এই সব দুঃখমালা
শুজা রশীদ
একজন দু’জন করে মানুষ আসতে আসতে দুপুর নাগাদ টরন্টোর নাথান ফিলিপস স্কোয়ারে কয়েক হাজার মানুষ জমায়েত হয়ে গেছে। অক্টোবরের শেষ উইক এন্ড। অস্বাভাবিক রকমের রৌদ্রজ্জ্বল এবং উষ্ণ একটা দিন। চারদিকে শারদীয় রঙের ছড়াছড়ি। এই জনতা যে কারণে আজ এখানে জমায়েত হয়েছে সেটা যদি এমন হৃদয় বিদারক না হত. তাহলে হয়ত দিনটাকে চমৎকার বলে আখ্যায়িত করা যেত। পরনে সালওয়ার-কামিজ, পায়ে ফ্ল্যাট স্যান্ডেল এবং গায়ে একটা শাল জড়িয়ে রেহানা ফুটপথের ভীড় ঠেলে দ্রুত পায়ে হাঁটছে নাথান ফিলিপস স্কোয়ারের দিকে, তার দৃষ্টি চারদিকে ছুটে বেড়াচ্ছে বান্ধবীদের খোঁজে। এই মিছিল-মিটিংয়ের কারণে শহরের ভেতরে পার্কিং করাটা অসম্ভব হবে মনে করে ও আজ সাবওয়ে নিয়ে চলে এসেছে। সাবওয়ে স্টেশন থেকে স্কোয়ার বেশ খানিকটা হাঁটা পথ কিন্তু আজকের এমন মনরম হওয়ায় ওর কাছে হাঁটতে ভালোই লেগেছে। এখন বান্ধবীদেরকে ভালোয় ভালোয় খুঁজে পেলে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়তে পারবে।
স্কোয়ারে পৌঁছে ও রুবিনাকে একটা ফোন দিল। রুবিনা ফোন না ধরায় নিজের অবস্থান জানিয়ে একটা ভয়েস মেইল রাখল। তারপর ফোন করল ফাতেমাকে। বেশ কয়েকবার আগু-পিছু ফোনালাপ করে অবশেষে মিনিট দশেক পরে রুবিনা, ফাতিমা এবং পার্বতী সাথে একত্রিত হল। উচ্ছসিত হয়ে পরস্পরকে আলিঙ্গন করলো ওরা। আজকের এই প্রতিবাদ মিছিলে শরিক হতে পেরে ওরা সবাই আনন্দিত। ওদের মধ্যে পার্বতীই সবচেয়ে অল্পবয়স্ক -ত্রিশ-একুত্রিশ হবে। রুবিনা এবং রেহানা দু’জনেই পঞ্চাশের মত, ফাতিমা ওদের চেয়ে কয়েক বছরের বড়, ষাটের কাছাকাছি। ওয়ালমার্টে কাজের সূত্র ধরে ওদের পরিচয় এবং বন্ধুত্ব। রেহানা অনেক দিন সেখানে কাজ না করলেও বন্ধুত্বটুকু অটুট আছে।
ফাতিমা কে দেখে অস্থির মনে হয়। সে ছোটখাটো মানুষ, মাথার চুল প্রায় পুরোটাই ধবধবে সাদা, কিন্তু তার মনবল ঈর্ষনীয়। ওদের আজ এখানে আসার পেছনে তার ভূমিকাই মূল। তার ভাষ্য অনুযায়ী আজকের এই প্রতিবাদ সভা কোন একটি বিশেষ জনগোষ্ঠীকে সমর্থন করবার জন্য নয়। বরং উদ্যোক্তাদের উদ্দেশ্য হচ্ছে সামগ্রিকভাবে সকল পক্ষের কাছে যুদ্ধ বন্ধ এবং শান্তির জন্য আবেদন করা। ফাতিমাকে অনুসরণ করে ওরা তিনজন স্কোয়ারের মাঝামাঝি হেঁটে গেল যেখানে জন্তার ভীড়ের মাঝে দাঁড়িয়ে জনৈক ভদ্রমহিলা জ্বালাময়ী ভাষায় বক্তৃতা দিচ্ছে। ইসরাইলের সেনাবাহিনী গাজায় যে নির্বিচার হত্যাকাণ্ড চালাচ্ছে যে কোন মূল্যে হোক সেই হত্যাকাণ্ড বন্ধ করতেই হবে। হামাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের অছিলায় ইসরাইলের খুনীরা নিরীহ প্যালেস্টাইনিদের রক্তে রাঙিয়ে দিচ্ছে তাদেরই জন্মভূমি। মাত্র কয়েক সপ্তাহে তারা হত্যা করেছে কয়েক সহস্র নিষ্পাপ শিশু! সন্ত্রাসবাদ আমরা কোনদিন সমর্থন করিনি, আজও করি না – তা সে হামাসই হোক আর ইসরাইলের খুনীআর্মিই হোক। এই অবৈধ যুদ্ধ বন্ধ করা হোক, এই হত্যাযজ্ঞ বন্ধ করা হোক- এটাই আমদের দাবি – ‘সমবেত জনতা সমস্বরে গর্জে উঠল ‘বন্ধ কর যুদ্ধ’, ‘বন্ধ কর হত্যাযজ্ঞ’। তাদের গর্জনের শব্দ ধীরে ধীরে উচ্চতর হতে থাকে, শত শত প্যালেস্টাইনের ঝান্ডা বাতাসে পত পত করে উড়তে থাকে। সেই সম্মিলিত শব্দে রেহানার লোম খাড়া হয়ে ওঠে। যুদ্ধের চেয়ে ঘৃণ্য ওর কাছে আর কিছু নেই। বহু বছর আগে তার জন্মভূমি বাংলাদেশের স্বাধীনতার যুদ্ধে সে হারিয়েছিল তার দুই তরুণ সহদরকে। তার তখনও জন্মই হয় নি। তাদেরকে সে চেনে ছবিতে।
অল্প কিছুক্ষণ পরে জনতার মিছিল নাথান ফিলিপস স্কোয়ার থেকে বেরিয়ে ইউনিভার্সিটি এভেনিউ ধরে হাঁটতে থাকে পার্লামেন্ট বিল্ডিংয়ের দিকে। সেখানে পৌঁছে প্রভিনসিয়াল গভর্নমেন্টের কাছে যুদ্ধ বন্ধের লিখিত দাবি হস্তান্তর করবে সমাবেশের উদ্যোক্তারা।
ওরা চার বান্ধবী জনতার সাথে তাল মিলিয়ে হাঁটে, চেষ্টা করে পরস্পরের কাছাকছি থাকতে যেন ভীড়ের ধাক্কায় বিচ্ছিন্ন না হয়ে যায়। জনতার সেই স্রোতে নানা ধরনের মানুষের সমারোহ- যুবতী মায়েরা এসেছে স্ট্রলারে তাদের শিশুদেরকে নিয়ে, বৃদ্ধরা এসেছে তাদের স্কুটারে, স্যুট পরনে অফিসের কর্মচারীরা এসেছে দলে দলে, আর এসেছে শত শত তরুণেরা- ক্ষুব্ধ, ক্রদ্ধ।
“এত জোরে হেঁটো না,” ফাতিমা ওদেরকে সতর্ক করে। “তাড়াতাড়ি ক্লান্ত হয়ে পড়বে। রুবিনা – বিশেষ করে তুমি। তোমার ডায়াবেটিস এবং হাই ব্লাড প্রেসার আছে। আমি চাইনা তোমার শরীর খারাপ হয়ে যাক।”
রুবিনাকে দেখে মনে হয় সে ইতিমধ্যেই ক্লান্ত হয়ে গেছে। হাতের বিশাল পার্টস এর ভিতর থেকে একটা পানির বোতল বের করে কয়েক চুমুক পানি খায়। “বুঝতে পারিনি এতখানি হাঁটতে হবে।”
“অত বেশী হাঁটতে হবে না,” ফাতেমা আশ্বস্ত করে। “ঐ যে সামনে পার্লামেন্ট বিল্ডিং। ওখান থেকে ফেরার পথে আমরা খুব সম্ভবত কলেজ স্ট্রিট নিয়ে আবার স্কোয়ারে ফিরে যাব। বড় জোর খান দুই কিলোমিটার। সাথে খাবার দেওয়ার কিছু এনেছো? খেয়াল রেখ তোমার ব্লাড সুগার লেভেল যেন না পড়ে যায়।”
“অল্প কিছু ক্র্যাকার এনেছি,” রুবিনা ইতস্তত করে বলে। “তুমি তো বলেছিলে আমরা নাথান ফিলিপস স্কোয়ারেই থাকবো।”
ফাতিমা কাঁধ ঝাঁকাল। “আমি তো তাই ভেবেছিলাম। এখন দেখছি প্ল্যান পাল্টে গেছে। এখানে আসার পরে জানতে পারলাম কিন্তু তোমার দুঃশ্চিন্তার কোন কারণ নেই। এদিকে খাবারের অনেক দোকান আছে।”
জনতার ভীড় থেকে অচিরেই নতুন আরেকটা শ্লোগান বাতাসে অনূরননিত হয় – হে হে হো হো, দ্যা অকুপেশন গোট টু গো! ফাতিমা তার কন্ঠের সমস্ত শক্তি দিয়ে স্লোগান দেয়। পার্বতী এবং রুবিনাও তার সাথে যোগ দেয়। রেহানা ঠোঁট মেলায়। চীৎকার করবার শক্তি পায় না। তার নানা ধরনের অসুখ বিসুখ আছে। খুব সহজেই ক্লান্ত হয়ে পড়ে। রুবিনার উদ্দীপনা দেখে একটু শংকাই বোধ করে। রুবিনাকে কনুই দিয়ে হালকা ধাক্কা দিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল, “এতো গলা ফাটাচ্ছো কেন? শরীর খারাপ হলে বিপদ হবে।”
রুবিনা অস্বস্তি নিয়ে মাথা নাড়ে। সবার উত্তেজনা-উদ্দীপনা দেখে ওর ভেতরেও বেশ একটা তেজ অনুভব করছে সে, যদিও জানে হঠাত করেই মাথা ঘুরে পড়ে যেতে পারে। তার তেমনটা আগে হয়েছে।
রেহানার ফোন বাজছে। সে হ্যন্ড ব্যাগের ভেতর হাতড়ে সেল ফোনটা বের করল। মন্টি- তার স্বামী। তার ফোন কলের অপেক্ষাতেই ছিল ও। ওদের বিড়াল হ্যাপিকে পশু চিকিৎসকের কাছে চেকআপের জন্য নিয়ে যাবার কথা আজ। হ্যাপির বয়েস দশ, বৃদ্ধ, ইদানীং তার শরীরটা তেমন ভালো যাচ্ছে না। রেহানার পুরো পরিবারই বিড়ালটার জন্য পাগল হলেও ওর সাথেই হ্যাপির সম্পর্ক সবচেয়ে ঘনিষ্ট। ও-ই স্বামীকে রাজি করিয়েছে বিড়ালটাকে ভালো করে চেকআপ করানোর জন্য। আজকের এই প্রতিবাদ অনুষ্ঠানে না এলে সে নিজেই হ্যাপিকে নিয়ে পশু চিকিৎসকের কাছে যেত।
মন্টি একটা খারাপ খবর দিল। “ভেট হ্যাপির পেট এক্সরে করেছে এবং টেস্ট করবার জন্য রক্ত নিয়েছিল,” সে বলল। “ডায়াগনোসিস খুব একটা ভালো না। বলছে হ্যাপির লাংগসে পানি জমেছে, শরীরের অন্য কোথাও টিউমারও হয়ে থাকতে পারে। নিশ্চিত হওয়ার জন্য আরও টেস্ট করতে হবে। কি করবো?”
রেহানা বিরক্ত হলো। “কি করবে মানে? ভেটকে জিজ্ঞেস করো কি করতে হবে। সে নিশ্চয়ই কিছু একটা সাজেশন দেবে। তার কাজই তো এইটা।“
অন্য প্রান্তে দীর্ঘক্ষণের নীরবতা।
“কথা বলছ না কেন?” রেহানা ধমকে ওঠে। মন্টির একটা বদ স্বভাব হচ্ছে অনেক কিছু সে ওর কাছ থেকে গোপন করে যায়। ওর মনে হচ্ছে এখনও সে ঝেড়ে কাশছে না।
মন্টি গলা পরিষ্কার করল। “ইয়ে, মানে, ভেট বলছে ওকে ইউথানাইজ করতে,” অবশেষে বলল।
রেহানা জমে গেল। “কি?” শব্দ খুঁজে পেতে ওর অনেকখানি সময় লাগল। “তার কি মাথা খারাপ? বল কিছু ওষুধ পত্র দিতে। সেগুলো নিয়ে ওকে সহ বাসায় চলে যাও।”
“ভেট বলছে হ্যাপির এভাবে বেঁচে থাকাটা যন্ত্রনাময়। তার শরীরে অনেক অসুখ বিসুখ। বলছে আমি যদি তার কথায় রাজী না হই তাহলে কোন একটা এনিমাল সোসাইটির কাছে রিপোর্ট করবে। তারা পরে আমাদের সাথে যোগাযোগ করে সিদ্ধান্ত নেবে হ্যাপির জন্য কোনটা সবচেয়ে ভালো হবে। কাদের কথা বলছে আমার কোন ধারনা নেই।”
রেহানার শরীর কাঁপতে শুরু করে। হ্যাপি ওর কাছে এসেছিল যখন সে এইটুকুন। ওর কাছে সে নিজের আরেকটা বাচ্চার মত। ওর বিছানায় একটা ছোট্ট অংশ হ্যাপির জন্য আলাদা করে রাখা যেখানে বিড়ালটা প্রতি রাতে ঘুমায়। ওর যখন মন খারাপ লাগে তখন হ্যাপিকে কোলে নিয়ে কচলা-কচলি করলে ওর মনটা ভালো হয়ে যায়। হ্যাপির মুড যেমনই থাক সে নীরবে ওর সমস্ত আদরের অত্যচার সহ্য করে। রেহানা ভুলেই গেছে যে বিড়ালের শরীরের মধ্যে হ্যাপি আরেকটা মানুষ নয়। ওর বাচ্চারা হ্যাপিকে তাদের সহদরার মত দেখে। গত দশ বছর ধরে ওদের বাসার প্রধান আকর্ষন হচ্ছে হ্যাপি। ইদানীং বয়েস হয়ে যাওয়ায় সে বেশ চুপচাপ এবং ধীর স্থির হয়ে গেছে কিন্তু তারপরও তার উপস্থিতি ওদের বাসাটাকে জীবন্ত করে রাখে।
ফাতিমা লক্ষ্য করল রেহানা দাঁড়িয়ে আছে। তাকে দেখে অসুস্থ মনে হচ্ছে। “রেহানা! সব ঠিক আছে?” সে চীৎকার করে জানতে চাইল।
রেহানা মাথা নাড়ল। লক্ষ্য করল ওর বান্ধবীরা বেশ খানিকটা এগিয়ে গেছে। ও বেশী পিছিয়ে পড়তে চায় না। একা হয়ে যাবে। সেল ফোনটা শক্ত করে কানে চেপে ধরে দ্রুত পায়ে অন্যদেরকে ধরে ফেলার চেষ্টা করে।
“আমি কি করব এখন?” মন্টি ফোনের অন্য প্রান্ত থেকে জানতে চায়।
“আবার জিজ্ঞেস করছ কেন?” রেহানা ধমকে ওঠে। “বললাম না বাসায় নিয়ে যাও ওকে। আমি ফিরলে তখন ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা-ভাবনা করে একটা সিদ্ধান্ত নেব। ও এতো সেই রকম অসুস্থ নয় যে ওকে মেরে ফেলতে হবে।”
“তুমি বাসায় ফিরছ কখন?”
“জানি না। আমরা পার্লামেন্ট বিল্ডিংয়ের দিকে যাচ্ছি। হয়ত ওখান থেক একটা উবার নিয়ে বাসায় ফিরতে পারব। তুমি হ্যাপিকে নিয়ে বাসায় চলে যাও। ভেটের কথায় পাত্তা দিও না।”
ফোন রেখে দিয়ে দ্রুত পায়ে বান্ধবীদেরকে ধরে ফেলল রেহানা। পুরো পরিস্থিতিটার বর্ণনা দিল তাদের কাছে। তারা সবাই ওর বাসায় গেছে, হ্যাপির সাথে তাদের সম্যক পরিচিতি আছে। ঘটনা শুনে তাদের সবারই মন খারাপ হয়ে গেল।
“আমার মনে হয় তোমার বাসায় চলে যাওয়া উচিৎ,” পার্বতী বলল। “তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে তুমি নিজেই অসুস্থ হয়ে যাবে।”
“আমি পার্লামেন্ট বিল্ডিং পর্যন্ত অন্তত যেতে চাই,” রেহানা দ্বিধা করে বলল। “নাহলে নিজেকে অপরাধী মনে হবে। আমাকে মাফ করে দিও তোমরা। অসহায় প্যলেস্টাইনীরা অযাচারে খুন হচ্ছে। ওদের থাকার জায়গা নেই, খাবার নেই, পানি নেই, অষূধ নেই, কোন নিরাপত্তা নেই। এমনকি হাসপাতালও নিরাপদ নয়। কি একটা দোযখের মধ্যে তারা বসবাস করছে। আর আমি এখানে আমার সামান্য একটা বিড়াল নিয়ে মন খারাপ করছি!”
ফাতিমা গম্ভীর মুখে মাথা নাড়ল। “প্রিয় বস্তু- তা সে মানুষ হোক আরে বিড়াল হোক, দুটোর মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। সে তোমার পরিবারের অংশ। তোমার মনতো খারাপ হবেই। তোমার চারদিকে তাকিয়ে দেখ। এদের অনেকেরই আত্মীয় স্বজনেরা থাকে গাজায়। দেখেই বোঝা যায়। ওরা হয়ত তাদেরকে আর কোনদিন দেখবে না। ঐ হারামী ইসরাইলীগুলো সবখানে অযাচারে বোমা মারছে। হাজার হাজার মানুষকে নির্বিচারে হত্যা করছে।”
“হামাসও অনেক ইসরাইলীদেরকে হত্যা করেছে,” রুবিনা নীচু স্বরে বলল। “এই ধ্বংসযজ্ঞ তো ওরাই শুরু করল। কত নিরীহ মানুষ অকারণে খুন হয়েছে।”
“হামাস যে এখনও টিকে আছে তার কারণ তো ওরাই,” ফাতিমা তীক্ষ্ণ কন্ঠে বলে। “প্যালেস্টাইনিদের নিজেদের দেশেই ওদেরকে বন্দী করে রেখেছে। দখলের জমিতে বেআইনিভাবে অবাঞ্ছিত মানুষদেরকে বসতি বানানোর সুযোগ দিচ্ছে। দুই জাতি দুই দেশ সমাধানের কথা সেই কবে থেকে চলছে কিন্তু এতোদিনেও কোন আগ্রগতিই হয় নি। তোমার কি ধারণা কোন জনঙ্গোষ্ঠীবছরের পর বছর এমন অপমানজনক, মানবেতর জীবন যাপন করতে পারে? মানুষের আত্মসম্মানবোধ যখন ছিনিয়ে নেয়া হয়, তাদের আত্মীয় স্বজনদেরকে হত্যা করা হয়, অকারণে তরুণদেরকে ধরে ধরে জেলে ঢুকিয়ে রাখা হয়, তাদের কাছ থেকে ভালো আর কি আশা করতে পারো? ওরা ইসরাইলীদেরকে মারবে না তো কি প্রেম পত্র পাঠাবে?“
ফাতিমার কন্ঠে উত্তেজনা, দৃষ্টিতে আগুণ। চারপাশের মানুষেরা মাথা দুলিয়ে তার কথায় সম্মতি জানায়। ফাতিমা হঠাৎ এক হাত মাথার উপরে তুলে চীৎকার করে সেøাগান দেয় “ফ্রি, ফ্রি প্যালেস্টাইন!” প্রথমে ডজন খানেক মানুষ ওর সাথ যোগ দেয়। ধীরে ধীরে তাদের সংখ্যা বাড়তে থাকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই হাজারো মানুষের তীব্র নিনাদ অনুরণনিত হতে থাকে চারদিকে – “ফ্রি, ফ্রি প্যালেস্টাইন!”। পার্বতী, রুবিনা এবং রেহানা পরস্পরের দিকে তাকায়। হঠাৎ করেই ফাতিমা যেন হয়ে উঠেছে এই প্রতিবাদী মিছিলের একটা মূল কন্ঠ। তাকে দেখে একজন নির্ভিক, ক্রুদ্ধ যোদ্ধার মত মনে হয়। অন্যদের পাশ কাটিয়ে দ্রুততর পায়ে এগিয়ে চলেছে সে। ওরা তিনজন আপ্রাণ চেষ্টা করে তার সাথে তাল মিলিয়ে চলতে।
এক পর্যায়ে মিছিলটা পুলিশের মুখোমুখি হয়। আগেই প্রচুর পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছিল শান্তি-শৃংখলা বজায় রাখার জন্য। প্রথমে পুলিশ তাদেরকে থামিয়ে দিলেও কিছুক্ষণ পরে এগিয়ে যাবার অনুমতি দেয়। ওরা যখন চমৎকার স্থাপত্যের নিদর্শন পার্লামেন্ট বিল্ডিংয়ে পৌঁছাল তখন দুপুর দুইটা বাজে। উপস্থিত জনতার কন্ঠে সেøাগান গর্জে গর্জে ওঠে। রেহানা সুযোগ বুঝে সেই ভীড় থেকে বেরিয়ে গিয়ে একটি অপেক্ষাকৃত নিরালা জায়গা খুঁজে নিয়ে মন্টিকে ফোন করে।
“কি অবস্থা এখন?” সে উৎকন্ঠা নিয়ে জানতে চায়।
“বাসায় নিয়ে এসেছি ওকে,” মন্টি দ্বিধান্বিত কন্ঠে বলে। “কিন্তু এখন ওকে দেখে আসলেই অসুস্থ মনে হচ্ছে। ভেট মনে হয় কিছু একটা করেছে। হয়ত রক্ত নেবার আগে ওকে শান্ত করার জন্য কোন ওষুধ দিয়েছিল। যেখানে সুচ ফুটিয়েছিল সেখান থেকে ফোঁটা ফোঁটা রক্ত পড়ছে। আমার মনে হয় ওকে আবার ভেটের কাছে নিয়ে যাওয়াই উচিৎ। হয়ত সে ঠিকই বলেছে। তার উপদেশ হয়ত আমাদের শোনা উচিৎ।”
রেহানা দীর্ঘ একটা মুহুর্ত নীরব থাকে। “তুমি কিছু কর না। আমি বাসায় আসছি। ওর কাছে থাক। ঠিক আছে?”
রেহানা ফোন রেখে দিয়ে উবার এ্যাপে একটা রাইড খোঁজে। স্বাভাবিক অবস্থায় এই এলাকায় প্রচুর ড্রাইভার পাওয়া যায় কিন্তু আজকের এই মিছিল-সভার কারণে চারদিকের রাস্তায় জট লেগে গেছে। উবার ড্রাইভাররা আটকে যাবার ভয়ে বেশ খানিকটা দূরত্ব রেখে দাঁড়িয়ে আছে। ও একজনকে পেল দুই ব্লক দূরে। এই টুকু পথ ওকে হেঁটে যেতে হবে। খুব একটা মন্দ না। বান্ধবীদের খোঁজ করল। এই অল্প সময়ের মধ্যেই পার্লামেন্ট বিল্ডিংয়ের সামনের বিশাল ময়দান মানুষে সয়লাব হয়ে গেছে। এর মধ্যে কাউকে খুঁজে বের করার প্রশ্নই ওঠে না। তারপরও কিছুক্ষন চেষ্টা করে হাল ছেড়ে দিল রেহানা। ফাতিমাকে একটা টেক্সট মেসেজ পাঠাল – বাসায় চলে যাচ্ছি। হ্যাপিকে শেষ দেখা দেখতে চাই। তারপর ইউনিভার্সিটি ড্রাইভ ধরে হাঁটতে শুরু করে, লক্ষ্য পরবর্তি ইন্টারসেকশন। ওর উবার ড্রাইভার ওর জন্য সেখানে অপেক্ষা করবে।
উবার ড্রাইভার, জোসেফ, পঞ্চাশোর্ধ ভদ্র দর্শন মানুষ। রাস্তার ভীড় ঠেলে ধীরে ধীরে এগিয়ে যেতে যেতে তার দৃষ্টি রাস্তার উপর থেকে পেছনে বসে থাকা মহিলা আরোহীর উপর স্থির হয়। তাকে দেখে খুবই বিধ্বস্ত মনে হয়। “ম্যা’ম, তুমি ঠিক আছো?”
রেহানা আপ্রাণ চেষ্টা করছে ভেঙে না পড়তে। কিন্তু খুব একটা সফল হচ্ছে না। হ্যাপিকে হারানোর কথা চিন্তা করতেও ওর কষ্ট হচ্ছে, বুকের ভেতরটা হু হু করে উঠছে। জানত একদিন না একদিন এমনটা হবে। কিন্তু এতো তাড়াতাড়ি হবে কখন ধারনাও করে নি। দশটা বছর যেন ঝট করে চলে গেছে।
“আমার বিড়ালটা মারা যাচ্ছে,” রেহানা ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলে। “আমি খুব দুঃখিত। তোমাকে অযথা বিরক্ত করতে চাই না। কিন্তু বিড়ালটা আমার কাছে সন্তানের মত।”
“বিরক্ত কেন হব?” জোসেফ শান্ত কন্ঠে বলল। “পোষা প্রানীরা আমাদের পরিবারেরই অংশ। তুমি কষ্ট পাবে সেটাই তো স্বাভাবিক। তুমি কি প্রতিবাদ মিছিলে এসেছিলে?”
“হ্যাঁ কিন্তু এখন অপরাধ বোধ করছি। এতো মানুষ মারা যাচ্ছে আর আমি আমার পোষা প্রাণীটার নিয়ে কাঁদছি,” রেহানা ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলে।
জোসেফ একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়ে। “অপরাধ বোধ করার কিছু নেই এখানে। দুঃখ-বেদনা আর ভালোবাসা নিয়েইতো আমাদের জীবন। আমাকে দেখলে স্বাভাবিক মনে হতে পারে কিন্তু যদি জানতে আমার মনের মধ্যে কি চলছে। তোমার মত মন খুলে যদি কাঁদতে পারতাম তাহলে বুকের বোঝাটা একটু হলেও হালকা হয়ে যেত।”
“কেন? কি হয়েছে তোমার?” রেহানা কান্না থামিয়ে অবাক হয়ে জানতে চায়।
“তোমাকে যদি বলি তুমি বিশ্বাস করবে না,” লোকটা ভাঙ্গা গলায় বলল। “আমি একজন ইস্রায়েলী ইহুদী, আমার স্ত্রী প্যালেস্টাইনী। আমাদের পাঁচ বাচ্চা। আমার বড় মেয়েটা কিহুদিন আগে আঠারো হয়েছে। ও ইস্রায়েল, গাজা আর ওয়েস্ট ব্যঙ্কে বেড়াতে যেতে চেয়েছিল। সব খানেই আমাদের আত্মীয় স্বজনেরা আছে। আমি ওকে যেতে দিতে চাই নি। ভেবেছিলাম নিরাপদ নয়। ও আমার কথা শুনতে চায় না। সেই জন্য বলেছিলাম ওর যাবার কোন খরচ আমি দেব না। আমার উপর ভীষন রেগে যায়। পার্ট টাইম কাজ করে কিছু টাকা পয়সা জমিয়েছিল, বন্ধুদের কাছ থেকে কিছু ধার করে, তারপর কাউকে কিছু না বলে চলে যায়।” “হামাসের আক্রমণের সময় কোথায় ছিল সে?” রেহানা লোমহর্শক সেই পরিণতির কথা ভাবতেও পারে না।
“জানি না। আমাদের সাথে কোন যোগাযোগ করে নি। আমাদের প্রায় সব আত্মীয় স্বজনদেরকে ফোন করেছি। গাজায় কয়েক জনের সাথে যোগাযোগ করতে পারি নি। ও হয়ত গাজাতেই আছে। হয়ত ইতিমধ্যেই আমদের ছেড়ে চলে গেছে নয়ত জীবন হাতে নিয়ে ছুটে বেড়াচ্ছে নিরাপত্তার জন্য।” একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ছাড়ে সে। “মেয়েটা আমার কোথায় আছে, কিভাবে আছে, বেঁচে আছে না মরে গেছে জানি না, সেটাই আমদের সবাইকে কুরে কুরে খাচ্ছে। আমি হয়ত নিজেই চলে যেতাম ওকে খুঁজতে কিন্তু আমার একটা পরিবার আছে, আরোও চারটা বাচ্চা আছে। সব বেদনা বুকের মধ্যে পুষে রেখে আমাকে দিন গুজরান করতে হবে। হাজার হাজার মানুষ মরছে সেখানে, আমার মেয়ে হয়ত তাদেরই একজন হয়ে গেছে।”
রেহানার বুকের মধ্যে খঁচ করে ওঠে। “এভাবে বল না। তোমার মেয়ে বেঁচে আছে, ভালো আছে। সেখানে যোগাযোগের সমস্যা হচ্ছে, সেই কারণে হয়ত বাসায় ফোন করতে পারে নি। হাল ছেড়ে দিও না। মনকে শক্ত কর। ঠিক আছে?”
“কোন ব্যাপারটা আমাকে সবচেয়ে বেশী কষ্ট দিচ্ছে জান?” জোসেফ ভেঁজা গলায় বলে। “যাবার আগে রাগ করে আমাদেরকে একটু বলেও যায় নি। আমরা কেউ ওকে বিদায় জানাতে পারি নি, আলিঙ্গন করতে পারি নি। যদি ওকে আর একটা বার বুকে জড়িয়ে ধরতে পারতাম, বলতে পারতাম ওকে কতখানি ভালোবাসি”
রেহানার একটা অভাবনীয় কাজ করে। সামনে ঝুঁকে জোসেফের কাঁধে আলতো করে হাত বোলায়। “দুঃখ কর না। ও ভালোয় ভালোয় ফিরে আসবে। আমার মন বলছে। আমি ওর জন্য দোয়া করব।”
লোকটা হঠাৎই হু হু করে কেঁদে ওঠে। “সেই আশাতেই বুক বেঁধেছি। সেটাই যেন হয়।”
ঘন্টা খানেক পরে, অসুস্থ এবং অথর্ব হ্যাপিকে বুকে জড়িয়ে ধরে রেহানা তার কানে ফিসফিসিয়ে বলে- যা মা, চির শান্তির দেশে চলে যা! তারপর তাকে সযত্নে শুইয়ে দেয় তার ক্যারিয়ারের ভেতরে, তারপর মন্টির দিকে ফিরে আলতো করে মাথা নাড়ে। মন্টি ক্যারিয়ারটা তুলে নয়ে ধীর গতিতে বেরিয়ে যায় বাসা থেকে, হ্যাপির শেষ যাত্রায়।
রেহানা অজু করে, জায়নামাজে বসে, তারপর দোয়া করে হ্যাপির জন্য, জোসেফের মেয়ের জন্য, প্যালেস্টাইনিদের জন্য, ইসরায়েলীদের জন্য এবং পৃথিবীর প্রতিটি মানুষের জন্যঃ হে মহান স্রষ্টা, আমাদের শক্তি দাও এই পার্থিব দুঃখ-কষ্ট-যন্ত্রণা সহ্য করবার।

লেখক পরিচিতি :
কানাডা প্রবাসী শুজা রশীদ একজন ছোট গল্পকার, ঔপন্যাসিক ও কলামিস্ট। তিনি টরন্টো থেকে প্রকাশিত ধাবমান সাহিত্য সাময়িকীর সম্পাদক