বীরদর্পে এসেছিলেন মঞ্চে বিদায় নিলেন মলিন বদনে
এক দশকে জাস্টিন ট্রুডোর সফলতা বনাম ব্যর্থতা
খুরশিদ আলম
জাস্টিন ট্রুডোর বয়স তখন মাত্র চার মাস। সময়টা ছিল ১৯৭২ সাল। অটোয়াতে এক রাষ্ট্রীয় সফরে এসেছিলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন। সফরকালে এক রাষ্ট্রীয় ভোজসভায় মিলিত হয়েছিলেন তখনকার কানাডার প্রধানমন্ত্রী পিয়ের ট্রুডো ও তার পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে। ট্রুডোর সঙ্গে নিক্সনের রাজনৈতিক সম্পর্ক ভালো ছিল না। কিন্তু সেদিন চার বছরের সেই শিশুটিকে দেখে প্রেসিডেন্ট নিক্সন কৌতুকচ্ছলে একটি ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন এই শিশুটি একদিন কানাডার প্রধানমন্ত্রী হবে। ৪৩ বছর পর সেই কৌতুকচ্ছলে বলা ভবিষ্যদ্বাণীটি অক্ষরে অক্ষরে মিলে গিয়েছিল! জাস্টিন ট্রুডো সত্যি সত্যি কানাডার প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। সরকারও গঠন করেছিলেন নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে। এবং তিনিই হয়েছিলেন কানাডার ইতিহাসে প্রথম প্রধানমন্ত্রী যাঁর বাবাও ছিলেন একজন প্রধানমন্ত্রী।
সুদর্শন ও সুঠাম দেহের অধিকারী জাস্টিন ট্রুডো যখন প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন তখন তাঁর বয়স ছিল ৪৩ বছর। কেউ কেউ মজা করে বলেছিলেন সেক্সিয়েস্ট প্রাইম মিনিস্টার অন আর্থ। জন্মেছিলেন বিশেষ একটি দিনে। ২৫ ডিসেম্বর। খ্রিস্টানদের বড় দিন। যিশু খ্রিস্টের জন্মদিন।
জাস্টিন ট্রুডো অল্প বয়সে কানাডার প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন বলে বিশ্ববাসীর নজর কেড়েছিলেন তা নয়। তিনি এমন এক পিতার সন্তান যাঁর নামের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে আধুনিক কানাডার ইতিহাস। কানাডার মাল্টিকালচারালইমজের প্রবক্তা ও প্রতিষ্ঠাতা তিনি।

জাস্টিন ট্রুডো পিয়ের ট্রুডোর বড় ছেলে। জাস্টিনের মায়ের নাম মার্গারেট ট্রুুডো। পিয়ের ট্রুডো মৃত্যুবরণ করেন ২০০০ সালে ২৮ সেপ্টেম্বর। মা মার্গারেট এখনো জীবিত। মার্গারেটও রাজনৈতিক পরিবারেরই মেয়ে। তাঁর জন্ম ভেঙ্গুভারে। বাবা জেমস সিনক্লেয়ার ছিলেন লিবারেল পার্টির এমপি। মৎস্য ও সমুদ্র বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী ছিলেন তিনি। সাইমন ফ্রেসার ইউনিভারসিটিতে ইংরেজি সাহিত্যে লেখাপড়া করেন মারর্গারেট। লেখালেখি, অভিনয়, ফটোগ্রাফি করা ছিল তার শখ। তিনি টিভি টক শো’র হোস্টও ছিলেন। (তথ্য সূত্র: অনলাইন ও উইকিপিডিয়া)
জাস্টিন ট্রুডো প্রেমিক পুরুষ হিসেবেও ছিলেন একজন সফল ব্যক্তি। প্রেম করেই বিয়ে করেছিলেন। প্রেমিকার নাম সোফি গ্রেগওয়ার। জন্ম ১৯৭৫ সালের ২৪ এপ্রিল। সোফিকে জাস্টিন চিনতেন সেই শৈশব থেকেই। ২০০৪ সালের অক্টোবরে এঙ্গেজমেন্ট এবং ২০০৫ সালের মে মাসে বিয়ে। কিন্তু জাস্টিন ট্রুডো প্রেমে সফল হলেও সংসার জীবনের সফলতা দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। বিয়ের ১৮ বছর পর ২০২৩ সালের আগস্ট মাসে তাঁদের সেপারেশন হয়ে যায়। তাঁদের সেপারেশনের সংবাদ শুনে সেই সময় গোটা কানাডার মানুষ বিস্ময়াভিভূত হয়ে গিয়েছিলেন। কেউ ভাবতেও পারেননি এরকম একটি সংবাদ তাঁদের শুনতে হবে। বিভিন্ন সময় তাঁদের যুগল ছবি দেখে মনে হতো সুখের স্বর্গলোকে বাস করছেন তাঁরা।
কিন্তু সুখের সেই স্বর্গলোকে হঠাৎ আগুন ধরিয়ে দিল কে? অথবা কি এমন ঘটনা ঘটলো যে তাঁদেরকে আলাদা হয়ে যেতে হবে? সবার মুখে মুখে ছিল এই একই প্রশ্ন। কিন্তু কোন উত্তর ছিল না। কেউ জানতে পারেননি কি এমন ঘটনা ঘটেছিল যার কারণে তাঁদেরকে আলাদা হয়ে যেতে হয়েছিল। তবে সেপারেশনের ঘোষণা আসার পরপরই পরকীয়ার একটি গুজব সামনে চলে এসেছিল। গুজবটি ছিলো, কানাডার পররাষ্ট্র মন্ত্রী মেলানিয়া জোলির সঙ্গে জাস্টিন ট্রুডোর পরকীয়া সম্পর্ক রয়েছে। আর সে কারণেই ট্রুডোর কাছ থেকে সোফি দূরে সরে গেছেন।
গুজবের শাখাপ্রশাখা আরো বেশী করে গজিয়েছিল এই কারণে যে, জাস্টিন ট্রুডো বা সোফি গ্রেগোয়ার কেউই স্পষ্ট করে কিছুই বলেননি কেন তাঁরা সেপারেশনে গিয়েছেন। তাঁদের সেপারেশনের খবরটি প্রথমে প্রকাশ পায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ইনস্টাগ্রামে। তাঁরা তাঁদের নিজ নিজ ইনস্টাগ্রাম পেজে সেপারেশনের অভিন্ন তথ্যটি প্রকাশ করেছিলেন। সেখানে তাঁরা বলেছিলেন, ‘সবার অবগতির জন্য জানাচ্ছি যে, অনেক অর্থবহ, খোলামেলা ও দুরূহ আলোচনার পর আমরা আলাদা হয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তবে সবসময়ের মত আমরা পরস্পরকে গভীরভাবে ভালবাসবো এবং একে অপরের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করবো। এবং আমরা ঘনিষ্ঠ পরিবার হিসাবেই থাকবো। আমরা উভয়ে এ যাবৎকাল যা কিছু গড়ে তুলেছি এবং আগামীতে যা কিছু গড়ব তার প্রতি আমাদের শ্রদ্ধাবোধ বজায় থাকবে। আর আপনাদের সবার প্রতি অনুরোধ, আমাদের সন্তানদের মঙ্গলের কথা ভেবে আপনারা আমাদের এবং তাদের ব্যক্তিগত গোপনীয়তার প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকবেন।’
হ্যাঁ, শ্রদ্ধাশীল থেকেছেন সবাই। এ নিয়ে কোন মিডিয়াও আর গসিপ করেনি। গসিপ করতে দেখা যায়নি কাউকে সোশ্যাল মিডিয়াতেও।
তবে সংসার জীবনের প্রায় মধ্যগগনে এসে ট্রুডোকে যে ভাবে ইউটার্ন নিতে হলো, তেমনি ইউটার্ন নিতে হলো তার রাজনৈতিক জীবনের গতিপথেও। তিনি রাজনীতির মঞ্চে এসেছিলেন বীরদর্পে, উজ্জ্বল নক্ষত্রের মত। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে একটি দশক পার হওয়ার আগেই তাঁকে বিদায় নিতে হলো মলিন বদনে।
তবে রাজনীতির মঞ্চে বিশেষ করে সরকার বা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় এক দশক টিকে থাকাটা কোন কম কথা নয়। এটি বড় এক অর্জন এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়। কারণ দেখা গেছে অনেক রাজনৈতিক নেতা ক্ষমতায় এক টার্মের বেশি টিকতে পারেন না। সেক্ষেত্রে জাস্টিন ট্রুডো পরপর তিনবারের নির্বাচনে জয়ী হয়েছিলেন। কিন্তু তৃতীয় মেয়াদ পূর্ণ করার আগেই তাঁকে পদত্যাগ করতে হলো। তবে ট্রাজেডিটা হলো, তাঁর নিজ দলের এমপিরাই শেষ পর্যন্ত বিদ্রোহ করে তাঁকে ক্ষমতা থেকে সরে যেতে বাধ্য করেছেন। এই বিদ্রোহে শেষ পেরেকটি মেরেছিলেন তাঁরই অতি বিশ^স্ত ও নির্ভরযোগ্য উপ প্রধানমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রী ক্রিস্টিয়া ফ্রিল্যান্ড। তিনি শেষের দিকে এসে জাস্টিনের মন্ত্রীসভা থেকে পদত্যাগ করে বসেন।
যখন দলের ভিতর জাস্টিন ট্রুডোর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ক্রমশ দানা বেধে উঠছিল তখন এবং প্রায় শেষের দিক পর্যন্ত এসেও ক্রিস্টিয়া ফ্রিল্যান্ড জাস্টিনকে সমর্থন দিয়ে আসছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেই সমর্থন আর থাকেনি। ফ্রিল্যান্ড পদত্যাগ করে যে চিঠি লেখেন, তাতে অভিযোগ করা হয়, ট্রুডো দেশের জন্য ভালো কিছু করার দিকে মনোযোগ না দিয়ে ‘রাজনৈতিক ছলচাতুরী’র আশ্রয় নিচ্ছেন।
দলের ভিতর জাস্টিন ট্রুডোর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ সৃষ্টি হওয়ার অন্যতম কারণ ছিল শেষের দিকে খোদ জনগণের মধ্যেই তাঁর জনপ্রিয়তায় ধ্বস নামার পরও তিনি বিষয়টিকে গুরুত্ব দিচ্ছিলেন না। বরং বলে বেড়াচ্ছিলেন তিনি সঠিক পথেই আছেন। ২০২৩ সালের অক্টোবরে প্রকাশিত এক জরিপে দেখা গেছে, কানাডিয়ানরা মনে করছেন, ট্রুডো হলেন গত ৫৫ বছরের মধ্যে দেশের সবচেয়ে কম পছন্দের প্রধানমন্ত্রী। রিসার্চ কো. নামের একটি প্রতিষ্ঠানের জনমত জরিপে এমনটাই জানা গিয়েছিল।
তবে ঐ সময় জরিপ রিপোর্ট যাই বলুক, ট্রুডোর দাবি ছিল তিনি দেশটিকে সঠিক পথেই এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। যদিও তার দলের ভিতরই কেউ কেউ তখন বলছিলেন এখন সময় এসেছে তাঁর সরে দাঁড়ানোর। এদের মধ্যে কয়েকজন দলীয় এমপিও আছেন। কিন্তু ট্রুডোর সাফ কথা ছিল, তিনি নিজে নিজে ক্ষমতা থেকে সরে দাঁড়াবেন না।
তাঁর এই অহংকারী অবস্থান তাঁর পতনের পথ আরো ত্বরান্বিত করে তুলেছিল। তাঁর বিরোধিতাকারী এমপিদের সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলছিল। অন্যদিকে প্রধান বিরোধী দল পিয়ের পলিয়েভ নেতৃত্বাধীন কনজারভেটিভ পার্টির জনপ্রিয়তা ক্রমান্বয়ে বেড়েই চলছিল। কয়েকমাস আগে বিভিন্ন জরিপ বলছিল, ঐ সময়ে যদি কানাডার জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতো তবে লিবারেল পার্টির প্রধান ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর ভরাডুবি ঘটতো। আর বিপুল ভোটে জয়ী হতেন প্রধান বিরোধী দল কনজার্ভেটিভ পার্টির প্রধান ও বিরোধী দলীয় নেতা পিয়েরে পোইলিয়েভ। নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে সরকার গঠন করতে পারতেন তিনি।
অন্যদিকে The Leger poll এর সাম্প্রতিক এক জরিপের বরাত দিয়ে গত ১৫ নভেম্বর দি কানাডিয়ান প্রেস জানিয়েছিল ঐ সময় প্রায় প্রতি তিনজন কানাডিয়ানের মধ্যে দু’জনই জাস্টিন ট্রুডোর প্রতি নেতিবাচক ধারণা পোষণ করছিলেন এবং অর্ধেক কানাডিয়ানই চাচ্ছিলেন পরবর্তী নির্বাচনের আগে তিনি পদত্যাগ করুক।
বিশেষজ্ঞরা বলছিলেন, ট্রুডো ও তাঁর সরকারের প্রতি জনগণের ব্যাপক অসন্তোষের অন্যতম কারণগুলোর মধ্যে ছিল বাড়ির মূল্য ও ভাড়া আকাশচুম্বী হওয়া, দ্রব্যমূল্যের দাম বেড়ে যাওয়া, স্বাস্থ্য সেবা যথাযথভাবে না পাওয়া ইত্যাদি। আরো ছিল লিবারেল সরকারের ইমিগ্রেশন পলিসি।
শেষ পর্যন্ত জাস্টিন ট্রুডো ক্ষমতা থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দিতে বাধ্য হয়েছিলেন। বলেছিলেন লিবারেল পার্টির নতুন নেতা নির্বাচিত হওয়ার পর তিনি দলীয় প্রধান এবং প্রধানন্ত্রীর পদ দুটোই ছাড়বেন।
এর পর গত ৯ মার্চ ২০২৫ তারিখে লিবারেল পার্টি অফ কানাডার দলীয় সদস্যদের বিপুল সমর্থন পেয়ে দলটির নতুন নেতা নির্বাচিত হন মার্ক কার্নি। তিনি ভোট পান ৮৫%। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ক্রিস্টিনা ফ্রিল্যান্ডসহ অন্যান্য প্রার্থীরা ভোটে পিছিয়ে ছিলেন ব্যাপকভাবে। মার্ক কার্নির ধারে কাছেও ছিলেন না কেউ। তিনি ফ্রন্টরানার ছিলেন। তবে তার সমর্থকরাও ভাবেননি এরকম বিশাল জয় পাবেন তিনি।
দলীয় প্রধান নির্বাচিত হওয়ার পর ব্যাংক অব কানাডা এবং ব্যাংক অব ইংল্যান্ডের প্রাক্তন গভর্নর মার্ক কার্নি গত শুক্রবার ১৪ মার্চ আনুষ্ঠানিকভাবে জাস্টিন ট্রুডোর কাছ থেকে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এর আগে ঐদিনই সকালে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করেন জাস্টিন ট্রুডো। আর তার মধ্য দিয়ে অবসান ঘটে জাস্টিনের প্রায় এক দশকের শাসনামল।
জাস্টিন ট্রুডো পদত্যাগের ঘোষণা দেওয়ার পর যে বিষয়টি খুব লক্ষণীয় হয়ে উঠেছে তা হলো লিবারেল পার্টির জনপ্রিয়তায় সুবাতাসের ছোঁয়া লাগা। বিশেষ করে মঞ্চে মার্ক কার্নির আবির্ভাবের পর লিবারেল পার্টি তার জনপ্রিয়তা আবার ফিরে পেতে শুরু করেছে। বলা যায় হু হু করেই বাড়ছে মার্ক কার্নি ও লিবারেল পার্টির জনপ্রিয়তা।
গত ২৫ মার্চ সিবিসি নিউজের পুল ট্রাকার (বিভিন্ন জরিপের গড় হিসাব) এর ফলাফলে দেখা গেছে এই মুহূর্তে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে মার্ক কার্নির নেতৃত্বাধিন লিবারেল পার্টি আসন পাবে ১৮৩টি। ১৭২টি আসন পেলেই সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেতে পারে যে কোনো দল। আর পেয়ের পলিয়েভ এর নেতৃত্বাধীন কনজারভেটিভ পার্টি আসন পাবে ১৩০টি।
রাজনীতি আসলে বড়ই বিচিত্র জিনিস। আজ যিনি রাজা কাল তিনি হয়ে যেতে পারেন প্রজা। আবার আজ যিনি প্রজা তিনিও কাল হয়ে যেতে পারে রাজা। জাস্টিন ট্রুডো আর মার্ক কার্নির বিষয়টা ঐরকমই হয়েছে। একেবারেই দৃশ্যপটে ছিলেন না এমন একজন ব্যক্তি মার্ক কার্নি প্রায় রাতারাতি হয়ে গেলেন দেশের প্রধানমন্ত্রী আর দীর্ঘ প্রায় দশ বছর প্রধানমন্ত্রী থেকে জাস্টিন ট্রুডো প্রায় রাতারাতিই হয়ে গেলেন প্রজা।
গত ১৭ মার্চ কানাডিয়ান টায়ারের একটি স্টোরে দিন কয়েক আগের প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোকে শপিং করতে দেখা গেছে একটি ট্রলি নিয়ে। তিনি নিজেই এই ছবি পোস্ট করেছেন সোশ্যাল মিডিয়াতে। সেখানে তিনি নিজেকে উপস্থাপন করেছেন একেবারেই একজন সাধারণ নাগরিক হিসাবে।
সন্দেহ নেই জাস্টিন ট্রুডো শুরুতে যে বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবন শুরু করেছিলেন, সেটা তিনি শেষ পর্যন্ত রক্ষা করতে পারেননি। তবে এই ব্যর্থতার মাঝেও তার রয়েছে কিছু সাফল্যে ইতিহাস।
কানাডার রাজনীতিবিষয়ক সাংবাদিক এবং ‘জাস্টিন ট্রুডো অন দ্য রোপস’-এর লেখক পল ওয়েলস ইতিপূর্বে বিবিসিকে বলেছিলেন, তিনি বিশ্বাস করেন ‘একজন ফলপ্রসূ’ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ট্রুডো স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। বিশেষ করে আদিবাসীদের মধ্যে সম্পর্কোন্নয়ন, জলবায়ু নীতিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে তিনি যে নেতৃত্ব দিয়েছেন, সে জন্য তাঁকে স্মরণ করা হবে। কিন্তু তিনি আবার এমন একজন মানুষও, যিনি ক্রমশ জনমত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিলেন এবং পরিবর্তিত সময়ের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে পারছিলেন না।
স্মরণ করা যেতে পারে যে, প্রথমবার জাতীয় নির্বাচনে জাস্টিন ট্রুডোর বিস্ময়কর বিজয়ের পর কানাডাসহ বিশ্ব মিডিয়ায় তাকে নিয়ে ব্যাপক সাড়া পড়ে গিয়েছিল। কানাডার টপ ক্যাটাগরির নিউজ মিডিয়া কানাডিয়ান প্রেস, ম্যাকলিন ম্যাগাজিনসহ দেশের বেশ কয়েকটি মিডিয়া প্রতিষ্ঠান তাকে নিউজমেকার অব দ্যা ইয়ার হিসাবে ঘোষণা করেছিল। লিবারেল সমর্থকদের মধ্যে তখন প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর জনপ্রিয়তা বা সমর্থন বাস্তবিক অর্থে ছিল আকাশচুম্বী। ফোরাম রিসার্চের হিসাব অনুযায়ী লিবারেল দলের সমর্থকদের মধ্যে তার জনপ্রিয়তা ৯০%। কিন্তু EKOS এর জরিপে দেখা গিয়েছিল এই জনপ্রিয়তা আরো বেশী। শতকরা ৯৮ ভাগ।
জাস্টিন ট্রুডোর এই উত্তেজনাপূর্ণ বিজয় তাকে এনে দিয়েছিল আরো কিছু খ্যাতি। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে অবস্থিত বিভিন্ন নিউজ মিডিয়ার সম্পাদক ও ডিরেক্টরদের কাছে তিনি হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন আকর্ষণীয় এক ব্যক্তিত্ব। এ কথা বলেছিলেন কানাডিয়ান প্রেস এর তৎকালীন প্রধান সম্পাদক স্টিফেন মুরিস।
নির্বাচনের জয় পরাজয় সবসময়ই বড় মাপের সংবাদ হয়ে থাকে। কিন্তু জাস্টিন ট্রুডোর জয় ছিল ঐতিহাসিক এবং এই বিজয় তাকে অনেক নিউজ মিডিয়া কর্মীদের কাছে আলাদা চরিত্র হিসাবে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল। আন্তর্জাতিক মহলেও তার উচ্চ প্রশংসাধ্বনি উচ্চারিত হচ্ছিল সেই সময়। নির্বাচনে জয়ী হয়ে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণের পরপরই জাস্টিন ট্রুডো কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যোগ দেন এবং ঐ সম্মেলনগুলোতে তিনি ছিলেন সকলের মধ্যমণি। সিরিয়ার রিফিউজিদের গ্রহণ করেও তিনি আন্তর্জাতিক মহলে প্রচুর সম্মান লাভ করেন। এ সমস্ত কিছু মিলিয়ে তিনি ২০১৫ সালে নিউজমেকার অব দ্যা ইয়ার নির্বাচিত হন কানাডায়।
শুধু রাজনৈতিকভাবেই যে জাস্টিন ট্রুডো কানাডা ও অন্যান্য দেশের গণমাধ্যমের নজর কেড়েছেন তা নয়। তার ব্যক্তি ইমেজ ও সুদর্শন অবয়বও নজর কেড়েছে অনেকের। আমেরিকার খ্যাতিমান ও জনপ্রিয় ম্যাগাজিন ভোগ এর কভার ম্যান হিসাবেও এসেছেন তিনি। ভোগ ম্যাগাজিনের কভারে সাধারণত মুভি স্টার বা ফ্যাশন স্টারদেরকে আনা হয়। কিন্তু জাস্টিন ট্রুডোর বেলা সেই রীতি ভঙ্গ করা হয়েছিল। ভোগ ম্যাগাজিনে জাস্টিন ট্রুডোকে তারুণ্যে ভরপুর ও আশাবাদী এক নেতা হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছিল।
উল্লেখ্য যে, করোনাকালে কানাডীয়দের সেবায় এবং অর্থনীতিকে নিজের পায়ে দাঁড় করানোর ক্ষেত্রে জাস্টিন ট্রুডোকে কানাডার সেরা নেতা হিসাবে বিবেচনা করা হয়েছিল। তাছাড়া জরিপে ভোটাররা ট্রুডোকে বেশ বড় ব্যবধানে অন্যতম দৃঢ়সংকল্প, বুদ্ধিদীপ্ত ও ক্যারিশম্যাটিক নেতা এবং সবচেয়ে সেরা যোগাযোগকারী ব্যক্তিত্ব হিসেবে বর্ণনা করেছিলেন। তাকে দেখা হচ্ছিল অন্যতম যত্নশীল এবং দরদি মানুষ হিসেবে।
কানাডার জনগণ চান রাজনীতিতে স্বচ্ছতা ও অবারিত দ্বার। ট্রুডো কানাডার রাজনীতিতে সেই বিষয়গুলোই আনার চেষ্টা করছেন। কিন্তু সাবেক প্রধানমন্ত্রী স্টিফেন হারপার করেছিলেন ঠিক তার উল্টোটি। জনগণ এমনকি পার্টির লোকদের কাছেও তিনি স্বচ্ছ ছিলেন না। গোপনদ্বার বৈঠকে তিনি সিদ্ধান্ত নিতে ও চাপিয়ে দিতে ভালবাসতেন।
জাস্টিন ট্রুডো ক্ষমতায় আসার পর প্রথম দিকে যে ভাবে সরকার পরিচালনা করে আসছিলেন তাতে সাধারণ মানুষ ছিল সন্তুষ্ট। কানাডার জরীপ প্রতিষ্ঠানের EKOS Research Associates এর প্রেসিডেন্ট ফ্রেঙ্ক গ্র্যাভিস এবং Abacus Data’র প্রধান নির্বাহী ডেভিড কলেটো ডেভিড কলেটো দুজনেই এই ব্যাপারে একমত প্রকাশ করেছিলেন। গ্র্যাভিস বলেন, একটি সাহসী ও সপ্রতিভ এবং সক্রিয় সরকার ব্যবস্থা গড়ে তোলার ব্যাপারে জাস্টিন ট্রুডোকে মনে হচ্ছে একজন চ্যাম্পিয়ন ব্যক্তিত্ব। তিনি সরকার ব্যবস্থায় অধিকতর স্বচ্ছতা এনেছেন। জনগণ আগের সরকারের তিরিক্ষি ও অভদ্র আচরণে পরিশ্রান্ত।
স্মরণ করা যেতে পারে যে, প্রথম এক বছরের মধ্যে জাস্টিন ট্রুডো আলোচিত বেশ কয়েকটি প্রতিশ্রুতিই রক্ষা করেছিলেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য প্রতিশ্রুতিগুলো ছিল :-
-মন্ত্রী পরিষদে আগের তুলনায় অধিক সংখ্যক মহিলার অন্তর্ভুক্তকরণ। যার ফলে প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী সেই সময় সমান সংখ্যক পুরুষ ও মহিলা মন্ত্রী ছিল ট্রুডোর মন্ত্রীসভায়।
– যাদের বাৎসরিক আয় ৪৫,২৮২ থেকে ৯০,৫৬৩ ডলারের মধ্যে তাদের জন্য ইনকাম টেক্স রেট নির্ধারণ করা হয়েছিল ২০.৫% যা আগে ছিল ২২%।
– যাদের বাৎসরিক আয় বছরে ২০০,০০০ ডলারের বেশি তাদের জন্য নতুন ৩৩% টেক্স নির্ধারণ।
-অধিকতর উদার নতুন চাইল্ড বেনিফিট।
-নির্দলীয় এবং মেধার ভিত্তিতে সিনেট মেম্বার মনোনয়নের জন্য একটি নিরপেক্ষ অ্যাডভাইজরি বোর্ড গঠন করা।
-ওল্ড এজ সিকিউরিটি এ্যান্ড গ্যারান্টিড ইনকাম সাপ্লিমেন্ট পাওয়ার জন্য বয়স ৬৭ থেকে কমিয়ে আবার ৬৫ এ করা।
-২৫ হাজার সিরিয়ান রিফিউজিকে কানাডায় স্বাগতম জানানো।
– স্টুডেন্ট গ্র্যান্ট ৫০% বৃদ্ধি করা।
-এমপ¬য়মেন্ট ইন্স্যুরেন্স এ ক্লেইম করার আগের যে ওয়েটিং টাইম তা কমানোর জন্য আইন পুনর্গঠন করা, ইআই এর জন্য যোগ্য হতে হলে মোট কর্মঘণ্টায় পরিমাণ কমিয়ে আনা।
– সাবেক কনজার্ভেটিভ সরকার কর্তৃক করে যাওয়া দ্বৈত নাগরিকদের নাগরিকত্ব বাতিলের আইন রদ করা। ( সূত্র : কানাডিয়ান প্রেস।)
দ্বৈত নাগরিকদের নাগরিকত্ব বাতিলের আইন রদ করার পাশাপাশি ইমিগ্রেশন সংক্রান্ত আরো যে সব আইন রদ করা হয়েছে তার মধ্যে আছে –
– প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে যারা কানাডিয়ান সিটিজেনশীপের জন্য আবেদন করবেন তাদেরকে এই মর্মে কোন ঘোষণা দিতে হবে না যে, সিটিজেনশীপ পাওয়ার পর তারা কানাডায় অব্যাহতভাবে বাস করবেন।
– সাবেক কনজার্ভেটিভ সরকার আইন করে গিয়েছিল কানাডার নাগরিকত্ব লাভ করতে হলে ইমিগ্রেন্টদেরকে ৬ বছরের মধ্যে কমপক্ষে ৪ বছর কানাডায় বাস করতে হবে। লিবারেল সরকার এখন নিয়ম করেছে ৫ বছরের মধ্যে কমপক্ষে ৩ বছর কানাডায় বাস করতে হবে সিটিজেনশীপের জন্য আবেদন করার আগে।
সাবেক কনজার্ভেটিভ সরকার যেখানে এথনিক কমিউনিটিকে কোণঠাসা করে রেখেছিল সেখানে জাস্টিন ট্রুডো ক্ষমতায় এসে এথনিক কমিউনিটি থেকে নির্বাচিত বেশ কয়েকজন এমপি’কে ঠাঁই দিয়েছেন তার মন্ত্রী সভায়। শুধু ঠাঁই নয়, এদের কেউ কেউ পেয়েছেন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব।
বিগত কনজার্ভেটিভ সরকার কানাডার রাজনীতিসহ প্রায় সব ক্ষেত্রেই একটা রক্ষণশীলতার সংস্কৃতি গড়ে তুলেছিল। এর মধ্যে অন্যতম ছিল ইমিগ্রেশন নীতি। কনজার্ভেটিভ পার্টির নেতৃত্বেই ইমগ্রেন্টবান্ধব নয় এমন আইন পাশ হয়েছিল যে আইনে দ্বৈত নাগরিকদেরকে দেশ থেকে বহিষ্কার করার বিধান রাখা হয়েছিল। এর বিরুদ্ধে কোনো আপিলের সুযোগও রাখা হয়নি তখন। অথচ যে অপরাধসমূহের দোহাই দিয়ে এই আইন করা হয়েছিল সেই অরাধসমূহের বিচার করার জন্য দেশটির প্রচলিত আইনই যথেষ্ট ছিল। কানাডার আইন বিশেষজ্ঞরাই তখন বলছিলেন, দেশ থেকে বহিষ্কারের আইনটি মধ্যযুগীয় প্রথা যা আধুনিক গণতান্ত্রিক দেশে একেবারেই বেমানান এবং মানবাধিকার পরিপন্থি। এটি সংবিধানও লঙ্ঘন করেছে।
দ্বৈত নাগরিকদের নাগরিকত্ব বাতিলের এই আইনটি বিগত সরকার করেছিল প্রধানত ভোটের রাজনীতির কারণে। মধ্যপ্রাচ্যে জঙ্গীবাদের প্রসার, কানাডায় জঙ্গীদের কয়েকটি হামলা ইত্যাদির কারণে এখানে সাধারণ মানুষের মধ্যে এক ধরনের ভীতি বা ইসলামোফোবিয়া তৈরি হয়েছিল তাতে সন্দেহ নেই। আর এটাকে কাজে লাগিয়েই বিগত সরকার চেয়েছিল নতুন একটা আইন করে জনগণের মধ্যে দলের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি করতে। তাছাড়া বিগত কনজার্ভেটিভ সরকারের প্রধান স্টিফেন হারপার নিজেও একজন ইসলাম বিদ্বেষী ছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এরকম অভিযোগ একজন কানাডিয়ান আইনজীবীই তুলেছিলেন সরাসরি। তার নাম ড্যানিস এ্যাডনি। তিনি বলেন, “স্টিফেন হারপার একজন মুসলিম বিদ্বেষী ধর্মান্ধ ব্যক্তি।” তিনি দাবি করেন, হারপার যে মুসলিম বিদ্বেষী তা প্রমাণ করার যথেষ্ট প্রমানাদিও রয়েছে তার কাছে। ড্যানিস এ্যাডনি গুয়ান্তনামার বন্দি কানাডিয়ান নাগরিক ওমর খাদারের কেসটি নিয়ে লড়েছেন।
স্টিফেন হারপার ও তার কিছু মন্ত্রী মিলে সেদিন আরো কিছু আইন প্রবর্তনের চেষ্টা
করেছিল যা ছিল কানাডার রাজনীতিতে রক্ষণশীলতাকে আরো জেঁকে বসানোর প্রচেষ্টা। নিকাব ইস্যু, বার্বারিক কালচার ইস্যু ইত্যাদিকে কাজে লাগিয়ে একটা সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের পরিস্থিতি সৃষ্টির পাঁয়তারা ছিল তাদের কর্মকাণ্ডে। কিন্তু কানাডার জনগণ সেই ফাঁদে পা দেয়নি। তারা সম্প্রীতির পক্ষেই রায় দিয়েছেন। আর এর কৃতিত্ব জাস্টিন ট্রুডোরই। তিনি ও তাঁর দল মুসলিমসহ অন্যান্য এথনিক সম্প্রদায়কে কাছে টেনে নেন।
ইউনিভার্সিটি অব ব্রিটিশ কলম্বিয়ার সেন্টার ফর দ্যা স্টাডি অব ডেমোক্রেটিক ইন্সটিটিউশন এর পরিচালক ম্যাক্স ক্যামেরুন ইতিপূর্বে বলেছিলেন, “জাস্টিন ট্রুডো দেশের জন্য তাঁর কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে যে আবেগ ও ভালবাসা প্রদর্শন করছেন তা ছলনাহীন এবং আন্তরিকতাপূর্ণ।”
সুতরাং এ কথা বলাই চলে যে, শেষদিকে এসে নানান কারণে জাস্টিন ট্রুডোর জনপ্রিয়তায় ধস নামলেও ইতিহাস তাকে মনে রাখবে তার বেশ কিছু ইতিবাচক কর্মকাণ্ডের জন্য যা কানাডার জনগণের জন্য কল্যাণ বয়ে এনেছে।
খুরশিদ আলম
সম্পাদক ও প্রকাশক
প্রবাসী কণ্ঠ