এদেশের দাসপ্রথার ইতিহাস সম্পর্কে কানাডীয়দের অনেক কিছু জানার আছে
ইয়ারমাউথের কাউন্টি মিউজিয়ামের কৃষ্ণাঙ্গ ইতিহাস কক্ষে গবেষণার সময় শ্যারন রবার্ট-জনসন কৃষ্ণাঙ্গ শিক্ষাবিদদের বিভিন্ন চিত্রকর্ম, নোভা স্কশিয়ার প্রথম যে ব্যক্তি রয়েল কানাডিয়ান মাউন্টেড পুলিশে (RCMP) যোগ দেন তার কথা এবং এমনকি তার নিজেরও একটি শিল্পকর্ম তুলে ধরেন। শ্যারন রবার্ট-জনসনই প্রথম ব্যক্তি যিনি ওই অঞ্চলের কৃষ্ণাঙ্গ জনগণকে নিয়ে বই লিখেছেন।
তবে তিনি তার সবচেয়ে প্রিয় একটি শিল্পকর্মটি সংরক্ষণ করে রাখেন।
সেটি হলো জ্যুড নামের এক ক্রীতদাসী নারীকে তার মালিকের ছেলের প্রহার করার কাঠখোঁদাই চিত্র।
আদালতের নথিপত্রে দেখা যায়, প্রহারের কারণে মারাত্মক আহত জ্যুড ১৮০০ সালের ২৮ ডিসেম্বর মারা যায়। তার বয়স তখন ছিলো ২৮ বছর।
নভো স্কশিয়ার দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত ওই মিউজিয়ামে সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে রবার্ট-জনসন বলেন, “মারা যাবার আগের রাতে জ্যুড ভাঁড়ার ঘরে ঢুকেছিল, এই কাজটি সে প্রায়ই করতো, কারণ তাকে খেতে দেয়া হতো না।” “সে দুয়েক টুকরো রুটি এবং খানিকটা পনির চুরি করার চেষ্টা করেছিলো।”
ওই মালিককে হত্যার দায়ে অভিযুক্ত করা হয় তবে পরে বিচারে খালাস দেয়া হয়।
রবার্ট-জনসন বলেন, “যখন জানতে পারি যে, খালাস পেয়েই তারা পালিয়ে যায় তখন আমার অত্যন্ত রাগ হয়, এমনকি এখনও আমি আরও বেশি ক্রুদ্ধ। তারা খুন করেও আক্ষরিক অর্থেই পালিয়ে যায়।” তার প্রথম বই আফ্রিকার শিশু: নোভা স্কশিয়ার ইয়ারমাউথে কৃষ্ণাঙ্গদের ইতিহাসে (Africa’s Children: A History of Blacks in Yarmouth, Nova Scotia) জ্যুডকে নিয়ে একটি পরিচ্ছেদ রয়েছে।
ওই তরুণীকে কেন্দ্র করে বর্বর এই দৃষ্টান্তটি এদেশের লজ্জাকর দাসপ্রথার ইতিহাসের অগণিত উদাহরণের একটিমাত্র। বিশেষজ্ঞরা বলেন, ওই ইতিহাস বেশিরভাগ কানাডীয় খুব সামান্যই জানে।
তারা আশা করেন যে, এ বছর থেকে এক্ষেত্রে পরিবর্তনের সূচনা হবে।
দাসমুক্তি দিবস হলো ১৮৩৪ সালের পহেলা আগস্টের স্বীকৃতি। তখন ব্রিটিশ সামাজ্য তার উপনিবেশগুলোতে প্রায় আট লাখ আফ্রিকান বংশোদ্ভূত মানুষকে মুক্ত করে দিয়ে দাসপ্রথা বিলুপ্ত করে। বর্তমানে যেটি কানাডা নামে পরিচিত সেটিও তখন ব্রিটিশ উপনিবেশ।
তখন থেকে আজকের দিন পর্যন্ত অন্টারিও ছিলো একমাত্র প্রদেশ যেটি দাসমুক্তি দিবস পালন করে এসেছে। তবে চলতি বছর সারা দেশে দিবসটি পালনের পক্ষে ভোট দেন পার্লামেন্ট সদস্যরা। নোভা স্কশিয়াতেও প্রথমবারের মত প্রদেশজুড়ে দিবসটি পালিত হয়।
রবার্ট-জনসন বলেন, জ্যুডের কাহিনী জেনে তিনি নিদারুণ মর্মপীড়ায় ভুগতে শুরু করেন। তিনি জ্যুডি ও ডায়ানা নামে দ্বিতীয় বই প্রকাশ করেন যেটি একটি ঐতিহাসিক কথাসাহিত্য। এতে জ্যুডি ও তার বোনের জীবনচিত্র বিবৃত করা হয়েছে।
নথিপত্রে দেখা যায়, জ্যুডকে নিউ জার্সি থেকে নোভা স্কশিয়ায় নিয়ে আসেন তার মালিক ফ্রান্সিস উড। এসময় তার বয়স ছিলো নয় বছর। পরে তাকে ব্রিটিশ উপনিবেশের অনুগত নেতা (Loyalist leader) মেজর স্যামুয়েল এন্ড্রুজ-এর কাছে বিক্রি করা হয়, যিনি নর্থ ক্যারোলাইনা থেকে ১৭৮৫ সালে নভো স্কশিয়ায় আসেন।
রবার্ট-জনসন বলেন, “আমার জানা ছিলো না যে, ইয়ারমাউথের লোকেরা দাসদাসী রাখতো, তাই আমার জন্য এটি ছিলো চোখ খুলে দেওয়ার একটি বিরাট ঘটনা।” ২৮ বছর আগে নিজের বংশলতিকা নিয়ে গবেষণা করার সময় জ্যুড সম্পর্কিত নথিপত্রগুলো গভীর মনোনিবেশের সঙ্গে পাঠ করেন এই মিজ. রবার্ট-জনসন।

আর্কাইভ থেকে
নোভা স্কশিয়ার মহাফেজখানার (আর্কাইভ) রেকর্ডে রয়েছে পালিয়ে যাওয়া দাসদাসীদের ফিরে পাবার জন্য পত্রিকায় দেওয়া বিজ্ঞাপন, দাসদাসী বেচাকেনার দর, আদালতের নথি যার সবকিছুই এই প্রদেশের দাসপ্রথার ইতিহাসের চিত্র তুলে ধরে।
১৮০০ সালের একটি পত্রিকার ক্লিপিংয়ে লেখা হয়, “এক বছরের জন্য বিক্রি হবে।” “বয়স ১৮ বছর, স্বভাব-চরিত্র ভালো, শিশুদের প্রতি অনুরক্ত এবং শহরের ও গ্রামীণ উভয় ধরণের কাজ করতে অভ্যস্ত।”
১৭৫০ সালে হ্যালিফ্যাক্স-এর মোট ৩০০০ অধিবাসীর মালিকানায় প্রায় ৪০০ দাসদাসী ছিলো।
ব্যবস্থাপক এবং মহাফেজখানার সংরক্ষক জন ম্যাকলেয়ড বলেন, নোভা স্কশিয়ার বিশেষ করে দুজন প্রধান বিচারপতি, স্যামসন সাল্টার ব্লোয়ার্স (Sampson Salter Blowers) এবং টমাস এন্ড্রু লুমিসডেন স্ট্রাঞ্জ (Thomas Andrew Lumisden Strange) দাসদাসীর মালিকানা অব্যাহত থাকার প্রেক্ষাপটে ১৮০০ সালের শুরুর দিকে তাদের কাছে আসা মামলাগুলোতে দাসদাসীদের স্বাধীনতার পক্ষে রায় দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন বলেই দৃশ্যত মনে হয়। কিছু ঐতিহাসিক এমনকি ওই দুই বিচারপতিকে দাসপ্রথা বিলুপ্তকরণবাদী (abolitionists) বলে আখ্যা দেওয়ারও প্রয়াস পান।
ম্যাকলেয়ড বলেন, এটি সম্ভব ছিলো কারণ, দাসপ্রথা জোরদার করার মত কোনও আইনগত কাঠামো ছিলো না।
তিনি বলেন, “তবে, আইনসভা এই প্রথা নিষিদ্ধ করারও কোনও পদক্ষেপ নেয়নি।”
এ প্রসঙ্গে তিনি জনগণের সমর্থন নিয়ে পেশ করা একটি দরখাস্তের কথা উল্লেখ করেন। এতে দেখা যায়, ১৮০৭ সালে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য দাস মালিকদের একটি দলকে, যাদের বেশিরভাগ ছিলেন ব্রিটিশের অনুগত, তাদের ‘সম্পত্তি’ অর্থাৎ দাসদাসীদের সঙ্গে করে নিয়ে আসতে পারবে বলে নিশ্চয়তা দান করে। আদালতের সিদ্ধান্ত পুরোপুরি উপেক্ষা করেই এই নিশ্চয়তা দেয়া হয়। ওইসব দাস মালিক তাদের মালিকানাধীন দাসদাসীর সংখ্যা উল্লেখ করে ওই দরখাস্তে নাম স্বাক্ষর করেন।
ম্যাকলয়েড বলেন, “নোভা স্কশিয়ার দাস মালিকরা বুঝতে পারছিলেন যে, আদালতের মাধ্যমে তাদের অবস্থায় ক্রমবর্ধমান হারে ভাঙ্গন ধরছে। “সেজন্যে তারা যেটিকে তাদের সম্পত্তির অধিকার হিসাবে দেখতেন সেই দাসপ্রথা অব্যাহতভাবে চালিয়ে যাবার জন্য আইনসভার কাছে দরখাস্ত দিয়েছিলেন যেন এ বিষয়ে এমন একটি আইন প্রণয়ন করা হয় যাতে দাসপ্রথার বৈধতাদান কিংবা সেটিকে একটি আইনী কাঠামোর মধ্যে আনা হবে।”
এ ধরণের একটি প্রস্তাবিত আইন পার্লামেন্টে বেশ কয়েকবার উপস্থাপনও করা হয়, তবে তা কখনই পাস করা হয়নি।

কানাডার দাসপ্রথা নিয়ে পঠনপাঠনের লক্ষ্যে নবগঠিত ইন্সটিটিউট
মিজ. শার্মেইন নেলসন হলেন হ্যালিফ্যাক্সে অবস্থিত নোভা স্কশিয়া আর্ট অ্যান্ড ডিজাইন কলেজের শিল্পের ইতিহাস বিষয়ের অধ্যাপক। তিনি কানাডার দাসপ্রথা নিয়ে পঠনপাঠনের উদ্দেশ্যে নবগঠিত ইন্সটিটিউটেরও প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক। তিনি বলেন, দাসমুক্তি দিবস পালন গুরুত্বপূর্ণ।
এক সাক্ষাৎকারে নেলসন বলেন, “এটি সত্যিই আমাদের জন্য এমন একটি সময় যখন দাসপ্রথা কেমন ছিল এবং কানাডায় এর রূপ কেমন ছিলো সে সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করা উচিৎ।”
তিনি বলেন, আর্ট কলেজে এমন একটি ইন্সটিটিউট প্রতিষ্ঠার বিষয়টি কাউকে বিস্মিত করলেও আসলে শিল্পই হচ্ছে এদেশে দাসপ্রথার ইতিহাস বুঝতে জনগণকে সহায়তা করার মূল চাবিকাঠি।
তিনি বলেন, আটলান্টিকের দুই পাড়ের দাসপ্রথা বিষয়ে কি জানেন এবং কীভাবে জেনেছেন এমন প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করা হলে বেশিরভাগ মানুষ হলিউডের কিছু চলচ্চিত্রের নাম উল্লেখ করেন যেমন, লিঙ্কন, অ্যামিস্টাড, ১২ ইয়ার্স এ স্লেভ এবং জাঙ্গো আনচেইন্ড।
তিনি বলেন, “দাসপ্রথার ভয়াবহতা ও বর্বর প্রকৃতির দিক থেকে বিবেচনা করলে অতি সাম্প্রতিক কিছু মুভি যথেষ্ট নির্ভুল, কিন্তু এসব চলচ্চিত্রের প্রায় সবগুলোই কেবল হলিউড যার প্রতিনিধিত্ব করে সেই আমেরিকার দক্ষিণাঞ্চলের (যুক্তরাষ্ট্রের) দাসপ্রথারই উপস্থাপনমাত্র।
তিনি বলেন, কানাডার দাসব্যবস্থার ইতিহাস প্রধানত লেখা হয়েছে শ্বেতাঙ্গদের হাতে এবং তাতে এ দেশে দাসব্যবস্থা প্রচলিত থাকার স্বীকৃতির পাশাপাশি কিছুটা ক্ষমা চাওয়ার মনোভাব আছে, কিন্তু আমেরিকার দক্ষিণাঞ্চল বা ক্যারিবীয় অঞ্চলের চেয়ে এদেশে দাসের সংখ্যা যেহেতু কম ছিলো তাই এখানকার দাস মালিকরা একদিক থেকে অপেক্ষাকৃত দয়ালু ও ভদ্র ছিলেন এমনটা বলার চেষ্টা আছে। এটি কোনওভাবেই সত্য নয়।
লোকেরা প্রায়ই দাসপ্রথাকে কৃষি খামারে হাজারও মানুষের একসঙ্গে কাজ করার সঙ্গে সম্পর্কিত বলে মনে করে।
কানাডায় দাসপ্রথা সেরকম ছিলো না; কারণ, এখানে জলবায়ু ও মৌসুমের যে পরিবর্তন ঘটে তাতে সারা বছর চাষাবাদ চালিয়ে সম্ভব ছিলো না।
নেলসন বলেন, কানাডার দাসরা আপেল বা শস্য ফলাতো ঠিকই কিন্তু তাদেরকে গাভী দোহন করা, ঘোড়ার লালনপালন এবং নারীদের ক্ষেত্রে নিজের সন্তানকে বঞ্চিত করে শ্বেতাঙ্গ মালিকের সন্তানদেরকে স্তন্যদানের মত কাজ করতেও বাধ্য করা হতো।
তিনি বলেন, সার্বিকভাবে কানাডার জনগণ দাসপ্রথার সঙ্গে নিজ দেশের সম্পৃক্ততা সম্পর্কে আমেরিকানদের মত শিক্ষিত নয়।
তিনি বলেন, “যে বিষয়ে জানার কোনও সুযোগ কখনই পায়নি সে বিষয়ে লোকেরা জানবে কেমন করে? আর যেসব কানাডীয় কিছু সময় প্রাথমিক, হাই স্কুল বা কলেজে কাটিয়েছেন … তাদেরও সে সুযোগ হয়নি, কারণ বিষয়টি পাঠ্যসূচিতে একেবারেই নেই।”
এই অবস্থা পাল্টানোর জন্য নেলসন নতুন ইন্সটিটিউট এবং দাসমুক্তি দিবসকে পরিবর্তনের সূচনাবিন্দু হিসাবে ব্যবহারের আশা করছেন।
তিনি বলেন, সাধারণ জনগণ প্রাতিষ্ঠানিক সাহিত্য পড়তে যাবে না, সুতরাং যে উপায়ে তাদের পক্ষে এ ধরণের ইতিহাস বুঝে নেয়া সহজ হবে সেটি হলো শিল্পপ্রদর্শনী। সেটি হতে পারে কোনও চিত্রকর্ম অথবা চলচ্চিত্র।
তিনি বলেন, “এ জন্যেই শিল্পীদেরকে এগিয়ে আনা ছাড়া আমরা কখনই বৃহত্তর জনগণকে শিক্ষিত করে তুলতে পারবো না যে, আটলান্টিকের উভয় পাড়ে ৪০০ বছর ধরে বিদ্যমান দাসপ্রথা নামের ইন্সটিটিউটটি সত্যিই কতটা গভীর ও বিশ্ব-রূপান্তরকারী ছিলো।”
দাসমুক্তি দিবসকে সবাই স্বাগত জানায়নি
কিন্তু লেখক রবার্ট-জনসন, যার চতুর্থ প্রপিতামহ ছিলেন একজন পালিয়ে যাওয়া ক্রীতদাস, এই মুক্তি দিবসকে খুবই অকিঞ্চিৎকর এবং অত্যন্ত বিলম্বিত বলে মনে করেন।
তিনি বলেন, “আমরা প্রায় দুই ’শ বছর পর্যন্ত একথা শোনার জন্য অপেক্ষা করে থাকতে পারি না যে, ওই ধরণের ঘটনা ঠিক ছিলো না।”
তিনি জ্যুড ও তার বোনের ব্যক্তিগত কাহিনী বর্ণনায় সময় দেন।
তিনি বলেন, “ওই সুদীর্ঘ সময়ের মধ্যে কেউই তাদের কথা শোনেনি তাই ভবিষ্যতেও কেউই কোনওভাবে তাদের কথা জানতে পারতো না। সুতরাং এখন তাদের কাহিনী বলা হলো।”
-সৌজন্যে : কায়লা হাউন্সেল/সিবিসি নিউজ