া মহাদেব চক্রবর্তীর পৈতৃক নিবাস বাংলাদেশের নাটোরের দুয়ারী গ্রামে। বাবা ছিলেন গ্রামের স্কুলের হেড পন্ডিত। বাবা তার মায়ের মৃত্যু-পূর্ব প্রশান্তি ও অক্ষয় শিবলোক প্রাপ্তির জন্য সেই যে কাশী গমন করেছিলেন তারপর ধীরে ধীরে সেই পরিবারটি কাশীতেই অবস্থান শুরু করে দেয়। সেই সূত্রে মহাদেব চক্রবর্তীর সেখানেই জন্ম, বেড়ে উঠা আর পড়াশুনা। মহাদেব চক্রবর্তী বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থ বিজ্ঞানে প্রথম বিভাগে অনার্স ও মাস্টার্স পাশ করে ১৯৬৩ সালে ভারতের পারমানবিক শক্তি কমিশনে কিছুদিন কাজ করার পর কানাডায় চলে আসেন। কানাডায় এসে মূলত তিনি শিক্ষকতা পেশার সাথে নিজেকে জড়িত রাখেন।
মনিস রফিক তার কলামে আরো লিখেন, আজীবন নিষ্ঠাবান এই মানুষটি তার জীবনের সব চেয়ে প্রগাঢ় প্রেমে যে কাজটি করেছেন তা হচ্ছে, কানাডায় বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতিকে পরম মমতায় সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। নিজের জীবনের সঞ্চিত সব অর্থ আর মাঝে মধ্যে বিভিন্ন মানুষের কাছে হাত পেতে অর্থ সংগ্রহ করে তিনি যে তহবিল তৈরী করেছিলেন তা দিয়ে তিনি টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষা নিয়ে পড়া ছাত্রছাত্রীদের জন্য বৃত্তির ব্যবস্থা করেন। আমাদের এ বিষয়টা ভাবলেই তার প্রতি শ্রদ্ধায় মাথা নুয়ে আসে। আমরা যখন সবাই জাগতিক দৌড়ে ছুটে চলছি তখন এই মহান মানুষটি নিজ ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি নীরবে একাএকি যে পরম প্রেমের ফেরী করে বেড়িয়েছেন তা আমাদের বিস্মিত করে।
বাংলা ভাষা বর্তমান পৃথিবীর সপ্তম তম আসনে অধিষ্ঠিত হয়েছে, প্রায় পয়ত্রিশ কোটি মানুষ এ ভাষায় কথা বলে। তারপর ১৯৯৯ সালে আমাদের ২১শে ফেব্রুয়ারীকে ধরে বছরের সেইদিনকে ইউনেস্কো আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘোষণা করেছে। কিন্তু এরপরো এটাতো সত্য, বর্তমানের অভিভাসনের যুগে অধিকাংশ ভাষা তাদের স্বকীয় বৈশিষ্ট্য হারিয়ে ফেলছে। আমাদের কানাডার দিকে তাকালে, এটা স্পষ্ট হয়ে যায়। কানাডায় বাংগালী অভিবাসীদের কয়জন উত্তরসূরী বাংলা ভাষায় কথা বলা বা লেখা চালিয়ে যেতে পারবে, তা বলা খুবই কঠিন। তবে পরিমাপ করলে এটা যে একেবারে নীচের দিকে চলে আসবে, তা আশংকা করা যায়। মহাদেব চক্রবর্তী এমন একজন আলো হাতে চলা মানুষ যিনি নিজের শেকড় থেকে আমাদের বিচ্যুত না হওয়ার জন্য আপ্রাণ প্রচেষ্টা চালিয়ে গেছেন আর যিনি আমাদের বারে বারে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন আমরা পৃথিবীর যে প্রান্তেই থাকি না কেনো মায়ের ভাষার পতাকা আমাদের উড্ডীন রাখতে হবে পরম মর্যাদার সাথে।