সুফিবাদ ও বাংলাদেশ

অধ্যাপক ড. মো. গোলাম দস্তগীর

পর্ব – ৭

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

৮. সোহরাওয়ার্দিয়া তরিকা

সোহরাওয়ার্দিয়া তরিকার প্রকৃত প্রবর্তক হলেন হযরত শিহাবুদ্দীন ওমর বিন আবদুল্লাহ-আম-সোহরাওয়ার্দি (র.)। তিনি এই তরিকার ইমাম ও সর্বশ্রেষ্ট কুতুব। বিখ্যাত সাধক শেখ সাদী (র.) ছিলেন তাঁর শিষ্য। তাঁর লেখা “আওয়ারিফুল মারিফ” একটি বিখ্যাত গ্রন্থ। ইহা কাদেরিয়া তরিকার একটি উপশাখা। ইরান, ইরাক, ভারত,  পাকিস্তান ও আফগানিস্তানে এই তরিকার যথেষ্ট প্রভাব রয়েছে। এক সময় বাংলাদেশেও এই তরিকার যথেষ্ট অনুসারী ছিল। বর্তমানে এই তরিকার অনুসারী বিরল।

৯. তৈফুরিয়া তরিকা

হযরত বায়েজিদ বোস্তামীর প্রচারিত তরিকাই হলো তৈফুরিয়া তরিকা।  বায়েজিদ  বোস্তামীর আসল নাম হলো আবু ইয়াজিদ তৈফুর। তাঁর নামানুসারে এরূপ নামকরণ করা হয়েছে। তিনি ইমাম জাফর সাদেক হতে বেলায়েতপ্রাপ্ত হন। তবে তিনি হযরত হাসান বসরীর শিষ্য হাবিব আজমীর মাযার হতেও রুহানিয়াতভাবে বিলায়েত লাভ করেন। তাঁর প্রচারিত তরিকাকে চৌদ্দখান্দার অন্তর্ভুক্ত বলে ধরা হয়। হযরত বায়েজিদের সিলসিলা ‘বোস্তাামিয়া’ তরিকা নামেও পরিচিত। এককথায় বাংলাদেশেও এই তরিকার অনুসারী রয়েছে। এখনও চট্টগ্রামের নাসিরাবাদে তাঁর স্মৃতি-মাযারকে কেন্দ্র করে অনেক অনুসারীদের সমাগম ঘটে। তাঁর প্রকৃত মাযার বোস্তাাম নগরে।

১০. জালালিয়া তরিকা

বাংলাদেশের সুফিকুলের শিরোমনী হযরত শাহজালাল মুজরদ-ই-ইয়ামেনী (র.) প্রতিষ্ঠিত তরিকার নাম হলো জালালীয়া তরিকা। তিনি অন্যতম শ্রেষ্ট ইমাম ও কুতুব। তিনি সাজরাসূত্রে হযরত আবু বকর (রা.) এর বংশধর। তিনি ৬২৫ সালে ৩৬০ জন আউলিয়া সঙ্গীসহ আরবের ইয়ামেন থেকে প্রথমে দিল্লির নিজামুদ্দিন আউলিয়ার (র.) দরবারে এবং পরে বাংলাদেশ আসেন এবং সিলেটে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। তখন তাঁর মুরিদদের সংখ্যা ব্যাপকভাবে বেড়ে যায়। এখনো সিলেটে হযরত শাহজালাল (র.) এর মাযারকে কেন্দ্র করে মুিরদদের উপস্থিতি বাংলাদেশে এই তরিকার প্রভাব প্রমাণ করে।

১১. এনায়েতপুরী তরিকা

এমন একসময় খাজা এনায়েতপুরী (র.)-এর আগমন ঘটে যখন বাংলাদেশ ও তৎকালীন ভারতের আসাম প্রদেশের বিস্তাীর্ন অঞ্চলের মানুষ ছিল চরম অন্ধকারে। আকিদা বিধ্বংসী ওহাবী আন্দোলন তখন চরম পর্যায়ে পৌঁছেছিল। মুসলমানেরা স্বীয় (ইসলাম) ধর্মের ফরয, ওয়াজেবের সুন্নাত ক্রিয়াকর্ম যেমন নামায, রোজা, হজ্জ, যাকাত, পর্দা, শিক্ষা-দীক্ষা, আচার-আচরণ প্রায় ছেড়ে দিয়েছিল। ইসলামি শিক্ষা রীতি-নীতি তখন কোনঠাসা হয়ে পড়েছিল এবং বিজাতীয় শিক্ষা সংস্কৃতি তখন মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল। মুসলিম সমাজ ছিল বিভিন্ন কুসংস্কারে ভরপুর। সমাজে চলত বিভিন্ন বিজাতীয় কর্মকান্ড। মোটকথা, সাধারণ মানুষ ইসলামের মূল ভাবধারা ছেড়ে আচার-অনুষ্ঠানের দিকে বেশী জড়িয়ে পড়ে। ইসলামের মূল উৎস কুরআন ও হাদিস উপেক্ষা করা হয়। তখন অন্ধ ভাবধারা বিরাজ করতে থাকে। এতে ইসলামের মূল ভাবধারা খর্ব হয়। মুসলিম জাতির তখন এক মুজাদ্দিদের প্রয়োজন ছিল। তিনি সমাজে ধর্মীয় চেতনা ও মৌলিক মূল্যবোধ জাগিয়ে তুলে মুসলিম সমাজে প্রতিষ্ঠা করলেন ইসলামি আদর্শ ও সুন্নতে নব্বী। এ দেশে মুসলিম জাতির এ অভাব পূরণের ঐতিহাসিক প্রয়োজনেই এদেশে আর্বিভাব ঘটে মহান ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব সুফি মুজাদ্দিদ খাজা এনায়েতপুরী (র.)। এ প্রসঙ্গে ড. মো. গোলাম দস্তাগীর-এর বক্তব্য উল্লেখ করা যায়। তিনি বলেন but no one was able to establish a systematic school or monastery in the country until the 20th century when the country produced as ever the most celebrated spiritual leader Khwaja Enayetpuri.

সুফি পেইন্টিং । এঁকেছেন মুাহাম্মদ সুলেমান রেহমান (সাচ্চি আর্ট)

পরম করুণাময় আল্লাহপাক আশরাফুল মাখলুকাত বা সৃষ্ঠির সেরা জীব মানুষকে পৃথিবীতে প্রেরণ করেছেন তাঁর প্রতিনিধিরূপে কতিপয় বিধি নিষেধ দিয়ে। আর মানুষ যাতে আল্লাহর অনুগত থেকে তাঁর আদেশ নিষেধ মেনে চলে সঠিকভাবে চলতে পারে সেজন্য সৃষ্টির শুরু থেকেই বিধান বা ওহীসহ রাসূল বা নবীকে পাঠিয়েছেন যুগে যুগে সকল গোত্রে সকল এলাকায়। কিন্তু এক নবীর শিক্ষা ভুলে গিয়ে মানুষ যখন ভুল পথে, ধ্বংসের পথে, গোমরাহীর পথে পা বাড়িয়েছে ঠিক তখনি আল্লাহপাক অন্য এক নবী প্রেরণ করেছেন আলোকবর্তিকারূপে। আর এভাবেই মানবজাতির শিক্ষা ও সভ্যতার এক চরম পর্যায়ে তথা আইমে জাহেলিয়ার যুগে সমগ্র বিশ্বের রহমতস্বরূপ বিশ্বমানবের আলোকবর্তিকারূপে বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-কে ওহীসহ প্রেরণ করেন। দুনিয়ার সমস্ত জাহেলী ও শিরকবাদী চিন্তা ও সমাজ ব্যবস্থায় বিলুপ্তি ঘটিয়ে একমাত্র আল্লাহ প্রদত্ত ইসলামের সত্য, নির্ভেজাল ও ইনসাফপূর্ণ সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব আল্লাহ তাঁর প্রিয় সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বশেষ নবীর ওপর অর্পণ করেছিলেন। তিনি বিশ্ব মানবতাকে দান করেছেন একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনবিধান। আর এই বিধান হচ্ছে আল্লাহর মানোনীত ইসলাম। তিনি বিশ্ব মানবের সামনে যে শিক্ষার আলো জ্বালিয়ে গেছেন এবং যে আদর্শ প্রতিষ্ঠা করে গেছেন তা-ই ইসলামের প্রকৃত শিক্ষা ও প্রকৃত আদর্শ। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর প্রচারিত ও অনুসৃত মতাদর্শকে বুকে ধারণ করে তাঁর অনুসারীরা এর প্রচার ও প্রসারে নেমে পড়েন। আল্লাহ বলেন: “তোমাদের মধ্যে এমন একটি দল থাকবে যারা মানুষকে কল্যাণের দিকে আহবান করে এবং সৎ কাজের আদেশ করবে এবং অসৎ কাজের নিষেধ করবে ইহারাই সফলকাম”  [সূরা আল-ইমরাণ (৩):১০৪]। এ প্রসঙ্গে হাদিস থেকেও উদ্ধৃতি দেয়া যেতে পারে। হযরত মুহাম্মদ (সা.) বলেছেন ‘আমার পক্ষ থেকে একটি বাণী হলেও তা তোমরা অপরের কাছে পৌঁছে দাও।’ আর ইহাই মুসলমানদেরকে উজ্জীবিত করে দাওয়াও কার্যক্রমে। ইসলামে দাওয়াতী কাজ প্রতিটি মুসলমানের জন্য ফরয বা আবশ্যিক। ইসলামের প্রচার ও প্রসারের লক্ষ্যে হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর যুগে সাহাবীগণ পরবর্তীকালে তাবেয়ী ও তাবে-তাবেয়ীগণ এবং এভাবে পর্যায়ক্রমে মুসলমানদের বিভিন্ন দল বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েন। যার অংশ হিসেবে বাংলাদেশেও একদল সুফি সাধকের আগমন ঘটে।

মোট কথা, শেষ নবীর পূর্ণতাপ্রাপ্ত শিক্ষা ও মতাদর্শকে কিয়ামত পর্যন্ত কার্যকর রাখার জন্য আল্লাহপাক প্রত্যেক শতাব্দীর মাথায় এক একজন ওয়াবাসা তুল আম্বিয়া আলিম, মুজাদ্দিদ মনোনীত করেছেন। তাঁরা নিজেদের ব্যক্তি জীবনকে মডেল করে সমাজের সামনে, মানুষের সামনে উপস্থাপন করেছেন ইসলামের দাওয়া (দাওয়াত) কার্যক্রমে। হিজরীর দশম শতাব্দীর শেষভাগে ৯৭১ হিজরীতে পাক ভারতের মুজাদ্দিদরূপে হযরত শায়খ আহমদ সিরহিন্দি (র.) জন্মগ্রহণ করেন। তিনি মুজাদ্দিদে আলফে-সানী (২য় সহস্রাব্দের সংস্কারক) হিসেবে মুসলিম সমাজে প্রতিষ্ঠিত  হয়েছেন।  তাঁর  চিন্তাধারা  বাংলাদেশ, ভারত  ও পাকিস্তাানে  প্রসার লাভ  করেছে।  তাঁর এই চিন্তাধারা পীর পরম্পরা হয়ে বর্তমান যুগ পযন্ত চলে এসেছে। বাংলাদেশে মুজাদ্দেদিয়া তরিকার ব্যাপক প্রচার ও প্রসার লাভ করে হযরত খাজা এনায়েতপুরীর মাধ্যমে। আজকের যুগের সুফিসাধকদের মধ্যে হযরত খাজা এনায়েতপুরীর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তিনি নক্শেবন্দিয়া-মুজাদ্দেদিয়া তরিকার অসংখ্য কামালাতের অধিকারী এবং যুগের মুজাদ্দেদ হিসেবে খ্যাত। বর্তমানে খাজা এনায়েতপুরীর মাধ্যমে এই তরিকা নক্শেবন্দিয়া-মুজাদ্দেদিয়া তরিকা নামে পশ্চিম বাংলার আসাম এবং বাংলাদেশে ব্যাপকভাবে প্রচার ও প্রসারিত হয়েছে।

খাজা এনায়েতপুরী (র.) কোলকাতায় তাঁর পীরের সান্নিধ্যে থেকে দীর্ঘকাল সাধনার পর ইলমে মারেফত কামালিয়াত হাসিলের পর খেলাফত লাভ করে তাঁর নির্দেশে ইসলাম ও মুসলিম সমাজের খিদমতে নিজের জীবন উৎসর্গ করেন। এ সময়ে তাঁর পীরের নির্দেশ প্রনিধানযোগ্য। তাঁর প্রতি পীরের কঠোর নির্দেশ ছিল, “হেদায়েত বাহির না হওয়া পর্যন্ত তুমি আর শয্য ত্যাগ করতে পারবে না।”  তিনি ছিলেন ইসলামের জন্য নিবেদিত প্রাণ। ইসলামি আদর্শ ও শিক্ষার প্রসার ও প্রচারে অন্ধ বিশ্বাস, কুসংস্কার, শিরক, বিদআত, পর্দা এবং অ-ইসলামি ভাবধারা রীতি-নীতি ও আচার-অনুষ্ঠানের পঙ্কিলতা হতে মুক্ত একটি আদর্শ মুসলিম সমাজ প্রতিষ্ঠা করাই ছিল তাঁর সারাজীবনের একমাত্র সাধনা। এ লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য তিনি সুচিন্তিত কর্মপন্থা অনুসরণ করেন।

ইসলাম প্রচার ও প্রসারে এবং ইসলামি সমাজ প্রতিষ্ঠায় তিনি আল্লাহ ও রাসূলের (সা.) তরিকা এবং এর অনুসৃত পন্থা অনুসরণ করেন। আর লোকদেরকে ঐ মহব্বতে উদ্ধুদ্ধ করার মানসে আপন জীবন উৎসর্গ করেন। সমাজ জীবন হতে অনৈসলামিক ভাবধারা ও রীতি-নীতির মূল উৎপাটনের লক্ষ্যে ব্যাপক প্রচারে আত্মনিয়োগ করেন। আল্লাহর তাওহীদভোলা মানুষদের আল্লাহর যিকরে রাসূলের প্রেম ও আল্লাহর ভয় এবং পাপের অনুশোচনায় ক্রন্দন দীক্ষা দেবার উদ্দেশ্যে হেদায়েতের দাওয়াত নিয়ে বাংলা ও ভারতের আসাম প্রদেশের বহু স্থানে পরিভ্রমন করেন এবং সর্বসাধারণকে আল্লাহর মনোনীত ‘সিরাতুল মুস্তাাকিম’ পথের ও রাসূলের মহব্বতের তরিকার দাওয়াত প্রদান করেন।  বলা বাহুল্য, নতুন রাস্তা, নতুন পরিবেশ, অনাচার, অনিন্দাহসহ তাঁকে বহুবিধ অবর্ণনীয় দুঃখ-কষ্ট ও সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছে। এমন কি অনেক সময় মোনফেক, কাফের ও বেঈমান লোকের অকথ্য নির্যাতন সহ্য করতে হয়েছে, জীবনও বিপন্ন হয়েছে।

রাসূলে করীম (সা.) এর সত্য তরিকার দাওয়াত নিয়ে তিনি দক্ষিণ বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে যথা জামালপুর, ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল, রাজশাহী, ফরিদপুর, সিরাজগঞ্জ, বগুড়া, বৃহত্তর কুমিল্লা ও নোয়াখালী জেলার বিভিন্ন অঞ্চলে ব্যাপকভাবে প্রচার অভিযান পরিচালনা করেন। এ সকল জেলার বিভিন্ন এলাকা ও বিভিন্ন গ্রামে তিনি ব্যাপকভাবে তাঁর তরিকা প্রচার করেন। এতে এদেশের বিভিন্ন জেলার বিভিন্ন এলাকার অসংখ্য লোক তাঁর মুিরদ হন।

প্রতিদিন অসংখ্য লোক তাঁর বায়াত গ্রহণ করতেন। অন্য ধর্মের অনেক লোক ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছেন। কথিত আছে যে, তাঁর হায়াতদশায় প্রায় ২৫ লক্ষাধিক লোক তাঁর বায়াত গ্রহণ করেছিলেন। তাঁর মধ্যে লক্ষ্যধিক লোক অন্য ধর্মাবলম্বীও ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় গ্রহণ করেন। এ প্রসঙ্গে মৌলবী খাজা ছায়েফ উদ্দীনের বক্তব্য উল্লে­খ করা যায়। তিনি আদর্শ মুর্শিদ গ্রন্থে বলেন, ‘হযরত খাজা সাহেবের মৌখিক উপদেশ ও আন্তরিক ফায়েজে এবং পর্দা-পুষিদা, নামাজ, রোজা ইত্যাদি শরিয়তের বাহ্য কর্মে অনুপ্রাণিত হয়ে আজ অগণিত নর-নারী পূর্ণ মুসলমানরূপে গড়ে উঠেছে।’ প্রসঙ্গে তদীয় পীরের বক্তব্য উল্লে­খ করা যায়। একদা সৈয়দ সাহেব জনতাকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন, “ইউনুছের মুরিদ দেশ বিদেশের চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়বে এবং অসংখ্য লোক তাঁর সেলসেলার অন্তর্ভূক্ত হবে।”  আজ অবশ্য তাঁর পীরের বক্তব্য সত্য প্রমাণিত হয়েছে। বর্তমানে ভারত, বৃটেন, আমেরিকা, কানাডা, ফিলিপাইনসহ বিভিন্ন দেশের মুসলিম ও অমুসলিম তাঁর তরিকা গ্রহণ করছেন।

তিনি প্রচার করতেন পূর্ণভাবে শরিয়ত মেনে চলতে। তিনি বলেন, ‘মৃত্যুর পূর্বেই মরে যাও, তাহলে মরে অমর হবে।’ জার্মানীর ভাববাদী দার্শনিক হেগেলও একই কথা বলেছিলেন, ‘বাঁচার জন্য মর’। তিনি আরও প্রচার করতেন, ‘যে ব্যক্তি দুনিয়ার প্রেমিক সে আল্লাহর প্রেমিক নহে। কারণ দুনিয়া এবং আল্লাহকে একসাথে ভালবাসা যায় না।’ শরিয়ত ও তরিকত পন্থায় ইসলামি জীবনযাপনের জন্য তাঁর অনুসারীদের উদ্দেশ্যে তাঁর উপদেশ নিম্নরূপ:

‘কম খাও এবং মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত হও। শুধুমাত্র আল্লাহকে ভয় কর, আল্লাহ ছাড়া কাউকে ভয় কর না। কামেল সুফিদের সান্নিধ্যে থাকার চেষ্টা কর। কারণ আল্লাহকে পেতে হলে অলী আল্লাদের কাছে গমন করা উচিত। চুরি, ডাকাতি, জেনা, খুন করবে না, মিথ্যা কথা বলবে না, হারাম দ্রব্য ভক্ষণ করবে না। হালাল রোজগার কর এবং হালাল খাবার খাও। প্রতিশোধ গ্রহণ না করে ক্ষমাশীল হও। কারণ প্রতিশোধের চেয়ে ক্ষমা শ্রেষ্ঠতম। আল্লাহ ও রাসূলকে মহব্বত কর। নিজেকে ছোট ও মন্দ জান অপরকে বড় ও উত্তম জান। দমে দমে আল্লাহকে স্মরণ কর। এ বিশ্বাসে আল্লাহকে ভুলবে না, কাহারও নিন্দা করবে না। অহংকার ও লোভ হতে সাবধান থাকবে। পরকালের সম্বল সংগ্রহ কর। আল্লাহর ভয়ে ক্রন্দন করতে পারলে দোজখ তাকে স্পর্শ করবে না। কাজেই আল্লাহর ভয়ে ক্রন্দন কর। চোখের পানিতে পাপ ধৌত কর।’

তিনি জনগণের মধ্যে তাঁর তরিকা তথা ইসলামি বিধি বিধানসমূহ প্রচার ও প্রসারের জন্য কতিপয় কর্মসূচী প্রণয়ন করেন, যা বাংলাদেশে মুজাদ্দেদিয়া তরিকা প্রচার ও প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। নিম্নে এই কর্মসূচী সমূহের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা প্রদান করা হল:

১. বিশ্বশান্তি মঞ্জিল (খানকা) প্রতিষ্ঠা

হযরত খাজা এনায়েতপুরী (র.) মুজাদ্দেদিয়া তরিকা প্রচারের প্রধান মাধ্যম হলো খানকা শরীফ প্রতিষ্ঠা। এ খানকা শরীফে শরিয়াতের বিধি বিধান প্রচার করা হয়ে থাকে এবং তরিকার বিভিন্ন বিষয়ে তালিম দেওয়া হয়। এ খানকা ‘বিশ্বশান্তি মঞ্জিল’ নামে পরিচিত। এ খানকা সমাজের ওপর অনেক প্রভাব বিস্তার করে আছে। ফলে এটি তরিকা প্রচারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। প্রতিদিন অসংখ্য ভক্ত-আশেকান, মুসলিম-অমুসলিম, মুরিদ-অমুরিদ এই খানকা শরীফে উপস্থিত হয়ে খাজা এনায়েতপুরীর পবিত্র মাযার জিয়ারত করেন বা তাঁর আদর্শে বিশ্বাসী হয়ে এই তরিকার বায়াত গ্রহণ করছেন।

২. সফরের ভূমিকা         

খাজা এনায়েতপুরী বাংলার বিভিন্ন জনপদে এবং আসামে ১৭বার সফর করেছেন আল্লাহর বাণী সহজ সরলভাবে ভক্তদের কাছে পৌঁছে দিতে। তাঁর সফরের মাধ্যমে দলে দলে মুসলিম অমুসলিম মুজাদ্দেদিয়া তরিকার হিম-শীতল শান্তির পতাকাতলে আল্লাহ আশ্রয় গ্রহণ করেছেন। খাদেমগণ ও বিভিন্ন সময়ে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে সফরে গিয়ে তাঁর তরিকার অমর বাণী প্রচার করেন। এখনও বর্তমান সাজ্জাদানিশিন হযরত খাজা কামাল উদ্দীন (নূহ মিয়া) দিন-রাত অক্লান্ত পরিশ্রম করেন রাসূলে করিম (সা.)-র সত্য তরিকার গৌরবান্বিত পতাকা সমুজ্জ্বল রাখতে। মোজাদ্দেদিয়া তরিকার মিশন নিয়ে তিনি প্রায়ই সফর করেন দেশের ও আসামের প্রত্যন্ত অঞ্চলে। তাছাড়া ময়মনসিংহের শম্ভুগঞ্জের সাজ্জাদানিশিন ও তাঁর সহোদরগণ বছরে অত্যন্ত একবার আসাম সফর করেন। এনায়েতপুর দরবার শরীফের খাদেম, পেশ ইমাম ও মাওলানাগণও বছরে কয়েকবার বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সফর করেন।

৩. তরিকত মিশন

মুজাদ্দেদিয়া তরিকা প্রচারে তাঁর অন্য একটি গুরুত্বপূণ পদক্ষেপ ছিল দেশ বিদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের তরিকত মিশন প্রেরণ। এ ধারা আজও অব্যাহত রয়েছে। তাঁর যোগ্য মুরিদ, খাদেম ও স্থানীয় গণ্যমাণ্য ব্যক্তিবর্গ ও আত্মীয়স্বজনদের সহযোগিতা ও প্রচেষ্টায় বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলা ও আসামের বিভিন্ন অঞ্চলে তরিকত মিশন প্রেরিত হয়েছিল। তাঁরা সাফল্যের সাথে তরিকা প্রচার করেছিলেন। এই মিশনের মাধ্যমে হযরত পীর সাহেবের তরিকা প্রচার খুবই প্রসারিত হয়েছিল। লক্ষ লক্ষ মানুষ তাঁর উদাত্ত আহ্বানে সাড়া দিয়ে তাঁর তরিকায় বায়াত হয়েছেন।

৪. পুস্তিকা প্রণয়ন ও প্রকাশ

খাজা এনায়েতপুরী (র.) এর তরিকা প্রচারের একটা উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ হলো পুস্তক প্রণয়ন ও প্রকাশ। জনসাধারনের মধ্যে ইসলামি আদর্শ ও বিধি-বিধান প্রচারের উদ্দেশ্যে তাঁর কর্মসূচী ছিল বাংলায় পুস্তক প্রকাশ ও তা প্রচার করা। এ উদ্দেশ্যকে বাস্তবায়িত করার জন্য তিনি অভিজ্ঞ মুরিদদেরকে বাংলা ভাষায় বিভিন্ন বই লেখার দায়িত্ব অর্পন করেন। তাঁর নির্দেশে ও পৃষ্ঠপোষকতায় ইসলাম ও তরিকত বিষয়ক অসংখ্যক পুস্তক প্রণীত ও প্রকাশিত হয়েছে। খাজা এনায়েতপুরী শরীয়তের আলো ও গঞ্জে আসরার নামে দু’টি গ্রন্থ রচনা করেন মাওলানা মকিম উদ্দিনের সহযোগিতায়। এসব পুস্তক পাঠ করেও অনেকে তাঁর তরিকায় আত্মনিয়োগ করেছেন। তাঁর দর্শনের উপর প্রচুর গ্রন্থ রচিত ও প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর যোগ্য মুরিদ শাহ সুফি মাওলানা হাসমত উল্লাহ (আটরশির পীর) খাজা এনায়েতপুরীর দর্শনকে ভিত্তি করে সুফিবাদের উপর ২৪ খন্ডের গ্রন্থ রচনা করেছেন, যা নসিহত নামে পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া দৈনিক আল-মুজাদ্দেদ এবং মাসিক মেঘনা নামক দু’টি পত্রিকায় নিয়মিতভাবে মুজাদ্দেদিয়া তরিকার ওপর নিবন্ধ প্রকাশিত হচ্ছে।

৫. গ্রন্থাগার ও গবেষণাকেন্দ্র

মুজাদ্দেদিয়া তরিকা প্রচার ও প্রসারের গ্রন্থাগার বা লাইব্রেরী অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। তিনি এনায়েতপুর দরবার শরীফে একটি লাইব্রেরী প্রতিষ্ঠা করেছেন যা এখন অনেক সমৃদ্ধশালী। এখানে সুফিতত্ত্ব ও ইসলাম ধর্ম বিষয়ক অনেক গ্রন্থ সংরক্ষিত রয়েছে। এই লাইব্রেরীতে খাজা এনায়েতপুরীর (র.) জীবন ও ধর্ম এবং তাঁর প্রচারিত তরিকত সম্পর্কিত অনেক গ্রন্থ সংরক্ষিত রয়েছে। অনেকে এসব গ্রন্থ পাঠ করে তাঁর আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে এখনো তাঁর তরিকায় বায়াত গ্রহণ করছেন।

সম্প্রতি ‘খাজা এনায়েতপুরী সুফিবাদ গবেষণা কেন্দ্র’ নামে একটি আধুনিক গবেষণা কেন্দ্র স্থাপিত হয়েছে, যেখানে দেশ-বিদেশের অসংখ্য মূল্যবান গ্রন্থ পাওয়া যায়। এনায়েতপুর দরবার শরীফ একটি প্রকাশনা সংস্থা হিসেবেও পরিচিত। তরিকতের ওপর প্রচুর বই এখান থেকে প্রকাশিত হয়।

৬. গবেষণার ভূমিকা     

খাজা এনায়েতপুরী মুজাদ্দেদিয়া তরিকার ওপর এখন দেশে বিদেশে গবেষণা হচ্ছে। দেশী-বিদেশী গবেষণামূলক জার্নালে খাজা এনায়েতপুরীর ওপর প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। ২০০৬ সালে লন্ডন থেকে  প্রকাশিত Oliver Leaman সম্পাদিত Biographical Encyclopedia of Islamic Philosophy-তে বাংলাদেশ থেকে খাজা এনায়েতপুরীর ওপর প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। এই বিশ্বকোষে স্থান পাওয়া বাংলাদেশ থেকে তিনিই একমাত্র সুফিসাধক। দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা এম. ফিল এবং পিএইচ.ডি পর্যায়ে এনায়েতপুরীর সুফিবাদ নিয়ে গবেষণা করছেন। কানাডায় টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ে খাজা এনায়েতপুরীর ওপর ডক্টরেট-উত্তর গবেষণা হচ্ছে। ২০০৮ এবং ২০০৯ সালে আমেরিকা ও কানাডা এবং অষ্ট্রেলিয়ায় খাজা এনায়েতপুরীর প্রচারিত মুজাদ্দেদিয়া তরিকার ওপর গবেষণাধর্মী সেমিনার হয়েছে।

৭. গণমাধ্যমের ভূমিকা

বিভিন্ন সময়ে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন ব্যক্তিবর্গ এনায়েতপুর দরবার শরীফে গমন করেছেন। দেশের বরেণ্য ব্যক্তিবর্গ মন্ত্রী, এম.পি, সরকার প্রধান, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, বিশিষ্ট সাংবাদিক, বিদেশী রাষ্ট্রদূত প্রমুখ এনায়েতপুর দরবার শরীফে গমন করে মুজাদ্দেদিয়া তরিকায় বায়াত গ্রহণ করেছেন এবং আজও করছেন। এসব খবর স্বচিত্র প্রতিবেদন পত্র-পত্রিকায়, টেলিভিশন ও ইন্টারনেটে প্রচারিত হয়েছে। ফলে মুজাদ্দেদিয়া তরিকা ব্যাপকভাবে প্রচারিত ও প্রসারিত হয়েছে। কাজেই দেখা যায় যে, বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের উপস্থিতি এবং গণমাধ্যমের ইতিবাচক ভূমিকার কারণেও এদেশে মুজাদ্দেদিয়া তরিকা ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয়েছে। উল্লেখ্য যে, বর্তমানে http://www.enayetpuri.com ওয়েবসাইটে এনায়েতপুরী তরিকা সম্পর্কে   বিস্তারিত জানা যাচ্ছে।  (চলবে)

অধ্যাপক ড. মো. গোলাম দস্তগীর

টরন্টো

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *