বিএনপি, অর্ন্তবর্তী সরকার এবং নির্বাচন
জসিম মল্লিক
এরশাদ বিরোধী দীর্ঘ আন্দোলনের পর ১৯৯১ সালে আওয়ামী লীগকে হতবাক করে দিয়ে বিএনপি ক্ষমতায় এসেছিল। পাঁচ বছর বেগম খালেদা জিয়া চমৎকারভাবে দেশ পরিচালনা করেছিলেন। আমার সবসময় মনে হতো শিল্পপতিরা রাজনীতিতে আসলে দেশের জন্য ভালো হবে। তাঁদের চুরির ধান্দা থাকবে না। দেশের জন্য কাজ করবে। বিএনপির টিকিটে ইলেকশন করে প্রায় ৬২ জন শিল্পপতি এমপি মন্ত্রী হয়েছিলেন সে বছর। তার মধ্যে একজন ছিলেন মুন্নু সিরামিকের এমডি হারুণার রশিদ খান মুন্নু। আমি ঠিক তার আগের বছর ১৯৯০তে মুন্নুতে জনসংযোগ কর্মকর্তা হিসাবে যোগদান করি। অবাক কান্ড হচ্ছে মুন্নু সাহেব আমাকে খুবই পছন্দ করে ফেলেন এবং তার রাজনীতি দেখভালের দ্বায়িত্ব দেন। আমার জন্য এটা ছিল বিরাট চ্যালেঞ্জ। আমি ২০০২ পর্যন্ত সেই দ্বায়িত্ব পালন করেছি। মুন্নু সাহেব ছিলেন আপাদমস্তক একজন সৎ রাজনীতিবিদ এবং শিল্পদ্যোক্তা। তিনি ছিলেন দানবীর। আজকের দিনে তার মতো মানুষ খুবই বিরল।
এরপর ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে। তারাও অনেক শিল্পপতিকে নমিনেশন দিয়েছিল। আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় আসা খুবই প্রত্যাশিত ছিল এবং শেখ হাসিনার পাঁচবছরও চমৎকারভাবে দেশ পরিচালিত হয়েছিল। ২০০১ এ আবার বিএনপি ক্ষমতায় আসে। একটা গণতান্ত্রিক ধারার প্রচলন হয়েছিল। তিনটি নির্বাচনই ছিল নিরপেক্ষ তত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে। এবং সেই নির্বাচনগুলো অপেক্ষাকৃত সুন্দর হয়েছিল। পার্লামেন্ট ছিল মুখরিত। শক্তিশালী বিরোধীদল থাকলে যা হয়। কারণ আমি প্রায় একযুগ সংসদের প্রসিডিংস কাছ থেকে দেখেছি। এরপরই সব বদলে যেতে থাকে। ক্ষমতার লোভ পেয়ে বসে দলগুলোকে। ১/১১ সব লন্ডভন্ড করে দেয়। তারপর আওয়ামী লীগ টানা ক্ষমতায় থাকে। গত পনেরো বছর কোনো নির্বাচনই হতে দেয়নি। একটা স্বৈরাচারী শাসন কয়েম করে। দুর্নীতিতে জড়িয়ে পরে মন্ত্রী, এমপি ও অনুসারীরা। গতবছর প্রবল গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগের পতন হয়। বেশীরভাগ নেতাই বিদেশে পালিয়ে গিয়েছে এবং বিলাসী জীবন যাপন করছে। অথচ কর্মী সমর্থকরা কষ্টে আছে। অনেকে জেলে আছে। কিন্তু তারা আওয়ামী লীগ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়নি। তারা বিশ্বাস করে যে শেখ হাসিনা কোনো ভুল করেন নি এবং যে কেনো সময় ফিরে আসবেন। অন্ধ সমর্থকরাই আওয়ামী লীগের শক্তির জায়গা।
এখন প্রফেসর ইউনূসের অন্তবর্তী সরকার ক্ষমতায়। তারা সংস্কারে মনোযোগী। অনেকগুলো কমিশন গঠন করা হয়েছে। তারা কাজও করছেন। সরকারের সফলতা অনেক ক্ষেত্রেই এখন দৃশ্যমান। আইন শৃঙ্খলা এখন যথেষ্ট ভাল। দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে। তা সত্বেও রাজনৈতিক দলগুলো তেমন খুশী হতে পারছে না। তারা দ্রুত নির্বাচন চায়। রোডম্যাপ চায়। বিশেষ করে বিএনপি। জামাত বা এনসিপি নামের নতুন দলটি এখনই নির্বাচন চায় না। এনসিপি আন্দোলনের মূল স্টেক হোল্ডার। আবার বিএনপির চাওয়াও যৌক্তিক। বিগত দিনগুলোতে তারাই আন্দোলন সংগ্রাম করেছে, নির্যাতিত হয়েছে, জেল জুলুম সহ্য করেছে। খালেদা জিয়া বিনাদোষে দীর্ঘদিন জেলখানার নির্জন সেলে বন্দী ছিলেন। তারেক রহমান নির্বাসিত থেকে দল পরিচালনা করেছেন। অনেকে মনে করেন বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে শুধু নির্বাচনই গণতন্ত্রে ফেরার মূলকথা নয়। সংষ্কার ছাড়া নির্বাচন হলে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি যে হবে না তার কোনো গ্যারান্টি নাই। আপাতদৃষ্টিতে বিএনপি ও জামাত ক্ষমতার স্বাদ উপভোগ করছে। মাঠ পর্যায়ে বিএনপির নেতা কর্মীরা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে বলে অভিযোগ উঠেছে। যদিও দলীয় হাই কামান্ড এসব ব্যাপারে অনেক শক্ত অবস্থান নিয়েছে। বিএনপিকে এখনই সতর্ক হতে হবে। দেশের মানুষ তাদের কর্মকান্ড আবজার্ভ করছে। তাদের দিকে তাকিয়ে আছে। পুরনো স্টাইল থেকে তাদের বের হতে হবে। শুধু তাত্ত্বিক কথা বলে মানুষের মন গলানো যাবে না। ইউনিক কিছু করতে হবে যা মানুষকে আশাবাদী করে।

আগামী ডিসেম্বর থেকে পরের বছর জুনের মধ্যে নির্বাচন হওয়ার কথা বলেছে সরকার। ঢাকার বাইরের মানুষের কাছে অন্তবর্তী সরকারের কর্মকান্ড বা তাদের হৃদয়ের কথা যতখানি না পৌঁছায় তারচেয়ে বেশি রাজনৈতিক দলগুলোর মেঠো কথার আবেদন বেশি। দীর্ঘদিনে এই অভ্যাস তৈরী হয়েছে। সুইডিশ লেখক ও ইতিহাসবিদ জোহান্স নর্গবাগ বলেছেন, গণতন্ত্রহীন পরিস্থিতিতে মানুষ সম্ভাবনা নয়, সুরক্ষা খুঁজে। তিনি ‘দ্য প্রোগ্রেস’ গ্রন্থে এই ধারণা তুলে ধরেন। গণ-অভ্যুত্থান পরবর্তী যে কথোপজীবী শ্রেণি গড়ে উঠেছে, তারাও শীতাতপনিয়ন্ত্রিত সম্মেলনকক্ষের অনুরাগী। বৈষম্যবিরোধী গণ-অভ্যুত্থানের সামাজিক কোনো রূপান্তর গ্রামীণ পরিসরে দেখা যাচ্ছে না। মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশ কেবল গুটিকয় শহরের সমষ্টি নয়। নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতার সঙ্গে গ্রামের মানুষদের যুক্ত করা না গেলে তা বিশেষ কোনো ফল আনবে না। আরেকটি বিষয় হলো, শাসন যত ভালো হোক না কেন, তা যদি জনগণের মনে স্বস্তি তৈরি না করে, তাহলে এর ধারাবাহিকতা রক্ষা করা যায় না। শেখ হাসিনার পতনের মূলে রয়েছে জন-অসন্তুষ্টি। উন্নয়ন একটু কম হলেও সমস্যা নেই। মানুষ স্বস্তি চায়। ৫ আগস্ট-পরবর্তী মাঠে বিএনপি ও জামায়াতের বিরুদ্ধে দখল, চাঁদাবাজি, হানাহানি, কলহ, ক্ষেত্রবিশেষে খুনোখুনির অভিযোগ উঠছে। মানুষ শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিল একটু স্বস্তি, নিরাপত্তা ও মর্যাদার আশায়। বাস্তবে জনপরিসরে নতুন করে অস্বস্তি বাড়ছে। এটাই অর্ন্তবর্তী সরকারের বড় চ্যালেঞ্জ।
এদিকে ৫ আগস্টের আগে পর্যন্ত আওয়ামী লীগের নেতা কর্মীদের একমাত্র টার্গেট ছিল বিএনপি। খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানকে একবার করে গালি না দিলে তাদের পেটের ভাত হজম হতো না। অনেকটা ইবাদতের মতো ছিল ব্যাপারটা। বিএনপিকে বাঁচিয়ে রেখেছিল আওয়ামী লীগ। বিশেষকরে ওবায়েদুল কাদের। বিএনপি নামে যে একটা দল আছে সেটা আওয়ামী লীগ মনে করিয়ে দিত প্রতিদিন। সেই তুলনায় জামাত কম অত্যাচারিত হয়েছে। আর জাতীয় পার্টির মতো সুখী দল কেউ ছিল না। দীর্ঘ পনোরো বছর আরাম আয়াসে ছিল। পরগাছার মতো। সরকারী গাড়ি, বাড়ি, ব্যবসা, ক্ষমতা ভোগ করেছে। আর বিএনপি প্রতিদিন অত্যাচারিত হয়েছে। খালেদা জিয়া কারাগারের নির্জন সেলে দিন যাপন করেছেন দিনে পর দিন। বিএনপি কিন্তু আন্দোলন করে তাদের নেত্রীকে মুক্ত করতে পারেনি। এমনকি চিকিৎসার জন্য বিদেশেও পাঠাতে পারেনি। অথচ বিএনপি কিন্তু দেশের সবচেয়ে বড় দল। জনপ্রিয় দল। তারা প্রতিটি ক্ষেত্রে স্বৈরাচারের বিরোধিতা করেছে। আপোষ করেনি।
৫ আগষ্ট ছাত্ররা ঘটালেও বিএনপির অবদান অস্বীকার করা যাবে না। দীর্ঘ আন্দোলন, সংগ্রাম, জেল, জুলুম সহ্য করেছে বিএনপি। একটা প্রেক্ষাপট তৈরী হয়েই ছিল। তবে আওয়ামী পতনের সব কৃত্বিত্ব তারা দাবী করলে সেটা সঠিক হবে না। এখানে এনসিপি ছিল মূল অনুঘটক। অর্ন্তবর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর কোনো এক অলৌকিক কারণে আওয়ামী লীগের লোকজন বিএনপির বিরেুদ্ধে একটা শব্দও উচ্চারন করেনা। বরং বিএনপির প্রতি খুবই সহানুভূতিশীল। তাদের সব রাগ ক্ষোভ প্রফেসর ইউনূসের উপর। সম্ভব হলে তাকে কেটে টুকরা টুকরা করে ফেলতে চায়। রাজনীতি সত্যি খুব ইন্টারেস্টিং জিনিস। সাধারণ মানুষের পক্ষে বোঝা কঠিন। রাজনীতির প্যাঁচ বড়ই জটিল। শত্রু মুহূর্তে বন্ধু হয়ে যায়। যেমন আওয়ামী লীগের সবচেয়ে বড় বন্ধু এখন বিএনপি এবং সবচেয়ে বড় শত্রু অর্ন্তবর্তী সরকার।
এখন নির্বাচন নিয়ে মন কষাকষি চলছে। সরকার বলছে তারা অবশ্যই ২০২৬ এর জুনের মধ্যে নির্বাচন আয়োজন করবেন। তারা ভাল সংস্কার করে নির্বাাচন করতে চায়। কিন্তু বিএনপি তা মানতে রাজী না। তারা সংস্কারও চায় আবার ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন চায়। তা না হলে আন্দোলনের হুমকি দিয়ে রেখেছে। এটা ঠিক যে অর্নিবাচিত সরকার বেশিদিন ক্ষমতায় থাকলে নানা অঘটন ঘটতে পারে। তবে মানুষ যে কারণে আন্দোলন করেছে তার যদি কিছুই না হয় তাহলে সেই নির্বাচনের দরকার কি! নির্বাচনই সব সমস্যার সমাধান না। অনেকেই বলছেন বিএনপি বড্ড বেশি তাড়াহুড়া করছে। আবার কেউ কেউ প্রফেসর ইউনূসকে আরো বেশিদিন ক্ষমতায় থাকার জন্য আওয়াজ তুলছে। বিএনপি হয়ত নিশ্চিত যে নির্বাচনে তারাই ক্ষমতায় যাবে। সে কারণেও তাড়াহুড়া থাকতে পারে। তবে যদি ছাত্ররা আন্দোলন করে সরকার না হটাত তাহলে কিন্তু নির্বাচনের জন্য বিএনপিকে আরো অনেকদিন অপেক্ষা করতে হতো। অন্তত আরো পাঁচ বছর। তাহলে মাত্র ছয় মাসের ব্যবধানে কি এমন ক্ষতি হবে তা বোধগম্য নয়। বিএনপির উচিত সরকারকে সহযোগিতা করা। তবে অর্ন্তবর্তী সরকার তাদের কথা রাখবে বলেই আশা করা যায়। আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল স্পষ্ট করে বলেছেন ২০২৬ এর জুনের মধ্যেই নির্বাচন হবে। দেখা যাক কোথাকার পানি কোথায় গড়ায়।
আজব এই শহরে
আমার জীবনটা যদি তিন ভাগে ভাগ করি তাহলে দেখা যায় প্রতি ভাগ প্রায় সমান। প্রথম ভাগ বরিশাল, দ্বিতীয় ভাগ ঢাকা এবং তৃতীয় ভাগ টরন্টো। শেষ ভাগটা ক্রমেই বাড়ছে। হয়ত বাড়তেই থাকবে যদি না সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে ফিরে যাই। সত্যি কি ফেরা যায়! কার কাছে ফিরব! তবুও বছর বছর ছুটে যাই। মা, বাবা, ভাই, বোনরা ঘুমিয়ে আছে কবরে। আপনজনদের জন্য টান অনুভব করি তাই যাই। দেশের জন্য টান অনুভব করি তাই যাই। আবার ফিরে আসি। কেনো ফিরতে হয়! নিজের সন্তান পরিবারের টানে ফিরে আসি। এই যে ছুটে চলা মৃত্যুতেই এর যবনিকাপাত ঘটবে। সেটা কখন জানা নাই। জানা থাকলে ভাল হতো। বস্তুতঃ আমি মনের কাছে খুউবই একা। চিবুকের কাছেও একা। আমাকে বেশি মানুষ বোঝে না। খুবই অল্প কয়েকজন আমাকে বোঝে, প্রশ্রয় দেয়, সহ্য করে তাই হাজার মাইল দূরে হলেও ছুটে যাই। এরকম সারা পৃথিবীতেই একজন দুজন আছে যারা আমাকে ভালবাসে। টরন্টোতেও আছে। তবে আমাকে না দেখেও অনেকে ভালবাসা প্রকাশ করে। এটাই বেঁচে থাকার আনন্দ।
এই যে এতোটা বছর বিদেশে আছি নিজের কাছেই অবাক লাগে। আমার কখনও বিদেশে স্থায়ী হওয়ার কথা ছিল না। কোনো কারণও নাই। মা একবার আমাকে বলেছিল, তুমি কেনো বিদেশ গেলা! ওই দেশে কি আছে! নিজের দেশ ছেড়ে কেউ যায়! মা লেখাপড়া জানতেন না কিন্তু দেশপ্রেম ছিল প্রগাঢ়। মা সত্যি বুঝেছিলেন বিদেশে আসলে কিছু নাই। আলগা চাকচিক্য, বাগাড়ম্বর, বাড়ি গাড়ির গল্প, মেকি বন্ধুত্ব আর হাসি ছাড়া কিছু নাই। মা কখনও চাননি আমি বিদেশে যাই কিন্তু কখনও আমাকে আটকাতেও চাননি। সন্তান দূরে চলে গেলে বাবা মা কতখানি শূন্য হয়ে যায় সেটা এখন আমি টের পাই। এতোটা বছরেও আমার নিঃসঙ্গতা ঘোচেনি। কখনও ঘুচবেও না। কারো সাথেই আমার বেশি কথা থাকে না। এমনকি আমার স্ত্রীর সাথেও না। সে কথা বলে আমি মন দিয়ে শুনি। আমি ভাল শ্রোতা। যেখানেই যাই মানুষ অনেক কথা বলে। কথা বলতে মানুষ ভালবাসে। মানুষ অনেক কোলাহলপ্রিয়। মানুষ তার নিজের কথাই বেশি বলে। অন্যের কথা একদম শুনতে চায় না। অন্যকে বুঝতে চায় না। সেটা আমি বিদেশে পা দিয়েই টের পেয়েছিলাম। এই শহরটাকে আমি পছন্দ করি। তাই দিনমান একলা ঘুরতে আমার খারাপ লাগে না। মানুষের সঙ্গ ছাড়াও আমি দিব্যি বেঁচে আছি। গর্তেই সুখে আছি। আমি কি একটু কিম্ভুত!
টরন্টো ২৩ এপ্রিল ২০২৫
মত্যু একটি মহান ঘুম!
মাঝে মাঝে ভাবি জীবন কত অকিঞ্চিতকর। এই আছে এই নাই। মৃত্যু যেনো একটা হিমশীতল ঘুম। একটা মহান ঘুম। আজকে গিয়েছিলাম মাইকেল গ্যারন হাসপাতালে। ঝকঝকে তক তকে হাসপাতাল। কিয়স্কি থেকে সেলফ রেজিষ্ট্রেশন করে দোতলায় গেলাম। প্যারামেডিকস হাতে ইনজেকশন পুশ করল। তারপর ওয়েট করতে লাগলাম। কখন ডাক পরবে। আমার পাশের চেয়ারে আর একজন মহিলা। তিনি এসেছেন মাসকুকা থেকে। অন্য শহর। আর বাসা থেকে মাইকেল গ্যারন হাসপাতাল মাত্র বারো মিনিটের ড্রাইভ। আজকে আমি ড্রাইভ করতে পারব না তাই উবার নিয়ে এসেছি। যখন অপারেশন কক্ষের দুগ্ধধবল বিছানায় শুয়েছি মনে হলো যেনো বিমানের বোয়িং ৭৮৭ এর ককপিটে শুয়েছি। অতি উজ্জল আলো চারিদিকে। অত্যাধুনিক সব যন্ত্রপাতি। চোখ ঠিকরে যায়। সুশ্রী নার্স পরম মমতায় নাকে দুটো নরম পাইপ ঢুকিয়ে দিল। বলল, দুই মিনিটে ঘুমিয়ে যাবা। ওমা সে কি কথা! আমি শক্ত করে চোখ খুলে রেখেছি। মনে মনে ঠিক করেছি কেমন করে ঘুম আসে আমি অনুভব করতে চাই, কখন গভীর ঘুমে হারিয়ে যাব আমি টের পেতে চাই। এর আগেও আমি কয়েকবার এনেসথেসিয়ার কবলে পরেছি। প্রতিবারই এমন মনে হয়েছে।
সেই ঘুম যখন ভাঙল দেখি আমি অন্য একটি কক্ষে। কখন ঘুমিয়ে গেছিলাম টেরই পেলাম না। আজব ঘটনা। নার্সকে বললাম, জায়গাটা চেনা চেনা লাগছে। নার্স হেসে বলল, হ্যাঁ প্রথমে তুমি এখানেই ওয়েট করছিলা। বললাম, কতক্ষণ ঘুমালাম! সে বলল, সতেরো মিনিট! বাপরে! সতেরো মিনিট এই পৃথিবীতে ছিলাম না! কাপড় চোপড় চেঞ্জ করে ওয়েটিং রুমে এসে দেখি জেসমিন বিমর্ষমুখে বসে আছে। আমাকে দূর থেকে দেখে মুখটা এমন উজ্জল হয়ে উঠল! যেনো নতুন করে দেখছে! আজকের ঘটনা উদ্বিগ্ন হওয়ার মতো কিছু না যদিও। জাষ্ট নর্মাল চেক আপ। গত তিন চার মাস কত যে হাসপাতাল দৌঁড়েছি নিজেই জানি না। আমার ভাই যখন অসুস্থ্য ছিল আমি তখন দেশে। বরিশাল ও ঢাকার হাসপাতালগুলোতে অনেক ছুটাছুটি করেছি। আমি নিজেও কয়েকবার অসুস্থ হয়ে হাসপাতাল গিয়েছি। হাসপাতালে গেলে বোঝা যায় জীবন কত তুচ্ছ। অসুস্থ্য মানুষের পাশে না দাঁড়ালে বোঝা যায় না মানুষ কত কষ্ট করে বেঁচে থাকে। শেষ পর্যন্ত আমার ভাইকে বাঁচানো যায়নি। আমার ভাই চলে গেলো। যে যায় সে আর ফেরে না।
এসব নানা কারণে অনেকদিন লেখালেখির টেবিলে জুত করে বসা হয় না। একবারে কিছুই যে লিখি না তা না। কয়েকটি পত্রিকায় নিয়মিত কিছু কলাম লিখি। এগুলো একটা অভ্যাসের মতো। কিন্তু যা লিখতে চাই, যা নিয়ে সারাক্ষণ ভাবি, মনে মনে লিখি কিন্তু অক্ষরে রূপ দেওয়া হয় না। সেসব কল্পনায়ই থেকে যায়। এমনও হয় রাতে ঘুমাতে পারি না। মাথার মধ্যে কিল বিল করতে থাকে। যন্ত্রণা দিতে থাকে। গত ছয় মাস থেকেই এমন হচ্ছে। নানা ঘটনায় লেখালেখিতে বাঁধা তৈরী করছে। মনোসংযোগে ব্যাঘাত ঘটছে। আমি এমন একজন মানুষ সহজে কোনো কিছু উপেক্ষা করতে পারি না। নির্বিকার থাকতে পারি না। যেকোনো মানবিক ব্যাপারে নির্বিকার থাকা আমার জন্য কষ্টের। যারা আমাকে কষ্ট দিয়েছে তারাও সাহায্য চাইলে আমি সারা দেই। অনেক অপ্রত্যাশিত ঘটনা, আচরনে কষ্ট পাই কিন্তু কাউকে বুঝতে দেই না। কাউকে আঘাত করি না।
সাম্প্রতিককালে আমরা ব্যাক্তিগত সম্পর্কের চেয়েও রাজনীতিকে বেশি প্রাধান্য দিচ্ছি। জীবনের অংশ করে ফেলেছি। এর বাইরে আমাদের আর কিছু ভাবনায় নাই। যেনো এটাই জীবন। আমাদের টলারেন্স কমে গেছে। রাজনীতির কারণে সম্পর্কের মধ্যে যে একটা মাধুর্য্য ছিল তাতে কালো দাগ পড়েছে। এটা আমাকে অনেক পীড়া দেয়। কিন্তু আমার কিছু করার থাকে না। কেউ সম্পর্ক ভেঙ্গে দিতে চাইলে সেটা তার নিজস্ব সিদ্ধান্ত। আমি কখনও জানতেও চাই না। ওসব মেনে নেই। সবারই স্বাধীনতা আছে। তবুও বলি আসুন ভালবাসায় বাঁচি। ঘৃণা আপনাকে কিছুই দেবে না।
মনে পড়ে আমি ছিলাম
আজকাল কোনো কিছুই আর ঠিকঠাকমতো ঘটে না সহজে। যা কিছু করি মনে হয় কিছুই ঠিকমতো হয় নি। লেখা ঠিকমতো হয়নি, বলা ঠিকমতো হয়নি, যোগাযোগ ঠিক মতো হয়নি। মনে হয় কোথায় যেনো একটা ভুল হচ্ছে। মনে হয় কোথায় যেনো ভুলের চিহ্ন থেকে গেছে। কলেজে পড়ার সময় থেকেই নীহার রঞ্জন গুপ্তের বই পড়তে শুরু করি। তার রহস্য বইগুলোতে কিরীটি রায় ছিল একজন ঝানু গোয়েন্দা। অপরাধী যত বড় সেয়ানাই হোক না কেনো কিরীটি বাবু ঠিকটাক ধরে ফেলতেন। অপরাধী কোথাও না কোথাও একটা চিহ্ন রেখে যায়। গোয়ান্দারা সবসময় মনে করেন, কোথাও না কোথাও একটা ক্লু থাকবেই। আমার ভুলগুলো অবশ্য ভিন্ন মাত্রার, একান্ত নিজের। আমি আমার নিজের ভুলে নিজেই জর্জরিত। আমার ভুলগুলো অন্য কেউ সহজে শুধরে দেয় না, কোনো গোয়েন্দাগিরিও নেই হয়তবা বা আছে। বস্তুত আমার গোয়েন্দা আমি নিজেই। আমি যেমন ভুল করি, আবার একা একা ভুল স্বীকার করি, ভুল শোধরাতেও চেষ্টা করি। একই ভুল বার বার করি বলে নিজের উপর নিজেই ক্ষুব্ধ।
কেনো ভুল করলাম এইসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজি। ভাবি একই ভুল আর করব না। বড় অপরাধীরা বড় বড় ক্রাইম করে। আমি চুনোপুটি টাইপ মানুষ। বড় অপরাধ করতে বুকের পাটা লাগে, সবাই পারে না। আমি আমার ক্ষুদ্র জীবন নিয়ে জেরবার। অন্যে কে কি করল সেসব নিয়ে লিখতে সাহস পাই না। কি থেকে কি হয়। শুনেছি আমরা যে যাই লিখি না কেনো সবকিছু সিস্টেমে থেকে যায়। কিছুই মুছে যায় না। হারিয়ে যায় না। লেখা পছন্দমতো না হলে একদিন ধরা হবে। জাল পাতা আছে। তাই ওসবের ধারে কাছে নাই আমি। শুভকাঙ্খিরা সবসময় বলে নিজেকে সেভ করে চলতে। সত্য কথা বলার দরকারটা কি। সত্যবাবুর মা মইরা গেছে। যেমনে আছ তেমনে থাক। জেসমিনও বলে, তুমি হইছ দুই পয়সার মানুষ, কে কি করলো তা নিয়া এতো চিন্তা করতে হবে না। নিজেরে নিয়া চিন্তা করো।
কথা সত্য। আমি তাই করি। নিজেরে নিয়া চিন্তা করি। আজকাল এমন হয়েছে একটা না একটা কিছু ভুল হয়েই যায়। নিজের উপর কন্ট্রোল কমে যাচ্ছে। যা করা দরকার তা করি না, অদরকারি কাজ নিয়ে সদা ব্যস্ত। আর ভুলগুলোও খুউব হাস্যকর। অন্য কেউ আমার মতো করে কিনা জানি না। আমার মতো কারো না হওয়াই বাঞ্চনীয়। আমার এখন যে বয়স
তাতে আমার আরো চিন্তাশীল, শান্ত, স্থির থাকার কথা। কিন্তু তা না হয়ে অপ্রত্যাশিত সব কান্ড করি। যাকে যা বলার কথা না তাকে তা বলি, যার সাথে যে আচরন করা উচিত না, তার সাথে সে আচরন করি। যাকে সম্মান করা উচিত তাকে যোগ্য সম্মান না দিয়ে অযোগ্যকে সম্মান দিয়ে বসি।
পক্ষান্তরে আমার সাথেও অন্যেরা এমন আচরন করে। যার উপকার করি সেই দেখি চোখ উল্টে ফেলে। এসব কারণে একসময় গভীর বেদনায় আচ্ছন্ন হতাম। এখন হইনা তেমন। এখন সবকিছু স্বাভাবিকভাবে নিতে শিখেছি। আমার উদারতার সুযোগ নিয়েও কেউ কেউ আমাকে ব্যবহার করতে চায়। তাই এসব ভেবে কখনও একটু এলোমেলো হই বটে, নিজের উপর নিয়ন্ত্রণও হারাই। কিন্তু মেনে নেই, ভাবি এটাই জীবন। প্রতিটি জীবন তার আপন নিয়মে চলবে। কেউ আমাকে নিয়ন্ত্রণ করুক, অভিযোগে জর্জরিত করুক আমি তা চাই না। আমি কখনো কারো উপর অভিযোগ করি না। কত আপনজন আমাকে দূরে সরিয়ে দিয়েছে! আমি কখনো জানতে চাইনি কেনো এমন করেছে। আমার জানতে চাইতে ইচ্ছে করে না। যে হারায় সে এমনি হারায়, আর যে থাকে সে এমনি থাকে।
এইসব যখন ভাবি তখন আউলা ঝাউলা লাগে। রাস্তায় নেমে পথ হারিয়ে ফেলি। এক জায়গায় যাব বলে পথে বেরিয়েছি চলে যাই অন্য জায়গায়। হঠাৎ মনে হয় আরে আমার তো এখানে আসার কথা না! অন্য কোথাও যাওয়ার কথা ছিল!
জীবনানন্দের কবিতার লাইন দিয়ে শেষ করছি-
“আবার আকাশে ঘন হয়ে উঠেছেঃ
আলোর রহস্যময় সহোদরার মতো অন্ধকার।
যে আমাকে চিরদিন ভালোবেসেছে
অথচ যার মুখ আমি কোনোদিন দেখিনি,
সেই নগরীর মতো ফাল্গুন আকাশে অন্ধকার নিবিড় হয়ে উঠেছে।
মনে হয় কোন্ বিলুপ্ত নগরীর কথা
সেই নগরীর এক ধূসর প্রাসাদের রূপে জাগে হৃদয়ে..”
টরন্টো, কানাডা
জসিম মল্লিক
লেখক ও সাংবাদিক। টরন্টো
jasim.mallik@gmail.com