সুফিবাদ ও বাংলাদেশ

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

৮. উরস ও মাহফিল প্রতিষ্ঠা

খাজা এনায়েতপুরীর তরিকা প্রচারের একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হলো উরস ও মাহফিল প্রতিষ্ঠা। কথিত আছে যে, একদা খাজা সাহেবের পীর গোপনে তাঁকে ফরমাইলেন যে, “বৎস রাসূলুল্ল­াহ (সা.) আমাকে ফরমাইয়াছেন যে, উরসের মাহফিল যেন চিরদিনই অনুষ্ঠিত হয় এবং কোন বৎসরই যেন বাদ না পড়ে। কারণ ইহার সাথে যাবতীয় আম্বিয়া ও আউলিয়াগণের অবিচ্ছিন্ন সম্বন্ধ জড়িত রয়েছে।” সে অনুযায়ী তিনি তাঁর কতিপয় মুরিদ ও স্থানীয় লোকদের নিয়ে সর্বপ্রথম বাংলা ১৩২২ সালে প্রথম উরস মাহফিল সমাধা করেন। এই উরসে তিনি বললেন, “আসলে আমার পক্ষে সকলের ঘরে গিয়ে হেদায়েতের দাওয়াত পৌঁছানো মোটেও সম্ভবপর নয়। তাই আমি উরস মাহফিল প্রতিষ্ঠা করলাম যেন নির্দিষ্ট তারিখে সকল লোক একত্র হতে পারে এবং আমি তাঁদের কাছে হেদায়েতে বাণী পৌঁছাতে পারি। এ ধারা অব্যাহত থাকবে।” আজও এ ধারা অব্যাহত রয়েছে।

তখনকার উরস মাহফিলে হয়ত দশ-পনের শত লোকের সমাগম হতো। বর্তমানে উরস মাহফিল একটা অভিনব এবং অপূর্ব মিলন মজলিসে পরিণত হয়েছে। এই উরস মাহফিলে দূর দূরান্ত থেকে শত শত, হাজার হাজার লোকের সমাবেশ ঘটে। বর্তমানে এই উরস মাহফিল আগের মতই অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। তখন কে ফকির, কে বিদ্ধান, কে মূর্খ বুঝবার সাধ্য থাকে না। তাঁদের মধ্যে হিংসা, দ্বেষ, আত্ম-গৌরব এবং আপন পর কিছুই স্মরণ থাকে না। প্রত্যেকেই ভাই-ভাই এবং সকলে একই পথের যাত্রী। এটাই সকলের হৃদয়ে জাগে। তখন সবার মনে পড়ে যায় পবিত্র কুরআনের বাণী ‘এক মুসলমান আরেক মুসলমানের ভাই।’

সুফি পেইন্টিং । এঁকেছেন মুাহাম্মদ সুলেমান রেহমান (সাচ্চি আর্ট)

উরস শরীফে তরিকতের নিয়ম অনুসারে ওয়াজ, নসিহত, তসবীহ, তাহলীল, ওজিফা পাঠ, যিকর-আজকার, দরুদ শরিফ পাঠ, মুরাকাবা করা, কুরআন তেলওয়াত ও সমসাময়িক সামাজিক বিষয়ে আলোচনা হয় এবং মজলিশে ব্যয়কৃত যাবতীয় অর্থ বা বস্তুর ছওয়াব-নজরাণা বিশ্বের সকল আম্বিয়া ও পরলোকগত আউলিয়াগণের এবং সকল মোমেন মোমেনা মুসলমানের পবিত্র আত্মার মাগফেরাত কামনা ও রূহের শান্তির জন্য দো’আ করা হয়। তাছাড়া প্রত্যেক দিনে কুরআন হাদিসের আলোচনা মিলাদ-মাহফিল, যিকর-আজকার ও বিশেষ বিশেষ দিনে বিশেষ এবাদত বন্দেগী করা হয়।

প্রায় দুই দশক ধরে পীরজাদা হযরত খাজা কামাল উদ্দীন (সাজ্জাদানিশিন) সরাসরি ‘এনায়েতপুরী তরিকা’ এনায়েতপুরীর অনুসারীদের মধ্যে অত্যন্ত সফলভাবে প্রচার করে আসছেন এবং শান্তি অগ্রগতি ও নৈতিকতার উন্নতি সাধনে নীরব বিপ্লব সাধন করে যাচ্ছেন। তাঁর সময়ে তরিকার প্রভূত উন্নতি সাধিত হয়। দরবার শরীফের অভাবনীয় আধুনিকীকরণ ও তরিকার আন্তর্জাতিক খ্যাতি তাঁরই অক্লান্ত পরিশ্রমের সোনালী ফসল।

মাওলানা হযরত খাজা কামাল উদ্দীন সাহেব উরস শরীফের সকল কার্যক্রম সুশৃঙ্খলার সঙ্গে পালনের জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়ে থাকেন এবং বর্তমানে ৮৪ বছর বয়সেও নিজে সকল কার্যক্রমের তদারকি ও তত্ত্বাবধান করেন। তাঁর যোগ্য পরিচালনায় অনুষ্ঠিত উরসের মোনাজাতে শরিক হওয়ার জন্য লক্ষ লক্ষ যাকের ছাড়াও দেশের গণ-মাধ্যমের ব্যক্তিবর্গ, গণ্য-মান্য নেতৃবর্গ, মুন্ত্রি, এম.পি, সাংসদ, ডাক্তার, শিক্ষক, ইঞ্জিনীয়ারসহ সকল পেশাজীবীর মানুষ সবকাজ ফেলে ছুটে আসেন দরবারে। লক্ষ লক্ষ লোকের দ্বীনি পিপাসা নিবারণে হেদায়েতের বাণী বর্ষিত হতে থাকে তাঁর ক্রন্দন-ভরা, অঝোরে অশ্রু-নিঃসৃত দরদী কন্ঠের আখেরী মোনাজাতে। তাঁর বয়ান শ্রবণ করে যারা প্রথমবারের মতো পরীক্ষামূলকভাবে উরসে আসেন তাঁরাও তাঁর পবিত্র হাত ধরে তরিকায় বায়াত গ্রহণ করেন। কাজেই দেখা যায় যে, উরস মাহফিলের মাধ্যমেও বাংলাদেশে মুজাদ্দেদিয়া তরিকা প্রচারিত হয়েছে এবং এখনো প্রচারিত ও সম্প্রসারিত হচ্ছে।

৯. মুরিদগণের খানকার ভুমিকা

মুরিদগণ খাজা এনায়েতপুরী (র.) এর মুজাদ্দেদিয়া তরিকা প্রচারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন। খাজা এনায়েতপুরী কাউকে আনুষ্ঠানিকভাবে তাঁর তরিকার খেলাফত প্রদান করেন নি। তবে মুরিদদের মধ্যে যারা তাঁর দরবারে দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষা লাভ করেছেন এবং তরিকতের পথে উন্নতি লাভ করেছেন তাঁদের তিনি তাঁর তরিকা প্রচার করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু খেলাফত কাউকে দেন নি। তাঁর নির্দেশ মোতাবেক তাঁরা বাংলাদেশ ও ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে তরিকা প্রচারে অবদান রাখেন। নিচে উল্লে­খযোগ্য কয়েকজনের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা প্রদান করা হলোঃ

(ক) মাওলানা শাহসুফি খাজা সাইফুদ্দিন মুজাদ্দেদী (র.)

তিনি তদীয় পিতা সুলতান মাশায়েখ হযরত খাজা এনায়েতপুরীর (র.) দ্বিতীয় প্ত্রু। তিনি ময়মনসিংহ জেলার শম্ভুগঞ্জের লালকুঠিতে খানকা স্থাপন করেন এবং ইসলামি শিক্ষা বিস্তারে আত্মনিয়োগ করেন। তিনি বহুগ্রন্থ প্রণেতা এবং ফেকাহশাস্ত্রের অদ্বিতীয় পান্ডিত্যের অধিকারী। তাঁর খানকা ‘মুজাদ্দেদিয়া তরিকত মিশন’ নামে পরিচিত। সেখানেই তাঁর মাযার অবস্থিত।

(খ) মাওলানা শাহসুফি মকিম উদ্দিন মুজাদ্দেদী (র.)

তিনি খাজা এনায়েতপুরীর, অর্থাৎ স্বীয় পীরের নির্দেশে টাঙ্গাইল শহরের প্যারাডাইস পাড়ায় খানকা প্রতিষ্ঠা করেন এবং মুজাদ্দেদিয়া তরিকা প্রচারে আত্মনিয়োগ করেন। তিনি উচ্চ কামালাতের অধিকারী ছিলেন এবং শরিয়ত, তরিকত, হকিকত এবং মারেফাতের একজন অতি উঁচুস্তরের আলেম হিসেবে সকলের নিকট পরিচিত। তাঁর খানকায় অগণিত ভক্ত-আশেকানের সমাগম ঘটে এবং এনায়েতপুর দরবার শরীফে তাঁর অকৃত্রিম আনুগত্যের জন্য এ খানকার প্রচার দিনে দিনে বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাঁর সুযোগ্য উত্তরসূরী বর্তমান সাজ্জাদানিশিনের পুত্র ডা. আব্দুল মালেক সাহেব মোজাদ্দেদিয়া তরিকার উচুস্তরের আলেম। প্যারাডাইসপাড়া দরবার শরীফ ডা. আব্দুল মালেক সাহেবের অকৃত্রিম আন্তরিকতা ও আনুগত্যের কারণে এনায়েতপুর দরবার শরীফের সঙ্গে এক নিবিড় সম্পর্ক গড়ে তুলেছে।

(গ) মাওলানা শাহসুফি হাসমত উল্ল­াহ ফরিদপুরী (র.) সুফি হাসমত উল্ল­াহ ফরিদপুরী ‘আটরশির পীর’ হিসেবে পরিচিত। মোজাদ্দেদিয়া তরিকার প্রচার-প্রসারে তিনি হযরত খাজা এনায়েতপুরীর (র.) এর সবচেয়ে সফল মুরিদ। স্বীয় পীরের তত্ত্বাবধানে দু’যুগেরও বেশী সাধনায় স্বীয় পীরের তাওয়াজ্জুহ লাভ করে তিনি কামালাতের সর্বোচ্চ স্তরে উপনীত হন। তাঁর নিজ বাড়ি শেরপুর। কিন্তু তিনি স্বীয় পীরের নির্দেশে শেরপুর জেলা হতে ফরিদপুর জেলার আটরশি গ্রামে হিজরত করেন এবং সেখানেই তরিকা প্রচার শুরু করেন। তাঁর খানকায় প্রতি বৎসর তাঁর প্রিয় মুর্শিদ হযরত খাজা এনায়েতপুরীর স্মরণে অনুষ্ঠিত উরস শরীফে লক্ষ লক্ষ লোকের সমাগম হয়। তিনি বর্তমানে মাওলানা ফরিদপুরী বা আটরশির পীর নামে   আন্তর্জাতিকভাবে খ্যাত। তাঁর খানকা আজ ‘বিশ্ব যাকের মঞ্জিল’ নামে পরিচিতি।

(ঘ) মাওলানা শাহসুফি সুলতান আহমেদ (র.)

তিনি খাজা এনায়েতপুরীর একজন যোগ্য মুরিদ ছিলেন। এনায়েতপুরীর (র.) নির্দেশে ফরিদপুরের চন্দ্রপাড়া গ্রামে হিজরত করে তরিকা প্রচার শুরু করেন। এই গ্রামেই তিনি খানকা প্রতিষ্ঠা করেন। এই চন্দ্রপাড়ায় গ্রামেই তাঁর আস্তানা ও মাযার বিদ্যামান। বর্তমানে ইহা চন্দ্রপাড়া দরবার শরীফ নামে খ্যাত।

(ঙ) মাওলানা খন্দকার আসির উদ্দিন মুজাদ্দেদী (র.)

তিনি খাজা এনায়েতপুরীর (র.) আস্তানায় বহু বৎসর সাধনা করে এলমে মারেফাতের সর্বোচ্চ স্তর হাসেল করেন। তিনি জামালপুরের শ্যাওড়ার চর গ্রামে আস্তানা স্থাপন করে মুজাদ্দেদিয়া তরিকা প্রচারে আত্মনিয়োগ করেন। খাজা সাহেবের উত্তারাধিকারীদের মধ্যে তিনি নিঃসন্দেহে উল্লে­খ্যযোগ্য একজন।

কাজেই দেখা যায়, খাজা এনায়েতপুরীর নির্দেশে তাঁর সুযোগ্য মুরিদগণের মাধ্যমেও বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে মুজাদ্দেদিয়া তরিকা প্রচারিত হচ্ছে।

উপরোক্ত আলোচনায় এটা সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে, হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর পরে সাহাবী তাবেঈন, তাবে-তাবেঈন ও পরবর্তীতে আলিমগণ প্রিয় নবীর অনুসৃতপন্থা ও পদ্ধতিতে মহান আল্ল­াহপাকের বাণী প্রচার করছেন। বর্তমানে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ব্যাপকভাবে সুফি তরিকাসমূহ প্রচলিত রয়েছে এবং বহু অলী দরবেশ ও পীর-মুর্শিদ বিভিন্ন তরিকা প্রচারে নিয়োজিত রয়েছেন। বাংলাদেশে মুজাদ্দেদিয়া তরিকার যথেষ্ঠ প্রভাব রয়েছে। বাংলাদেশে মুজাদ্দেদিরা তরিকা প্রচার ও প্রসারে এবং ইসলামি সমাজ প্রতিষ্ঠায় খাজা এনায়েতপুরীর অবদান সর্বজনস্বীকৃত ও অনস্বীকার্য। হযরত খাজা এনায়েতপুরী (র.) চার তরিকার তালীম দিতেন। তিনি প্রচার করতেন শরিয়ত, তরিকত, হকিকত ও মারেফতের পূর্ণ আমল করেই পূর্ণভাবে ইসলামে প্রবেশ করা সম্ভব।

মূলত একজন মুরিদ নিয়মিত তালীম ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে ঈমান আমলে, আখলাকে, আচার, আচরণে, চাল-চলনে, পোষাকে-আশাকে এককথায় নবী করিম (সা.) এর অনুসৃত তরিকা অনুযায়ী জীবন যাপন করে প্রকৃত মুসলিম হতে পারে। সেজন্য তিনি বিশেষ তাগিদ দিতেন।

তরিকা শিক্ষাদানের ব্যাপারে এনায়েতপুরীর মূল লক্ষ্য ছিল শিক্ষার্থীদের অন্তরে আল্ল­াহ ও রাসূলের মহব্বত ও অনুরাগ জাগ্রত করা। এ উদ্দেশ্যে তিনি কুরআন ও সুন্নাহর নিদের্শাবলী আন্তরিকতার সাথে জীবনের সকল ক্ষেত্রে অনুসরণ করার জন্য গুরুত্ব দিতেন।

তিনি অত্যন্ত সহজ, সরল জীবন যাপন করতেন। সাধারণ পোষাক পরিধান করতেন, স্বল্প আহার করতেন ও পাক-পবিত্র থাকতেন। ইবাদত, বন্দেগীতে তিনি সুন্নত ও মস্তাবসমূহ অতি নিষ্ঠার সাথে পালন করতেন। তাঁর জীবনে কখনো সুন্নতের বরখেলাফ দৃষ্টিগোচর হয়নি। দৈহিক পাক-পবিত্রতার দিকে খুব লক্ষ্য রাখতেন। যিকর-আযকার, নফল নামায ও তাহাজ্জুদ নামায রীতিমত আদায় করতেন। তাঁর আচার-আচরণ, চাল-চলন, উদার ও মহান চরিত্রে মুদ্ধ হয়ে অনেক হিন্দু লোকও ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন এবং তাঁর তরিকায় বায়াত নিয়েছিলেন। তিনি সাধারণ মানুষকে আহ্বান জানালেন, আশ্বাস দিলেন, প্রেরণা যোগালেন, আশ্রয় দিলেন, আত্মবিশ্বাস জন্মালেন এবং সামাজিক স্বীকৃতি ও সমতার প্রতিশ্রুতি দিলেন। ফলে অনেক সাধারণ মানুষ উৎসাহে ও আনন্দে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন ও মুজাদ্দেদিয়া তরিকায় বায়াত নেন। এনায়েতপুরের এই মহান সুফিসাধকের অক্লান্ত প্রচেষ্টায় এবং তাঁর ভক্ত, অনুরক্ত, মুিরদ ও খলিফাদের সহযোগিতায় বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে শিরক, বিদাত, অনৈসলামিক রীতি-নীতি, আচার আচরণের মূল উৎপাটনে এবং ইসলাম প্রচারে তথা মুজাদ্দেদিয়া তরিকা প্রচারে তিনি যে মূল্যবান অবদান রেখে গেছেন তার জন্য সত্যিই তিনি বাংলাদেশে তথা এই উপমহাদেশে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন।

বাংলাদেশে সুফিবাদের চর্চা ও খাজা এনায়েতপুরী

পীর, দরবেশ ও অলী-আউলিয়ার দেশ হলো বাংলাদেশ। এ হলো শহীদ গাজীর বাংলাদেশ। বাংলাদেশের অধিকাংশ লোক সুফি মতবাদে বিশ্বাসী এবং কোন না কোনভাবে সুফি তরিকার সাথে জড়িত। মুসলিম জনগোষ্ঠির দিক থেকে বাংলাদেশ বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম (প্রথম ইন্দোনেশিয়া, দ্বিতীয় ভারত ও তৃতীয় পাকিস্তান) মুসলিম দেশ হিসেবে পরিচিত। এই বিশাল ধর্মপ্রাণ মুসলিম জনগোষ্ঠি, যাদের ছোঁয়ায়, যাদের পরশে, যাদের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়েছেন তাঁরা হলেন আরব বিশ্ব থেকে আগত সুফি সাধকগণ। এদেশে মহানবী (সা.) নিজে আসেন নি বা তাঁর সাহাবায়ে কেরামগণের দ্বারাও সরাসরি ইসলাম প্রচারিত হয়নি এদেশে। বরং আল্ল­াহ ও রাসূল (সা.) এর আদর্শে আদর্শিত সুফিসাধকগণ এদেশে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নভাবে ইসলাম প্রচার প্রসারে বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। অনেক সুফি সাধক মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশ থেকে এসে বিভিন্ন তরিকায় দ্বীনের দাওয়াত দিয়েছেন, ফলে বাংলাদেশে বহু সুফি তরিকার উদ্ভব হয়েছে। তার মধ্যে চিশতিয়া, কাদিরিয়া, মুজাদ্দেদিয়া, সোহরাওয়ার্দিয়া, ওয়ায়েসিয়া আদহামিয়া, নকশেবন্দিয়া, খিজিরিয়া, কলন্দারিয়া ও তাবাকাদী বা মাদারিয়া প্রধান। এ ছাড়া হুসাইনী রূহানিয়াও শফ্ফা উপশাখাও বাংলাদেশে বিদ্যমান রয়েছে।

উল্লি­খিত সকল তরিকাই হক এবং এই সকল তরিকার ছবক যারা দিয়েছেন বা সাধনা করেছেন তাঁরা হকের ওপরই ছিলেন, এবং কুরআন ও সুন্নাহর বিপরীত কোন তরিকা অবশ্যই প্রতিষ্ঠা লাভ করেনি। কিন্তু তরিকা সাধনা করতে গিয়ে কোন সাধক মজ্জ্বব হয়েছেন, বা স্বাভাবিক নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছেন এবং এ অবস্থায় শরিয়ত থেকে দূরে সরে পড়েছেন। সেক্ষেত্রে তার অনুসারীগণ অজ্ঞতাবশতঃ অথবা ভক্তি ও আনুগত্যের আতিশয্যের স্রোতে অথবা শয়তানের ধোকায় বা প্রতারকের প্রভাবে ‘আল কুরআন ও সুন্নাহ’ রাসূলুল্ল­াহ (সা.), সাহাবায়ে কেরাম ও পরবর্তী হকপন্থীদের অনুসরণ ভুলে গিয়ে, শরিয়তবিরোধী কাজকে বৈধ, সঠিক ও পুণ্যের কাজ মনে করে তা অব্যাহত রেখেছেন। কেউবা স্বার্থহানির আশঙ্কায় সে রেওয়াজ বন্ধ করেন নি।

এর বিপরীতে এমন অনেক সুফি দরবার আছে যেখানে কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে সুফিবাদের সঠিক চর্চা করা হয়। এমনই একটি সুফি কেন্দ্র হলো উপমহাদেশের প্রখ্যাত সুফিসাধক খাজা ইউনুছ আলী (র.) [১৮৮৬-১৯৫২], খাজা এনায়েতপুরী (র.) হিসেবে যিনি বাংলাদেশে প্রসিদ্ধ। দল-মত নির্বিশেষে সকল ভক্ত-আশেকান এখানে প্রত্যহ আগমন করেন এবং শরিয়তবিরোধী কোন প্রকার কার্যকলাপ এখানে বরদাশত করা হয় না। একারণেই মহান এ অলীর মাযার আজ সর্বজনস্বীকৃত পূণ্যভূমিতে পরিণত হয়েছে।

নিম্নে বাংলাদেশে সুফিবাদচর্চার যে বিকৃত ধারা বর্তমান তার একটি সাধারণ চিত্রের পাশাপাশি খাজা এনায়েতপুরীর তরিকার পার্থক্য তুলে ধরা হলো।

কবর সেজদা করা:

সুফি সাধকদের কিছু কিছু ভক্ত অতিভক্তি বা আনুগত্য প্রদর্শনের নিমিত্তে পীরকে বা পীরের কবরে সেজদা করেন। ঢাকার মীরপুরে বিখ্যাত সুফি সাধক কামিল পীর হযরত শাহ আলী বোগদাদী (র.) শুয়ে আছেন। আমি নিজে দেখেছি যে, তাঁর মাজারের পাশে সিজদায় পড়ে এক ভক্ত বলছেন, “দে বাবা শাহ আলী দে।” এখানে দু’টি শরিয়ত বিরোধী কাজ হলো। প্রথমত: সেজদা দেয়া Ñ তা কবরেই হোক বা জীবিত কোন পীরের কদমেই হোক নিষিদ্ধ ও হারাম। ছিহাহ্ সিত্তাহ হাদিসে বর্ণিত হয়েছে (হাদিস-ই-কুদসি), ‘আমি যদি  আল্ল­াহ  ছাড়া অন্য  কাউকে  সেজদা করার নির্দেশ দিতাম তবে সন্তানকে স্বীয় পিতা-মাতাকে সিজদা করতে বলতাম।’ এছাড়া ইসলামের প্রাথমিক কোন যুগেই মানুষ-সেজদা বা কবর সেজদার প্রমাণ নেই।

দ্বিতীয়ত: কোন কিছু চাইতে হলে স্বীয় প্রতিপালকের কাছেই চাইতে হবে। কেননা আল্ল­াহপাক বলেন, “তোমরা আমার কাছে চাও, আমি তোমাদেরকে দিব।” অন্যভাবে বলা হয়েছে, “হে নবী আপনি বলুন যখন আমার বান্দা আমার কাছে চায় তখন আমি তার অতি নিকটেই থাকি। যখন যা কিছু চায় আমি তা দিয়ে থাকি।” বুখারী শরীফে বর্ণিত হয়েছেÑ রাসূল (সা.) বলেন, “আল্ল­াহ দাতা আর আমি বন্টনকারী।” কাজেই চাইতে হবে আল্ল­াহর কাছে। তবে আল্ল­াহর প্রিয় বান্দাদের অছিলায় চাওয়া যেতে পারে।

এবার এনায়েতপুর দরবার শরীফের দিকে তাকানো যাক। এ দরবার শরীফে সেজদা করা হয় না, করতে দেয়া হয় না। প্রতিদিন দরবারের খাদেম, পেশ ইমাম, মোদারেছগণ ভক্তদের উদ্দেশ্যে বারবার সতর্কবাণী উচ্চারণ করেন যে, মাযারে সেজদা করা হারাম। যে-কেউ দরবার শরীফে গমন করলে দেখবেন যে, দরবারের বিভিন্ন দেওয়ালে, মাযারের চারপাশে অসংখ্য লাল পোষ্টার লাগানো আছে। আর তাতে লেখা আছে: ‘সাবধান! মাযারে কেহ সেজদা করিবেন না’।

এ ব্যাপারে খাজা এনায়েতপুরী (র.) তাঁর হায়াতকালে স্পষ্ঠ করে সতর্ক -বাণী দিয়ে গেছেন। তিনি বলেছেন, ‘কোন ব্যক্তি কোন পীর কিম্বা মানুষকে সেজদা করিও না। আল্ল­াহর নিষেধ। যে-কেহ শরীরের (গায়ের) জোরে এইরূপ অন্যায় কাজ করিবে সে শরিয়ত অনুসারে কাফের ও শয়তান হইবে। সাবধান! কেহ শরিয়তের বিরুদ্ধে চলিও না।’ 

দ্বিতীয়ত: এনায়েতপুর দরবার শরীফে পীর বা অলীর কাছে কোন কিছু চাওয়া হয় না। এখানে যে ফাতেহা শরীফ পাঠ করা হয়, তার ছওয়াব-নজরাণা জামে আম্বিয়া, জামে আউলিয়া ও কুল্লে মোমিন-মোমেনার বিদেহী আত্মায় বখশিষ করা হয়, আর খাজা এনায়েতপুরীর অছিলা নিয়ে মুনাজাত করা হয়। কখনই খাজা পীরের কাছে মুনাজাত করা হয় না। অর্থাৎ সকল চাওয়া আল্ল­াহর কাছে নিবেদন করা হয় এবং তা অবশ্যই খাজা পীরের অছিলা নিয়ে চাওয়া হয়।  (চলবে)

অধ্যাপক ড. মো. গোলাম দস্তগীর

টরন্টো

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *