ঢাকা পথকথন ২০২৫

মোয়াজ্জেম খান মনসুর

(পাঁচ)

নিউমার্কেট থেকে এলিফেন্ট রোড যাবার পথ -ব্যক টু ব্যক ট্রাফিক। রিকশা বাস গাড়ী মটর বাইক সিএনজি স্থির হয়ে আছে রাস্তায়। কি ব্যপার কি হলো? রাস্তা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে সায়েন্স ল্যবরটেরির কোনায়। ঢাকা কলেজের পাশ রাস্তা বন্ধ। সারা দিনের কাজকর্ম শেষে মানুষ রাস্তায় বন্দী অসহায় অবস্থায় আটকে আছে। ভাগ্নে শাকিল আর আমি যাব এলিফেন্ট রোডে কেনাকাটা এবং সুট পিকাপ করতে। এদিকে পাঞ্জাবী মন মতন না পেয়ে রওনা দিলাম ইস্টার্ন মার্কেটে। ও মাই গড! বিগ মিস্টেক। শাহবাগ মোড় বন্ধ। এই পথ রাস্তা কমপ্লিটলি বন্ধ। রিকশাওয়ালা পাকা ড্রাইভার। এদিক সেদিক করে নিয়ে এল আধা ঘন্টা লাগিয়ে। রাস্তা বন্ধের কারণ সাত কলেজের ছাত্র আন্দোলন। সাত কলেজকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে আনতে হবে। ছাত্রদের এই দাবী না মানলে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যকে গৃহবন্দী করার হুমকি। রিকশাওয়ালা বলছে ভাই দেখেন কি অবস্থা। একটার পর একটা, অন্দোলন চলছে। রাস্তা বন্ধ থাকলে আমাগো পেটে লাথি। এইগুলি কে বুঝে বলেন! শাহবাগ মোড় বন্ধ। আন্দোলন। নিউমার্কেট শাহবাগ ইউনিভার্সিটি এলাকা আজিমপুর লালবাগ নুতন পল্টন হাজার হাজার গাড়ি জ্যামে আটকে পরে আছে রাত সাড়ে দশটা পর্যন্ত।

সন্ধ্যায় বন্ধু আলমগীর নিয়ে গেল লালবাগে -ডিনার করাতে। আমরা কিছুক্ষণ পায়ে হেটে কিছুক্ষণ রিকশায় এই ভাবে তিন রিকশা বদল করে গিয়ে পোঁছালাম জায়গামত। আলমগীর বেশি দূর হাটাতে পারে না। কষ্ট হয় তার। আমাকে বলে আস্তে হাট। আমার পেট খারাপ গত দুই দিন। থাই সুপটা খুব মজা করে খেলাম আর একটু ফ্রাইড রাইস। আসার পথে রিকশাওয়ালা দেখি মহা খেপা ছাত্রদের উপর। রাত প্রায় এগারটা এখনও রাস্তায় প্রচন্ড জানজট। আলমগীর বলে, ‘ছাত্ররা ইকটু আধটুতো করবই। এত চেতো কেন ভাই? বাড়ী কই?’

‘রংপুর।’

‘ঢাকায় কতদিন!’

‘দুই বছর। আমাগো নতুন স্বাধীনতা আইনা দিসে না।’ আলমগীর ছাত্র আন্দোলনে রাস্তায় ছিল কয়েক দিন। পেশায় উকিল। বি এন পি ঘরনার লোক। ছাত্রদের প্রতি মমতা ভালবাসা সমর্থন তার এখনও আছে। দেশের সার্বিক রাজনীতি আইন শৃংখলা অর্থনীতি নিয়ে খুব বেশি কথা হয়নি কিন্তু আঁচ করা গেল এখনো এই সরকারের প্রতি তার অসীম বিশ^^াস। ছাত্রদের নিয়ে আশাবাদী। ছাত্রদের প্রতি ভীষণ আস্থাশীল। ঢাকার রাস্তায় তীব্র জানজট এটা তার কাছে কোন বড় সমস্যা নয়। (যার লগে যার ভাব। লাগে খাপে -খাপ) আলমগীর এক সময় রস করে বলত আমাদের বন্ধুদের আড্ডায়।

ছোট ভাই নাদিরের বউ মনি কানাডা থেকে এসেছে কন্যা আমাইরাকে নিয়ে দেশে বেড়াতে। মাস খানেক থাকবে।

নাদিরের শাশুড়িকে দেখতে গেলাম ভাগ্নে শাকিলকে নিয়ে। তার শরীর দিন দিন খুব খারাপ হয়ে যাচ্ছে। এম বি এ করা একমাত্র ছেলের মানসিক বিপর্যয় তাঁকে শারীরিক ও মানসিক ভাবে অত্যন্ত বিধ্বস্ত করে ফেলেছে। শরীর ভেঙ্গে যাচ্ছে দিন দিন। মুক্তার (নাদিরের শ্যলিকা) স্বামী একজন প্রখ্যাত সাংবাদিক। কথা হচ্ছিল লাঞ্চ টেবিলে। দেশের বর্তমান ভবিষ্যত হালচাল নিয়ে। সংবাদ পত্রের স্বাধীনতা – বাক স্বাধীনতা নিয়ে। সে বলল আমরা যখন হাসিনা সরকার কর্তৃক বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বিরুদ্ধে ভয়াবহ পুলিশি-আর্মি আক্রমণের নিউজ করে যাচ্ছিলাম তখন আমাকে ডিজিএফআই অনেক ওয়ার্নিং দিয়েছে। কিন্তু সেগুলো উপেক্ষা করে আমরা আন্দোলনের নিউজ করেছি। আন্দোলনের প্রতিদিনের হালচাল তুলে ধরেছি। জনগনের পাশে ছিলাম প্রতিদিন। কিন্তু এখন ছাত্রদের, ইউনুস সরকারের আবারও সেই অবস্থা। সংবাদ পত্রের স্বাধীনতা নেই। ইউনুস সরকারের কথামত সংবাদ করতে হয়। ছাত্রদের কথাই আইন। আইন শৃংখলা বলতে কিছুই নেই। রাজনীতির নামে প্রতিপক্ষকে পিটিয়ে হত্যা করা, মামলা হামলা এগুলো সমানে চলছে। ঢাকা শহরের গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টগুলো আটকিয়ে ছাত্ররা সমাবেশ করছে। রাস্তায় লক্ষ লক্ষ যাত্রীর কাজ কর্ম ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে । অসুস্থ রোগী হাসপাতালে সময় মতন না যেতে পেরে প্রাণ হারাচ্ছে রাস্তায়। পরিবহন -যোগাযোগ ব্যবস্থার ভয়াবহ ক্ষতি হচ্ছে। সেগুলো আমলে নেবার এখন কেউ নেই।

তবে সুখবর হচ্ছে বাজারের অবস্থা অনেক ভাল। মাছ মাংশ শাক সবজি অত্যন্ত সুলভ মুল্য পাওয়া যাচ্ছে। বাজার ভর্তি আলু পেয়াঁজ টমেটো ফুলকপি ব্রকলী সিম বরবটি লতি ঢেঁড়স। সন্ধ্যায় ভ্যান গাড়ীতে সবজি নিয়ে ফেরিওয়ালা উচ্চস্বরে কাস্টমার ডাকছে। পাঁচ কেজি আলু ১০০ টাকা,  টমেটোর কেজি বিশ টাকা। পিয়াঁজ বিশ টাকা কেজি। এখন শীতের মৌশুম। প্রচুর ফলন সবজির। শীত শেষে সবজির বাজার কেমন হবে তা দেখার বিষয়। বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে জনমনে সরকারের প্রতি অনাস্থা সৃষ্টি হবে সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। আর রাজনীতি ৭১ বনাম ২৪ নতুন নতুন পট পরিবর্তনের ইশারা দিচ্ছে কি!

ফেব্রুয়ারী ০২-২০২৫

(ছয়)

একজন ব্যাংক ম্যনেজারের গল্প

বাংলাদেশ বিমানে টরন্টো থেকে এক টানা (ডিরেক্ট) ১৮ ঘন্টা জার্নি শেষে শুক্রবার (জানুয়ারী ১০/২৫) রাত একটায় বাড়ী (ঢাকা) পৌঁছালাম। রাতে সারপ্রাইজিংলি ঘুম হল মুটামুটি ভালই। গতবার (২০২৩) ঢাকায় গিয়ে প্রথম কয়েকদিন ঘুম হয়নি। তাই একটু টেনশনে ছিলাম ঘুম নিয়ে। তবে এবার ছিল ব্যতিক্রম। বড় দুই বোন এবং বড় ভাবীর (তমালের মা) সাথে গালগল্পে দিন কাটালাম শনিবার। পরদিন রবিবার সকালে ব্যাংকে গেলাম। আজই ব্যাংককে এক নতুন ম্যানেজার জয়েন করেছে। সেকেন্ড অফিসার বললেন স্যার আজ আমাদের নতুন ম্যানেজারের সাথে পরিচিত হয়ে যান। আজ আমরা একটু বেশি ব্যস্ত থাকবো। ম্যানেজার সাহেব আমাদের সবার সাথে পরিচিত হবেন। আমাদের সবার কাজকর্ম বুঝে নেবেন। আপনি দয়াকরে কাল সকালে আসেন। আপনার ফাইল সবটা রেডি করা আছে। আশাকরি আপনার কাজটা দ্রুত হয়ে যাবে। আমি থাকতে-থাকতে আপনার কাজটা শেষ করে দিয়ে যেতে পারব ইনশা আল্লাহ -সেকেন্ড অফিসারের বদলি হবার অর্ডার হয়ে গেছে।

এবার গতবছরের (২০২৩) পারিবারিক (বড় ভাই প্রয়াত জাকির হোসেন খান মিলনের সম্পত্তি ও ব্যাংক ব্যালেন্স ওয়ারিশ সূত্রে পাওয়া) অসমাপ্ত কাজটি সম্পন্ন করতে ঢাকা এলাম তিন সপ্তাহের জন্যে। ব্যাংকের কাজটি সময়মত হবে কিনা সেটা নিয়ে আমি যথেষ্ট সন্দিহান এবং ভীষণ টেনসনে ছিলাম কারণ বাংলাদেশে কাজকর্ম খুব সহজে হয়না। আমরা প্রবাসীরা হাতে গোনা সময় নিয়ে দেশে যাই। আমাদের সময়ের সাথে দেশের মানুষ চলেনা। তারা তাদের সময় মত চলে। সেই উদ্বেগ মাথায় নিয়ে রাতে খুব ভাল ঘুম হয়নি।

পরদিন সোমবার সকাল দশটার দিকে গেলাম ব্যাংকে। সেকেন্ড অফিসার মুনিরুজ্জামান সাহেব আমার ফাইলটা সাথে নিয়ে ম্যনেজারের রুমে এসে আমাকে তাঁর সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বললেন, মোয়াজ্জেম ভাই এ পাড়ার একজন বিশিষ্টজন। তাঁদের বাড়ীর সকলে ব্যংকিং কাজ আমাদের ব্রাঞ্চেই (পিলখানা-আজিমপুর) করেন। পরিবারের সকল সদস্যদের একাউন্ট আমাদের ব্রাঞ্চে। তারা সকলেই আমাদের চেনা -জানা। মোয়াজ্জেম ভাইয়ের রিলিজ অর্ডারটা এসেছিল গত বছর ওনি চলে যাবার এক সপ্তাহ পর। গতবার কাজটি করার জন্য তিনি টিকেট ক্যান্সেল করে আরো এক মাস ওভারস্টে করেছিলেন। তারপরও কাজটি শেষ করে যেতে পারেননি। সে কারণে উনার ওখানে- এখানে ফাইনান্সিয়ালি ভীষণ ক্ষতি হয়ে গেছে। ম্যানেজার সাহেব আমার ফাইল দেখে বললেন আদালতের সাক্সেসন সার্টিফিকেট অনুযায়ী বোনদের নিয়ে আসেন। সবার একাউন্টে নির্ধারিত অংকের টাকা ট্রান্সফার করে দেওয়া হবে। আমি বললাম আমিতো কোর্টের নির্দেশ অনুযায়ী ‘আম মোক্তার’ নিযুক্ত হয়েছি। আমার একাউন্টে পুরো এমাউন্টটা ট্রান্সফার করে দিন। আমি সেভাবেই একটা এপ্লিকেশন করে রেখেছিলাম। তিনি বললেন না, আপনি বোনদের নিয়ে আসেন আমি আজই সবার একাউন্টে টাকা ট্রান্সফার করে দিচ্ছি। আমি দুই বোনকে নিয়ে ব্যাংকে চলে গেলাম দুপুর দুইটায়। ম্যানেজার সাহেব টানা সাড়ে চারঘন্টা সময় লাগিয়ে ব্যাংকের প্রায় সকল কর্মচারীদের সাথে নিয়ে আমার কাজটি সম্পন্ন করে দিলেন তখন সন্ধ্যে সাড়ে ছয়টা বেজে গিয়েছে। যদিও ব্যংকের কর্ম দিবসের সময়সূচি অনুযায়ী ব্যংক বন্ধ হয়ে যায় বেলা চারটায়।

কনিষ্ঠ ভ্রাতা নাদির এবার আমাদের সাথে উপস্থিত না থাকায় এবং তার কোন একাউন্ট এই পিলখানা ব্রাঞ্চে না থাকায় তিনি তার জন্য পেঅর্ডার কাজটি আগামীকালের জন্য ফাইল পত্র গুছিয়ে রাখলেন। সেই সাথে নাদিরের পেঅর্ডারটি তৈরী করার জন্য এপ্লিকেশন ড্রাফটি পর্যন্ত লিখে তৈরী করে দিলেন আমাকে।

আমি অবাক বিস্ময়ে এই নতুন তরুণ ম্যনেজারের কর্মদক্ষতা, কর্মক্ষমতা, নিপুণতা, দায়ীত্বজ্ঞান দেখে সত্যই বিমোহিত হয়ে পরেছিলাম। আমি তার কাজের প্রতি দায়িত্ব¡বোধ নিষ্ঠাজ্ঞান দেখে যারপর নেই বিস্মিত হয়েছি। তার কর্মজ্ঞান কর্ম নিপুণতা ব্যংকের দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞ কর্মচারীদের চেয়ে ঢেড় বেশী তা দেখে আমি সত্যই সত্যই মুগ্ধ হয়েছি। বাংলাদেশে এমন সৎ শিক্ষিত দায়িত্ব¡শীল স্মার্ট তরুণ প্রজন্ম বাংলাদেশকে অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে যাবে বলে আমার দৃঢ় বিশ^াস। আমি এই তরুণ ম্যনেজার আবদুল্লা হাসানের আগামী দিনের দায়ীত্বশীল ভবিষ্যত পথ, চেলেঞ্জিং কেরিয়ার, উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হউক সেই কামনা করছি এবং তার যাত্রাপথের সাথে বেঁধে দিলাম প্রিয় জন্মভূমি সোনার বাংলার লাল সবুজের পতাকা।

জানুয়ারী ১৫-২০২৫

(সাত)

সুদীর্ঘ হাজার হাজার মাইল আকাশপথ অতিক্রম করে জন্ম শহর ঢাকায় এসে পৌঁছালে এক অনাবিল অনবদ্য আনন্দধারা হৃদয়তন্ত্রীতে এসে ঝংকার তুলে।

শাহজালাল বিমান বন্দরে বিমান অবতরণ করার পর কখন যে প্লেন থেকে নামব সেই সময়টুকু যেন আর পার হয় না। বিমান বন্দর থেকে বের হয়ে ঢাকার রাস্তায় নামলে ব্যস্ত শহরের অবিরাম কোলাহল প্রচন্ড জানজট গাড়ীর অকারণে হর্ন বাজানো সবকিছুতেই কেমন যেন এক অদ্ভূত ভালবাসার গন্ধ পাই।

প্রথম দিন পাড়ায় রাস্তায় নামলে এক অনাবিল আনন্দে মনটা ভরে যায়। এক অদ্ভূত শিহরন খেলা করে মনের গভীরে পাটাতনে। ফেলে আসা শৈশব কৈশোরের স্মৃতিগুলো বাঁধভাঙ্গা জোয়ারের মতন ভাসিয়ে নিয়ে যায়। ইরাকি মাঠের উপর দিয়ে হাটলে কে যেন কানে -কানে বলে যায় এই সেই তোমাদের ছোট্টবেলার ইরাকি মাঠ যেখানে খেলতে -খেলতে বড় হয়েছ। সকাল বিকাল সন্ধ্যায় যেখানে ছিল বন্ধুদের আনন্দ উচ্ছাস কোলাহলের ঝর্ণাধারা। বৃষ্টিভেজা মাঠে ফুটবল খেলার কি অনাবিল আনন্দ। শীতের সকালে মাঠে ক্রিকেট খেলার যারপর নেই আনন্দ। ঐড়ি রং ঃযধঃ বলে উচ্চস্বরে চিৎকার। টি ব্রেক। সন্ধ্যায় ফ্লাড লাইট জ্বালিয়ে বেডমিন্টন খেলা। এখন পাড়ায় শতশত নতুন মুখ- প্রায় সকলেই অচেনা। (ভাড়াটে বা নতুন ফ্লাট মালিক) কিন্তু আজ মাঠে যারা খেলছে তাদের কাউকেই তুমি চিনতে পারনা।

রাস্তায় নামলে গলীর মুখেই শুনি বাংলা ভাষায় কোলাহল- কথোপকথন। অপেক্ষমান রিকশা চালকদের বিভিন্ন আঞ্চলিক ভাষা (দিনাজপুর, রংপুর, ময়মনসিংহ, বরিশাল) আর ঢাকাইয়া ভাষার রসের ভান্ডারতো আছেই। ছোট্ট দোকানি সেলিম চা সিগারেট বিক্রি করছে। ভ্যানের উপর সাজিয়ে রাখা ডাব বিক্রি চলছে। ইরাকী মাঠে সকালে বাজার। মাছ মাংস মুরগী শাক সবজি সবই পওয়া যায় এই বাজারে। নিউমার্কেট বা নবাবগঞ্জ যেতে হয় না। তবে বড় আয়োজনের বাজার করতে হলে পাড়ার মাঠের বাজারে চলে না। যেতে হয় নিউমার্কেটে অথবা নবাবগঞ্জ বাজারে। সন্ধ্যায় ইরাকী মাঠে বসে বিভিন্ন দোকানে রকমারি খাবারের পসরা। চিকেন বার্গার, বিফ বার্গার, ডাল পুরি, সুপ নুডুলস, চাইনিজ ফ্রাইড রাইস, চটপটি, মম মুড়ি, চানাচুর, শিক-কাবাব। মহিলারা বিক্রি করছে শীতের গরম গরম পিঠা আরো কত কি! পাড়ার ইরাকি মাঠের দুই পাশে দুই ক্লাব। উত্তরণ যুব সংসদ আর যুব সংসদ। আমরা উত্তরণ ক্লাবের আদি সদস্য। সন্ধ্যায় প্রায়ই আড্ডা জমে দুই ক্লাবে। উত্তর পাড়ার যুব সংসদ ক্লাবের সাথেই চায়ের দোকান। এক পাশে এক মহিলা পানও বিক্রি করছে। সকাল বিকাল চলে জমজমাট আড্ডা আনন্দ রাজনৈতিক- অরাজনৈতিক কোলাহল।

ঢাকার রাস্তায় ট্রাফিক জ্যাম নিত্যদিনের ঘটনা। ঘন্টার পর ঘন্টা পথে বসে থকতে হয়। গত বছর মেট্রো রেলভ্রমনের অনবদ্য সুখকর অভিজ্ঞতা হয়েছে। আমাদের টরন্টোর মেট্রোর চেয়ে অনেক উন্নত এবং নিরাপদ ঢাকার মেট্রোরেল। অত্যন্ত সুলভমূল্যে পরিবহন ভাড়া। ঢাকা ইউনিভার্সিটি থেকে মীরপুর মাত্র ৭০ টাকা।

ঢাকার রাস্তায় রিক্সা চালক। ছবি : লেখক

ঢাকায় এলে আমি মাঝে -মাঝে ধূমপান করি। এক সন্ধ্যায় পাড়ায় রাস্তায় দাড়িয়ে সিগারেট টানছিলাম। দেখলাম একটি রিকশা এসে থেমেছে। রিকশাওয়ালা আর যাত্রীর সাথে শুরু হয়েছে বচসা ভাড়া নিয়ে। মহিলা ভাড়া দিচ্ছে ১২০ টাকা রিকশাওয়ালা নেবে না। বলল আমাকে ১৫০ টাকা দিবেন কারণ যেখানে নামার কথা ছিল আপনি সেখানে নামেন নি। মহিলা কোনভাবেই ১৫০ টাকা দেবে না। দুজনের খুব উচ্চস্বরে ঝগড়া চলল প্রায় মিনিট পাঁচ। একসময় মহিলা পাশের দোকান থেকে টাকা ভাংগিয়ে ১২০ টাকা দিয়ে রিকশাওয়ালাকে শাসাতে -শাসাতে বাড়ীতে ঢুকে গেল। রিকশাওয়ালা রাগে গজ -গজ করতে করতে রিকশা ঘুরিয়ে চলে যাচ্ছিল। আমি তাকে জিজ্ঞাস করলাম ভাই কোথা থেকে যাত্রী নিয়ে এসেছিলেন। সে বলল ভাই সুত্রাপুর। বুঝলাম সুত্রাপুর থেকে নিউপল্টন ১২০ টাকা ভাড়া সত্যই কম। মহিলা তাকে সত্যই কম ভাড়া দিয়েছে। ১৫০ টাকা ভাড়াও কম হয়ে যায় বলে আমার ধারনা। আমি রিকশাওয়ালাকে তিরিশ টাকা হাতে গুজে দিয়ে বললাম নাও এটা তোমার চা খরচ। সে বলল না ভাই আপনি দেবেন কেন। আমি আপনার টাকা নেব না। আমি বললাম ভাই আমাদের পাড়ায় এসে তুমি তোমার ন্যয্য ভাড়াটি পাওনি এটা আমাদের লজ্জার কথা। তুমি গিয়ে এক কাপ চা খাও ভাই। শান্ত হও। রিকশাওয়ালা চলে গেল। আমি মনে মনে ভাবলাম যেই মহিলাটি রিকশাওয়ালাকে ৩০ টাকা বেশি কোনভাবেই দিল না। এত ঝগড়া কথা কাটাকাটি হল কিছুতেই দিল না। ধারনা করি এই বাড়তি তিরিশ টাকাটাও ছিল তার জন্য জন্য অতিরিক্ত একটি চাপ। এই তিরিশ টাকায় মাসিক বাজারের একদিন সবজি কেনা হয়ে যায়। যাদের নির্ধারিত টাকায় মাস চালাতে হয় তাদের দিনকাল যাপিত জীবনের খোঁজ খবর আমরা কতটাই জানি!

জানুয়ারী ১৫, ২০২৫

(আট)

গত কয়েক বছর ধরে দেশে যেতে হয়েছে কিছু ব্যক্তিগত এবং পারিবারিক কাজের জন্য। গতবার (জানুয়ারী- ফেব্রুয়ারী) ২০২৪ সালে গিয়েছিলাম আমি এবং অনুজ নাদির এক মাসের জন্য এবং পরে আমি আরো এক মাস বেশি থাকলাম টিকেটের সময় বাড়িয়ে ৫০,০০০ টাকা গচ্ছা দিয়ে। কিন্তু যে কাজের জন্য থাকতে হল -কোর্ট কাচারী – ব্যংক- সেগুলো শেষ করে আসতে পারিনি। মানে আমার নির্ধারিত সময় (দুই মাস) মত ব্যংকের কাজ সমাধান করার আর সম্ভবনা ছিল না। আইনজীবী এবং ব্যংকের কিছু অভিজ্ঞতার কথা এখানে বন্ধুদের সাথে ভাগ করতে চাই।

আমার প্রয়াত বড় ভাইয়ের কিছু সম্পত্তি এবং ব্যাংকে গচ্ছিত টাকা আমরা ভাই বোন উত্তারাধিকার (ওয়ারিশ) সূত্রে পেয়েছিলাম। বাংলাদেশের আইনের বিধান অনুযায়ী সে কারণে কোর্ট থেকে আমাদের একটা সাক্সেসন সার্টিফিকেট নিতে হয়। সেটা নেবার জন্য আমরা আইনজীবী নিয়োগ করেছিলাম। আইনজীবী  সাহেব আমাদের দেশে থাকার সময় সল্পতার সুযোগ নিয়ে প্রতি মিটিংয়ে -মিটিংয়ে দফায়- দফায় টাকার অংক বাড়িয়ে নিচ্ছিল। আমরা দেড় মাস পর কোর্টের সাক্সেসন সার্টিফিকেট হাতে পেয়ে সেটা নিয়ে ব্যংকে জমা দিলাম । ব্যংকের নিয়ম- নির্দেশ অনুযায়ী আমাদের পক্ষ থেকে সমস্ত ডকুমেন্ট (ডেথ সার্টিফিকেট -হাসপাতালের সার্টিফিকেট -কবরস্থানের সার্টিফিকেট) ব্যংকে আগেই জমা দেওয়া হয়েছিল কিন্তু বাঁধ সাধল ভাইয়ের ডেথ সার্টিফিকেটে একটি তথ্য নিয়ে। আমার ভাই যেহেতু অবিবাহিত এবং নি:সন্তান ছিলেন সে কারণে তার কোন স্পাউস (স্ত্রী) ছিল না।

ঘটনাটি হল সার্টিফিকেটে স্পাউসের জায়গায় আমার বড় ভাবীর নাম দেওয়া হয়েছে। সেটা ম্যনেজারের নজরে আসায় আমাকে ফোন দিয়ে ডেকে নিয়ে গেলেন এবং জিজ্ঞাস করলেন আপনার ভাই অববাহিত ছিলেন কিন্তু এই (স্পাউসের) জায়গায় এই নাম কেন (বড় ভবীর নাম) সার্টিফিকেটে ভাবীর নাম রয়েছে এটা আমাদের কারো নজরে আসেনি কখনও। আমরাওতো এতে বেশ অবাক। ভাবী বললেন আমি সার্টিফিকেটের জন্য আবেদন করেছি, কারণ ডলির (ছোট বোন) লেটেস্ট বার্থ সার্টিফিকেট করা ছিল না। ইরৎঃয সার্টিফিকেক না থাকলে আবেদন করা যাবে না। আমার নামতো আবেদনকারী (অঢ়ঢ়ষরপধহঃ) হিসেবে থাকার কথা। ম্যনেজার বললেন এটা ঠিক না করলে আপনাদের টাকা দেওয়া যাবে না, হেড অফিস ক্লিয়ারেন্স দেবে না। এটা আমার ফ্লাই করার কয়েকদিন আগের ঘটনা। পরের দিন ভাবীকে নিয়ে গেলাম মিউনিসিপাল অফিসে যেখান থেকে এই সার্টিফিকেট করা হয়েছিল। তারা বলল কি কারণে এটা হয়েছে তারা বলতে পারবে না। এটা শুধুমাত্র উঈ অফিস কারেকশন বা চেঞ্জ করতে পারবে। এই সফটওয়ারে একমাত্র তাঁর অফিস এক্সেস আছে। আরো বলল ডেথ সার্টিফিকেটে কোন কারেকসন হয় না। এদিকে আমার টিকিটের দ্বিতীয়বারের বাড়ানো সময়ও শেষ হয়ে এসেছে। ডিসি আফিসে যেয়ে এই অল্প সময়ে কজটা কতদূর হবে সেটা নিয়ে যথেষ্ট সন্দিহান ছিলাম। কারণ বাংলাদেশে সোজাসুজি বা স্পিডমানি ছাড়া কোন কাজ যে হয়না সে অভিজ্ঞতা আমার ইতিমধ্যেই হয়ে গেছে।

সার্টিফিকেটের এই কাজের দায়িত্ব ভাতিজা তমালকে (প্রয়াত শাহাজাদা ভাইয়ের ছেলে) দিয়ে টরন্টো ফিরে এলাম। তমাল বলল চাচা আপনি টেনশন করবেন না। আমি ব্যাপারটা সমাধান করছি। এখনতো সময় নিয়ে কোন সমস্যা থাকবে না। মাস খানিক পর তমাল মিউনিসাপাল অফিসে উর্ধ্বতন এক কর্মকর্তার সাথে দেখা করে ব্যংক ম্যনেজারের স্পাউসের জায়গায় নাম থাকার আপত্তি-অবজেকসনের ব্যপারটা জানাল। তিনি বললেন এই ফরমে স্পাউসের স্থান খালী রাখার কোন নিয়ম নেই। সেকারণে যিনি ডেথ সার্টিফিকেটের জন্য আবেদন করেছেন তার নামটা স্পাউসের জায়গায় বসিয়ে দেওয়া হয়েছে। এটা কোন ভুল নয় বা কোন সমস্যা নয়। এটা স্বাভাবিক। ঘড় সরংঃধশব. তমাল সেই কর্মকর্তাকে ব্যংকের ম্যনেজারের সাথে ফোনে কথা বলিয়ে তার

সত্যতা প্রমাণ করিয়ে নিল। সে কথা তমাল আমাকে ফোন করে জানিয়েছিল।

আমি ব্যংকের এক কর্মকর্তার (যিনি আমাদের ফাইলটি দেখেশুনা করছিলেন) সাথে ফোনে কথা হলে, তিনি জানালেন আপনি আসলে খুব সল্প সময়ের মধ্যে আপনাদের টাকা ট্রান্সফার করে দেওয়া হবে। এখন আর কোন সমস্যা নাই। আমি বললাম ভাই আমিতো এখন আসতে পারবো না, আমারতো দেশে আসতে আসতে ডিসেম্বর- জানুয়ারীর আগে হবে না। তিনি বললেন আপনি আসেন আপনার সময় সুযোগ মতন। আমার আবার বাংলাদেশে যেতে হবে এর প্রধান কারণ কোর্টের কাগজ অনুযায়ী আমি এই কাজের জন্য ‘আম মোক্তার’ হিসেবে নিযুক্ত হয়েছি। আমি ছাড়া এই কাজটি সম্পন্ন হবে না।

ব্যংকের ম্যানেজারের সামান্য কিন্তু ভয়নক অজ্ঞতার কারণে আমার বাড়তি একমাস সময় বাংলাদেশে থাকা এবং টিকেট এক্সটেনসন করাতে গিয়ে প্রায় সাড়ে পাঁচলক্ষ টাকার দণ্ডি দিতে হল। এতে অজ্ঞ দায়ীত্বহীন ব্যংক ম্যানেজারের কিইবা আসে যায়। এবার আবারও কয়েক লক্ষ টাকা খরচ করে দেশে গিয়ে কাজটা শেষ করতে হল। এতে (ব্যাংকের) কার কি আসে যায়। বাংলাদেশ বিমানের টরন্টো -ঢাকা (নন স্টপ) বিমান ভ্রমনের দীর্ঘ ২২ ঘন্টার ভয়ানক বিরক্তকর -ক্লান্তিকর অভিজ্ঞতার কথা আর নাই বা বললাম।

২৮ শে ফেব্রুয়ারী,২০২৫

(নয়)

আজ সকালে ব্যাংকের কিছু জরুরী কাজ সেরে বাসায় ফেরার পথে ছোটবেলার বন্ধু আরিফের সাথে দেখা করতে গেলাম। ওদের বাড়ী গিয়ে আরিফ কোন ফ্লাটে থাকে সেটা মনে করতে পারছিলাম না। নীচের ফ্লাটে দড়জায় নক করলাম। একজন বললো বাড়ীওয়ালা দোতালায় থাকেন। আরিফের সাথে গত বছর আজিমপুর মোড়ে রাস্তায় দেখা হয়েছিল। আমি খুব ব্যস্ত ছিলাম সে কারণে বেশিক্ষণ কথা বলতে পারিনি। দেখেছিলাম খুব অসুস্থ এবং বেশ ক্লান্ত। আরিফের শরীর তেমন ভাল নেই। ওপেন হার্ট সার্জারী হয়েছে কয়েক মাস আগে। কিন্তু মনের খুব জোর। দেশের বিভিন্ন হাসপাতালের রোগী বাণিজ্যের গল্প করল। হাসপাতালের দালাল চক্রের গল্প হল। দালালচক্র কিভাবে নিরীহ রোগীদের অজ্ঞতার সুযোগ কাজে লাগিয়ে অত্যন্ত নিম্ন মানের ক্লিনিক বা হাসপাতালে রোগীদের ভর্তি করিয়ে অর্থ কামিয়ে নিচ্ছে। আনপ্রফেসনাল (প্রাইভেট কলেজের) ডাক্তারের হাতে পরে কত প্রাণ ঝরে পরছে এবং ভুল চিকিৎসার কারণে কেউ- কেউ চিরতরে পঙ্গু হয়ে যাচ্ছে। তবে আমার বন্ধুর জন্য সুখবর যে তার সার্জারীটা সফল হয়েছে এবং প্রাইজ ওয়াজ রাইট। বহুবছর পর অনেক্ষণ গল্প হল বাল্যবন্ধুর সঙ্গে।

আমাদের ছোটবেলার অত্যন্ত ঘনিষ্ট প্রাণপ্রিয় বন্ধু নাসিম।

কয়েক বছর আগে চলে গেল আমাদের ছেড়ে খুব অসময়ে। আরিফের সাথে নাসিমের ছিল এক ভিন্ন আঙ্গিকের সম্পর্ক। অতি গভীর বন্ধুত্বের সম্পর্ক ছিল আরিফ আর নাসিমের। আমাদের হারিয়ে যাওয়া দিনগুলো গল্প হল। বিভিন্ন সুবিধা অসুবিধায় দুজন ছিল অকৃত্তিম বন্ধু। নাসিমের চাকুরী ব্যবসা সংসার, করোনায় তার স্ত্রীর চলে যাওয়া, বড় ছেলের মার মৃত্যুর সময় না আসা ইত্যাদি নিয়ে অনেক্ষণ আমরা অতীত রোমান্থন করলাম।

আজ নাসিমের পরিবারের আর কেউ বেঁচে নেই। মসজিদের নীচে সেই বাড়ীটায় এসে নাসিম -নাসিম বললে চিৎকার করলে আর কেউ বারান্দায় এসে বলবেনা আয় উপরে চলে আয় দোস্ত।

পাড়ার আরেক ছোট্টবেলার বন্ধু জামাল। এখন আর পাড়ায় থাকে না। বেশ কিছু বছর আগে ওর সাথে ফেসবুকে যোগাযোগ হয়। সেই থেকে মাঝেমধ্যেই আমাদের মেসেঞ্জারে কথা হয়। মেসেঞ্জারে কল পেলাম জামালের। কিছুক্ষণ এই কথা সেইকথা বলার পর সে বলল ওর মেয়ের একটা সমন্ধ এসেছে কানাডা থেকে এই নিয়ে কথা হচ্ছিল। আমি বললাম আমি ঢাকায়। সে জানতে চাইল কবে এসেছি। বললাম এক সপ্তাহ হল। আরও বললাম চলে আয়। তোর সাথে দেখা নাই তিরিশ বছর। আজ বিকালে ফ্রি। কিন্তু সন্ধ্যায় প্রোগ্রাম আছে। বিকালে চলে এল বন্ধু। আমরা পাড়ার রেস্তোরায় চা- পুরী খেলাম। ওর কাছ থেকে পলাশির বন্ধুদের খোঁজ খবর নিলাম। শুনে খুব খারাপ লাগল তারা কেউ ভাল নেই। মিন্টা -ব্রাইট -খয়রাত। সেই ছোটবেলার মতন দুই বন্ধু হাতে -হাত ধরে হাটাহাটি করলাম পড়ায় এদিক সেদিক। ছবি তুললাম দুই বন্ধু। হাটতে -হাটতে আমরা ফিরে গিয়েছিলাম আমাদের ছেলেবেলায়। নতুন পল্টন পাড়ায় বিভিন্ন অলি গলিতে আমাদের হাজারো কিশোর পায়ের ছাঁপের গল্প। ইরাকি মাঠের আনন্দ উচ্ছাসের খল -খল হাসির ঝর্ণার গল্প। পশ্চিমের আকাশে এক জীবনের হারিয়ে যাওয়ার স্বর্ণালী গল্পের লাল নীল কথোপকথন।

জানুয়ারী ১৭-২০২৫

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *